(কয়েকটি পার্টি কমিটির সঙ্গে আলোচনার সারসংক্ষেপ। লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৮৬ থেকে)
পার্টি স্কুল ব্যবস্থা অনুষ্ঠান-সর্বস্বতায় পর্যবসিত হয়ে পড়ার এক বিপদ থেকে যায়। কতগুলি ক্লাস নেওয়া হল এবং কত বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হল সেই পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখা ভালো এবং চমৎকার, কিন্তু সেটাই বড় কথা নয়। বড় কথা হল – মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক মানের উন্নতি ঘটছে কিনা। যে কোনো বিশেষ অভিযানেই আনুষ্ঠানিকতার প্রবণতা মাথা চাড়া দেয়, আর তাই এর বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
এই ক্লাসগুলির লক্ষ্য হল বিভিন্ন সামাজিক পরিঘটনাগুলিকে অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করতে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী উপলব্ধির বিকাশ ঘটানো; শ্রেণীগুলি কীভাবে আচরণ করে, শ্রেণী-স্বার্থ কীভাবে কাজ করে, ইত্যাদি।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কৃষকরা সিপিআই(এম)-এর প্রভাবাধীনে ছিলেন। সেখানে সিপিআই(এম)-এর সংশোধনবাদ, সংসদ-সর্বস্বতা ইত্যাদি সম্পর্কে বিমূর্ত প্রচার চালিয়ে আমাদের কমরেডরা ঐ কৃষকদের আমাদের পক্ষে জয় করে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালান, কিন্তু তাঁরা ব্যর্থ হন। জনগণ সাধারণত তাদের শ্রেণী-স্বার্থ বুঝে ক্রিয়াশীল হন এবং কোনো দল যখন তাদের স্বার্থের কথা বলছে বলে মনে হয় তখন তারা সেই দলকে অনুসরণ করেন। কোনো মানুষই সিপিআই(এম), কংগ্রেস বা ডিএমকে হয়ে জন্মান না। এখন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলস্বরূপ সিপিআই(এম) ঐ এলাকায় জমিদারদের সঙ্গে সমঝোতা করতে এবং ধনী কৃষকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে এবং ফলে তার আগের সামাজিক ভিত্তিতে দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে ওঠে। আমাদের কমরেডরা ইতিমধ্যেই নিজস্ব সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন এবং সংগ্রাম পরিচালনা করছিলেন। তাঁরা ঐ দ্বন্দ্ব ধরতে পারলেন, ব্যাপক কৃষক জনতাকে প্রভাবিত করতে পারে এমন স্লোগান ও ইস্যুগুলিকে তুলে ধরলেন এবং সিপিআই(এম)-এর নীচুতলার কর্মীবাহিনী ও তাদের প্রভাবাধীন জনগণের সঙ্গে যৌথ কার্যকলাপের বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা চালালেন। এবার তাঁরা সফল হলেন। জনগণ ক্রমে ক্রমে তাঁদের আনুগত্য পরিবর্তিত করে আমাদের দিকে চলে এলেন।
আপনারা দেখে থাকবেন ভালো সংখ্যক সৎ ও জঙ্গী পেটি বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী সিআরসি, জনযুদ্ধ গোষ্ঠী, ইত্যাদির মতো ‘বামপন্থী’ সংগঠনগুলির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। তাঁদের শ্রেণীগত অবস্থানের গুণেই পেটি বুর্জোয়া নৈরাজ্যবাদী সিন্ডিক্যালিস্ট চিন্তাধারার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। বাস্তবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগের কারণে শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষক জনতা প্রকৃতিগতভাবে রাজনীতি বিমুখ নয়। আর তাই শ্রমিকশ্রেণী ও ব্যাপক কৃষক জনতার মধ্যে ঐ সমস্ত গোষ্ঠীর বা বলতে পারেন নীচুতলাবাদীদের প্রভাব বা গণভিত্তি মোটেই দীর্ঘস্থায়ী হতে দেখবেন না। শুধু বিতর্ক চালিয়ে ঐ সমস্ত গোষ্ঠীর প্রভাবে থাকা বুদ্ধিজীবীদের জয় করে নিয়ে আসা যাবে না। স্বাধীন রাজনৈতিক উদ্যোগ ও শক্তিশালী গণআন্দোলন যত বেশি করে বিকাশলাভ করবে ততই এই সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা দিক পরিবর্তন করবেন।
অনেকেই তামিলনাড়ুতে এআইএডিএমকে-র প্রভাবের কারণ হিসাবে রামচন্দ্রনের আকর্ষণীয় ক্ষমতার কথা বলে থাকেন। গভীর বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যাপক সংখ্যক মানুষ যে এই দলকে সমর্থন করেন তার কারণ হল, এই দল তাঁদের কিছু দাবি পূরণ করে থাকে বলে তাঁরা মনে করেন, অথবা তাঁদের অন্ততপক্ষে সে রকম প্রত্যাশা রয়েছে। অপরদিকে, এক ব্যাপকতর সামাজিক ভিত্তিকে বজায় রাখা ও তার বিকাশ ঘটানোর প্রচেষ্টার সঙ্গে এআইএডিএমকে-র বুনিয়াদী শ্রেণীগত অবস্থানের সর্বদাই সংঘাত দেখা দেয়।
এই বাস্তবতাগুলিকে আমাদের অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে স্লোগান, কৌশল ও আন্দোলনের বিকাশ ঘটাতে হবে। এই পথেই আমাদের ব্যবহারিক রাজনীতির অনুশীলনের দিকে যাওয়া উচিত, এইভাবেই উপরোক্ত পার্টিগুলির সামাজিক ভিত্তি ও তাদের শ্রেণীগত অবস্থানের মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে তীব্র করে তুলতে হবে।
আপনারা যদি শুধু হৃদয়বৃত্তি বা আবেগ দ্বারা চালিত হন তবে কেবলমাত্র এই দলগুলিকেই নিন্দা করার অবস্থানেই পৌঁছাবেন। আর আবেগ যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী হয় না বা বস্তুগত শক্তিতে রূপান্তরিত হয় না, তাই শেষমেষ সমগ্র ব্যাপারটি আত্ম-ধিক্কারেই পর্যবসিত হবে। আপনাদের মননশীলতার ভিত্তিতেও কাজ করতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট নীতি ও কৌশল, স্লোগান ও কাজের ধারার বিকাশ ঘটাতে হবে যাতে ঐ সমস্ত দলগুলিকে নির্দিষ্ট অর্থে উন্মোচিত করা যায় এবং জনগণকে নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষালাভ করতে সাহায্য করার মাধ্যমে তাদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরানো যায় এবং জনগণকে অবশেষে জয় করে নেওয়া যায়।
আমাদের আন্দোলনের অধিকাংশ লোক মনের দিক থেকে নয়, হৃদয়বৃত্তির দ্বারাই চালিত হন। এর ফলে বিপ্লবী বুলির দিক থেকে তাঁরা সবচেয়ে এগিয়ে থাকেন, আর গণভিত্তির দিক থেকে থাকেন সবার পিছনে। এইভাবে জনগণ প্রতিক্রিয়াশীল, সমাজগণতন্ত্রী ও উগ্র আঞ্চলিকতাবাদীদের প্রভাবাধীনে থেকে যান। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কিছু মানুষ এ ব্যাপারে একটুও উদ্বিগ্ন হন না, জনগণ তাঁদের স্লোগানগুলিতে প্রভাবিত হলেন কী হলেন না তাতে তাঁদের কিছু যায় আসে না, তাঁরা কিন্তু নিজেদের স্লোগানগুলিকে পরিবর্তন করতে প্রস্তুত নন। এই মানুষগুলি মনে হয় বিশ্বাস করেন যে বিপ্লব সম্পন্ন হয় শুধু কথা দিয়েই, জনগণের দ্বারা নয়। একেই বলা হয় বাম বুলিসর্বস্ততা।
যে বাস্তব নিয়মগুলির দ্বারা সমাজ, শ্রেণীগুলির অবস্থান পরিবর্তন হয় ও তাদের সংগ্রাম পরিচালিত হয়, চিরায়ত মার্কসবাদী সাহিত্যের অধ্যয়ন সেই নিয়মগুলিকে আয়ত্ত করতে আপনাদের সাহায্য করবে।
এই অধ্যয়ন আত্মগত আকাঙ্খার পরিবর্তে বাস্তবতার ভিত্তিতে আপনাদের স্লোগান, নীতি ও কৌশলগুলিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে সাহায্য করবে।
গণতন্ত্র বলতে সাধারণভাবে আমরা যা বুঝি, কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে তার তাৎপর্য কিছুটা আলাদা। এখানে গণতন্ত্র কেন্দ্রীয় পরিচালনার অধীন। কখন এবং কী বিষয়ে বিতর্ক ও আলোচনা চালানো হবে তা ঠিক করে থাকে কেন্দ্রীয় কমিটি। অন্যথায় পার্টি একটি বিতর্ক চালানোর সংস্থায় অধঃপতিত হবে। সিআরসি গোষ্ঠী উগ্র গণতন্ত্রের এক চরম নিদর্শন। তাঁরা নিজেদের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রকৃত অনুগামী হিসাবে দাবি করেন, তথাকথিত দু-লাইনের সংগ্রামকে বিরামহীনভাবে চালিয়ে যান এবং প্রত্যেককে লাগাতার বিতর্কে নিয়োজিত থাকার কথা বলেন। এর ফলে কী দাঁড়াল? তাঁরা কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে গেলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এখন মার্কসবাদ সঠিক কী সঠিক নয় সেই বিতর্ক চালাচ্ছেন, কেউ কেউ আবার বলছেন যে ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা’ সম্পর্কে লেনিনীয় ধারণা ভুল। অনেকে সিআরসি সংগঠনকে খুবই গণতান্ত্রিক সংগঠন বলে মনে করেন। এই ধারণা ভুল। উগ্র গণতন্ত্র পেটি বুর্জোয়াদের পছন্দের বিষয় হতে পারে, সেক্ষেত্রে কিন্তু সংগঠন বলে কিছু থাকবে না। কেন্দ্রীকতা ছাড়া সংগঠন হতে পারে না। ৭০ দশকের গোড়ার দিকে আমার এক বন্ধু আমাকে বলেন, ‘ব্যক্তি সংগঠনের অধীন’ এবং ‘সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর অধীন’ – এই ধারণা অত্যন্ত অবমাননাকর এবং তিনি দাবি করেন ‘সত্য প্রায়শই সংখ্যালঘুর মধ্যেই নিহিত থাকে’ এই কথা ঘোষণা করে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঐ ধারণাকে ধুলিস্যাৎ করেছে। আমি তাঁকে বলেছিলাম, তাহলে আপনার সংগঠন বলে কিছু থাকবে না।
এই ব্যক্তি পরবর্তীকালে পার্টি ছেড়ে চলে যান, তিনি এখন একটি ‘আন্তর্জাতিকতাবাদী’ কেন্দ্র পরিচালনা করছেন। কিন্তু অবাক ব্যাপার, তাঁর অভিযাত্রায় আজ তিনি একা!
পার্টি কংগ্রেসই পার্টি লাইন নির্ধারিত করে থাকে। তার আগে পার্টি লাইনের সমস্ত দিক সম্পর্কে বিতর্ক ও আলোচনা চালানো হয়। পার্টি কংগ্রেসে সমস্ত বিষয়গুলি নির্ধারিত হয়ে গেলে সমগ্র পার্টিকেই তার প্রয়োগে নামতে হবে। পুনরায় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে এবং তখন আবার বিতর্কও চালানো হবে। এর মধ্যবর্তী সময়কালেও নতুন কর্মনীতি, ও কৌশল সংক্রান্ত প্রশ্নে, যে সমস্ত বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে সেই সমস্ত প্রশ্নে সব সময়েই বিতর্ক ও আলোচনা চালানো হয় এবং মতামতগুলি সংগ্রহ করা হয়। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু ভিত্তিতে এবং সংখ্যালঘুরা নিজেদের মতামত সংরক্ষিত রাখতে পারেন।
কেউ কেউ বলেন, আপনাদের পার্টি যথেষ্ট গণতান্ত্রিক না হওয়ার কারণেই আপনারা ভাঙ্গন ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছেন। এই ধারাবাহিক ঐক্য দেখিয়ে দেয় যে আপনারা গণতান্ত্রিক নন। সিআরসি, পিসিসি এবং অন্যান্য সংগঠনগুলির মধ্যে বারবারই যে ভাঙ্গন ঘটছে তার কারণ হল তারা গণতান্ত্রিক। কেউ কেউ আবার এমন অভিমতও ব্যক্ত করেন, আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পেরেছেন কারণ আপনারা কর্মীবাহিনীকে অন্ধকারে রেখে দেন, আপনারা তাদের রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেন না, তাদের অন্যান্য সংগঠনের পত্রপত্রিকা পড়ার বা অন্যান্য সংগঠনের কর্মীদের সংস্পর্শে আসার অনুমতি দেন না; আর আপনাদের নেতৃত্ব চলছে দুটি বা তিনটি গোষ্ঠীর মধ্যে এক অনীতিনিষ্ঠ ঐক্যের ভিত্তিতে, যে গোষ্ঠীগুলি একেবারে ভিন্নধর্মী বা বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে আছে।
আপনারা জানেন, এ সমস্ত কিছুই ভিত্তিহীন। বস্তুত এই ধরনের মানুষগুলি নিজেদের নৈরাজ্যবাদকে যথার্থ প্রতিপন্ন করতে, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ভিত্তিতে এক সংগঠন গড়ে তুলতে নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকতে ঐ ধরনের আজগুবি কথাবার্তার আশ্রয় নেন। এই সমস্ত গোষ্ঠীগুলি কেন্দ্রীকতাকে ভয় করে এবং নিজেদের নৈরাজ্যবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতেই তাঁরা সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও মাও-এর কথা বলে বেড়ান।
কিছু ব্যক্তি বলেন যে, সত্যনারায়ণ সিং-এর মৌলিক অবদান ছিল চারু মজুমদারের আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাকে তুলে ধরা। তাই যদি হয় তবে এক ঐক্যবদ্ধ পার্টি গড়ে তুলতে তিনি নিদারুণভাবে ব্যর্থ হলেন কেন? যখনই কোনো বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে তখনই তাঁর পিসিসি গোষ্ঠীতে ভাঙ্গন ঘটেছে কেন? আর যাঁরা চারু মজুমদারকে ধরে রইলেন তাঁরাই শেষপর্যন্ত এক ঐক্যবদ্ধ পার্টি গড়ে তুলতে সফল হলেন কীভাবে? বস্তুত সত্যনারায়ণ সিং উগ্র গণতন্ত্রের জন্যই লড়াই করেছেন এবং শেষপর্যন্ত কেন্দ্রীকতার বুনিয়াদী মতবাদকেই আঘাত করেছেন, এবং তাও চরম দমন-পীড়নের সময়। চারু মজুমদার যথার্থভাবেই গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, যে পার্টি জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে নিয়োজিত তার কাছে গণতন্ত্র ছেলেখেলার বস্তু নয়। শ্বেত সন্ত্রাসের পর্যায়ে তিনি সঠিকভাবেই কেন্দ্রীকতার উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি মূলগতভাবে সঠিক ছিলেন। একথা অবশ্য সত্যি যে, কেন্দ্রীকতার উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপের ফলে কিছু বিচ্যুতি দেখা দিয়েছিল। এসত্ত্বেও প্রকৃত ও আন্তরিক বিপ্লবীরা চারু মজুমদারের সঙ্গেই ছিলেন এবং ক্রমে ক্রমে তাঁরা ঐ বিচ্যুতিগুলিকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সত্যনারায়ণ সিং-এর সব থেকে বড় ব্যর্থতা দেখিয়ে দেয় যে মূলগতভাবে তাঁর অবস্থান ছিল ভুল এবং তাঁর লড়াই ছিল গণতন্ত্রের জন্য নয়, কেন্দ্রীকতার বিরুদ্ধে।
মোটের উপর গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা সফল হয়েছি। তা সত্ত্বেও আমাদের সংগঠনের মধ্যে কিছু ভুল প্রবণতা রয়ে গেছে। গণসংগঠনগুলির ক্ষেত্রে আমরা তাদের স্বাধীন ভূমিকা ও কার্যকলাপের পক্ষে এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির ক্ষেত্রে আমরা তাদের স্বায়ত্ততাকে সমর্থন করি। কিন্তু এই সংগঠনগুলিতে পার্টির কিছু কিছু ব্যক্তি এই স্বাধীনতা ও স্বায়ত্ততার অপব্যাখ্যা করেন। আমরা বলতে পারি, তাঁরা ‘স্বতন্ত্রতার’ জন্য উৎসুক। স্বাধীনতা ও স্বায়ত্ততা হল ব্যাপকতম জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং কাজের ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা ও দক্ষতার বিকাশ ঘটানোর হাতিয়ার। এই স্বাধীনতাকে আপনি ‘আপেক্ষিক স্বাধীনতা’ হিসাবে অভিহিত করতে পারেন। কিন্তু ‘স্বতন্ত্রতা’ হল সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় : তা পার্টি লাইন, পার্টির পরিচালনা ও পার্টি শৃঙ্খলাকে অমান্য করার অধিকারের দাবি জানায়।
আজকাল অনেকেই পার্টির সিদ্ধান্তগুলিকে লঙ্ঘন করেন, ‘বিক্ষুব্ধ’ হিসাবেই তাঁরা পরিচিত হতে পছন্দ করেন। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি, এই অজুহাতে তাঁরা পার্টি নেতৃত্বের কাছ থেকে আসা সমস্ত পদক্ষেপগুলির, সমস্ত ধারণাগুলির সমালোচনা করেন। এমন কিছু সদস্যকে আমি জানি যাঁরা একজন পার্টি সদস্য যে অধিকারগুলির ভোগ করেন সেগুলি সবই চান, কিন্তু সংগঠন তাঁদের যে দায়িত্ব দেয় সেগুলি পালন করতে তাঁরা রাজি নন। যদি কোনো কিছু তাঁদের বিরুদ্ধে যায় তাঁরা তা মানবেন না।
একজন সদস্যের প্রাথমিক কর্তব্য হল সংগঠনের দেওয়া দায়িত্ব অবশ্যই পালন করা। এই দায়িত্ব অর্পণের সময় সংশ্লিষ্ট সদস্যের সঙ্গে অবশ্যই আলোচনা করা হবে ও তাঁর সম্মতি নেওয়া হবে, কিন্তু একবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেলে তা তাঁকে সম্পূর্ণ আন্তরিকভাবেই পালন করতে হবে। এই ন্যূনতম পার্টি-বোধ যদি না থাকে তবে তিনি সদস্য হওয়ার উপযুক্ত নন এবং তার ফলে পার্টি সদস্যের কোনো অধিকারও তাঁর থাকবে না।
এইগুলি হল উগ্র গণতন্ত্রের কিছু বহিঃপ্রকাশ। প্রতিটি সমস্যাকেই আবার উগ্র গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে চিহ্নিত করা ঠিক নয়। কিছু কিছু রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, কঠোর পরিশ্রম না করা হল উগ্র গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ। বিলোপবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম যখন আমরা শুরু করি, আমার মনে আছে তখনকার একটি রিপোর্টের কথা – বৈঠকে দেরীতে আসা বা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময় ঘুমিয়ে পড়াকেও বিলোপবাদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আমার মনে হয় এগুলি ঠিক নয়। সবকিছুকেই যদি উগ্র গণতন্ত্র বলে চালানো হয় তবে আসল লক্ষ্যবস্তুই নাগালের বাইরে থেকে যাবে।
যাই হোক, কেন্দ্রীকতার ভিত্তি হল গণতন্ত্র। পার্টির মধ্যে যদি আলোচনা ও বিতর্কের অনুমতি না দেওয়া হয়, যদি বিভিন্ন মতামতগুলিকে সংগ্রহ করা ও বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনার নিয়মিত ব্যবস্থা না থাকে, গণসংগঠনের প্রতিটি টুকিটাকি ব্যাপারেই যদি অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ ঘটতে থাকে, তবে কেন্দ্রীকতা আমলাতন্ত্রে পর্যবসিত হবে।
আবার যদি সঠিক নীতিমালা না থাকে, যদি সময়মতো নেতৃত্ব দিতে না পারা যায়, যদি নিয়ম-কানুন না থাকে, কাজের যথাযথ ভাগবিন্যাস না থাকে, তাহলে কেন্দ্রীকতা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না।
আর সবশেষে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, কেন্দ্রীকতা ও শৃঙ্খলা কার্যকরী করার বিষয়টি কর্মীবাহিনীর চোখে পার্টি নেতৃত্বের মর্যাদার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। নীচুতলায় যদি ব্যাপক ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকে, যদি বিভ্রান্তি ও মতবিরোধ ব্যাপকভাবে বিরাজ করে, তবে তার মূল কারণ কিন্তু নেতৃত্বের মধ্যেই খুঁজতে হবে। পরিস্থিতি ও মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্পর্কে নেতৃত্বের যদি ভালোরকম দখল না থাকে, তাঁদের জীবনধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি যদি অবক্ষয়ী বুর্জোয়া সংস্কৃতির অনুসারী হয়, তাঁরা যদি বিনয়ী, ভদ্র ও কঠোর পরিশ্রমী না হন, যদি কর্মীবাহিনীর স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে না পারেন, তবে পার্টিতে নিছক উঁচুপদে থাকলেও তা কোনো কাজে লাগবে না। মূল নেতৃত্ব যদি পরিণত ও নিবেদিত প্রাণ হন এবং সেই মতো মর্যাদার উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত হন, তবে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অন্যথায় ঐ ধরনের সমস্ত প্রচেষ্টাই হিতে বিপরীত হয়ে দেখা দেবে। অতএব, সমস্ত মতবিরোধকেই পার্টি-বিরোধী হিসাবে দেখলে চলবে না, আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমস্যাকে শৃঙ্খলার শাসন ও তীব্র সমালোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করাও ঠিক নয়। আমার ধারণা, কিছু কিছু জায়গায় কিছু নেতা ও পার্টি কমিটি যথেষ্ট পরিমাণেই তাঁদের মর্যাদা হারিয়েছেন। এই সংহতকরণ অভিযানে আমাদের প্রাথমিকভাবে এই সমস্যার প্রতি নজর দিতে হবে। এটি কিন্তু কেন্দ্রীকতাকে দুর্বল করা নয়, এতে বরং কেন্দ্রীকতা শক্তিশালী হবে। আমি কেন্দ্রীকতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছি, কেননা অনেক নতুন কমরেড এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবহিত নন এবং গুরুত্ব আরোপের আরও কারণ হল, এত বছর ধরে অনেক কষ্টসাধ্য পরিশ্রমের মাধ্যমে পার্টি যে কেন্দ্রীকতা গড়ে তুলেছে তাকে দুর্বল করে তুলতে আমাদের চারপাশে নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলি বদ্ধপরিকর। এছাড়াও, যে পার্টিকে কিছু কিছু এলাকায় চূড়ান্ত দমনপীড়নের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে এবং অন্যান্য অঞ্চলেও পরিস্থিতি যে কোনও সময়ে ঐ রকম হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেই পার্টির কাছে কেন্দ্রীকতা চূড়ান্তভাবেই গুরুত্বপূর্ণ।
যথার্থভাবে বলতে গেলে, নীচুতলার পার্টি সংগঠনগুলি একেবারে বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে। যাই হোক, আমাদের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি ও কয়েকটি কেন্দ্রীয় বিভাগ রয়েছে। রাজ্য কমিটিগুলিও মোটামুটি নিয়মিতভাবে ও স্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করে। কিন্তু আঞ্চলিক ও তার নীচুতলার কমিটিগুলি এবং ইউনিট ও সেলগুলির প্রসঙ্গ এলেই দেখা যাবে যে সেখানে নিয়মিত ও স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে যথাযথ পার্টি ব্যবস্থার কোনো অস্তিত্ব নেই। নীচুতলায় যে বিভ্রান্তি ও নৈরাজ্য বিরাজ করে এই পরিস্থিতিই তার জন্য দায়ী এবং তা নেতৃত্বের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব, কয়েকজনের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং গুটিকয়েক ব্যক্তির মাথা থেকেই সমস্ত সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসার উর্বর জমি তৈরি করে দেয়।
এই অবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি সরাসরি আঞ্চলিক কমিটিগুলির কাছে আহ্বান জানিয়েছে এবং তাদের অগ্রগতি সম্পর্কে পর্যায়কালীন রিপোর্ট সরাসরি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠাতে বলেছে। সংহতকরণের প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি জায়গায় পার্টি সেল, ইউনিট ও কমিটিগুলি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন তার মধ্যে অনেকগুলিই অকার্যকর হয়ে গেছে এবং কমরেডরা বুঝতে পারছেন যে এই কাজগুলি করা হয়েছিল অত্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে। অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কমরেডরা তাঁদের পদ্ধতির পরিবর্তন করছেন। বহু জায়গায় তাঁরা পার্টির সেল ও ইউনিট গঠনের সাথে সাথে অধ্যয়ন সংস্থাও গঠন করছেন। যাঁদের উপর ভিত্তি করে এই নীচু স্তরের পার্টি সংগঠনগুলি গড়ে উঠবে সেই সমস্ত সংগঠক ও মূল কমরেডদের গড়ে তোলার উপরই তাঁরা জোর দিচ্ছেন।
কলকারখানা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, অফিস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিতে পার্টি কমিটিগুলি গড়ে তোলার ব্যবস্থার তেমন উন্নতি ঘটেনি, আবার গণসংগঠনগুলির মধ্যে পার্টি কেন্দ্রগুলিকেও স্থিতিশীল করা যায়নি। শুধুমাত্র এলাকাভিত্তিক পার্টি কমিটিগুলির অস্তিত্বের ব্যবস্থা এখনও বিদ্যমান। নেতৃস্থানীয় ক্যাডাররা পার্টি গঠনের এই দিকটির উপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করেন না এবং পুরোনো ধারা চলছেই। এর কারণ হল, আমাদের পার্টির কার্যকলাপের ক্ষেত্রে যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্টির কাজের যে বৈচিত্র্যপূর্ণ বিস্তার ঘটেছে অনেক কমরেডই তার সম্পূর্ণ তাৎপর্য এখনও অনুধাবন করতে পারেননি। পার্টির পুরোনো গড়ন দিয়ে আর সমগ্র কাজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব নয় : হয় কাজের সমগ্র ধারা থেকে পার্টি বিচ্ছিন্ন থাকে অথবা কয়েকজন মাত্র নেতা সর্বত্র ছোটাছুটি করে নির্দেশ জারি করেন এবং অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করতে থাকেন। পার্টির কর্মকাণ্ডের ব্যাপক অংশই এখন আইনি ক্ষেত্রের মধ্যে পড়ে এবং অনেক নতুন মানুষ পার্টির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। পার্টি সংগঠনের পুরোনো ধাঁচার পক্ষে এই সমস্ত নতুন বিকাশগুলির সঙ্গে তাল রাখা সম্ভব নয়। নতুন কাঠামোর কেন্দ্রে থাকবে এক সম্পূর্ণ গোপন ও বেআইনি নিউক্লিয়াস, যার চারপাশে থাকবে পার্টি ইউনিট, সেল ও গোষ্ঠীর সুবিস্তৃত জাল, যাদের মধ্যে অনেকগুলিই কাজ করবে আধা-আইনি এবং এমনকি আইনি অবস্থায়। নীচুতলায় পার্টি সংগঠনগুলিকে শক্তিশালী করার অর্থ শুধু আরও অনেক কমিটি, ইউনিট ও সেল গঠন করা নয়; বরং তার অর্থ হল তাদের কাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও বিভিন্ন রূপের মধ্যে ঐ কাঠামোগুলিকে সক্রিয় ও কার্যকরী করে তোলা। এই বিষয়টি এতদিন সম্পূর্ণভাবে অবহেলা করা হয়েছে।
এখানে প্রশ্ন হল শুধু নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমানার মধ্যে কাজকে কেন্দ্রীভূত করার কথা বুঝলে চলবে না, বরং এক বিশেষ কাজের ধারাকে, বলা যায় ‘সচেতন কাজের এলাকাকে’ বুঝতে হবে। বেশিরভাগ রিপোর্টেই স্বতঃস্ফূর্ত কাজের ধারা, ঘটনাবলীর পিছনে ছোটার কথা বলা আছে। কোথাও মন্দির থেকে সোনাদানা চুরির ঘটনা, কোথাও দেখা যায় কাবেরীর জল বণ্টন নিয়ে একটি ইস্যু সামনে এসেছে, আর তখনই সে সব নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ছোটাছুটি করা হয়। এই সমস্ত ঘটনাবলীর পিছনে দৌড়াদৌড়ি করা হয় এবং এই কাজের ধারার ভিত্তিতে যে কর্মীবাহিনী গড়ে উঠবে তারা হবে আংশিক চরিত্রের মরশুমি কর্মী। কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটার পর তারা সক্রিয় হয়ে উঠবে। অন্য সময়ে তারা নিষ্ক্রিয় থাকবে।
‘কেন্দ্রীভূত কাজের এলাকাগুলিকে’ এক সুনির্দিষ্ট কাজের ধারার মডেল হিসাবে বিকশিত করতে হবে। সেখানে আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি থাকবে, কাজের এক দীর্ঘকালীন পরিপ্রেক্ষিত, কর্মনীতি ও কৌশল থাকবে, এমন কাজের ধারা অনুসরণ করা হবে যেখানে কর্মীবাহিনী দৈনন্দিন গণকার্যকলাপে যুক্ত থাকবেন। এই রকম পরিকাঠামো থাকলে আপনারা পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তনের মুখেও সময়োচিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবেন।
অনেক রিপোর্টে আমি দেখেছি কর্মনীতি ও কাজের পরিকল্পনার কোনো উল্লেখ নেই। আপনাদের যদি কোনো কর্মনীতি থেকে থাকে, প্রথমত সেগুলি প্রয়োগের মাধ্যমে আপনারা কী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন? দ্বিতীয়ত, এই অভিজ্ঞতা কি কর্মনীতির কোনো পরিবর্তনের দাবি জানায়? এই সমস্ত প্রশ্নে অনেক রিপোর্টই নীরব, আর এটিই আমাদের কাজের ধারার সব থেকে বড় ঘাটতি। অনেক জায়গায় হয় কোনো কর্মনীতি বা পরিকল্পনা ছিল না, বা থাকলেও শুধু কাগুজে থেকে গেছে। অন্ধভাবে কাজ করার অর্থ হল ভুল কর্মনীতির ভিত্তিতে কাজ করা। আপনাদের যদি কোনো সঠিক ও সচেতন কর্মনীতি না থাকে, তবে রয়েছে ভুল স্বতঃস্ফূর্ত কর্মনীতি, এবং এইভাবে চলার মধ্যে নিহিত বিপদ সম্পর্কেও আপনারা ওয়াকিবহাল থাকবেন না। একটি পার্টি কমিটির সংহতকরণ সব সময়েই তার কর্মনীতি, ঐ কর্মনীতির প্রয়োগ ও সেগুলির লাগাতার পর্যালোচনাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। নেতৃবৃন্দ এই দিকটির উপরও যথেষ্ট মনোযোগ দেননি। তাঁদের কাজ হল বিশেষ এলাকা বা ক্ষেত্রে কাজকে কেন্দ্রীভূত করা, কর্মনীতির বিকাশ ঘটানো, বিশেষ বিশেষ ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ করা এবং এই সমস্ত অভিজ্ঞতার আলোকে সমগ্র সংগঠনকে পরিচালিত করা।
এই সমস্ত সংগঠনগুলির মাধ্যমেই পার্টি জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ জীবন্ত সম্পর্ক বজায় রাখে। এই সংগঠনগুলির কাজ হল জনগণের একেবারে প্রাথমিক দাবিগুলিকে তুলে ধরা, জনগণের সঙ্গে সংযোগকে নিয়তই বাড়িয়ে চলা।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে রাজ্য স্তরের বা সর্বভারতীয় সংস্থা হিসাবে নিজেদের বিকশিত করতে গিয়ে এই সমস্ত সংগঠনগুলি তাদের গতিময়তা অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলে এবং তৃণমূল স্তরে জনগণের সঙ্গে তাদের সংযোগ অনেক শিথিল হয়ে পড়ে। আংশিক চরিত্রের সংগ্রামগুলিকে তৎক্ষণাৎ রাজনৈতিক সংগ্রামে পরিণত করার আমাদের অতি উৎসাহের ফলে ঐ সমস্ত সংগঠনগুলিকে বহু জায়গায় গণরাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিকল্পরূপে পরিণত করা হয়েছে। একদিকে শ্রেণী ও বিভাগীয় সংগঠনগুলি এবং অন্যদিকে গণ-রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে সঠিক আন্তসম্পর্ক বজায় রাখা উভয়ের বিকাশের পক্ষেই গুরুত্বপূ্র্ণ। উভয়েরই সক্রিয়ভাবে উভয়কে সাহায্য করা উচিত, কিন্তু একটি সংগঠন অন্য সংগঠনের ভূমিকা পালন করবে না। গণরাজনৈতিক সংগঠনকে যেখানে প্রথমে জাতীয় স্তরে শক্তিশালী করে তোলার পর রাজ্য স্তরে শক্তিশালী করতে হবে, সেখানে শ্রেণী ও বিভাগীয় সংগঠনগুলিকে সর্বপ্রথম ও সর্বাগ্রে শক্তিশালী করতে হবে স্থানীয় ও আঞ্চলিক স্তরে এবং তারপর রাজ্য বা জাতীয় স্তরে।