ফরাসি বিপ্লবের ইস্তাহার সুপরিচিত “মানব অধিকারের ঘোষণা” যদি হবসবম কথিত “বিপ্লবের যুগ”-এর (১৭৮৯ – ১৮৪৮ পর্যায়) আবির্ভাবের অগ্রদূত হয়ে থাকে তবে ইস্তাহার-এর আবির্ভাব ছিল ঐ যুগের চূড়ান্ত ক্ষণ। উভয় দলিলই ছিল মহান বিপ্লবী তাৎপর্যে মণ্ডিত ঐতিহাসিক মাইলফলক, এবং ফরাসি বিপ্লবের “স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব”র মহান ধারণা থেকে “দুনিয়ার মজদুর এক হও”-এর উদাত্ত আহ্বানে যে উত্তরণ কমিউনিস্ট ইস্তাহার-এ ঘটল তা মানব চেতনার ইতিহাসে এবং উন্নততর সমাজের দিকে নিরবচ্ছিন্ন যাত্রায় এক বিরাট উল্লম্ফন হয়ে দেখা দিল।
তবে, ফরাসি বিপ্লব বা সামগ্রিকভাবে বুর্জোয়া বিপ্লবগুলো অর্থনৈতিক ভিত্তি বা মতাদর্শগত-রাজনৈতিক উপরিকাঠামোর প্রাক-পুঁজিবাদী সম্পর্ক ও প্রথাগুলোর সম্পূর্ণরূপে বিলোপ ঘটাতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানিতে তখনও বুর্জোয়া বিপ্লব ঘটেনি এবং ইস্তাহার প্রকাশিত হওয়ার পরপরই যখন সেটা ঘটল (ইস্তাহার সঠিকভাবেই যার ভবিষ্যৎবাণী করেছিল) তা কিন্তু সর্বহারা বিপ্লবে পরিণতি লাভ করল না (ইস্তাহার যেমনটা হবে বলে ভেবেছিল), তার মধ্যে চূড়ান্ত রক্ষণশীল বা প্রতিবিপ্লবী চরিত্রের প্রকাশ দেখা গেল। মূলত জার্মানি এবং তারপর ফ্রান্স, ইতালি, পোল্যান্ড এবং হল্যান্ড-এর মতো ইউরোপের দেশগুলোর ওপরই কমিউনিস্ট লিগ (যে সংগঠন ইস্তাহার প্রকাশ করেছিল) তার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করল – সে সময় পুঁজিবাদী বিকাশের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশ ইংল্যান্ডের ওপর তারা ততটা গুরুত্ব দিল না, যে ইংল্যান্ডই পরবর্তীকালে মার্কসের পুঁজি গ্রন্থের ভিত্তি রচনা করেছিল। এই সমস্ত দেশে শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন ছাড়াও অন্যান্য নানা আন্দোলনও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছিল – যথা, দাস মালিকদের বিরুদ্ধে ক্রীতদাসদের, ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে কৃষকদের, সামন্ত অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে বুর্জোয়ারা সহ সাধারণ জনগণের আন্দোলন, ইত্যাদি। ঐ সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলন থেকে উঠে আসা ও সেগুলোর নেতৃত্বকারী গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সঙ্গে কমিউনিস্টদের ঐক্যের ওপর ইস্তাহার স্বভাবতই গুরুত্ব প্রদান করল।
“বিপ্লবের যুগ” খুব স্বাভাবিকভাবেই হয়ে উঠেছিল প্রতিবিপ্লবী নিপীড়নেরও যুগ। জার্মানি এবং অন্যান্য দেশ থেকে ভালো সংখ্যক যে সমস্ত বিপ্লবীদের (ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে) নির্বাসিত করা হয়েছিল বা যাঁরা পালিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা ১৮৩০-এর দশক থেকে প্রধানত লন্ডন ও প্যারিসে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা চালাতে ও পুনরায় সংগঠিত হতে লাগলেন। এই ধারায় জার্মান বিপ্লবীরা ১৮৩৩ সালে প্যারিসে গঠন করলেন “নির্বাসিতদের সংঘ” (সোসাইটি অফ এক্সাইলস)। সংঘে একটা ভাঙ্গনের মধ্যে দিয়ে ফরাসি নৈরাজ্যবাদী ব্লাঙ্কির প্রভাবাধীন বিপ্লবীরা গঠন করলেন “ন্যায়ের জন্য লিগ” (লিগ অফ দ্য জাস্ট)। এই সংগঠন ১৮৩৯-এর প্যারিস অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, যে অভ্যুত্থানকে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছিল। এর পরিণতিতে তাদের মধ্যে থেকে কার্ল শ্যাপার সহ বেশ কয়েকজন লন্ডনে চলে গেলেন। সেখানে তাঁরা ১৮৪০ সালে একটি সংগঠন তৈরি করলেন। পুলিশী হয়রানিকে এড়াতে তার নাম তাঁরা দিলেন – “শ্রমিকদের শিক্ষা সংঘ”।
লিগের আর এক নেতা উইলহেলম ওয়েটলিং সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি একটি বই বার করলেন যাতে লুম্পেন সর্বহারাদের ওপর ভিত্তি করে বিপ্লবের আহ্বান জানানো হল। তাঁকে প্রথমে জেলে পোরা হল ও পরে জার্মানিতে পাঠিয়ে দেওয়া হল, এবং এরপর ১৮৪৪ সালে তিনি লন্ডনে চলে এলেন। উদ্দীপনায় ভরপুর ও যথেষ্ট প্রভাবশালী এই নৈরাজ্যবাদী নেতার আগমন শ্যাপার সহ অন্যান্য দেশান্তরী ব্যক্তিদের “সমস্ত দেশের গণতান্ত্রিক বন্ধুদের সংঘ” প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করল।
একদিকে ন্যায়ের জন্য লিগ এবং অন্যদিকে চার্টিস্টপন্থীরা (ইংল্যান্ডে) এবং বিভিন্ন দেশের নানান সংগ্রামী শক্তিগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনাও চলছিল, আর এর সঙ্গেই চলছিল সমাজতন্ত্র। সাম্যবাদের বিভিন্ন ধারাগুলোর মধ্যে বিতর্ক। এই প্রক্রিয়ায় লিগের অধিকাংশ সদস্যই বিভিন্ন ইউটোপীয় 'ব্যবস্থার' তুলনায় মার্কস-এঙ্গেলসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের উৎকর্ষের সমাদর করতে লাগলেন। হেনরিক বয়ার, যোশেফ মল ও কার্ল শ্যাপারের মতো লিগের নেতৃবৃন্দ ১৮৪৬-এর শেষদিকে একটি সার্কুলার দিলেন যাতে একটি 'শক্তিশালী পার্টি' গঠনের লক্ষ্যে কমিউনিস্টদের অন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করার প্রস্তাব করা হল। লন্ডনে ১৮৪৭-এর জুন মাসে ঐ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হল। ব্রাসেলসে থাকায় মার্কস ঐ কংগ্রেসে যোগ দিতে পারলেন না বটে, তবে ঐ শহর থেকে যাওয়া প্রতিনিধি উইলহেলম উলফকে বিশদ পরামর্শ দিলেন; আর এঙ্গেলস প্যারিসের প্রতিনিধি হিসাবে তাতে যোগ দিলেন।
কংগ্রেস নতুন নাম “কমিউনিস্ট লিগ” গ্রহণ করল এবং তার কর্মসূচীর ভিত্তি হিসাবে “কমিউনিস্ট মতবাদ (অথবা সূত্রগুলো)” গ্রহণ করল। এঙ্গেলস এটি রচনা করেছিলেন বিপ্লবী প্রশ্নোত্তরের আঙ্গিকে – যে আঙ্গিকে তখনকার শ্রমিক সংঘগুলো তাদের কর্মসূচী সূত্রায়িত করতে অভ্যস্ত ছিল। মার্কস ও এঙ্গেলসের প্রস্তাব অনুসারে কংগ্রেস ইউটোপীয় সমাজবাদী মন্ত্র “সমস্ত মানুষই পরস্পরের ভাই”-কে পাল্টে তার জায়গায় নিয়ে এল এক শ্রেণী-সচেতন আহ্বান : “দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষ, এক হও”! পুরনো শ্লোগানটা যেখানে বাস্তব পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলত এবং এই মোহের সঞ্চার করত যে, যথেষ্ট প্রচার করতে পারলে পুঁজিপতি ও জমিদাররা শ্রমিক ও কৃষকের ভাই হয়ে উঠবে, নতুন শ্লোগানটা সেখানে আশু রাজনৈতিক কর্তব্যটিকে সুনির্দিষ্ট করেছিল – শ্রেণীসংগ্রামের জন্য, পুরনো সমাজ ব্যবস্থাটাকে উৎখাত করে নতুন সমাজ গড়ার জন্য শ্রমিকদের বিশ্বজুড়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এটা অবশ্যই ছিল এক বিশাল অগ্রগতি।
এই কংগ্রেসের অল্প কিছুদিন পরই ব্রাসেলস শহরে মার্কসের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট লিগের একটি জেলা কমিটি গঠিত হল। কেন্দ্রীয় কমিটি লন্ডনে অবস্থিত হলেও এই জেলা কমিটিই কার্যত নেতৃত্বকারী মতাদর্শগত কেন্দ্র রূপে কাজ করতে লাগল। মার্কস ও এঙ্গেলস উপলব্ধি করলেন, লিগের বেআইনি এবং আপেক্ষিকভাবে সংকীর্ণ সাংগঠনিক কাঠামোর – ইউরোপের স্বৈরতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রগুলো যে কাঠামোকে লিগের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল – চারদিকে শ্রমিকদের খোলা সংঘগুলোর একটি জাল তৈরি করতে হবে। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁরা ব্রাসেলসে জার্মান শ্রমিক সংঘ প্রতিষ্ঠা করলেন এবং ব্রাসেলস গণতান্ত্রিক সমিতি গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা রাখলেন। শ্রমিক সংঘে মার্কস যে বক্তৃতাগুলো দেন পরবর্তীকালে তা মজুরি, শ্রম ও পুঁজি নামে পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয় এবং গণতান্ত্রিক সমিতির দুই ভাইস চেয়ারম্যানের অন্যতম রূপে তিনি নির্বাচিত হন। বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর এক বৃহত্তর জোট গড়ে তোলাটাও ছিল সমিতির এক কৃতিত্ব।
এঙ্গেলস রচিত কমিউনিজম-এর নীতিমালা-কে (যা ছিল কমিউনিস্ট মতবাদ-এর এক পরিমার্জিত ও বর্ধিত সংস্করণ) লিগের কর্মসূচীর রূপরেখা বলে গণ্য করা হল। এঙ্গেলস কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন যে “প্রশ্নোত্তরের আঙ্গিকটিকে পাল্টে সেটাকে কমিউনিস্ট ইস্তাহার বলতে হবে”। (কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, নির্বাচিত পত্রাবলী, পৃ: ৪৫)। মার্কস এর সঙ্গে সহমত পোষণ করলেন এবং ১৮৪৭-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট লিগের দ্বিতীয় কংগ্রেস সেটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিল।
লিগ ইতিমধ্যেই তার সদস্যরূপে চার্টিস্ট আন্দোলনের সামনের সারির নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করেছিল এবং কংগ্রেসে ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিলেন। মার্কস বিভিন্ন ভুল ধারণার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ লড়াই চালালেন এবং এঙ্গেলসের সুদক্ষ সহযোগিতায় তাঁর প্রস্তাবগুলোর সপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেন। মার্কস ও এঙ্গেলস উত্থাপিত একটি প্রস্তাবকে সমর্থন করে কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিল যে, বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে লিগ খোলাখুলিভাবে একটি কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবেই নিজেকে ঘোষণা করবে। তার ইস্তাহার রচনার দায়িত্ব বর্তালো মার্কস ও এঙ্গেলসের ওপর (১৮৭২-এর জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় যে কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে)।