(১০ আগস্ট ১৯৯৭, সারা ভারত মুসলিম ফোরাম কর্তৃক, লক্ষ্ণৌতে আয়োজিত ‘ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর এবং মুসলিম জনগণ’ শীর্ষক কনভেনশনে প্রদত্ত ভাষণ। লিবারেশন, সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ থেকে)
আমার ভাই ও বোনেরা,
খুব জাঁকজমক করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বছর পালন করা হচ্ছে। কিন্তু জনগণের কথা বিচার করলে প্রকৃত অবস্থা কী? স্বাধীনতার সময়কালে মোট যে জনসংখ্যা ছিল আজ তার সমান সংখ্যক জনগণ দারিদ্রসীমার নীচে জীবনযাপন করছেন। বিশেষ করে মুসলিমদের মধ্যেকার ৫০-৬০ শতাংশ জনগণ চরম দারিদ্রের মধ্যে বসবাস করছেন। প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয়দের মধ্যে ৫০ শতাংশের ওপর নিরক্ষর এবং মুসলিমদের মধ্যে এই হার আরও অনেক বেশি।
সুতরাং মুসলিমদের মধ্যেকার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যাঁরা ভারতীয় জনসংখ্যার ১২ শতাংশেরও বেশি, তাঁরা চরম কষ্ট ও বঞ্চনার মধ্যে জীবনধারণ করছেন এবং পঞ্চাশ বছরের স্বাধীনতা তাঁদের জীবনে বিশেষ কোনো উন্নতি ঘটায়নি।
পূর্বতন ভারতবর্ষের অংশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আজ স্বাধীন রাষ্ট্র এবং সেখানকার মুসলিমরা ধর্মের দিক থেকে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু ভারতবর্ষে তাদের সংখ্যা উভয় দেশেরই মুসলিমদের থেকে বেশি হওয়া সত্ত্বেও এখানে তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু। ভারতবর্ষে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হিন্দু এবং এখানে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে গভীর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ বিরাজ করছে।
ভারতীয় রাষ্ট্র হল এক সাংবিধানিক রাষ্ট্র; অর্থাৎ এখানে সরকারিভাবে রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই এবং সমস্ত ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা প্রদানের ঘোষিত দাবির মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতার কথা প্রচার করে। কিন্তু সাংবিধানিক ঘোষণার চাইতেও যাঁরা রাষ্ট্র চালাচ্ছেন তাঁদের প্রকৃতির দ্বারাই রাষ্ট্রের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। যেহেতু সমাজে আধিপত্যকারী ধর্ম হিন্দু, বাস্তব জীবনে এই ধর্ম তাই অন্যান্য ধর্মের তুলনায় বেশি ‘সমানাধিকার’ ভোগ করে। যে সমস্ত লোকেরা রাষ্ট্রের অর্থাৎ তার প্রশাসনিক আইনসভা বা বিচার বিভাগ যে শাখাতেই হোক না কেন সমস্ত শাখাগুলির মধ্যেই বসে আছেন তারা সাধারণভাবে হিন্দু ধর্মের প্রতি পক্ষপাতপূর্ণ।
রাষ্ট্রের ভূমিকা হল দুমুখো। একদিকে সংখ্যালঘুদের নামে তারা মুসলিমদের কোনো না কোনো ধরনের বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে আবার একইসাথে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের (মুসলিমদের) চাপের মধ্যে রাখছে। রাষ্ট্র সম্পর্কে মুসলিম জনগণ বহন করছে এক বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি, প্রকৃত জাতীয়তার বিপরীতে তাদের এক কাল্পনিক জাতীয়তাকে দাঁড় করানোর মনোভাব।
সুতরাং এক সাংবিধানিক রাষ্ট্রেও মুসলিম রাজনৈতিক মুক্তি আজও অসম্পূর্ণ। আমরা দেখেছি আগ্রাসী হিন্দুত্বের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে মুসলিমরা যাদের ওপর সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখত সেই কংগ্রেস কীভাবে নপুংসকে পরিণত হল। এই সেদিন কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সর্বভারতীয় অধিবেশনে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করার প্রতিশ্রুতি থেকে তারা পিছু হটলেন এবং নিছক দুঃখপ্রকাশ করার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেন। এতে তারা বিশেষ কী আর করলেন? ১৯৯২ সালে যখন মসজিদ ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল সম্ভবত তখনও তারা দুঃখপ্রকাশই করেছিলেন।
যুক্তমোর্চার সরকার, যারা বাবরি মসজিদ ইস্যুকে পুঁজি করার সুযোগ হাতছাড়া করেননি এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে খুঁটি করে ক্ষমতায় এলেন, তারাও এই বিষয়ে এখনও পর্যন্ত বিশিষ্টভাবে কোনো কিছু করলেন না এবং বিষয়টিকে ১৩৮(২) ধারায় সুপ্রীম কোর্টে পাঠানোর জন্য ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচিতে তাদের যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা আজও পালিত হয়নি। আমি যা বলতে চাই তা হল এই যে, আধিপত্যকারী হিন্দু ধর্মের চাপ এতখানি যে এমনকি সাংবিধানিক রাষ্ট্র ও ধর্মনিরপেক্ষ পার্টিগুলিও নপুংসকে পরিণত হচ্ছে।
বিজেপির মতো পার্টি, যারা প্রকাশ্যে হিন্দু রাষ্ট্র অর্থাৎ এমন এক রাষ্ট্র যেখানে হিন্দুত্ব হবে রাষ্ট্রের ধর্ম বলে প্রচার করে, তারা যখন ক্ষমতায় আসে তখন ধর্মনিরপেক্ষতার পরিণতি কী দাঁড়াবে তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। মুসলিম পরিচিতি বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে।
এখন এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার দুটি পথ আছে। একটি হচ্ছে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া এবং কোনো এক ধরনের মুসলিম মৌলবাদের আশ্রয় নিয়ে হিন্দু মৌলবাদের বিরোধিতা করা। আমার মতে এই পথ বিপরীত ফলই দেবে। অপর পথ হল প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির সাথে হাত মেলানো এবং ভারতবর্ষে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে তুলতে সংগ্রাম করা।
একজনের পরিচিতির মধ্যকার দ্বৈতসত্তাজনিত সমস্যা অর্থাৎ সে একজন মুসলিম আবার একজন নাগরিক অথবা সে একজন হিন্দু আবার একজন নাগরিক, কেবলমাত্র তখনই সমাধান হতে পারে যখন রাজনৈতিক রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের মধ্যকার ধর্মনিরপেক্ষ বিভাজন সম্ভব হবে। ভারতবর্ষের এই প্রক্রিয়া অসমাপ্ত রয়েছে।
হিন্দুত্ব যে সংকট চাপিয়ে দিয়েছে তাতে মুসলিম জনগণের কাছে নিজেদের পরিচিতিকে নতুন করে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক সুযোগও হাজির হয়েছে। সেই পরিচিতি কী হওয়া উচিত? আমরা কমিউনিস্টরা মুসলিম জনগণের আকাঙ্খার বিপরীতে রাষ্ট্রের দ্বারা ওপর থেকে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার সম্পূর্ণ বিরোধী। আমার মনে হয় আধুনিক পটভূমিতে নিজেদের পরিচিতিকে নতুন করে তুলে ধরার বিষয় নিয়ে মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেক আলোচনা চলছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হয় মুসলিম সমাজে মহিলাদের মর্যাদার প্রশ্ন, বহুবিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ থেকে উদ্ভূত সমাস্যাবলী খুবই গুরুত্ব বহন করে। তুরস্ক ও টিউনিসিয়ার মতো মুসলিম রাষ্ট্রে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এমনকি পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও বহু ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ হয়েছে। সুতরাং আমি মনে করি এই সমস্ত বিষয়গুলি নিয়ে মুসলিম জনগণের মধ্যকার আলোকপ্রাপ্ত অংশের গুরুত্বের সাথে ভাবনাচিন্তা করা দরকার।
এখন মুসলিম হিসাবে ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণের দাবি এসেছে। কিন্তু একই সাথে মুসলিম জনগণের মধ্য থেকে মণ্ডল কমিশনে তালিকাভুক্ত পশ্চাদপদ মুসলিমদের জন্য কার্যকরী সংরক্ষণের দাবিও উঠে আসছে। এমনকি দলিত মুসলিমদের জন্য সংরক্ষণের দাবিও জারালো হয়ে উঠছে। সুতরাং এই প্রশ্নও গুরুত্বের সাথে মনোযোগ দেওয়ার দাবি জানায়।
হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে রোখার প্রচেষ্টায় আপনারা কংগ্রেসের পাশে এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন মধ্যপন্থী পার্টিগুলির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু স্বল্পমেয়াদে লাভের লক্ষ্যে নেওয়া এই স্ট্র্যাটেজি সমস্যাটিকে কেবল জটিল করে তুলেছে।
মুসলিম যুবকদের নতুন প্রজন্ম নিজেদেরকে বামপন্থী শক্তিগুলির পাশে দাঁড় করাচ্ছেন কেননা তাঁরা বুঝছেন যে কেবলমাত্র বামপন্থীরাই হল দৃঢ় ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাপক গণতন্ত্রের রূপান্তরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত।
আমি মনে করি, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গড়ার সংগ্রাম যত এগোবে; ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে গণতান্ত্রিক কনফেডারেশন গড়ার পরিস্থিতি তত পেকে উঠবে। আর এইভাবেই আমরা ১৯৪৭ সালের ঐতিহাসিক ভুলকে সংশোধন করতে পারব।
ধন্যবাদ।