(২৭ মার্চ ১৯৯৫, কালনায় কমরেড আবদুল হালিমের স্মরণসভায় ভাষণ)
সর্বপ্রথম আমি আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে শহীদ কমরেড আবদুল হালিমকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছি। আমার বিশ্বাস আমাদের পার্টি অবশ্যই কমরেড হালিমের হত্যার বদলা নেবে, প্রতিশোধ নেবে।
বামপন্থী রাজত্বে তা সে পশ্চিমবাংলাতেই হোক বা ত্রিপুরাতেই হোক, মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার থাকছে না। এটা আমার কথা নয়, সিপিআই(এম)-এর পলিটব্যুরোর সদস্য নৃপেন চক্রবর্তী নিজেই বলেছেন যে বামফ্রন্টের রাজত্বে এত বিকৃতি ঘটেছে, এত পতন ঘটেছে, সে পশ্চিমবাংলাতেই হোক বা ত্রিপুরাতেই হোক, মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার থাকছে না। আমরা কংগ্রেসী জমানায় কংগ্রেসী সন্ত্রাস দেখেছি, এই কালনা কংগ্রেসী সন্ত্রাস দেখেছে। কীভাবে গোটা শাসনব্যবস্থা, গোটা পুলিশবাহিনী সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেসীরা বিরাট আকারে সন্ত্রাস নামিয়েছিল। আজ একই জিনিস সিপিআই(এম)-এর রাজত্বে দেখছি। যদি পরিস্থিতি এরকমই হয়ে ওঠে, সরকার নিজেই যদি সন্ত্রাসের পথ গ্রহণ করে, সরকারের পুলিশবাহিনী যদি শাসক পার্টির ইশারাতেই সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার নামিয়ে আনে, সরকারের গুণ্ডারা যদি আমাদের কমরেডদের ও সাধারণ মানুষের ওপর জঘন্য অত্যাচার নামিয়ে আনে, তাহলে সাধারণ মানুষেরও অধিকার আছে এই অত্যাচারের প্রতিরোধ করার, প্রয়োজন হলে সশস্ত্রভাবে প্রতিরোধ করার। এই অধিকার আপনার নৈতিক অধিকার।
সিপিআই(এম) আজ এমন একটা পার্টি হয়ে উঠেছে যে পার্টি তার ভিতরের কোনো প্রতিবাদ সহ্য করতে পারছে না। এই ধরনের চরিত্র কোনো কমিউনিস্ট পার্টির হতে পারে না। এই ধরনের চরিত্র একটা ফ্যাসিস্ত পার্টিরই শুধু থাকে। এই প্রশ্নটা ভাববার আছে, যে পার্টি একসময় কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে গড়ে উঠেছিল ক্রমেই একটা ফ্যাসিবাদী পার্টি হিসাবে তার পতন ঘটছে। সেই পার্টির মধ্যে আপনি নেতৃত্বের লাইন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না, নেতৃত্বের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারবেন না, নেতাদের জনগণ বিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদ করতে পারবেন না। যদি তা আপনি করতে চান, তাহলে আপনার বিরুদ্ধে সবরকমের কুৎসা রটনা করা হবে, আপনাকে পার্টি থেকে বার করে দেওয়া হবে। তবু যদি আপনি চুপ না করেন তাহলে ঠাণ্ডা মাথায় আপনাকে হত্যা করা হবে। আমাদের করন্দার ক্ষেতমজুর কমরেডদের, কমরেড আবদুল হালিমের, নাদনঘাটের কমরেডদের ‘অপরাধ’ এটাই ছিল যে, তাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন পার্টি নেতৃত্বের দাদাগিরির বিরুদ্ধে, সিপিআই(এম) নেতৃত্বের দুর্নীতির বিরুদ্ধে। আমি বলতে চাই, এই ‘অপরাধ’ আমাদের পার্টি হাজারবার করতে থাকবে এবং তার জন্য এক নয় – হাজার হাজার আবদুল হালিমকেও যদি জীবন দিতে হয়। আমার বিশ্বাস বর্ধমানের সংগ্রামী মানুষের ভিতর থেকে, পশ্চিমবাংলার সংগ্রামী মানুষের ভিতর থেকে আবদুল হালিমদের অভাব হবে না।
আজ পশ্চিমবাংলায় তারা শিল্পায়নের নামে দেশী-বিদেশী ধনিকশ্রেণীর সাথে বড় বড় বুর্জোয়াদের সাথে দহরম মহরম করছে। গ্রামাঞ্চলে তারা ধনী চাষি, জোতদারদের সাথে হাত মেলাচ্ছে। আমাদের পার্টি এই ঘটনাগুলির প্রতিবাদ করছে। যেহেতু এই প্রতিবাদ গোটা পশ্চিমবাংলায় একমাত্র আমাদের পার্টিই জোরালোভাবে জানিয়েছে, সেটাই একমাত্র কারণ যে, সিপিআই(এম) সর্বত্রই চেষ্টা করছে আমাদের পার্টিকে শেষ করে দেওয়ার। কারণ তারা জানে যে আগামীদিনে সিপিআই(এম)-এর যে বিকল্প এই পশ্চিমবাংলায় উঠে আসবে সেই বিকল্প একমাত্র ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)।
একসময় এই পশ্চিমবাংলায়, বামপন্থীদের এই বর্ধমান জেলায় আমাদের যে কোনো প্রচেষ্টা যখন শুরু হত, শুরুতেই ওরা আমাদের মেরে শেষ করে দিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এবার আমরা দেখেছি, করন্দায় তারা আমাদের ওপর গণহত্যা সংগঠিত করল, কিন্তু আজও করন্দার মাটিতে আমাদের পার্টি বেঁচে আছে। আর করন্দার মাটি থেকে আমাদের পার্টি আরও শক্তিশালী হয়েছে। কালনায় তারা আবদুল হালিমকে মেরে ভেবেছিল এখান থেকে তারা আমাদের পার্টিকে উৎখাত করবে। কিন্তু কালনায় আমাদের পার্টি আরও শক্তিশালী হয়েছে। নাদনঘাটে অত্যাচার করে তারা ভেবেছিল আমাদের পার্টিকে সেখান থেকে উৎখাত করবে। কিন্তু আমাদের পার্টি সেখানে ব্যাপক গণভিত্তি নিয়ে এগিয়ে গেছে। যতই তারা হত্যা করে আমাদের শেষ করতে দিতে চাইছে, ততই বেশি বেশি করে সিপিআই(এম)-এর ভিতর থেকেই সমস্ত সৎ বামপন্থী কর্মীরা, যাদের মধ্যে আজও বিবেক আছে, সততা আছে, হিম্মত আছে, বেশি বেশি সংখ্যায় ঐ পার্টি থেকে বেরিয়ে আসছেন এবং সিপিআই(এমএল)-এর পতাকাতলে সমাবেশিত হচ্ছেন।
আজ নতুন যুগে, নতুন পরিস্থিতিতে এই বর্ধমান জেলার বুকে বিপ্লবী বামপন্থী শক্তি যেভাবে এগিয়ে আসছে তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সুবিধাবাদী বামপন্থীদের সাথে বিপ্লবী বামপন্থীদের যে সংগ্রাম দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে পশ্চিমবাংলার বুকে চলছে, তার রণভূমি হচ্ছে এই বর্ধমান। এবং এই সংগ্রামে আমাদের পার্টি অবশ্যই এবার বিজয়ী হবে।
সমস্ত বামপন্থী কর্মীরা, তাঁরা যে কোনো বামপন্থী পার্টিতেই থাকুন না কেন, সকলের কাছে আমাদের আহ্বান, আসুন আমরা একসাথে হাত মেলাই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বিপ্লবী বামপন্থার পতাকা এই বর্ধমান জেলা থেকেই উঠতে থাকবে। এখান থেকে বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে যেতে থাকবে। নতুন পর্যায়ে যে নকশালবাড়ি পশ্চিমবাংলায় ঘটবে, তার রণভূমি হবে এই বর্ধমান জেলাই।