(কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ “মাও সে তুঙ জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি” আয়োজিত আলোচনা সভায় ভাষণ)

আজকে দুনিয়া জুড়ে প্রশ্নটা শুধু মাও সে তুঙ-এর বা মাও সে তুঙ চিন্তাধারার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে নয়, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে এবং বুর্জোয়ারা এটা ঘোষণাও করে দিয়েছে যে মার্কসবাদ ব্যর্থ হয়েছে। তাই সামগ্রিক অর্থেই প্রশ্নটা আজকের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পুনরুজ্জীবনের প্রশ্ন এবং সেই প্রসঙ্গেই মাও সে তুঙ চিন্তাধারার প্রশ্নটা আলোচনার দাবি রাখে।

সোভিয়েত নেতৃত্ব একটা পেটিবুর্জোয়া চিন্তাধারা হিসাবে ‘মাওবাদ’কে চিহ্নিত করতেন, যার সাথে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নাকি কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের আন্দোলনের মধ্যেও একটা ধারা মাও সে তুঙ চিন্তাধারাকে ‘মাওবাদ’ হিসাবে চিহ্নিত করে একটা বিশেষ কোনো ধারা হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করতেন। আমি এই মতকে সমর্থন করি না। মাও সে তুঙ চিন্তাধারাকে কোনো একটা বদ্ধ বা স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা হিসাবে আমি দেখি না।

মাও সে তুঙ চিন্তাধারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের এক নির্দিষ্ট প্রয়োগ। বিশেষ করে পশ্চাদপদ অর্থনীতির দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার ক্ষেত্রে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের এক বিশষ প্রয়োগ হিসাবে মাও সে তুঙ চিন্তাধারাকে দেখতে হবে। পশ্চাদপদ অর্থনীতির দেশে সমাজতন্ত্র গড়ার যে নির্দিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা তার একটা সার্বজনীন মূল্য আছে এবং মাও সে তুঙ চিন্তাধারা এই অর্থে এক সার্বজনীন মূল্য রাখে। অন্যদিকে, আজকের যুগে মাও সে তুঙ চিন্তাধারা হচ্ছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ পুনরুজ্জীবনের চাবিকাঠি।

মাও সে তুঙের দুটো মৌলিক অবদান। প্রথমত তিনি একটি পশ্চাদপদ দেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করেন বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে; অর্থাৎ যে বিপ্লব পুঁজিবাদের দিকে নয়, সমাজতন্ত্রের দিকে যাত্রা করবে। এই বিপ্লব করতে গিয়ে তিনি প্রথমত কৃষকদের সাথে জোট গড়ে তুললেন এবং কৃষকদের বিপ্লবী ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠা করলেন। দ্বিতীয়ত বুর্জোয়া শ্রেণীকে দুভাগে ভাগ করে ‘জাতীয় বুর্জোয়া’ অংশের সাথে এক জোট তৈরি করেন – এমনকি সমাজতন্ত্র গঠনের পর্যায়েও তাদের সাথে ঐক্য ও সংগ্রামের পদ্ধতিতে তাদের রূপান্তর ঘটান। সুতরাং তাঁর প্রথম মৌলিক অবদান হল এমন এক গণতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া, যাকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে পরিচালনা করা যায়। তাঁর দ্বিতীয় মৌলিক অবদান হচ্ছে চীনের মতো পিছিয়ে পড়া দেশে সমাজতন্ত্র গঠন।

সমাজতন্ত্র হল পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মধ্যকার এক উত্তরণকালীন ব্যবস্থা। সমাজতন্ত্রের এই পর্যায় বহু বছর ধরে চলবে, এমনকি কয়েকশত বছর ধরেও চলতে পারে। মাও সে তুঙ উত্তরণকালের এই দীর্ঘমেয়াদী চরিত্রকে সামনে নিয়ে আসেন এবং বলেন, এই উত্তরণশীল অবস্থায় শ্রেণী থাকবে, শ্রেণীসংগ্রাম থাকবে, এমনকি পিছিয়ে যাওয়ার, পুঁজিবাদের পুনঃপ্রবর্তনের বিপদও আছে। এই কথা তিনি বলেছেন কোনো বিষয়ীগত কারণে নয়, তার একটা বস্তুগত কারণ আছে। দুঃখের কথা সেই বিষয়ে অধ্যয়ন আমাদের দেশে মার্কসবাদীদের মধ্যে খুবই কম। একটা সমাজতান্ত্রিক দেশের পুঁজিবাদে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ কারণ থাকে এবং বাহ্যিক কারণ থাকে। অভ্যন্তরীণ কারণের ক্ষেত্রে মূল বিষয় হল – এখানে বিতরণের যে নীতি তা মোটামুটি পুঁজিবাদী সমাজের মতোই থেকে যায়। সেখানে সমগ্র জনগণের মালিকানা থাকে তার সাথে শ্রমিকের সম্পর্কের মধ্যে দ্বৈত চরিত্র থাকে। একদিকে, যেহেতু সেটা জনগণের বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সেই মালিকানার একটা অংশ তারও, অর্থাৎ সে নিজেও মালিক – এরকম একটা অনুভূতি শ্রমিকের মনে আসে। কিন্তু অন্যদিকে যেহেতু বিতরণের নীতিটা হচ্ছে কাজের ভিত্তিতে (প্রত্যেকে তার কাজ অনুসারে পাবে), সেই কারণে সে একজন মজুরি শ্রমিক – এরকম একটা অনুভূতিও তার থাকে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ উত্তরণকালীন পর্যায়ে থাকায়, তার বিশিষ্টতার জন্যই এই দ্বৈত সত্তা শ্রমিকের চেতনায় থাকে। তেমনই এই মালিকানায় সমগ্র জনগণের মালিকানা হিসাবে একটা দিক থাকে। অন্যদিকে, যেহেতু সেটা রাষ্ট্রীয় মালিকানা, তার কর্মচারিরা রাষ্ট্রের দ্বারা নিযুক্ত হয়, কাজেই সেই মালিকানায় আমলাতন্ত্রের এক প্রবণতাও থাকে। মালিকানার মধ্যেও দ্বৈত সত্তা থাকে, শ্রমিকের মধ্যেও দ্বৈত চেতনা থাকে। আর এটাই একটা সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রধান দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বই শ্রেণীসংগ্রামের জন্ম দেয় এবং তার প্রতিফলন হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যেও দুই লাইনের সংগ্রামের জন্ম দিয়ে থাকে। এখান থেকে কোনো সমাজতান্ত্রিক সমাজ এই দ্বন্দ্বের সমাধান করে এগিয়েও যেতে পারে সমাজতন্ত্রের উন্নততর রূপ কমিউনিজমের দিকে, আবার সে পিছিয়েও যেতে পারে পুঁজিবাদের দিকে। এখানে মূল প্রশ্নটা হচ্ছে সর্বহারার একনায়কত্বের প্রশ্ন। মার্কস বলেছিলেন, সমাজতন্ত্রের দীর্ঘ এই উত্তরণকালীন পর্বে সর্বহারার একনায়কত্ব হচ্ছে এক যোগসূত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্রুশ্চেভের সময় থেকেই সর্বহারা একনায়কত্বকে দুর্বল করা হয়েছে, সর্বহারা একনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আর তখন থেকেই সোভিয়েতের পুঁজিবাদের দিকে যাত্রাও শুরু হয়েছে।

মাও সে তুঙের সাংস্কৃতিক বিপ্লব নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। ক্ষুদে উৎপাদকদের দেশে উগ্র সমানতাবাদের চেতনার এক গভীর সামাজিক-ঐতিহাসিক উৎস থাকে। অর্থাৎ উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ পশ্চাদপদ থেকে গেলেও বিতরণের ক্ষেত্রে উগ্র সমানতার এক আকাঙ্খা পেটি বুর্জোয়া উৎপাদকদের চেতনায় থাকে। সেক্ষেত্রে অনেকে মনে করে থাকেন, উৎপাদিকা শক্তি পিছিয়ে থাকলেও কোনো একটা মতাদর্শগত বিপ্লব – কোনো একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে বোধহয় সেই সাম্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। এইভাবেই সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে অনেকে দেখে থাকেন। কিন্তু মাও সে তুঙের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধ্যানধারণা ভিন্ন ছিল। সর্বহারা একনায়কত্বকে দৃঢ় করার জন্য, সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা, সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে বাড়ানোর লক্ষ্যটা অবশ্যই ছিল। কিন্তু কখনই সমাজতন্ত্র গঠনের যে মূল অর্থনৈতিক নিয়ম আছে তাকে বা সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়গুলিকে খারিজ করে দিয়ে শুধুমাত্র মতাদর্শগতভাবে ‘উন্নত উৎপাদন সম্পর্ক’ প্রতিষ্ঠা করে ফেলা যায়, আমি মনে করি না যে মাও সে তুঙ তা বিশ্বাস করতেন।

আমাদের দেশে যেসব সমাজগণতান্ত্রিক শক্তি বা সংশোধনবাদী শক্তি আছে তাদের দিক থেকে মাও সে তুঙকে গ্রাস করে ফেলার একটা চেষ্টা সাম্প্রতিককালে আমরা দেখেছি। প্রথমত বুর্জোয়াদের প্রশ্ন তুলে তাঁরা বলছেন যে, মাও সে তুঙ বুর্জোয়াদের সাথে জোট তৈরি করেছিলেন। তাঁরা যে কথাটা বলছেন না, মাও সে তুঙ বুর্জোয়াশ্রেণীকে দুভাগে ভাগ করেছিলেন – মুৎসুদ্দি এবং জাতীয়। মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে তিনি লড়েছিলেন এবং জাতীয় বুর্জোয়াদের সাথে জোট করেছিলেন। এই বিভাজনকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু সমাজগণতন্ত্রীরা আমাদের দেশের বুর্জোয়াদের জাতীয় বুর্জোয়াই মনে করেন, কাজেই তাঁরা মাও সে তুঙের কথা নিয়ে এসে – জাতীয় বুর্জোয়াদের সাথে ঐক্য করতে হবে – এভাবে বলে মাও সে তুঙের শিক্ষাকে বিকৃত করছেন। তাঁরা মাও সে তুঙের অন্য এক শিক্ষার কথা নিয়ে আসছেন – তিনি কৃষকদের নিয়ে বিপ্লব করেছেন। কিন্তু কৃষকদের মধ্যেও মাও সে তুঙ যে বিভাজন করেছেন এবং গরিব-ভূমিহীন-নিম্নমধ্য কৃষকদের ওপরে যে তাঁর জোর থেকেছে সেই প্রশ্নটাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং কৃষক বলে মধ্য, ধনীকৃষক সবার কথা বলা হচ্ছে। তেমনি বারবার বলা হচ্ছে মাও সে তুঙ দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিলেন। এভাবে তাঁরা ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর উগ্র জাতীয়তাবাদের পক্ষেও দাঁড়াচ্ছেন। এভাবেই মাও সে তুঙকে গ্রাস করে ফেলার একটা সমাজগণতন্ত্রী প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে।

এক সময়ে মাও সে তুঙ চিন্তাধারার একটা ধারণার ভিত্তিতে আমরা বিপ্লবী আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। তারপর থেকে গঙ্গা-গোদাবরী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। বহুধা বিভক্ত হয়েও আমরা সকলেই বিভিন্নভাবে শক্তি সঞ্চয় করেছি এবং তা প্রমাণ করে যে আমাদের আন্দোলনের মধ্যে বিরাট শক্তি আছে। আমি আশা করব, মাও সে তুঙ চিন্তাধারার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে হয়তো আবার আমরা হাত মেলাবো।

(দেশব্রতী, ১৬-৩০ জুন ১৯৯৩ থেকে)

পশ্চিমবাংলায় এবার পঞ্চায়েত নির্বাচন কিছুটা অপ্রত্যাশিত ফলাফল নিয়েই হাজির হয়েছে। বামফ্রন্টের জয় সুনিশ্চত ছিল। কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে কেবল কোন্দলজনিত ও কংগ্রেস-বিজেপির মধ্যে ভোটের বিভাজনের সম্ভাবনা থেকে সিপিআই(এম) নেতৃত্ব বরং এবার আগের চেয়েও ভালো ফলাফলেরই প্রত্যাশা করেছিলেন। অথচ অদ্ভুতভাবেই দেখা গেল পৌরসভাতেই হোক বা গ্রাম পঞ্চায়েতেই হোক, কংগ্রেস তার অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। এছাড়া বিজেপিও একটি পৌরসভা দখল করা ছাড়াও গ্রাম পঞ্চায়েতেও একটা অবস্থান করে নিতে পেরেছে। কংগ্রেস-বিজেপির মধ্যে বিভিন্ন স্তরে সমঝোতা হয়েছে, হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে একথাও ভুললে চলবে না যে বিজেপি নিছক কংগ্রেসের ভোটেই ভাগ বসায়নি। বামফ্রন্টের সামাজিক ভিত্তির মধ্যেও সে অল্পবিস্তর ভাঙ্গন ধরিয়েছে।

নির্বাচনের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল – বামফ্রন্টের শরিকদের মধ্যেও এবার বহু ক্ষেত্রে সমঝোতা হয়নি এবং সিপিআই ও আরএসপি-র মতো দল সিপিআই(এম)-এর বিরোধিতা সত্ত্বেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সিপিআই(এম)-কে পরাজিত করেই জয়ী হয়েছে এবং নিজেদের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করেছে।

বামফ্রন্টের বাইরের দলগুলির মধ্যে কোচবিহারে কমল গুহদের ফরওয়ার্ড ব্লক এবং এসইউসিআই নিজেদের শক্তিকে ধরে রাখতে বা কিছুটা বাড়িয়ে তুলতেই সক্ষম হয়েছে। আইপিএফ এই প্রথম হাজার তিনেক আসনে প্রার্থী দেয় এবং নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও বর্ধমানে ৩৫টির মতো আসনে জয়লাভ করতেও সমর্থ হয়। সবচেয়ে বড় কথা, সিপিআই(এম)-এর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত বর্ধমান জেলায়, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে অন্য কোনো বামপন্থী শক্তির কার্যকরী কোনো অস্তিত্ব নেই বললেই চলে, সেই বর্ধমান জেলায় আইপিএফ এবার ৩০০-র মতো প্রার্থী দেয়। এই প্রার্থীদের একটা বড় অংশই গত তিন বছর ধরে সিপিআই(এম) থেকে বেরিয়ে আসা। সিপিআই(এম)-এর প্রচণ্ড সংগঠিত নির্বাচনী মেশিনারী এবং ব্যাপক সন্ত্রাসের মুখেও আইপিএফ প্রার্থী এবং কর্মীরা সাহসের সঙ্গে রাজনৈতিক সংগ্রামের ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং বেশি কিছু জায়গায় নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা সিপিআই(এম) ও আইপিএফ-এর মধ্যেই কেন্দ্রীভূত হয়।

বর্ধমানের মতো জেলায় সিপিআই(এম)-এর একাংশের আইপিএফ-এ চলে আসাটা কিন্তু নিছক দলবদলের কোনো ঘটনা নয় – সিপিআই(এম)-এর গণভিত্তির এই বিভাজন এখানে একটা শ্রেণীবিভাজনের রূপ গ্রহণ করে চলেছে। গ্রামের সম্পন্ন সম্ভ্রান্ত অংশ,  পার্টি-প্রশাসন-পঞ্চায়েতের ওপর কর্তৃত্বের জোরে যারা গত পনেরো বছর ধরে ক্রমেই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, সেই অংশটির সাথে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষক ও ক্ষেতমজুর জনগণ ও তাদের ঘনিষ্ঠ পার্টি কর্মীদের একাংশের মধ্যে যে ব্যবধান বেড়ে উঠেছে তারই প্রতিফলন ও পরিণতি হিসেবে এককালের সিপিআই(এম) সমর্থক ও কর্মীবাহিনীর এই অংশটি আমাদের দিকে আসতে শুরু করেছেন। এই প্রক্রিয়াটি অবশ্যই আরও গভীর অনুসন্ধানের দাবি রাখে এবং বর্ধমানের এই ধারাটি শুধু উন্নত কৃষি-অর্থনীতির এলাকাগুলিতে ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক মেরুকরণেরই একটি রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি না গ্রামবাংলার রাজনৈতিক জীবনের সাধারণ কোনো প্রবণতা তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে বর্ধমানে এই শ্রেণীবিভাজন শ্রেণীসংগ্রামের রূপ নেয় এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতো রাজনৈতিক সংগ্রামে যখন উদীয়মান কায়েমী স্বার্থান্বেষী ও স্বার্থবাহীদের ‘ঘুঘুর বাসায়’ ঘা পড়ে তখনই তারা মরীয়া হয়ে ওঠে। ঘটে যায় করন্দা, গণহত্যার এমন নারকীয় ঘটনা যার তুলনা কেবল বিহারের বহুনিন্দিত নরসংহারগুলির সাথেই করা চলে।

সামগ্রিক বিচারে বলা যায় যে বিগত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবাংলায় যে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা চলছিল, এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তা হঠাৎই নড়েচড়ে উঠেছে। কংগ্রেস, বিজেপি থেকে শুরু করে সিপিআই, আরএসপি, কমল গুহর ফরওয়ার্ড ব্লক বা এসইউসি, আইপিএফ সকলেই সিপিআই(এম)-এর বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান মজবুত করেছে। এরই পরিণতিতে গোটা পশ্চিমবাংলা জুড়ে একের পর এক নির্বাচন-পরবর্তী সংঘাত ও হিংসার ঘটনা ঘটে চলেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির বেড়ে ওঠা সক্রিয়তায় হঠাৎই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক আবহাওয়া। একচ্ছত্র রাজনৈতিক আধিপত্য ও নড়ে ওঠা রাজনৈতিক ভারসাম্যকে ফিরিয়ে আনতে মরীয়া হয়ে সিপিআই(এম) বেছে নিয়েছে সেই অতিপরিচিত কংগ্রেসী সন্ত্রাসের পথ। বিপরীতে নির্বাচনী সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে কংগ্রেস-বিজেপি বামপন্থার বিরুদ্ধে তাদের সার্বিক অভিযান আরও তীব্র করে তুলেছে। পাশাপাশি করন্দার কলঙ্কজনক গণহত্যা ও অন্য বামপন্থী শক্তিগুলির ওপরেও নেমে আসা সিপিআই(এম)-এর আক্রমণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বামপন্থী শক্তিগুলির মধ্যে সহযোগিতার একটা সম্ভাবনাও গড়ে উঠেছে। করন্দার গণহত্যার প্রতিবাদে ৩ জুন পার্টি নির্বিশেষে যেভাবে ব্যাপক বামপন্থী কর্মীর সহযোগিতা ও সমর্থনে বর্ধমান জেলায় ১২ ঘণ্টার সর্বাত্মক বনধ পালিত হল তা এই সম্ভাবনারই একটি ইঙ্গিত বহন করছে।

এমন এক জটিল অবস্থায় বাম ঐক্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের বন্ধুরা অনেকেই চিন্তিত হয়ে উঠেছেন। তাঁদের আশঙ্কা, বামপন্থী শক্তিগুলির মধ্যে বিভাজনের সুযোগ নিয়ে কংগ্রেস-বিজেপি এ রাজ্যে মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে। আমি মনে করি, এ ব্যাপারে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সিপিআই(এম)-এর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আজ যে বামপন্থীরা সোচ্চার হচ্ছেন তাঁরা কংগ্রেস-বিজেপির সাথে নীতিগত ও রাজনৈতিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রশ্নে যথেষ্ট সচেতন ও সচেষ্ট। কিন্তু কংগ্রেস-বিজেপির ধুয়ো তুলে সিপিআই(এম) যদি বিভিন্ন বামপন্থী শক্তিকে পোষ মানাতে চায় তাহলে এটুকুই বলতে পারি যে সেটা হবে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক নেতিবাচক রাজনীতি। পুরোনোভাবে বাম ঐক্যকে আর ধরে রাখা যাবে না – তাকে দাঁড়াতে হবে এক নতুন ভিত্তির ওপর। বামফ্রন্টের অভ্যন্তরে যেসব শরিক দল তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব তুলে ধরেছে তাদের সকলেরই দাবি – সিপিআই(এম)-কে তার দাদাগিরির মনোভাব ছাড়তে হবে। বামফ্রন্টের বাইরে যে বামশক্তি আছে, বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা নিয়ে তাদের সাথে তাত্ত্বিক বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়ার সাহস সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বকে দেখাতে হবে – সম্মান জানাত হবে বামফ্রন্ট সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের আন্দোলন করার অধিকারকে। আর অবশ্যই করন্দার মতো কলঙ্কজনক ঘটনার ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) নেতৃত্বকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আত্মসমালোচনা করতে হবে, দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে হবে। সিপিআই(এম) যদি এই পথ বেছে নিতে পারে তাহলে অবশ্যই পশ্চিমবাংলায় বাম ঐক্যের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, তার নীতিগত ভিত্তিও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এরকম নীতিনিষ্ঠ বাম ঐক্যই প্রকৃত মার্কসবাদীদের কাম্য।

আর এ পথ না নিয়ে সিপিআই(এম) যদি অধুনালিপ্ত সোভিয়েত নেতৃত্বের মতো নিজেদের মডেলকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে অহংকারে ভোগেন, দাদাসুলভ মনোভাব নিয়ে সকলের ওপর নিজেদের  কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিতে চান, সোভিয়েত নেতৃত্বের মতোই পার্টির প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে ভুল ও বিকৃত তথ্য পার্টি কর্মীবাহিনীর কাছে পরিবেশন করতে থাকেন, তাহলে বাম ঐক্য তো দূরের কথা সোভিয়েত নেতৃত্বের মতোই তাঁদেরও পতন ঘটবে। লেনিন একসময়ে বলেছিলেন, ইতিহাসে বহু বিপ্লবী পার্টিই, যারা অহংকারী হয়ে উঠেছিল ও প্রকৃত আত্মসমালোচনা করার সাহস দেখাতে পারেনি, ধ্বংস হয়ে গেছে। ইতিহাসের এমনই পরিহাস যে খোদ সোভিয়েত পার্টির মতো বিশালকায় পার্টি ও তার দ্বারা পরিচালিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তিও লেনিনের এই শিক্ষা ভুলে গিয়ে সেই পরিণতিরই শিকার হয়েছে। সিপিআই(এম) নেতৃত্ব ইতিহাস থেকে কী শিক্ষা নেবেন জানি না, ইতিহাস কিন্তু তার নিজস্ব অমোঘ গতিতেই এগিয়ে চলবে।

(দেশব্রতী, ২৫ মে ১৯৯৩ থেকে)

প্রত্যেক বছর ২৫ মে ঘুরে আসে এবং আমাদের মনে করিয়ে দেয় নকশালবাড়ির কথা। নকশালবাড়ির জোতদার-জমিদারদের বিরুদ্ধে গরিব ভূমিহীন কৃষকদের বিদ্রোহ কোনও সাধারণ বিদ্রোহ নয়। নকশালবাড়ি ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে এবং এটাই তার বৈশিষ্ট্য। নকশালবাড়ি ঘটেছিল এমন এক পরিস্থিতিতে যখন স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় শাসনব্যবস্থার প্রথম সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল, যখন বিভিন্ন ইস্যুতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যাচ্ছিল এক গণজাগরণ এবং তার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের একাধিপত্য ভেঙ্গে গড়ে উঠছিল অ-কংগ্রেসী সরকারগুলি। নকশালবাড়ি ঘটেছিল পশ্চিমবাংলায় – যেখানে গণজাগরণ ছিল শীর্ষবিন্দুতে এবং যেখানে প্রথম অ-কংগ্রেসী সরকারে বামপন্থীরাই ছিলেন প্রধান শক্তি।

এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নকশালবাড়ি বনাম যুক্তমোর্চা সরকার – এই দুই মডেলের মধ্যকার সংঘাত ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুই পথ ও দুই কৌশলের মধ্যকার সংঘাতের ব্যবহারিক রূপ গ্রহণ করে। তারপর থেকে গত ২৬ বছর ধরে গঙ্গা-গোদাবরী দিয়ে বহু জলই গড়িয়ে গেছে। নকশালবাড়ির ধারার কৃষক আন্দোলন বিহারে তার ভরকেন্দ্র খুঁজে পেয়েছে যেখানে প্রায় কুড়ি বছর ধরে তার অস্তিত্ব ও অগ্রগতি অব্যাহত।

সংগ্রাম-বিপর্যয়-পুনর্গঠনের জটিল প্রক্রিয়া থেকে শিক্ষা নিয়ে বিপ্লবী কমিউনিস্টরা তাঁদের রণকৌশলে বহু কিছু বাতিল করেছেন ও অনেক কিছুই সংযোজন করেছেন। অপরদিকে পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকার প্রায় সতেরো বছর ধরে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিতে শাসনক্ষমতা ধরে রেখেছে এবং যাবতীয় গণউদ্যোগকে তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে পঞ্চায়েতের গণ্ডিতে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

বহু কিছু পাল্টে গেলেও তাই বিহারে কমিউনিস্ট বিপ্লবী শক্তির নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন ও পশ্চিমবাংলায় সমাজগণতন্ত্রীদের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের মডেলের মধ্যে দিয়ে সেই চিরন্তন দুই পথের ও দুই কৌশলের সংগ্রাম আজও অব্যাহত।

ইতিহাসে শাসকশ্রেণীর পরবর্তী প্রজন্মের পরিধি ও গণভিত্তি সর্বদাই সম্প্রসারিত হয়ে থাকে। ইংরেজ শাসকরা গ্রামের জমিদারদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে শাসন করত, কংগ্রেসী শাসনের গণভিত্তি গ্রামে সম্প্রসারিত হয় নব্য জমিদার-জোতদারদের মধ্যে। সিপিআই(এম)-এর সমাজগণতান্ত্রিক শাসনে এই গণভিত্তি বিস্তৃত হয়ে ধনী কৃষক ও মধ্য কৃষকের স্বচ্ছল অংশকেও সামিল করেছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ধাপে শাসকশ্রেণীর পুরোনো অংশগুলি তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হারায়। তাদের কিছু অংশ অবশ্য নবরূপে নতুন শাসনক্ষমতার শরিক হয়ে দাঁড়ায়।

সিপিআই(এম)-এর শাসনের ১৭ বছরে পার্টি ও সরকারি ক্ষমতায় আধিপত্যকারী শ্রেণীশক্তিগুলির সাথে ব্যাপক ক্ষেতমজুর ও দরিদ্র কৃষক জনগণের বিরোধ ক্রমেই বাড়ছে। বর্ধমানের মতো জেলায় নীচুতলার মানুষ আমাদের প্রতি যে আকৃষ্ট হতে শুরু করেছেন এটা তারই প্রমাণ। যত দিন যাবে পঞ্চায়েতের ভেতরে ও বাইরে এই বিক্ষোভ বাড়বে এবং পশ্চিমবাংলায় পঞ্চায়েতের গণ্ডি ভেঙ্গে এইভাবেই নবরূপে নকশালবাড়ির আবির্ভাব ঘটবে। পশ্চিমবাংলার মাটিতে সার্থক হবে কমরেড চারু মজুমদারের কথা : নকশালবাড়ি মরেনি, নকশালবাড়ি মরবে না।

(২৮ ডিসেম্বর, ১৯৯২ ব্রিগেড ময়দানে ভাষণ)

“বহু বছর আগে একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। ৭০ দশকের শেষের দিকে আমরা যখন গণ-বিচ্ছিন্নতায় ভুগছিলাম একদিন কলকাতার রাস্তায় লাখ লাখ মানুষের মিছিল দেখেছিলাম – লাল ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে। একটা ইচ্ছে জেগে ছিল এমন দিন কী আসবে যখন আমার পার্টির নেতৃত্বে আমাদের পার্টির ঝাণ্ডা নিয়ে লাখ লাখ মানুষের মিছিল কলকাতার রাস্তায় এভাবেই যাবে। আজ সেই স্বপ্ন সফল হয়েছে।

“এই কলকাতা ১৯৭০-এর দশকে আমাদের আন্দোলন দেখেছে। তাছাড়া দেখেছে কেমনভাবে হাজার হাজার তরুণকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে এই ব্রিগেড ময়দানেই কমরেড সরোজ দত্তকে নৃশংসভাবে। কমরেড চারু মজুমদারকে ঠাণ্ডা মাথায় লালবাজার পুলিশ লক-আপে হত্যা করা হল। সারা পশ্চিমবাংলা জানল, সারা দেশ জানল, সারা পৃথিবী জানল ১৯৭০-এর দশকে কলকাতায় হাজার হাজার যেসব বিপ্লবী তরুণরা জীবন দিয়েছিল তারা ছিল নকশালপন্থী। অথচ আশ্চর্যের সঙ্গে দেখলাম বামফ্রন্ট সরকার যখন ক্ষমতায় এল তাঁদের নেতারা বললেন অর্ধ-সন্ত্রাসের যুগে অর্ধ-ফ্যাসিবাদের যুগে নাকি ওঁদের ১১০০ কর্মী মারা গেছেন এবং সেটাই যেন সেই ফ্যাসিবাদের আসল অত্যাচারের কথা। শুনে আশ্চর্য হয়েছি। সিপিআই(এম)-এর বা অন্য যে সব বামপন্থী কর্মীরা সেই কংগ্রেসী সন্ত্রাসের যুগে প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের সকলকেই আমরা শহীদের মর্যাদা দিই। কিন্ত হাজার হাজার যে সব বিপ্লবী তরুণ জীবন দিলেন তাঁরা কিন্তু সেই সংগ্রামের অংশীদার হিসাবে সেই মর্যাদা পেলেন না। শহীদ বলে স্বীকারও করা হল না তাঁদের। আমরা দেখেছি ও ব্যাপারে তদন্তগুলো হল না। আজও সরোজ দত্তের হত্যারহস্য – রহস্যই থেকে গেল। চারু মজুমদারের হত্যারহস্য – রহস্যই থেকে গেল। আর আমরা শুনেছি ১৫ বছর ধরে নাকি এখানে একটা বামফ্রন্টের শাসন আছে। কমিউনিস্ট পার্টি শাসন চালায়। অথচ কংগ্রেসী সন্ত্রাসের যুগের সেই সমস্ত অত্যাচার ও সেই সমস্ত নেপথ্য কাহিনীগুলো আজও কেন যে নেপথ্যে থেকে গেল সে প্রশ্নের জবাব কিন্তু আমরা পেলাম না।

“১৯৭০-এর দশকে এই পশ্চিমবাংলার বুকে একটা ঝড় এসেছিল। সেই ঝড়ে অনেক কিছু পড়ে গিয়েছিল। বহু মনীষীর মূল্যায়নে আমরা একপেশেপনার শিকার হয়েছিলাম। আমরা ভুল করেছি। ক্রমে ক্রমে সে ভুল শুধরেছি। যে কোনও জাতির একটা আবেগ থাকে, একটা মর্যাদা থাকে। সেই মনীষীদের সেই সম্মান অনেক সময়ই আমরা দিতে পারিনি। সমালোচনা আমরা যা করেছি তার অনেক দিক সঠিক থাকা সত্ত্বেও তাঁদের সম্পূর্ণভাবেই নাকচ করে দেওয়ার প্রবণতাটি ছিল ভুল। হয়তো বিপ্লবী আন্দোলনের একটা জোয়ারে এভাবেই শুরু হয়ে থাকে। তবে আজ আমরা আমাদের সেই ভুলগুলো শুধরে নিয়ে পশ্চিমবাংলার বুকে আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছি। আজ আজকের এই ৠালি দেখিয়ে দিচ্ছে যে আমরা পশ্চিমবাংলার বুকে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করেছি।

“আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে এবার দু-চার কথা বলব। বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। আপনারা জানেন, এরপরে আমাদের দেশের চেহারা বিরাটভাবে বদলে গেছে। এ ব্যাপারে আমরা দেখছি, কংগ্রেস সরকার বলছে – আমরা বিজেপি-কে বিশ্বাস করেছিলাম আর এটাই ছিল আমাদের ভুল। কিন্তু এখানে একটা কথা বলার আছে। জাতীয় সংহতি পরিষদের বৈঠকে কেন্দ্রীয় সরকার কেবল একটাই প্রস্তাব দেয়। তা হল, পুরো বিষয়টা সুপ্রীম কোর্টের ওপর ছেড়ে দেওয়া যাক। এই প্রস্তাবে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ার কোনো কথাই ছিল না। তা ঐ বৈঠকে আমাদের কমরেড জয়ন্ত রংপিও উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমাদের পার্টির বক্তব্য সেখানে রাখেন। তিনি বলেন – রাও সাহেব, আপনি ভুল রাস্তা নিচ্ছেন। সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোকে এভাবে তুষ্ট করে চললে তাদের মারমুখীভাব আরও বাড়তে থাকে। সমঝোতার পথ আপনি ছাড়ুন। ওদের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। কমরেড রংপি আরও বলেন – জাতীয় সংহতি পরিষদের উচিত রাও সরকারকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া। কিন্তু আমাদের কমরেডের কথা সেখানে শোনা হয়নি। বরং আমরা দেখলাম, সিপিআই(এম)-এর প্রতিনিধি প্রস্তাব দিয়ে বসলেন – কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর আমাদের ভরসা আছে, সুতরাং রাও সাহেব যা করবেন আমরা তার পেছনে থাকব।

“এরপরে কী ঘটল তা তো আপনারা জানেনই। এখন নরসীমা রাও বলছেন যে আমরা বিজেপির ওপর ভরসা রেখেছিলাম কিন্তু তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আর সিপিআই(এম) বলছে – আমরা রাও সাহেবের ওপর ভরসা করেছিলাম কিন্তু তিনি আমাদের পথে বসিয়েছেন। এইভাবে এক রাজনীতির খেলা চলছে। অনেক দ্বিধা করে কয়েকটি বিলম্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার পর কংগ্রেস এখন বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। সিপিআই(এম)ও কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতার পথ খুঁজছে। এমনকি, কংগ্রেসের সঙ্গে এক “ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চার” কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে।

“আমি বলতে চাই, মোর্চা তো আপনারা বানিয়েই ছিলেন। জাতীয় সংহতি পরিষদ তো এক ধরনের মোর্চাই ছিল। ঐ মোর্চা গড়ার পরেই বা কী হল? বাবরি মসজিদের ওপর হামলা তো আপনারা রুখতে পারলেন না। তাহলে আবার ঐ একই লোকেদের সঙ্গে মোর্চা গড়ে সাম্প্রদায়িকতার ঢেউ আপনারা রুখতে পারবেন মনে করছেন?

“অবশ্য এর পাশাপাশি অন্য একটা প্রচেষ্টাও চলছে। বামপন্থীরা নিজেরা আরও ঘনিষ্ঠভাবে ঐক্যবদ্ধ হোক এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে সামিল করে মোর্চা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাক। এই প্রচেষ্টায় আমরা অবশ্যই থাকব, সম্প্রতি গঠিত জাতীয় প্রচার কমিটিতে আমরা আছিও। কিন্তু আমরা মনে করি, কংগ্রেসকে সাথে নিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সত্যিকারের কোনো লড়াই আদৌ লড়া যায় না।

“আসল প্রশ্নটা হল, বামপন্থার কর্তব্যটা ঠিক কী? কখনও জনতা দলের পিছনে চলার আর কখনও কংগ্রেসের পিছনে চলার সিদ্ধান্ত নেওয়াটুকুই কি একমাত্র কর্তব্য হয়ে গেছে? আমাদের পার্টির মতে, এ ব্যাপারটা এবার ছাড়া উচিত। বহুকাল থেকেই ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন তথা বামপন্থী আন্দোলন এই পাপচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাদের সদ্যসমাপ্ত পার্টি কংগ্রেসে আমরা এটাই বলেছি। বামপন্থীদের আজ এগিয়ে যেতে হবে এক নতুন দৃশ্যকল্প নিয়ে, এক বামপন্থী বিকল্পের ধারণা নিয়ে। আর এটাই আজকের রাজনীতির মূল কথা, আসল কথা – আমাদের সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের পার্টি কংগ্রেসে আমরা এনিয়ে আলোচনা করেছি এবং এজন্য আমরা সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করে যাব।

“অবশ্য বাম ঐক্য গড়াটা কোনো সহজ কাজ নয়। অনেক গুরুতর ও মৌলিক বিষয়ে আমাদের মতপার্থক্য থাকায় বাম ঐক্য গড়ে তোলা বা তাকে ধরে রাখা খুবই কঠিন। তবু আমরা এদিকে এগোচ্ছি। বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে আমরা একসাথে কাজ করছি। বিহারে আটটি বামপন্থী দল যুক্তভাবে জমি দখল আন্দোলন চালাচ্ছে। সেখানে সিপিআই আছে, সিপিআই(এম) আছে, আমরা সকলে মিলে হাজার হাজার একর উদ্বৃত্ত জমি দখল করেছি। এখন আমরা পরবর্তী স্লোগান হিসাবে ফসল তোলার আওয়াজ রেখেছি।

“একইভাবে, শ্রমিকফ্রন্টে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলি মিলিত হয়ে ভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের উদ্যোক্তা (স্পনসরিং) কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির আহ্বানেই কদিন আগে দিল্লীতে হাজার হাজার শ্রমিকের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হল। এটা সত্যিই এক ইতিবাচক ঘটনা। তবু, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে বামপন্থী পার্টিগুলি অর্থনৈতিক ইস্যুতে সংগ্রাম কমিয়ে আনতে পারে এবং কংগ্রেসের প্রতি নরম মনোভাব নিতে পারে – এ বিপদ সর্বদাই থেকে যায়। আমাদের অবশ্যই এ ধরনের সমস্ত প্রবণতার বিরুদ্ধে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে।

“কৃষক ও শ্রমিকদের, ছাত্র ও মহিলাদের এই ধরনের সব সংগ্রামের ভিত্তিতেই আমরা সমস্ত বামপন্থী শক্তির এক দৃঢ়, শক্তিশালী ঐক্য গড়তে চাই। ঐক্য বলতে আমরা নেতাদের মধ্যে সমঝোতা বুঝি না, নির্বাচনী আসন বা মন্ত্রীত্ব বিতরণের ফর্মুলা বুঝি না। এ ধরনের সংকীর্ণ ভাসা ভাসা ঐক্যের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। গণআন্দোলনের ভিত্তিতে ঐক্য, শ্রেণীসংগ্রামের আগুনে পোড় খাওয়া ঐক্যই আমরা চাই।

“এরকম ঐক্য গড়তে সময় হয়তো বেশি লাগবে, কিন্তু আমাদের ধৈর্য্য হারালে চলবে না। যেভাবেই হোক সাময়িক কিছু বানানোর দিকে আমরা ছুটব না। স্থায়ী ও দৃঢ় ঐক্য গড়তে প্রয়োজনীয় সময় আমাদের দিতেই হবে।

“আর একটি কথা। আমাদের পার্টি কংগ্রেস নব্বই-এর দশককে বিপ্লবী সংগ্রামের দশকে পরিণত করার ডাক দিয়েছে। আমরা বর্তমান শতকেই আমাদের দেশের চেহারায় পরিবর্তন নিয়ে আসতে চাই। আমরা চাই, আগামী শতাব্দী – একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করুক এক নতুন ভারত। এই কাজ সম্পন্ন করতে আমাদের পার্টি কমিউনিস্ট ঐক্যের কথা অর্থাৎ সমস্ত ভারতীয় কমিউনিস্টদের একটিই কমিউনিস্ট পার্টির পতাকাতলে নিয়ে আসার কথাও তুলে ধরেছে। সত্যিই তো, ভারতবর্ষে কেন এতগুলি কমিউনিস্ট পার্টি থাকবে? আমরা, ভারতের কমিউনিস্টরা, কেন একটি পার্টিতে মিলে মিশে কাজ করতে পারব না?

“কিন্তু আমরা এও জানি যে, এই লক্ষ্য তখনই অর্জন করা যাবে যখন আমরা নিজেদের ভারতের বৃহত্তম কমিউনিস্ট দলে পরিণত করতে পারব। কেবল তখনই আমরা দেশমায়ের মুখচ্ছবি পাল্টে দিতে পারব। কেবল তখনই আমরা লেনিনের স্বপ্ন – বিংশ শতাব্দীকে বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের মুক্তির শতাব্দীতে পরিণত করার স্বপ্ন – অংশত হলেও পূরণ করতে পারব। কেবল তখনই আমরা পারব বিপ্লবের এক নতুন জোয়ার সৃষ্টি করতে, যে জোয়ার প্রবাহিত হবে গঙ্গা থেকে ভল্গার দিকে।

“অতএব আসুন, আমরা নিজেদের উৎসর্গ করি ভারতের বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে ওঠার কাজে। বামপন্থী শক্তিগুলির দৃঢ় ও সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তোলার কাজে। আমাদের দেশের চেহারাটাই পাল্টে দেওয়ার কাজে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে আমাদের মহান মাতৃভূমিকে মুক্ত করার কাজে।

“আমার বক্তব্য আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। লাল সেলাম।”

(দেশব্রতী, সেপ্টেম্বর ১৯৯০ থেকে)

২৫ মে নকশালবাড়ি দিবস। নকশালবাড়ি এক, তার অর্থ অনেক। ভিন্ন ভিন্ন অর্থকে ধরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন গোষ্ঠী যারা একে অপরের বিরুদ্ধে দীর্ঘ বছরগুলি ধরে অন্তহীন বিতর্কে লিপ্ত। প্রায়শই তাদের মধ্যকার সম্পর্কও হয়ে দাঁড়িয়েছে শত্রুতাপূর্ণ। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তির শেষ নেই এবং পশ্চিমবাংলার মানুষ ধরেই নিয়েছেন যে, নকশাল আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

সিপিআই(এম)-এর যা সব কার্যকলাপ – আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি, সন্ত্রাস – তাতে ব্যাপক মানুষের মনেও যেমন বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে, তেমনি সিপিআই(এম)-এর অভ্যন্তরেও বেড়ে চলেছে বিক্ষোভ, অশান্তি ও ভাঙন। এই বিক্ষোভের স্বাভাবিক উত্তরণ নকশালবাদেই ঘটত কিন্তু নকশালবাড়ির ধারা সম্পর্কে ব্যাপক বিভ্রান্তি এবং পশ্চিমবাংলায় আমাদের করুণ অবস্থার দরুণ অনেকেই হয় সিপিএমেই থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, না হয় সিপিআই(এম)-এরই কিছু কিছু বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীগুলির জন্ম দিচ্ছেন। এই গোষ্ঠীগুলি সিপিআই(এম) ও নকশালবাদের মাঝখানের এক তথাকথিত বিকল্পের মোহ ছড়াচ্ছে। সিপিআই(এম)-এর বিকল্প একমাত্র নকশালবাদই হতে পারে, এ সত্য ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং সিপিআই(এম) নেতৃত্ব একথা খুব ভালো করেই জানেন। জানেন বলেই তাঁরা নকশালবাদকে তাঁদের প্রধান মতাদর্শগত শত্রু বলে ঘোষণা করেন। তাঁদের অভ্যন্তরে যে কোনো বিক্ষোভে নকশালবাদের ভূত দেখেন, নকশালবাদকে সাধারণ বামপন্থী ধারার অংশীদার মানতেও তাই তাঁরা নারাজ এবং খুব সচতেনভাবেই যে কোনো সংযুক্ত কার্যকলাপ এড়িয়ে গিয়ে, পায়ে পা বাধিয়ে প্ররোচনা দিয়ে সংঘাতকেই বাড়িয়ে চলেছেন।

সিপিআই(এম) ও নকশালবাদের মাঝামাঝি কোনো বিকল্পের ধারণা এক ব্যর্থ প্রয়াস শুধু নয়, এক প্রতিঘাতী ধারণাও বটে। তবে এসব বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীগুলিকে দোষ দিয়ে আর কী হবে। আমাদের দুর্বলতাই তাদের অস্তিত্বের শর্ত যোগাচ্ছে। বিহারে যেখানে আমরা নকশালবাড়ি ধারার শক্তিশালী প্রতিনিধি হিসাবে বেরিয়ে এসেছি, সেখানে সিপিআই(এম)-এর এক বড় অংশ সরাসরি আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন।

পশ্চিমবাংলাতেও যদি আমরা নকশালবাড়ির প্রকৃত তাৎপর্য প্রতিষ্ঠা করতে পারি এবং এই ধারার শক্তিশালী প্রতিনিধি হিসাবে বেরিয়ে আসতে পারি তাহলে সিপিআই(এম)-এর মধ্যে এক ধ্বস নামতে বাধ্য।

নকশালবাড়ির প্রকৃত তাৎপর্য বলতে কী বোঝায়? নকশালবাড়ির অর্থ বুনিয়াদী কৃষক জনগণের জাগরণ। সশস্ত্র কিছু স্কোয়াড দিয়ে এদিক ওদিক বিক্ষিপ্ত কিছু কার্যকলাপ বা কিডন্যাপের মতো চমকপ্রদ এ্যাকশন করে বেড়ানো নয়। তার অর্থ কলকাতা, দিল্লী, বোম্বেতে কফি হাউসে বসে বড় বড় বিপ্লবী বুলি আওড়ানোও নয়। নিজেদের ব্যর্থতাকে চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী আমাদের যতই গালাগালি দিয়ে বেড়াক না কেন, সত্য এটাই যে নকশালবাড়ির ধারায় এই কৃষক জাগরণ একমাত্র ঘটছে বিহারেই এবং আমাদের পার্টিই রয়েছে তার সামনের সারিতে।

নকশালবাড়ির অর্থ এই কৃষক জাগরণের ভিত্তিতে জাতীয় রাজনীতিতে এক বৈপ্লবিক রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন। স্থানীয় ভিত্তিতে কৃষকের কিছু অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া পূরণের মানেই কিন্তু নকশালবাড়ি নয়। পাহাড়ে-জঙ্গলে গিয়ে ‘লাল সেনা ও ঘাঁটি এলাকা’ গড়ে যারা বিকল্প রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তাদের সকলেই ব্যর্থ হয়েছেন। এখন সেখানে রাজনীতি বন্দুক চালাচ্ছে না, উল্টে বন্দুকই রাজনীতি চালাচ্ছে।

নকশালবাড়ি মার্কসবাদ বনাম সংশোধনবাদ, সশস্ত্র সংগ্রাম বনাম সংসদীয় পথের মধ্যকার কোনো বিমূর্ত সংগ্রামের সাফল্য নয়। পেটিবুর্জোয়া বিপ্লববাদ কিন্তু তাই ভাবে। কাজেই সে মনে করে বিপ্লবী ভাবাবেগ দিয়ে ও কিছু মৌলিক মার্কসবাদী সূত্র দিয়ে যখন খুশি, যেখানে খুশি নকশালবাড়ি গড়ে তোলা সম্ভব। যাবতীয় নৈরাজ্যবাদী কার্যকলাপ, তদজনিত হতাশা এবং অবশেষে উল্টো পথে যাত্রা – যার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে – এ সবের পিছনে বিপ্লব সম্পর্কে মধ্যবিত্তের সেই কল্পনাবিলাসই কাজ করে।

নকশালবাড়ির শিকড় রয়েছে ভারতের গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে, তার পেছনে আছে দীর্ঘ কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস, তেভাগা-তেলেঙ্গানার ধারাবাহিকতা। আছে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুই বিপরীতমুখী কৌশলগত লাইনের মধ্যকার দীর্ঘ সংগ্রামের প্রক্রিয়া। একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যার পরিণতি ঘটেছিল নকশালবাড়ির বিদ্রোহে। নকশালবাড়িকে বুঝতে হলে এসবই বুঝতে হবে।

মেহনতি কৃষক জনগণের জাগরণের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা হবে নাকি বুর্জোয়াদের কোনো না কোনো অংশের সাথে যুক্তফ্রন্টের স্বার্থে কৃষক জনগণের উদ্যোগকে স্তিমিত করা হবে – এই দুই বিপরীতমুখী কৌশলের লড়াই দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল। ১৯৬৭ সালের বিশেষ এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই এই লড়াই তার চরমবিন্দুতে পৌঁছায় – যখন ক্ষমতাসীন যুক্তফ্রন্ট সরকার কৃষক আন্দোলনের ঢেউকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা এগিয়ে যান এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিতে।

নকশালবাড়ির পক্ষে আপোশ বা পশ্চাদপসরণ করা সম্ভবও ছিল না, উচিতও ছিল না, কারণ তা হয়ে উঠেছিল এক নতুন বিপ্লবী পথের অগ্রদূত। ইতিহাসে সর্বদাই প্রথম বিপ্লবী অভিযানগুলি চূড়ান্ত মীমাংসার দিকেই ধাবিত হয়ে থাকে এবং তাই তারা ইতিহাসও সৃষ্টি করে যায়। কৌশলগত দিকগুলির সমন্বয় সাধন করতে দুপা পিছনে সরে আসা ইত্যাদি ইত্যাদি সবই সংরক্ষিত থাকে পরবর্তী প্রচেষ্টাগুলির জন্যই। নকশালবাড়ির অন্যতম নেতা হওয়া সত্ত্বেও কানু সান্যাল নকশালবাড়ির এই মর্মবস্তুটাই ধরতে পারেননি। ইতিহাস তাই রসিকতা করে তাকে ঠেলে দিয়েছে নকশালবাড়ির এলাকায় নেতা হয়ে থাকার জন্য। হাজার চেষ্টা করেও নকশালবাড়ি ধারার নেতা তিনি হতে পারেননি।

ইতিহাস যেমন কখনও নিজের অবিকল পুনরাবৃত্তি করে না, তেমনি একটি মহান আন্দোলনের পুনর্জন্মও তার পুরোনো রূপে আর হয় না। যে যুগে আমরা ভালোরকম অধিবিদ্যায় ভুগতাম, বছরের পর বছর পুরোনো রূপে ও পদ্ধতিতেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য কত চেষ্টাই না চালিয়েছি কিন্তু তাতে সফলতা আসেনি।

কোনো সংগ্রামই সরলরেখায় চলে না। ঠিক সময়ে এগিয়ে গিয়ে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে আঘাত যেমন হানতে হয়, তেমনি প্রয়োজন হলে দুপা পেছনে সরে এসে নিজের শক্তিকে পুনর্গঠিত করতেও শিখতে হয়। যে কোনো আন্দোলন, সংগ্রাম বা যুদ্ধ এই উভয় দিককে নিয়ে গড়ে ওঠে। এই উভয় দিকের সঠিক সমন্বয় ঘটানোই হল নেতৃত্বের দক্ষতা বা যোগ্যতার প্রমাণ।

নকশাবাড়ির মর্মবস্তু অর্থাৎ বুনিয়াদী কৃষক জনগণের জাগরণই গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। বুর্জোয়াদের কোনো না কোনো অংশের সাথে যুক্তমোর্চা বানিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের স্বপ্ন নিছক ধাপ্পাবাজি – সেটা আজও সত্য। প্রশ্নটা হল পরিস্থিতির বিকাশের সাথে সঙ্গতি রেখে সংগঠন ও সংগ্রামের নতুন নতুন রূপের মধ্যে সেই একই অন্তর্বস্তুকে প্রবাহিত করা।

ব্যাপক কৃষক জনগণের গণজাগরণের ভিত্তিতে বিপ্লবী গণতন্ত্রের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চার নামে বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তির বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তির স্বাধীন বিকাশের শ্লোগানের মধ্য দিয়ে এবং সংসদীয় সংগ্রামে চরম বিরোধী পক্ষের অবতারণার মাধ্যমে আজকের পরিস্থিতিতে আমরা নকশালবাড়ির সেই মর্মবস্তুকেই, দুটি বিপরীতমুখী কৌশলের সেই একই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে চলেছি।

আমাদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে সশস্ত্র সংগ্রামের গলাবাজি বা চমকপ্রদ এ্যাকশনগুলি ভোঁতা অস্ত্রে পরিণত হয়েছে এবং সেগুলি সমাজগণতন্ত্রীদের গণভিত্তিকে একটুও নড়াতে সক্ষম নয়। অপরদিকে আমাদের বর্তমান রণকৌশল দিয়েই আমরা সমাজগণতন্ত্রীদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ দাঁড় করাতে সক্ষম হচ্ছি। আমাদের গণভিত্তি ব্যাপকভাবে সিপিআই(এম)-এর দিকে সরে যাওয়ার ১৯৭৭ পরবর্তী ধারামুখ পশ্চিমবাংলাতেও ক্রমে ক্রমে ঘোরানো সম্ভব হচ্ছে।

পশ্চিমবাংলায় আবার এক নকশালবাড়ির গড়ে ওঠার শর্তগুলি পেকে উঠছে। দীর্ঘ বারো বছরের বামফ্রন্টের রাজত্বে এবং অবশেষে কেন্দ্রে ‘বন্ধু সরকার’ প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে সিপিআই(এম)-এর রাজনৈতিক লাইনের সুবিধাবাদ পূর্ণতা লাভ করেছে। যেখান থেকে এখন সংগ্রাম ও আন্দোলনের নামে পার্টি নেতৃত্ব শুধু হাওয়ায় তলোয়ার ঘোরাতে পারে মাত্র।

অপরদিকে আমাদের পার্টির ভিতর থেকে উঠে আসা দক্ষিণপন্থী আত্মসমর্পণবাদী লাইনের পরাজয় এবং রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের বিকাশ সাম্প্রতিককালে জন্ম নেওয়া বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়েছে। এই লাইনের প্রবক্তা মুষ্টিমেয় পদলোভী চক্রান্তকারী পাণ্ডাদের তাড়িয়ে দিয়ে পশ্চিমবাংলার পার্টি সংগঠনে ফিরে এসেছে ঐক্য, শৃঙ্খলা ও কর্মোদ্যমের পরিবেশ। এখন পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭০-এর দশকে যে নতুন ইতিহাস আমরা লিখতে গিয়েছিলাম, তা কি শুধু ইতিহাসই হয়ে থাকবে? অসাধারণ বীরত্ব, আত্মবলিদান, বেদনা ও বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা এক বেদনাদায়ক ইতিহাস হয়ে থাকবে – যা নিয়ে কবিরা কবিতা লিখবে, শিল্পীরা ছবি আঁকবে, গবেষকরা থিসিস রচনা করবে, বিপ্লবের শত্রুরা উপহাস করবে এবং আমরা মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান করে স্মৃতিমন্থন করব? না, তা আমরা হতে দিতে পারি না। বাংলার আকাশে বাতাসে আবারও প্রতিধ্বনিত হবে সেই চিরপরিচিত রণধ্বনি “নকশালবাড়ি লাল সেলাম”। সেই দিনকে এগিয়ে আনার শপথই তো নিতে হবে আজকের দিনে।

(দেশব্রতী, বিশেষ সংখ্যা, অক্টোবর ১৯৯৪ থেকে)

১৯৭২-এর ২০ মে-র সকালে আমাদের সামনে যখন বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলের সদর দরজা খুলে গেল তখনও বিশ্বাস হয়নি যে সত্যিই আমরা ছাড়া পাচ্ছি। পিডি এ্যাক্টে বিনা বিচারে এক বৎসর আটক রাখার মেয়াদ সেদিনই শেষ হচ্ছিল বটে তবে পশ্চিমবাংলায় তখন চলছে জঙ্গলের রাজত্ব। জেল গেট থেকে ধরে পুনরায় জেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। গেটের সামনে দাঁড়ানো কালো ভ্যান দেখে সেই আশঙ্কাই ঘনীভূত হল। গেট থেকে বেরিয়ে পাঁচিলের গা ঘেঁষে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। পেছনে ফিরে তাকালাম – ওরা আসছে না। আমরা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম।

এই বিরাট উঁচু পাঁচিলকে ওপার থেকে ডিঙ্গোনোর পরিকল্পনা করতে গিয়ে কয়েক মাস আগেই কত তাজা প্রাণ রক্ত ঝরিয়েছে এবং আমরা গোটা সময়টাই ফাঁসির আসামীদের জন্য নির্ধারিত ২৫ নম্বর সেলে ২৪ ঘণ্টা আটক থেকেছি।

জেলে ছেড়ে আসা সাথীদের জন্য মন খারাপ হয়ে গেল। সেলে আটক অবস্থাতে যদিও একে অপরের মুখ দেখতে পেতাম না, কিন্তু জোরে স্লোগান, গান ও রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এবং সর্বোপরি রাত্রে চা-গাড়ির মাধ্যমে – দড়ি দিয়ে বাঁধা বাটিতে চায়ের গ্লাস এক সেল থেকে অপর সেলে পাঠিয়ে – আমরা জীবন্ত সম্পর্কে আবদ্ধ থাকতাম। সে যুগে এ গ্রুপ সে গ্রুপ ছিল না, আমরা সকলেই ছিলাম একই পার্টির কমরেড, নকশালপন্থী বন্দী।

স্বাধীনোত্তর ভারবর্ষের জেলে এমন রাজনৈতিক বন্দীরা বোধ হয় প্রথম এবং অদ্বিতীয়। পশ্চিমবাংলার জেলে হাজারে হাজারে তাঁরা বন্দী থেকেছেন, চরম নির্যাতন সহ্য করেছেন, জেলকে পরিণত করেছেন বিদ্রোহের কেন্দ্রে এবং একের পর এক জেল ভাঙ্গার অভিনব নজির প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের বীরত্ব ও আত্মদানের গাথা নিয়ে ভবিষ্যতের কবি এক মহাকাব্যই লিখতে পারেন।

কয়েক ঘণ্টা বহরমপুরে কাটিয়ে আমরা সেই রাত্রেই পাড়ি দিলাম দুর্গাপুরের দিকে। এখানে আমরা বলতে আমি আর কালী। কালীকে এই নামেই আমি জানতাম এবং এই নামেই ও পুরো জেল জীবনটা কাটিয়ে দিল। শত চেষ্টা করেও পুলিশ ওর আসল নাম, ঠিকানা উদ্ধার করতে পারেনি। কালীর সাথে আমার পরিচয় ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে – যে দিন আমরা ধরা পড়লাম। ও বর্ধমান জেলার গ্রামাঞ্চলে কাজ করত এবং আমার মতো ওকেও জেলা কমিটিতে নেওয়া হয়েছিল এবং সে দিনই জেলা কমিটির প্রথম বৈঠক হতে যাচ্ছিল। অন্য যাঁরা আমাদের সঙ্গে ধরা পড়েছিলেন তাঁরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমি আর কালী পুলিশের মারে ভাঙ্গা হাত-পা নিয়ে আসানসোলের হাসপাতালে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে থেকেছি, একই হাতকড়ায় আটক অবস্থায় দুর্গাপুরের কোর্টে যাওয়া-আসা করেছি, স্লোগান দিয়েছি, পাশাপাশি সেলেই জেল জীবনটা কাটিয়েছি এবং আজ একই সঙ্গে ছাড়া পেয়ে একই লক্ষ্যের অভিমুখে যাত্রা করছি।

বাইরের পরিস্থিতি ততদিনে অনেক পাল্টে গেছে। সেই ছাত্র আন্দোলনের জোয়ারের উদ্দীপনা জাগানো দিনগুলি যেন হঠাৎই মিলিয়ে গেছে, ‘গেরিলাযুদ্ধের বিস্তৃতি’র ও ‘শ্রেণীশত্রু খতম অভিযানের’ খবরও বিশেষ আর শোনা যায় না। নেতারা একের পর এক ধরা পড়ছেন, শহীদ হচ্ছেন। পার্টিতে বেড়ে চলেছে বিভ্রান্তি ও হতাশার পরিবেশ, দলত্যাগ ও বিশ্বাসঘাতকতা।

দুর্গাপুরে আমার পরিচিত পুরোনো শ্রমিক কমরেড ও তাঁদের পরিবারগুলির কাছ থেকে পেলাম সেই একই আন্তরিক ভালোবাসা। তবে আমার সহকর্মীরা, যাঁরা তখন বর্ধমান আঞ্চলিক কমিটির নেতা হয়েছেন, তাঁরা কেউই দেখা করতেও এলেন না। বর্ধমান আঞ্চলিক কমিটির সীমানা ছিল বিহারের ধানবাদ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং সেই ধাক্কার পর্যায়েও প্রায় শ’খানেক সর্বক্ষণের কর্মী সেখানে কর্মরত ছিলেন।

ইতিমধ্যে একদিন বজ্রাঘাতের মতো কমরেড চারু মজুমদারের গ্রেপ্তার হওয়া ও মৃত্যুর সংবাদ এল। আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

কালী গেল বাঁকুড়ার দিকে কাজ করতে এবং আমি আঞ্চলিক কমিটির নির্দেশে একটা টিনের বাক্সে আমার টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে রওয়ানা হলাম নবদ্বীপের দিকে, আর সেখান থেকে অগ্রদ্বীপের একটি গ্রামে। আমার বিপ্লবী জীবনের নব পর্যায় এখান থেকেই শুরু হল।

আমাদের এলাকার ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক কমিটির সদস্য ছিলেন অশোক মল্লিক, বর্তমানে ইনি সিওআই(এমএল) করেন। খোকা নামেই তার খ্যাতি। নবদ্বীপ শহরে মধ্যবিত্ত সমর্থকদের একটি বৈঠকে তিনি আসছেন শুনে দেখা করতে গেলাম। তিনি ব্যস্ত তাই দেখা করতে পারবেন না বলে বাড়ির দরজা থেকেই ফিরে আসতে হল। অবশ্য কয়েকদিন পরে ভদ্রলোক দেখা করলেন, অনেক উপদেশও দিলেন।

বীরভূমের পাশাপাশি বর্ধমান জেলার ভাতার অঞ্চলে ১৯৭১ সালে কৃষক সংগ্রাম একটি স্তর পর্যন্ত এগিয়েছিল। তারপর ধাক্কার মুখে পুলিশের তাড়া খেয়ে কয়েকজন কমরেড এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তারই একজন কার্তিক, পূর্বস্থলী এলাকায় নতুন করে সংগঠন গড়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এখানেই তার সাথে পরিচয়, যা অচিরেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত হল।

ভাতার থেকে কালনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আমরা ভাঙ্গাচোরা সংগঠনকে জোড়া লাগানো ও কৃষক আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা শুরু করলাম। দুর্গাপুর থেকে পরেশ, তাপস এসে যোগ দিল, বিকাশ তো ছিলই। কয়েকটি গ্রামে কিছু নতুন উদ্যোগ গড়ে উঠলেও চরম কংগ্রেসী সন্ত্রাসের জমানায় বিশেষ সাফল্য আমাদের হাতে আসেনি। তবে গোটা জেলায় আমাদের এলাকাতেই বোধ হয় নব উদ্যমে এক কঠোর প্রচেষ্টা চলেছিল।

আঞ্চলিক কমিটির নেতৃত্ব বিমূর্ত সব তাত্ত্বিক কচকচানিতে লিপ্ত ছিলেন। একটা অদ্ভুত বিতর্ক ছিল – সি এম (চারু মজুমদার)-কে শুধু শ্রদ্ধেয় নেতা বলা উচিত নাকি শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় নেতা কমরেড চারু মজুমদার বলা উচিত। এ নিয়ে নাকি আঞ্চলিক কমিটিতে দু’লাইন ছিল। এসবের মাথামুণ্ডু আমি বুঝতাম না এবং একটি মিটিং-এ শুধু সি এম বলার অপরাধে খোকাবাবু আমার ওপর ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। কমিটি সম্পাদক দীর্ঘক্ষণ বোঝালেন কেন শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় নেতা কমরেড চারু মজুমদার বলা উচিত। বুঝতে আমি পারিনি এবং ঈশ্বরদ্রোহিতার অপরাধে মহাপাতক হয়ে থাকলাম। যা বুঝলাম তা হল সংগঠন-আন্দোলনকে পুনর্গঠনের কঠিন কঠোর প্রচেষ্টা থেকে সরে থাকার যুক্তি হিসাবেই ওরা এসব বাম বুলিসর্বস্বতার আশ্রয় নিয়েছে। বুঝলাম ‘আজকের পর্যায়ে দুই লাইনের সংগ্রামই শ্রেণী সংগ্রাম’ জাতীয় তাঁদের সূত্রায়নের আসল মর্মবস্তু।

ক্রমেই আঞ্চলিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কর্মীবাহিনীর বিক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে এবং অপরদিকে আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা সকলেরই নজর কাড়ে। এমন সময়েই কলকাতার দু’জন নেতৃস্থানীয় কমরেড অগ্নি ও কমলের পার্টির ভেতর থেকেই হত্যার চক্রান্তে সামিল থাকার সন্দেহে আঞ্চলিক কমিটির দুজন সদস্য – গৌতম সেন ও কৌশিক ব্যানার্জীকে কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়। ওঁরা এই সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি এবং ‘সত্য প্রায়শই অল্প লোকের মধ্যে নিহিত থাকে’ মাও-এ এই উক্তির দোহাই দিয়ে এক সমান্তরাল কেন্দ্র গঠন করেন। এই প্রথম গৌতম – যে আমার সহপাঠী ছিল – আমার সাথে দেখা করতে আসে। নিজের প্রতি সমর্থন জোগাড়ের প্রত্যাশায় অবশ্য। আমি বলি ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না তবে তোমাদের উচিত কমিটির সিদ্ধান্ত মেনেই নিজেদের বক্তব্য রাখা। এভাবে বিদ্রোহ করা পার্টির সাংগঠনিক নিয়মনীতির পরিপন্থী। ও আমাকে বোঝায় ‘সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর অধীনে’ এসব রীতিনীতি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরে অচল। সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করেছে ‘সত্য প্রায়শই অল্প লোকের মধ্যে নিহিত থাকে’ এবং ‘বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত’। আমি বলি যে রেড বুক হাতে নিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লব হল তাতে মাও-এর এইসব রীতিনীতির উল্লেখ আছে এবং সবচেয়ে বড় কথা এসব নিয়মনীতি বাদ দিলে কোনো সংগঠন চলবে কী করে। গৌতমকে বলি তুমি নিজে যে সংগঠন গড়ছ তাতেও আজ হোক কাল হোক মতপার্থক্য দেখা দেবে এবং সেখানে লোকে একই যুক্তিতে বিদ্রোহ করলে তুমি ঠেকাবে কী দিয়ে। ওর কাছে আমার কথাগুলি পুরাতনপন্থীদের মতোই শোনাল। আমি দুঃখ পেলাম, কিন্তু গৌতম অনেক যোগ্যতা-দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও কোনো সংগঠনই কোনোদিন গড়ে তুলতে পারল না।

দেখা করতে এলেন কৌশিকবাবুও। বললেন আঞ্চলিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আপনাদেরও তো অনেক বিক্ষোভ। তাছাড়া আপনি নিজে তো ব্যক্তিগতভাবে উপেক্ষিত হয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন। আপনি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিন, গোটা কর্মীবাহিনী আপনার পাশে দাঁড়াবে, আমরাও আপনার সাথে আছি। বললাম ক্ষমা করবেন, আপনাদের মতো বিদ্রোহী আমি নই। পার্টি শিক্ষা এতদিন যা পেয়েছি তাতে সংগঠনের অভ্যন্তরেই নীতিনিষ্ঠ সংগ্রাম চালানোতেই আমার বিশ্বাস।

এই ঘটনার উল্লেখ করলাম কারণ মনে হয় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নাম করে এ জাতীয় বহু ধ্যানধারণা আমাদের পার্টিতেও ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তা পার্টি ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে অজস্র গ্রুপের অস্তিত্ব ও ছোটোখাটো মতপার্থক্য ও একের পর এক বিভাজনের পেছনেও এসব ধারণার অনেক অবদান আছে বলে মনে হয়।

এদিকে সি এম-এর মৃত্যুর পর শর্ম-মহাদেবের কেন্দ্র গড়ে ওঠে। কিছুদিন পরেই তা দু-টুকরো হয়। নিজেকে চারু মজুমদারের উত্তরাধিকারী দাবি করে মহাদেববাবু অদ্ভুত অদ্ভুত সব ভাববাদী ধ্যানধারণা ছড়াতে শুরু করেন। আমাদের আঞ্চলিক নেতৃত্ব কোনো মতাদর্শগত-রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে নিতান্তই অক্ষম ছিল। আমরা এলাকা কমিটি থেকে মহাদেব লাইনের বিরুদ্ধে দলিল তৈরি করে আঞ্চলিক নেতৃত্বকে পাঠাই। তাঁরা তা বিলিও করলেন না। তবে মনে হয় পার্টি পুনর্গঠনের সংগ্রামে সেটাই বোধহয় প্রথম রাজনৈতিক দলিল।

নদীয়ার কমরেডরা, যাঁরা আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন, এই সংগ্রামে তাঁরা আমাদের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। এমনকি নবদ্বীপে যে কালীদার বাড়িতে আমার আশ্রয় হত এবং পাড়ার টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করে যে দু-চার চাকা তিনি রোজগার করতেন তাতেই আমাদের দুজনের খাওয়া-দাওয়া হত – সেই কালীদাও সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে নদীয়ায় কাজ করতে গিয়ে মহাদেব লাইনের প্রভাবে পড়েন এবং শহীদ হন।

ইতিমধ্যে আঞ্চলিক কমিটিতে আমাকে ও কার্তিককে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পাদক নিজের প্রতি ‘আস্থার সংকট’ সমাধান করতে চান। আঞ্চলিক কমিটিতে গেলাম এবং কিছু সময় পরেই সম্পাদকের দায়িত্ব নিতে হল। কারণ পুরাতন সম্পাদক সকলের আস্থা হারিয়েছিলেন এবং ততদিনে নিজেও ‘শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় নেতা কমরেড চারু মজুমদারের’ প্রতি আস্থা হারিয়েছেন।

সে যাই হোক। পার্টি পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া এগোতে থাকল। দ্রুতই বর্ধমান, বাঁকুড়া, নদীয়া, বীরভূম, কলকাতা ও উত্তরবাংলার সংগঠনগুলিকে নিয়ে তৈরি হল রাজ্য লিডিং টিম। কেন্দ্রের সন্ধানে এবার আমরা বেরোলাম শর্মার সাথে যোগাযোগ করতে। উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর জেলার একটি গ্রামে দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা হল। নির্ধারিত সময়ে কোট-প্যান্ট-টাই পরিহিত শর্মাজী এলেন। তাঁর হয়ে যাবতীয় কথাবার্তা চালালেন রামনাথ, যিনি পরে সিএলআই গ্রুপের নেতা হন। সি এম-এর নামে যা নয় তাই বলতে লাগলেন। আমরা প্রতিবাদ করলাম। শেষমেষ মিটিং ভেঙ্গে গেল এবং আমরাও মাঝরাত্রে বেরিয়ে এসে ট্রেন ধরলাম। ফিরে এসে শর্মা লাইনের বিরুদ্ধে তৈরি হল আমাদের দ্বিতীয় রাজনৈতিক দলিল।

এই দলিলে আমরা গণসংগঠন গণআন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করি। আমাদের রাজ্য লিডিং টিম-এর শান্ত (সৌমেন গুহ) যখন অর্চনাদের দিয়ে ‘সাহসী বোন’ সংগঠন বানাবার পরিকল্পনা করে, আমি তাকে স্বাগত জানাই। এই চিন্তন প্রক্রিয়া অবশ্য কয়েক বৎসরের মধ্যে ব্যহত হয় মূলত গেরিলা সংগ্রামকে চলমান যুদ্ধের স্তরে উন্নীত করার আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে। বিহারের উদীয়মান সংগ্রামের এই পর্যায়ে নতুন সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখারও বোধ হয় প্রয়োজন ছিল।

শর্মার লাইনের বিরুদ্ধে নামতে গিয়ে এটা পরিষ্কার হল যে তৈরি কোনো কেন্দ্রের সন্ধান বৃথা। কেন্দ্রও গড়ে তুলতে হবে নতুন করে। এই প্রক্রিয়াতেই সি এম-এর মৃত্যুর দুবছর পরে ১৯৭৪-এর ২৮ জুলাই গড়ে ওঠে পার্টির নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি কমরেড জহরের নেতৃত্বে। পেছনে ফিরে তাকালে সেদিন আমাদের দৃঢ় সিদ্ধান্ত এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপই মনে হয়। কমরেড জহর ছিলেন খুবই দৃঢ় প্রকৃতির অথচ অত্যন্ত বিনম্র একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট। তিনি পশ্চিমবাংলায় আমাদের কাজের এলাকাগুলি কয়েকবারই পরিদর্শন করেন। তিনি আমাদের উৎসাহিত করেন এই বলে যে বিহারের সংগ্রাম এখনও প্রথম পর্যায়ে আছে, পশ্চিমবাংলায় আপনারা সেই পর্যায় পেরিয়েছেন এবং এখন সার্বিক বিপর্যয়ের পরে পুনর্গঠনের কাজে হাত লাগিয়েছেন। এহেন পরিস্থিতিতে সীমিত হলেও নতুন করে যে কৃষক আন্দোলন আপনারা গড়ে তুলেছেন তার গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁর ছিল অসাধারণ বিশ্লেষণ ক্ষমতা এবং আমাদের কাছে তিনি প্রেরণার নতুন স্রোত হিসাবেই উপস্থিত হন।

ক্রমেই আমাদের কাজের ভরকেন্দ্র দক্ষিণবাংলা থেকে সরে যায় উত্তরবাংলায়। নকশালবাড়িতে কর্মরত শান্তি পালের গ্রুপ – আগে যার নেতা ছিল দীপক বিশ্বাস, যে সি এম-কে ধরিয়ে দেয় – পুলিশের চাপে পূর্ণিয়াতে সরে পড়ায় আমরা সেখানে অনুপ্রবেশ করি। নকশালবাড়িকে পুনরুজ্জীবিত করার চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমাদের সর্বশক্তি সেখানে আমরা ঢেলে দিই। ধাক্কার পর থেকেই সেখানে গোয়েন্দাবাহিনী গ্রামে গ্রামে দালালদের ভালো জাল বিস্তার করেছিল। ফলে পদে পদেই আমরা ধাক্কা খেলাম, মূল্যও দিলাম অনেক। তবে এই প্রক্রিয়ায় আমরা এক বিস্তীর্ণ এলাকায় গরিব কৃষক সাধারণ ও চা মজুরদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তুলি, গড়ে ওঠে গেরিলা যোদ্ধাদের নতুন নতুন দল, এমনকি আদিবাসী রাজবংশী মেয়েদের সশস্ত্র গেরিলা বাহিনীও। পুলিশের ক্যাম্প থেকে রাইফেল দখল সহ সাহসিক অ্যাকশনও ঘটে। নকশালবাড়ির কথা ভাবতে গেলে দুটি বিশিষ্ট চরিত্রের কথা মনে পড়ে। একজন ১৮/১৯ বছরের যুবক পটল, যে এক দুর্দান্ত গেরিলা যোদ্ধা এবং পুলিশের কাছে রীতিমতো আতঙ্ক ছিল। বহু চেষ্টার পর বিস্তৃত এক ফাঁদ পেতে পুলিশ তাকে হত্যা করে এবং সেই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কনস্টেবল পায় রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। অন্যজন ছিলেন বৃদ্ধ কমরেড বুধুয়া ওরাঁও, যাঁকে আমরা সকলেই শ্রদ্ধায় পিতাজী বলেই ডাকতাম। আদিবাসী মানুষের সাথে তাঁর গভীর যোগাযোগ ছাড়া আমাদের পক্ষে সেইসব এলাকায় টিকে থাকা ছিল একান্তই অসম্ভব।

বড়পথুজোতের ঘটনার পর উত্তরবাংলায় আমাদের কেন্দ্রীকরণের যবনিকাপাত হল এবং ক্রমেই কাজের ভরকেন্দ্র আবার সরে এসেছে দক্ষিণবাংলার দিকে। তবে নকশালবাড়ি আজও অপেক্ষা করছে তার পুনর্জাগরণের জন্য।

সংক্ষেপে পশ্চিমবাংলায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭-এর পর্যায়ে এই ছিল পার্টি ও আন্দোলনকে পুনর্গঠনের প্রচেষ্টার ইতিহাস। এই পর্যায়ের অভিজ্ঞতার সারসংকলনের ভিত্তিতেই ১৯৭৭ পরবর্তী শুদ্ধিকরণ আন্দোলন চলে।

এমন এক সময় যখন যতদূর দেখা যায় শুধু অন্ধকারই চোখে পড়ত। একদল বলতেন আগে পথটা ঠিক করে নেওয়া হোক তারপরেই নামা ভালো। ইতিহাসচক্রে তাঁদের পথও হারিয়ে গেছে, তাঁরাও হারিয়ে গেছেন। অন্য দল বললেন পথে নেমেই পথ চেনা হবে এবং দৃঢ় প্রত্যয়ে হাঁটতে থাকলেন। উন্নততর সমাজ গড়ার স্বপ্ন ও শহীদ সাথীদের রক্তঋণ শোধ করার দায়িত্ববোধই ছিল তাঁদের প্রেরণা এবং ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ পার্টি সংগঠনই ছিল তাঁদের হাতিয়ার। তাঁরাই শেষ বিচারে পথের সন্ধানও পেয়েছেন, আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন এবং পার্টির পুনর্গঠন সম্পন্ন করেছেন। নতুন নতুন কমরেডরা এই সব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবেন এই আশাতেই অতীতের এই স্মৃতিচারণা।

(ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

আসামের কার্বি আংলং ও উত্তর কাছাড় পার্বত্য জেলায় পার্টির বিশ্বাসযোগ্যতা যথেষ্ট ব্যাপক। যুবকদের নতুন বাহিনী পার্টিতে ও এএসডিসি-র স্বায়ত্ততার আন্দোলনে ক্রমশই যুক্ত হচ্ছে, যে স্বায়ত্ততার আন্দোলন উগ্র জাত্যাভিমান থেকে মুক্ত, ভগ্মোন্মুখ অসমীয়া সমাজে যা একগুচ্ছ সংখ্যালঘু জাতিসত্তা গোষ্ঠীকে একটি ছাতার তলায় ঐক্যবদ্ধ করেছে, যা কমিউনিজমের সু-উচ্চ আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং যার মধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতের চেহারা পাল্টে দেওয়ার যথেষ্ট সম্ভানা রয়েছে।

কিন্তু আমাদের এটি বুঝতে হবে যে, কেবল পতাকা পরিবর্তন করলেই পার্টিকে সামনে আনা যায় না। শুধুমাত্র পরিষদের কাজকর্মের তত্ত্বাবধান করা এবং স্বায়ত্ততার আন্দোলনকে পরিচালিত করার মধ্যেই পার্টির ভূমিকা সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। পার্টিকে বরং ভূমিসংস্কারের ক্ষেত্রে দরিদ্র কৃষকদের ইস্যুগুলিকে তুলে ধরে স্বায়ত্ততার আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাকে ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ের ওপরই সচেতনভাবে কেন্দ্রীভূত করতে হবে। কেবলমাত্র তখনই পার্টির এক স্বাধীন ভিত্তি ও একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট ক্যাডারদের গড়ে তোলা যেতে পারে।

বেশ কয়েক বছর ধরে জেলা কাউন্সিলের ক্ষমতায় থাকার ফলে সেখানে কিছু জটিলতার জন্ম হয়েছে। জীবনযাত্রায় স্বচ্ছলতা আসা, জেলা কাউন্সিল ও কার্যকরী কমিটির সদস্যদের চারপাশে আমলা-কন্ট্রাক্টর ও ব্যবসায়ীদের চক্র গড়ে ওঠা, পার্টি ও এএসডিসি-র জেলা কাউন্সিলের তল্পিবাহক হয়ে পড়া, জনগণ ও জনগণের আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া, গোষ্ঠী লড়াই শুরু হওয়া ইত্যাদি হল কয়েকটি নমুনা। যদিও আমরা ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জিতেছি, কিন্তু জনগণের চোখে সংগঠনের নৈতিক কর্তৃত্বের ক্ষয় ঘটেছে। এএসডিসি এবং জেলা কাউন্সিলের বর্তমান জটিলতা পেটিবুর্জোয়াদের দ্বারা জাতিসত্তা আন্দোলনের নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার এবং বুর্জোয়া-জমিদার ব্যবস্থায় ধাপে ধাপে অঙ্গীভূত হয়ে পড়ার মূল তাত্ত্বিক প্রশ্নকেই তুলে ধরছে।

(পার্টির ২৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে গুয়াহাটিতে ২২ এপ্রিল, ১৯৯৮ আসাম রাজ্য কমিটি সংগঠিত ক্যাডার প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রদত্ত ভাষণ)

সারাদিন ধরে আপনারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছেন, যার মধ্যে এক স্বতন্ত্র রাজ্যের জন্য আন্দোলন এবং জেলা পরিষদের কাজকর্মের ধারাও রয়েছে। যাই হোক, চিরায়ত মার্কসবাদী উপলব্ধিতে গণতান্ত্রিক বিপ্লব মর্মবস্তুতে যেহেতু বুর্জোয়া বিপ্লব, অর্থাৎ তা দ্রুত পুঁজিবাদী বিকাশের পথ প্রশস্ত করে, তাই বুর্জোয়া শ্রেণীকেই অবশ্যম্ভাবীভাবে এর নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে। কিন্তু, এক সংগঠিত শক্তি হিসাবে সর্বহারার আবির্ভাব এবং প্যারি কমিউনে তাদের ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা বুর্জোয়াদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। সেই সময় থেকেই বুর্জোয়ারা তাদের বিপ্লবী ভূমিকা পরিত্যাগ করেছে এবং তার পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ বিবর্তনমূলক ধারাতেই সামন্ততন্ত্রের রূপান্তরকে বেছে নিয়েছে। এইভাবে এরা সামন্তশক্তিগুলির সঙ্গে এক অনীতিনিষ্ঠ আঁতাতে উপনীত হয়। এই সন্ধিক্ষণেই লেনিনের আবির্ভাব এবং তিনি গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সর্বহারার নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়টি জোরের সাথে তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর আগে আমাদের অবশ্যই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আর যেহেতু বুর্জোয়া শ্রেণীর পক্ষে এই বিপ্লবকে তার যুক্তিসঙ্গত পরিণতিতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়, তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব এখন এসে পড়েছে সর্বহারার কাঁধে। প্রথমে রুশ সর্বহারা, তারপর চীনের সর্বহারা এবং পরবর্তীতে ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশের সর্বহারাও ঐ পথ অনুসরণ করে।

এই প্রশিক্ষণ শিবির থেকে যে প্রশ্ন উঠে এসেছে তা হল, জাতিসত্তার আন্দোলনে, বা আরও যথাযথভাবে বলতে গেলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব প্রদান সঙ্গত হবে কিনা। আমাদের দেশের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে আসামে এই আন্দোলনগুলি বাস্তব ঘটনা। আমি বলব, এই আন্দোলনগুলিতে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ যেখানেই আসবে তাতে নেতৃত্ব দেওয়া পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত। বিজাতীয় শক্তিগুলির হাতে নেতৃত্ব চলে যেতে দেওয়া এবং তারপর পরিস্থিতি পেকে ওঠার জন্য অপেক্ষা করা এমন এক গোঁড়া তত্বগত পদ্ধতি যা মার্কসবাদের আত্মাকেই নাকচ করে।

কিছু ব্যক্তির কাছে বিধায়ক, সাংসদ এমনকি জেলা পরিষদের সদস্য[] হওয়া এবং গাড়ি-বাড়ি করাই আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির কাছে লক্ষ্য একেবারেই আলাদা। আমরা দেখতে পাই সংখ্যালঘু জাতিসত্তার আন্দোলনে গরিব কৃষকরা ব্যাপক সংখ্যায় অংশগ্রহণ করছেন এবং তাঁরাই এই আন্দোলনে চালিকা শক্তি। গরিব কৃষকদের সংগঠিত করা, তাঁরা যাতে এক শ্রেণী হিসাবে নিজেদের আত্মঘোষণা করতে পারেন এবং রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন, কমিউনিস্ট পার্টিকে এই বিষয়গুলিই সুনিশ্চিত করতে হবে। এখন এর অর্থ যদি গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য কিছু সংস্কারসাধন এবং তাদের কিছু আর্থিক সহায়তা প্রদান হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়, তবে সেটি হবে চরম মূর্খামি।

আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, কোন ধরনের লোকজন আমাদের অফিসে ভিড় জমাচ্ছেন। তারা কী ঠিকাদারের দল না গরিব মানুষজন? কোন ধরনের মানুষরা আমাদের নেতাদের চারপাশে থাকেন? তারা কী ঠিকাদার না সাধারণ মানুষ? যদি প্রথমোক্তদের উপস্থিতিই প্রকৃত তথ্য হয় তবে হাজারও বিপ্লবী বুলি আউড়ানো সত্ত্বেও আমাদের সরকার ঠিকাদারদের সরকারে পরিণত হবে।

আন্দোলনের পর্যায়ে এবং সরকার পরিচালনার[] প্রথম পর্যায়েও গ্রামীণ দরিদ্রদের সংগঠিত করার গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু বর্তমানে মনে হয় আমরা এক স্থিতাবস্থার পর্যায়ে প্রবেশ করেছি এবং তা আবার উপদলীয় বিবাদের জন্ম দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, কমিউনিস্ট মানসিকতার যথেষ্ট অবক্ষয় ঘটেছে। অথচ তীব্র আন্দোলনের পর্যায়ে ঐ একই কমরেডরা দৃষ্টান্তমূলক সততার পরিচয় রেখেছেন, আত্মত্যাগ করেছেন এবং কষ্টসাধ্য জীবনধারার মধ্য দিয়ে গেছেন। আমি একথা কখনই বলছি না যে, ব্যক্তি হিসাবে তাঁরা খুব নিকৃষ্ট হয়ে গেছেন। ব্যাধি কিন্তু যথেষ্ট গভীরে বলেই মনে হয়। বস্তুত কমিউনিস্ট বীক্ষার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক শ্রেণী হিসাবে গ্রামীণ দরিদ্রদের সংগঠিত করার পথই ঐক্যকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারে এবং গোষ্ঠীগত উপদলীয়তার সমস্যার এক দীর্ঘস্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারে।

গৌরবময় কার্বি আন্দোলন থেকে কিছু মানুষ কেবলমাত্র অর্ধেক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন বলেই মনে হয়। তাঁরা মনে করেন যে, সাংসদ, বিধায়ক অথবা জেলা পরিষদের সদস্য হওয়ার এটিই হল সহজ রাস্তা। কিন্তু তাঁরা চরম ভুল করছেন। কার্বি আন্দোলন এত সহজে গড়ে তোলা যায়নি। এর পিছনে রয়েছে ব্যাপক সংখ্যক ক্যাডারদের কঠোর ও কষ্টসহিষ্ণু পথে গ্রামীণ দরিদ্রদের সংগঠিত করে তোলার এক দীর্ঘ ইতিহাস। অনেকেই ভুলে যেতে চান যে, এক বিপ্লবী মতাদর্শের ভিত্তিতেই এই আন্দোলন সংগঠিত করা হয়েছিল এবং তা দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তার আন্দোলন, যেমন মিশিং উপজাতিদের আন্দোলন সম্পর্কে আমরা বেশি কিছু জানতে পারি না। আমরা শুধু শুনতে পাই কিছু কথাবার্তা চলছে, কিছু প্রতিনিধি দল দিল্লী যাচ্ছেন, কিছু চুক্তি আসন্ন, ইত্যাদি। কিন্তু আন্দোলন কী অবস্থায় রয়েছে, পার্টি গঠনের ক্ষেত্রেই বা পরিস্থিতি কী রকম? আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করা নিয়ে আপত্তি নেই, কিন্তু এক শক্তিশালী আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে যদি ঐ আলাপ-আলোচনা না চালানো হয় তবে তা এক অনীতিনিষ্ঠ আপোশে পরিণত হতেই বাধ্য হবে। কার্বি আন্দোলন দক্ষতার সঙ্গে আন্দোলন ও আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে সমন্বয় সাধান করতে পেরেছিল এবং অন্যদেরও এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।

তথাকথিত প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক। দীর্ঘদিন ধরেই আপনারা আসামে এই প্রগতিশীল আঞ্চলিকতাবাদের শক্তিগুলির অনুসন্ধান করছেন। যাদেরই আমরা আজ প্রগতিশীল আঞ্চলিকতাবাদী হিসাবে আখ্যা দিই, দুদিন বাদেই দেখি তারা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিতে পরিণত হয়ে গেছে। আর তাই দমে না গিয়ে আমরা নিজেরাই প্রগতিশীল আঞ্চলিকতাবাদীতে পরিণত হতে মনস্থির করলাম। যাই হোক, আমি মনে করি প্রগতিশীল আঞ্চলিকতাবাদী শক্তিগুলির স্থায়ী বর্গের সন্ধান করে চলা হবে এক নিষ্ফলা প্রয়াস। আমাদের আন্দোলনের কোনো নির্দিষ্ট পর্যায়ে যে আঞ্চলিক শক্তিই আমাদের সঙ্গে হাত মেলাবে তাদের আমরা প্রগতিশীল হিসাবে আখ্যা দেব। আর এই চরিত্রায়ন ততক্ষণই চলবে যতক্ষণ তারা আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমার মনে হয় এই বিষয়টি বোধহয় আমাদের কৌশলগত লাইনের পর্যালোচনার দাবি রাখে।

আমাদের নিজস্ব গণভিত্তিকে শক্তিশালী করে তোলার উপরই আমরা প্রধান গুরুত্ব আরোপ করব। আসামে আমাদের বেশ কিছু শক্তিশালী দিক রয়েছে। তেল ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে আমাদের পার্টির প্রভাবাধীনে রয়েছে আধুনিক শ্রমিকশ্রেণীর এক শক্তিশালী বাহিনী। আসামের শ্রমিকশ্রেণীর এক ব্যাপক অংশই হল চা-শ্রমিক, আর সেক্ষেত্রেও আমাদের কাজের সূচনা ভালোই হয়েছে। কয়েক বছর আগেও কিছু মানুষ এই ধারণা পোষণ করতেন যে চা-শ্রমিকদের মধ্যে আমাদের প্রবেশ করা প্রচণ্ড কঠিন ব্যাপার। আমার মনে হয়, এখন তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন সেখানে কাজের কী বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। চা বাগানের এক কমরেডের এ ব্যাপারে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তিনি বললেন যে তাঁদের একা একাই কাজ করতে হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট জেলার পার্টি কমিটির কাছ থেকে তাঁরা কোনো সাহায্যই পাচ্ছেন না। শুধুমাত্র লেভি সংগ্রহেই তাঁদের যত আগ্রহ। আর একজন কমরেডও এক অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলে ধরেছেন : আমাদের সাংসদ ও বিধায়করা সংসদ বা বিধানসভায় চা বাগান সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলেন না কেন? আমাদের সাংসদ অস্ট্রেলিয়ার ধর্মঘটী শ্রমিকদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তা বেশ ভালো কথা। কিন্তু দেশের মাটিতে কি তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন অথবা সংসদের মধ্যে শ্রমিকদের ইস্যুগুলিকে তুলে ধরেন? এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং আমি মনে করি আমাদের সাংসদ ও বিধায়কদের উচিত শ্রমিক বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করা। এর ফলে শ্রমিকদের মনোবল বাড়বে এবং তা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকেও রক্ষণাত্মক করে তুলবে। আসামে আবার আমাদের এক শক্তিশালী নারী আন্দোলনও রয়েছে এবং মূল ধারার অসমীয়া জনগণের মধ্যেও তার ভালো প্রভাব রয়েছে। এর বাইরেও যদি মূল ধারার অসমীয়া জনগণের মধ্যে আমাদের প্রভাব বাড়ানোর পরিকল্পনা করতে হয় তবে আমার মনে হয় সমাজের একেবারে নিম্নস্তরের মানুষের মধ্যেই আমাদের বড় ধরনের মনোযোগ দেওয়া উচিত।

সবশেষে, সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী ফ্রন্ট সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই। এটি স্পষ্ট থাকা দরকার যে, আমরা কমিউনিস্টরা নীতিগতভাবে সন্ত্রাসের বিরোধী নই। আমাদের বিচার করতে হবে যে, কোন শক্তি সন্ত্রাস চালাচ্ছে আর তা চালাচ্ছে কাদের বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি দাবি জানালে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে হবে। আলফার মতো সংগঠনগুলি যে জনবিরোধী কার্যকলাপ চালায় সেগুলি অপরাধমূলক কার্যকলাপের পর্যায়ে পড়ে এবং অবশ্যই সেগুলির বিরোধিতা করা উচিত। কিন্তু আমরা যদি সাধারণভাবে সন্ত্রাস-বিরোধী মোর্চা গঠনের জন্য উঠে-পড়ে লাগি তবে তার অর্থ হবে লাল সন্ত্রাস সহ সমস্ত ধরনের সন্ত্রাসেরই বিরোধিতা করা এবং শেষমেষ তা আমাদের কাছেই বাধাস্বরূপ হয়ে উঠবে। কমরেড অনিল বড়ুয়াকে হারানো অত্যন্ত বেদনাদায়ক, কিন্তু মূলত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকেই আমাদের লক্ষ্যবস্তু করতে হবে।

আসামে পার্টির বিকাশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাম ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সিপিআই(এমএল)-কে আসামের প্রধান বাম শক্তিতে পরিণত করার জন্য আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। তার জন্য পরিস্থিতি পরিপক্ক হয়ে উঠেছে।

টীকা

(১) জেলা পরিষদের সদস্যরা হলেন জেলা স্তরের আইনসভার সদস্য।

(২) এএসডিসি পরপর তিনবার ভোটে জিতে কার্বি আংলং জেলা কাউন্সিলের ক্ষমতায় আসে। এইভাবে জেলা স্তরে সরকার পরিচালনা করা আসামে পার্টি অনুশীলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

(শহীদ কমরেড অনিল বড়ুয়ার স্মৃতিতে ২৪ মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক স্মরণসভায় বক্তব্যের অংশবিশেষ।
লিবারেশন, এপ্রিল ১৯৯৮ থেকে)

... এইভাবে এর থেকে (আলফা কর্তৃক কমরেড অনিল বড়ুয়ার হত্যা) অনেক প্রশ্নই উঠে এসেছে। অনেকে বলেন যে আঞ্চলিকতাবাদ মূলত একটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন, আর তাই একে সমর্থন করা উচিত। নীতিগত দিক থেকে দেখলে এটি একটি যুক্তিগ্রাহ্য অনুসিদ্ধান্ত। কিন্তু আঞ্চলিকতাবাদ বা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের লড়াই সবসময়েই যে প্রগতিশীল হবে তার নিশ্চয়তা নেই। এমন কোনো সূত্রের অস্তিত্ব নেই। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি এই আন্দোলনগুলির দৃষ্টিভঙ্গির বিচার করেই সেগুলির প্রতি সমর্থন বা বিরোধিতার নীতি ঠিক করতে হবে। আমরা দেখছি তেলেগু দেশম, অগপ, আকালী দলের মতো আঞ্চলিক দলগুলি কট্টর সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপির দিকে ঢলে পড়ছে। আমরা খালিস্তানীদের দেখেছি, আর আজ দেখছি আলফা-কে। ক্রমে ক্রমে উভয়েরই নিশানা হয়ে উঠছে বামপন্থী শক্তিগুলি। অনিলদার হত্যায় এত বড় প্রতিবাদ উঠেছে বলে আপনারা এসব জানতে পারছেন। এর আগে সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর বহু কর্মীকেও তারা হত্যা করেছে। পিসিসি সংগঠনের কর্মীদেরও হত্যা করা হয়েছে। টাটা টি-র মালিকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের যত আন্দোলন হচ্ছে। বাংলাদেশ-রাওয়ালপিণ্ডি-করাচিতে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির চলছে। যথেচ্ছভাবে তারা আন্তর্জাতিক পাশপোর্ট জোগাড় করছে, কোটি কোটি টাকা জোগাড় করছে। তাদের আন্দোলনে এসব ব্যাপার যত বাড়ছে তত তারা বামপন্থী বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করছে। অনিল বড়ুয়ার ঘটনা কেবল একটি প্রতীক যা জানিয়ে দিচ্ছে যে আলফা আর গণতান্ত্রিক বা প্রগতিশীল শক্তি নেই। তাদের স্বাধীন আসাম তাই এক ফ্যাসিবাদী আসাম ছাড়া আর কিছুই হবে না। ... নির্বাচনের পর তারা ঘোষণা করেছিল, যে সমস্ত অসমীয়া নির্বাচনে ভোট দিয়েছে তাদের ৫৩ শতাংশ ভারতীয় নয়, আর তাই তাদের আসামে থাকার কোনো অধিকার নেই, এক মাসের মধ্যে তাদের আসাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। তারা আসামে বসবাসকারী প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের উপর এই ফতোয়া জারি করেছে। আমাদের পার্টি আরও বলিষ্ঠভাবে এই বর্বরতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।