যথেষ্ট লক্ষণীয় ব্যাপার হল, মার্কস ও এঙ্গেলস ইস্তাহারে পুঁজিবাদ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তাঁরা “বুর্জোয়া সমাজ”, “আমাদের যুগ, বুর্জোয়াদের যুগ”-এর মতো অভিব্যক্তিগুলোকেই বেছে নিয়েছেন এবং গোটা আলোচনাটাকেই উপস্থাপিত করেছেন এই যুগের দুই বুনিয়াদী শ্রেণী অর্থাৎ, বুর্জোয়া ও সর্বহারার মধ্যে শ্রেণীসংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে। এর মধ্যে দিয়েই পুঁজিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতাগুলোকে তাঁরা বর্ণনা করেছেন।
এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতাকে তাঁরা বিভিন্ন উপাদানে গঠিত এক সমগ্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ রূপেই দেখেছেন, কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তি তাঁদের নিজস্ব শ্রেণীদৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে এই নানান উপাদানগুলোকে একপেশে দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখেছেন এবং কোনো এক বিশেষ দিকের ওপর নজর দিতে গিয়ে সমগ্র ছবিটি তাঁদের দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। এইভাবে দেখতে গিয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক ১৯৯৬ সালে তাদের বিশ্ব উন্নয়ন রিপোর্ট-এ এবং টমাস ফ্রিডম্যান তাঁর ১৯৯৯ সালের সর্বাধিক বিক্রিত বই দ্য লেক্সাস এন্ড দ্য অলিভ ট্রি-তে বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির ব্যাখ্যায় প্রশংসামূলক ভঙ্গিতে ইস্তাহার থেকে বিশ্বায়নের ওপর নির্বাচিত অংশকে উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবেই যে দিকে নজর দেননি তা হল পুঁজিবাদের অধীনে সংকটের অনিবার্যতা সম্পর্কে আলোচনাটা।
১৯৪৮-এর এই দলিল দুটি বিপরীত প্রবণতার দ্বান্দ্বিক ঐক্যের মধ্যে পুঁজিবাদের গতিধারাকে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। একটি প্রবণতা হল শক্তিগুলোর দ্রুত ও লাগাতার বিকাশের দ্বারা চালিত বিশ্ব আধিপত্যের অভিমুখে, অন্যটি, সম্প্রসারিত উৎপাদিকা শক্তিগুলোর সঙ্গে সংকুচিত উৎপাদন সম্পর্কের সংঘাতের ফলে বারবার ফিরে আসা, গভীরতর সংকটের দিকে।
আর বিশ্লেষণের এই কাঠামো যে ঊনবিংশ, বিংশ ও একবিংশ শতকের বুর্জোয়া সমাজকে অনুধাবন করতে যথেষ্ট কার্যকরী তা সুনিশ্চিতভাবেই প্রমাণিত হয়েছে। একই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার উপরোক্ত দুটি দিককে একে একে বিচার করা যাক।
ইস্তাহার উল্লেখ করেছে, উৎপাদিকা শক্তিগুলোর দ্রুত বৃদ্ধির স্বাভাবিক পরিণাম হল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও ঘনীভবনের দিকে প্রবণতা : ছোটোখাটো কারখানার জায়গায় “দৈত্যাকায়, আধুনিক শিল্প”, “শিল্পীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর” স্থানে “শিল্পীয় ধনকুবের”, “উৎপাদনের উপায়গুলোর কেন্দ্রীভবন, এবং … অল্প কয়েক জনের হাতে সম্পদের ঘনীভবন”, এর “অপরিহার্য পরিণাম” হিসাবে “রাজনৈতিক কেন্দ্রীভবন” ইত্যাদি। এই প্রবণতা বাড়তে থাকে এবং প্রায় ৭০ বছর পর লেনিন সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর গ্রন্থে যেমন দেখালেন, তা সাম্রাজ্যবাদ বা একচেটিয়া পুঁজিবাদ-এর বিশ্ব ব্যবস্থায় পরিণতি লাভ করে – যা হল পুঁজিবাদের গুণগতভাবে এক নতুন এবং এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর। আজ আরও একশ বছর পর আমরা পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্তরের এক নতুন পর্যায় দেখতে পাচ্ছি – যা হল নয়া উদারবাদী বিশ্বায়ন
মার্কস ও এঙ্গেলসের সময়ে যেখানে বিশ্বায়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রধান মাধ্যম ছিল পুরনো ধারার উপনিবেশবাদ, আমাদের শতকে সেখানে উপনিবেশবাদকে সরিয়ে তার জায়গা নিয়েছে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদ। নগ্ন প্রত্যক্ষ শাসন থেকে ক্রমেই আরও বেশি মাত্রায় আধুনিক অপ্রত্যক্ষ শাসন কায়েমের দিকে পরিবর্তনের সঙ্গে এসেছে পণ্য রপ্তানির ওপর গুরুত্ব প্রদানের স্থানে পুঁজির রপ্তানির ওপর গুরুত্ব প্রদান এবং অর্থনীতির সমস্ত ক্ষেত্রে একচেটিয়া ঘরনাগুলোর এবং বিশেষভাবে বিপুল ক্ষমতাশালী আর্থিক মোড়লতন্ত্রের আবির্ভাব।
এই পরিবর্তনকে লেনিন ইস্তাহার থেকে আজ পর্যন্ত সময়কালের মাঝামাঝি পর্বে অত্যন্ত নিপুণভাবে বর্ণনা করেছেন : “সাধারণভাবে পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য হল যে, পুঁজির মালিকানাকে পুঁজির উৎপাদনে নিয়োগ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় , অর্থ পুঁজিকে বিচ্ছিন্ন করা হয় শিল্পীয় বা উৎপাদনশীল পুঁজি থেকে, এবং যে লভ্যাংশজীবী সম্পূর্ণরূপে বেঁচে থাকে অর্থ পুঁজি থেকে আয়ের ওপর তাকে বিচ্ছিন্ন করা হয় উদ্যোগপতি থেকে। … সাম্রাজ্যবাদ, অর্থাৎ লগ্নি পুঁজির আধিপত্য হল পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর যেখানে এই বিচ্ছিন্নতা বিপুল মাত্রা অর্জন করে। অন্যান্য সমস্ত রূপের পুঁজির তুলনায় লগ্নি পুঁজির আধিপত্যের অর্থ হল লভ্যাংশজীবী এবং আর্থিক মোড়লতন্ত্রের” এবং তার সঙ্গে “আর্থিকভাবে শক্তিশালী গুটিকয়েক রাষ্ট্রের আধিপত্য।” (সাম্রাজ্যবাদ)
“অর্থ পুঁজির … শিল্পীয় পুঁজি থেকে ” এই “বিচ্ছিন্নতা” এখন আরও গভীর মাত্রা অর্জন করেছে, আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজিকে উৎপাদনে তার শিকড় থেকে প্রায় ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে এবং সে শেয়ার, পণ্য ও মুদ্রা বাজারে ফাটকা খেলে, ব্যাঙ্ক ও বীমা, নির্মাণ ক্ষেত্র ইত্যাদিতে বিনিয়োগের মধ্যে দিয়ে ফুলেফেঁপে উঠছে।
একইভাবে, মার্কস ও এঙ্গেলস দেখিয়েছেন যে, বু্র্জোয়া ব্যবস্থার পশ্চিম থেকে পূর্বে সম্প্রসারণের প্রক্রিয়ায় পূর্বকে পশ্চিমের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়, আর আমাদের শতকে এই নির্ভরশীলতাকে চিরস্থায়ী ও পূর্ণাঙ্গ করে তোলা হয়েছে “অনুন্নয়নের বিকাশ” রূপে। অসম বিনিময়, বেছে বেছে বৈষম্যমূলক সংরক্ষণের প্রবণতা এবং ঋণ-ফাঁদের প্রলোভনের মতো কৌশলগুলোর মাধ্যমে “প্রাচ্য”র – অথবা আজকের পরিভাষায় তৃতীয় বিশ্বের – বড় অংশকেই সুপরিকল্পিতভাবে পরিণত করা হয়েছে বিকাশরুদ্ধ, বিকৃত, অপরিণত পুঁজিবাদের বিস্তৃত অঞ্চলে, যা ধনী দেশগুলোর স্বার্থ চরিতার্থ করে চলেছে।
বিশ্বায়ন যে উচ্চতর স্তরে পৌঁছেছে, মাইকেল লোউই ২০০৮ সালে তাঁর লেখায় তার এক জীবন্ত বর্ণনা দিয়েছিলেন :
“পুঁজি গোটা দুনিয়ার ওপর পরিপূর্ণ, নিরঙ্কুশ, একীকৃত, বিশ্বজনীন এবং সীমাহীন যে ক্ষমতা একবিংশ শতকে প্রয়োগ করতে পারছে, এর আগে কোনোদিন তা সম্ভব হয়নি। অতীতে কোনোদিনই সে বিশ্বের সমস্ত দেশের ওপর তার শাসন, তার নীতি, তার কট্টর ধ্যানধারণা ও তার স্বার্থকে এই মাত্রায় চাপিয়ে দিতে পারেনি, যতটা আজ পারছে। আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি এবং বহুজাতিক সংস্থাগুলো রাষ্ট্রসমূহ এবং সংশ্লিষ্ট জনগণের এতটা নিয়ন্ত্রণ মুক্ত আগে কোনোদিনই হতে পারেনি। আগে কখনই পুঁজিবাদী মুক্ত বাজার এবং পুঁজিবাদী অবাধ মুনাফার কঠোর নিয়মের অনুগামী হয়ে মানবজাতির জীবনকে নিয়ন্ত্রণ, শাসন ও পরিচালিত করতে উদ্যত হওয়া আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাঙ্ক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন নিবিড় নেটওয়ার্ক দেখা যায়নি। এবং সবশেষে, আগে কোনোদিনই মানবজীবনের সমস্ত ক্ষেত্রকে – সামাজিক সম্পর্ক, সংস্কৃতি, শিল্প, রাজনীতি, যৌনতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খেলাধুলা, বিনোদন – এমন নিরঙ্কুশ মাত্রায় পুঁজির অধীনস্থ করে তোলা হয়নি এবং “আত্মসর্বস্ব হিসাব-নিকাশের বরফ জলে”-র গভীরে নিক্ষেপ করা হয়নি।” (কমিউনিস্ট ইস্তাহার ১৬০ বছর পর)
কিন্তু পুঁজির এই সর্বব্যাপী আধিপত্যের সঙ্গেই এসেছে বিশ্বস্তরে সংকটের অভূতপূর্ব বিস্তার (১৯৩০-এর দশকের সংকটের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন তার আওতার বাইরে ছিল)
উৎপাদনের এই ধরনের মধ্যে নিহিত রয়েছে এর সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত আরও একটি এবং সম্ভবত আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা। ইস্তাহার আমাদের জানাচ্ছে, পালা করে ফিরে ফিরে আসা সংকটের মোকাবিলার জন্য পুঁজি যে সমস্ত পন্থার ওপর নির্ভর করে সেগুলো মূলত এমনই পন্থা যা আরও ধ্বংসাত্মক সংকটের জন্ম নেওয়ার পথ প্রশস্ত করে এবং তাকে প্রতিহত করার উপায়কেও সংকুচিত করে তোলে। আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এটা আরও বেশি সত্যি বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
যে দুটি বুনিয়াদী পন্থার আশ্রয় পুঁজি নেয় তা হল : “নতুন বাজার দখল” এবং “পুরনো বাজারকে আরও বেশি মাত্রায় নিংড়ে নেওয়া” (প্রথম অধ্যায়)। কিন্তু অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদ এখন এক বিশ্বজনীন ব্যবস্থা, অতএব নতুন নতুন অঞ্চলকে উপনিবেশে পরিণত করা বা (পূর্বতন) সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বাজারে জোরজবরদস্তি ঢোকার মতো পুরনো পথ খাটিয়ে নতুন কোথাও সম্প্রসারণ ঘটানোর সুযোগ আর নেই। বিশ্ব পুঁজির কাছে চিরাচরিত যে পথটা ছিল তা হল, বিভিন্ন উপায়ে পুরনো বাজারগুলোকে আরও তীব্রভাবে নিংড়ে নেওয়া, যথা, মোবাইল ফোন ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক গ্যাজেট, জীবনযাত্রার নানান সামগ্রী, সামাজিক নেটওয়ার্কিং পরিষেবা ইত্যাদি পণ্যের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সমাজ-জীবনে বাজারের আরও গভীর অনুপ্রবেশ ঘটানো। তবে, মানুষের ক্রমেই বেড়ে চলা প্রয়োজন পূরণে পণ্য ও পরিষেবার এই সম্প্রসারণ কিন্তু পুঁজির ক্রমবর্ধমান খাঁই মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। আর তাই বিশ্বের উত্তর ও দক্ষিণে নতুন নতুন কৌশল গ্রহণের দরকার পড়ল।
উত্তরে মুনাফার প্রধান উৎস হিসাবে লগ্নিকরণ ও ফাটকাবাজিকে প্রধান হাতিয়ার করা হল, আর কার্যকরী চাহিদাকে বাড়িয়ে তোলার মাধ্যম হয়ে উঠল সহজলভ্য ঋণ, যদিও মজুরির স্তরকে যথেষ্ট নীচেই রেখে দেওয়া হয়। দক্ষিণে বিশেষভাবে তথাকথিত “উদীয়মান অর্থনীতিগুলোতে” – যার মধ্যে আমাদের দেশও পড়ে – প্রধান অস্ত্র করা হল এল-পি-জিকে (উদারিকরণ-বেসরকারীকরণ-বিশ্বায়ন) যা জনগণ ও জাতিকে লুঠ করে দেশী ও বিদেশী বৃহৎ পুঁজির বিপুল মুনাফা ও সম্পদ সঞ্চয়কে সুনিশ্চিত করল।
কিন্তু উত্তর ও দক্ষিণ উভয় অঞ্চলেই এই পদক্ষেপগুলো জিডিপি-র বৃদ্ধিতে যে সাময়িক উদ্দীপনা যুগিয়েছিল, ক্রমবর্ধমান অসমতা, ফুলেফেঁপে ওঠা আর্থিক ক্ষেত্র এবং বিকাশরুদ্ধ প্রকৃত অর্থনীতির মধ্যে ক্রমেই আরও বেশি বেশি বিচ্ছিন্নতা, ইত্যাদির মতো বিপজ্জনক “পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলো” তাকে চুপসে দিয়েছিল। এর পরিণতি অবশেষে ঘটল এক গভীর সংকটের মধ্যে যা ২০০৭-০৮ সালে 'সবচেয়ে সফল' পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল।
পালাক্রমিক সংকটের সর্বশেষ পর্যায়টি অস্বাভাবিক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী ও গভীর কাঠামোগত বলে প্রমাণিত হচ্ছে যা আমাদের ইস্তাহার-এর এই কথাগুলো মনে পড়িয়ে দিচ্ছে যে, সংকটগুলো “বারবার ফিরে এসে প্রতিবার আরও বেশি করে গোটা বুর্জোয়া সমাজের অস্তিত্বটাকেই বিপন্ন করে তোলে” (প্রথম অধ্যায়)। এই রকম নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে বুর্জোয়া শ্রেণীর সর্বোচ্চ ও নেতৃত্বকারী স্তরগুলো লগ্নিকরণের রণনীতিকে নাছোড়বান্দাভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে এখন আরও বেশি বেশি নির্ভর করছে আয় ও সম্পদের পুনর্বণ্টনের ওপর – আন্ত-শ্রেণী (উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদকদের কাছ থেকে তার আত্মসাৎকারীদের কাছে, আরও সাধারণভাবে বললে, দরিদ্রদের কাছ থেকে ধনী এবং ঊর্ধ্বগামী মধ্যবিত্ত শ্রেণীগুলোর কাছে), একই শ্রেণীর মধ্যে (কেন্দ্রীভবন/একচেটিয়াকরণ এবং তার সঙ্গে একগুচ্ছ অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে বুর্জোয়াদের নিম্নস্তর থেকে উচ্চতর ও উচ্চতম স্তরের কাছে), বিশ্ব অর্থনীতির প্রান্তবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে কেন্দ্রের কাছে (অনুন্নত দেশগুলো থেকে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোতে)।
এই ধারা স্পষ্টতই ধনী এবং দরিদ্র উভয় ধরনের দেশগুলোতেই মন্দার প্রবণতাকে বাড়িয়ে তুলছে। আজকের বুর্জোয়া ব্যবস্থার প্রধান ত্রয়ী – আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ ও জাপান – জন বেলামি ফস্টার এবং রবার্ট ডব্লিউ ম্যাকচেসনি কথিত বিকাশরুদ্ধতা – লগ্নিকরণের ফাঁদ-এর কবলে পড়েছে (মান্থলি রিভিউ প্রেস প্রকাশিত “অন্তহীন সংকট” দেখুন)। এ বছরের (২০১৪) গোড়ার দিকে আইএমএফ-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ক্রিস্টিন ল্যাগার্ড এমনকি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে অর্থনীতি সংকোচনে (ডিফ্লেশন) আক্রান্ত হতে পারে – যে ভয়াবহ দৈত্যটা ১৯৩০-এর দশকের গোড়ায় আমেরিকায় ব্যাপক বিপর্যয় ঘটিয়েছিল।
এতো গেল বিশ্বায়ন এবং পুঁজির সংকটের কথা। এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক থেকে পুঁজিবাদ অবশ্যই অনেক পাল্টেছে, তবে তা ইস্তাহার নির্দেশিত অভিমুখেই।
বুর্জোয়াদের/বুর্জোয়া ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্য বৈশিষ্ট্যটা রয়েছে তার বিপ্লবী ভূমিকার মধ্যে। এই বিষয়টাকে আমরা সাধারণভাবে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে দেখে থাকি। তা হল, তারা অচল সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকে সরিয়ে তার জায়গায় তুলনামূলকভাবে উন্নত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে এনেছিল; মার্কস ও এঙ্গেলসের কাছে ঐ ভূমিকা ছিল কমিউনিজমের জন্য বস্তুগত এবং সাংস্কৃতিক এই উভয় ভিত্তির সৃষ্টি, এবং এই মহান রূপান্তরণ ঘটাতে সক্ষম শ্রেণী শক্তিটির জন্ম দেওয়া। ইস্তাহার সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে যথেষ্ট বিশদ বিশ্লেষণ দিয়েছে।
ইস্তাহার বলছে, বুর্জোয়া শ্রেণী বাঁচতে পারে না যদি না তারা নিম্নলিখিত তিনটি ক্ষেত্রে অবিরাম বিপ্লবী পরিবর্তন ঘটিয়ে চলে, (ক) “উৎপাদনের উপকরণসমূহে” (যন্ত্রপাতি, দক্ষতা ও প্রযুক্তি); (খ) “এবং ফলত উৎপাদন সম্পর্কে” (অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় সমস্ত পুরুষ ও নারীর মধ্যে – যেমন পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের মধ্যে, সমবেতভাবে যাঁরা একটি নির্দিষ্ট সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো গঠন করেন তাঁদের মধ্যে বুনিয়াদী সম্পর্ক); (গ) “এবং সেই সঙ্গে সমস্ত সামাজিক-সম্পর্কে” (পারিবারিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক)। উদাহরণস্বরূপ, অর্থের শাসন এবং “আত্মসর্বস্ব হিসাবনিকাশ” প্রেম, মর্যাদা, পারিবারিক বন্ধন এবং জ্ঞানকেও নিছক বেচাকেনার সামগ্রীতে পরিণত করে আর “ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভ্রমে যে শোষণ এতদিন ঢাকা ছিল” তার জায়গায় আসে “নগ্ন, নির্লজ্জ, প্রত্যক্ষ, পাশবিক শোষণ”। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, এগুলো নিয়ে পরিবর্তন শুধু একবারই ঘটে না। সমস্ত ক্ষেত্রে লাগাতার পরিবর্তন বুর্জোয়া যুগের একটা বুনিয়াদী, অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য (প্রথম অধ্যায়)। ইস্তাহার পরবর্তী পর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এর সঙ্গে যোগ করতে পারি, এই গতিশীলতার মধ্যেই রয়েছে পুঁজিবাদের মূলগত জোর, আবার নতুন নতুন দ্বন্দ্বের উৎস।
কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণীর একটা প্রতিক্রিয়াশীল দিকও কি নেই? এই বিষয়ে দুটি জিনিস লক্ষণীয়। প্রথমত, বুর্জোয়া ব্যবস্থার সর্বাঙ্গীণ সমালোচনামূলক আলোচনা ইস্তাহার-এর লক্ষ্য না হওয়ায় তা ঐ ব্যবস্থার সমস্ত ধরনের ত্রুটি, বিচ্যুতি ও বিকৃতি নিয়ে আলোচনা করেনি। আর তাই শস্তা পণ্যকে “ভারী কামান” হিসাবে আলাদাভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে প্রাচ্যকে দখল করা হয়েছিল, কিন্তু ঐ লক্ষ্যে যে দৈহিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল এবং সত্যিকারের বন্দুক ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল সে সম্পর্কে শুধু একটা আবছা ইঙ্গিতই রয়েছে – “সামরিক অভিযান”। আবার,“তার নিজের ছাঁচে জগৎ গড়ে তোলা”র মেট্রোপলিটান বুর্জোয়াদের প্রকল্পের সঙ্গে যে দৈহিক অত্যাচার এবং সাংস্কৃতিক জুলুম জড়িয়ে রয়েছে তার কোনও উল্লেখও ইস্তাহার-এ নেই।
বাদ পড়ে যাওয়া এই ধরনের কিছু বিষয় তথ্যের অলভ্যতা এবং রচনাটিকে সংক্ষিপ্ত করার আবশ্যকতার জন্য হতে পারে, কিন্তু মনে হয় তা অনেকটা সচেতনভাবেই করা হয়েছিল। উদ্দেশ্যটা সম্ভবত ছিল প্রধান দিকটিকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়া : যা হল, বুর্জোয়া শ্রেণীর রূপান্তর সাধনের ভূমিকা, যা আবার আরও একটা, এবং আরও মৌলিক চরিত্রের পরিবর্তনের জন্য বিশ্বকে পরিপক্ক করে তুলেছে।
দ্বিতীয়ত, লেখকদ্বয় যেমন পশ্চিম দুনিয়ার অধিকাংশ দেশে পুঁজিবাদী বিকাশের ঘাটতি সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন (এঙ্গেলসের সুইজারল্যান্ডে গৃহযুদ্ধ (১৮৪৭) দেখুন, সংগৃহীত রচনাবলী, মার্কস ও এঙ্গেলস, খণ্ড ৬), তেমনি আবার বুর্জোয়াদের প্রকৃত প্রতিক্রিয়াশীল/রক্ষণশীল/প্রতিবিপ্লবী ভূমিকা পরিপূর্ণরূপে দেখা যায় ১৮৪৮-এর বিপ্লবের সময় ও তারপর অর্থাৎ ইস্তাহার রচনার পর। মার্কস দ্রুতই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন বুর্জোয়া শ্রেণী ও প্রতিবিপ্লব শীর্ষক রচনায় (মার্কস ও এঙ্গেলসের নির্বাচিত রচনাবলী, খণ্ড ১)। একই বছরে (১৮৪৮-এর ডিসেম্বরে) এবং প্রায় একই শৈলীতে লেখা এই রচনায় বুর্জোয়াদের তীব্রভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যেটিকে ইস্তাহার-এর উপসংহার বা উত্তরকথন হিসাবে পাঠ করা যেতে পারে :
“প্রুশিয়ার বুর্জোয়ারা রাজতন্ত্রের সঙ্গে এক শান্তিপূর্ণ চুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের জায়গায় পৌঁছতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে এটা ঘটেছিল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। অন্য কথায়, গণ-আন্দোলনই তাকে এই কর্তৃত্বের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিল, তাই নিজের স্বার্থ নয় বরং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অর্থাৎ নিজেরই বিরুদ্ধে জনগণের স্বার্থ দেখতে সে বাধ্য হয়েছিল।
“প্রুশিয়ায় মার্চ বিপ্লবকে ১৬৪৮-এর ইংল্যান্ডের বিপ্লব বা ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না।
“১৬৪৮ সালে বুর্জোয়ারা রাজতন্ত্র, সামন্ততান্ত্রিক অভিজাততন্ত্র এবং প্রতিষ্ঠিত চার্চের বিরুদ্ধে আধুনিক অভিজাততন্ত্রের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিল।
“১৭৮৯ সালে বুর্জোয়ারা রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং প্রতিষ্ঠিত চার্চের বিরুদ্ধে জনগণের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিল। …
“উভয় বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণীই ছিল আন্দোলনের নেতা। …
“১৬৪৮ ও ১৭৮৯-এর বিপ্লব নিছক ইংল্যান্ডের বা ফ্রান্সের বিপ্লব ছিল না, সেগুলো ছিল যেন গোটা ইউরোপেরই বিপ্লব। এরা পুরনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর বিশেষ সামাজিক শ্রেণীর বিজয়ের প্রতিনিধিত্ব করেনি; এরা ইউরোপের নতুন সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ঘোষণা করেছিল। এই বিপ্লবগুলোতে বুর্জোয়া শ্রেণী বিজয়ী হয়েছিল, কিন্তু সেই সময় বুর্জোয়া শ্রেণীর বিজয় ছিল এক নতুন সমাজব্যবস্থার বিজয়, সামন্ততান্ত্রিক মালিকানার ওপর বুর্জোয়া মালিকানার, প্রাদেশিকতার ওপর জাতীয়তার, গিল্ডব্যবস্থার ওপর প্রতিযোগিতার, বড় ছেলের উত্তরাধিকারের ওপর (জমির) বিভাজনের, জমির ওপর জমির মালিকের আধিপত্যের জায়গায় ভূস্বামীর শাসনের, সংস্কারের ওপর জ্ঞানালোকের, পারিবারিক নামের ওপর পরিবারের, অভিজাত্যপূর্ণ অলসতার ওপর শ্রমের, মধ্যযুগীয় বিশেষ সুবিধার ওপর বুর্জোয়া আইনের বিজয়। ১৬৪৮-এর বিপ্লব ছিল ষোড়শ শতকের ওপর সপ্তদশ শতকের বিজয়; ১৭৮৯-এর বিপ্লব ছিল সপ্তদশ শতকের ওপর অষ্টাদশ শতকের বিজয়। এই বিপ্লবগুলোর মধ্য দিয়ে কেবল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বদলে সেই সময়ের সমগ্র পৃথিবীর প্রয়োজন প্রতিফলিত হয়েছিল।
“মার্চ মাসের প্রুশিয়ার বিপ্লবে এই ধরনের কিছুই ঘটেনি।
“... এটি কোনো ইউরোপীয় বিপ্লব ছিল না, বরং এক পশ্চাদপদ দেশে এক ইউরোপীয় বিপ্লবের দুর্বল ছায়ার মতো দেখা দিয়েছিল। সেই শতক থেকে এগিয়ে থাকার পরিবর্তে তা সমসময়ের অর্ধশতকেরও বেশি পিছনে ছিল। … তা নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন নিয়ে সংঘটিত হয়নি, বরং প্যারিসে যে সমাজের মৃত্যু ঘটে গিয়েছিল তাকেই বার্লিনের বুকে পুনরুজ্জীবিত করা হল। …”
এই ধরনের প্রতিবিপ্লবী বৈশিষ্ট্যগুলো বেড়ে চলল, এবং প্যারি কমিউন ও রুশ বিপ্লবের পর সেগুলোই বুর্জোয়াদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠল। শ্রমজীবী জনগণের বিক্ষিপ্ত কিন্তু শক্তিশালী অগ্রগতির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে বুর্জোয়ারা তাদের বিপ্লবী প্রবণতা থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে গিয়ে সামন্ততন্ত্র, ধর্মীয় উন্মাদনা, বর্ণবাদ, ইত্যাদির মতো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও ধারাগুলোর সঙ্গে হাত মেলালো। বিশ্ব স্তরে লগ্নি পুঁজির কর্তৃত্বে চালিত সাম্রাজ্যবাদ অবক্ষয় ও প্রতিক্রিয়ার বাহক হয়ে উঠল। ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোতে সামন্ততন্ত্র ও উপনিবেশবাদ-এর সঙ্গে জোট বেঁধে মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ আত্মপ্রকাশ করল। ইউরোপে ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটল – প্রথমে এক আন্দোলন হিসাবে এবং পরে শাসন ক্ষমতায়। কিছুকাল পরে তথাকথিত “এশীয় শার্দুলদের” এবং ভারতের মতো কয়েকটি দেশে পেটোয়া পুঁজিবাদের আবির্ভাব (এবং সংকট) দেখা গেল। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে নয়া-উদারবাদ, নয়া-ফ্যাসিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং এই ধরনের উগ্র দক্ষিণপন্থী ধারাগুলোর সঙ্গে প্রচ্ছন্ন যোগাযোগের মধ্যে দিয়ে পাশ্চাত্য থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
তাই বলা যায়, আমরা আজ এমন একটা বিশ্বে বাস করছি যেখানে উৎপাদন, যোগাযোগ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমস্ত শাখায় চমকপ্রদ অগ্রগতি অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতির জগতে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল ধারাগুলো এবং পরিবেশের ভয়াবহ অবনতির হাত ধরাধরি করে চলেছে। বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক সৃজনগুলোর আন্তর্জাতিকীকরণ, জনগণের মধ্যে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের কিছুটা ক্ষয়, ইত্যাদির মতো (প্রথম অধ্যায়ে যেগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে) বুর্জোয়া যুগের সাফল্যগুলো নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু জাতীয় বৈরিতার অবসান বা এই ধরনের আরও কিছু কথা যা ইস্তাহার-এ বলা হয়েছে তার সঙ্গে আমরা পুরো সহমত হতে পারি না। সাম্রাজ্যবাদের যুগে প্রধান ধারা না হলেও যা কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয় তা হল, বুর্জোয়া যুগের ঊষাকালের মহান প্রতিশ্রুতির অনেকগুলোরই অপূর্ণ থেকে যাওয়া – বস্তুত, তার গোড়ার দিকের অগ্রগতি থেকে কিছুটা পিছু হঠাই লক্ষ্য করা যায়।
ইস্তাহার-এর রচয়িতাদের উল্লিখিত এই সমাজব্যবস্থার আর একটি বৈশিষ্ট্যকে বিচার করা যাক : “গোটা সমাজ ক্রমেই দুটি বিশাল বৈরী শিবিরে ভাগ হয়ে পড়ছে – বুর্জোয়া ও সর্বহারা।” এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আজকের যুগের বাস্তবতার ঠিক কতটা মিল রয়েছে?
ইস্তাহার “সর্বহারা, অর্থাৎ আধুনিক শ্রমিকশ্রেণী”কে সংজ্ঞায়িত করেছে এইভাবে : “মেহনতিরা একটা শ্রেণী, যারা বাঁচতে পারে যতক্ষণ তাদের কাজ জোটে, আর কাজ জোটে শুধু ততক্ষণ যতক্ষণ তাদের পরিশ্রমে পুঁজি বাড়তে থাকে। এই মেহনতিদের নিজেদের টুকরো টুকরো করে বেচতে হয়। বাণিজ্যের অন্য সামগ্রীর মতোই তারা পণ্য বই অন্য কিছু নয়। তাই তাদের নিয়তই প্রতিযোগিতার সব ঝড়-ঝাপটা, বাজারের ওঠা-পড়া সবকিছুই সহ্য করতে হয়।” এঙ্গেলসের কমিউনজমের নীতিমালা ও (১৮৪৭) এই শ্রেণীকে সংজ্ঞায়িত করেছে এইভাবে : তারা হল “সমাজের সেই শ্রেণী যারা কেবলমাত্র নিজেদের শ্রম বেচে জীবিকা অর্জন করে, কোনো পুঁজির ওপর মুনাফা থেকে নয় ”।
“শ্রম” বিক্রির স্থানে আরও সঠিক অভিব্যক্তি “শ্রমশক্তি”কে ব্যবহার করা ছাড়া মার্কস ও এঙ্গেলস এই সংজ্ঞাকে কখনও বদলাননি। এই সংজ্ঞার মধ্যে অফিস, ব্যাঙ্কে কর্মরত কম্পিউটার অপারেটাররা সহ – যারা তাদের (বৌদ্ধিক) শ্রমশক্তি বিক্রি করে জীবনধারণ করে – সাধারণ কর্মচারিরাও এসে যায়। তবে, রাষ্ট্রের ওপরতলার কর্তাব্যক্তিরা, কর্পোরেট ক্ষেত্রের উচ্চপদস্থ কর্তারা, এবং এ রকমই অন্যান্যরা, প্রচুর আয় করে পুঁজিপতিতে পরিণত হওয়ার পথ যাদের সামনে খোলা আছে এবং যাঁদের আয়ের মধ্যে সাধারণভাবে থাকে শেয়ারের লভ্যাংশ, অন্যান্য বিনিয়োগ থেকে লাভ করা সুদ, ইত্যাদি, তাঁরা এই বর্গের মধ্যে পড়েন না। ব্যাপক অসংগঠিত ক্ষেত্রের – দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমাদের দেশে কৃষি ও তার সঙ্গে সংযুক্ত ক্ষেত্র – শ্রমিক সহ সাধারণ শ্রমিক-কর্মচারিদের মোট সংখ্যা বেড়ে চলেছে, এমনকি সম্ভবত অনেক দেশেই জনসংখ্যার শতাংশ হিসাবেও। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আমাদের দেশে কৃষিশ্রমিক সহ গ্রামীণ সর্বহারার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে, যদিও ঐ বৃদ্ধি শুধুই কৃষিশ্রমিকদের মধ্যে সীমিত নয়। বিদেশী কর্পোরেশনগুলোর তত্ত্বাবধানে বাণিজ্যিক চাষাবাদের সম্প্রসারণ ঘটায় লাতিন আমেরিকার অনেক দেশেই গ্রামীণ সর্বহারার সংখ্যার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটছে। অধিকন্তু, পুঁজির আদিম (কিছু পণ্ডিতের মতে, মূল জার্মান শব্দ অনুসারে সঠিক শব্দটি হল প্রাথমিক) সঞ্চয় – যা আজ তৃতীয় বিশ্বে একটি বাড়তে থাকা বিপদ – বহু মানুষকে সর্বহারা শ্রেণীতে (মূলত শিল্পীয় মজুত বাহিনীতে) ঠেলে দিচ্ছে। এরা আসছেন ক্ষুদ্র উৎপাদকদের/আমাদের দেশের আদিবাসীদের মতো স্বনির্ভর দরিদ্র জনগণের বিভিন্ন বর্গ থেকে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, শ্রমশক্তির বিক্রেতা ও ক্রেতার ব্যাপকতর অর্থে মেরুকরণের এই প্রক্রিয়া সাধারণভাবে (কিছু ব্যতিক্রম সহ) এবং কিছুটা পরিবর্তিত রূপে ঊনবিশংশ শতক থেকে অব্যাহতভাবে চলছে। এই ব্যাপারটাই একুশ শতকে এসে “১ শতাংশের বিপরীতে ৯৯ শতাংশ” এই শ্লোগানের মধ্যে এক নতুন রাজনৈতিক অভিব্যক্তি পেয়েছে।
তথাপি, অন্তত তিনটি দিক থেকে ইস্তাহার-এর পর্যবেক্ষণকে সময়োপযোগী করে তোলা দরকার। প্রথমত, সমস্ত দেশেই আমরা বিপুল সংখ্যাক স্ব-নিয়োজিত মানুষকে দেখতে পাই – ছোট ব্যবসায়ী থেকে রাস্তার বিক্রেতা ও হকার, এবং ক্ষুদ্র/মধ্য চাষি থেকে বিভিন্ন পেশাজীবী।দ্বিতীয়ত, মজুরি ও বেতনভোগী শিবিরের মধ্যে স্তরভেদ যথেষ্ট মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। একই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ এবং জীবনযাত্রার ধরনে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায় : যথা, গ্রাম ও শহরাঞ্চলের কাজের মধ্যে, উঠতি ও পড়ন্ত শিল্পের মধ্যে, কায়িক ও বৌদ্ধিক কাজের মধ্যে, বিধিবদ্ধ ও অ-বিধিবদ্ধ (ফর্ম্যাল ও ইনফর্ম্যাল) ক্ষেত্রের মধ্যে।
তৃতীয়ত, আধিপত্যবাদী সামাজিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে নানান ধরনের প্রতিরোধের ভিত্তি হিসাবে লিঙ্গ, বর্ণ, জাতিসত্তা, জাত, ইত্যাদির মতো অ-শ্রেণী পরিচিতিগুলো সামনে এসেছে। কিছু ক্ষেত্রে এর সঙ্গে পুঁজিবাদের প্রকৃতির সম্পর্ক রয়েছে (উদাহরণস্বরূপ, পিতৃতন্ত্র এবং বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদের ওপর ঐতিহাসিক ও অব্যাহত নির্ভরতা), এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে তার অসম বিকাশের এবং পুঁজিবাদের সঙ্গে প্রাক-পুঁজিবাদী ও পশ্চাদগামী শক্তিগুলোর বিভিন্ন ধরনের সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক জোটবদ্ধতার মধ্যে। মার্কসবাদীদের তাই এখন শ্রেণীসংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও পরিচালিত করার বুনিয়াদী কর্তব্যকর্মের পাশাপাশি ও তার অংশ হিসাবে সামাজিক ন্যায়ের এই আন্দোলনগুলোর সঙ্গে আন্তক্রিয়া চালিয়ে যেতে এবং যেখানেই সম্ভব সেগুলোতে অবদান রাখতে হবে। উৎপীড়নের এই সমস্ত রূপ কীভাবে পুঁজিবাদের সঙ্গে যুক্ত সেকথা তুলে ধরেই তা করতে হবে।