(আলফার উপর সামরিক বাহিনীর দমনপীড়ন নামিয়ে আনার ঠিক আগে এক অসমীয়া পত্রিকার জন্য লেখাটি তৈরি হয়। লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯১ থেকে)

১৯৭৯-র গ্রীষ্মের এক সুন্দর সকালে বেজিং-এ মাও জে দং-এর সমাধি-সৌধে সুরক্ষিত তাঁর নিথর দেহের সামনে যখন দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে সরতে মন চাইছিল না। এখানেই চিরশান্তিতে শায়িত সেই মানুষটি যিনি মানবজাতির এক চতুর্থাংশের নিয়তিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন, জগৎ যে আগের মতো আর থাকবে না তা সুনিশ্চিত করেছিলেন এবং ১৯৬০-এর দশকের শেষার্ধে সারা পৃথিবীর যুবসমাজকে আলোড়িত করেছিলেন। অবনত মস্তকে নিমগ্ন চিত্তে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। চীনা কমরেডরা এগিয়ে যেতে বলায় হুঁশ ফিলে এল। আমাদের পিছনে যে এক দীর্ঘ সাগ্রহী মানুষের সারি।

চীন ভ্রমণে গিয়ে আমি লং মার্চের গোটা পথই পরিক্রমা করেছিলাম – একেবারে চাংশা পর্বতমালা থেকে ইয়েনানের গুহা পর্যন্ত।

তরুণ চীনা গাইডদের কাছে যেমন চীন বিপ্লবের পুরো বর্ণনা শুনেছি, তেমনি কিছু কৃষক সহ প্রবীণ মানুষদের কাছে জীবন্ত মাও-এর সঙ্গে তাঁদের সান্নিধ্যের আবেগপূর্ণ স্মৃতিমন্থনও শুনেছি। বেজিং-এ গুরুত্বপূর্ণ পার্টি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার সময় মাও বিসর্জনের যেটুকু আভাস পেয়েছিলাম, দেখেছিলাম তৃণমূলে তার কোনো ছাপই পড়েনি। মাও সেই দেবতাই রয়ে গিয়েছিলেন। দেং-এর উত্থান এবং তার সঙ্গে সঙ্গে মহান কাণ্ডারী মাও-কে ঘিরে যা নাকি ছিল অতিকথা তার অবসান ঘটানোর মতো পরিস্থিতি চীনে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমি অবশ্য মাও, তাঁর বিপ্লব ও চিন্তাধারা সম্পর্কে পুনর্নবীকৃত প্রত্যয় নিয়ে দেশে ফিরে এলাম।

আমরা মাও চিন্তাধারাকে বরণ করেছিলাম ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকের সেই ঝোড়ো দিনগুলিতে যখন মতাদর্শগত মহাবিতর্ক চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব এবং ভারতে নকশালবাড়ির জন্ম দিয়েছিল। আমরা জেলারেল গিয়াপ, চে গুয়েভারা, রেজি দ্যব্রে এবং অন্যান্যদের লেখা পড়েছিলাম এবং আজকের আসামের আলফার তরুণ কমরেডদের মতোই সমস্ত ধরনের সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতিই দুর্বার আকর্ষণ বোধ করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছিলাম মাও চিন্তাধারা ও তাঁর কৃষি বিপ্লবকে।

১৯৭১-৭২ সালে বহরমপুর জেলে থাকার সময় আমি লুকিয়ে একটি মাও-এর নির্বাচিত রচনাসংগ্রহ জোগাড় করেছিলাম এবং যে কোনো কারণেই হোক প্রতিদিন তল্লাশি সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ ঐ বইটি নিয়ে যেতে পারেনি। মাসের পর মাস ২৪ ঘণ্টা ঐ কনডেমড সেলে আটক থাকার সময় বারবার ঐ বইটি পড়া ছাড়া আমার আর কোনো কাজ ছিল না, বইটি  প্রায় মুখস্থ করেই ফেলেছিলাম। পার্শ্ববর্তী সেলের কমরেডদের সুবিধার জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় ঐ বইটি থেকে অনুবাদ করে জোর গলায় পড়তাম। এইভাবেই আমি মাও-কে বিভিন্ন দিক থেকে উপলব্ধি করতে পারি – দার্শনিক, প্রথম সারির রণনীতিবিদ এবং শ্রেষ্ঠ সমর নায়ক হিসাবে।

তৃতীয় বিশ্বে নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে কোনো বিপ্লবী সংগ্রামেই মাও-এর চিন্তাধারাকেই একমাত্র হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করা হয় – তা সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধেই হোক অথবা কৃষক জনতার উপর সামন্ততান্ত্রিক আধিপত্যের বিরুদ্ধেই হোক বা দেশের অভ্যন্তরে নিপীড়নের বিরুদ্ধে কোনো জাতিসত্তার সংগ্রামই হোক। সামন্ততন্ত্রের জোয়াল থেকে কৃষক জনতার মুক্তি এবং সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সংগ্রামে আমরা যেমন মাও চিন্তাধারার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তেমনি অসমীয়া জাতিসত্তার স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন আলফা ভারতীয় উগ্রজাতীয়তাবাদী স্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যে মাও চিন্তাধারাকেই তার মতাদর্শগত হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছে তা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

মাও চিন্তাধারার প্রতি তাদের বিশ্বাস তাদের নিয়ে গেছে ভারতবর্ষ থেকে আসামকে বিচ্ছিন্ন করার সংগ্রামে, আর মাও চিন্তাধারার প্রতি আমাদের বিশ্বাস থেকে আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি এক ঐক্যবদ্ধ, গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতবর্ষ গঠনে যেখানে জাতিসত্তার উপর সমস্ত ধরনের নিপীড়নকেই মুছে ফেলা হবে। মাও চিন্তাধারার প্রতি তাদের বিশ্বাস পূর্বতন অসমীয়া আন্দোলনে এক নতুন মোড় প্রদানের পথে তাদের নিয়ে গেছে, যা অবশ্যই এক বাম মোড় এবং যা ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকের কমিউনিস্ট-বিরোধী, বাম-বিরোধী, সাম্প্রদায়িক ঝোঁককে দূর করেছে। মাও চিন্তাধারার প্রতি আমাদের বিশ্বাস একেবারে শুরু থেকেই আমাদেরকে অসমীয়া জনগণের সেই আকাঙ্খা ও শঙ্কার শরিক করে তুলেছে, যা হল নিজেদের সম্পদ নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করার আকাঙ্খা এবং জনসংখ্যার পরিসংখ্যানগত বড় আকারের পরিবর্তনের মুখে নিজেদের পরিচিতি হারানোর আশঙ্কা।

মাও চিন্তাধারার বশবর্তী হয়ে তাঁরা রাষ্ট্রের মোকাবিলার জন্য এক সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছেন। আর আমাদের বিশ্বাসের বলে আমরা এগিয়ে গেছি শ্রমজীবী কৃষক জনতার ব্যাপকতর প্রতিরোধ গড়ে তুলে সেই একই রাষ্ট্রশক্তির মোকাবিলার পথে। তাঁদের বিশ্বাস তাঁদের নিয়ে গেছে বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় খণ্ডিত এবং প্রায়শই পরস্পরের সঙ্গে উগ্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত অসমীয়া জনগণের বৃহত্তম ঐক্য পুনর্গঠিত করার দিকে। আমরাও অসমীয়া জনগণের এক বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করি – এমন এক ঐক্য যেখানে মূলধারার অসমীয়া জাতিসত্তার জাতিদম্ভ যেমন থাকবে না, তেমনি উপজাতিদের বিচ্ছিন্নতাকেও প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। কার্বি আন্দোলনের উপর আমাদের পার্টির প্রভাব ঐ আন্দোলনের গণতান্ত্রিকীকরণেই সাহায্য করেছে এবং অন্য সমস্ত সম্প্রদায়ের শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে তার ঐক্যকে শক্তিশালী করেছে।

আলফার তরুণ বিপ্লবীরা যে পেটিবুর্জোয়া বিপ্লবী সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, আর সম্ভবত বর্তমানে তাদের পক্ষে ঐরকম হওয়াই স্বাভাবিক। তারা অবশ্য আসাম আন্দোলনকে এক প্রগতিশীল দিকে ঘোরাতে সক্ষম হয়েছে এবং অসমীয়া যুবসম্প্রদায়ের অসীম গতিময়তা, সাহস ও চমকপ্রদ সাংগঠনিক দক্ষতার তারা প্রতিনিধি। মাও চিন্তাধারার সঙ্গে বাস্তব জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষার সমন্বয়সাধন কি যুক্তিসঙ্গত পরিণতি হিসাবে তাদেরকে কমিউনিস্টে রূপান্তরিত করবে?

আলফার কমরেডরা দেশের এই অংশে মাও ও তাঁর চিন্তাধারার উত্তরাধিকারকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। আমি তাঁদের লাল সেলাম জানাই।

(লিবারেশন, ডিসেম্বর ১৯৭৯ থেকে)

অসমীয়া জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা রক্ষার জন্য আপনাদের যে উৎকণ্ঠা, আমাদের পার্টি তার অংশীদার এবং এই উদ্দেশ্যে আপনারা যে সংগ্রাম চালাচ্ছেন আমরা তাকে সমর্থন করি। অসমীয়া যুবকদের ব্যাপক বেকারত্ব ও অসমীয়া জনগণ যেসব সমস্যার সম্মুখীন সেগুলির বিরুদ্ধে আপনাদের সংগ্রামকে আমরা সমর্থন করি।

এটা ঠিকই যে বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ ভ্রান্ত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণায় ভোগে এবং অসমীয়া জাতিকে পশ্চাৎপদ ও বর্বর মনে করে তাচ্ছিল্য করে। এটা অতীতেরই ধারাবাহিকতা ও ব্রিটিশ শাসকদেরই সৃষ্টি।

ব্রিটিশ শাসকরা কয়েকটি জাতির স্বার্থের বিনিময়ে অন্য কয়েকটি জাতির বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিয়োগ ও অন্যান্য ব্যবস্থাদি গ্রহণ করে কাছে টেনে নেওয়ার নীতি অনুসরণ করেছিল। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা এই নীতি চালিয়েছে। এভাবে তারা একদিকে কয়েকটি জাতির বেশ কিছু অংশকে তাদের পক্ষে টেনে এনেছিল এবং অন্যদিকে অপর জাতিগুলির মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি করেছিল যে তাদের শত্রু সুবিধাপ্রাপ্ত জাতিগুলি তারা নিজেরা (ব্রিটিশ শাসকরা) নয়। এই পদ্ধতিতে ব্রিটিশ শাসকরা জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল এবং এতবছর ধরে আমাদের দেশ শাসন করেছিল। ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম চালিয়েই বিভিন্ন জাতির ভারতীয় জনগণ তাদের ঐক্য গড়ে তুলেছেন।

সুতরাং অসমীয়া ও বাঙালীদের মধ্যে যেমন বিভেদের একটি ইতিহাস তেমনি রয়েছে তাদের উভয়ের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামেরও এক ইতিহাস।

১৯৪৭ সালের পর জনগণের সংগ্রামী ঐক্য ধ্বংস করার জন্য ভারতের শাসকশ্রেণী হাজারো অপচেষ্টা চালিয়েছে এবং যেহেতু শত্রু বর্তমানে আরও ছদ্মবেশী তাই তাদের পক্ষে একাজ করা সহজ। ‘স্বাধীনতা’র সময় মাতৃভূমি দু-টুকরো হয়ে যায় এবং ‘স্বাধীনতা’র ৩২ বছর পরেও দেখা যায় জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে অসংখ্য বিভেদ। সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি এযাবৎ আসামে অসমীয়া-বাঙালী বিভেদের উপর নির্ভর করেই টিকে থেকেছে। যেমন ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে তারা টিকে থেকেছে হিন্দু-মুসলমান বা জাতপাতগত প্রশ্নগুলির উপর নির্ভর করে।

আসাম থেকে বাঙালী ও নেপালীদের বিতাড়িত করে কি অসমীয়া জনগণের কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব? কখনোই নয়। একাজ কেবল জনগণের ঐক্য নষ্ট করবে, পারস্পরিক লড়াইয়ে জনগণেরই শক্তি ক্ষয় করবে এবং কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদীরা ও দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীলরাই এর থেকে ফয়দা তুলবে। এতে অসমীয়া জনগণের যতটা সমস্যার সমাধান হবে তার চেয়ে বেশি সমস্যা এর ফলে সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষের ভারতে আসা এবং ভারতের এক রাজ্যের মানুষের অন্য রাজ্যে যাওয়ার পিছনে নিজ নিজ ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণ আছে, যেমন কারণ রয়েছে লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীর পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যাওয়ার পেছনেও। আসামেই লক্ষ লক্ষ আদিবাসী শ্রমিক রয়েছেন যারা এসেছেন বিহার, উড়িষ্যা ও মধ্যপ্রদেশ থেকে। আপনারা তাদের সকলকে বিতাড়িত করতে পারেন না।

বেঁচে থাকার মতো জরুরি প্রশ্নের সম্মুখীন না হওয়া পর্যন্ত ব্যাপক মানুষ তাদের দেশ বা জন্মভূমি পরিত্যাগ করে না। জীবিকার সন্ধানেই তারা স্থানান্তরে যেতে বাধ্য হয়। আপনারা ইতিহাসকে অবহেলা করতে পারেন না, পারেন না সামাজিক কারণগুলিকে অস্বীকার করতে। পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনাই ঘটে থাকে যা কারুর পছন্দ বা অপছন্দের অপেক্ষা রাখে না। উগ্র স্থানীয় জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিকেরা হয় অজ্ঞ যারা ইতিহাস বা সামাজিক নিয়মগুলি সম্পর্কে কিছুই বোঝে না অথবা তারা ভণ্ড। তাদের অভিপ্রায় যাই হোক না কেন, জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে তারা অসমীয়া জনগণেরই স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং অসমীয়া জনগণের সামনে থেকে প্রকৃত শত্রুকে ও প্রকৃত সংগ্রামী কর্মসূচিকে আড়াল করছে।

আমাদের পার্টি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কঠোর পরিশ্রমী অসমীয়া জনগণ, তাদের অপূর্ব ভাষা আর সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ অসমীয়া সংস্কৃতি সম্পর্কে উঁচু ধারণা পোষণ করে। অসমীয়া জনগণকে হীন চোখে দেখে এমন সমস্ত উগ্র জাতীয়তাবাদের আমরা ঘোর বিরোধী এবং আমরা নয়া-গণতান্ত্রিক দিশায় অসমীয়া সাংস্কৃতিক বিকাশের পক্ষে। আমরা সরল, বুদ্ধিমান ও সাহসী অসমীয়া যুবকদের উপর দৃঢ় আস্থা রাখি ও আন্তরিকভাবে আশা করি যে, তারা গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করবেন, সমস্যাগুলি তলিয়ে দেখবেন, শত্রু ও মিত্রের মধ্যে পার্থক্য করতে শিখবেন এবং শাসকশ্রেণীর ফাঁদে পড়ার বিপদ থেকে মুক্ত হবেন।

অসমীয়া ছাত্র ও যুবকদের একাংশ ইতিমধ্যেই প্রকৃত প্রগতির পথ গ্রহণ করেছেন। শেষ পর্যন্ত বাকিরাও সেই পথই অনুসরণ করবেন। বর্তমান ঘটনাবলী খুবই বেদনাদায়ক, কিন্তু আশা রাখি, যে জাতির যুবকবৃন্দ দীর্ঘ অসন্তোষে ভুগছেন এবং মাথা তুলতে চাইছেন সেই জাতির কাছে এগুলি হবে শিক্ষাপর্বকালের একটি পদক্ষেপ।

২৫ নভেম্বর ১৯৭৯

কেন্দ্রীয় কমিটি
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)

(লিবারেশন, জুলাই ১৯৮৪ থেকে)

দেশবাসীগণ,

ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক স্বর্ণমন্দিরের ওপর জঘন্য আক্রমণ এবং শিখদের গণহত্যা যত না সমস্যার সমাধন করতে পেরেছে সৃষ্টি করেছে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি সমস্যা। আগে যেখানে শিখদের কেবল এক ক্ষুদ্র অংশই ‘খালিস্তানে’র দাবি করতেন, আজ সেখানে সমগ্র শিখ সম্প্রদায় এই দাবির পেছনে সামিল হয়েছেন। দেশের ভেতরে-বাইরে সর্বত্র শিখরা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাচ্ছেন, প্রতিটি ক্যান্টমেন্টে শিখ সৈন্যরা বিদ্রোহে জেগে উঠছেন এবং খোদ পাঞ্জাবে শিখ কৃষকরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। নিহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে আর প্রতিটি মৃত্যুর সাথে সাথে কঠোরতর হয়ে উঠছে তাঁদের মনোভাব।

যে শিখদের সর্বদাই ‘নতুন ভারতের স্থপতি’ হিসাবে, ‘জাতীয় সংহতির দৃঢ় সৈনিক’ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, তাঁরাই হঠাৎ আজ সরকারি প্রচারে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা পাচ্ছেন। কী করে এমনটা হল? এ সমস্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পেছনে প্রকৃত অপরাধী কে? প্রতিটি চিন্তাশীল এবং দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর মনেই আজ এই কয়েকটি প্রশ্ন তোলপাড় করছে।

প্রিয় দেশবাসী,

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস পার্টির ভুল নীতিগুলিই ১৯৪৭ সালে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে দু-টুকরো করেছিল। আর আজ শ্রীমতী গান্ধীর নীতিগুলি দেশকে নিয়ে যাচ্ছে আরও টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার দিকে। ৩৭ বছরের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা সত্ত্বেও এবং কেন্দ্রে একের পর এক ‘লৌহদৃঢ় ব্যক্তিত্বের’ অধীনে কার্যত একচেটিয়া কংগ্রেসী শাসন সত্ত্বেও; সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, জাতপাতের লড়াই, আঞ্চলিকতাবাদ, ধর্মীয় উন্মত্ততা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আমরা যারা এখানে বাস করি তাদের সকলেরই পবিত্র মাতৃভূমি ভারতবর্ষকে আজ পরিণত করা হয়েছে হিন্দু ভারতবর্ষে; বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, একচেটিয়া পুঁজিপতি, জমিদারদের নিজস্ব সেনাবাহিনী, লম্পট রাজনীতিবিদ আর সমাজের যত আবর্জনার মৃগয়াক্ষেত্রে এবং যে সমস্ত শ্রমিক, কৃষক ও যুবকরা তাঁদের অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রামের হিম্মত দেখান তাঁদের সকলের কবরখানায়; ধর্মীয় সংখ্যালঘু, পশ্চাদপদ জাতিসত্তা ও জাতীয় সংখ্যালঘুদের কারাগারে।

ইন্দিরা গান্ধীই তাঁর নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে আকালীদের সঙ্গে গুরুত্ব সহকারে কোনো অর্থবহ আলোচনায় বসতে অস্বীকার করেছিলেন, সচেতনভাবে পাঞ্জাব ও হরিয়ানার মধ্যে তথা পাঞ্জাবের অভ্যন্তরে হিন্দু ও শিখদের মধ্যে সংঘাতকে স্থায়ী রূপ দিয়েছিলেন। আকালী দলকে মোকাবিলা করার জন্য তিনিই প্রথমে ভিন্দ্রানওয়ালাকে  ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন ও শক্তিশালী গণআন্দোলনের উত্থান রোখার জন্য সন্ত্রাসবাদকে উস্কানি দিয়েছিলেন, আর শেষপর্যন্ত তিনিই ভিন্দ্রানওয়ালাকে এক শহীদে পরিণত করলেন।

ইন্দিরা গান্ধী যতদিন দেশের কর্ণধার থাকবেন, জাতীয় ঐক্যের ওপর থেকে সংকটের কালো মেঘ ততদিন দূর হবে না। সংসদীয় বিরোধীপক্ষও নিজেদের চরম অপদার্থতার ভুরিভুরি প্রমাণ দিয়েছে। তাদের কাজ হল ‘সাধারণ’ সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর নিন্দা করে চলা আর ‘সংকটের’ সময়ে দৃঢ়ভাবে তাঁর পাশে দাঁড়ানো। কোনো স্বাধীন বস্তুগত ফল দিতে পারে এমন কোনো নিজস্ব কার্যক্রম তাঁদের নেই।

সাম্প্রদায়িক সংহতি বজায় রাখা ও জাতীয় ঐক্য রক্ষা করার দায়িত্বভার আজ এসে পড়েছে বিপ্লবী কমিউনিস্ট, সমস্ত প্রগতিশীল জনগণ ও প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের কাঁধে। আর এই কর্তব্য অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে আছে এক নতুন ভারত, জনগণের ভারত, গণতান্ত্রিক ভারত গড়ার সংগ্রামের সাথে।

প্রিয় দেশবাসীগণ,

স্বর্ণমন্দিরের ওপর পাশবিক আক্রমণের নিন্দা করুন, বেদনাহত শিখ ভাইদের পাশে দাঁড়ান। দাবি তুলুন, পাঞ্জাব সমস্যার দ্রুত নিষ্পত্তি চাই। সরকার এবং বিরোধী দলগুলি যে ভূয়ো দেশপ্রেমের প্রচার চালাচ্ছে তাতে বিভ্রান্ত হবেন না, কারণ তা ‘খালিস্তানের’ জন্মকেই ত্বরান্বিত করবে মাত্র।

অতীতে আমরা কংগ্রেসী ও ‘কমিউনিস্ট’ নেতাদের ‘উদ্দীপনাময়’ কথাগুলিকে বিশ্বাস করেছিলাম, তাঁদের হাতেই সব উদ্যোগ সঁপে দিয়েছিলাম। পরিণতি দাঁড়িয়েছিল এই যে আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির দু-টুকরো হয়ে যাওয়া রুখতে পারিনি।

এ ভুলের পুনরাবৃত্তি আর করব না।

বন্দুক আর কামান দিয়ে ভারতবর্ষকে ঐক্যবদ্ধ রাখা যাবে না। ভারতবর্ষকে এক রাখতে পারে কেবল যৌথ সংগ্রামের ময়দানে সমস্ত সম্প্রদায়ের জনগণের ঐক্য ও সংহতি।

অভিনন্দন সহ, ১১ জুন, ১৯৮৫

(১৯৯২-এ অনুষ্ঠিত পঞ্চম পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

যে দেশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে এবং যাকে এখনও সাম্রাজ্যবাদের দিক থেকে নয়া-ঔপনিবেশিক হুমকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে সেই দেশের কমিউনিস্ট হিসাবে আমরা অবশ্যই জাতীয় ঐক্য চাই। জন্মলগ্ন থেকেই সিপিআই(এমএল) তার নীতিগত লক্ষ্য হিসাবে ভারতবর্ষকে ঐক্যবদ্ধ করার কথা বলে এসেছে। আমরা এমনকি আমাদের মহান দেশের বিভাজনের প্রতিকার করতে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে এক মহাজোটের স্বপ্নও দেখি। আমরা কখনই খালিস্তানের দাবিকে বা স্বাধীন আসামের দাবিকে সমর্থন করিনি।

শাসক কংগ্রেস হোক, বিজেপি হোক, সুবিধাবাদী বাম হোক বা বিপ্লবী কমিউনিস্ট হোক সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ধারার কাছে জাতীয় ঐক্য অবশ্যই এক উদ্বেগের বিষয়। প্রশ্ন হল বিভিন্ন অবস্থানের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্যরেখা কীভাবে টানা যায়।

আমাদের প্রায় সমস্ত ছোটো প্রতিবেশীই ভারতবর্ষকে এক আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি হিসাবে ও এক বিপদ হিসাবেই দেখে থাকে এবং এর কিছু ভিত্তিও আছে। সমস্ত সরকারি প্রচারমাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলিকে বিশেষ করে পাকিস্তানকে এইভাবে তুলে ধরে যে তারা সর্বদাই ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে চক্রান্ত চালাচ্ছে। সিপিআই ও সিপিআই(এম) একই ধারায় প্রচার চালায়। আমাদের এটি বুঝতে হবে যে প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে ভারতবর্ষকে এক বিপদ হিসাবে দেখার এই অনুভূতি বা প্রবণতা থাকলে কেবলমাত্র তার মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত কাজ করতে পারে।

সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস করার অর্থই হল কমিউনিস্টদের অবশ্যই নিজ দেশের বুর্জোয়াদের উগ্র জাতিদম্ভের বিরোধিতা করার সাহস রাখতে হবে। এই নীতিগত অবস্থান ছাড়া দেশের স্থায়িত্বের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী হুমকি সম্পর্কে উদ্বেগ অবশ্যম্ভাবীরূপ কমিউনিস্টদের বুর্জোয়া মতাদর্শ ও বুর্জোয়া স্বার্থের প্রভাবাধীনে নিয়ে যাবে।

আবার, বিশেষ ক্ষেত্রগুলিতে যেখানে বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনের পিছনে জনপ্রিয় সমর্থন রয়েছে ও এক সমগ্র ইতিহাস রয়েছে সেখানে বিচক্ষণ পরিচালনা ও বিশেষ সমাধান দরকার।

উপর থেকে জাতীয় ঐক্য রক্ষা করার অজুহাতে ভারতীয় রাষ্ট্র কেবলমাত্র তার প্রতিক্রিয়াশীল হাতিয়ারগুলিই শাণিয়ে চলেছে – একের পর এক দানবীয় আইন চালু করা হচ্ছে এবং মিথ্যা সংঘর্ষ ও গণহত্যা ক্রমেই আইনসম্মত হয়ে উঠছে। উপর থেকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার এই বিসমার্কীয় কায়দার আমরা দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করি। আমরা নীচ থেকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পক্ষে যেখানে সমস্ত জাতিসত্তার জন্য ও জাতীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সম্ভাব্য সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা থাকবে। গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে ভারতবর্ষের জাতীয় ঐক্যসাধন আমাদের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এক অন্যতম দায়িত্ব।

(ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

আমাদের দেশে মুসলিম প্রশ্ন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁরা যে ধর্মীয় নিপীড়নের মুখোমুখি হন তা এক বিশেষ ধরনের সংখ্যালঘুগত পরিবেশের জন্ম দেয়, আর হিন্দুত্বের শক্তিগুলির উত্থান এটিকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এই পরিবেশ ঐ সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়াকে এক নির্দিষ্ট রূপ দেয় – তাঁরা নিজেদের সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতি বলে ভাবতে শুরু করেন। কেবল সাম্প্রদায়িকতার একক সীমাতেই তাঁদের প্রতিক্রিয়া নির্ধারিত হয়ে যায় এবং তাঁরা গণতান্ত্রিক সংস্কার, দুর্নীতির বিরোধিতা, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের বিরোধিতা ইত্যাদি ইস্যুতে আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন। এর ফলে নেতৃত্ব মৌলবাদী শক্তি ও ‘গুণ্ডাদের’ কব্জায় চলে যায়।

মুসলিম জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আন্তঃক্রিয়ার বিকাশ ঘটানো এবং তাদের সুনির্দিষ্ট সমস্যাগুলিকে উপলব্ধি করার বিষয়টি আমাদের এক বড় দুর্বলতা হিসাবে থেকেছে। বিহারে আমরা যে ইনকিলাবী মুসলিম কনফারেন্স গড়ে তুলেছি তা আমাদের মুসলিম জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের বিকাশ ঘটানো, তাদের সমস্যা উপলব্ধি করা এবং আমাদের সাড়াকে সূত্রবদ্ধ করার ব্যাপারে পার্টিকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। এটা ঠিক যে সংগঠনটি নিজে খুব একটা অগ্রসর হতে পারেনি এবং মহিলা প্রশ্ন, দলিত মুসলিমদের জন্য সংরক্ষণের প্রশ্ন ইত্যাদি নিয়ে সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিতর্কে হস্তক্ষেপ করতে প্রায়শই ব্যর্থ হয়েছে। তবু মুসলিম জনগণের মধ্যে পার্টির কাজে গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলতে এর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। উর্দুতে প্রচার, মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আন্তঃক্রিয়া এবং পার্টি নেতৃত্বের দ্বারা বিশেষ সম্মেলন বা জনসভায় ভাষণ দেওয়া এ সবকিছুই উৎসাহিত হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এগুলি এখনও যথেষ্ট অপ্রতুল।

আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে বিহারে অনেক জায়গাতেই সিপিআই(এমএল) মুসলিম জনগণের মধ্যে ভালো সাড়া পাচ্ছে এবং ‘লালুর পরে কে’, এই প্রশ্নের উত্তরে প্রায়শই সিপিআই(এমএল)-এর নাম উল্লেখ হচ্ছে। লক্ষ্ণৌ থেকে পরিচালিত সারা ভারত মুসলিম ফোরাম এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লীগের বিহার শাখার সঙ্গে আমরা ঘনিষ্ঠ মৈত্রী সম্পর্কের বিকাশ ঘটিয়েছি। জেএনইউ এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে এআইএসএ যে সাড়া পেয়েছে এবং শহীদ চন্দ্রশেখরের পক্ষে ও তার হত্যাকারী সাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে তাঁরা যেরকম দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছেন, তা যথেষ্ট উৎসাহব্যাঞ্জক। এটা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, মুসলিম ছাত্র ও যুবকরা মুসলিম রাজনীতির পুরোনো ধারাকে ভেঙ্গে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত এবং তাঁরা বাম শক্তিগুলির নিকটতর হচ্ছেন।

লালু-মুলায়ম আর মুসলিম সমাজের প্রশ্নাতীত নায়ক নন। ঐ সমাজ পরিবর্তনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে এবং তরুণ ছাত্ররা সেই প্রেরণার প্রতিনিধি। তাঁদের আরও বেশি করে পার্টির ধারায় নিয়ে আসা এক জরুরি কর্তব্য।

(১০ আগস্ট ১৯৯৭, সারা ভারত মুসলিম ফোরাম কর্তৃক, লক্ষ্ণৌতে আয়োজিত ‘ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর এবং মুসলিম জনগণ’ শীর্ষক কনভেনশনে প্রদত্ত ভাষণ। লিবারেশন, সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ থেকে)

আমার ভাই ও বোনেরা,

খুব জাঁকজমক করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বছর পালন করা হচ্ছে। কিন্তু জনগণের কথা বিচার করলে প্রকৃত অবস্থা কী? স্বাধীনতার সময়কালে মোট যে জনসংখ্যা ছিল আজ তার সমান সংখ্যক জনগণ দারিদ্রসীমার নীচে জীবনযাপন করছেন। বিশেষ করে মুসলিমদের মধ্যেকার ৫০-৬০ শতাংশ জনগণ চরম দারিদ্রের মধ্যে বসবাস করছেন। প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয়দের মধ্যে ৫০ শতাংশের ওপর নিরক্ষর এবং মুসলিমদের মধ্যে এই হার আরও অনেক বেশি।

সুতরাং মুসলিমদের মধ্যেকার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যাঁরা ভারতীয় জনসংখ্যার ১২ শতাংশেরও বেশি, তাঁরা চরম কষ্ট ও বঞ্চনার মধ্যে জীবনধারণ করছেন এবং পঞ্চাশ বছরের স্বাধীনতা তাঁদের জীবনে বিশেষ কোনো উন্নতি ঘটায়নি।

পূর্বতন ভারতবর্ষের অংশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আজ স্বাধীন রাষ্ট্র এবং সেখানকার মুসলিমরা ধর্মের দিক থেকে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু ভারতবর্ষে তাদের সংখ্যা উভয় দেশেরই মুসলিমদের থেকে বেশি হওয়া সত্ত্বেও এখানে তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু। ভারতবর্ষে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হিন্দু এবং এখানে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে গভীর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ বিরাজ করছে।

ভারতীয় রাষ্ট্র হল এক সাংবিধানিক রাষ্ট্র; অর্থাৎ এখানে সরকারিভাবে রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই এবং সমস্ত ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা প্রদানের ঘোষিত দাবির মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার কথা প্রচার করে। কিন্তু সাংবিধানিক ঘোষণার চাইতেও যাঁরা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন তাঁদের প্রকৃতির দ্বারাই রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। যেহেতু সমাজে আধিপত্যকারী ধর্ম হিন্দু, বাস্তব জীবনে এই ধর্ম তাই অন্যান্য ধর্মের তুলনায় বেশি ‘সমানাধিকার’ ভোগ করে। যে সমস্ত লোকেরা রাষ্ট্রের অর্থাৎ তার প্রশাসনিক আইনসভা বা বিচার বিভাগ যে শাখাতেই হোক না কেন সমস্ত শাখাগুলির মধ্যেই বসে আছেন তারা সাধারণভাবে হিন্দু ধর্মের প্রতি পক্ষপাতপূর্ণ।

রাষ্ট্রের ভূমিকা হল দুমুখো। একদিকে সংখ্যালঘুদের নামে তারা মুসলিমদের কোনো না কোনো ধরনের বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে আবার একইসাথে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের (মুসলিমদের) চাপের মধ্যে রাখছে। রাষ্ট্র সম্পর্কে মুসলিম জনগণ বহন করছে এক বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি, প্রকৃত জাতীয়তার বিপরীতে তাদের এক কাল্পনিক জাতীয়তাকে দাঁড় করানোর মনোভাব।

সুতরাং এক সাংবিধানিক রাষ্ট্রেও মুসলিম রাজনৈতিক মুক্তি আজও অসম্পূর্ণ। আমরা দেখেছি আগ্রাসী হিন্দুত্বের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে মুসলিমরা যাদের ওপর সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখত সেই কংগ্রেস কীভাবে নপুংসকে পরিণত হল। এই সেদিন কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সর্বভারতীয় অধিবেশনে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করার প্রতিশ্রুতি থেকে তারা পিছু হটলেন এবং নিছক দুঃখপ্রকাশ করার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেন। এতে তারা বিশেষ কী আর করলেন? ১৯৯২ সালে যখন মসজিদ ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল সম্ভবত তখনও তারা দুঃখপ্রকাশই করেছিলেন।

যুক্তমোর্চার সরকার, যারা বাবরি মসজিদ ইস্যুকে পুঁজি করার সুযোগ হাতছাড়া করেননি এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে খুঁটি করে ক্ষমতায় এলেন, তারাও এই বিষয়ে এখনও পর্যন্ত বিশিষ্টভাবে কোনো কিছু  করলেন না এবং বিষয়টিকে ১৩৮(২) ধারায় সুপ্রীম কোর্টে পাঠানোর জন্য ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচিতে তাদের যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা আজও পালিত হয়নি। আমি যা বলতে চাই তা হল এই যে, আধিপত্যকারী হিন্দু ধর্মের চাপ এতখানি যে এমনকি সাংবিধানিক রাষ্ট্র ও ধর্মনিরপেক্ষ পার্টিগুলিও নপুংসকে পরিণত হচ্ছে।

বিজেপির মতো পার্টি, যারা প্রকাশ্যে হিন্দু রাষ্ট্র অর্থাৎ এমন এক রাষ্ট্র যেখানে হিন্দুত্ব হবে রাষ্ট্রের ধর্ম বলে প্রচার করে, তারা যখন ক্ষমতায় আসে তখন ধর্মনিরপেক্ষতার পরিণতি কী দাঁড়াবে তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। মুসলিম পরিচিতি বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে।

এখন এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার দুটি পথ আছে। একটি হচ্ছে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া এবং কোনো এক ধরনের মুসলিম মৌলবাদের আশ্রয় নিয়ে হিন্দু মৌলবাদের বিরোধিতা করা। আমার মতে এই পথ বিপরীত ফলই দেবে। অপর পথ হল প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির সাথে হাত মেলানো এবং ভারতবর্ষে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে তুলতে সংগ্রাম করা।

একজনের পরিচিতির মধ্যকার দ্বৈতসত্তাজনিত সমস্যা অর্থাৎ সে একজন মুসলিম আবার একজন নাগরিক অথবা সে একজন হিন্দু আবার একজন নাগরিক, কেবলমাত্র তখনই সমাধান হতে পারে যখন রাজনৈতিক রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের মধ্যকার ধর্মনিরপেক্ষ বিভাজন সম্ভব হবে। ভারতবর্ষের এই প্রক্রিয়া অসমাপ্ত রয়েছে।

হিন্দুত্ব যে সংকট চাপিয়ে দিয়েছে তাতে মুসলিম জনগণের কাছে নিজেদের পরিচিতিকে নতুন করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক সুযোগও হাজির হয়েছে। সেই পরিচিতি কী হওয়া উচিত? আমরা কমিউনিস্টরা মুসলিম জনগণের আকাঙ্খার বিপরীতে রাষ্ট্রের দ্বারা ওপর থেকে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার সম্পূর্ণ বিরোধী। আমার মনে হয় আধুনিক পটভূমিতে নিজেদের পরিচিতিকে নতুন করে তুলে ধরার বিষয় নিয়ে মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেক আলোচনা চলছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হয় মুসলিম সমাজে মহিলাদের মর্যাদার প্রশ্ন, বহুবিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ থেকে উদ্ভূত সমাস্যাবলী খুবই গুরুত্ব বহন করে। তুরস্ক ও টিউনিসিয়ার মতো মুসলিম রাষ্ট্রে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এমনকি পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও বহু ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ হয়েছে। সুতরাং আমি মনে করি এই সমস্ত বিষয়গুলি নিয়ে মুসলিম জনগণের মধ্যকার আলোকপ্রাপ্ত অংশের গুরুত্বের সাথে ভাবনাচিন্তা করা দরকার।

এখন মুসলিম হিসাবে ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণের দাবি এসেছে। কিন্তু একই সাথে মুসলিম জনগণের মধ্য থেকে মণ্ডল কমিশনে তালিকাভুক্ত পশ্চাদপদ মুসলিমদের জন্য কার্যকরী সংরক্ষণের দাবিও উঠে আসছে। এমনকি দলিত মুসলিমদের জন্য সংরক্ষণের দাবিও জারালো হয়ে উঠছে। সুতরাং এই প্রশ্নও গুরুত্বের সাথে মনোযোগ দেওয়ার দাবি জানায়।

হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে রোখার প্রচেষ্টায় আপনারা কংগ্রেসের পাশে এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন মধ্যপন্থী পার্টিগুলির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু স্বল্পমেয়াদে লাভের লক্ষ্যে নেওয়া এই স্ট্র্যাটেজি সমস্যাটিকে কেবল জটিল করে তুলেছে।

মুসলিম যুবকদের নতুন প্রজন্ম নিজেদেরকে বামপন্থী শক্তিগুলির পাশে দাঁড় করাচ্ছেন কেননা তাঁরা বুঝছেন যে কেবলমাত্র বামপন্থীরাই হল দৃঢ় ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাপক গণতন্ত্রের রূপান্তরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত।

আমি মনে করি, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গড়ার সংগ্রাম যত এগোবে; ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে গণতান্ত্রিক কনফেডারেশন গড়ার পরিস্থিতি তত পেকে উঠবে। আর এইভাবেই আমরা ১৯৪৭ সালের ঐতিহাসিক ভুলকে সংশোধন করতে পারব।

ধন্যবাদ।

(ইনকিলাবী মুসলিম কনফারেন্স আয়োজিত “ভারতীয় মুসলিমরা কোন পথে” শীর্ষক জাতীয় কনভেনশনে উদ্বোধনী ভাষণ। লিবারেশন, ডিসেম্বর ১৯৯৩ থেকে)

সভাপতিমণ্ডলী ও বন্ধুগণ,

ইতিহাসে অহরহ ছোটো বড় অনেক ঘটনা ঘটে চলে। কিন্তু সমাজের ওপর কিছু কিছু ঘটনার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব থাকে, কেননা এগুলি বহু সক্রিয় প্রক্রিয়াকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করে। প্রায় একবছর আগে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়া ছিল এমনই এক ঘটনা। এটা বলা হয় যে, মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে বিজেপি বিচার ব্যবস্থা, সংসদ, প্রশাসন – এক কথায় রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলিকেই অগ্রাহ্য করেছে। হ্যাঁ, এটি সত্য কথা। কিন্তু যে সত্য আরও বেশি জাজ্জ্বল্যমান ও আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হল আগ্রাসী হিন্দুত্বের সামনে রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠাগুলির মিলিত শক্তি পঙ্গু হয়ে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী যে নিষ্ক্রিয়তা ও দ্বিধা দেখিয়েছেন তা – প্রায়শই যেমন বোঝানো হয়ে থাকে – নিছক একজন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য ছিল না, বরং তা ছিল রাষ্ট্রের পঙ্গুত্বেরই এক প্রতীক, এক প্রতিচ্ছবি।

দেশ বিভাগের নির্মম ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ভারতীয় মুসলিমরা ভারতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছিলেন। পরপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, এমনকি বড় আকারের দাঙ্গা সত্ত্বেও তাঁরা ভারতীয় রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ওপর আস্থা রাখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনা তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূলকে কাঁপিয়ে দিয়েছে, তাদের সামনে উঠে এসেছে লাখ টাকার প্রশ্ন – ভারতীয় রাষ্ট্র প্রকৃতই কতটুকু ধর্মনিরপেক্ষ? এর সাথে সাথে যে সমস্ত প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেছে বলে এতদিন মনে করা হত, সেই সমস্ত প্রশ্নও আবার মুসলিম মনে উঠতে শুরু করেছে।

এটি মাথায় রাখতে হবে যে জিন্নার মুসলিম জাতীয়তাবাদ সাভারকার বা গোলওয়ালকরের হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে গড়ে ওঠেনি, কেননা সেই সময়কালে এই ধরনের হিন্দু জাতীয়তাবাদের শক্তি খুবই দুর্বল ছিল। বরং তা গড়ে ওঠে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে গান্ধীবাদী বীক্ষার বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া হিসাবেই। গান্ধীর যুগের উদার হিন্দুত্ব ক্রমে ক্রমে নিজেকে উগ্র হিন্দু ধারায় রূপান্তরিত করে। বস্তুতপক্ষে নেহরুর মহিমময় ব্যক্তিত্ব ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্ট্যময় উদারনীতিবাদী হিন্দু ভাবধারাকে আড়াল করে রাখে এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কল্পকথাকে স্থায়ী করে। পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধীর পৃষ্ঠপোষকতায় উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের মধ্যকার সীমারেখা প্রকৃত অর্থে খুবই সূক্ষ্ম। মূলত এর উপর ভর করে পরবর্তীকালে খোলাখুলিভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ওকালতির পথ প্রশস্ত হয়। এই উর্বর জমিতে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত অতএব এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার যৌক্তিক পরিণতি।

কংগ্রেস সরকার রামজন্মভূমির তালা খুলে দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার দৈত্যকে বোতল থেকে ছেড়ে দেয়, আর এখন হাজার চেষ্টা করেও সেই দৈত্যকে আর বোতলবন্দী করা যাচ্ছে না। ভারতের নিয়তি আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যেখানে একটি রাস্তা সোজা গেছে ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে এবং অপরটি, আঁকাবাঁকা হলেও, এক আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দিকে। আমাদের অবশ্যই এক আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দিকে এগোতে হবে এবং আমি মনে করি এই সংগ্রামে ভারতীয় মুসলিমদের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা অবশ্যই প্রয়োজনীয়।

এই প্রসঙ্গে আমি একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। জিন্নার জাতীয়তাবাদ পাকিস্তানে মুসিলম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, এবং তার ফলশ্রুতিতে ভারতীয় রাষ্ট্রও গুরুতর বিকৃতিকে এড়িয়ে যেতে পারেনি এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী এটি কখনও উদার আবার কখনও উগ্র হিন্দুত্বের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। হিন্দুত্বের সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি যে নিজেদের হাতিয়ারগুলি নামিয়ে রাখল, তার মূল কারণ রয়েছে এখানে। সুতরাং আজকের সংগ্রাম হল ভারতবর্ষে এক প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, এক প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে তোলার সংগ্রাম। এই কারণে ভারতীয় রাষ্ট্রের বিকৃতিকে দূর করা দরকার, যে বিকৃতি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পাক-বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠার কারণে উদ্ভূত হয়েছে। এই কারণে আমাদের পার্টি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সমতার ভিত্তিতে এক কনফেডারেশন গড়ে তোলার কথা বলে। এইভাবে এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে তোলার সংগ্রাম এই কনফেডারেশন গড়ে তোলার সংগ্রামও বটে। কেননা সম্ভবত একমাত্র এই কনফেডারেশনই ভারতীয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিকৃতির সঞ্চারকে রুখে দিতে পারে। সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখলে এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলার সংগ্রামে এটি এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

নীচু স্তরে, মুসলিমদের স্বকীয় পরিচিতি বজায় রাখার প্রশ্নটি ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিজেপির হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা মুসলিমদের স্বকীয় পরিচিতিকে বশীভূত করার দাবি জানায় এবং হিন্দুদের মধ্যকার একটি সম্প্রদায় হিসাবে মুসলিমদের রূপান্তরিত করতে চায়। নিজেদের স্বকীয় পরিচিতি বজায় রাখার জন্য এক সম্প্রদায় হিসাবে মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া জানানো তাই এক স্বাভাবিক ব্যাপার। অভিজ্ঞতা তাদের শিখিয়েছে যে একমাত্র বামপন্থীরাই দৃঢ়তা ও সততার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বিপ্লবী বামপন্থীরাই হিন্দুত্বের বাহিনীর সামনে জোরালো প্রতিবাদ খাড়া করেছে। তাই ভারতীয় মুসলিম ও বামপন্থীদের ঐক্যকে শক্তিশালী করা ও এই বিকাশমান সম্পর্ককে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া প্রয়োজন। বামপন্থীদের সম্পর্কে আপনাদের কিছু আশঙ্কা আছে। এই প্রশ্নে মুসলিমদের সম্পর্কে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে আমি কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করব।

যখন আপনারা আপনাদের স্বকীয় পরিচিতির প্রতীক হিসাবে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখেন এবং এর সংখ্যালঘু মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার জন্য সমস্ত ধরনের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেন, যখন আপনারা ভারতবর্ষে উর্দু ভাষার উপযুক্ত মর্যাদা দাবি করেন, যখন আপনারা মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের উপর বাইরের কোনো হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানান, আমাদের পার্টি তখন আপনাদের অনুভূতিকে মর্যাদা দেয় এবং দাবিগুলিকে সমর্থন করে। তথাপি আমি বলব মুসলিম যুবকদের এক বড় অংশ আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও হিন্দু ছাত্রদের সঙ্গে এক সাথে শিক্ষা লাভ করছেন। বহু মুসলিম ছাত্র হিন্দী ও ইংরাজি ভাষা শিখছেন। বহু মুসলিম যুবক হিন্দী পত্রিকার সাংবাদিক হিসাবে কাজ করছেন। অনেক প্রকাশনা সংস্থা যারা আগে কেবলমাত্র উর্দু পত্রিকা প্রকাশ করত, এখন হিন্দী বা ইংরাজি সংস্করণও প্রকাশ করছে। সমাজের মূল ধারার সঙ্গে মুসলিম যুবকদের এই মেলামেশার বিরোধিতা করেন, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের ব্যাপারে আমার যতটুকু জানা আছে মুসলিম সমাজের ভেতরেই এ সম্পর্কে, বিশেষ করে মহিলাদের অধিকারের প্রশ্নে বিতর্ক আছে। আমি আশা করি সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এক প্রগতিশীল অভিমুখে এই বিতর্কের মীমাংসা হবে। আমাদের সমাজে এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য যে, যেখানে উগ্র হিন্দুত্ব মাথাচাড়া দেওয়ার ফলে মহিলাদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটছে – বধূ হত্যার ঘটনা বেড়ে চলেছে, সতীপ্রথাকে আবার চালু করার চেষ্টা চলছে, সেখানে মুসলিম সমাজে মহিলাদের অধিকার বাড়ানোর প্রশ্নে গভীরভাবে আলোচনা চলছে।

যাকে প্রধান ধারার মুসলিম দেশ হিসাবে ধরা হয় না সেই ইন্দোনেশিয়াকে বাদ দিলে বিশ্বে মুসলিম জনসংখ্যা ভারতেই সবচেয়ে বেশি। যে ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে আপনারা বসবাস করেছেন এবং যে সামাজিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আপনারা আজ চলেছেন, তাতে ভারতীয় মুসলিমদের পক্ষে বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল ও গতিময় মুসলিম হিসাবে এগিয়ে আসা সম্পূর্ণরূপে সম্ভব।

যদিও দেশের জনসংখ্যায় মুসলিমরা হলেন ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, তথাপি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারত যেভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যেভাবে তার সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তাতে আপনাদের অবদান অর্ধেক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আগামীদিনের আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গড়ে তোলার কাজে আপনারা অর্ধেক দায়িত্বও কাঁধে নেবেন।

(ষষ্ঠ কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

বিশেষ করে বিএসপি-র চকমপ্রদ উত্থানের সাথে সাথে দলিত প্রশ্ন অন্যতম একটি প্রধান প্রশ্ন হিসাবে দেখা দিয়েছে। পাঞ্জাবে এক ভালো সূচনা ঘটানোর পরে বিএসপি উত্তরপ্রদেশে অনেকখানি বৃদ্ধি ঘটায় এবং মধ্যপ্রদেশে ও অন্যান্য কিছু রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। এক সময়ে মনে হয়েছিল যে সে অন্ধ্রকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এবং সেখানে সে বিভিন্ন নকশালপন্থী গোষ্ঠীর দিক থেকে সহানুভূতিপূর্ণ সাড়াও পেয়েছিল। ৠাডিক্যালরা তাদের প্রভাবাধীন এলাকায় নির্বাচনী প্রচার চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা থেকে বিএসপি-কে ছাড় দিয়েছিল। একটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী গোষ্ঠী তো নির্বাচনে বিএসপি-কে খোলাখুলি সমর্থন করার কথা ঘোষণা করে দিয়েছিল। কিছু কিছু প্রাক্তন পিডব্ল্যুজি নেতা এমনকি বিএসপি-তে যোগ পর্যন্ত দিয়েছিলেন এবং একজন নামকরা তাত্ত্বিক কাঁসিরামকে ভারতের পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও চিন্তাধারাকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার কৃতিত্ব পর্যন্ত দিয়ে ফেলেছিলেন। এভাবে দলিত ধ্যানধারণা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল এবং ঐ আন্দোলনের শ্রেণী মানদণ্ডকে পাল্টে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।

আমাদের পার্টি দৃঢ়ভাবে এইসব বিচ্যুতিগুলির বিরোধিতা করে এই মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ ঊর্ধ্বে তুলে ধরে যে, জাতপাতগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে ও দলিতদের সামাজিক সমতার জন্য লড়াই চালাতে গিয়ে শ্রেণীসংগ্রামের সীমানাকে সম্প্রসারিত করাই মার্কসবাদীদের কাছে একমাত্র প্রস্থানবিন্দু হতে পারে। কাঁসিরামরা এইসব ইস্যুগুলিকে ধরেন শ্রেণীসংগ্রামকে নাকচ করার অবস্থান থেকে এবং চূড়ান্ত বিচারে তারা শেষপর্যন্ত শ্রেণী-শান্তির কথা প্রচার করেন ও শাসক অভিজাতশ্রেণীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠেন। বিহারের যেসব অঞ্চলে সামাজিক মর্যাদা ও সমতার দাবিতে দলিত আন্দোলন গ্রামীণ গরিবদের শ্রেণীসংগ্রামের অঙ্গ হয়ে উঠেছে সেখানে বিএসপি-র লোকজন তাদের আসল স্বরূপ উদ্ঘাটিত করেছেন। রণবীর সেনার সাথে তাদের ওঠাবসা করতে দেখা গেছে এবং পরবর্তীকালে বিএসপি নিজেই উত্তরপ্রদেশে সামন্ততান্ত্রিক-ব্রাহ্মণ্যবাদী পার্টি বিজেপির সাথে হাত মিলিয়েছে। বিহারে আমরা আমাদের সংগ্রামের এলাকাগুলিতে সফলভাবে বিএসপি-র অনুপ্রবেশ ঠেকিয়েছি এবং উত্তরপ্রদেশে সিপিআই-এর যেসব পুরোনো ভিত্তিগুলি বিএসপি ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেগুলিকে আবার বামপন্থার পক্ষে ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ আমরা নিয়েছি।

কংগ্রেস ও বিজেপির সাথে বিএসপি-র দহরম মহরম এবং তার লাগাতার বাম বিরোধী মনোভাব দলিত বুদ্ধিজীবী সহ প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যে তার সম্পর্কে মোহ দূর করতে সহায়তা করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উত্তরপ্রদেশের দলিত কৃষকশ্রেণী ও দলিত পেটিবুর্জোয়া অংশের মধ্যে বিএসপি যথেষ্ট সমর্থন ভোগ করে। মায়াবতীর কিছুদিন ক্ষমতায় থাকা এবং আম্বেদকর গ্রামীণ প্রকল্প, দলিত মুক্তির প্রবক্তাদের মূর্তি স্থাপন, জেলাগুলির নতুন নামকরণ ইত্যাদির মতো তাঁর প্রতীকী কাজগুলি তাঁকে অনেক সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে গেছে। পাঞ্জাবে বিএসপি কুলাকদের পার্টি আকালিদের সঙ্গে পুরোপুরি এক সুবিধাবাদী জোট গড়ে তুলেছে এবং লোকসভা নির্বাচনে ভালো ফসল তুলেছে। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে যখন সে একাই লড়ে তখন তাকে শূন্য হাতে ফিরতে হয়।

উত্তরপ্রদেশেও তার বিধায়ক বাহিনীকে একত্রিত রাখতে সে সমস্যায় পড়েছে। তাদের অনেককেই অন্যান্য পার্টি থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং মজার ব্যাপার, তাদের অনেকেই উঁচু জাতের লোক। নিছক বিএসপি-র দলিত ভোটব্যাঙ্কের ফায়দা তুলতেই তারা এসেছিল এবং কাঁসিরাম যথেচ্ছভাবে তা নিয়ে সওদা করেছেন। এই জন্যই মায়াবতীর হাত থেকে মুখ্যমন্ত্রীর লাগাম কল্যাণ সিং-এর হাতে চলে যাওয়ার সময়ে বিএসপি স্পীকারের পদে নিজের লোক বসানোর জন্য এত পীড়াপীড়ি করেছিল, যদিও শেষপর্যন্ত তাকে পিছিয়ে আসতে হয়। দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্ব ভারতে তার উত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

তৃণমূল স্তরে বিএসপি দলিত জাতগুলির মধ্যে মর্যাদা, সমতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশীদারিত্বের এক আকাঙ্খা গড়ে তুলেছে। কিন্তু সর্বোচ্চ স্তরে সে জন্ম দিয়েছে এক দলিত অভিজাতশ্রেণীর। এরা কদর্যভাবে বৈভব প্রদর্শন করে, অবক্ষয়ী বু্র্জোয়া জীবনযাপন করে। বিএসপি মূলগতভাবে উপরোক্ত দলিত অভিজাত ও পেটিবুর্জোয়াদের শ্রেণীস্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে এবং এই দলের চূড়ান্ত ভবিতব্য হচ্ছে বিজেপি বা কংগ্রেস(ই)-র মধ্যে মিশে যাওয়া। কিন্তু ব্যাপক দলিত জনগণের মধ্যে মজুরি, জমি, সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক মুক্তির দাবিতে যে সচেতনতার বৃদ্ধি ঘটেছে, তাকে লাল পতাকার নীচে নিশ্চিতভাবেই সমাবেশিত করা সম্ভব।

মহারাষ্ট্রে দলিত আন্দোলন এক পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আম্বেদকরের মূর্তির অবমাননার পর সেখানে যে দলিত জনরোষ দেখা গেছে তার হাত থেকে এমনকি অধঃপতিত পুরোনো দলিত নেতারাও রেহাই পায়নি। সাম্প্রতিককালে আম্বেদকরকে হেয় প্রতিপন্ন করা ও তাঁকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী বলে তুলে ধরার এক পরিকল্পিত প্রচেষ্টা চলছে। খুব সম্প্রতি মুলায়ম সিং-এর সমাজবাদী পার্টিও আম্বেদকরকে আক্রমণ করতে শুরু করেছে। বিজেপি তার সাম্প্রদায়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য আম্বেদকরকে ব্যবহার করতে চাইছে। আমাদের অবশ্যই এইসব প্রচেষ্টার বিরোধিতা করতে হবে। সামাজিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে গান্ধী ও এমনকি নেহরুর চাইতেও আম্বেদকর অনেক বেশি বিপ্লবী ছিলেন। রাজনৈতিক দিক থেকেও ভারতে জাতিগঠনের জটিলতা সম্পর্কে তিনি বেশি সচেতন ছিলেন। তিনি অন্যান্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে একজন জাতীয় নেতা হিসাবে নিজেকে তুলে ধরার ভণিতা কখনও দেখাননি এবং দলিত মুক্তির প্রশ্নকে স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অঙ্গাঙ্গী বিষয় করে তোলার জন্য জোরালো সওয়াল করেছিলেন। আর এটি এমন এক প্রশ্ন যা নিয়ে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও ভারতকে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে দলিত প্রশ্নকে নিছক দলিত বনাম ব্রাহ্মণ্যবাদী উঁচু জাতগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ এক বিষয় হিসাবে দেখলে চলবে না। উপরের স্তরে উঠে আসা মধ্যবর্তী জাতগুলির মধ্যেকার বর্ধিষ্ণু কুলাকরাও কৃষিশ্রমিক ও গরিব কৃষকদের মজুরি ও জমির দাবিকে নাকচ করার জন্য দলিতদের ওপর আক্রমণ চালায়।

এই বিষয়টির স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায় তামিলনাড়ুর দক্ষিণের জেলাগুলিতে দলিত ও থেবরদের (পশ্চাদপদ জাত) মধ্যেকার ব্যাপক সংঘর্ষ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের খোলাখুলি থেবরদের পক্ষ নেওয়ার মধ্যে। উত্তরপ্রদেশ ও বিহারেও এই ঘটনা প্রকট হয়ে উঠেছে। দলিতদের ওপর দমনপীড়ন প্রতিরোধকারী কেন্দ্রীয় আইন বাতিল করার জন্য মুলায়মের দাবিও একই অবস্থান থেকে উঠে আসছে।

বিএসপি-র বিপরীতে দলিত প্রশ্নে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করার জন্য আমরা উত্তরপ্রদেশে দলিত মহাসভা সংগঠিত করতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এটি ঠিকমতো শুরুই করা যায়নি এবং পরবর্তীকালে আমরা এই প্রকল্প পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিই। সঠিক কর্মনীতি হওয়া উচিত বিপ্লবী দলিত সংগঠনগুলির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও দলিত সাহিত্যের প্রবক্তাদের মতো প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী মহলের সাথে আন্তঃক্রিয়া ঘটানো। তামিলনাড়ুতে সম্প্রতি তিরুনেলভেলীতে আমরা দলিতদের ওপর দমনপীড়ন নিয়ে একটি কনভেনশন করেছি এবং জঙ্গী দলিত সংগঠনগুলির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। কিন্তু আমাদের সংগঠনের ভিতর দলিতবাদী ভাবধারার অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে আমাদের অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে।

(শ্রী টমাস ম্যাথুর প্রত্যুত্তরের জবাব, লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯৫ থেকে)

শ্রী টমাস ম্যাথুর জাত ও শ্রেণীর গতিসূত্র – র্র্যাডিক্যাল আম্বেদকরপন্থী তত্ত্বানুশীলন বইটি ধরে শ্রেণী ও জাতের বৈপরীত্য সম্পর্কে আমার বিতর্কমূলক প্রবন্ধের (লিবারেশন, বিশেষ সংখ্যা, এপ্রিল ১৯৯৪) যে প্রত্যুত্তর শ্রী ম্যাথু দিয়েছেন (লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯৪), তাতে খুব কম করে বললে, ঐ বইতে প্রতিফলিত অদ্ভুত ধারণাগুলিই আরও প্রকট হয়ে উঠেছে মাত্র। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় আসা যাক।

সংশ্লেষণ প্রসঙ্গে আরেকবার

১। শ্রী ম্যাথুর মতে তিনি মার্কসবাদ ও আম্বেদকরবাদের যে সংশ্লেষণের প্রস্তাব রেখেছেন, তা মর্মবস্তুতে মাওবাদী ভাববাদ ও বৌদ্ধ দ্বন্দ্ববাদের সমন্বয়। তাছাড়া, আগে তিনি এই সমন্বয়কে লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীর একমাত্র আশা হিসাবে তুলে ধরেছিলেন, আর এখন তিনি মনে করেন তা সমগ্র মানবজাতির একমাত্র ভরসা। নিঃসন্দেহে বিরাট অগ্রগতি।

‘মাওবাদী ভাববাদ’ কথাটি ব্যবহারের জন্য শ্রী ম্যাথু আমার সমালোচনা করতেই পারেন, তিনি তো এই ভাষা আদৌ ব্যবহার করেননি। অপরাধ স্বীকার করেও আমি আবার বলব যে মাও চিন্তাধারার যে ব্যাখ্যা তিনি রেখেছেন, তা থেকে অন্য কোনো সূত্রায়নে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। আমরা জানি মৌলিক মার্কসবাদী নীতিসমূহকে নাকচ করার ক্ষেত্রে শ্রী ম্যাথু কে ভেনুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘মার্কসবাদের পশ্চিমী সংস্করণের যান্ত্রিক অনুশীলনের’ বিপরীতে মাও মতাদর্শকে যে ‘গৌরবের আসনে’ তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সে সম্পর্কে তাঁর উচ্ছ্বাস বস্তুবাদী মনে সত্যিই সন্দেহের উদ্রেক করে।

কাঠামো ও উপরিকাঠামোর দ্বান্দ্বিক আন্তঃসম্পর্ক মার্কসবাদী দর্শনের ভিত্তিস্বরূপ। তা সত্ত্বেও কাঠামোর ওপর উপরিকাঠামোর ক্রিয়াকে তুলে ধরার জন্য, অথবা ভাষান্তরে, মতাদর্শকে ‘গৌরবের আসনে’ বসানোর জন্য যদি একা মাও-এর বিশেষ গুণকীর্তন করা হয়, তাহলে গোটা ব্যাপারটি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের কাঠামোর মধ্যে মাও চিন্তাধারার যথার্থ উপলব্ধির পরিবর্তে পেটিবুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীসুলভ নৈরাজ্যবাদী-ভাববাদী মানসিকতার সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হয়।

মাও নিজে চীনা পরিস্থিতিতে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগের ওপর জোর দিয়েছেন। আর সুনির্দিষ্টভাবে তিনি সোভিয়েত অধিবিদ্যার সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে মার্কসবাদী দর্শনের দ্বান্দ্বিক মর্মবস্তুকে পুনরুদ্ধার করেন।

সারা বিশ্বের মাওবাদের অত্যুৎসাহী প্রবক্তারা অবশ্য সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কথা বলে মাও-কে মৌলিক মার্কসবাদী নীতিসমূহের বিরুদ্ধে দাঁড় করান এবং তাঁকে এক বিষয়ীগত ভাববাদীর স্তরে নামিয়ে আনেন। শ্রী ম্যাথুও ঐ দলেরই অন্তর্ভুক্ত।

শ্রী ম্যাথু আমাদের আরও জানিয়েছেন যে, আম্বেদকর নাকি একসময়ে পশ্চিমী যান্ত্রিক বস্তুবাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন আর জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে তাঁর বৌদ্ধ দ্বন্দ্ববাদে ‘উত্তরণ’ ঘটে।

পশ্চিমের সর্বাধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে সুপরিচিত আম্বেদকর দ্বন্দ্ববাদের সেদিনকার সর্বোচ্চ বিকাশ মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদের পরিবর্তে সুপ্রাচীন বৌদ্ধ দ্বন্দ্ববাদে ‘উত্তরণকে’ কেন বেছে নিয়েছিলেন? এই প্রশ্নকে গুরুত্বসহকারে ও গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে যে মার্কসবাদ ও আম্বেদকরবাদ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দার্শনিক-মতাদর্শগত ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে।

নিঃসন্দেহে ভারতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আশু পরিপ্রেক্ষিতে একটি মার্কসবাদী কর্মসূচির বহু কিছু আম্বেদকরবাদের র্র্যাডিক্যাল দিকটির সঙ্গে মিলে যেতে পারে। কিন্তু একটি একক দার্শনিক-মতাদর্শগত ধারায় উভয়ের সম্মিলন কেবল অকল্পনীয় নয়, বহুক্ষেত্রে তা এমনকি এক প্রতিক্রিয়াশীল প্রচেষ্টাতেও অধঃপতিত হতে পারে।

সমাজতান্ত্রিক বনাম র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া বীক্ষা

২। শ্রী ম্যাথু আমার লেখা থেকে প্রশংসাসহ উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন যে আম্বেদকর সমাজতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তবে সেইসঙ্গে তিনি যোগ করেছেন একটি অনুসিদ্ধান্ত – আম্বেদকর এটাও বিশ্বাস করতেন যে নিপীড়িত শ্রেণীগুলি (অস্পৃশ্য ও শুদ্ররা) সমাজতন্ত্র আনতে পারে কেবলমাত্র শাসকশ্রেণীতে পরিণত হওয়ার পরে।

আমি খুব স্পষ্টভাবেই দেখিয়েছি যে সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আম্বেদকরের বীক্ষা ছিল এক ৠাডিক্যাল বুর্জোয়া বীক্ষা, গান্ধীর রক্ষণশীল বু্র্জোয়া বীক্ষার বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। সেই সময়ে সমাজতন্ত্র ছিল একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। প্রগতিশীল বা তেমন প্রগতিশীল নয় এমন সমস্ত চিন্তাধারার প্রবক্তারা নিজেদের সমাজতন্ত্রী হিসাবেই পরিচয় দিতেন। নেহরুর ব্যাপারটিও এইরকম, আম্বেদকরের ব্যাপারটিও এইরকম। শ্রী ম্যাথুর জানা উচিত যে জমির জাতীয়করণ ও জাতিভেদের অবসানের দাবি র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অধীনে পড়ে। পুঁজিবাদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ জাতিভেদের অবসানের সামর্থ্য রাখে। এগুলি আবার গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কমিউনিস্ট কর্মসূচির মধ্যেও গুরুত্বপূর্ণ দাবি। কেননা সামন্ততান্ত্রিক শৃঙ্খল আমূল ছিন্ন না করে কোনও প্রকৃত পুঁজিবাদী বিকাশ সম্ভব নয়। একজন র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়ার কাছে কিন্তু এটিই চরম মোক্ষ। আর একজন কমিউনিস্টের সামনে এর মধ্যে দিয়ে খুলে যায় সেই পর্যায়ের দ্বার যখন সমাজতন্ত্রের জন্য এক মহান শ্রেণীযুদ্ধ নির্ধারকভাবে শুরু করা যাবে এবং বিজয়ী হওয়া যাবে।

জাতের অবসান কোনোভাবেই শ্রেণীর বিলোপ ঘটায় না। বিপরীতে তা বরং শ্রেণী গঠনে সহায়তা করে, শ্রেণী মেরুকরণকে তীব্রতর করে এবং শ্রেণী সংগ্রামকে করে তোলে আরও প্রকাশ্য, আরও ব্যাপক, আরও প্রত্যক্ষ। পশ্চিমী সমাজগুলির দিকে তাকালে এই ব্যাপারটি উপলব্ধি করা খুব কঠিন নয়। সেখানে জাতিভেদ দেখতে পাওয়া যায় না। এর ফলে শ্রেণীসংগ্রাম সেখানে অনেক বেশি বিশুদ্ধ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।

অস্পৃশ্য ও শুদ্র জাতগুলির শাসকশ্রেণীতে (শাসক জাতে) পরিণত হলেও তা কোনোভাবেই সমাজতন্ত্রের জন্ম দেবে না। ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে ঐ জাতগুলির কিছু কিছু অংশ ইতিমধ্যেই শাসকশ্রেণীতে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদের মধ্যেকার প্রতিপত্তিশালী জাতগুলি নীচুতলার জাতগুলির প্রতি সেই একই ব্রাহ্মণ্যবাদী ধরনের আচরণ করে থাকে। অনগ্রসর জাতগুলির মধ্যে আবার শক্তিশালী কুলাক গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করেছে, যারা কৃষিশ্রমিক ও গরিব কৃষকদের – যাঁদের অধিকাংশই দলিত – তাঁদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। তাঁর বইতে শ্রী ম্যাথু কেরলে কিছু কিছু শুদ্র জাতের এই ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করেছিলেন। তার প্রত্যুত্তরেও তিনি দলিত-শুদ্র কৃষক জনতার মধ্যে শ্রেণী বিভাজনের কথা উল্লেখ করেছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে অনগ্রসর জাতের জাতীয় বুর্জোয়ারা বিপ্লবের স্থায়ী মিত্র নাও হতে পারে। এই উপলব্ধিকে স্বাগত জানিয়ে আমি আশা করব শ্রী ম্যাথু এটিও উপলব্ধি করবেন যে গ্রামাঞ্চলে এদেরই সমগোত্রীয়রা, অর্থাৎ গ্রামীণ বুর্জোয়া বা অনগ্রসর জাতের কুলাকরা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ‘প্রধান শক্তি ও প্রধান মিত্র’ও হবে না।

আম্বেদকরবাদের শ্রেণী চরিত্র

৩। আম্বেদকরকে দলিতদের পেটিবুর্জোয়া স্তরের শ্রেণী প্রতিনিধি হিসাবে চরিত্রায়িত করার জন্য শ্রী ম্যাথু আমার ওপর খড়্গহস্ত। তিনি নিজে আম্বেদকরের শ্রেণী অবস্থান সম্পর্কে কী বলেছেন দেখা যাক। শুরুতেই তিনি ‘আম্বেদকরবাদের পেটিবুর্জোয়া সীমাবদ্ধতা’ স্বীকার করে নিয়েছেন। এরপর তিনি হাজির করেছেন একটি অপ্রমাণিত অনুমান – দলিত পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে নাকি ‘তাঁদের বুর্জোয়া হয়ে ওঠার আকাঙ্খা বারংবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর সর্বহারা মূল্যবোধ অর্জন করার’ বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। এরসঙ্গে বৌদ্ধ-উত্তর ও তারপর দলিত প্যান্থার-উত্তর পর্যায়ে আম্বেদকরবাদের ‘উত্তরণ’ থেকে শ্রী ম্যাথু এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে ‘আম্বেদকরবাদ দলিত পেটিবুর্জোয়া ও দলিত সর্বহারার মধ্যে দ্বিধায় দীর্ণ’। শ্রী ম্যাথু আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন উত্তরণ-পূর্ব, বৌদ্ধ-পূর্ব পর্যায়ের আম্বেদকরে, যিনি ‘দলিত বুর্জোয়ার বিপরীতে দলিত সর্বহারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন’। শ্রী ম্যাথুর বক্তব্যের অস্পষ্টতা ও অপ্রতিষ্ঠিত অনুমানের ওপর নির্ভরশীলতা প্রমাণ করে যে আম্বেদকরকে সর্বহারার শ্রেণী-প্রতিনিধি হিসাবে নাকি বুর্জোয়াদের শ্রেণী-প্রতিনিধি হিসাবে চরিত্রায়ণ করবেন এই দ্বন্দ্বে তিনি নিজেই দীর্ণ।

শ্রী ম্যাথুর এই কষ্টসাধ্য কসরৎ কিন্তু আম্বেদকরের শ্রেণীচরিত্র সম্পর্কে আমার বক্তব্যকেই সঠিক প্রমাণ করেছে। কেননা আম্বেদকরের বিভিন্ন অবস্থানের মধ্যে যে দোদুল্যমানতা তিনি দেখিয়েছেন, তা পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর এক মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও তাঁকে একথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত যে, দলিত হোন আর নাই হোন, পেটিবুর্জোয়াদের বু্র্জোয়া হয়ে ওঠার আকাঙ্খা বারংবার ব্যর্থ হলেই তা নিশ্চিতভাবে তাঁদের সর্বহারা মূল্যবোধে পৌঁছে দেয় না। প্রায়শই তা কেবল হতাশা ও নৈজরাজ্যবাদের জন্ম দেয়। আম্বেদকরবাদের দলিত প্যান্থার-উত্তর পর্যায় সম্পর্কে এত আশাবাদী শ্রী ম্যাথু একটি প্রশ্নের জবাব দেবেন কি : সেদিনের সেই দলিত প্যান্থাররা আজ গেল কোথায়?

আমি বলেছি যে আম্বেদকরের বীক্ষা ছিল এক র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া বীক্ষা এবং এটা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে বিশেষ করে গান্ধীর রক্ষণশীল বু্র্জোয়া বীক্ষার সঙ্গে তাঁর বিতর্কের মধ্যে দিয়ে। ‘বুর্জোয়া’ শব্দটি আমাদের দেশে এতই কুখ্যাতি অর্জন করেছে যে মানুষ র্র্যাডিক্যাল আর রক্ষণশীল বুর্জোয়া বীক্ষার মধ্যে ফারাক করতে পারেন না এবং তাঁরা এটিও খেয়াল করতে পারেন না যে আমাদের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আশু পরিপ্রেক্ষিতে র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া বীক্ষা এক বিপ্লবী বীক্ষাই বটে। আম্বেদকরের অন্ধ অনুরাগীদের কাছ থেকে আমি সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছি তাঁকে ‘বুর্জোয়া’ হিসাবে চরিত্রায়িত করার জন্য। অথচ তাঁকে একজন র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া হিসাবে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে আমি বরং তাঁর এক ইতিবাচক পুনর্মূল্যায়ন করেছি, তাঁর সমসাময়িক অনেকের থেকেই অনেক ঊর্ধ্বে তাঁকে স্থান দিয়েছি এবং কমিউনিস্ট ও র্র্যাডিক্যাল আম্বেদকরপন্থীদের মধ্যে রণনৈতিক ঐক্যের পথ প্রশস্ত করতে চেয়েছি। এই ব্যাপারটি শ্রী মাথু একেবারেই ধরতে পারেননি।

এখানে মূল যে ব্যাপারটির দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার তা হল আম্বেদকরের এক সমালোচনামূলক মূল্যায়ন করা, যা তাঁর বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আদর্শকেও তুলে ধরবে, আবার একই সঙ্গে তাঁর র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া বীক্ষার অসঙ্গতিগুলিকেও স্বীকার করবে। কেননা, শেষবিচারে চীনের সান ইয়াৎ সেনও ছিলেন একজন র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া, যদিও তিনি ছিলেন আম্বেদকরের থেকে অনেক বেশি একনিষ্ঠ।

বিএসপি বনাম জনতা দল

৪। শ্রী ম্যাথু এখনও মনে করেন যে বিএসপি-র দলিত মহা-ঐক্যের ধারণা রিপাবলিকান (আম্বেদকরপন্থী) অনুশীলনের তুলনায় এক বিশেষ তাত্ত্বিক অগ্রগতি এবং মণ্ডল মঞ্চকে তুলে ধরে জনতা দল বিএসপি-র এই দলিত মহা-ঐক্যের কাঠামোকে ইতিবাচক ও কার্যকরীভাবে গ্রহণ করেছে। বইটি প্রকাশের পরবর্তী পরিস্থিতি শ্রী ম্যাথুকে সাধারণভাবে জনতা দল এবং বিশেষভাবে রামবিলাস পাসোয়ান সম্পর্কে তাঁর উচ্ছ্বাসকে যথেষ্ট সংযত করতে বাধ্য করেছে এবং তিনি শুধুমাত্র ‘তথ্যের উল্লেখের’ মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তথ্যও কিন্তু উল্টো কথাই বলছে। পরবর্তীকালে বিএসপি জনতা দলের পালের হাওয়া কেড়ে নিয়েছে আর কাঁসিরাম রামবিলাস পাসোয়ানকে নিছক এক পার্শ্বচরিত্রে পরিণত করেছে। পাশার দান এভাবে উল্টে গেল কেন, তার কোনো ব্যাখ্যা শ্রী ম্যাথুর কাছে নেই।

ব্যর্থ হলেন যে দেবতা

৫। শ্রী ম্যাথুর কাছে মণ্ডল হল তাঁর প্রিয় দলিত বিপ্লবের পূর্বসূরী। কিন্তু হায়! সে বিপ্লব মাঝপথে পথভ্রষ্ট হয়ে গেল। তাঁর হতাশা খুবই স্পষ্ট। আগে তিনি মণ্ডলের বিরোধিতা করার জন্য মূলধারার বামদের – উচ্চবর্ণের শিল্পীয় শ্রমিক বাহিনীর তথাকথিত প্রতিনিধিদের অভিযুক্ত করেছিলেন; আর এখন তিনি মণ্ডল সম্পর্কে সিপিআই-এর অবস্থানের প্রশংসা করছেন আর সুবিধাভোগী স্তর সম্পর্কিত রায়কে সমর্থন করার জন্য আমাদের ও সিপিআই(এম)-এর বিরুদ্ধে তাঁর ক্রোধ কেন্দ্রীভূত করছেন।

তথাকথিত শ্রমিক অভিজাততন্ত্র বা শ্রী ম্যাথুর ভাষায় ‘উচ্চবর্ণের শিল্পীয় শ্রমিকদের’ মধ্যে যে সিপিআই-এর শিকড় আমাদের এমনকি সিপিআই(এম)-এর চেয়েও গভীরে প্রোথিত, মণ্ডলের সাপেক্ষে সেই সিপিআই-এর অবস্থান বা বিহারের মণ্ডল রাজত্বে সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর ধারাবাহিকভাবে জনতা দলের ‘স্বাভাবিক মিত্র’ হয়ে চলার বিষয়টি তিনি কীভাবে ব্যাখ্যা করছেন, তা আমি জানি না।

আমরা যে সুবিধাভোগী স্তর সংক্রান্ত রায়কে সমর্থন করছি, শ্রী ম্যাথুর মতে তা হল অর্থনৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে সংরক্ষণকে সমর্থন করার সামিল। অর্থাৎ তা হল অর্থনৈতিক অগ্রগতির উপায় হিসাবে সংরক্ষণকে দেখা এবং এইভাবে তা আম্বেদকরের ‘অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ও প্রশাসন যন্ত্রের গণতান্ত্রিকীকরণের’ দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে উন্নয়নের গান্ধীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পৃষ্ঠপোষকতা করে। কী অসাধারণ যুক্তি পরম্পরা!

মণ্ডলের বিশ্লেষণে আমি যা বলেছি এবং যার থেকে শ্রী ম্যাথু উদ্ধৃতি দিয়েছেন তা হল ‘ক্ষমতার কাঠামোয় নতুন ভারসাম্য আনা’। অন্য কথায়, শাসক শ্রেণীগুলির পরিধির মধ্যে অনগ্রসরদের কিছু অংশকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ও প্রশাসনযন্ত্রের গণতান্ত্রিকীকরণ। বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় কোনো সংস্কারমূলক পদক্ষেপ এছাড়া আর কী ঘটাতে পারে? যে সুবিধাভোগী স্তর অবাধ প্রতিযোগিতায় সক্ষম হয়ে উঠেছে এবং অন্যথায় যারা অনগ্রসরদের জন্য নির্ধারিত সমগ্র কোটাকেই আত্মসাৎ করে নেবে, সেই সুবিধাভোগী স্তর সংক্রান্ত রায়কে সমর্থন করে আমরা কি অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ও প্রশাসনযন্ত্রের গণতান্ত্রিকীকরণের পরিধিকেই বিস্তৃত করার চেষ্টা করছি না?

এইভাবে সংস্কারের প্রক্রিয়ার মধ্যে এ র্র্যাডিক্যাল উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমরা কি চাপ সৃষ্টি করছি না? দলিত সর্বহারার এক স্বঘোষিত প্রতিনিধির পক্ষে সুবিধাভোগী স্তরের স্বার্থের জন্য এই একনিষ্ঠ ওকালতি সত্যিই বিস্ময়কর। তবে তাঁর কল্পনার জগতে শ্রী ম্যাথু অবশ্য বিশ্বাস করেন যে তফশিলি জাতিগুলি মণ্ডলের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেছিল আর মণ্ডল-বিরোধী প্রত্যাঘাতের মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাদেরই। মণ্ডলকে কেন্দ্র করে দলিত ও অনগ্রসরদের ঐক্যবদ্ধ করার মহান সুযোগকে কাজে না লাগানোর জন্য এবং তার পরিবর্তে গ্রামীণ সর্বহারা ও অনগ্রসর জাতের কুলাকদের মধ্যে শ্রেণীসংঘাতকে তীব্রতর করে তুলতে সচেষ্ট থাকার জন্য বামদের অদূরদর্শিতায় তিনি অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন।

প্রথমত, আমি বলব যে, এই অভিযোগ সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর বিরুদ্ধে খাটে না। গ্রামীণ সর্বহারা ও অনগ্রসর জাতের কুলাকদের মধ্যে শ্রেণীসংঘাত তীব্রতর করে তুলছে – তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের সুযোগ কারও নেই। তাই যদি হত তবে জনতা দলের সঙ্গে তাদের মিতালি এত দীর্ঘস্থায়ী হত না। আমাদের ক্ষেত্রে এই অভিযোগ আমি স্বীকার করি এবং শ্রী ম্যাথু শুনে আশ্চর্য হবেন যে বিহারে আমাদের বামপন্থী বন্ধু সিপিআই এবং সিপিআই(এম) প্রতিনিয়তই আমাদের এই একই অভিযোগে অভিযুক্ত করে থাকে।

দ্বিতীয়ত, দলিত ও অনগ্রসরদের মধ্যে ঐক্যের যে রূপ শ্রী ম্যাথু কল্পনা করেছেন আশ্চর্যজনকভাবে তার মূল কথা হল কুলাকদের সাপেক্ষে দলিতদের তাদের শ্রেণীস্বার্থকে বিসর্জন দিতে ও সুবিধাভোগী স্তরগুলির স্বার্থে লড়াই করতে, ত্যাগ স্বীকার করতে এবং এমনকি নেতৃত্ব দিতে আহ্বান জানানো।

শ্রী ম্যাথুর জানা উচিত যে নিজেদের লড়াই-এ নেতৃত্ব দেওয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা কুলাকদের আছে, আর রামবিলাস পাসোয়ানের মতো কুলাককূলের দালালরা ছাড়া অন্যান্য দলিতরাও তাঁর পরামর্শে কান দেবে না। বস্তুত, কার শ্রেণীস্বার্থের কথা শ্রী ম্যাথু সর্বাগ্রে ভাবেন, সেটুকুই তিনি তাঁর পরামর্শের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করে ফেলেছেন।

তিনি অবশ্য একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। শক্তিশালী অনগ্রসরদের অন্তর্ভুক্ত করে শাসকশ্রেণীর ভিত্তিকে প্রসারিত করা যদি মণ্ডল কর্মসূচির লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে সুবিধাভোগী স্তরকে বাদ দিয়ে সেই উদ্দেশ্য কি সিদ্ধ হতে পারে?

শ্রী ম্যাথু আশ্বস্ত থাকতে পারেন, সামাজিক বাস্তবতা কখনই আদালতের রায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাতে ও তাকে প্রতীকসর্বস্বতায় পর্যবসিত করে তুলতে সামাজিক বাস্তবতা অবশ্যই উপায় বার করে নেবে। তামিলনাড়ু ইতিমধ্যেই সংরক্ষণকে ৫০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার রায়কে পাশ কাটিয়ে গেছে এবং অন্য কয়েকটি রাজ্যও শীঘ্রই তাকে অনুসরণ করবে। বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে স্তর নির্ধারণের মান এমনভাবে সূত্রায়িত হয়েছে যে নথিভুক্ত করার মতো কোনো সুবিধাভোগী স্তর আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুবিধাভোগী স্তর সংক্রান্ত রায় বামদের কাছে জাত-সম্প্রদায়গুলির মধ্যে শ্রেণী সচেতনতা বৃদ্ধির সুযোগ এনে দিয়েছে আর সে সুযোগ আমরা হাতছাড়া করিনি।

শ্রেণী ও জাত

শ্রেণীই হল বুনিয়াদী বর্গ আর উৎপাদনের ধরনের মধ্যেই তার উৎস – আমার এই সূত্রায়নের সঙ্গে শ্রী ম্যাথু পুরোপুরি একমত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে এক দ্বৈততা আমদানি করে বলেছেন জাতের উৎসও রয়েছে উৎপাদনের ধরনের মধ্যেই।

মার্কস ও এঙ্গেলস যখন ঘোষণা করেন যে, এতকালের সমস্ত সমাজের (আদিম সাম্যবাদী সমাজ ছাড়া) ইতিহাস হল শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস, তখন তাঁরা সামাজিক বিকাশের একটি বুনিদায়ী সূত্রকেই আবিষ্কার করেন। অবশ্য কেবলমাত্র একটি পরিপক্ক পুঁজিবাদী সমাজেই শ্রেণীগুলি ও তাদের মধ্যকার সংগ্রাম বিশুদ্ধতর রূপে দেখা দেয়। অন্য সমস্ত সমাজে শ্রেণী সংগ্রাম অত্যন্ত জটিল রূপ পরিগ্রহ করে। মার্কস নিজে বেশ কিছু অধ্যয়নে দেখিয়েছেন, কীভাবে ধর্মযুদ্ধ, ঔপনিবেশিক অভিযান, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সামাজিক সম্প্রদায়গুলির মধ্যকার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বাহ্যিক রূপের অন্তরালে বিভিন্ন শ্রেণীস্বার্থগুলি পরস্পরের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই মার্কসবাদী পরিপ্রেক্ষিতের ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় কমিউনিস্টদেরও জাতপাতের লড়াইয়ের বাহ্যিক রূপ ভেদ করে তার আড়ালে আমাদের সমাজের শ্রেণী-গতিসূত্রের মর্মবস্তুকে উদ্ঘাটিত করতে হবে। কিন্তু শ্রেণী ও জাতের দ্বৈততার তত্ত্ব এই অধ্যয়নে প্রথম থেকেই বাধা দিয়ে চলেছে।

জাতিভেদ প্রথাকে আমি উৎপাদনের একটি নির্দিষ্ট ধরন ও তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উৎপাদন সম্পর্কের ফসল হিসাবেই দেখিয়েছি। এখানে শ্রেণীসম্পর্কগুলি জাতের রূপ পরিগ্রহ করে, যেগুলির ওপর আবার পুরোহিত সম্প্রদায় দৈব মহিমা আরোপ করে। কিন্তু তাদের ‘স্থায়িত্ব’ মূলত কোনো দৈবমহিমার দ্বারা নির্ধারিত হয় না। উৎপাদিকা শক্তির একটি সুনির্দিষ্ট স্তর থেকে জন্ম নেওয়া গ্রামসমাজের স্থিতিশীল সামাজিক সংগঠন তা নির্ধারণ করে থাকে। এখানে জাত ও শ্রেণীগুলিকে একে অপরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়। শ্রেণী ও জাতের এই সংহতি, কাঠামো ও উপরিকাঠামোর মধ্যে এই সাযুজ্য নিতান্তই বাহ্যিক, কেননা এ দুটি হল সুনির্দিষ্টভাবে দুটি ভিন্ন বর্গ, যাদের উৎস রয়েছে যথাক্রমে কাঠামো ও উপরিকাঠামোয়, উৎপাদনের ধরন ও বণ্টনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে।

উৎপাদিকা শক্তিগুলির বিকাশ এবং উৎপাদনের ধরনে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসার সাথে সাথে এই সংহতি ভেঙে যায়, শ্রেণী এবং জাত, কাঠামো এবং উপরিকাঠামোর মধ্যে সংঘাত দেখা দেয়, একে অপরকে নির্ধারণের চেষ্টা করে। আর দীর্ঘ এক উত্তরণশীল পর্যায় ধরে শ্রেণীগত আত্মঘোষণা স্পষ্টতরভাবে আত্মপ্রকাশ করে এবং অদ্ভুত মনে হলেও প্রায়শই তা জাতগত গতিময়তার এক ঘূর্ণাবর্তের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়। বিভিন্ন জাতের মধ্যে উৎপাদনের উপকরণগুলির বিভাজনের তথাকথিত স্থায়িত্বে চিড় ধরে। তবে, নতুন আধুনিক অর্থনৈতিক শ্রেণীগুলি অবশ্য রাজনৈতিক তথা প্রশাসনিক ক্ষমতার ভাগের জন্য নিজেদের মধ্যে সংগ্রামে জাতের প্রাতিষ্ঠানিক পতাকাকে কাজে লাগিয়ে থাকে। সেই পুরোনো হাতিয়ার, কিন্তু অন্তর্বস্তুর মধ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। এই পর্যায়ে প্রথম পর্যায়ের সংহতির নেতিকরণ ঘটে এবং শ্রেণী ও জাতগুলি পরস্পরকে ছেদ করে, আবার পরস্পরের মধ্যে ঢুকে যায়। এই পর্যায়ে আবার শ্রেণী ও জাতগত সত্তার মধ্যে দ্বন্দ্বও তীব্রতর হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত ঐতিহাসিক আন্দোলন এই পর্যায়েরও নেতিকরণ ঘটাবে এবং কাঠামো ও উপরিকাঠামোর মধ্যকার সংহতি ও সাযুজ্যকে ফিরিয়ে আনবে, অবশ্য উন্নততর রূপে। আর তখন জাতপ্রথার বিলোপ ঘটবে এবং শ্রেণীগুলির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও শ্রেণীসংগ্রাম বিশুদ্ধতর রূপে আবির্ভূত হবে। শুধুমাত্র আত্মগত বাসনা এই সাযুজ্যকে ফিরিয়ে আনতে পারে না। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, উৎপাদনের সুনির্দিষ্ট ধরন ও তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উৎপাদন সম্পর্ক থেকে সৃষ্টি হয়েছে জাতপাত ব্যবস্থার। তার বিলোপও ঘটবে উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদনের ধরনের উন্নততর স্তরে। আমি আরও বলেছি, পুঁজিবাদের অবাধ বিকাশ অর্থনীতি-বহির্ভূত রূপের নিপীড়নের অবসান ঘটায়, শ্রেণীকেই বণ্টনের ধরনের প্রত্যক্ষ নির্ধারক করে তোলে এবং এইভাবে জাতিপ্রথাকে ধ্বংস করার সুমহান সম্ভাবনা তার মধ্যে নিহিত রয়েছে।

শ্রী ম্যাথুর মতে জাতপাত ব্যবস্থাই উৎপাদন সম্পর্ককে প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করে এবং উৎপাদনের উপকরণগুলিকে বিভিন্ন জাতের মধ্যে স্থায়ীভাবে বিভাজিত করে। সুতরাং তাঁর বিবেচনায় জাতপাত ও তার স্থায়িত্ব পুরোহিততন্ত্রের চক্রান্তের ফসল। এই ব্যবস্থা উপরিকাঠামোর প্রধান ভূমিকা, অর্থাৎ বণ্টন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে – একথা স্বীকার করে নিয়েও উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতপাত যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে – ভাষান্তরে যা হল কাঠামোর ওপর উপরিকাঠামোর ক্রিয়া, তার অর্থ করা হয়েছে যে, জাতও কাঠামোর অন্তর্গত। কিন্তু তাতে সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি হয় একটি ধাঁধার – তাই যদি হয়, তাহলে অপর বুনিয়াদী বর্গ অর্থাৎ শ্রেণীর তখন কী অবস্থা হয় এবং জাতের সঙ্গে তার সম্পর্ক এগোয় কীভাবে? আমাদের সমাজের সীমিত শিল্প বিকাশের মধ্যে শ্রেণী গঠনের প্রক্রিয়াকে – তা যতই প্রারম্ভিক পর্যায়ের হোক না কেন – শ্রী ম্যাথু দেখতে পান না। বিপরীতে তা জাতপাতের গঠনকেই শক্তিশালী করে বলে তাঁর মনে হয়েছে। প্রাক-পুঁজিবাদী গঠনের ক্ষেত্রে আমার সূত্রায়ন ছিল, ঐ পর্যায়ে শ্রেণী জাতরূপে অভিব্যক্ত হতে পারে। এর বিপরীতে শ্রী ম্যাথু যে তত্ত্ব হাজির করেছেন তা হল ঐ পর্যায়ে জাত অর্থনৈতিক ও অর্থনীতি-বহির্ভূত শোষণকে সমন্বিত করে অর্থনৈতিক শ্রেণীরূপে আবির্ভূত হয়। তিনি আরও বলেছেন, অন্যান্য ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে শ্রেণী ও জাত নয় বরং শ্রেণীর অর্থনীতিগত ও অর্থনীতি-বহির্ভূত দিকগুলি পরস্পরের মধ্যে মিশে যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে, শ্রেণী এবং জাত উভয়ের অর্থনৈতিক ও অর্থনীতি-বহির্ভূত দিক আছে, উভয়ের উৎস উৎপাদনের ধরনের মধ্যে, উভয়েই বুনিয়াদী বর্গ এবং এইভাবে তাদের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। শ্রীযুক্ত ম্যাথু, এতেও কিন্তু ধাঁধাটির মীমাংসা হল না। তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যের বিচারে দুটি বর্গই বুনিয়াদী হয় কীভাবে? তাদের পরস্পরের মধ্যে পার্থক্যই বা কোথায়? এই দ্বৈততা আমাদের কোথাও পৌঁছে দেয় না। আর এর একমাত্র যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে যে, জাতই হল বুনিয়াদী বর্গ যা শ্রেণীকে নির্ধারিত করে। এইভাবে শ্রেণীকে ঊর্ধ্বে তুলে স্থান দেওয়া হয়েছে উপরিকাঠামোয়, যে উপরিকাঠামো উদ্ভাবন করেছে আধুনিক পুরোহিততন্ত্র, অর্থাৎ কমিউনিস্টরা। জাতপ্রথার প্রতি-সিদ্ধান্ত (অ্যান্টি-থিসিস) হল জাতপ্রথাই এবং জাতগুলির মধ্যকার আসন্ন সংগ্রামে শ্রেণী অবলুপ্ত হয়ে যাবে! শ্রী ম্যাথুর তথাকথিত দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এটিই হল প্রকৃত বিষয়বস্তু।

শ্রেণীর নির্মূলীকরণ

দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে সর্বহারাকে আমরা সংঘবদ্ধ শ্রেণী হিসাবে দেখতে পাই না, সেখানে আমরা দলিত সর্বহারা ও উচ্চ জাতের সর্বহারাদের সন্ধান পাই। একইভাবে কৃষক ও বুর্জোয়াদের বিভিন্ন শ্রেণীগুলিও জাতের আনুগত্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন অংশে খণ্ডিত এবং পরস্পরের বিরোধিতায় রত। জাতের মতো শ্রেণী যে খণ্ডিত সত্তা নয় এবং হতে পারে না, একথা শ্রী ম্যাথু বিস্মৃত হয়েছেন। কারখানা ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদ সর্বহারার শ্রেণীসত্তা নির্মাণের শর্ত সৃষ্টি করেছে, আর সেই উদ্দেশ্যে যৌথ কার্যকলাপে তাদের সংগঠিত করা ছাড়াও একটি কমিউনিস্ট পার্টিকে সংগঠিত ও অসংগঠিত শ্রমিকশ্রেণীর বিভিন্ন অংশের মধ্যকার জাতপাত, সাম্প্রদায়িক ও উগ্র জাতিদম্ভের ঝোঁকের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে।

পুঁজিবাদ ও শিল্পীয় শ্রমিকশ্রেণীর উদ্ভবকে জাতপাতের বৈপরীত্য হিসাবে ও তার মধ্যে জাতপাতের বিলোপের সম্ভাবনাকে শ্রী ম্যাথু দেখতে পান না। তিনি এটাও ভুলে যান যে, জাতপাতকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আম্বেদকরবাদ সহ অন্যান্য র্র্যাডিক্যাল চিন্তাধারার আবির্ভাব ঘটে কেবলমাত্র পুঁজিবাদের উন্মেষের সাথে সাথে এবং পশ্চিম থেকে উদ্ভূত র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া ও সর্বহারা চিন্তাধারার সঙ্গে আন্তঃক্রিয়ার প্রক্রিয়াতেই। তিনি মনে করেন, আত্মগত পরিকল্পনা থেকে যে জাতপাতের উদ্ভব, সাংস্কৃতিক বিপ্লব ধরনের সেরকম কোনো এক বিষয়ীগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তার বিলোপ ঘটানো যাবে। জাতপাতের বিরুদ্ধে আম্বেদকরের জেহাদ এবং তাঁর ৠাডিক্যাল অর্থনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে তিনি কোনো যোগসূত্র দেখতে পান না এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, জাতপাতের ধ্বংস ব্যতীত পুঁজিবাদ বা শিল্পায়ন কোনোটাই সম্ভব নয়।

সর্বহারা নেতৃত্ব

নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাওবাদী ধারণা সম্পর্কে শ্রী ম্যাথু কিছু অদ্ভুত মতামত পোষণ করেন। পশ্চিমী দেশগুলির পুরোনো গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং পূবের দেশের নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মৌলিক পার্থক্য এই যে দ্বিতীয়টি পুঁজিবাদে থেমে যায় না, নিরবচ্ছিন্নভাবে সমাজতন্ত্রে উত্তীর্ণ হয় – আমার এই বক্তব্য শ্রী ম্যাথুর মতে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ধারণার সঙ্গে মেলে না। তাঁর মতে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ধারণা হল নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয় শ্রমিকশ্রেণী। ভালো কথা, কিন্তু নতুন সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই সর্বহারা নেতৃত্বের অর্থ কী দাঁড়ায়? নয়া বা পুরোনো, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অর্থনৈতিক অন্তর্বস্তু অবশ্যই বুর্জোয়া। এই বিপ্লব সামন্ত অবশেষের বিলোপ ঘটিয়ে অবাধ পুঁজিবাদী বিকাশের পথ প্রশস্ত করে। কিন্তু আধা-ঔপনিবেশিক দেশে, যেখানে ঐতিহাসিকভাবে এই বিপ্লবের নেতৃত্ব বর্তায় শ্রমিকশ্রেণীর ওপর, সেখানে এর পাশাপাশি এক শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক ক্ষেত্রও আত্মপ্রকাশ করে এবং সর্বহারার নেতৃত্ব সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সুনিশ্চিত করে। মাও-এর চীনে ঠিক এইরকমই ঘটেছিল আর মাও-এর “নয়া গণতন্ত্র সম্পর্কে” প্রবন্ধে এমনকি একনজর চোখ বোলালেও এই সবেরই যথার্থতা প্রমাণ হয়।

কিন্তু শ্রী ম্যাথুর সমস্যা হল, তাঁর সর্বহারারা দলিত সর্বহারা – গ্রামীণ সর্বহারা এবং অপ্রধান অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, যারা নাকি উচ্চ জাতগুলি থেকে আগত শিল্পীয় সর্বহারাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ। তাছাড়া, অনগ্রসর জাতের কুলাক ও বুর্জোয়ারা এই দলিত সর্বহারার প্রধান মিত্র ও প্রধান শক্তি। শ্রী ম্যাথু ভালোভাবেই জানেন, এইরকম ‘শ্রেণী-বিন্যাস’ নিয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব নয়, কাম্যও নয়। তিনি এটাও ভালোভাবে জানেন যে, সমাজতন্ত্র গঠন করতে হলে একটি শক্তিশালী সর্বহারা রাষ্ট্রের আবশ্যক। এর বিপরীতে তাঁর নৈরাজ্যবাদী মনোভঙ্গি রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ভূমিকাকে অস্বীকার করে। কাজেই তিনি সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে দায়সারা থেকে যান এবং কখনও গর্বাচভের রাশিয়া বা দেং-এর চীনের দোহাই দিয়ে আবার কখনও বা আম্বেদকরের রাষ্ট্রবাদী নির্দেশাবলীর সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার অছিলায় নতুন সমাজব্যবস্থার প্রশ্ন এড়িয়ে চলেন। শ্রী ম্যাথু নিশ্চয়ই জানেন, সমভিত্তিতে জনগণের মধ্যে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন শেয়ারগুলির তথাকথিত বণ্টন বেসরকারিকরণ ছাড়া অন্য কিছু নয়।

শ্রী ম্যাথুর এটাও জানা উচিত যে নকশালবাড়ি আন্দোলনে গ্রামীণ সর্বহারা এবং দরিদ্র কৃষকরা যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা সর্বহারা বিশ্ববীক্ষার দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিল এবং কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমেই তা তাঁদের কাছে পৌঁছেছিল। এই পথনির্দেশ ও নেতৃত্ব থেকে তাঁদের বঞ্চিত করার অর্থ হল বুর্জোয়াদের কবলে তাঁদের ঠেলে দেওয়া। এ দুয়ের মধ্যবর্তী কোনো পথ হতে পারে না। সর্বহারার বিশ্ববীক্ষা হল মূলত শিল্পীয় সর্বহারারই বিশ্ববীক্ষা। সমাজতন্ত্র এবং সাম্যবাদের পথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক ব্রত ঐ শ্রেণীর ওপর বস্তুগতভাবে ন্যস্ত হয়েছে – তবে শুধুমাত্র বস্তুগতভাবেই। বিষয়ীগত দিক থেকে বলতে গেলে ঐ ঐতিহাসিক ব্রতের উপযোগী করে ঐ শ্রেণীকে গড়ে তুলতে হবে কমিউনিস্ট পার্টিকেই, যার মধ্যে এই বাস্তব ভবিতব্যের ঘনীভূত প্রকাশ ঘটেছে।

শ্রী ম্যাথুর প্রিয় বিষয় হল সুবিধাভোগী স্তর অর্থাৎ অনগ্রসর জাতগুলির কুলাকদের স্বার্থে লড়াই করার জন্য দলিতদের উপদেশ বর্ষণ করা। ধনী কৃষকরাও বিপ্লবের প্রধান মিত্র – এই অজুহাতে তিনি এর যথার্থতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন। শ্রীযুক্ত ম্যাথু, আবার ভুল হচ্ছে। শ্রেণী হিসাবে ধনী কৃষকদের খুব বেশি হলে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতির মাধ্যমে নিরপেক্ষ করা যাবে। তাদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ বিপ্লবের পক্ষে দাঁড়াতে পারে, অন্যরা এর তীব্র বিরোধিতাই করবে। ভারতবর্ষের পরিস্থিতিতে খামার ক্ষেত্রে অধিকতর বিকাশের দরুন কুলাকদের দিক থেকে আরও বেশি প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

তাঁর কাঙ্খিত আঁতাতের নেতৃত্ব ‘জাতীয় বুর্জোয়াদের’ এবং গ্রামীণ দরিদ্রদের ওপর আধিপত্যকারী অনগ্রসর জাতগুলির কুলাকদের হাতে চলে যাওয়ার বিপদ সম্পর্কে শ্রী ম্যাথু একমত। তিনি এটিকে অবশ্য মাওবাদী মডেলের সাধারণ বিপদ হিসাবেই বর্ণনা করেছেন এবং এমনকি এও বলেছেন যে এই বিপদ ইতিমধ্যেই আমাদের পার্টি পরিচালিত আন্দোলনকেও গ্রাস করেছে। শ্রী ম্যাথুকে আমি শুধু পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আমাদের আন্দোলনের মধ্যে তা যদি ঘটত তবে সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর মতো আমাদের পার্টিও বিহারে জনতা দলের ‘স্বাভাবিক মিত্র’ হয়ে যেত। বিহারে একমাত্র মণ্ডলপন্থী জনতা দল সরকারের বিরুদ্ধে লাল পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা গ্রামীণ দরিদ্রদের চূড়ান্ত শ্রেণীগত ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার পতাকাকে তুলে ধরা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

আমার লেখাতে আমি দেখিয়েছিলাম যে, শ্রী ম্যাথুর সংশ্লেষণ মার্কসবাদ এবং আম্বেদকরবাদ থেকে তাদের র্র্যাডিক্যাল আত্মাকে মুছে দিয়েছে। আর তিনি যা হাজির করেছেন তা হল এই দুই ধারার দুই স্বনামধন্য দলত্যাগী কে ভেনু ও রামবিলাস পাসোয়ানের এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ। বোঝা যাচ্ছে, এ বিষয়ে শ্রী ম্যাথু বিন্দুমাত্র বিচলিত নন এবং তিনি গর্বিত যে তাঁর তাত্ত্বিক প্রয়াস বহুল মাত্রায় বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করেছে।

এই বাস্তবতার স্বরূপ কী? জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর পূর্বতন সম্পাদক কে টি সত্যমূর্তির বিএসপি-তে যোগদান এবং কেরলে কে আর গৌরীর গণতান্ত্রিক সুরক্ষা কমিটিতে সিআরসি-র পূর্বতন সম্পাদক কে ভেনুর যোগদান – এই দুটি ঘটনাকেই শ্রী ম্যাথু তাঁর তাত্ত্বিক প্রয়াসের সমর্থনে সাক্ষ্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন – যে দুটি ঘটনা হল মার্কসবাদের মতাদর্শ ও নকশালবাদের ব্রতের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টান্ত।

তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তিনি ১৯৯৩-এর ১৪ এপ্রিল রামবিলাস পাসোয়ানের সঙ্গে ‘আম্বেদকর জয়ন্তী’ মঞ্চে আমাদের যোগদানেরও উল্লেখ করেছেন। প্রথমেই বলা দরকার, এটি ছিল সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রচার সমিতির কর্মসূচি। ঐ কর্মসূচির দিন নির্ধারণ এবং তা নিয়ে পাসোয়ানের জেদ তাঁর অভিপ্রায় সম্পর্কে আমাদের সন্দিগ্ধ করে তোলে। এ নিয়ে কমিটিতে আমরা বারবার আমাদের আশঙ্কা ব্যক্ত করি এবং আমাদের সুস্পষ্টভাবেই আশ্বস্ত করা হয়। এর পরেও সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে শ্রী পাসোয়ান গোটা কর্মসূচিকেই আম্বেদকর জয়ন্তী উদযাপনে পর্যবসিত করেন এবং সভাপতি সুরজিত আমাদের প্রতিবাদকে কোনো আমল দেন না। এইভাবে পরিস্থিতি চরমে পৌঁছায় এবং আমরা জাতীয় প্রচার সমিতির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।

দ্বিতীয়ত, আমি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলতে চাই, র্র্যাডিক্যাল আম্বেদকরপন্থী শক্তিগুলির সঙ্গে একই মঞ্চে অংশগ্রহণ বা আম্বেদকর জয়ন্তী উদযাপনে আমাদের কর্মীদের যোগদান কোনোমতেই আমাদের পার্টির নীতির বিরোধী নয়। আম্বেদকরকে আমরা র্র্যাডিক্যাল গণতন্ত্রী হিসাবে শ্রদ্ধা করি এবং আমাদের সাধারণ গণতান্ত্রিক উদ্যোগে র্র্যাডিক্যাল আম্বেদকরপন্থীদের সঙ্গে হাত মেলাতে আমরা একান্ত আগ্রহী। একে মার্কসবাদ ও আম্বেদকরবাদের সমন্বয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা এবং সত্যমূর্তি এবং কে ভেনুর দলত্যাগের সঙ্গে একাকার করে ফেলা তাত্ত্বিক দেউলিয়াপনার চূড়ান্ত নিদর্শন।

আশা করব, আমার কিছু শব্দচয়নের ফলে বিতর্কে যে তিক্ততার সৃষ্টি হতে পারে সে ব্যাপারে শ্রী ম্যাথু বিশেষ গুরুত্ব দেবেন না।

আমার বিশ্বাস, গ্রামীণ দরিদ্রদের ওপর কুলাকদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে বিপদ তাঁর মডেলের মধ্যে নিহিত রয়েছে, শ্রী ম্যাথুকে তা স্বীকার করতে বাধ্য করাতে পেরেছি। ‘মাও-এর মডেলকে প্রতিটি সমাজ ও যুগের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও গতিশীলতার সঙ্গে উপযোগী করে নিয়ে’ তিনি এই বিপদের মোকাবিলা করতে চান। আমার বিভ্রান্তি কিন্তু এখনও দূর হল না। আর আমি আশা রাখি আমাদের নিজ নিজ চিন্তাধারার ‘সমন্বয়’ সাধনের লক্ষ্যে তিনি এই বিষয় নিয়ে গুরুত্ব সহকারে চিন্তাভাবনা করবেন।

(লিবারেশন, এপ্রিল ১৯৯৪ থেকে)

একটি বিতর্ক

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতবর্ষ জুড়ে এক সামাজিক আলোড়ন চলছে, যার পিছনে অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে দুই যমজ সত্তা – জাতপাত ও ধর্ম। ১৯৯০ সালে ভি পি সিং-এর নেতৃত্বাধীন জনতা দল সরকার অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীগুলির জন্য সংরক্ষণ প্রশ্নে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশগুলি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই গোটা ব্যাপারটা সামনে আসে। কংগ্রেস-বিরোধিতার ওপর ভিত্তি করে বিজেপির প্রচ্ছন্ন সমর্থন নিয়েই জনতা দল ক্ষমতায় এসেছিল। কিন্তু এই আঁতাত বেশি দিন টেকেনি। আর এই দুটি দল ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসের দুটি প্রধান সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের মুখ্য চরিত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। পরস্পর বিরোধী এই দুই আন্দোলনের দ্বন্দ্ব জনপ্রিয় ভাষায় মণ্ডল বনাম মন্দির দ্বন্দ্ব হিসাবে পরিচিত। প্রথমদিকে, দুর্নীতির (বোফর্স) বিরুদ্ধে সংগ্রামে জনতা দলের সমর্থন-ভিত্তি ছিল অনেক ব্যাপক। কিন্তু অন্য সবকিছুকে ছেড়ে একমাত্র মণ্ডলকেই তুলে ধরার ফলে তার সমর্থন-ভিত্তি অনেকটাই ক্ষয়ে যায় এবং ধারাবাহিক কয়েকটি রাজনৈতিক সংকটের পরিণতিতে এই দল আজ ভারতীয় রাজনীতির এক প্রান্তিক শক্তিতে পর্যবসিত হয়েছে।

ভি পি সিং ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের কথা অনুসারে, যথাস্থিতি ও ধর্মীয় গোঁড়ামিবাদের শক্তিগুলির বিরুদ্ধে তথা তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি যথাক্রমে কংগ্রেস(ই) ও বিজেপির বিরুদ্ধে মণ্ডলের এক নজিরবিহীন সমাজ বিপ্লবের জন্ম দেওয়ার কথা ছিল।

ইতিহাসের এমনই পরিহাস, মণ্ডলের সুপারিশগুলি কার্যকর করে কংগ্রেস(ই) সরকার এবং এই প্রক্রিয়ায় সে জনতা দলের পালের হাওয়া অনেকটাই কেড়ে নেয়।

‘ন্যায়যোদ্ধা’ ভি পি সিং অবশ্য সহজে ক্ষান্ত দিতে চান না। তাঁর লড়াই এখন মতাদর্শগত-রাজনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে একজন দলিতকে রাষ্ট্রপতি বা একজন অনগ্রসর জাতের মানুষকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে দেখার দাবিতে এসে ঠেকেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে যতদিন না কোনো অনগ্রসর সংরক্ষণ কোটার ভিত্তিতে চাকরি পাচ্ছেন ততদিন দিল্লী থেকে সরে থাকার চমকসর্বস্ব ঘোষণা। এইভাবে তাঁর বিপ্লব অধঃপতিত হয়েছে প্রসাধনসর্বস্ব সংস্কারে আর তাঁর আন্দোলন পর্যবসিত হয়েছে নিছক প্রতীকসর্বস্বতায়।

সংরক্ষণের নির্দিষ্ট প্রশ্নে জনতা দলের সামনে এখন যে বিকল্পগুলি রয়েছে সেগুলি হল সুবিধাভোগী স্তর সংক্রান্ত রায়ের বিরোধিতা করা এবং উচ্চবর্ণের জন্য অর্থনৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, যে প্রতিশ্রুতি ভি পি সিং দিয়েছিলেন মণ্ডল-বিরোধী বিক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য। স্বাভাবিক কারণে এই দুই বিকল্পের কোনোটাকে নিয়েই তারা আন্তরিকভাবে আন্দোলনে নামতে পারে না।

ভি পি সিং ও তাঁর জনতা দলের রাজনৈতিক অস্তগমন মুলায়ম সিং ও কাঁসিরামের উত্থানের সূচনা করে। মুলায়ম নিজেকে বহিরাগত ভি পি সিং-এর তুলনায় অনগ্রসরদের সহজাত প্রতিনিধি হিসাবে দাবি করেন। লোহিয়াকে স্মরণ করে তিনি তাঁর রাজনীতিকে সাজিয়েছেন এক সমাজতান্ত্রিক বাচনভঙ্গিতে, যার মধ্যে এক বলিষ্ঠ উত্তরাধিকার ও উদ্দেশ্যের আন্তরিকতা প্রতীয়মান। অন্যদিকে দলিত রাজনীতির উদীয়মান নক্ষত্র কাঁসিরাম স্মরণ করেন আম্বেদকরের উত্তরাধিকারকে। এক চরম দলিতবাদী অবস্থান এবং কমিউনিস্টদের সম্পর্কে ঘৃণাকে সম্বল করে তিনি স্বয়ং আম্বেদকরকেও ছাড়িয়ে যেতে উদ্যোগী।

এইসব নাটকীয় ঘটনা ভারতীয় বাম ও কমিউনিস্ট আন্দোলনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। একদিকে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে অনগ্রসর জাতের কৃষক জনতার মধ্যে কমিউনিস্টদের সামাজিক ভিত্তিতে মণ্ডল বিরাট ক্ষয় ধরিয়েছে, অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশে বাম দলগুলির পরম্পরাগত দলিত সমর্থন-ভিত্তিকে বিএসপি নিশ্চিহ্ন করেছে। এই পরিস্থিতি বাম ও কমিউনিস্ট মহলে এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যার মূল কথা হল ভারতীয় সমাজে জাতিভেদের বিষয়টি নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে হবে এবং বিশেষ করে সোভিয়েত বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে, শ্রেণী সম্পর্কে “সনাতন” ধারণাটিকেও নতুনভাবে বিচার করতে হবে। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে সিপিআই-এর প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের দলত্যাগ করে সমাজবাদী পার্টিতে যোগদান, অন্ধ্রপ্রদেশে জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর নকশালপন্থীদের বিএসপি-তে ভিড় করা এবং বিহারে কয়েকজন আইপিএফ বিধায়কের জনতা দলে যোগদান – এ সমস্তই পরিস্থিতির গুরুত্ব ও জটিলতার পরিচায়ক।

আমার সামনে এখন একটা বই। নাম, জাত ও শ্রেণীর গতিসূত্র – র্র্যাডিকাল আম্বেদকরপন্থী তত্ত্বানুশীলন (Caste and Class Dynamics – Radical Ambedkarite Praxis)। লেখক, জনৈক ডঃ টমাস ম্যাথু। জাত ও শ্রেণীর আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে লেখক বেশ কিছু চমকপ্রদ মতামত রেখেছেন। বইটিতে উপস্থাপিত ধারণাগুলির বিশ্লেষণের প্রক্রিয়ায় আমি জাত ও শ্রেণীর মধ্যকার সম্পর্কের জট খোলার চেষ্টা করব।

লেখকের ঘোষিত উদ্দেশ্য মার্কসবাদ ও আম্বেদকরবাদের সমন্বয় সাধন, যা তাঁর মতে “ভারতবর্ষের লক্ষ কোটি মানুষের একমাত্র ভরসা”। তিনি এই কঠিন দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এমন এক পরিস্থিতিতে যখন “মার্কসবাদী অনুশীলন, অন্তত তার প্রধান প্রধান ধরনগুলি, বিশ্ব জুড়ে ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন”, কিন্তু “আম্বেদকরীয় তত্ত্বানুশীলনের ধারা ভারতে তার শৈশবের সমস্যাগুলিকে কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে”। তা সত্ত্বেও ঐ সমন্বয়কে “মার্কসীয় কাঠামোয় আম্বেদকরবাদকে অঙ্গীভূত করে নেওয়া” হিসাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে, প্রাসঙ্গিক পরিপ্রেক্ষিতের উল্লেখ থেকে যদিও বিপরীতটাই স্বাভাবিক হত বলে মনে হয়। লেখকের মার্কসবাদী পরিচিতি পরিষ্কার হয় শ্রী কে ভেনুর প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকারের মধ্যে দিয়ে। তাঁর ভাষায়, “মার্কসবাদী মৌলবাদ তথা নেতৃত্বের “বিপ্লবী কর্তৃত্বের” ধারণার বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁর পথপ্রদশন ও নেতৃত্ব ছাড়া আমার পক্ষে অনেক মার্কসবাদী অন্ধবিশ্বাসকেই প্রশ্ন করে ওঠা সম্ভব হত না।” এ প্রসঙ্গে আরও কথা পরে।

আম্বেদকরের পুনর্মূল্যায়ন

এগোনো যাক। বইটির প্রথম অংশে গান্ধী ও গান্ধীবাদের বিরুদ্ধে আম্বেদকরের সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা রয়েছে। ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এই সংগ্রামের বর্ণনা রয়েছে আম্বেদকরের কংগ্রেস, গান্ধী ও আস্পৃশ্যরা শীর্ষক বইটিতে। দিল্লীর এক লাইব্রেরী থেকে বইটির আদি সংস্করণের এক পুরোনো কপি লেখক জোগাড় করেছেন। ব্যাপারটা উল্লেখযোগ্য, কেননা লেখক দাবি করেন যে পরবর্তী সংস্করণগুলিতে এর বিষয়বস্তুকে পাল্টে দেওয়ার ও লঘু করার চেষ্টা হয়েছে।

লেখকের দাবি, শাসকশ্রেণী, কংগ্রেস ও গান্ধীবাদ সম্পর্কে ডঃ আম্বেদকরের বিশ্লেষণ ও সূত্রায়নগুলি স্বীকৃত আম্বেদকরপন্থী অবস্থানের থেকে অনেকাংশেই পৃথক। তাছাড়া, “পশ্চিমী সংসদীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন এবং প্যারি কমিউন ও সোভিয়েত ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর অনুমোদসূচক উল্লেখ আম্বেদকরকে কমিউনিস্ট-বিরোধী হিসাবে উপস্থাপিত করার সমস্ত তত্ত্বকে নাকচ করে দিয়েছে।”

বোঝা যায়, গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি মূলত ছিল তথাকথিত “গঠনমূলক কাজের” মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের কিছু সংস্কারসাধন করা, যাতে স্বাধীনতা সংগ্রামে কংগ্রেসের উচ্চবর্ণ নেতৃত্বের পিছনে অস্পৃশ্যদের সমর্থন আদায় করা যায়। অন্যদিকে, আম্বেদকরের প্রচেষ্টা ছিল হিন্দু ধর্মের আমূল পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে জাতিভেদ প্রথার বিলোপসাধন এবং দলিতদের ক্রমবর্ধমান আশা-আকাঙ্খাকে একটি রাজনৈতিক মঞ্চে উপস্থাপিত করা। গান্ধী ও আম্বেদকরের দৃষ্টিভঙ্গির এই বৈপরীত্যই তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ককে তথা মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে এবং ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ককে নির্ধারিত করেছে।

গান্ধীর অর্থনৈতিক দর্শন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আম্বেদকর লিখেছিলেন, “সমস্ত অর্থনৈতিক অন্যায়ের মূলে যন্ত্র ও যন্ত্রনির্ভর সভ্যতা – এই গান্ধীবাদী বিশ্লেষণের মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। এগুলি পুরোনো ও বস্তাপচা যুক্তি; রুশো, পুশকিন, তলস্তয়ের পুনরাবৃত্তি। তাঁর অর্থনৈতিক ধারণা নিতান্তই ভ্রান্ত, কারণ যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন ও সভ্যতা কর্তৃক সৃষ্ট অমঙ্গলগুলির জন্য যন্ত্রকে দায়ী করা চলে না। ... এর মূলে রয়েছে একটি ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা, যা ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত লাভের পিছনে ছোটাকে এক মহান ও পবিত্র ব্যাপার করে তুলেছে ... সুতরাং যন্ত্র ও সভ্যতাকে বর্জন করেই এর সমাধান করা যাবে না। প্রয়োজন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন, যাতে সমস্ত সুযোগসুবিধা মুষ্টিমেয়ের করায়ত্ত না হয়ে সকলের মধ্যে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে”।

গান্ধীর সঙ্গে সংঘাতে আম্বেদকরকে নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক র্র্যাডিক্যাল সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মসূচির অন্যতম প্রবক্তা হিসাবে দেখা যায়।

হরিজন থেকে দলিত – এই রূপান্তরের মধ্যে নিহিত রয়েছে অস্পৃশ্যদের আত্মোপলব্ধির সমগ্র প্রক্রিয়াটি। আর এই রূপান্তরের পিছনে প্রধান প্রেরণা হিসাবে থেকেছেন আম্বেদকর স্বয়ং। তিনিই সম্ভবত প্রথম দলিত নেতা যিনি দলিতদের সামাজিক জাগরণকে তাঁদের রাজনৈতিক আত্মঘোষণার রূপ দিতে যথেষ্ট সফল হয়েছিলেন।

আম্বেদকরের অপর গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনা। আধুনিক ভারত সম্পর্কে নেহরুর বীক্ষার তিনিও অংশীদার ছিলেন এবং কোনো কোনো দিক থেকে তিনি নেহরুর চেয়ে বেশি দূরদৃষ্টি দেখিয়েছিলেন। ভারতের আত্মাবিষ্কারের ওপর নেহরুর জোর দেওয়ার বিপরীতে তিনি ঘোষণা করেন, “আমরা যদি মনে করি যে আমরা একটা জাতি হয়ে উঠেছি, সেটা নিছকই কল্পনাবিলাস। আমরা জাতি হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় থাকার চেষ্টা করতে পারি মাত্র”।

তিনি সংবিধান-নির্ভর রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ান, এক শক্তিশালী কেন্দ্রের কথা বলেন এবং এমন এক অর্থনৈতিক কর্মসূচির পক্ষে রায় দেন যার মূল কথা হবে জমির জাতীকরণ ও সমবায় ভিত্তিতে চাষের জন্য তা কৃষকদের মধ্যে বণ্টন তথা বুনিয়াদী শিল্পের জাতীয়করণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, নিপীড়িত শ্রেণীগুলির অনুকূলে রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক পদক্ষেপগুলির পাশাপাশি ঐরকম এক অর্থনৈতিক কর্মসূচি ‘জাতের বিলোপ’ ঘটাবে, আর সেটাই ছিল তাঁর অন্তিম লক্ষ্য।

দলিতদের সামাজিক মুক্তির জন্য সংগ্রামই ছিল তাঁর জীবনের ধ্যানজ্ঞান। তাই রক্ষণশীল শক্তিগুলির চাপে নেহরু হিন্দু নাগরিক আইনসংক্রান্ত বিলে সম্মতি দেওয়ার পর তিনি নেহরুর সঙ্গ ত্যাগ করেন। এই ঘটনায় আম্বেদকরের এই ধারণা আরও দৃঢ়মূল হয় যে জাতপাত হিন্দু ধর্মের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আর তাই এর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করা ছাড়া দলিতদের গত্যন্তর নেই।

এই কারণে তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি এই ধর্মের এক আধুনিক ব্যাখ্যা দেন ও আশা প্রকাশ করেন যে তা দলিতদের মধ্যে এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক জাগরণের জন্ম দেবে। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জগতে তিনি নিপীড়িত শ্রেণীগুলির স্বাধীন গণতান্ত্রিক দল হিসাবে রিপাবলিকান পার্টি গড়ে তোলেন।

এইভাবে আম্বেদকরের সংগ্রাম তার চরম শিখরে পৌঁছায়। দুর্ভাগ্যবশত, একমাত্র তাঁর নিজের সম্প্রদায় মাহাররাই তাঁর সঙ্গে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। আর তাঁর মৃত্যুর পর রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে প্রতিফলিত তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলন বিভাজনের সম্মুখীন হয় এবং কংগ্রেস তাকে গ্রাস করে নেয়।

শ্রেণীগত বিচারে আম্বেদকর দলিতদের পেটিবুর্জোয়া অংশেরই প্রতিনিধিত্ব করেন, যার মধ্যে ছোটো ও মাঝারি কৃষকরাও রয়েছেন। তাঁদের নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক অবস্থানের মধ্যেই রয়েছে আম্বেদকরের রাডিক্যালিজমের শিকড়, আবার সেটাই তাঁর সীমাবদ্ধতারও উৎস। তৎকালীন পরিস্থিতিতে তিনি কেবলমাত্র পুঁজিবাদের পরিপূর্ণ বিকাশ ও এক কল্যাণমূলক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের জন্যই প্রচেষ্টা চালাতে পারতেন, যা যুগ-সঞ্চিত স্থবিরতা ও জড়তা কাটাতে হাতিয়ার হিসাবে কাজ করবে। কমিউনিস্ট অনুশীলনের কিছু কিছু দিক সম্পর্কে অনুমোদনসূচক উল্লেখ ও সমাজতান্ত্রিক পরিভাষার ব্যবহার তাঁর র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মর্মবস্তুরই পরিচায়ক। এর অর্থ কিন্তু আম্বেদকরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো নয়, বরং এই মূল্যায়ন তাঁকে সমকালের অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের চেয়ে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে, যাঁরা আম্বেদকরের নিজের ভাষায় “ব্রাহ্মণ-বেনিয়া আঁতাতকে” অক্ষুণ্ণ রেখে পুঁজিবাদী বিকাশের এক রক্ষণশীল পথের ওকালতি করতেন।

আম্বেদকরের দোদুল্যমানতা, তাঁর আপোশ ও শেষপর্যন্ত ধর্মানুশীলনকে আশ্রয় করা, এ সবকিছুরও মূলে রয়েছে তাঁর অস্তিত্বের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট। স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিকল্প রণনীতি রচনা করতে গিয়ে একজন দলিত পেটিবুর্জোয়া হিসাবে তাঁর সহজাত সীমাবদ্ধতা কখনও তাঁকে গান্ধী ও কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে, আবার কখনও ব্রিটিশের ওপর আস্থা রাখতে বাধ্য করেছে। এই বিকল্প রণনীতি রচনা করা সম্ভব ছিল একমাত্র কমিউনিস্টদের পক্ষেই, যাঁরা ছিলেন ভারতের গ্রামীণ ও শহুরে সর্বহারার প্রতিনিধি, যাঁদের একটা বড় অংশই দলিত। সব ধরনের র্র্যাডিক্যাল বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক আঁতাত এই বিকল্প রণনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হওয়া উচিত ছিল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই দায়িত্ব গ্রহণে ব্যর্থ হয়। তবে সে এক ভিন্ন কাহিনী।

লেখকের আক্ষেপ, “আম্বেদকরবাদ বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক চেতনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে”, কেননা, “কৃষক শ্রেণী-উৎসের দ্বারা নির্ধারিত সীমাকে তিনি অতিক্রম করে যেতে পারেননি”।

যে সীমানা অতিক্রম করতে আম্বেদকর ব্যর্থ হয়েছেন, তা অতিক্রম করতে আমাদের লেখক এক দুঃসাহসিক তাত্ত্বিক অভিযানে নেমেছেন। তিনি শুরু করেছেন এক বিচিত্র বিশ্লেষণ দিয়ে।

“আম্বেদকরবাদের ভিত্তি এমন কোনো শ্রেণীর মধ্যে ছিল না যা পূর্ণ ঊর্ধ্বগতিসম্পন্ন – যে শ্রেণীর, বা এমনকি সেই শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিবিশেষ বা কোনো ক্ষুদ্র অংশের পক্ষে বুর্জোয়া ব্যবস্থার সম্পূর্ণ অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়া সম্ভব। তা ছিল এমন এক কৃষক সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী, যা অংশত সর্বহারাকরণের পথগামী ও অংশত সম্পত্তিচ্যুত, যার সর্বোচ্চ অংশেরও উন্নতির আকাঙ্খা অপূর্ণই থেকে গেছে। এই ব্যাপারটাই অস্পৃশ্য সম্প্রদায় ও শাসক বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে আঁতাতের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই কারণেই শাসক শ্রেণীগুলির সঙ্গে প্রতিটি মুলাকাতই ডঃ আম্বেদকরকে তাদের কাছ থেকে আরও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এটাই আম্বেদকরবাদের মধ্যে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার এক মহান সম্ভাবনা এনে দিয়েছে”।

এইভাবে ঐ সম্ভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করার পর লেখক মার্কস, প্যারি কমিউন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে আম্বেদকরের কিছু অনুমোদনসূচক উল্লেখকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছেন। ব্রাহ্মণ্যবাদ ও পুঁজিবাদ এই দুই শত্রুর বিরুদ্ধে আম্বেদকরের সমালোচনা এবং একটি “সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচির” পক্ষে তাঁর রায়ের সঙ্গে মিলিয়ে এই সবকিছুকে সাম্যবাদের পথে আম্বেদকরের উত্তরণের পরিচায়ক হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এমনকি তাঁর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণকেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে সাধারণভাবে মার্কসবাদের ও নির্দিষ্টভাবে ভারতে তার অনুশীলনের তুলে ধরা সমস্যাবলীর সমাধান হিসাবে। তাঁর ধর্মীয়-রাজনৈতিক অনুশীলনকেও দেখানো হয়েছে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অগ্রদূত হিসাবে, মার্কসবাদী মতাদর্শে ও আন্দোলনে গণতান্ত্রিকতার পুনরুত্থানের অগ্রদূত হিসাবে। “একদিক থেকে আম্বেদকর কর্তৃক বৌদ্ধধর্ম পুনরুদ্ধার মাও-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পূর্বসূরী”। এইভাবে আমাদের লেখক মার্কসবাদ ও আম্বেদকরবাদের সমন্বয়ের ভিত্তি স্থাপন করেছেন এবং পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে অত্যন্ত সুকৌশলে সেই কাজ সম্পন্ন করেছেন।

এক দলিত মহা-ঐক্যের সন্ধানে

লেখক গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন যে, “আম্বেদকরের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চালু করা হল এবং কংগ্রেস ‘সমাজতন্ত্রকে’ বরণ করল। অনগ্রসর শ্রেণীগুলির জন্য সংরক্ষণের জন্য কাকা কালেলকর কমিশন গঠিত হল। প্রায় ঐ সময়েই নেহরু সরকার দিল্লীতে বুদ্ধের ২৫০০তম মহাপরিনির্বাণ বার্ষিকী উদযাপন করে। ... সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সহযোগিতাও বৃদ্ধি পায়”। এরপরই তিনি এর এক উদ্ভট ব্যাখ্যা হাজির করেছেন, “ভারতের শাসকশ্রেণীগুলি স্তালিনের সঙ্গে আপোশ করে নিয়ে আম্বেদকরকে উৎখাত করে”।

আম্বেদকর-উত্তর পর্যায়ের ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেখক বিভিন্ন অনগ্রসর জাতের অগ্রগতি সঠিকভাবেই লক্ষ্য করেছেন।

“কেরলে সংখ্যাগত দিক থেকে শক্তিশালী শূদ্র সম্প্রদায় সাবর্ণ গোষ্ঠীতে উন্নীত হয়েছে, বিশেষত এই কারণে যে ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বেনিয়া সম্প্রদায় সংখ্যাগতভাবে নগণ্য। যে নায়ার সম্প্রদায়কে এককালে “দেবতারা” দূষিত বলে মনে করত, তারাই এখন প্রায় “পৃথিবীর বুকে দেবতার” সমতুল। ... এঝাভা নামক অপর এক অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ও এখন আর্থ-সামাজিক মানদণ্ডে অনেক এগিয়ে গেছে”।

কেরলের ক্ষেত্রে যে কথা খাটে, ভারতের অন্যান্য অংশেও সে কথা বিভিন্ন মাত্রায় খাটে। ভূমি-সংস্কার তথা আর্থ-সামাজিক অন্যান্য পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনের ফলেই বেশ কিছু অনগ্রসর জাতের এই অগ্রগতি ঘটেছে। হিন্দী বলয়ে এই কৃতিত্ব মূলত লোহিয়াবাদী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের।

সমাজে যে কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যম্ভাবীভাবেই শাসক শ্রেণীগুলির সামাজিক গঠন ব্যাপকতর ভিত্তিতে পুরর্গঠিত হয়। ব্রিটিশ-উত্তর ভারতও কেবল ব্রিটিশ যুগের পুরোনো সামাজিক আঁতাতের ভিত্তিতে টিকে থাকতে পারত না। সুতরাং কয়েকটি অনগ্রসর জাতের এই অগ্রগতি ও তাদের সুবিধাভোগী অংশের শাসক শ্রেণীগুলিতে স্থান পাওয়া ছিল এক অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া। কোনো কোনো রাজ্যে অগ্রসর-অনগ্রসর মেরুকরণ স্পষ্টতর করা ছাড়াও এই প্রক্রিয়া এতদিনকার অনগ্রসর সম্প্রদায়গুলির মধ্যেই ক্রমবর্ধমান জাত-শ্রেণী বিভাজনের জন্ম দেয়। ক্ষেতমজুর প্রধান দলিত সম্প্রদায় ও কৃষিতে বিকাশনীতির সর্বাধিক সুবিধাভোগী মধ্যবর্তী জাতের সম্পন্ন কৃষকদের মধ্যে সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

লেখক অবশ্য কিছু দলিত জাত, গোষ্ঠী ও ব্যক্তিবিশেষের শাসনব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে পড়ার ঘটনাকে ধূর্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক শ্রেণীগুলির “সুচতুর চালের” ফলশ্রুতি হিসাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। দলিত জাত বলতে লেখক অস্পৃশ্য ও শূদ্র জাতগুলির, অর্থাৎ সরকারি ভাষায়, তফশিলী জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর সামগ্রিকতাকেই বোঝাতে চেয়েছেন এবং তিনি এমন এক তাত্ত্বিক অনুশীলনের সন্ধান করেছেন যা এক দলিত মহা-ঐক্যের বার্তাবহ। আর এটি তিনি খুঁজে পেয়েছেন বহুজন সমাজ পার্টির মধ্যে।

“রিপাবলিকান আন্দোলন ধাক্কা খায় যুক্তমোর্চার প্রশ্নটিতে এসে। ডঃ আম্বেদকরের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বঞ্চিত শ্রেণীগুলির শাসক শ্রেণী হয়ে ওঠা, আর এই উদ্দেশ্যেই এই পার্টির জন্ম। কিন্তু সমাজের নিপীড়িত অংশগুলির প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক শক্তিগুলির সঙ্গে আঁতাত ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। ডঃ আম্বেদকর ঐ দিশা দিতে পারেননি, তাঁর পার্টিও এই রণনীতি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়নি। যেটুকু আঁতাত তাঁরা করেছেন তা ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকশ্রেণীর পার্টিগুলির সঙ্গে। এর বিকল্প ছিল পার্টির কাঠামোটিকেই বিভিন্ন শোষিত ও নিপীড়িত শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের যুক্তমঞ্চ হিসাবে খাড়া করা। বহুজন সমাজ পার্টি ঠিক এটাই করতে পেরেছে। এইভাবে বিএসপি আম্বেদকরপন্থী অনুশীলনের ক্ষেত্রে এক বিশেষ তাত্ত্বিক অগ্রগতি হিসাবে হাজির হয়েছে। বিএসপি-র লক্ষ্য তফশিলী জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে নিয়ে এক ব্যাপকতর মঞ্চ গড়ে তোলা। ‘বিভেদ সৃষ্টি করে শাসন কর’ ভারতের শাসক শ্রেণীগুলির এই রাজনীতির এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী তাত্ত্বিক জবাব”।

তা ক্রমবর্ধমান সামাজিক বিভাজনের মোকাবিলা করে লেখকের সাধের দলিত মহা-ঐক্য গড়ে তুলতে ও তাকে টিকিয়ে রাখতে বিএসপি কতদূর সফল হবে সেটা দেখা এখনও বাকি, কিন্তু প্রয়োজনবাদী এক জগাখিচু়ড়িকে আম্বেদকরকে পেরিয়ে যাওয়া এক বিরাট তাত্ত্বিক অগ্রগতি হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা চূড়ান্ত তাত্ত্বিক বাতুলতা। ডঃ আম্বেদকর সমাজের নিপীড়িত অংশগুলির প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক শক্তিগুলির সঙ্গে আঁতাতের দিশা দিতে পারেননি এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকশ্রেণীর পার্টিগুলিকেই আঁকড়ে থেকেছেন, লেখকের এই অভিযোগ আম্বেদকরের এক অনৈতিহাসিক মূল্যায়নকেই শুধু নয়, সত্যেরও অপলাপ।

বিএসপি-কে “সবচেয়ে শক্তিশালী তাত্ত্বিক জবাব” ইত্যাদি আখ্যা দেওয়ার অব্যবহিত পরেই এক নিখুঁত তাত্ত্বিক ডিগবাজি খেয়ে লেখক চলে গেছেন জনতা দলের প্রশংসায়। তাঁরা নাকি “মণ্ডল-মসজিদ প্রচার ধারাকে” সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে “(বিএসপি-র) অনুরূপ মঞ্চকে” ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছেন। উপরন্তু, ওপর থেকে আসা জনতা দলের এই উদ্যোগ তৃণমূল স্তরে কাঁসিরামের সংগ্রামের চেয়ে বেশি সাড়া জাগিয়েছে। তাছাড়া, বিএসপি-র পার্টিজান আচরণ দলিত সম্প্রদায়ের বাইরে কোনো মিত্র জোটাতে পারেনি (গুরুত্ব আমাদের)। সমস্ত নিপীড়িত সম্প্রদায়ের সাধারণ স্বার্থের প্রতিভু এক সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট সামাজিক ন্যায়ের মঞ্চকে তুলে ধরতে জনতা নেতৃত্বকে বাধ্য করা নিঃসন্দেহে এক বিরাট রাজনৈতিক কৃতিত্ব। উত্তর ভারতের জঙ্গী সমাজবাদী ঐতিহ্যই এই মতাদর্শগত অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়”।

মণ্ডল বাতিক

জনতা দলের প্রায় মুখপাত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে লেখক জনতা দলের সামাজিক ন্যায়ের মঞ্চের সাফল্যের এক তালিকা হাজির করেছেন। আম্বেদরকে ভারতরত্ন প্রদান, তাঁর জন্মশতবর্ষ উদযাপন উৎসবের আয়োজন, গ্রামাঞ্চল এবং তফসিলী জাতি ও উপজাতির জন্য আনুপাতিক যোজনা বরাদ্দ, বাঁধা মজুর, ঠিকা মজুর ও ক্ষেত মজুরদের জন্য পর্যাপ্ত সাহায্যদান, সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য সাহায্য (প্রস্তাবিত), কাজের অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতিদান (প্রস্তাবিত), কৃষকদের জন্য ব্যাপক সুযোগসুবিধা, বিরাট সাক্ষরতা অভিযান (প্রস্তাবিত), নিপীড়িত জাতিগুলির জন্য কিছু হাঁফ ছাড়ার সুযোগ, বাবরি মসজিদ প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ, ইত্যাদি। বিহারের জনতা সরকারের বিশেষ প্রশংসা করা হয়েছে, কেননা তারা বিচারবিভাগকেও সংরক্ষণের অধীনে এনেছে এবং তফশিলী জাতি ও উপজাতির জন্য আনুপাতিক যোজনা বরাদ্দের নীতি বাস্তবে রূপায়ন করেছে। লেখকের মতে, “এই সমস্ত পদক্ষেপের পথ ধরেই আসে মণ্ডল কর্মসূচি। এই রাজনৈতিক স্লোগান ও নির্দিষ্ট দিশা স্থিতাবস্থার শক্তিগুলির কাছে এক বাস্তব বিপদ হিসাবে হাজির হয়। এরই ফলে শাসক শ্রেণীগুলি জনতা দলকে ক্ষমতাচ্যুত করার ও ধ্বংস করার চক্রান্ত করতে শুরু করে”। এখন, উল্লিখিত পদক্ষেপগুলির পথ ধরেই মণ্ডল কর্মসূচি আসে, নাকি এক ৠাডিক্যাল আর্থ-সামাজিক কর্মসূচির বিনিময়ে, বিশেষত কাজের অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এড়াতেই এর উপস্থাপনা, সে প্রশ্নের মীমাংসা এখনও বাকি। এই রাজনৈতিক স্লোগান ও নির্দিষ্ট দিশা স্থিতাবস্থার শক্তিগুলির কাছে এক বাস্তব বিপদ হিসাবে হাজির হয়, নাকি কিছু কিছু অনগ্রসর শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ক্ষমতার কাঠামোয় নতুন ভারসাম্য আনার হাতিয়ার হিসাবে এর জন্ম, সে প্রশ্নও এখনও বিচারসাপেক্ষ। কংগ্রেস সরকার কর্তৃক মণ্ডল সুপারিশগুলির রূপায়ন দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। জনতা দলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হিসাবে অবশিষ্ট আছে সুবিধাভোগী স্তরের ধারণার বিরোধিতা করা, যা এই প্রক্রিয়ায় তার প্রকৃত মর্মবস্তুকেই উন্মোচিত করেছে।

আমাদের লেখকের মতে অবশ্য মণ্ডল এমন এক কেন্দ্রীয় বিষয়, যা শুধুমাত্র ভারতীয় সমাজেই নয়, কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যেও মেরুকরণ ঘটিয়েছে।

“দলিতদের মধ্যে ভিত্তিসম্পন্ন এই (নকশালপন্থী) আন্দোলনগুলি মণ্ডল সংরক্ষণকে এক গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ হিসাবে সমর্থন করেছে, আর শহুরে শ্রমিকদের মধ্যে ভিত্তিসম্পন্ন প্রথাগত কমিউনিস্টরা মণ্ডলের বিরোধিতা করেছে”। “প্রথাগত কমিউনিস্ট পার্টিগুলি দ্বিধায় পড়ে, এবং সিপিআই(এম) নেতৃত্ব ও এমনকি নকশালপন্থী সংগঠন ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্টও কংগ্রেস ও বিজেপির তুলে ধরা ‘অর্থনৈতিক মানদণ্ডের’ দিকেই ঝোঁকে”।

নিজের তাত্ত্বিক কাঠামোর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য তথ্যকে বিকৃত করার এটা একটা স্পষ্ট নিদর্শন। মণ্ডল ইস্যুতে সিপিআই জনতা দলকে পুরোপুরি সমর্থন জানায়, এমনকি সুবিধাভোগী স্তর সংক্রান্ত রায় ও তথাকথিত অর্থনৈতিক মানদণ্ডেরও তারা প্রকাশ্যে বিরোধিতা করে। সিপিআই(এম) কখনই মণ্ডল সুপারিশের বিরোধিতা করেনি। অনগ্রসর জাতগুলির মধ্যে স্তরবিভাগের পরিপ্রেক্ষিতেই তারা অর্থনৈতিক মানদণ্ডের কথা বলেছে, আর তাই তারা সুবিধাভোগী স্তরের রায়কেও স্বাগত জানায়। ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট কখনই অর্থনৈতিক মানদণ্ডের দিকে ঝোঁকেনি। তারা বরং উচ্চবর্ণের অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর অংশের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ওকালতি করায় ভি পি সিং-এর সমালোচনা করে, এবং এই দৃঢ় অবস্থান নেয় যে সামাজিক ও শিক্ষাগত অনগ্রসরতাই সংরক্ষণের একমাত্র ভিত্তি হতে পারে।

আমাদের পার্টি অবশ্যই সুবিধাভোগী স্তরের রায়কে স্বাগত জানিয়েছিল কারণ শক্তিশালী অনগ্রসর সম্প্রদায়গুলির মধ্যে শ্রেণীবিভাজনকে ত্বরান্বিত করে এমন যে কোনো পদক্ষেপকেই মার্কসবাদীরা স্বাগত জানায়। আমরা জানতাম যে ক্ষমতার কাঠামোয় এক পুনর্বিন্যাসের পরিস্থিতি পেকে উঠেছিল, ভি পি সিং-এর ভূমিকা ছিল কেবল অনুঘটকের। তাই আমরা মণ্ডলকে কোনো সমাজবিপ্লবের অগ্রদূত হিসাবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করি, এক বুর্জোয়া-জমিদার গঠন হিসাবে জনতা দলের ভণ্ডামির স্বরূপ উন্মোচন করতে থাকি এবং আমাদের পার্টির মতাদর্শগত-রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক স্বাধীনতাকে সযত্নে রক্ষা করে চলি।

অনগ্রসরবাদের শক্তিশালী প্রত্যাঘাত সত্ত্বেও, বিহারে জনতা দল আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করা সত্ত্বেও এবং কয়েকজন বিধায়কের দলত্যাগ করে জনতা দলে যোগ দেওয়ার মতো মূল্য দিয়েও, আমাদের পার্টি তার অবস্থানে দৃঢ় থাকে। মণ্ডল উচ্ছ্বাস থিতিয়ে আসার পর আমাদের পার্টি আবার বিহারে দ্রুত অগ্রগতির পথে ফিরে এসেছে। বিপরীতে, জনতা দলের ধামা ধরে সিপিআই-এর প্রথাগত গণভিত্তি আজ প্রায় নিঃশেষ হতে চলেছে, তারা এখন বিভাজনের ও সম্পূর্ণ দিশাহীনতার বিপদের সম্মুখীন।

লেখক জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কারণ “তারা এ প্রশ্নে বিচারবিভাগের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে অন্ধ্র বনধ ডাকে। ... মণ্ডল ইস্যুর সমর্থনে জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর সভায় জনতা দল নেতারা ভাষণ দেন”। অন্য যে নকশাল গোষ্ঠীটি লেখকের প্রশংসা অর্জন করেছে তা অবশ্যই এমসিসি, তারাই নাকি “বিহারে উচ্চবর্ণের অত্যাচারের বিরুদ্ধে দলিতদের প্রতিরোধে” নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমরা সত্যশোধক কমিউনিস্ট পার্টিরও উল্লেখ দেখতে পাই, যারা নাকি মার্কস-ফুলে-আম্বেদকরের মতাদর্শ অনুসরণ করে “সংসদীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সামনে এক মতাদর্শগত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে”।

এইভাবে লেখক তাঁর সংশ্লেষণ প্রকল্পের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছেন, এবং এখানে এসে তিনি তাঁর ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। উদাহরণস্বরূপ তুলে ধরা যাক একটি অতুলনীয় রত্নকে : “দলিত বিদ্রোহের সঙ্গীত যখন আকাশে-বাতাসে অনুরণন তুলছে, (দলিত) প্যান্থার, নকশালপন্থী ও (খালিস্তানী ও কাশ্মীরী) জঙ্গীদের অগ্নিঝঞ্ঝা তখন এক তাত্ত্বিক রূপরেখার সন্ধান পেল। দলিত সেনা ও আম্বেদকর শতবার্ষিকী সমারোহের মধ্যে দিয়ে রামবিলাস পাসোয়ান তত্ত্ব ও অনুশীলনের এই উদীয়মান ঐক্যকেই ধরার চেষ্টা করেছেন”।

আম্বেদকর থেকে কাঁসিরাম হয়ে রামবিলাস পাসোয়ান! নিঃসন্দেহে এ এক অপূর্ব উত্তরণ!

জাত ও শ্রেণীর বৈপরীত্য

জাত সম্বন্ধে লেখক কিছু অভিনব ধারণা উপস্থিত করেছেন। “মার্কস যেখানে জাতপ্রথাকে ভারতের শক্তি ও প্রগতির পথে নির্ধারক বাধা হিসাবে দেখেছেন, সেখানে তাঁরা (ভারতীয় মার্কসবাদীরা) জাতকে উপরিকাঠামোর ব্যাপার বলেই গণ্য করেছেন। ... ... জাত হল একটি উৎপাদন সম্পর্ক, সুতরাং তা উপরিকাঠামোর ব্যাপার নয়, বরং আর্থ-সামাজিক কাঠামোরই অন্তর্ভুক্ত। ভারতীয় মার্কসবাদীদের সবচেয়ে বড় তাত্ত্বিক ব্যর্থতা হল জাতকে সমাজের মূল কাঠামোর বিষয় হিসাবে গণ্য করতে অস্বীকার করা”। তা মার্কসবাদী আলোচনায় আমরা অর্থনৈতিক ভিত্তি আর তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা উপরিকাঠামোর কথা অবশ্যই শুনেছি, কিন্তু আর্থ-সামাজিক ভিত্তি বলে কিছু তো কখনও শুনিনি। জাতকে সামাজিক তথা অর্থনৈতিক ভিত্তির সঙ্গে যুক্ত করতে গিয়ে লেখক নিজেই বিভ্রান্ত বলে মনে হয়। এই দ্বৈতচরিত্রকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে :

“এক্ষেত্রে, একদিকে উৎপাদনের উপকরণ ও পেশার স্থায়ী বিভাজনের প্রতিষ্ঠান হিসাবে জাতপ্রথা ও অন্যদিকে অস্পৃশ্যতা ও বৈষম্যের মানসিকতা হিসাবে জাতপ্রথা, এই দুইয়ের মধ্যে আমাদের পার্থক্য করতে হবে। জাতপ্রথার মধ্যে এই উভয় দিকই বর্তমান। প্রথমটি ভিত্তি এবং দ্বিতীয়টি উপরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত”।

বস্তুত, অর্থনৈতিক উদ্বৃত্তের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে সাম্যভিত্তিক সমাজগুলি শ্রেণীসমাজে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সমস্ত সমাজের ইতিহাসই হল শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস। প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজে অবশ্য উদ্বৃত্ত থেকে সৃষ্ট এই বৈষম্যের সামঞ্জস্য বিধান হত এক সামাজিক স্তরবিন্যাসের মাধ্যমে, যা সামাজিক সম্প্রদায় (সোশ্যাল এস্টেট) নামে পরিচিত। জনগোষ্ঠীগুলির অভ্যন্তরীণ সংহতি চিরায়ত অর্থে শ্রেণী গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উপরন্তু, অর্থনীতি-বহির্ভূত বলপ্রয়োগের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক গঠন এই সামাজিক সম্প্রদায়গুলিকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে জাতপ্রথায় দৈবমহিমা আরোপ ও বিশেষত স্বৈরাচারী কেন্দ্রীয় শাসন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমাজগুলির সহাবস্থান এই স্তরবিন্যাসকে আরও বেশি স্থায়িত্ব দিয়েছে।

উৎপাদনের ধরনের মধ্যেই শ্রেণীর উৎস। বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্বের অর্থনৈতিক শর্তাবলীই তাদের পরস্পর বৈরী সম্পর্কে আবদ্ধ করে এবং এই প্রক্রিয়ায় সমাজে শ্রেণীবিভাজনকে ত্বরান্বিত করে। বিপরীতে, সামাজিক সম্প্রদায় বা জাতগুলি বণ্টনের ধরনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ফলে ‘বিশুদ্ধ’ বর্গ হিসাবে শ্রেণী গঠনে বাধা দেয়। সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যেই শ্রেণীসংগ্রাম নিহিত থাকে এবং এইভাবে তা বহু জটিল রূপ নেয়।

আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ শ্রেণীবিভাজনের এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এই প্রথম শ্রেণীগুলির আত্মোপলব্ধির এবং প্রকাশ্য শ্রেণীযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ভারতবর্ষেও পুঁজিবাদের উদ্ভব ও বৃহদায়তন শিল্প উৎপাদন এই প্রথম জাত-পেশায় ভাঙন ধরায় এবং এক নতুন শ্রেণী আত্মপ্রকাশ করে, সে হল শিল্পীয় সর্বহারা। বাগিচা, খনি, বস্ত্র ও পাটশিল্পে নিযুক্ত প্রথম প্রজন্মের সর্বহারাদের অধিকাংশই এসেছিলেন অস্পৃ্শ্য ও শূদ্র জাতগুলি থেকে। পরবর্তীকালে উচ্চতর জাতের মানুষেরাও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।

এইভাবে কারখানাগুলি হয়ে ওঠে জাতপ্রথার বিলোপের সম্ভবনাময় এক সামাজিক কারখানাও। রক্ষণশীল পথে ভারতীয় পুঁজিবাদের বিকাশ শ্রেণীবিভাজনের এই প্রক্রিয়াকে কিছুটা মন্থর করে তোলে। নতুন প্রতিপত্তিশালী সামাজিক শ্রেণীগুলি রাজনৈতিক ক্ষমতায় তাদের বখরার জন্য লড়াইয়ে জাতপাতের সমীকরণকে কাজে লাগানোর ফলে সংসদীয় গণতন্ত্রের অধীনে জাতপ্রথা আরও স্থায়িত্ব অর্জন করে। সুবিধাবাদী বামপন্থীদের অর্থনীতিবাদ ও সংসদসর্বস্বতা শ্রমিকশ্রেণীর আত্মসচেতনতাকে কলুষিত করে। তা সত্ত্বেও, উচ্চবর্ণপ্রধান বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিপরীতে শ্রমিকশ্রেণী আজও জাতগত সত্তার বিলোপের এক প্রধান আধার। বিশ্বায়ন ও উদারনীতিকরণের নতুন যুগ শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠিত অংশটিকেও অসংগঠিত করে তুলতে শুরু করেছে। সুপ্তোত্থিত শ্রমিকশ্রেণীও তার ঐতিহাসিক ব্রতে আবার ব্রতী হয়ে উঠছে।

অতএব, শ্রেণীই হল বুনিয়াদী বর্গ। কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে জাত রূপেই তা অভিব্যক্ত হতে পারে, আবার অন্য কোনো পরিস্থিতিতে এই দুই বর্গ এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যে তারা পরস্পরের মধ্যে ঢুকে যায় আবার পরস্পরকে ছেদও করে। আবার সম্পূর্ণ পৃথক কোনো পরিস্থিতিতে, জাতগুলি ভেঙে গিয়ে শ্রেণী হিসাবে দানা বাঁধতে পারে। এইভাবে উভয়ের মধ্যে বৈপরীত্য চলতেই থাকে, যতদিন না বিনিময়ের ধরনের নিয়ন্ত্রক হিসাবে জাতের অবসান ঘটে।

আমাদের লেখকপ্রবর অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করেন। ভারতীয় পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় বর্গগুলিকে যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করার জন্য তিনি ভারতীয় কমিউনিস্টদের নিন্দা করেছেন এবং ভারতে শিল্পীয় সর্বহারা খোঁজাটা আদৌ সঠিক কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছেন। “তাঁরা (মার্কসবাদীরা) যাঁদের সর্বহারা বলে ধরে নিয়েছেন, ভারতের সেই শিল্প-শ্রমিকশ্রেণী আদতে সর্বহারাই নন। রূপোর চামচ মুখে নিয়েই এই শ্রেণীর জন্ম। জাত পরম্পরার ওপরের দিকেই এর অবস্থান। গ্রামে ও শহরে এদের শুধু ভূসম্পত্তিই ছিল না, এমনকি সাধারণ মানুষ যা থেকে বঞ্চিত সেই মেধাসম্পদেরও এরা ছিল উত্তরাধিকারী। শৃঙ্খল ছাড়া যাদের হারাবার কিছুই নেই, সেই অধিকারচ্যুত সর্বহারাশ্রেণী এটি ছিল না। এটি ছিল এমন এক শ্রেণী যার জঙ্গী মানসিকতা ও চরমপন্থার মূলে ছিল ধনী কৃষক চেতনা, আর গ্রামীণ ভারতে কুলাক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই জঙ্গীপনার অবসান হয়”।

লেখক ভারতীয় ও পশ্চিমী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এক অদ্ভুত পার্থক্যরেখা টেনেছেন। “মানসিক শ্রমশক্তি ছাড়া পশ্চিমী বুদ্ধিজীবীদের আর কিছুই নেই। ভারতবর্ষে জ্ঞান ধর্ম ও দর্শনের সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং বস্তুগত উৎপাদন ও সমাজের জগতে প্রবেশ করে। বিজ্ঞান, জ্ঞান ও দক্ষতা কায়িকশ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রাধান্য অর্জন করে। ... তাই ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে শ্রেণীচ্যুত হওয়া অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে”। এইসব অর্থহীন কথাবার্তার মাথামুণ্ডু উদ্ধার করা দুষ্কর। পশ্চিমী বুদ্ধিজীবীদের এই নির্লজ্জ প্রশস্তি অবশ্য শ্রী লেখকের ‘শ্রেণীচ্যুত’ হয়ে পড়ারই পরিচায়ক। তথাকথিত মানসিক শ্রমশক্তির (!) অধিকারী পশ্চিমী বুদ্ধিজীবীরা মূলত বু্র্জোয়া সমাজের সেবায় নিযুক্ত বুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী ছাড়া কিছুই নন। শ্রমিকশ্রেণীর প্রকাশ্য শ্রেণীযুদ্ধ তাঁদের মধ্যে বিভাজনের সৃষ্টি করে এবং তাঁদের একাংশ শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে যোগ দেন। মার্কস, লেনিন ও অন্যান্য অসংখ্য বুদ্ধিজীবী এই অংশেরই প্রতিনিধি। সর্বহারা বিপ্লব কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছ থেকে তীব্র প্রতিরোধেরই সম্মুখীন হয়ে এসেছে, এবং এখনও হচ্ছে।

বিপরীতে, ভারতীয় পেটিবুর্জোয়া সম্প্রদায় তাদের দোদুল্যমানতা ও উচ্চবর্ণের প্রতি পক্ষপাত সত্ত্বেও অনেক বেশি সংখ্যায় প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ও বাম আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। বিশেষ করে নকশাল আন্দোলন এক বিরাট সংখ্যক পেটিবু্র্জোয়া যুবককে দলিত ভূমিহীন কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম করে তুলেছে।

শিক্ষিত দলিতরা ব্রাহ্মণ্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার ও রাষ্ট্রের উৎকোচ এবং সুযোগসুবিধায় লালিত হয়ে দলিত অভিজাততন্ত্রে পরিণত হওয়ার বিপদ সম্বন্ধে লেখক অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি তুলনা টেনেছেন ভারতীয় দলিত ও পশ্চিমী সর্বহারার মধ্যে! “সাম্প্রতিক অতীতেও যন্ত্র ও শ্রমজাত পণ্যের ওপর তাঁদের যে কর্তৃত্ব ছিল তা পুনরুদ্ধার করতেই সর্বহারা সংগ্রামে নামে। দলিতরা কিন্তু বহু প্রজন্ম ধরেই অধিকারচ্যুত। অতীতের গৌরব, মহিমা ও আত্মসম্মান বিপ্লবী সর্বহারার স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল। কিন্তু প্রজন্ম পরম্পরায় দাসত্ব, অস্পৃশ্যতা ও গোলামীর আবর্তে হারিয়ে যাওয়া মানবিক পরিচয় পুনরুদ্ধারের জন্যই দলিতদের সংগ্রাম। তাঁদের আদর্শচ্যুত করতে ও দলে টানতে শাসকশ্রেণীর যে চক্রান্ত, তার শিকার হয়ে পড়ার মতো দুর্বলতা এই শ্রেণীর ছিল”। অদ্ভুত যুক্তি! পশ্চিমের সবকিছুই ভালো, ভারতের সবকিছুই খারাপ। সমাজগণতন্ত্রের সামাজিক ভিত্তি হিসাবে শ্রমিক অভিজাততন্ত্রের একটা স্তর পশ্চিমেই তাহলে আত্মপ্রকাশ করেছিল কী করে? ভারতে বিপ্লবী সংগ্রামে দলিতরাই বা কী করে ধারাবাহিকভাবে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন? শ্রমজীবী জনগণের একটা অংশ সবসময়েই প্রচলিত ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়ে পড়েন, এর মধ্যে পূর্ব-পশ্চিম বলে কিছু নেই। লেখকের বিশ্লেষণে, সমগ্র দলিত শ্রেণীই “শাসকশ্রেণীর চক্রান্তের শিকার হয়ে পড়ার মতো দুর্বল” বলে নিন্দিত। আশ্চর্যজনকভাবে লেখক এই শ্রেণীর ওপরেই তাঁর ভাষায় “দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের” নেতৃত্ব অর্পণ করেছেন।

দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লব

ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকশ্রেণীগুলির বঞ্চনার শিকার সমস্ত জাত ও স্তরের সমগ্রটিকেই লেখক ‘দলিত’ হিসাবে চিহ্নিত করেন! আর তাই তিনি এক দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ওপর জোর দেন। উচ্চবর্ণ থেকে আসা সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীরা এর কেবলমাত্র দোদুল্যমান ও অনির্ভরশীল মিত্রই হতে পারেন।

অনগ্রসর জাত ও নিপীড়িত সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলির উদীয়মান বু্র্জোয়াদের নিয়ে গঠিত জাতীয় বুর্জোয়াশ্রেণী অবশ্য নিঃসন্দেহে এর দৃঢ় মিত্র হতে পারে। বিশেষত ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন ও কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর ব্রাহ্মণ্য শ্রেণীগুলির ক্রমবর্ধমান কব্জার পরিপ্রেক্ষিতে এটা আরও বেশি সত্য।

দলিত জাতগুলি থেকে আসা গ্রামীণ সর্বহারা তথা অসংগঠিত ও অনিয়মিত (ইনফর্মাল) ক্ষেত্রের শ্রমিকশ্রেণী হবেন এই বিপ্লবের নেতা। আর গরিব কৃষক, আধা-সর্বহারা এবং দলিত ও শূদ্র জাতগুলি থেকে আসা ব্যাপক কৃষক জনতা হবেন এর সবচেয়ে একনিষ্ঠ মিত্র।

এইভাবে সমগ্র বিপ্লবটিকেই ওলটপালট করে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকশ্রেণী অনির্ভরশীল মিত্র, আর জাতীয় বুর্জোয়া দৃঢ় মিত্র! লেখকের দাবি, এই বিপ্লব ব্রাহ্মণ্য সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করবে ও প্রকৃত গণতন্ত্রের পথ তৈরি করবে। কিন্তু লেখক যে ব্যাপারটা স্পষ্টতই এড়িয়ে গেছেন তা হল এই বিপ্লব কোন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে – পুঁজিবাদী না সমাজতান্ত্রিক?

লেখক এইভাবে “শ্রেণীসরলীকরণ” ও “শ্রমিকশ্রেণী কেন্দ্রিকতার” বিপরীতে সমস্ত অনগ্রসর জাত ও সম্প্রদায়ের যুক্তমোর্চার ধারণায় এসে পৌঁছেছেন। একে তিনি ঘোষণা করেছেন মার্কসীয় শাস্ত্রে বৃহত্তম অগ্রগতি হিসাবে। তা এটা মার্কসবাদের বৃহত্তম দুর্গতি বটে।

দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে এসে লেখক আম্বেদকরের কর্মসূচিকে, অর্থাৎ জমির জাতীয়করণ ও বিশেষ রাষ্ট্রীয় সহায়তাসহ তা ভূমিহীন দলিত তথা ব্যাপক কৃষকের মধ্যে বণ্টনের ধারণাকে নাকচ করেছেন। লেখকের বক্তব্য, “দলিতরা উপলব্ধি করেছেন যে তাঁদের মুক্তি রয়েছে জমির মালিকানার মধ্যে, গ্রামীণ ভারতে এরই অর্থ ‘ক্ষমতা’।” আবার, “রাষ্ট্র কর্তৃক জাতীয়করণ করা জমি বণ্টনের যে পরামর্শ আম্বেদকর দিয়েছেন, তা একটি মূল বিষয়কেই ধরতে পারেনি। সেটা হল জনগণের চেতনা, যা জমির জন্য দলিতদের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের মাধ্যমে এক গতিময় বস্তুগত শক্তিতে পরিণত হয়”। লেখকের পরামর্শ অনুযায়ী যা করণীয়, তা হল “ভূমিহীন ও স্বল্প জমিসম্পন্নদের কথামতো (!) জমি বণ্টনের মাধ্যমে কৃষি বিপ্লব। বিভিন্ন কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে জমি বণ্টন করা উচিত জনসংখ্যায় তাঁদের সংখ্যাগত অনুপাতের ভিত্তিতে। উৎপাদন কীভাবে সংগঠিত হবে সে ব্যাপারটা সম্প্রদায়গুলির নিজ নিজ গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে”।

বুনিয়াদী শিল্প জাতীয়করণের যে কর্মসূচি আম্বেদকর রেখেছিলেন, লেখক তারও বিরোধিতা করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি হল, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র সবসময়ে শাসকশ্রেণীগুলির স্বার্থেই ব্যবহৃত হয়। বরং তিনি জনগণের মধ্যে সমহারে শেয়ার বণ্টনের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের কথা বলেছেন।

লেখক এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে বৃহৎ শিল্পগুলিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একমাত্র শিল্প-শ্রমিকশ্রেণীই কৃষিতে বিপ্লবী রূপান্তর ঘটাতে পারে, জাতীয় বুর্জোয়াদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিবর্তন করতে পারে এবং এইভাবে গণতান্ত্রিক থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে উত্তরণ সম্পন্ন করতে পারে। তাই শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্ব নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একে নয়া বলা হয় একমাত্র এই কারণে যে এই বিপ্লব পুঁজিবাদে থেমে না গিয়ে সমাজতন্ত্র পর্যন্ত এগিয়ে যাবে। উৎপাদনের ধরনের নিম্নতর স্তরের সঙ্গে যুক্ত থাকার দরুণ গ্রামীণ ও অসংগঠিত সর্বহারার পক্ষে নিজে থেকে এই রূপান্তর ঘটানো সম্ভব নয়। ভূমিহীনদের কথামতো জমি বণ্টনের কথা বলে ও উৎপাদন-সংগঠনের পুরো ব্যাপারটা কৃষিজীবী সম্প্রদায়গুলির নিজ নিজ গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে লেখকও তাঁদের সীমাবদ্ধতাকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর কর্মসূচি অনগ্রসর জাতের কৃষকদের, যাঁরা নাকি দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের একনিষ্ঠ মিত্র, উচ্চতর স্তরকে সন্তুষ্ট রাখতে যথাস্থিতিবাদের এক কর্মসূচি মাত্র।

রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র নিঃসন্দেহে সবসময়ে শাসকশ্রেণীরই সেবা করে। কিন্তু, একই সঙ্গে তা জাতীয় স্তরে শ্রমিক সংহতিকেও দৃঢ়তর করে এবং তাঁদের এই সমাজতান্ত্রিক চেতনায় শিক্ষিত করে তোলে যে পুঁজিবাদী মালিক অপরিহার্য নয়, শ্রমিকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণাধীনে বেতনভোগী একদল ম্যানেজার শিল্পগুলিকে পরিচালনা করার পক্ষে যথেষ্ট। এই জন্যই লেনিন বলেছেন, রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের থেকে মাত্র একধাপ এগোলেই সমাজতন্ত্র।

লেখকের প্রস্তাব মতো একটি ব্যাপকতম যুক্তমোর্চা যদি আদৌ বাস্তবে রূপ নেয়, তবে তার নেতৃত্ব অনিবার্যভাবেই চলে যাবে জাতীয় বুর্জোয়াদের হাতে এবং গ্রামীণ দরিদ্র জনতার ওপর অনগ্রসর জাতের কুলাকদের প্রাধান্যই সুনিশ্চিত করবে। দলিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি বস্তুত জনতা দলের গণ্ডির মধ্যে সর্বাপেক্ষা চরমপন্থীদেরও সর্বোচ্চ সীমা। লেখকও সেই সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারেননি।

আম্বেদকরের পথ ধরে লেখক “জাতভিত্তিক সমাজের ব্যাকরণের ভিত্তিতে শ্রেণীসংগ্রামের গতিসূত্র মেনে”, বিপ্লবের একটি মডেল গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি যা হাজির করতে পেরেছেন তা হল শ্রেণীসংগ্রামে পূর্ণচ্ছেদ টেনে জাতভিত্তিক সমাজের স্থিতিবিদ্যাকে সম্বল করে সংস্কারের একটি মডেল মাত্র।

এক অনবদ্য সংশ্লেষণ

এই উচ্চাকাঙ্খী সংশ্লেষণ-প্রকল্পের ভিত্তি ছিল একদিকে অর্থনীতিবাদ, সংসদবাদ এবং মার্কসবাদী তত্ত্ব ও অনুশীলনে শিল্পীয় শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বের ধারণা বর্জন, আর অন্যদিকে এক পেটিবুর্জোয়া কৃষক রাজনীতি থেকে মুক্তির চেতনায় আম্বেদকরবাদের উত্তরণ। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে অপমৃত্যু হয় মার্কসবাদের। তারপর মারা পড়ে আম্বেদকরবাদের ৠাডিক্যাল অর্থনৈতিক দিশা, প্রধানত যার ওপরে ভিত্তি করেই আম্বেদকর তাঁর দলিত মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন।

১৪০ পৃষ্ঠা জুড়ে ১৫০ টাকা মূল্যে লেখকের মানসিক শ্রমশক্তির এই কষ্টসাধ্য প্রয়োগের চূড়ান্ত ফসল হল তত্ত্বের স্তরে কে ভেনু আর রামবিলাস পাসোয়ান এবং ব্যবহারিক রাজনীতির স্তরে জনতা দল ও জনযুদ্ধ-এমসিসি-র এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ। এই অশুভ আঁতাতের ইঙ্গিত আমরা বহুদিন থেকেই দিয়ে আসছি। একে প্রকাশ্যে উন্মোচিত করে দেওয়ার জন্য লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ।