এই সামগ্রিকতায়, আসুন বিচার করা যাক সেই ইতিহাস যা ইতিমধ্যেই তৃণমূল নেতৃত্বাধীন সরকার এ রাজ্যের অষ্টম শ্রেণীর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য পাঠ্যসূচীভু্ক্ত করেছে।
১। ‘জীবিকা, সংস্কৃতি ও গণতন্ত্র’ রক্ষায় যারা ইতিহাস রচনা করলেন তাঁরা হলেন সিঙ্গুরের কৃষক সহ কৃষিমজুর, বর্গাদার, গ্রামীণ মেহনতিরা। সরকারী ইতিহাসে এরাই গৌণ অবস্থানে। মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একথা ঠিক প্রধান বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সমর্থন করায় কৃষকরা বল ভরসা পেয়েছেন। অন্যদিকে তিনি ও তাঁর দল যেভাবে সংগ্রামী কৃষকদের পিছন থেকে টেনে ধরেছেন (২ ডিসেম্বর ও ২ ডিসেম্বর পরবর্তী নির্ধারক ও কঠিন কঠোর দিনগুলিতে), এই আন্দোলনকে যেভাবে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছেন (সিঙ্গুরের মাটি থেকে আন্দোলনকে হাইজ্যাক করে ধর্মতলায় টেনে এনে) তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আন্দোলন। ক্ষমতায় বসে তড়িঘড়ি চমক দিতে যেভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ভুলে ভরা একটি আইন তৈরি করে টাটা গোষ্ঠীকে আদালতের যুদ্ধে অ্যাডভান্টেজ পাইয়ে দিয়েছেন, তার ফলে গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে কৃষক সংগ্রামের ভবিষ্যত। সর্বোপরি, ব্যাপক জনসমর্থন কাজে লাগিয়ে কৃষকদের জয়কে গণআন্দোলনের পথে ছিনিয়ে না এনে তিনি ক্ষমতায় বসেই কৃষক আন্দোলনকে আদালতের চৌহদ্দিতে আটকে দিয়েছেন। সরকারী ইতিহাস এসব তথ্যকেই আড়াল করেছে। কৃষকদের জয়ের রূপকার হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী।
২। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ১৪ ডিসেম্বর সিঙ্গুরের মাটিতে বীজ ছড়ালেন এ কারণে সরকারী পাঠ্যে ‘সিঙ্গুর দিবস’ রূপে চিহ্নিত হয়েছে ১৪ ডিসেম্বর। উপেক্ষিত হয়েছে ২ ডিসেম্বর, যেদিন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের সবধরনের নেতিবাচক পরামর্শ, পিছুটানকে অস্বীকার করে হাজার হাজার কৃষক জনগণ তাদের জমিতে রাজ্য সরকার ও টাটা গোষ্ঠীর বর্গী হানা ঠেকাতে দলে দলে অকুতোভয় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন সিঙ্গুরের অধিগৃহীত জমিতে। উপেক্ষিত হয়েছে ২২ মে যেদিন টাটা গোষ্ঠী ও রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের ঝাঁটা মেরে সিঙ্গুর থেকে বিদায় করেছিলেন সিঙ্গুরের শত শত কৃষক মহিলা। এমনকি উপেক্ষিত হয়েছে ২৫ সেপ্টেম্বর যেদিন হাজারো কৃষকের জমায়েতে পুলিশী অত্যাচার চললে শহীদ হয়েছিলেন কৃষিমজুর যুবক রাজকুমার ভুল। ২ ডিসেম্বর কৃষকরা পালন করেন সিঙ্গুর দিবস, সরকারী ইতিহাস মান্যতা দিক ২ ডিসেম্বরকে।
৩। সিঙ্গুর আন্দোলন পরিচালনায় গড়ে উঠেছিল ‘সিঙ্গুর কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’। পরবর্তীতে এই কমিটির নাম হল ‘কৃষিজমি, জীবন, জীবিকা রক্ষা কমিটি’। তৃণমূল কংগ্রেস, এসইউসিআই, সিপিআই(এমএল)(এনডি), এমকেপি, অনুরাধা তলোয়ারদের ক্ষেতমজুর ইউনিয়ন ইত্যাদি একাধিক সংগঠন মিলে গড়ে ওঠে এই কমিটি। তৃণমূল কংগ্রেস এই কমিটির মূল শক্তি হওয়ায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন বাইরে থেকেই আন্দোলনে লাগাতার হস্তক্ষেপ করত। এছাড়াও ছিল ‘সংহতি কমিটি’। সরকারী ইতিহাসে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ভূমিকাই কেবল উপেক্ষিত নয়, একই উপেক্ষার শিকার কৃষিজমি রক্ষা কমিটি ও এই কমিটির অন্তর্ভুক্ত এসইউসিআই সহ অন্য সংগঠনগুলি। উপেক্ষিত এপিডিআর সহ মানবাধিকার সংগঠনগুলির চমৎকার ভূমিকাও। এই ইতিহাস এমনকি কৃষিজমি রক্ষা কমিটির অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছে। স্বভাবতই এই উপেক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সর্বভারতীয় সংবাদপত্রগুলি।