ঐ বিজয়োল্লাস কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হল না। ১৯৯৭-৯৮ সালে দক্ষিণ এশীয় সংকট শুরু হওয়ায় ঐ একই নিউ ইয়র্কার পত্রিকা তাদের ১৯৯৭-এর ১০ অক্টোবর সংখ্যায় “মার্কসের প্রত্যাবর্তন”-এর কথা ঘোষণা করল। মার্কসবাদী পণ্ডিত এবং পার্টিগুলোও চিরায়ত রচনাগুলোকে নতুন করে অধ্যয়ন করতে শুরু করল। ১৯৯৮ সালে (কমিউনিস্ট ইস্তাহার-এর প্রথম প্রকাশের সার্ধ শতবার্ষিকীতে) পুস্তিকাটির কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হল। এর একটিতে ছিল এরিক হবসবম-এর ভূমিকা। অার অন্য একটি সংস্করণ প্রকাশ করল মান্থলি রিভিউ প্রেস, যাতে ভূমিকা লিখলেন পল এম সুইজি এবং একটি নিবন্ধ লিখলেন এলেন মেইকসিনথ উড।
নতুন সহস্রাব্দের শুরুর দিকে “টিনা”র জায়গায় শোনা গেল ভাসা-ভাসা আশাবাদের শ্লোগান “অন্য একটি বিশ্ব সম্ভব”, আর তারপর অনুরণিত হল “একুশ শতকের সমাজতন্ত্রর” রণধ্বনি। পৃথিবী যেন ক্রমেই আরও বেশি করে বিবিধ ধারার গণআন্দোলনের এক উত্তাল সমুদ্র রূপে দেখা দিতে লাগল। এই পরিস্থিতিতে দুটি বই প্রকাশিত হল যেগুলো একবিংশ শতকে মার্কসবাদের তাৎপর্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে অবদান যোগালো। একটি হল এলান বাডিউর “দ্য কমিউনিস্ট হাইপথিসিস” (২০০৮) যা যথেষ্ট আগ্রহের সৃষ্টি করল এবং ২০০৯ সালে লন্ডনে “কমিউনিজম-এর ধারণা” বিষয়ে সম্মেলন আয়োজনে প্রেরণা যোগালো। ঐ সম্মেলন মূলত পরিচালনা করলেন স্লাভজ জিজেক। অন্য বইটি হল টেরি ইগলটনের লেখা “কোন অর্থে মার্কস সঠিক ছিলেন” (২০১১)। জার্মানিতে তৈরি তথ্যচিত্র “মার্কস রিলোডেড”-এর লেখক ও পরিচালক জেসন বার্কার যখন বললেন, “আজকের রাজনৈতিক চিন্তাধারা ঠিক সেই ধরনের সামাজিক পরিস্থিতিকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে যে পরিস্থিতিতে মার্কস জীবন কাটিয়েছিলেন”, তখন তা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয়েছিল।
যে বই দুটি, চলচ্চিত্র এবং অনুষ্ঠানগুলোর উল্লেখ করা হল, সেগুলোর পটভূমি হিসাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ২০০৭-০৮ সালে বিশ্বে দেখা দেওয়া আর্থিক সংকট তথা অর্থনৈতিক মন্দা। বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা একদিকে যেমন মৃত দার্শনিকের পুনরুত্থান হচ্ছে দেখে শঙ্কিত হয়ে চেঁচামেচি জুড়ে দিল , যে দার্শনিককে ১৯ শতকে তাদেরই জাতিভাইরা শ্লেষাত্মকভাবে “লাল ডকটর” (ইঙ্গিতটা এখানে মার্কসের ২১ বছর বয়সে দর্শনশাস্ত্রে ডক্টরেট উপাধি লাভের দিকে) বলে অভিহিত করত, অন্যদিকে তাদের মধ্যে অধিকতর বুদ্ধিমান অংশটি মার্কসবাদী তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে পুঁজিবাদকে রক্ষা করা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে লাগল। এছাড়া পোপ এবং ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি পুঁজি গ্রন্থ অধ্যয়ন করে ধ্বংসাত্মক সংকটের কারণ (হয়তো বা তা মোচনের উপায়) বোঝার চেষ্টা করেছিলেন বলে শোনা গেল। ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকা সেই সময় মার্কসের পুঁজি গ্রন্থ নিয়ে একটি বিস্তৃত আলোচনা চালাল এবং জেসন বার্কার-এর একটি সাক্ষাৎকার ছাপলো যার শিরোনাম দেওয়া হল “মার্কস কি পুঁজিবাদকে রক্ষা করতে সক্ষম?”; এখন আবার ইকনমিস্ট পত্রিকা টমাস পিকেটি-কে “আধুনিক যুগের মার্কস” বলে অভিনন্দিত করেছে। ওরা মনে করছে যে একটা নির্বিষ, নিরীহ মার্কসকে ওরা পেয়ে গেছে যিনি উদ্বৃত্ত মূল্য নিষ্কাশনের মতো পুঁজিবাদের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন না, অথবা প্রশ্ন তুলছেন না আজকের দিনের সাম্রাজ্যবাদের বিপর্যয়কর কার্যকলাপ নিয়ে। তিনি নরম ধাঁচের এক মার্কস, যিনি শোষকদের সব সম্পত্তি কেড়ে নেওয় হবে একথা না বলে গম্ভীরভাবে ঘোষণা করছেন : রেন্টিয়ারদের (যারা সুদ ও লভ্যাংশ থেকে বিপুল সম্পত্তি অর্জন করে) ওপর উঁচু হারে কর বসাতে হবে।
“এর গদ্যের একটা অপ্রতিরোধ্য উৎকর্ষ ধরা পড়ে যখন তা যে সমাজে আমরা বাস করি, সেই সমাজ কোথা থেকে এসেছে এবং তার গন্তব্যই বা কোথায়, এ সম্পর্কে একের পর এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি আমাদের সামনে তুলে ধরে। এটা এখনও আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি এবং বারবার ফিরে আসা অর্থনৈতিক সংকট, একদিকে কোটি কোটি মানুষের অনাহার এবং অন্যদিকে “অতি উৎপাদন”
এটা একেবারেই সঠিক কথা। এই পুস্তিকায় এমন অনেক অংশ আছে – বিশ্বায়ন সম্পর্কে অংশের কথা চট করে মনে পড়ছে – যা এই দলিল যখন লেখা হয়েছিল তার তুলনায় আজ আরও বেশি বাস্তবানুগ ও তাৎপর্যময় বলে সকলেই স্বীকার করবেন। এই বিষয়ে আমরা একটু পরেই ফিরে আসব, তার আগে যে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই কালজয়ী রচনাটি আবির্ভূত হয়েছিল সে সম্পর্কে কিছুটা অবহিত হওয়া যাক।