(৯ ডিসেম্বর ১৯৯৪, পার্টির নদীয়া জেলা সম্মেলন উপলক্ষে কৃষ্ণনগর টাউন হল ময়দানে জনসভায় ভাষণ)
এই পশ্চিমবাংলায় গত সতের বছর ধরে একটা বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আছে। এত বছর ধরে শাসন করার পর আজ তাঁরা বলছেন, কেন্দ্রের নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগ করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। হঠাৎই আমরা দেখছি এই সরকারের নেতারা, এই পার্টির নেতারা, কেন্দ্রের নয়া আর্থিক নীতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়েছেন। হঠাৎই দেখা যাচ্ছে বোফর্স কেলেঙ্কারির অন্যতম নায়ক হিন্দুজাদের প্রশংসায় তাদের হয়ে সাফাই গাইছেন এখানকার সিপিআই(এম) নেতারা। আজ তাঁরা নয়া আর্থিক নীতি পশ্চিমবাংলায় চালু করতে চাইছেন, কাল কেন্দ্রের কৃষি নীতিও চালু করবেন, শিক্ষা নীতিও চালু করবেন। এবং সব ক্ষেত্রেই তাঁদের একটাই যুক্তি, পশ্চিমবাংলা তো আলাদা নয়, ভারতেরই অঙ্গ; আমাদের ক্ষমতা সীমিত, তাই আমরা বাধ্য, আমাদের সেটা করতে হচ্ছে।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, একথা আমাদের পার্টি বহু বছর আগেই বলেছিল। বলেছিল, তুমি যদি এই শাসন ক্ষমতা এভাবেই চালিয়ে যাও বহু বছর ধরে, এই শাসন ক্ষমতা চালাবার দায়িত্ব যদি তুমি নিজের হাতেই নিয়ে নাও, তাহলে এই ব্যবস্থার জন্যই তোমাকে কাজ করতে হবে, অন্যথা কিছু হতে পারে না।
আমাদের পার্টি যে কথাটা বলেছিল আজ তাঁরা নিজেরাই সেসব কথা স্বীকার করছেন এবং সেই নিয়ে তাঁদের নিজেদের পার্টির মধ্যেই ভালোরকম বিতর্ক হচ্ছে, ভালোরকম সংকট এসেছে। অনেকেই একথা বলছেন যে এত বছর ধরে শাসন করে যাওয়া, এটা তো ভালোর জায়গায় খারাপ হল। সতের বছরের মধ্যে আমাদের এই অবস্থা হয়েছে, আরও পাঁচ-সাত বছর ধরে শাসন করলে আমাদের আরও কী পরিণতি হবে। আমি বলছি এই পার্টি যেভাবে রাজনৈতিক নীতি পাল্টাচ্ছে, সেভাবেই তাদের সংগঠনের চরিত্রটাও পাল্টে যাচ্ছে। এখন পার্টির মধ্যে কংগ্রেসের মতনই বিভিন্ন গ্রুপ গড়ে উঠেছে। নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি-মারামারি শুরু হয়েছে।
তাদের রাজনৈতিক নীতিই হোক, সংগঠনের দুর্নীতিই হোক, তাদের সংগঠনের চরিত্রই হোক, এটা ক্রমেই কংগ্রেসের মতন হয়ে যাচ্ছে। এখানে প্রশ্ন উঠছে, যদি একটি বামফ্রন্ট সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া আর্থিক নীতিই এখানে চালু করে, তাহলে শাসক শ্রেণীর জন্য এই পার্টির শাসনটাই তো ভালো। সেই কারণে আমার মনে হয়, বোধহয় পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেস পার্টির প্রাসঙ্গিকতা শেষ হয়ে গেছে। কংগ্রেসকে দিয়ে যা করার কথা ভারতের শাসকশ্রেণী আগে ভাবত, ওরা দেখছে সেই কাজটাই অনেক ভালোভাবে, অনেক সুষ্ঠুভাবে বামফ্রন্ট সরকারকে দিয়ে করা যায়। এই একটি পরিস্থিতির পরিবর্তন এসেছে।
কাজেই আমাদের কাছে, বিপ্লবী বামপন্থীদের কাছেও দায়িত্ব এসে গেছে যে প্রধান বিরোধী পক্ষ হিসেবে আমাদের উঠে আসতে হবে। আপনাদের সেই দায়িত্ব নিতে হবে। কংগ্রেসের যে বিরোধিতা আছে এই বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে, তার আর কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, কারণ বামফ্রন্ট সরকার সেইসব নীতি কার্যকরী করছে যেটা একটি কংগ্রেস সরকার এখানে থাকলে করত। যদি এই বামফ্রন্ট সরকার কেন্দ্রেরই আর্থিক নীতি ও অন্য সমস্ত নীতি প্রয়োগ করে, তাহলে যে সমস্ত চাপ আসবে মেহনতি মানুষের ওপর, শ্রমিকশ্রেণীর ওপর এবং গ্রামাঞ্চলের ক্ষেতমজুর ও গরিব কৃষকদের ওপর, সেই সমস্ত মানুষদের সংগঠিত করার, সেই সমস্ত মানুষের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এখন এসে গেছে আমাদের কাঁধে। কাজেই আগামীদিনে পশ্চিমবাংলায় এই পরিস্থিতিটাই দেখা যাবে যে এখানে বামফ্রন্ট থাকবে সরকারে এবং প্রধান বিরোধী শক্তি হিসাবে দাঁড়াবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। এই দুটির মধ্যে সংগ্রামের ভেতর দিয়েই ফয়সালা হবে ভারতবর্ষের পরিবর্তন, ভারতবর্ষের বিপ্লব কোন পথে এগোবে।
এই নদীয়া জেলায় অন্যান্য নকশালপন্থী গ্রুপও আছে, ঐতিহাসিকভাবেও তাঁরা থেকেছেন। আমি আশা করব বিভিন্ন নকশালপন্থী গ্রুপের সাথে যুক্ত বিভিন্ন কমরেডরা, বন্ধুরা সকলেই একথাটা ভাববেন যে আমাদের মধ্যেকার বিভেদ আমাদের আন্দোলনকে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কাজেই আমি আশা করব নতুন করে গড়ে ওঠা, নতুন করে এগিয়ে চলা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-র পতাকাতলে সকলেই আপনারা ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে পশ্চিমবাংলায় আমাদের ওপর যে বিরাট দায়িত্ব এসেছ সে দায়িত্ব আমরা সকলে মিলে পালন করব।
সিপিআই(এম)-এর মধ্যেও, আমি বিশ্বাস করি, অনেক সৎ মানুষ আছেন এবং তাঁরাও চিন্তিত। যে দিকে, যে দিশায়, এ সরকার চলেছে সকলের কাছেই সেটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সব বামপন্থী কমরেডদের কাছেও আমি অনুরোধ করব আপনারা আপনাদের পার্টির নীতি নিয়ে ভেবে দেখুন এবং আসুন আমরা সকলে মিলে নতুন এক বামফ্রন্ট এখানে গড়ে তুলি, নতুন এক বামমোর্চা এখানে গড়ে তুলি। একটা বিপ্লবী পথে যে বামফ্রন্ট, যে বামমোর্চা এগিয়ে যাবে।