(লিবারেশন, ডিসেম্বর ১৯৭৯ থেকে)
বর্তমানে আমাদের সামনে যে কর্তব্য হাজির হয়েছে তা হল কিছুটা নতুন পরিস্থিতিতে পার্টিকে গঠন করা। পরিস্থিতির এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে বোঝার জন্য আমাদের পার্টির গড়ে ওঠার ইতিহাসের এক সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা জরুরি। পার্টি গঠনের শুরুতে আমরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বুনিয়াদী নীতিমালাগুলির প্রশ্নে দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছিলাম এবং সংশোধনবাদের প্রভাব থেকে হাজার হাজার অগ্রণী কর্মীবাহিনীকে আমাদের দিকে জয় করে নিতে সমর্থ হয়েছিলাম। সেই সময়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে যে পুরোনো রূপের সংগ্রামগুলি প্রচলিত ছিল পার্টি সেগুলিকে প্রত্যাখ্যান করে এবং বিপ্লবের অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন রূপের সংগ্রামগুলির বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা চালিয়েছিল। পার্টি বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্ন মাত্রায় জনগণকে বিপ্লবী সংগ্রামে সমাবেশিত করেছিল।
কিন্তু তখনও বেশ ভালো সংখ্যক মানুষ সংশোধনবাদী দলগুলির প্রভাবে থেকে যায়। কয়েক বছর পর, আমাদের নিজস্ব কর্মীবাহিনীর মধ্যেই বিভ্রান্তি ও বিভাজন দেখা দেয় এবং পার্টি তার ঐক্যবদ্ধ সর্বভারতীয় চরিত্র হারিয়ে ফেলে। মূলত আঞ্চলিক ও রাজ্যভিত্তিতে ভালো সংখ্যক গোষ্ঠীগুলি মাথাচাড়া দেয়। কেবলমাত্র কয়েকটি রাজ্যেই পার্টির বিপ্লবী শাখাগুলি সংগঠিত থাকতে পারে। সাম্প্রতিককালে যখন সর্বভারতীয় স্তরে পার্টির কর্মীবাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা শুরু হল, প্রথম পর্বে সুবিধাবাদীরাই বাজিমাৎ করল। অবশ্য, কেন্দ্রীয় কমিটি শুদ্ধিকরণ আন্দোলন চালানো ও সঠিক কৌশল গ্রহণ করার ফলে আমরা ক্রমে ক্রমে উদ্যোগ ফিরে পেতে শুরু করি। এখন দ্বিতীয় পর্বে, পরিস্থিতি কী রকম? সুবিধাবাদীদের মধ্যে স্পষ্টতই ভাঙ্গন ঘটছে এবং একমাত্র আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি সিপিআই(এমএল)-এর দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ কেন্দ্র হিসাবে উঠে এসেছে। এই কেন্দ্রীয় কমিটি এক সর্বভারতীয় চরিত্র পেয়েছে এবং দৃঢ়ভাবে সশস্ত্র সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই সর্বত্রই পার্টি কর্মীরা এই কেন্দ্রের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। জনগণের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এখন অনেক বিস্তৃত এবং বিভিন্ন জায়গায় এখন হাজার হাজার মানুষ আমাদের সঙ্গে এগোচ্ছেন। কিন্তু এখনও বিভিন্ন রঙের সুবিধাবাদী ও সংশোধনবাদীদের প্রভাবাধীনেই ব্যাপক জনগণ রয়ে গেছেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে শাসক শ্রেণীগুলি যখন গুরুতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি এবং তারা যখন জনগণের সঙ্গে সম্মুখ সমরের দিকে এগিয়ে চলেছে, সংশোধনবাদীরা তখন দ্রুতই উন্মোচিত হয়ে পড়ছে।
কাজেই সংশোধনবাদীদের ব্যাপক গণভিত্তিকে আমাদের পক্ষে জয় করে নেওয়ার মতো অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের সর্বভারতীয় পার্টি সম্মেলন (১৯৭৯) সঠিকভাবেই আমাদের নির্দেশ করেছে যে, অগ্রণীবাহিনীর সংগ্রামের পরিবর্তে শত শত বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাজার হাজার মানুষকে সমবেত করে জোর দিতে হবে তুলনামূলকভাবে আরও ব্যাপক জনসমাবেশের উপর, ন্যূনতম পক্ষে দশ-বিশ হাজার এবং তাকে আরও বাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে লক্ষাধিক তা তার দশ-বিশ গুণে। (তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক মানুষকে সমাবেশিত করার দিকটি ছিল আমাদের অতীত সংগ্রামগুলির বৈশিষ্ট্য। এখানে এটি উল্লেখ্য যে, বিপ্লবী সংগ্রামের বিকাশের প্রক্রিয়ায় এই অবস্থা ছিল অনিবার্য। আমাদের দৃষ্টিকোণ হল, জনগণের চেতনার বিষয়টি সংগ্রামের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই দৃষ্টিকোণ সেই সমস্ত গোষ্ঠীর দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা যারা ‘জনগণ’, কথাটি বলা ছাড়া কখনই মুখ খোলে না, কিন্তু বাস্তবে গণভিত্তিশূন্য বুদ্ধিজীবীদের ক্ষুদে চক্র মাত্র। আমাদের দৃষ্টিকোণ সেই সমস্ত গোষ্ঠীর থেকেও ভিন্ন যারা সাময়িভাবে ভালো সংখ্যক জনগণকেই সংস্কারের সংগ্রামে এমনভাবে সমাবেশিত করে যা আদতে জনগণের বিপ্লবী চেতনাকেই ভোঁতা করে দেয়।) এর জন্য বুনিয়াদী নীতিমালা সম্পর্কে মতাদর্শগত সংগ্রাম ও প্রচারই যথেষ্ট নয়। আমাদের ব্যাপকতম জনগণের আরও কাছাকাছি যেতে হবে, তাদের মানসিকতাকে বুঝতে হবে, তাদের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং তাঁরা যাতে নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উপলব্ধিতে পৌঁছতে পারেন তার জন্য ধৈর্য্য সহকারে তাঁদের সাহায্য করে যেতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘বাম’ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। আমাদের সামনে যে কর্তব্যকর্ম রয়েছে তার জন্য সমগ্র পার্টিকে সমাবেশিত করতে হলে পার্টির অভ্যন্তরে বাম বুলিসর্বস্বতার বিরোধিতা অবশ্যই করতে হবে, যা সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়।