প্রাণবন্ত এই কৃষক আন্দোলন, কৃষক ঘরের মহিলাদের বিপুল সংখ্যায় জানকবুল উপস্থিতি, কৃষক আন্দোলনের সপক্ষে সুমিত সরকার, তনিকা সরকার, অরুন্ধতী রায়, অরুণা রায়, অপর্ণা সেন, বিভাস চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবীর মতো বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীদের অবস্থান; এমতো নানা কারণে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রবল বিতর্ক। আন্দোলন ও বিতর্ক প্রসারিত হয়েছিল দেশব্যাপী। পশ্চিমবঙ্গ প্রত্যক্ষ করেছিল নন্দীগ্রাম, লালগড়ের কৃষক জাগরণ। এ সময়ই দেশের অন্যত্র দেখা দিয়েছিল কলিঙ্গনগর, দাদরি, রায়গড়ের কৃষক আন্দোলন। দেশজুড়ে উথাল-পাথাল করা এই কৃষক আন্দোলনের ঢেউ-এ পিছু হটতে হয়েছিল কংগ্রেস পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারকে। পরিণতিতে ২০১১ সালে বাতিল হয়েছিল ১১৭ বছরের পুরনো ঔপনিবেশিক আমলে রচিত কৃষক বিরোধী ১৮৯৪ সালের ভূমি অধিগ্রহণ আইন। রচিত হল ২০১৩ সালের নতুন ভূমি অধিগ্রহণ আইন যা কার্যকর রয়েছে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারী থেকে।
ঊনিশ শতক জুড়ে এদেশের আদিবাসী কৃষক জনতার ধারাবাহিক বিদ্রোহের চাপে ঔপনিবেশিক শাসকরা আদিবাসী এলাকার জন্য বিশেষ ভূমি আইন রচনা করতে বাধ্য হয়েছিল। আজ একুশ শতকে স্বাধীন দেশের শাসকরা বাধ্য হল ভূমিস্বত্বে কৃষকদের অধিকারকে বেশ কিছুটা মান্যতা দিতে। ১৮৯৪ সালের আইনটি নামে ছিল কেবলমাত্র অধিগ্রহণ আইন। নতুন আইনের নামে যু্ক্ত হল ‘যথাযথ ক্ষতিপূরণ’, ‘পুনর্বাসন ও পুনঃস্থাপন’ শব্দগুলি। পূর্ববর্তী আইনটিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কোনো প্রতিক্রিয়াকেই গুরুত্ব দেওয়া হত না। ‘জরুরি ধারা’র প্রয়োগে শাসকবর্গ যা ইচ্ছা করতে সক্ষম ছিল। ক্ষতিপূরণের হার ছিল বেশ নিম্ন। পূর্ববর্তী আইনে জমিকে সম্পদ রূপে না দেখে, দেখা হয়েছিল নিছক পণ্য রূপে। জমির মালিক ছাড়াও ওই জমিতে নির্ভরশীল অকৃষক মেহনতিদের গুরুত্ব দেয়নি পূর্বতন আইন। এসব কারণে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি গণপত সিংভি ১৮৯৪ সালের আইনকে ‘প্রতারণায় পরিণত’ হয়েছে (become a fraud) বলেছিলেন।
বর্তমানে কার্যকর ভূমি আইনটি অধিগৃহীত জমির উপর নির্ভরশীল কৃষিমজুর, বর্গাদার, মেহনতিদের অধিকারকে মেনে নিতে বাধ্য হল। কেবলমাত্র আর্থিক ক্ষতিপূরণ নয়, জমির বদলে জমি, বাসস্থান, চাকরি, অ্যানুইটির কথাও উল্লেখ করতে হল আইনে। বেসরকারী ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত এবং সরকারী-বেসরকারী পিপিপি মডেলের যৌথ উদ্যোগে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত জমি মালিকের সম্মতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক আজকের ভূমি আইনে। এমন ধারাও আইনি স্বীকৃতি পেয়েছে, অধিগৃহীত জমি ফেলে রাখলে ৫ বছর পর পূর্বতন মালিককে ফিরিয়ে দিতে হবে। আইনটির তাৎপর্যপূর্ণ ধারা হিসাবে ‘সামাজিক প্রভাব পরিমাপ’ সংক্রান্ত ধারাটি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষেত্রে এক ধরনের রক্ষাকবচ, অন্যদিকে শিল্পগোষ্ঠীর কাছে সামাজিক প্রভাব পরিমাপ বা এসআইএ (SIA) নামক ধারাটি ‘লালফিতের বাঁধন’ স্বরূপ।
সবমিলিয়ে বলা যায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-কলিঙ্গনগরের কৃষক আন্দোলন কৃষকদের সপক্ষে বেশ কিছু দাবিতে আইনি স্বীকৃতি আনতে সক্ষমতা দেখিয়েছে। এ কারণেই দেশী-বিদেশী শিল্পগোষ্ঠীর চাপে দিল্লীর বর্তমান বিজেপি সরকার নতুন ভূমি অধিগ্রহণ আইনটি বাতিল করতে, নিদেনপক্ষে সংশোধন করতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই অর্ডিন্যান্স জারি করে আইনটি বাতিল করার চেষ্টা চলেছে। যদিও প্রচেষ্টাগুলি এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। তবে কৃষকদের নতুনভাবে অর্জিত অধিকারগুলি কেড়ে নিতে বিল তৈরি হয়েছে এবং সংসদে পেশ করা হয়েছে, সঠিক সময়ে পাশ করার অপেক্ষায়।
একই সাথে একথাও স্মরণে রাখা ভালো যে নতুন আইন কার্যকর থাকা সত্ত্বেও ২০১৩ সালে ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রিড গড়ার নামে কৃষকের জমি কেড়ে নিতে নোটিশ জারি হয়েছে। হুগলীর ভাবাদিঘিতে রেলের প্রকল্প গড়ার নামে দিঘির উপর নির্ভরশীল মানুষদের স্বার্থহানি করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে শাসকরা।