(বেনারসে ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের সমাপ্তি ভাষণ, লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯৭ থেকে)

কমরেড,

আমাদের ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের সফল পরিসমাপ্তি হতে চলেছে। প্রথমেই আমি বলব যে অন্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টির অতিথিদের উপস্থিতি আমাদের উৎসাহিত করেছে। কমিউনিস্ট আন্দোলন সব সময়েই এক আন্তর্জাতিক আন্দোলন। দুনিয়া জুড়ে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শের ভিন্ন ভিন্ন রূপে যে চর্চা চলেছে আমাদের বিদেশী অতিথিরা সেই সমস্ত প্রয়োগেরই প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। আমাদের পার্টি কংগ্রেসে তাঁদের উপস্থিতি আমাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির নিদর্শন। এটা এই বিষয়টিকেও তুলে ধরে যে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মধ্যে বিভিন্ন মতপার্থক্য থাকলেও পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদান ও পরস্পর থেকে শিক্ষা গ্রহণ চালিয়ে যেতে হবে।

আর তাই, নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে আমি বিদেশী অতিথিদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।

কমরেড,

গত পাঁচ দিন ধরে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক চালিয়েছি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল, কখনও কখনও বিতর্ক তীক্ষ্ণও হয়েছে। নির্বাচন হয়েছে, কমরেডরা অংশগ্রহণ করেছেন, কেউ জিতেছেন, কেউ হেরেছেন। পার্টি কংগ্রেসে ও অধিবেশনগুলিতে খোলাখুলিভাবে আলোচনা ও বিতর্ক চালানোই আমাদের পার্টির ঐতিহ্য। তা করতে গিয়ে কিছু ক্ষোভ প্রকাশ হতে পারে, কিছু কমরেডের মনে আঘাত লাগতে পারে, কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমরা সকলেই সেই একই পার্টি কমরেড। আমাদের লক্ষ্য ও নীতিও অভিন্ন। এই লক্ষ্য পূরণে আমরা আমাদের সবকিছু, এমনকি জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই ধরনের কমিউনিস্ট বন্ধন যেখানে রয়েছে আমি মনে করি সেখানে কোনো দ্বন্দ্ব বা তিক্ততা স্থায়ী হতে পারে না। আর তাই সম্পূর্ণভাবেই, আমার এই বিশ্বাস রয়েছে যে আমরা যখন এই কংগ্রেস থেকে ফিরে যাব, আমরা সেই একইরকম অন্তরঙ্গতা, লৌহদৃঢ় ঐক্যের সঙ্গে পরস্পরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের সংগ্রাম চালিয়ে যাব। এটাই আমাদের পার্টির অতীত ঐতিহ্য, আগামী দিনেও এই ঐতিহ্য বজায় থাকবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

কমরেড,

আপনারা জানেন, আমাদের পার্টি ভেঙ্গে গিয়েছিল – অনেক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। গত বিশ-পঁচিশ বছর ধরে অন্য সমস্ত গ্রুপগুলিকে আমরা লাগাতার ভেঙে যেতে দেখেছি। কিন্তু এর বিপরীতে ১৯৭৪-এ পার্টি পুনর্গঠনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের সংগঠনে কোনো ভাঙ্গন ঘটেনি, আমাদের ঐক্য ক্রমাগত সুদৃঢ় হয়েছে। অনেকের কাছেই এটা একটা ধাঁধা হয়ে রয়েছে। অন্য সমস্ত নকশালপন্থী গ্রুপগুলি যখন লাগাতার ভাঙ্গনের মধ্যে দিয়ে চলেছে তখন কী সেই যাদু যার বলে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন গত পঁচিশ বছর ধরে তার ঐক্য অটুট রেখেছে। বিশেষত এমন সময়ে যখন কমিউনিস্ট আন্দোলনে নেতৃত্বের প্রশ্নে যাদের সাথে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সেই সমাজগণতন্ত্রী দল সিপিআই(এম)-এর মধ্যেও সংকট বেড়ে চলেছে। কৌশলগত লাইনের প্রশ্নে তাদের নেতৃত্বের মধ্যে গুরুতর বিভাজন আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের পার্টির গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে।

আমাদের এই লৌহদৃঢ় ঐক্যের মূল কারণ নিহিত রয়েছে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মহান ঐতিহ্যকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরার মধ্যে। ১৯৬৭-র নকশালবাড়ির আন্দোলন থেকে ৭০ দশকের আন্দোলনের বহু বিচ্যুতি ও ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও ঐ ঐতিহ্যগুলিকে আমরা কখনও অস্বীকার করিনি। আমাদের উত্তরাধিকারের মর্যাদা আমরা সব সময়েই দিয়েছি। আমরা কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মহান সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ বা কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্ব কোনো কিছুকেই অগ্রাহ্য করিনি। মহান শহীদ ও নেতৃবৃন্দের মর্যাদাকে সব সময়েই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছি। সাথে সাথে আমরা সব সময়েই ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। আমাদের ভুলত্রুটিগুলির খোলামেলা সমালোচনা করেছি এবং নতুন উপলব্ধিগুলিকে পার্টি লাইনের মধ্যে একাত্ম করেছি। আমাদের বিপ্লবী ঐতিহ্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা এবং বর্তমানের দাবির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে পার্টি লাইনের প্রয়োজনীয় পুনর্বিন্যাস ঘটানো – আমি মনে করি আমাদের পার্টি সঠিকভাবে এই দুটি কাজের মধ্যে সমন্বয়সাধন করেছে এবং এটাই আমাদের সুদৃঢ় ঐক্যের মূল কথা।

এর সাথে পার্টি পুনর্গঠনের সময় থেকেই আমরা এক পূর্ণাঙ্গ পার্টি ব্যবস্থার বিকাশ ঘটানোরও চেষ্টা করে গেছি। ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত, কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে একদম নীচের কমিটি পর্যন্ত সম্পূর্ণ কমিটি ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি। সমস্ত স্তরেই এক যৌথ নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়েছি। আমরা নিয়মিত আমাদের পার্টি কংগ্রেস সংগঠিত করেছি, প্রয়োজনমতো সর্বভারতীয় সম্মেলন সংগঠিত করেছি। আর এই ব্যবস্থাই কোনো ব্যক্তি বিশেষের উপর পার্টির নির্ভরশীল না হয়ে ওঠাকে সুনিশ্চিত করেছে। আমাদের পার্টি কোনো ব্যক্তি বিশেষের মর্জি অনুযায়ী চলে না, কোনো ব্যক্তির আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব-নির্ভর নয়। দীর্ঘ অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় অনেক অভিজ্ঞ কমরেড উঠে এসেছেন, তাদের মধ্যে এক সুদৃঢ় ঐক্য রয়েছে। আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি কয়েকটি গোষ্ঠীর ঢিলেঢালা সহাবস্থান নয়, তা একটি ঐক্যবদ্ধ সংগঠন। কোনো ধরনের কোনো গোষ্ঠীর অস্তিত্ব আমাদের পার্টিতে নেই। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ কমরেডদের নিয়েই আমাদের পার্টি নেতৃত্ব গঠিত, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাঁরা পার্টি কর্মী ও জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন। তাঁদের নিয়েই গঠিত আমাদের পলিটব্যুরো ও যৌথ নেতৃত্ব। আমি মনে করি এটাই সেই কারণ যা গত পঁচিশ বছর ধরে আমাদের পার্টির ঐক্যকে বজায় রেখেছে ও তাকে শক্তিশালী করেছে। আমি বিশ্বাস করি যে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিও আমাদের পুরোনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখবে এবং এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই কংগ্রেসে সারা দেশ থেকে আসা প্রায় ৭০০ প্রতিনিধি নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির ওপর যে আস্থা প্রকাশ করেছেন, যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, সেই দায়িত্ব নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি যোগ্যভাবে পালন করার চেষ্টা করবে। জনগণের সংগ্রাম, পার্টির সংগ্রামের সামনের সারিতে আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরাও সামিল থাকবেন এই প্রতিশ্রুতি আমি দিচ্ছি।

কমরেড,

আমাদের সমানের চ্যালেঞ্জগুলি সম্পর্কে আমরা অবহিত। বিভিন্ন দিক থেকেই আমাদের উপর আক্রমণ আসছে। এই সমস্ত চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার শপথ আমরা এই কংগ্রেসে নিয়েছি। কিন্তু এটা আবার এমন একটা সময় যখন আমাদের সামনে প্রচুর সুযোগও রয়েছে। এই সমস্ত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় আমাদের এই সুযোগগুলির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। কংগ্রেস আমাদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছে, ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে সমাজগণতন্ত্রীদের হটিয়ে দিতে হবে এবং সেখানে বিপ্লবী বামপন্থীদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই দায়িত্ব পূর্ণ করার ভার সমগ্র পার্টিকেই নিতে হবে। বর্তমান সময় সেই লক্ষ্যে সুবর্ণ সুযোগ হাজির করেছে, কেননা ক্ষমতার কাঠামোয় অঙ্গীভূত হয়ে পড়ায় সমাজগণতন্ত্রীরা কোথাও গণআন্দোলনের নেতৃত্বে নেই। আর তাই নকশালবাডির সময় থেকেই আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বকে পূর্ণ করার লক্ষ্যে এই সুযোগকে পূর্ণ সদ্ব্যবহারের জন্য আমাদের সর্বশক্তি নিয়ে  এগিয়ে যেতে হবে।

কমরেড,

এছাড়াও সামস্ত সশস্ত্র বাহিনী – তা রণবীর সেনাই হোক বা ঐ ধরনের অন্য কোনো সশস্ত্র বাহিনীই হোক – যারা মনে করে যে বন্দুকের জোরে, খুন ও গণহত্যার মধ্য দিয়ে আমাদের পার্টিকে মুছে দিতে পারবে, তারাও বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসাবে উপস্থিত হয়েছে। পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে তাদের এই উন্মত্ত আক্রমণ তাদের ভবিষ্যৎ, তাদের ক্ষমতার প্রতীক নয়। এগুলি ক্ষয়িষ্ণু শক্তির মরীয়া প্রয়াস মাত্র।

কমরেড,

রণবীর সেনার মতো সামন্ত শক্তিগুলির সশস্ত্র চ্যালেঞ্জের দৃঢ় মোকাবিলার শপথ গ্রহণ করেছে এই কংগ্রেস। কংগ্রেস বারবারই এই সংকল্প ঘোষণা করেছে যে পার্টি তার সমগ্র শক্তিকে সমাবেশিত করে এই ধরনের শক্তিগুলির উপর চূড়ান্ত আঘাত হানবে। এই শক্তিগুলিকে পরাস্ত করতে প্রয়োজনীয় সমস্ত উপায়ই অবলম্বন করতে পার্টি কোনোরকম দ্বিধা করবে না এই সংকল্পও কংগ্রেস নিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ আমরা গ্রহণ করেছি এবং রণাঙ্গনে তাদের পরাজয় আমরা সুনিশ্চিত করবই। অতীতেও অনেক সশস্ত্র বাহিনী মাথা তুলেছিল, কিন্তু জনগণের প্রতিরোধের মুখে কেউই টিকতে পারেনি। আমাদের পরিপূর্ণভাবে এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে নব উদ্ভুত এই সেনারও কোনো ভবিষ্যৎ নেই এবং সিপিআই(এমএল) পরিচালিত গণআন্দোলন এবং জনতার রোষ এই সেনাকে নিশ্চিহ্ন করবে। আমাদের সামনে এটিই হল দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ।

তৃতীয়ত, সমস্ত প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে, যে শক্তিগুলি মানবাধিকারের জন্য লড়ছে তাদের সর্বভারতীয় স্তরের একটি মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ করার সংকল্পও কংগ্রেস নিয়েছে। আমাদের সর্বভারতীয় স্তরের এক যথার্থ গণতান্ত্রিক মোর্চা গড়ে তুলতে হবে। এমনই এক মোর্চা যা প্রকৃত অর্থেই ভারতীয় বিপ্লবের এক যাদুঅস্ত্র হয়ে উঠবে। এই কর্তব্য সম্পন্ন করার নৈতিক অধিকার ও রাজনৈতিক বীক্ষা সিপিআই(এমএল) ছাড়া আর কারুরই নেই।

এই কংগ্রেস আমাদের উপর তিনটি দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তা হল, ভারতীয় বাম আন্দোলনের উপর বিপ্লবী কমিউনিস্টদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা; সামন্ত সেনাদের চ্যালেঞ্জকে সাহসের সাথে মোকাবিলা করা ও তাদের নির্মূল করা; প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি পরিচালিত সংগ্রামগুলি, মানবাধিকার, জাতীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের স্বায়ত্ততা এবং বিভিন্ন দলিত ও পশ্চাদপদ সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রামগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে এক ব্যাপকভিত্তিতে গণতান্ত্রিক মোর্চা গঠন করা। আমার বিশ্বাস এই কর্তব্যগুলি সম্পন্ন করতে এই পার্টি কংগ্রেস সমগ্র পার্টিকে উজ্জীবিত করবে। সবশেষে, পার্টি ও বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের যে শত শত কমরেড তাঁদের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছেন, আমরা যেন তাঁদের ভুলে না যাই।

শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করার এক উপযুক্ত সময় হল এই কংগ্রেস। আসুন আমরা শপথ নিই, আমাদের শহীদদের অসমাপ্ত স্বপ্ন আমাদের চোখে বেঁচে থাকবে। এই স্বপ্ন যতদিন না পূর্ণ হচ্ছে ততদিন আমরা থামব না।

আমাদের শহীদদের স্মৃতি দীর্ঘজীবী হোক!
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!
ইনকিলাব জিন্দাবাদ!