(দেশব্রতী, সেপ্টেম্বর ১৯৯০ থেকে)
২৫ মে নকশালবাড়ি দিবস। নকশালবাড়ি এক, তার অর্থ অনেক। ভিন্ন ভিন্ন অর্থকে ধরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন গোষ্ঠী যারা একে অপরের বিরুদ্ধে দীর্ঘ বছরগুলি ধরে অন্তহীন বিতর্কে লিপ্ত। প্রায়শই তাদের মধ্যকার সম্পর্কও হয়ে দাঁড়িয়েছে শত্রুতাপূর্ণ। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের বিভ্রান্তির শেষ নেই এবং পশ্চিমবাংলার মানুষ ধরেই নিয়েছেন যে, নকশাল আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
সিপিআই(এম)-এর যা সব কার্যকলাপ – আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি, সন্ত্রাস – তাতে ব্যাপক মানুষের মনেও যেমন বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে, তেমনি সিপিআই(এম)-এর অভ্যন্তরেও বেড়ে চলেছে বিক্ষোভ, অশান্তি ও ভাঙন। এই বিক্ষোভের স্বাভাবিক উত্তরণ নকশালবাদেই ঘটত কিন্তু নকশালবাড়ির ধারা সম্পর্কে ব্যাপক বিভ্রান্তি এবং পশ্চিমবাংলায় আমাদের করুণ অবস্থার দরুণ অনেকেই হয় সিপিএমেই থেকে যেতে বাধ্য হচ্ছেন, না হয় সিপিআই(এম)-এরই কিছু কিছু বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীগুলির জন্ম দিচ্ছেন। এই গোষ্ঠীগুলি সিপিআই(এম) ও নকশালবাদের মাঝখানের এক তথাকথিত বিকল্পের মোহ ছড়াচ্ছে। সিপিআই(এম)-এর বিকল্প একমাত্র নকশালবাদই হতে পারে, এ সত্য ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং সিপিআই(এম) নেতৃত্ব একথা খুব ভালো করেই জানেন। জানেন বলেই তাঁরা নকশালবাদকে তাঁদের প্রধান মতাদর্শগত শত্রু বলে ঘোষণা করেন। তাঁদের অভ্যন্তরে যে কোনো বিক্ষোভে নকশালবাদের ভূত দেখেন, নকশালবাদকে সাধারণ বামপন্থী ধারার অংশীদার মানতেও তাই তাঁরা নারাজ এবং খুব সচতেনভাবেই যে কোনো সংযুক্ত কার্যকলাপ এড়িয়ে গিয়ে, পায়ে পা বাধিয়ে প্ররোচনা দিয়ে সংঘাতকেই বাড়িয়ে চলেছেন।
সিপিআই(এম) ও নকশালবাদের মাঝামাঝি কোনো বিকল্পের ধারণা এক ব্যর্থ প্রয়াস শুধু নয়, এক প্রতিঘাতী ধারণাও বটে। তবে এসব বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীগুলিকে দোষ দিয়ে আর কী হবে। আমাদের দুর্বলতাই তাদের অস্তিত্বের শর্ত যোগাচ্ছে। বিহারে যেখানে আমরা নকশালবাড়ি ধারার শক্তিশালী প্রতিনিধি হিসাবে বেরিয়ে এসেছি, সেখানে সিপিআই(এম)-এর এক বড় অংশ সরাসরি আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন।
পশ্চিমবাংলাতেও যদি আমরা নকশালবাড়ির প্রকৃত তাৎপর্য প্রতিষ্ঠা করতে পারি এবং এই ধারার শক্তিশালী প্রতিনিধি হিসাবে বেরিয়ে আসতে পারি তাহলে সিপিআই(এম)-এর মধ্যে এক ধ্বস নামতে বাধ্য।
নকশালবাড়ির প্রকৃত তাৎপর্য বলতে কী বোঝায়? নকশালবাড়ির অর্থ বুনিয়াদী কৃষক জনগণের জাগরণ। সশস্ত্র কিছু স্কোয়াড দিয়ে এদিক ওদিক বিক্ষিপ্ত কিছু কার্যকলাপ বা কিডন্যাপের মতো চমকপ্রদ এ্যাকশন করে বেড়ানো নয়। তার অর্থ কলকাতা, দিল্লী, বোম্বেতে কফি হাউসে বসে বড় বড় বিপ্লবী বুলি আওড়ানোও নয়। নিজেদের ব্যর্থতাকে চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী আমাদের যতই গালাগালি দিয়ে বেড়াক না কেন, সত্য এটাই যে নকশালবাড়ির ধারায় এই কৃষক জাগরণ একমাত্র ঘটছে বিহারেই এবং আমাদের পার্টিই রয়েছে তার সামনের সারিতে।
নকশালবাড়ির অর্থ এই কৃষক জাগরণের ভিত্তিতে জাতীয় রাজনীতিতে এক বৈপ্লবিক রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন। স্থানীয় ভিত্তিতে কৃষকের কিছু অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া পূরণের মানেই কিন্তু নকশালবাড়ি নয়। পাহাড়ে-জঙ্গলে গিয়ে ‘লাল সেনা ও ঘাঁটি এলাকা’ গড়ে যারা বিকল্প রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তাদের সকলেই ব্যর্থ হয়েছেন। এখন সেখানে রাজনীতি বন্দুক চালাচ্ছে না, উল্টে বন্দুকই রাজনীতি চালাচ্ছে।
নকশালবাড়ি মার্কসবাদ বনাম সংশোধনবাদ, সশস্ত্র সংগ্রাম বনাম সংসদীয় পথের মধ্যকার কোনো বিমূর্ত সংগ্রামের সাফল্য নয়। পেটিবুর্জোয়া বিপ্লববাদ কিন্তু তাই ভাবে। কাজেই সে মনে করে বিপ্লবী ভাবাবেগ দিয়ে ও কিছু মৌলিক মার্কসবাদী সূত্র দিয়ে যখন খুশি, যেখানে খুশি নকশালবাড়ি গড়ে তোলা সম্ভব। যাবতীয় নৈরাজ্যবাদী কার্যকলাপ, তদজনিত হতাশা এবং অবশেষে উল্টো পথে যাত্রা – যার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে – এ সবের পিছনে বিপ্লব সম্পর্কে মধ্যবিত্তের সেই কল্পনাবিলাসই কাজ করে।
নকশালবাড়ির শিকড় রয়েছে ভারতের গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে, তার পেছনে আছে দীর্ঘ কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস, তেভাগা-তেলেঙ্গানার ধারাবাহিকতা। আছে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুই বিপরীতমুখী কৌশলগত লাইনের মধ্যকার দীর্ঘ সংগ্রামের প্রক্রিয়া। একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যার পরিণতি ঘটেছিল নকশালবাড়ির বিদ্রোহে। নকশালবাড়িকে বুঝতে হলে এসবই বুঝতে হবে।
মেহনতি কৃষক জনগণের জাগরণের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা হবে নাকি বুর্জোয়াদের কোনো না কোনো অংশের সাথে যুক্তফ্রন্টের স্বার্থে কৃষক জনগণের উদ্যোগকে স্তিমিত করা হবে – এই দুই বিপরীতমুখী কৌশলের লড়াই দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল। ১৯৬৭ সালের বিশেষ এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই এই লড়াই তার চরমবিন্দুতে পৌঁছায় – যখন ক্ষমতাসীন যুক্তফ্রন্ট সরকার কৃষক আন্দোলনের ঢেউকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা এগিয়ে যান এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিতে।
নকশালবাড়ির পক্ষে আপোশ বা পশ্চাদপসরণ করা সম্ভবও ছিল না, উচিতও ছিল না, কারণ তা হয়ে উঠেছিল এক নতুন বিপ্লবী পথের অগ্রদূত। ইতিহাসে সর্বদাই প্রথম বিপ্লবী অভিযানগুলি চূড়ান্ত মীমাংসার দিকেই ধাবিত হয়ে থাকে এবং তাই তারা ইতিহাসও সৃষ্টি করে যায়। কৌশলগত দিকগুলির সমন্বয় সাধন করতে দুপা পিছনে সরে আসা ইত্যাদি ইত্যাদি সবই সংরক্ষিত থাকে পরবর্তী প্রচেষ্টাগুলির জন্যই। নকশালবাড়ির অন্যতম নেতা হওয়া সত্ত্বেও কানু সান্যাল নকশালবাড়ির এই মর্মবস্তুটাই ধরতে পারেননি। ইতিহাস তাই রসিকতা করে তাকে ঠেলে দিয়েছে নকশালবাড়ির এলাকায় নেতা হয়ে থাকার জন্য। হাজার চেষ্টা করেও নকশালবাড়ি ধারার নেতা তিনি হতে পারেননি।
ইতিহাস যেমন কখনও নিজের অবিকল পুনরাবৃত্তি করে না, তেমনি একটি মহান আন্দোলনের পুনর্জন্মও তার পুরোনো রূপে আর হয় না। যে যুগে আমরা ভালোরকম অধিবিদ্যায় ভুগতাম, বছরের পর বছর পুরোনো রূপে ও পদ্ধতিতেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার জন্য কত চেষ্টাই না চালিয়েছি কিন্তু তাতে সফলতা আসেনি।
কোনো সংগ্রামই সরলরেখায় চলে না। ঠিক সময়ে এগিয়ে গিয়ে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে আঘাত যেমন হানতে হয়, তেমনি প্রয়োজন হলে দুপা পেছনে সরে এসে নিজের শক্তিকে পুনর্গঠিত করতেও শিখতে হয়। যে কোনো আন্দোলন, সংগ্রাম বা যুদ্ধ এই উভয় দিককে নিয়ে গড়ে ওঠে। এই উভয় দিকের সঠিক সমন্বয় ঘটানোই হল নেতৃত্বের দক্ষতা বা যোগ্যতার প্রমাণ।
নকশাবাড়ির মর্মবস্তু অর্থাৎ বুনিয়াদী কৃষক জনগণের জাগরণই গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। বুর্জোয়াদের কোনো না কোনো অংশের সাথে যুক্তমোর্চা বানিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের স্বপ্ন নিছক ধাপ্পাবাজি – সেটা আজও সত্য। প্রশ্নটা হল পরিস্থিতির বিকাশের সাথে সঙ্গতি রেখে সংগঠন ও সংগ্রামের নতুন নতুন রূপের মধ্যে সেই একই অন্তর্বস্তুকে প্রবাহিত করা।
ব্যাপক কৃষক জনগণের গণজাগরণের ভিত্তিতে বিপ্লবী গণতন্ত্রের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চার নামে বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তির বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তির স্বাধীন বিকাশের শ্লোগানের মধ্য দিয়ে এবং সংসদীয় সংগ্রামে চরম বিরোধী পক্ষের অবতারণার মাধ্যমে আজকের পরিস্থিতিতে আমরা নকশালবাড়ির সেই মর্মবস্তুকেই, দুটি বিপরীতমুখী কৌশলের সেই একই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে চলেছি।
আমাদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে সশস্ত্র সংগ্রামের গলাবাজি বা চমকপ্রদ এ্যাকশনগুলি ভোঁতা অস্ত্রে পরিণত হয়েছে এবং সেগুলি সমাজগণতন্ত্রীদের গণভিত্তিকে একটুও নড়াতে সক্ষম নয়। অপরদিকে আমাদের বর্তমান রণকৌশল দিয়েই আমরা সমাজগণতন্ত্রীদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ দাঁড় করাতে সক্ষম হচ্ছি। আমাদের গণভিত্তি ব্যাপকভাবে সিপিআই(এম)-এর দিকে সরে যাওয়ার ১৯৭৭ পরবর্তী ধারামুখ পশ্চিমবাংলাতেও ক্রমে ক্রমে ঘোরানো সম্ভব হচ্ছে।
পশ্চিমবাংলায় আবার এক নকশালবাড়ির গড়ে ওঠার শর্তগুলি পেকে উঠছে। দীর্ঘ বারো বছরের বামফ্রন্টের রাজত্বে এবং অবশেষে কেন্দ্রে ‘বন্ধু সরকার’ প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে সিপিআই(এম)-এর রাজনৈতিক লাইনের সুবিধাবাদ পূর্ণতা লাভ করেছে। যেখান থেকে এখন সংগ্রাম ও আন্দোলনের নামে পার্টি নেতৃত্ব শুধু হাওয়ায় তলোয়ার ঘোরাতে পারে মাত্র।
অপরদিকে আমাদের পার্টির ভিতর থেকে উঠে আসা দক্ষিণপন্থী আত্মসমর্পণবাদী লাইনের পরাজয় এবং রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের বিকাশ সাম্প্রতিককালে জন্ম নেওয়া বিভ্রান্তির অবসান ঘটিয়েছে। এই লাইনের প্রবক্তা মুষ্টিমেয় পদলোভী চক্রান্তকারী পাণ্ডাদের তাড়িয়ে দিয়ে পশ্চিমবাংলার পার্টি সংগঠনে ফিরে এসেছে ঐক্য, শৃঙ্খলা ও কর্মোদ্যমের পরিবেশ। এখন পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭০-এর দশকে যে নতুন ইতিহাস আমরা লিখতে গিয়েছিলাম, তা কি শুধু ইতিহাসই হয়ে থাকবে? অসাধারণ বীরত্ব, আত্মবলিদান, বেদনা ও বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা এক বেদনাদায়ক ইতিহাস হয়ে থাকবে – যা নিয়ে কবিরা কবিতা লিখবে, শিল্পীরা ছবি আঁকবে, গবেষকরা থিসিস রচনা করবে, বিপ্লবের শত্রুরা উপহাস করবে এবং আমরা মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান করে স্মৃতিমন্থন করব? না, তা আমরা হতে দিতে পারি না। বাংলার আকাশে বাতাসে আবারও প্রতিধ্বনিত হবে সেই চিরপরিচিত রণধ্বনি “নকশালবাড়ি লাল সেলাম”। সেই দিনকে এগিয়ে আনার শপথই তো নিতে হবে আজকের দিনে।