(১৯৭২-এর ২৮ জুলাই কমরেড চারু মজুমদারের শহীদের মৃত্যুকে স্মরণ করে ‘লোকযুদ্ধ’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ। সংক্ষিপ্ত অনুবাদ লিবারেশন সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল)
কমরেড চারু মজুমদার সংশোধনবাদী ও বিপ্লবী পার্টির ক্যাডারদের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যরেখা টেনেছিলেন। যেখানে প্রথমোক্তরা উপর থেকে আসা নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে, শেষোক্তরা নেতৃত্বের দিক থেকে আসা নির্দেশগুলিকে সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ করার জন্য স্বাধীন উদ্যোগ নেয়। এজন্য একজন বিপ্লবী ক্যাডারকে অবশ্যই উদ্যোগী প্রকৃতির হতে হবে এবং তাঁর এলাকার সমগ্র পরিস্থিতির উপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। তবে এক গভীরতর সামাজিক অনুসন্ধান ছাড়া এটি কিছুতেই সম্ভবপর নয়। কমরেড মাও একসময় মন্তব্য করেছিলেন যে তদন্ত ছাড়া কথা বলার কোনো অধিকার নেই। তৃণমূল স্তরে অনুশীলনের সঙ্গে প্রায়শই সংঘাত ঘটে এমন ভাবধারাগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা ছাড়া, প্রত্যেকটি বিষয় (Phenomenon) সম্পর্কেই ‘কী’ এবং ‘কেন’ প্রশ্ন তুলে জিজ্ঞাসা করা ছাড়া, মানবজ্ঞান কেমন করে এগিয়ে যেতে পারে? ‘সব কিছু ঠিক আছে’ – এমন বলা যাদের স্বভাব সেই কমিউনিস্ট ক্যাডারদের দিয়ে তত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে কী করে নতুন মাত্রা অর্জন করা যাবে?
কাজের ধারার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, কেন্দ্রীভূত কাজের ধারা আয়ত্ত করা। আামদের গণআন্দোলনের সীমান্তগুলি লাগাতার সম্প্রসারিত করে চলতে হবে, জাতীয় ও রাজ্য স্তরে সমস্ত সম্ভাব্য রাজনৈতিক উদ্যোগগুলি নিতে হবে। এই সবই বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট ফলাফল যদি অর্জন করতে হয় তাহলে কিছু বিশেষ এলাকায় কাজকে কেন্দ্রীভূত করতে হবে। অন্যথায় সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে এবং অনুশীলনকে কোনো উন্নত মাত্রায় নিয়ে যাওয়া যাবে না।
সম্প্রতি নির্বাচনগুলিতে আমরা দেখেছি, যে সমস্ত এলাকায় কেন্দ্রীভূতভাবে কাজ হয়েছে সেখানে আমরা আগের চেয়ে ভালো ফলাফল করতে পেরেছি। বিপরীতে, যেখানে মাও-এর ভাষায় কাজের ধারা ‘ঘোড়ার পিঠে চড়ে বাগান পরিদর্শনের’ মতো সেখানে আমাদের ফলাফল আরও খারাপ হয়েছে।
আপনি একটি এলাকার বা একটি গণসংগঠনের ভারপ্রাপ্ত হতে পারেন, সেক্ষেত্রে আপনার অনুশীলনে সাধারণ দিকগুলি সহ এক বিশেষ দিক অবশ্যই থাকতে হবে। এই বিশেষ দিকটি হল প্রকৃত অর্থেই আপনার গবেষণাগার যেখানে একজন বৈজ্ঞানিকের মতো আপনি নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার কাজগুলি হাতে নেবেন, আপনার ধারণাগুলিকে প্রয়োগের কষ্টিপাথরে যাচাই করবেন এবং সেখান থেকে আপনার সিদ্ধান্তগুলির সাধারণীকরণ করবেন। এইভাবে সাধারণ থেকে বিশেষ এবং পুনরায় বিশেষ থেকে সাধারণ, এই ধরনের বিজ্ঞানসম্মত কাজের ধারাই হল মার্কসীয় কাজের ধারা।
সাধারণ রাজনৈতিক ও বিক্ষোভ সমাবেশগুলি সংগঠিত করার সাথে সাথে, যারা লাগাতার গণআন্দোলনের প্রক্রিয়াগুলির মধ্য দিয়ে উঠে আসছেন সেই সব নতুন উপাদানগুলির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া, তাঁদের পার্টি শিক্ষা দেওয়া ও পার্টি সংগঠনের আওতায় নিয়ে আসা, তৃণমূল স্তরে তাদের মধ্যে থেকে পার্টির সক্রিয় কর্মীদল গড়ে তোলা ও পার্টি শাখা গঠন করা এবং তাঁদের সক্রিয় করে তোলা – এগুলিই কমিউনিস্ট কাজের ধারার আবশ্যিক অঙ্গ। এই সমস্ত উপাদানগুলি যে কাজের ধারায় অনুপস্থিত সেটি সংশোধনবাদী কাজের ধারা ছাড়া আর কিছুই নয়, যা এই চিন্তার ভিত্তিতেই পরিচালিত হয় যে, আন্দোলনই সব, লক্ষ্য কিছুই নয়। আন্দোলনের সমস্ত সুযোগের বিস্তার ঘটিয়ে চলার সাথে সাথে তৃণমূল স্তরে পার্টি সংগঠনকে সক্রিয় করে তোলা – এই আপাত দুই বিপরীতের ঐক্যই কমিউনিস্ট কাজের ধারার সারবস্তু।
পার্টিকে জাতীয় স্তরে সংগঠিত করা এবং নীচেরতলায় এক শক্তিশালী ও গতিশীল পার্টি পরিকাঠামোর বিকাশ ঘটিয়ে চলার মধ্য দিয়েই কমরেড চারু মজুমদারের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে।