সাম্প্রতিক সময়ে শিল্পায়নের নামে কৃষিজমি দখলের বিরুদ্ধে কৃষক প্রতিরোধের অন্যতম নাম সিঙ্গুর। ২২ মে ২০০৬ কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে সরেজমিনে জমি দেখতে আসা সরকারী আধিকারিক সহ টাটা কোম্পানির প্রতিনিধিদের ঝাঁটা হাতে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করেছিলেন কৃষিজীবী মহিলা-পুরুষরা। প্রতিবাদের এই একুশ শতকী বজ্রনির্ঘোষে চমকে উঠেছিল গোটা দেশ। অনেক লড়াই, অনেক আত্মত্যাগের এক দশক পর ৩১ আগস্ট ২০১৬ এদেশের সুপ্রীম কোর্টেও মান্যতা পেল এই আন্দোলনের ন্যায্যতা। আলোড়ন ফেলা রায়ে আদালত জানাল, সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ অবৈধ ছিল, নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে তিন মাসের মধ্যে পূর্বাবস্থায় ৯৯৭.১১ একর কৃষিজমি কৃষকদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে। কৃষকরা ইতিমধ্যে জমির দলিলপত্র ফিরে পেয়েছেন। একাংশে ফসল উৎপাদনও শুরু হয়েছে। যদিও মূল কারখানা যে জমিতে নির্মিত হয়েছিল, সেই অংশ এখনও চাষযোগ্য করতে পারেনি সরকার। সব মিলিয়ে গণআন্দোলনের ক্ষমতা ও তাৎপর্য বিষয়ে সিঙ্গুর এক চমৎকার উদাহরণ।
২০০৬ সালের ১৮ মে এক প্রেস বিবৃতিতে টাটা গোষ্ঠী জানিয়েছিল যে সিঙ্গুরে তারা একলাখি ন্যানো মোটর গাড়ির কারখানা গড়বে। রাজ্য মন্ত্রীসভা বা রাজ্য বিধানসভা কেউই জানত না এই সিদ্ধান্তের কথা। ৩১ মে রাজ্য মন্ত্রীসভা সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২ বছরের অধিক সময়ের কৃষক আন্দোলন চলে। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর টাটা গোষ্ঠী প্রেস বিবৃতিতে জানায় তারা সিঙ্গুর প্রকল্প সরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছে। ২৬ সেপ্টেম্বর রাজ্য মন্ত্রীসভা টাটাদের সিঙ্গুর ছেড়ে ‘চলে না যাওয়ার’ আর্জি জানায়। ৩ অক্টোবর রতন টাটা প্রেস কনফারেন্সে সিঙ্গুর পরিকল্পনা‘পরিত্যক্ত’ বলে ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময়ে প্রায় ৮ বছর শুধুমাত্র অাদালতে মামলা ঝুলে থাকার পর ৩১ আগস্ট ২০১৬ সুপ্রীম কোর্টের রায়ে কারখানা ভেঙ্গে কৃষকদের জমি ফেরতের নির্দেশ দেওয়া হয়।
বিস্তৃত এলাকা জুড়ে নির্মিত আস্ত একটা কারখানা ভাঙার বিরুদ্ধে ছিলেন কেউ কেউ। সিঙ্গুরে কৃষিজমিতে শিল্প স্থাপনের পক্ষে যারা, স্বভাবতই তারা ছিলেন কারখানা ভাঙার বিরুদ্ধে। এমন কিছু মানুষও ছিলেন, যারা কারখানা না ভেঙে এবং অতীত তিক্ততা ভুলে কোনো একটা সমাধানে আসার পক্ষপাতী ছিলেন। অন্যদিকে ছিলেন কৃষক জনগণ ও গণতন্ত্র সচেতন অসংখ্য মানুষ, যারা বন্দুকের ডগায় নির্মিত রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট বহুজাতিকের এই বলদর্পী নির্মাণ ভেঙে দেওয়ার মধ্যে শেষপর্যন্ত ‘শুভের জয় ও অশুভর পরাজয়’কে প্রত্যক্ষ করলেন।
বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিঙ্গুর আন্দোলনকে ২০১৭ বর্ষ থেকে অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যসূচীভুক্ত করেছে। ‘সমকালীন ইতিহাসের’ এই পাঠ্যসূচীভুক্তির সমর্থক বহু মানুষ; বিরোধীরাও আছেন। এ রাজ্যের অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাসে তেভাগা আন্দোলন, তেলেঙ্গানার সংগ্রামকে পাঠ্যভুক্ত করেছিল পূর্বতন বাম সরকার। খাদ্য আন্দোলন ও নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রামকে পাঠ্যসূচীভুক্তির দাবি থাকলেও তৎকালীন সরকার বিবেচনা করেনি। পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল “বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ” নকশালবাড়ি। দেশকে দারিদ্র-বঞ্চনা-শোষণ মুক্ত করতে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল নকশালবাড়ির আন্দোলনে। একদিকে কৃষকদের জাগরণ অন্যদিকে হাজার হাজার ছাত্র-যুব এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন নতুন ভারতবর্ষ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে। এই আত্মাহুতি ঘিরে রচিত হয়েছে হাজারো নাটক, কাব্য-গান। আজও নকশালবাড়িকে নিয়ে সাংস্কৃতিক সৃজন অব্যাহত। পূর্বতন বাম আমলে অবশ্য পাঠ্যসূচীভুক্ত হয়নি এই কৃষক জাগরণ, গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান। সম্ভবত রাজনৈতিক কারনেই।
ইতিহাসের স্রষ্টা জনগণ। কৃষক জনগণের সিঙ্গুর আন্দোলনের পাঠ্যসূচীভুক্তি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত। কিন্তু যেভাবে এই ইতিহাসকে উপস্থাপিত করা হয়েছে, তা “ইতিহাস বিকৃতি ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতার অন্যতম নিদর্শন” বলে অভিযোগ উঠেছে। নন্দীগ্রাম কেন সিঙ্গুরের সাথে অন্তর্ভুক্ত হল না সঙ্গতভাবে সে প্রশ্নও উঠেছে। একদল আছেন যারা সিঙ্গুরের এই স্বীকৃতির ঘোর বিরোধী। বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই সিঙ্গুরে কৃষক উচ্ছেদ করে টাটা গোষ্ঠীর কারখানা নির্মিত হয়। সম্ভবত সিপিএমের অনেকেই চান কৃষক জনগণের সাথে দলের এই বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসকে আড়ালে রাখতে। ঐ দলের গণসংগঠন এবিটিএ সিঙ্গুরের পাঠ্যসূচীর বিরোধিতায় জনমত সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। গত ৯ মার্চ ২০১৭ এবিটিএ নেতৃত্ব এই উদ্দেশ্যে মৌলালী যুব কেন্দ্রে এক কনভেনশনও সংগঠিত করেন। ইতিমধ্যে এ রাজ্য আলোড়িত ভাঙড় ও ভাবাদিঘীর কৃষক আন্দোলনে। বিরোধী দল সিপিএম নতুন পর্বের এই কৃষক আন্দোলনগুলোর সাথে নিজেদের যুক্ত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালাচ্ছে। এ সময় সিঙ্গুর আন্দোলন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি তাদের রাজনৈতিক
স্বার্থের অনুকূলে নয়, কারণ সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠবে ভাঙড়-ভাবাদিঘীর কৃষক আন্দোলন যদি ন্যায়সঙ্গত হয়, সিঙ্গুরের কৃষকরা সেদিন কোন অপরাধ করেছিলেন “জীবিকা-সংস্কৃতি-গণতন্ত্র” রক্ষায় পথে নেমে। পরিস্থিতি এভাবেই উন্মোচিত করে স্ববিরোধিতা।
কৃষক আন্দোলনের অভিঘাতে ক্ষমতা হারানো সিপিএম পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে ও জনমনে হারানো বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পেতে ‘ভুল স্বীকার’ করে। সিপিএম দলের কেন্দ্রীয় দলিলে উল্লিখিত হয়, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনায় গোটা দেশে পার্টির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রভাত পট্টনায়ক, অশোক মিত্রের মতো পার্টির ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা সিঙ্গুরে বাম সরকারের ভূমিকায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ভুল স্বীকার করলেও পার্টি নেতৃত্বের স্বীকারোক্তি নীতিগত নয় কেবল বহিরঙ্গে, এটা আবার স্পষ্ট হল সিঙ্গুর নিয়ে এবিটিএ-র অবস্থানে। এই ভাঙড়-পর্বেও এরা মনে মনে বিশ্বাস করে যে অঙ্গরাজ্যের অধীশ্বর বামফ্রন্ট সরকার ‘মহান’ উদ্দেশ্যেই সিঙ্গুরে কৃষক উচ্ছেদ চেয়েছিল, কৃষকদের আত্মত্যাগে এগোত দেশ। একটু ধৈর্য্য ধরে করলে সিঙ্গুরের উচ্ছেদ কৃষকদের ভালোর জন্যই হত। আশ্চর্য স্ববিরোধিতা। আজও কেন জনগণ সিপিএম-কে বিশ্বাস করতে পারছে না, এর উৎসও সম্ভবত এখানেই।