(৬ আগস্ট ১৯৯৮, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলনে সমাপ্তি ভাষণ)
আধা-সামন্ততন্ত্রের কথা যখন আমরা বলি তখন এটা ধরেই নেওয়া হয় যে সামন্ততন্ত্রের থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের একটা প্রক্রিয়া অবিরাম চলছে। কৃষিতে পুঁজিবাদ বেড়ে চলেছে এটা সত্য এবং কোনো বুর্জোয়া বিপ্লব ছাড়াও তা ঘটছে। বিপ্লবি পদ্ধতিতে সামন্ততন্ত্রকে সম্পূর্ণ উৎখাত করে পুঁজিবাদী বিকাশ আমাদের কাম্য, কিন্তু তা না করা গেলেও নিজস্ব স্বতস্ফূর্ত ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াতেও তা ঘটবে, এমনকি চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধরনের কোনো রাজত্বেও। তবে এটা হবে দীর্ঘতর কষ্টসাধ্য বহু সামন্ততন্ত্রের অবশেষকে বাঁচিয়ে রেখেও বা কিছুটা বিন্যস্ত করে। ভারতবর্ষে কৃষিতে পুঁজিবাদী বিকাশের এই প্রক্রিয়াই মূলত চলছে এবং আধা-সামন্ততন্ত্র বললে এই বিশিষ্ট প্রক্রিয়াকে বেশি সঠিকভাবে বোঝা বা চিহ্নিত করা সম্ভব। কাজেই আধা-সামন্ততন্ত্রের চরিত্রায়ণ পুঁজিবাদী বিকাশকে নাকচ করে না, বরং এই বিকাশের প্রকৃত চিত্রণ করে। অনেকে আধা-পুঁজিবাদ শব্দটা বেশি পছন্দ করেন ভারতের এই বিশিষ্ট প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করার জন্য। তবে উত্তরণটা যেহেতু সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদের দিকে তাই আধা-সামন্ততন্ত্রটাই বেশি বৈজ্ঞানিক বলে মনে হয়।
পশ্চিমবাংলায় “কৃষিতে সংকট নেই” যখন বলা হয় তার অর্থ এটা নয় যে, সাধারণ আপামর কৃষক জনসাধারণের সংকট নেই। কৃষি সংকট বলতে গ্রামের জোতদার, ধনী কৃষকদের অর্থনীতির সংকটের কথা বলা হয়। সিপিআই(এম)-এর রাজত্বে গ্রামাঞ্চলে অনেক সংস্কার হয়েছে এবং জোতদার ধনী কৃষক অর্থনীতির পুরোনো সংকট থেকে উদ্ধার করে এক নতুন স্থায়িত্ব তারা প্রদান করেছে। সেই প্রক্রিয়ায় শাসক শ্রেণীর স্তর বেড়েছে। নতুন নতুন সামাজিক স্তর শাসক শ্রেণীতে যোগ দিয়েছে। এই শাসক শ্রেণীর সাধারণ কৃষক জনগণের উপর মতাদর্শগত প্রভাবটাও বেশি। এই শাসকশ্রেণী সিপিআই(এম)-এর শক্তির মূল ভিত্তি। তাদের ভেতরে বিভিন্ন শক্তি-গোষ্ঠী আছে। তাদের মধ্যে সংঘাতও আছে। ক্রমেই তা বাড়ছে। সাম্প্রতিককালে মমতার উত্থানের পেছনে নিছক আন্দোলন ইত্যাদি কারণ নয়, এই শ্রেণীর একটা অংশ তাদের অভ্যন্তরীণ ঝগড়ার জন্য মমতার দিকে অবস্থান পরিবর্তন করেছে এবং সেটাই বড় কথা। তবে এখনও এই সংঘাত বিরাট রূপ নেয়নি। নিলে তা বামফ্রন্টের অভ্যন্তরে বা সিপিআই(এম)-এর অভ্যন্তরে ভাঙ্গন হিসাবে দেখা দিতে পারে। এই ঐক্য টিকে থাকার পেছনে কৃষি অর্থনীতির একটা স্থায়িত্ব সত্ত্বেও যেখানে শাসক শ্রেণীর এই পুরো স্তরটাই শোষণ চালিয়ে নিজেদের সম্পদশালী করছে সেখানে কৃষিমজুর এবং গরিব কৃষকদের সংগ্রামের ইস্যুগুলো আসবে, আন্দোলনও হবে, বড় বড় আন্দোলন সংগঠিত হবে এবং সেই আন্দোলন অবশ্যই করা যায়। তবে বাঁধে ফাটল ধরলে যেমন নদীর জল সেই ফাটল ধরে হুড়মুড় করে বন্যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভাসিয়ে দেয় তেমনি শাসক শ্রেণীর মধ্যে ফাটল ধরলে কৃষক আন্দোলনও যে উত্তাল গতিতে ছড়িয়ে পড়ে সেই পরিস্থিতি আছে কিনা তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে।
সিপিআই(এম)-এর সন্ত্রাসের মোকাবিলায় কিছুটা আধা-গোপন কাজের স্টাইল নিতে হবে। সিপিআই(এম) থেকে যারা আসছেন তাদের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্য করে না দিয়ে ভেতর থেকে প্রভাব বিস্তারের জন্য কিছুদিন কাজ করার কথা ভাবা যেতে পারে। যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে আপেক্ষিকভাবে এক বড় এলাকায় বিদ্রোহ সংগঠিত করতে হবে। প্রতিরোধের যাবতীয় প্রস্তুতিও বাড়াতে হবে এবং দু-একটা জায়গায় অনুকূল অবস্থায় পাল্টা আঘাতও দিতে হবে। পশ্চিমবাংলার পরিস্থিতি ক্রমেই আমাদের অনুকূল হবে, লোক বাড়াবার সুযোগও আসবে, যেমন এই উত্তরবাংলাতে।
নতুন প্রজন্মের যুব কমরেডদের এগোতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে। নেতৃত্বের উচিত সাহস করে তাঁদের দায়িত্ব দেওয়া। পার্টির জন্ম এই পশ্চিমবাংলায়, আন্দোলনের সর্বোচ্চ পর্যায়ও এখানেই পৌঁছেছিল, তবে ক্লান্তি ও বার্ধক্যের লক্ষণও এখানে সবচেয়ে বেশি। নবীন প্রজন্মের হাতে পার্টিটাকে তুলে দিতে হবে। তবেই সক্রিয়তা, ত্যাগ সবকিছুই আসবে।