সিঙ্গুরের কৃষক আন্দোলনকে ব্যবহার করে কৃষকদরদী সেজেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। ৩১ আগস্ট ২০১৬, সর্বোচ্চ আদালত কারখানা ভেঙ্গে জমি কৃষকদের ফিরিয়ে দিতে বলার ৬ মাসেরও কম সময়ে এ রাজ্যের বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে পৌঁছে গেছে অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস বই। এই পাঠ্যপুস্তকটিতে সংযোজিত হয়েছে সিঙ্গুর অধ্যায়, যার সিঙ্গুর সংক্রান্ত আলোচনার মোট ছয় পৃষ্ঠায় মুখ্যমন্ত্রীর ছবি পাঁচটি। এই ইতিহাসে উপেক্ষিত হয়েছেন সংগ্রামী কৃষকরা, উদ্ভাসিত হয়েছেন মমতা ব্যানার্জী ও তাঁর অনুগতরা। সিঙ্গুর আন্দোলনের বহু বর্ণের, বহু মাত্রার ইতিহাসকে তৃণমূলী রং-এ রঞ্জিত করে উপস্থাপিত করেছেন মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্যরা।
এ প্রসঙ্গে আসুন স্মরণ করি সিঙ্গুরকেই।
২০০৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুরে এক জনসভায় সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “... তাঁরা নেতারা ভেবেছিলেন, এখানে শিল্পপতিদের জমি দিতে গেলে কেউ বিরোধিতা করবে না, কেউ শব্দ করবে না। কিন্তু তাঁদের ‘থ’ বানিয়ে দিয়ে সিঙ্গুরের কৃষকরা শব্দ করছেন। সিঙ্গুরের কৃষকদের উপর অত্যাচার চালালে শুধু রক্তগঙ্গা বইবে না, যে রক্তস্রোতের সৃষ্টি হবে তাতে বামফ্রন্ট সরকার ভেসে যাবে, রাইটার্সের লালবাড়ি ভেসে যাবে।” বাস্তবে এটাই ঘটেছিল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতোই সিঙ্গুরের এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে নারাজ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীও। এ কারণে সিঙ্গুরের প্রকৃত ইতিহাসকে তিনি আড়াল করতে চাইছেন, বিকৃতভাবে উপস্থাপিত করতে চাইছেন। অন্যদিকে ভাঙড়ে আন্দোলনকারী কৃষকদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন ইউএপিএ সহ অসংখ্য ধারায় মিথ্যা মামলা। আরাবুল, সব্যসাচীদের পাঠিয়ে হত্যা করছেন মফিজুল, আলমগীরদের। সিঙ্গুরের ইতিহাস আজ এভাবে ভাঙড়-পর্বে প্রবেশ করেছে।
সিঙ্গুরের প্রতারণা, ভাঙড়ের প্রতারণার এই পথ ধরেই বাংলা আজ নতুন বর্গী হামলার মুখোমুখি। বিজেপির এই নয়া বর্গীরা রাম-রহিমে যুদ্ধ বাধাতে চায়। কৃষক ঐক্যের বাতাবরণে ফাটল ধরাতে চায়। নতুন জমি অধিগ্রহণ আইন ২০১৩-তে কৃষকরা রক্ত-ঘামের বিনিময়ে যেটুকু অধিকার ছিনিয়ে এনেছে, এদেরই কেন্দ্রীয় স্তরের নেতারা সেটুকুও খারিজ করতে চায় – এই অশুভ উদ্দেশ্যে দফায় দফায় অর্ডিন্যান্স জারি করে। এরাই নতুন ভূমি আইন বাতিলের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সংসদে।
জটিল এই প্রেক্ষাপটে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার দায়বদ্ধতা অনুভব করি আমরা। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই এই পুস্তিকার পরিকল্পনা।