নোট বন্দী রাস্তার বিক্রেতা এবং ছোট দোকানগুলোকে ভালো মাত্রায় আঘাত দিয়েছে, কেননা, ক্রমেই বেশি বেশি মানুষ সব্জি ইত্যাদি সুপারমার্কেট বা অনলাইন দোকানগুলো থেকে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন যেখানে ডিজিটাল/কার্ডের মাধ্যমে দাম মেটানোর ব্যবস্থা রয়েছে। এই সম্ভাবনাই যথেষ্ট রয়েছে যে, নগদহীন অর্থনীতিতে প্ল্যাস্টিক মানি থাকা ধনী ব্যক্তিরা সব্জি ইত্যাদি রাস্তার স্টলগুলোর চেয়ে আম্বানির রিলায়েন্স ফ্রেস বা বিয়ানির বিগ বাজার থেকেই কিনতে পছন্দ করবেন।
প্রধানমন্ত্রী মোদী যেমন তাদের করতে বলছেন, রাস্তার বিক্রেতারা কি পেটিএম বা ইপিআই অ্যাপ-এর মতো আইএমপিএস, মোবাইল ওয়ালেট ব্যবহার করতে পারেন না?
- পেটিএম-এর মতো মোবাইল ওয়ালেট তার ওয়ালেট থেকে ব্যক্তির নিজের টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানোর জন্য একটা চার্জ নেয় এবং তা এই উদ্দেশ্যে যে, পেটিএম-এর মাধ্যমে জমা হওয়া টাকা যেন পেটিএম-এর মাধ্যমেই খরচ করা হয়। ছোট ছোট বিক্রেতাদের কাছ থেকে যেটা এক অন্যায্য অর্থ আদায়-ই হবে।
- এই অ্যাপ এবং ই-ওয়ালেটগুলো নিজেদের খেয়ালখুশি মাফিক লেনদেন ফি আদায় করতে ও বাড়াতে পারে। আজ যদি সেটা শূন্য শতাংশ বা ১ শতাংশ হয়, আগামী দিনগুলোতে তারা সেটা বেশি হারে নিয়ে যেতে পারে। মূলগতভাবে 'নগদহীন অর্থনীতি' দরিদ্র জনগণ এবং তাদের কষ্টার্জিত অর্থের মাঝে বিভিন্ন কর্পোরেট দালাল খাড়া করে : প্রতি কাপ চা বিক্রির জন্য, প্রতি দফা সব্জি বিক্রির জন্য, প্রতিটি লেনদেনের জন্য ওরা মুনাফা করে।
- এক নিরক্ষর মহিলা ৮ নভেম্বরের আগে সফল রাস্তার বিক্রেতা হতে পারতেন। এখন এমনকি সব্জি বিক্রির জন্য তার প্রয়োজন : (ক) একটা স্মার্ট ফোন, (খ) একটি ডাটা-প্যাক, (গ) ইন্টারনেট, (ঘ) ফোনে চার্জ দেওয়ার জন্য হাতের কাছে থাকা বিদ্যুৎ, (ঙ) নানান অ্যাপস, (চ) স্মার্ট ফোন, ডাটা প্যাক, অ্যাপস ব্যবহারের জ্ঞান, (ছ) ইংরাজি/হিন্দি ইত্যাদি পড়া/লেখার কাজ চলা গোছের জ্ঞান, (জ) সেল ফোনে সংখ্যা পড়া ও টাইপ করার সামর্থ্য এবং (ঝ) প্রতিটি খরিদ্দারের ক্ষেত্রে এই সমস্ত করার সময়!
- প্রধানমন্ত্রী নিজেকে চা-ওয়ালা রূপে জাহির করে চলেছেন। রাস্তার বিক্রেতাদের অধিকারের পক্ষে যিনি প্রচার করে থাকেন সেই বিনয় শ্রীনিভাসা লিখছেন : “একটা চায়ের দোকানের মালিকের কথা কল্পনা করুন। প্রতি কাপ চা বিক্রির ক্ষেত্রে অনলাইনে দাম নেওয়ার জন্য ঐ বিক্রিটা ঠিক হল কিনা তাদের সুনিশ্চিত হতে হবে এবং তার জন্য আধ মিনিট থেকে এক মিনিট সময় ব্যয় করতে হবে, যেখানে আগে নগদে একটা বিক্রির জন্য কয়েক সেকেন্ড হলেই চলত! আর যদি এমনটা ঘটে যে খরিদ্দার বলছেন তিনি দাম দিয়েছেন অথচ দোকানদার তার ফোনে দাম মেটানোর ব্যাপারটা দেখতে পাচ্ছেন না -- বেশ কয়েকটি স্থানে যেটা ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে -- সেক্ষেত্রে জোর তর্কাতর্কি শুরু হবে এবং ফোন থেকে দাম পাওয়ার ব্যাপারটি সম্পর্কে সুনিশ্চিত হতে দীর্ঘ সময় লাগবে -- যে সময়টা বিক্রেতাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বিক্রেতা প্রায়শই তাদের ফোন নম্বর পাল্টান, সেক্ষেত্রে ঐ নতুন ফোন নম্বর তার অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যেখানে সংযুক্ত হতে পারবে তার জন্য তাকে ছোটাছুটি করতে হবে।"
- ‘নগদহীন'ভাবে ব্যবসা শুরুর অর্থ অতিরিক্ত কিছু ব্যয়ে বিনিয়োগ – যার মধ্যে থাকবে একটা কার্ড ঘষা মেশিন কেনা, ক্রেডিট অথবা ডেবিট কার্ডের জন্য দাম মেটানো, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের জন্য ব্যয়, এবং লেনদেনের জন্য ই-ওয়ালেট কোম্পানিগুলো আদায় করতে পারে এমন মূল্য দেওয়া। এই ধরনের অতিরিক্ত ব্যয়ে খরচ করাটা কি দরিদ্রদের আদৌ প্রয়োজন?
- বিনয় শ্রীনিভাসা যেমন দেখিয়েছেন : "ব্যাঙ্কে টাকা জমা নেওয়ার জন্য বিক্রেতারা ডিজিটাল সমাধান ব্যবহার শুরু করলে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে তারা নতুন রূপের করের শিকার হয়ে উঠবে। আর কেউ যদি সেটাকে এড়াতে চায় তবে তাদের খাতাপত্র রাখতে শুরু করতে হবে যেখানে কত খরচ হল আর কত আয় হল তা দেখানোর জন্য প্রতিটা লেনদেন নথিবদ্ধ করতে হবে! ধরুন রাস্তার এক বিক্রেতা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে তার সমস্ত খরচ নগদে মেটায় এবং বিক্রির জন্য খরিদ্দারদের কাছে মাসে পায় ৩০০০০ টাকা। সেক্ষেত্রে লাভ হবে হয়তো মাত্র ১০০০০ টাকা, কিন্তু কর্তৃপক্ষের নজর হয়তো পড়বে ঐ ৩০০০০ টাকারই ওপর। এবং ঐ ৩০০০০ টাকা যে লাভ নয়, সমস্ত বিক্রির পরিমাণ, সেটা প্রমাণ করার জন্য সমস্ত লেনদেন নথিবদ্ধ করার খাতাপত্র রাখতে হবে, দরিদ্র এবং হিসাব-নিকাশ নথিবদ্ধ করার দিক থেকে অজ্ঞদের কাছে যেটা অত্যন্ত অসুবিধাজনক। তারা কর দেওয়ার আওতায় আসবে না, কিন্তু সেটা প্রমাণ করতে তাদের অনেক অনাবশ্যক ঝামেলা পোহাতে হবে।"
ভারতের অনেক দরিদ্রতম মানুষের কাছেই রাস্তায় বিক্রি বা ছোট দোকান টিকে থাকার শেষ উপায়। খুচরো ব্যবসা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ এনে খুচরো বিক্রি ক্ষেত্রের কর্পোরেটদের সুবিধা করে দিতে সরকার ইতিমধ্যেই রাস্তার বিক্রেতা এবং ছোট দোকানদারদের উৎখাত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এখন আবার নোট বন্দীর পরিপ্রেক্ষিতে অনলাইন লেনদেনের জন্য লেনদেন-জনিত সময়, স্থির ব্যয়, স্থির সময় সবই রাস্তার বিক্রিকে আরও অলাভজনক করে তুলবে এবং এইভাবে দরিদ্র খুচরো বিক্রেতারা আরও হঠে যেতে থাকবেন।