বিমুদ্রাকরণের পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের ওপর বিপুল যন্ত্রণা চাপিয়ে দিয়েছে। এবং বাতিল নোটের স্থান পূরণে নতুন নোটের ঘাটতি ব্যাপক রূপে দেখা দেওয়ায় জনগণের নগদ-নির্ভর অংশ – বস্তুত প্রতি দশ জনের মধ্যে নয়জন – নগদ সংকটে জর্জরিত হয়ে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছেন। একেকটা দিন যাচ্ছে আর ক্রমেই এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, নগদ সংকট আসলে একটা সিংহদুয়ার যার মধ্যে দিয়ে দেখা দেবে একটা বৃহত্তর ও গুরুতর সংকট, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে ধাক্কার মধ্যে দিয়ে এবং ফলে সর্বস্তরে জনগণের আয় এবং ব্যয়ের সংকোচনের মধ্যে দিয়েই যে সংকট হাজির হবে। সরকার গোড়ার দিকে বলেছিল যে, অল্প কয়েকদিনের জন্য অসুবিধা ভোগ করতে হবে, এখন কিন্তু ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, ঐ যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী এবং ক্ষয়ক্ষতি স্থায়ী এবং অপূরণীয় হতে চলেছে।
নোট বাতিল পদক্ষেপের ঘোষিত লক্ষ্য – কালো টাকা এবং জাল মুদ্রাকে নিষ্ক্রিয় করা – এখন নিছকই একটা অছিলা বলে দেখা যাচ্ছে। সরকার নিজেই এখন এর আগে প্রস্তাবিত আয় ঘোষণা প্রকল্পে দেয় জরিমানার চেয়ে মাত্র ৫ শতাংশ বেশি হারে জরিমানায় কালো টাকাকে সাদা করার প্রস্তাব দিয়েছে। মহেশ শাহর মতো এক ব্যক্তি ১৩৮০০ কোটি কালো টাকা আয়ের কথা ঘোষণা করলেন এবং প্রকাশ্যেই বললেন ওটা আসলে রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসাদারদের টাকা। তাকে কোনো শাস্তি ছাড়াই রেহাই দেওয়া হল এবং তার ঘোষণাকেও কোনো তদন্ত ছাড়াই খারিজ করা হল। আমরা এও জানি যে, ৮ নভেম্বরের ঘোষণার আগে বিজেপি কিভাবে সারা দেশে বিপুল পরিমাণ টাকাকে জমি সম্পদে রূপান্তরিত করেছে এবং বিজেপি নেতাদের নতুন চালু ২০০০ টাকার নোটে লক্ষ লক্ষ ও কোটি কোটি টাকা সহ দেখা যাচ্ছে। নগদ টাকার অভাবে সাধারণ মানুষকে বিবাহ উৎসব পিছোতে এবং চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে, অন্যদিকে জনার্দন রেড্ডি এবং নীতীন গডকরির মতো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অপিরমেয় টাকা খরচ করে রাজকীয় বিবাহ উৎসবের অায়োজন করেছেন।
এটা মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, বাতিল মুদ্রার প্রায় সবটাই ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় ফিরে আসছে, যা বিপুল পরিমাণ মজুত করা নগদ টাকাকে নষ্ট করে ফেলার জল্পনা ও গুজবের অবসান ঘটিয়েছে, আর মোদী জনধন অ্যাকাউন্টগুলোকে কালো টাকার মজুত ভাণ্ডার রূপে অভিযুক্ত করে দরিদ্রদের ব্যাপক যন্ত্রণা ও অপমানে জর্জরিত করছেন।
বড় অর্থের নোটগুলো বাতিল করার বিশাল উদ্যোগের পিছনে অন্যতম যে উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে হয় তা হল ব্যাঙ্কগুলোকে সংকট থেকে উদ্ধার করা, যে ব্যাঙ্কগুলোকে লুট করেছে ভারতের বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাসমূহ এবং বিজয় মাল্যর মতো ঠগরা, যাকে বিজেপি রাজ্যসভার সাংসদ বানিয়েছিল এবং মোদী সরকার যাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। কর্পোরেট ক্ষেত্রকে বছর বছর ধরে ১১ লক্ষ কোটি টাকার ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ যোগানো হয়, যে ঋণকে এখন প্রণালীবদ্ধ ধারায় ধাপে ধাপে ব্যাঙ্কের খাতা থাকা থেকে বাতিল করা হচ্ছে।
নোট বাতিল প্রক্রিয়া সাধারণ জনগণের সমস্ত সঞ্চয়কে শুষে নিয়েছে, এবং ব্যাঙ্কগুলোতে নগদের যোগান যথেষ্ট উন্নত হওয়ায় তাকে এখন আবার ধনী ও দুর্নীতিগ্রস্তদের জন্য সস্তায় ঋণে পরিণত করা হবে।
ব্যাঙ্কগুলোতে নতুন পুঁজি যোগানো ছাড়াও বিমুদ্রাকরণের আর একটা উদ্দেশ্য হল ডিজিটাল ভারতের প্রচার এবং কর্পোরেটপন্থী অর্থনৈতিক সংস্কারকে তার সমগ্র পরিসরে প্রবলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যার ফলে গোটা অর্থনীতির ওপর কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ আরও জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
যা কিছু ছোট মাপের, ছোট আয়তনের কৃষি ও ব্যবসা থেকে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শিল্প এবং অন্যান্য উদ্যোগ ও পেশা, সব কিছুকেই আরও প্রবল কর্পোরেট আগ্রাসনের মুখে স্রেফ টিকে থাকার জন্য তীব্র লড়াই চালাতে হবে।
মোদী সরকারের বিমুদ্রাকরণ সৃষ্ট বিপর্যয়ের জন্য যে জনগণকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে, তাদের যন্ত্রণা বিজেপির আরও একটা প্রবল পরাজয়ে পরিণত হোক।
মোদীর জরুরি অবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করুন,
বিমুদ্রাকরণ সৃষ্ট বিপর্যয়কে প্রতিরোধ করুন!
(দ্য ওয়ার পত্রিকায় ১৮/১২/২০১৬ তারিখে প্রকাশিত সিদ্ধার্থ ভাটিয়ার লেখার অংশবিশেষ)
এই পুস্তিকার মলাটের ছবিটাকে দেখুন (যা প্রথম প্রকাশিত হয় হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায়, ছবির সৌজন্য : প্রভিন কুমার)
সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য নন্দলাল গুরগাঁওয়ে এসবিআই-এর এক শাখার বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে ছিটকে যাওয়ার পর অঝোরে কাঁদছেন।
ছবিটাকে ভালো করে লক্ষ্য করুন। মানুষটার মুখ আমাদের যন্ত্রণা ভোগের এবং মনের জোরে দুর্দশা সহ্যের অসংখ্য কাহিনী বলছে। এখন আমরা জেনে গেছি যে, তিনি ছোট একটা ঘরে একাই থাকেন এবং তিনি হলেন প্রাক্তন সেনা; তিনি শত্রুর বুলেট এবং আরও অনেক কিছুর মোকাবিলা করতে পারতেন, কিন্তু তিন দিন লাইনে দাঁড়ানোর পরও কয়েকশো টাকা তুলতে না পারাটা তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে দাঁড়ালো। আবার নতুন করে লাইনে দাঁড়াতে হবে এবং দাঁড়ানোর পরও তাঁকে শূন্য হাতে ফিরতে হতে পারে, এ কথাটা উপলব্ধির পর তাঁর অবরুদ্ধ আবেগের বাঁধ ভাঙলো।
তাঁর আশেপাশে যাঁরা ছিলেন তাঁরাও ছবিটাকে প্রকৃত তাৎপর্যে মণ্ডিত করলেন। লাইনে দাঁড়ানো মহিলারা তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হতেও পারেন, আবার নাও পারেন, কিন্তু কেউই লাইন ছেড়ে বেরিয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে রাজি নন, কেননা তার ফলে তাঁরাও লাইন থেকে ছিটকে যেতে পারেন। চাচা আগে আপন প্রাণ বাঁচা, তার পরে সহানুভূতি ও সংহতি। মহিলাদের মুখগুলোতেও একটা চাপা মরিয়াভাব, কেননা তাঁদের সবাইকেও টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হূবে, তা সে যত সামান্যই হোক না কেন, অন্যথায় তাঁদের পরিবারকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। যন্ত্রণা সহ্যের ব্যাপারে দেশ ঐক্যবদ্ধ, কিন্তু নগদ টাকার যোগান এত কম এবং সামান্য কিছু জোগাড় করাটাও এতো কষ্টের যে, প্রত্যেক নারী-পুরুষের ক্ষেত্রেই চাচা আগে আপন প্রাণ বাঁচা, অন্যের দুঃখে দরদের কথা পরে। ... ...
বিমুদ্রাকরণের যন্ত্রণা খুব তাড়াতাড়ি যাওয়ার নয় এবং সেটা অবশেষে যখন যাবে তখনও দরিদ্র মানুষের জীবনে কোনো উন্নতি ঘটবে না। ব্যাঙ্কের সামনে লাইন আর থাকবে না, কিন্তু এমন এক জমানার মোকাবিলা তাদের করতে হবে যা তাদের ঘাড়ে প্রযুক্তি চাপিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর; নগদে টাকা তোলার সীমাকে বেঁধে রাখাটা যদি স্থায়ী ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কি হবে? এই চরম পদক্ষেপকে খামখেয়ালের বশে ঘটিয়ে ফেলা একবারের জন্য একটা সিদ্ধান্ত বলে মনে করলে মুর্খামি হবে; এটা একটা বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ যার মধ্যে শুধু দেশ পরিচালনার ধারাকে নতুন পথে চালিত করার লক্ষ্যই নেই, নাগরিকরা নিজেদের জীবনকে কিভাবে চালিত করবেন তার ধারাকে নতুন পথে চালিত করার লক্ষ্যও রয়েছে। ইতিমধ্যে, লাইন ছোট হয়ে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না এবং নগদ টাকা হাতে পাওয়াটাও মানুষের কাছে সহজ হচ্ছে না।
মানুষের যন্ত্রণার আরও অনেক কাহিনী এবং আরও অনেক ছবি সামনে আসবে। নন্দলালকে ভুলে গিয়ে পৃথিবীর এগিয়ে চলার ঘটনাও বুঝিবা ঘটবে। কিন্তু তার ছবিটা আমাদের চেতনায় না হলেও সমবেত স্মৃতিতে যন্ত্রণার চিহ্ন হয়েই থাকবে। তবে এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রসঙ্গ যে, তার যন্ত্রণাকে লাঘব করা যাদের পক্ষে সম্ভব এবং তা করা উচিতও বটে, তারা ঐ ধরনের কোনো উভয় সংকটের মধ্যে আদৌ পড়বেন না, কেননা, প্রথমত ওর ছবিটা ওদের মনে একটুও দাগ কাটেনি।