“ক্ষমতা এমন ভাব করবে যেন যারা ক্ষমতার অন্যদিকে, যারা সাধারণ তাদের মঙ্গল তারা ভাবতে পারে না,তাদের মঙ্গল একমাত্র ভাবতে পারে যারা ক্ষমতায় থাকে তারা, শুধুই তারা, ক্ষমতায় থাকারাই ঠিকঠাক ভেবে নেয়”   ---- শুভেন্দু দাশগুপ্ত

চলমান কৃষক আন্দোলন কিভাবে সর্বব্যাপী বিতর্ক ডেকে আনে, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সংকটগ্রস্ত করে তোলে, তার চমৎকার উদাহরণ সিঙ্গুর। সরকারী বামরা বলেছিল ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। পাশাপাশি এই যুক্তিও ছড়ানো হয়েছিল, কৃষি যেহেতু লাভজনক নয়, সেকারণে কৃষি থেকে সরিয়ে মানুষকে শিল্পক্ষেত্রে আনতে হবে। এই যুক্তি প্রসারিত হতে হতে ক্রমে এই দর্শনে পৌঁছেছিল, ‘শিল্পের জন্য কৃষক উচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী’। শেষমেষ তারা এই একুশ শতকে ‘লগ্নি পুঁজির মধ্যে প্রগতিশীলতা’ খুঁজে পেয়েছিল। এই যুক্তি বিকৃত হয়েছিল বিনয় কোঙারের উপস্থাপনায়। ব্যাঙ্কে সুদ বেশি এই যুক্তিতে জমি বেচে কৃষকদের ব্যাঙ্কে টাকা রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন ঐ কৃষক নেতা। এরপর নির্মীয়মান প্রকল্পে ‘গার্হস্থ্যকর্মীর’ কাজে ঢুকে পড়তে কৃষকদের পরামর্শ দেন বিনয়বাবু। তোতা পাখির মতো আরও কিছু বামপন্থী কর্মী বলতে শুরু করেছিলেন, ‘গ্রাম থেকে শহর, কৃষি থেকে শিল্প’ – এটাই তো অগ্রগতি।

এমতো সব মন্তব্য বাম অচলায়তনে ডেকে এনেছিল তীব্র সামাজিক বিতর্ক। পাল্টা যুক্তিতে বলা হয়েছিল, ‘কৃষি ও শিল্পে জমির ব্যবহারের ভবিষ্যত ঠিক কেমন, তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু যাঁরা নীতি নির্ধারণ করছেন তাঁরা যদি শুরুতেই ভেবে রাখেন যে, উন্নয়নের বিচারে কৃষির চেয়ে শিল্প উঁচুতে, গ্রামের থেকে শহর এগিয়ে, তা হলে বুঝতে হবে উন্নয়নকে তাঁরা নতুন করে, নিজেদের মতো করে ভাবতে রাজি নন। বুঝতে হবে, যাঁরা কথায় কথায় পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন, তাঁদের চিন্তায় পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের নিরঙ্কুশ শাসন। সেটা দুর্ভাগ্যজনক নয় কি?’ (অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়, প্রবন্ধ – কৃষি থেকে শিল্প – গ্রাম থেকে শহর)। সব দেখেশুনে অশোক মিত্র প্রশ্ন তুললেন, “আমাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব, আমাদের আদর্শগত ব্রত তিমিরবরণ নয়, তিমিরহনন। জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতার কথা প্রায়ই মনে হয় আমার। তিমিরহননের অভিযানে নেমে আমরা কি হঠাৎ লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছি, তিমিরবিনাশীর ভূমিকা ভুলে হঠাৎ তিমিরবিলাসী বনে যাচ্ছি?”

বিশ্ব পুঁজিবাদের সাম্প্রতিক চরিত্র ও রূপ সম্পর্কে যারা বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল তাঁরা জানেন সাম্রাজ্যবাদী অর্থব্যবস্থায় লগ্নি পুঁজি তার সেই ‘প্রগতিশীল’ চরিত্র বহুদিন আগেই খুইয়ে বসে আছে। ডিএফআইডি, এডিবি বা সালিম-সিপুত্রা গোষ্ঠীর টাকায় যে শিল্পায়ন ও উন্নয়নের গল্প শোনানো হচ্ছে সেই পুঁজি পুঁজিবাদ-সামন্তবাদের গাঁটছড়াকে দুর্বল করে না, বরং তাকে নতুন রূপে আরও সংহত করে, শক্তিশালী করে। মুকেশ বা অনিল আম্বানিদের ‘প্রগতিশীলতায়’আপ্লুত কোনো বামপন্থী নেতা যদি ভেবে থাকেন এখানে ওখানে দু-চারটে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প গড়ে তুললে পুঁজিবাদ-সামন্তবাদের সম্পর্কের বা গাঁটছড়ার দুর্বলতম গ্রন্থিকে আরও দুর্বল করা যাবে, তবে তিনি লগ্নি পুঁজির চরিত্রও বুঝতে পারেননি আর সামন্তবাদ উচ্ছেদের বুনিয়াদী পথ নির্দেশিকা ভুলে গেছেন। বুনিয়াদী শিক্ষা কেউ ভুলে যেতেই পারেন, কিন্তু তাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা একটা রাজনৈতিক ক্রাইম।'      ---- পার্থ ঘোষ

এভাবেই, প্রাক বিপ্লব আধা-সামন্তী দেশের এক অঙ্গরাজ্যে কৃষির সর্বনাশ করে নগরায়ন, শিল্পায়ন, উন্নয়নের পরিকল্পনাটির রূপায়ণ কৃষক আন্দোলন ও সামাজিক বিতর্কের জীবন্ত পরিমণ্ডলে ক্রমেই এ রাজ্যের মনসবদারদের কাছে সাধ্যাতীত হয়ে উঠতে থাকল। শাসকোচিত দম্ভ নিয়ে গেল বলপ্রয়োগের পথে। কৃষক আন্দোলনে বলপ্রয়োগ বিতর্ককে নতুন মাত্রা দিল। সামনে এল গণতন্ত্রের প্রশ্নটি। রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদে সংগঠিত হতে থাকল বড় বড় প্রতিবাদ মিছিল। সিঙ্গুর সত্যিসত্যিই বুদ্ধবাবুর কাছে দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হল – ৩৪ বছরের অচলায়তন তাসের ঘরের মতো মুখ থুবড়ে পড়ল।