ইতিহাস বই গৌরবান্বিত করেছে টিএমসির ভুমিকাকে, উপেক্ষিত বিরোধী অন্যান্য মুখ্য আন্দোলনকারীরা
“সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশ যা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিঙ্গুর অবস্থানকে বৈধতা দিয়েছে, সেই নির্দেশের ৬ মাস আগেই সিঙ্গুরে তৃণমূল কংগ্রেসের নানা সাফল্যের বিবরণ সমৃদ্ধ অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস রাজ্যের সর্বত্রই শ্রেণীকক্ষে পৌঁছে গিয়েছে। অথচ এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, এসইউসিআই সহ অন্যরা যারা বর্তমানে মমতা বিরোধী -- তাদের ১০ পৃষ্ঠার সিঙ্গুর অধ্যায় থেকে আশ্চর্যজনকভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। ... ... অধ্যায়টির শিরোনাম ‘জমি, জল, জঙ্গল : জীবন জীবিকার অধিকার ও গণঅান্দোলন’-এর কেন্দ্রবিন্দুতে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই সিঙ্গুরে মমতার ভূমিকা। সিঙ্গুরের উপর ৬টি পৃষ্ঠার ৫টিতে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি, বাকি ৪ পৃষ্ঠায় তেভাগা, তেলেঙ্গানা, চিপকোর মতো আন্দোলনের বর্ণনা রয়েছে।” – ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭
বিপ্লবী বামপন্থার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রেখেই সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সিঙ্গুর আন্দোলনে হস্তক্ষেপ করে। কৃষিজমি রক্ষা কমিটিতে তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিপত্যের কারণে এই কমিটির মধ্যে স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখা সম্ভব নয়, এটা বুঝেই কমিটির অন্তর্ভুক্ত হয়নি সিপিআই(এমএল)। বাইরে থেকেই স্বাধীনভাবে আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকে এবং কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে ভূমিকা রাখে। এই অবস্থানকে সেদিন কেউ কেউ বাম সংকীর্ণতাবাদ বলে চিহ্নিত করেন। সেদিন যারা সিপিএমের মধ্যে ‘সামাজিক ফ্যাসিস্ট’ শক্তিকে প্রত্যক্ষ করে মমতা ব্যানার্জীদের হাত ধরতে দ্বিধা করেননি, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তাঁরাই আজ মমতা ব্যানার্জীর মধ্যে সেই ফ্যাসিস্টকেই প্রত্যক্ষ করছেন – কেবল সিঙ্গুরের বদলে ভাঙড়ে।
১। এটা ঠিক যে পরিস্থিতি সব সময় সোজাসাপটা থাকে না। উদ্ভুত পরিস্থিতির জটিলতায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সংগ্রামের ময়দানে কৃষকদের সাথে এক থেকেও তার নিজের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা একই সাথে রক্ষা করেছিল।
২। জমি রক্ষা কমিটির বাইরে থেকে কৃষক আন্দোলনে ধারাবাহিক হস্তক্ষেপের কাজটি খুব সহজ সরল ছিল না। কৃষক জনগণ সহ গ্রামীণ মেহনতিদের সাথে সংগঠনের একাত্মতাই কঠিন কাজকে অনেকাংশে সহজ করে দেয়। প্রথম থেকেই সিপিআই(এমএল) সংগঠকদের কয়েকজন নীরব পরিকল্পনায় কাজটি এগিয়ে নিয়ে যান।
কৃষকদের সবচেয়ে কঠিন দিনগুলিতে সিপিআই(এমএল) সর্বদা কৃষকদের পাশে ছিল। ১৮ মে ২০০৬ টাটাগোষ্ঠী সিঙ্গুরে কারখানা গড়ার কথা প্রেস বিবৃতিতে জানায়। ২২ মে সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত খবরটি মহিলাদের প্রতিরোধে আরও সামনে আসে। দ্রুতই সিপিআই(এমএল)-এর গণসংগঠন এআইএএলএ এবং আইপোয়া অধিগ্রহণের প্রতিবাদে ৩০ মে চূঁচূড়ায় জেলাশাসকের কাছে ডেপুটেশন দেয় এবং কৃষকদের মনোবল যোগাতে ৪ জুন সিঙ্গুরে পদযাত্রা সংগঠিত করে। এরপর ২২ জুন সিঙ্গুর স্টেশন চত্বরে ১২ ঘণ্টা ব্যাপী গণঅবস্থান ও বিডিও ডেপুটেশন কর্মসূচীর ডাক দেয়। ৯ জুলাই ৩ বিপ্লবী কমিউনিস্ট সংগঠন – সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, কানু সান্যালের নেতৃত্বাধীন সিপিআই(এমএল) এবং সিপিআই(এমএল) এনডি যৌথভাবে সিঙ্গুর পদযাত্রা করে। এই তিন সংগঠন ১৮ আগস্ট স্টুডেন্টস হলে গণকনভেনশন সংগঠিত করে। পরবর্তী ৩ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদ সিঙ্গুরে পদযাত্রা ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচী গ্রহণ করে। ২ দিন পরই ৫ সেপ্টেম্বর তিন শ্রমিক সংগঠন – এআইসিসিটিইউ, আইএফটিইউ এবং মজদুর ক্রান্তি পরিষদ সিঙ্গুরে যৌথভাবে পদযাত্রায় অংশ নেয়। এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর হাজার হাজার সমর্থক জনগণকে সামিল করে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সিঙ্গুর অভিযান করে। কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থক, আন্দোলনকারী কৃষকদের সমাবেশে সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এবং তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক কার্তিক পাল সহ নেতৃবৃন্দ সিঙ্গুরে টাটাগোষ্ঠীর ও বাম সরকারের জমিখেকো আঁতাত রুখে দিতে সিঙ্গুরের কৃষকদের হিম্মতকে সাবাশ জানান।
এরপর ঘটে ২৫ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। কৃষিজমি রক্ষা কমিটির ডাকে কয়েক হাজার কৃষক ঐদিন সিঙ্গুর বিডিও অফিসে ধর্ণায় বসেছিল। ভোররাতে পুলিশী সন্ত্রাস নেমে আসে। শহীদ হন কৃষিমজুর যুবক রাজকুমার ভুল। প্রতিবাদে ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর টানা কর্মসূচী গ্রহন করে সংগঠন। ২৬ সেপ্টেম্বর গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের সংহতি জানায় সিপিআই(এমএল) প্রতিনিধি দল। ২৭ সেপ্টেম্বর সিপিআই(এমএল) ও এসইউসিআই সিঙ্গুর বনধ সংগঠিত করে। ২৮ সেপ্টেম্বর জেলাশাসক দপ্তরের সামনে ১২ ঘণ্টার গণঅবস্থান চলে। ঐদিনই বিপ্লবী কমিউনিস্ট সংগঠনগুলির নেতৃবৃন্দ সংগ্রামী কৃষকদের সাথে গ্রামে এবং হাসপাতালে সাক্ষাত করেন। জেলবন্দিদের সাথেও দেখা করেন। ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর এআইএসএ সংগঠকরা সিঙ্গুরের বাড়ি বাড়ি প্রচার সংগঠিত করেন। ১ অক্টোবর ‘পিপলস হেলথ’ ও ‘উৎস মানুষ’-এর চিকিৎসকরা আহত কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা করেন। ২ অক্টোবর শহীদ রাজকুমার ভুলের শহীদ স্মরণ কর্মসূচীতে সামিল হয় এআইএসএ। এই পর্বে ৯ অক্টোবর সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, সিপিআই(এমএল) নিউ ডেমোক্রেসি ও কানু সান্যাল নেতৃত্বাধীন সিপিআই(এমএল)-এর ডাকে সফল হয় বাংলা বনধ।
৩। 'অপারেশন বর্গা’র পার্টি সিপিএম নেতৃত্বাধীন সরকার ১৮৯৪ সালের অাইন অক্ষরে অক্ষরে মেনেই সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের পথে এগোচ্ছিল। ফলে জমির মালিকরা ক্ষতিপূরণ পেলেও জমিতে বর্গাদারদের অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বর্গাদারদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কৃষিমজুর সমিতি ও কৃষক সমিতি সহ যুব সংগঠন আরওয়াইএ ও ছাত্র সংগঠন এআইএসএ-র উদ্যোগে বাজেমেলিয়ার দরিদ্র বর্গাদার জয়দেব মালিককে দিয়ে অধিগৃহীত জমিতে লালঝাণ্ডা পোঁতা হয়। অধিগৃহীত জমিতে বর্গাদারদের প্রতীকি অধিকার প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগ ব্যাপক প্রচার পায়। শাসকদলের মধ্যেও ‘অপারেশন বর্গার পার্টির ভাবমূর্তি রক্ষা’ সংক্রান্ত সংকট তৈরি হয়। সরকার তড়িঘড়ি বর্গাদারদের জন্য ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ ঘোষণা করলেও অনথিভু্ক্ত বর্গাদারদের অস্বীকার করা হয়।
দৈনিক স্টেটসম্যান কাগজে মহাশ্বেতা দেবী লিখলেন -- ‘সিঙ্গুরে আনরেকর্ডেড বর্গাদাররা কিছুই পাবেন না, কেননা তাঁদের কোনো আইনগত স্বীকৃতি নেই। সংখ্যায় এরা বেশি, আর রেকর্ডেড বর্গাদাররা সংখ্যায় কম। ১৮৯৪-এর ব্রিটিশ প্রণীত আইনের পর ‘কৃষক’ নামটি ক্যাশ করে রাজ্য সরকার ‘তেভাগা’ প্রমুখ অনেক কৃষক আন্দোলনের ফসল ঘরে তুললেন, ক্ষমতা প্রতিপত্তি ইত্যাদি কত না তুলে নিজেরা অবস্থা গোছালেন, কিন্তু ভূমিসংস্কার শব্দটি ক্রমেই বিফল হল। বর্গাদারদের অতি অল্প অংশ কিছুটা পেল, অন্যদের অবস্থা?’
৪। জমি দখলের লক্ষ্যে সরকারী তৎপরতা বাড়তে থাকলে সারা ভারত কৃষিমজুর সমিতি ও পশ্চিমবঙ্গ কৃষক সমিতি জমি পাহারায় কৃষকদের উৎসাহিত করতে গোপালনগর বারো হাত কালিতলা মাঠে ক্যাম্প খুলে ৭ নভেম্বর থেকে অবস্থানে থাকে। এই ‘জমি বাঁচাও, কৃষি বাঁচাও’ ক্যাম্পের আদলে অন্যান্য গ্রামগুলিতে ক্যাম্প সংগঠিত করে কৃষক জনগণ। প্রতিরোধের লক্ষ্যে কৃষকদের প্রস্তুতি বাড়তে থাকে। এই সময় কৃষকদের আরও সংহত করতে এআইএএলএ ক্যাম্প সংলগ্ন মাঠেই সংগঠিত করে জনশুনানি।
৫। ২৯ নভেম্বর আন্দোলনরত গ্রামগুলি থেকে দুরে একটি বড় জনসভা সংগঠিত করে সিপিএম। জমি দখলের প্রস্তুতিতে এরপরই সরকার ঘোষণা করে সিঙ্গুর জুড়ে ১৪৪ ধারা, ‘বহিরাগত’দের সিঙ্গুর প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জী এসময় সিঙ্গুর এবং কলকাতা থেকে অনেক দূরে দলীয় কর্মসূচীতে। সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সিপিআই(এমএল) রাজ্য সংগঠকদের কয়েকজন ও এআইএসএ নেতৃত্ব সিঙ্গুরে ১ ডিসেম্বরেই সমবেত হন। কৃষকদের সংগঠিত করেন। ২ ডিসেম্বর তৃণমূল নেতারা কৃষকদের প্রতিরোধ আন্দোলনে নামা দেখে পিছিয়ে আসতে পরামর্শ দেন। এসত্ত্বেও সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সহ এপিডিআর ও অন্য কিছু গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে হাজার হাজার কৃষক সরকারী বাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, গ্রেপ্তারবরণ করেন তপন বটব্যাল, রাংতা মুন্সীরা।
৬। ১৮ ডিসেম্বর ছিল আর এক কঠিন দিন। ধর্ষণ করে নিষ্ঠুরভাবে পুড়িয়ে মারা হয় আন্দোলনের মুখ তাপসী মালিককে। সেদিনও ছিলেন না তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ। গ্রামের মানুষ বিশেষত মহিলাদের একত্রিত করে এসইউসিআই সংগঠকরা এবং সিপিআই(এমএল)-এর মহিলা সংগঠন আইপোয়ার রাজ্য নেত্রী চৈতালী সেন প্রমুখের উদ্যোগে বিশাল প্রতিবাদ মিছিল দেখল সিঙ্গুর। সামিল হন সমাজকর্মী মধুছন্দা কার্লেকর সহ আরও অনেকে।
৭। ১৪৪ ধারা জারি ছিল সিঙ্গুরে। কৃষকদের সমস্ত প্রতিবাদ উপেক্ষা করে পুলিশী প্রহারায় পাঁচিল ঘেরা জমিতে কারখানার নির্মাণকাজ শুরু করে টাটা গোষ্ঠী। প্রতিরোধ কর্মসূচী গ্রহণ করে সিপিআই(এমএল), সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে। কর্মসূচীতে নেমে আসে পুলিশী দমন অভিযান, লাঠিচার্জ। সিপিআই(এমএল) সাধারণ সম্পাদক জমি দখল পূর্ববর্তী ১৪ সেপ্টেম্বরের হাজারো পার্টি সমর্থক ও কৃষক জনগণের সিঙ্গুর অভিযান কর্মসূচীতেও নেতৃত্বে ছিলেন। পরবর্তীতে জমি ফেরতে সুপ্রীম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে সংগঠিত ‘সিঙ্গুর চলো’ কর্মসূচীতেও নেতৃত্ব দেন সাধারণ সম্পাদক। নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির গর্ভেই জন্ম সিপিআই(এমএল)-এর। এ কারণেও সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সহ পার্থ ঘোষ, কার্তিক পালরা বারবার সিঙ্গুর পৌঁছেছেন – আন্দোলনে এবং সংহতি উদ্যোগে।