(পার্টির ২৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে গুয়াহাটিতে ২২ এপ্রিল, ১৯৯৮ আসাম রাজ্য কমিটি সংগঠিত ক্যাডার প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রদত্ত ভাষণ)
সারাদিন ধরে আপনারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছেন, যার মধ্যে এক স্বতন্ত্র রাজ্যের জন্য আন্দোলন এবং জেলা পরিষদের কাজকর্মের ধারাও রয়েছে। যাই হোক, চিরায়ত মার্কসবাদী উপলব্ধিতে গণতান্ত্রিক বিপ্লব মর্মবস্তুতে যেহেতু বুর্জোয়া বিপ্লব, অর্থাৎ তা দ্রুত পুঁজিবাদী বিকাশের পথ প্রশস্ত করে, তাই বুর্জোয়া শ্রেণীকেই অবশ্যম্ভাবীভাবে এর নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে। কিন্তু, এক সংগঠিত শক্তি হিসাবে সর্বহারার আবির্ভাব এবং প্যারি কমিউনে তাদের ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা বুর্জোয়াদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। সেই সময় থেকেই বুর্জোয়ারা তাদের বিপ্লবী ভূমিকা পরিত্যাগ করেছে এবং তার পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ বিবর্তনমূলক ধারাতেই সামন্ততন্ত্রের রূপান্তরকে বেছে নিয়েছে। এইভাবে এরা সামন্তশক্তিগুলির সঙ্গে এক অনীতিনিষ্ঠ আঁতাতে উপনীত হয়। এই সন্ধিক্ষণেই লেনিনের আবির্ভাব এবং তিনি গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সর্বহারার নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়টি জোরের সাথে তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর আগে আমাদের অবশ্যই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আর যেহেতু বুর্জোয়া শ্রেণীর পক্ষে এই বিপ্লবকে তার যুক্তিসঙ্গত পরিণতিতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়, তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব এখন এসে পড়েছে সর্বহারার কাঁধে। প্রথমে রুশ সর্বহারা, তারপর চীনের সর্বহারা এবং পরবর্তীতে ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশের সর্বহারাও ঐ পথ অনুসরণ করে।
এই প্রশিক্ষণ শিবির থেকে যে প্রশ্ন উঠে এসেছে তা হল, জাতিসত্তার আন্দোলনে, বা আরও যথাযথভাবে বলতে গেলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব প্রদান সঙ্গত হবে কিনা। আমাদের দেশের বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে আসামে এই আন্দোলনগুলি বাস্তব ঘটনা। আমি বলব, এই আন্দোলনগুলিতে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ যেখানেই আসবে তাতে নেতৃত্ব দেওয়া পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত। বিজাতীয় শক্তিগুলির হাতে নেতৃত্ব চলে যেতে দেওয়া এবং তারপর পরিস্থিতি পেকে ওঠার জন্য অপেক্ষা করা এমন এক গোঁড়া তত্বগত পদ্ধতি যা মার্কসবাদের আত্মাকেই নাকচ করে।
কিছু ব্যক্তির কাছে বিধায়ক, সাংসদ এমনকি জেলা পরিষদের সদস্য[১] হওয়া এবং গাড়ি-বাড়ি করাই আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির কাছে লক্ষ্য একেবারেই আলাদা। আমরা দেখতে পাই সংখ্যালঘু জাতিসত্তার আন্দোলনে গরিব কৃষকরা ব্যাপক সংখ্যায় অংশগ্রহণ করছেন এবং তাঁরাই এই আন্দোলনে চালিকা শক্তি। গরিব কৃষকদের সংগঠিত করা, তাঁরা যাতে এক শ্রেণী হিসাবে নিজেদের আত্মঘোষণা করতে পারেন এবং রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন, কমিউনিস্ট পার্টিকে এই বিষয়গুলিই সুনিশ্চিত করতে হবে। এখন এর অর্থ যদি গ্রামীণ দরিদ্রদের জন্য কিছু সংস্কারসাধন এবং তাদের কিছু আর্থিক সহায়তা প্রদান হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়, তবে সেটি হবে চরম মূর্খামি।
আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, কোন ধরনের লোকজন আমাদের অফিসে ভিড় জমাচ্ছেন। তারা কী ঠিকাদারের দল না গরিব মানুষজন? কোন ধরনের মানুষরা আমাদের নেতাদের চারপাশে থাকেন? তারা কী ঠিকাদার না সাধারণ মানুষ? যদি প্রথমোক্তদের উপস্থিতিই প্রকৃত তথ্য হয় তবে হাজারও বিপ্লবী বুলি আউড়ানো সত্ত্বেও আমাদের সরকার ঠিকাদারদের সরকারে পরিণত হবে।
আন্দোলনের পর্যায়ে এবং সরকার পরিচালনার[২] প্রথম পর্যায়েও গ্রামীণ দরিদ্রদের সংগঠিত করার গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু বর্তমানে মনে হয় আমরা এক স্থিতাবস্থার পর্যায়ে প্রবেশ করেছি এবং তা আবার উপদলীয় বিবাদের জন্ম দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, কমিউনিস্ট মানসিকতার যথেষ্ট অবক্ষয় ঘটেছে। অথচ তীব্র আন্দোলনের পর্যায়ে ঐ একই কমরেডরা দৃষ্টান্তমূলক সততার পরিচয় রেখেছেন, আত্মত্যাগ করেছেন এবং কষ্টসাধ্য জীবনধারার মধ্য দিয়ে গেছেন। আমি একথা কখনই বলছি না যে, ব্যক্তি হিসাবে তাঁরা খুব নিকৃষ্ট হয়ে গেছেন। ব্যাধি কিন্তু যথেষ্ট গভীরে বলেই মনে হয়। বস্তুত কমিউনিস্ট বীক্ষার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক শ্রেণী হিসাবে গ্রামীণ দরিদ্রদের সংগঠিত করার পথই ঐক্যকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে পারে এবং গোষ্ঠীগত উপদলীয়তার সমস্যার এক দীর্ঘস্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারে।
গৌরবময় কার্বি আন্দোলন থেকে কিছু মানুষ কেবলমাত্র অর্ধেক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন বলেই মনে হয়। তাঁরা মনে করেন যে, সাংসদ, বিধায়ক অথবা জেলা পরিষদের সদস্য হওয়ার এটিই হল সহজ রাস্তা। কিন্তু তাঁরা চরম ভুল করছেন। কার্বি আন্দোলন এত সহজে গড়ে তোলা যায়নি। এর পিছনে রয়েছে ব্যাপক সংখ্যক ক্যাডারদের কঠোর ও কষ্টসহিষ্ণু পথে গ্রামীণ দরিদ্রদের সংগঠিত করে তোলার এক দীর্ঘ ইতিহাস। অনেকেই ভুলে যেতে চান যে, এক বিপ্লবী মতাদর্শের ভিত্তিতেই এই আন্দোলন সংগঠিত করা হয়েছিল এবং তা দেশের অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তার আন্দোলন, যেমন মিশিং উপজাতিদের আন্দোলন সম্পর্কে আমরা বেশি কিছু জানতে পারি না। আমরা শুধু শুনতে পাই কিছু কথাবার্তা চলছে, কিছু প্রতিনিধি দল দিল্লী যাচ্ছেন, কিছু চুক্তি আসন্ন, ইত্যাদি। কিন্তু আন্দোলন কী অবস্থায় রয়েছে, পার্টি গঠনের ক্ষেত্রেই বা পরিস্থিতি কী রকম? আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করা নিয়ে আপত্তি নেই, কিন্তু এক শক্তিশালী আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে যদি ঐ আলাপ-আলোচনা না চালানো হয় তবে তা এক অনীতিনিষ্ঠ আপোশে পরিণত হতেই বাধ্য হবে। কার্বি আন্দোলন দক্ষতার সঙ্গে আন্দোলন ও আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে সমন্বয় সাধান করতে পেরেছিল এবং অন্যদেরও এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
তথাকথিত প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক। দীর্ঘদিন ধরেই আপনারা আসামে এই প্রগতিশীল আঞ্চলিকতাবাদের শক্তিগুলির অনুসন্ধান করছেন। যাদেরই আমরা আজ প্রগতিশীল আঞ্চলিকতাবাদী হিসাবে আখ্যা দিই, দুদিন বাদেই দেখি তারা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিতে পরিণত হয়ে গেছে। আর তাই দমে না গিয়ে আমরা নিজেরাই প্রগতিশীল আঞ্চলিকতাবাদীতে পরিণত হতে মনস্থির করলাম। যাই হোক, আমি মনে করি প্রগতিশীল আঞ্চলিকতাবাদী শক্তিগুলির স্থায়ী বর্গের সন্ধান করে চলা হবে এক নিষ্ফলা প্রয়াস। আমাদের আন্দোলনের কোনো নির্দিষ্ট পর্যায়ে যে আঞ্চলিক শক্তিই আমাদের সঙ্গে হাত মেলাবে তাদের আমরা প্রগতিশীল হিসাবে আখ্যা দেব। আর এই চরিত্রায়ন ততক্ষণই চলবে যতক্ষণ তারা আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমার মনে হয় এই বিষয়টি বোধহয় আমাদের কৌশলগত লাইনের পর্যালোচনার দাবি রাখে।
আমাদের নিজস্ব গণভিত্তিকে শক্তিশালী করে তোলার উপরই আমরা প্রধান গুরুত্ব আরোপ করব। আসামে আমাদের বেশ কিছু শক্তিশালী দিক রয়েছে। তেল ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে আমাদের পার্টির প্রভাবাধীনে রয়েছে আধুনিক শ্রমিকশ্রেণীর এক শক্তিশালী বাহিনী। আসামের শ্রমিকশ্রেণীর এক ব্যাপক অংশই হল চা-শ্রমিক, আর সেক্ষেত্রেও আমাদের কাজের সূচনা ভালোই হয়েছে। কয়েক বছর আগেও কিছু মানুষ এই ধারণা পোষণ করতেন যে চা-শ্রমিকদের মধ্যে আমাদের প্রবেশ করা প্রচণ্ড কঠিন ব্যাপার। আমার মনে হয়, এখন তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন সেখানে কাজের কী বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। চা বাগানের এক কমরেডের এ ব্যাপারে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তিনি বললেন যে তাঁদের একা একাই কাজ করতে হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট জেলার পার্টি কমিটির কাছ থেকে তাঁরা কোনো সাহায্যই পাচ্ছেন না। শুধুমাত্র লেভি সংগ্রহেই তাঁদের যত আগ্রহ। আর একজন কমরেডও এক অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তুলে ধরেছেন : আমাদের সাংসদ ও বিধায়করা সংসদ বা বিধানসভায় চা বাগান সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলেন না কেন? আমাদের সাংসদ অস্ট্রেলিয়ার ধর্মঘটী শ্রমিকদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তা বেশ ভালো কথা। কিন্তু দেশের মাটিতে কি তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন অথবা সংসদের মধ্যে শ্রমিকদের ইস্যুগুলিকে তুলে ধরেন? এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং আমি মনে করি আমাদের সাংসদ ও বিধায়কদের উচিত শ্রমিক বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করা। এর ফলে শ্রমিকদের মনোবল বাড়বে এবং তা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকেও রক্ষণাত্মক করে তুলবে। আসামে আবার আমাদের এক শক্তিশালী নারী আন্দোলনও রয়েছে এবং মূল ধারার অসমীয়া জনগণের মধ্যেও তার ভালো প্রভাব রয়েছে। এর বাইরেও যদি মূল ধারার অসমীয়া জনগণের মধ্যে আমাদের প্রভাব বাড়ানোর পরিকল্পনা করতে হয় তবে আমার মনে হয় সমাজের একেবারে নিম্নস্তরের মানুষের মধ্যেই আমাদের বড় ধরনের মনোযোগ দেওয়া উচিত।
সবশেষে, সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী ফ্রন্ট সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই। এটি স্পষ্ট থাকা দরকার যে, আমরা কমিউনিস্টরা নীতিগতভাবে সন্ত্রাসের বিরোধী নই। আমাদের বিচার করতে হবে যে, কোন শক্তি সন্ত্রাস চালাচ্ছে আর তা চালাচ্ছে কাদের বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি দাবি জানালে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে হবে। আলফার মতো সংগঠনগুলি যে জনবিরোধী কার্যকলাপ চালায় সেগুলি অপরাধমূলক কার্যকলাপের পর্যায়ে পড়ে এবং অবশ্যই সেগুলির বিরোধিতা করা উচিত। কিন্তু আমরা যদি সাধারণভাবে সন্ত্রাস-বিরোধী মোর্চা গঠনের জন্য উঠে-পড়ে লাগি তবে তার অর্থ হবে লাল সন্ত্রাস সহ সমস্ত ধরনের সন্ত্রাসেরই বিরোধিতা করা এবং শেষমেষ তা আমাদের কাছেই বাধাস্বরূপ হয়ে উঠবে। কমরেড অনিল বড়ুয়াকে হারানো অত্যন্ত বেদনাদায়ক, কিন্তু মূলত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকেই আমাদের লক্ষ্যবস্তু করতে হবে।
আসামে পার্টির বিকাশের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাম ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সিপিআই(এমএল)-কে আসামের প্রধান বাম শক্তিতে পরিণত করার জন্য আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। তার জন্য পরিস্থিতি পরিপক্ক হয়ে উঠেছে।
টীকা
(১) জেলা পরিষদের সদস্যরা হলেন জেলা স্তরের আইনসভার সদস্য।
(২) এএসডিসি পরপর তিনবার ভোটে জিতে কার্বি আংলং জেলা কাউন্সিলের ক্ষমতায় আসে। এইভাবে জেলা স্তরে সরকার পরিচালনা করা আসামে পার্টি অনুশীলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।