(দেশব্রতী, ২৫ মে ১৯৯৩ থেকে)
প্রত্যেক বছর ২৫ মে ঘুরে আসে এবং আমাদের মনে করিয়ে দেয় নকশালবাড়ির কথা। নকশালবাড়ির জোতদার-জমিদারদের বিরুদ্ধে গরিব ভূমিহীন কৃষকদের বিদ্রোহ কোনও সাধারণ বিদ্রোহ নয়। নকশালবাড়ি ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে এবং এটাই তার বৈশিষ্ট্য। নকশালবাড়ি ঘটেছিল এমন এক পরিস্থিতিতে যখন স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় শাসনব্যবস্থার প্রথম সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল, যখন বিভিন্ন ইস্যুতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যাচ্ছিল এক গণজাগরণ এবং তার পাশাপাশি বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের একাধিপত্য ভেঙ্গে গড়ে উঠছিল অ-কংগ্রেসী সরকারগুলি। নকশালবাড়ি ঘটেছিল পশ্চিমবাংলায় – যেখানে গণজাগরণ ছিল শীর্ষবিন্দুতে এবং যেখানে প্রথম অ-কংগ্রেসী সরকারে বামপন্থীরাই ছিলেন প্রধান শক্তি।
এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নকশালবাড়ি বনাম যুক্তমোর্চা সরকার – এই দুই মডেলের মধ্যকার সংঘাত ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুই পথ ও দুই কৌশলের মধ্যকার সংঘাতের ব্যবহারিক রূপ গ্রহণ করে। তারপর থেকে গত ২৬ বছর ধরে গঙ্গা-গোদাবরী দিয়ে বহু জলই গড়িয়ে গেছে। নকশালবাড়ির ধারার কৃষক আন্দোলন বিহারে তার ভরকেন্দ্র খুঁজে পেয়েছে যেখানে প্রায় কুড়ি বছর ধরে তার অস্তিত্ব ও অগ্রগতি অব্যাহত।
সংগ্রাম-বিপর্যয়-পুনর্গঠনের জটিল প্রক্রিয়া থেকে শিক্ষা নিয়ে বিপ্লবী কমিউনিস্টরা তাঁদের রণকৌশলে বহু কিছু বাতিল করেছেন ও অনেক কিছুই সংযোজন করেছেন। অপরদিকে পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকার প্রায় সতেরো বছর ধরে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিতে শাসনক্ষমতা ধরে রেখেছে এবং যাবতীয় গণউদ্যোগকে তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে পঞ্চায়েতের গণ্ডিতে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
বহু কিছু পাল্টে গেলেও তাই বিহারে কমিউনিস্ট বিপ্লবী শক্তির নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলন ও পশ্চিমবাংলায় সমাজগণতন্ত্রীদের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের মডেলের মধ্যে দিয়ে সেই চিরন্তন দুই পথের ও দুই কৌশলের সংগ্রাম আজও অব্যাহত।
ইতিহাসে শাসকশ্রেণীর পরবর্তী প্রজন্মের পরিধি ও গণভিত্তি সর্বদাই সম্প্রসারিত হয়ে থাকে। ইংরেজ শাসকরা গ্রামের জমিদারদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে শাসন করত, কংগ্রেসী শাসনের গণভিত্তি গ্রামে সম্প্রসারিত হয় নব্য জমিদার-জোতদারদের মধ্যে। সিপিআই(এম)-এর সমাজগণতান্ত্রিক শাসনে এই গণভিত্তি বিস্তৃত হয়ে ধনী কৃষক ও মধ্য কৃষকের স্বচ্ছল অংশকেও সামিল করেছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ধাপে শাসকশ্রেণীর পুরোনো অংশগুলি তাদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হারায়। তাদের কিছু অংশ অবশ্য নবরূপে নতুন শাসনক্ষমতার শরিক হয়ে দাঁড়ায়।
সিপিআই(এম)-এর শাসনের ১৭ বছরে পার্টি ও সরকারি ক্ষমতায় আধিপত্যকারী শ্রেণীশক্তিগুলির সাথে ব্যাপক ক্ষেতমজুর ও দরিদ্র কৃষক জনগণের বিরোধ ক্রমেই বাড়ছে। বর্ধমানের মতো জেলায় নীচুতলার মানুষ আমাদের প্রতি যে আকৃষ্ট হতে শুরু করেছেন এটা তারই প্রমাণ। যত দিন যাবে পঞ্চায়েতের ভেতরে ও বাইরে এই বিক্ষোভ বাড়বে এবং পশ্চিমবাংলায় পঞ্চায়েতের গণ্ডি ভেঙ্গে এইভাবেই নবরূপে নকশালবাড়ির আবির্ভাব ঘটবে। পশ্চিমবাংলার মাটিতে সার্থক হবে কমরেড চারু মজুমদারের কথা : নকশালবাড়ি মরেনি, নকশালবাড়ি মরবে না।