(আলফার উপর সামরিক বাহিনীর দমনপীড়ন নামিয়ে আনার ঠিক আগে এক অসমীয়া পত্রিকার জন্য লেখাটি তৈরি হয়। লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯১ থেকে)

১৯৭৯-র গ্রীষ্মের এক সুন্দর সকালে বেজিং-এ মাও জে দং-এর সমাধি-সৌধে সুরক্ষিত তাঁর নিথর দেহের সামনে যখন দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে সরতে মন চাইছিল না। এখানেই চিরশান্তিতে শায়িত সেই মানুষটি যিনি মানবজাতির এক চতুর্থাংশের নিয়তিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন, জগৎ যে আগের মতো আর থাকবে না তা সুনিশ্চিত করেছিলেন এবং ১৯৬০-এর দশকের শেষার্ধে সারা পৃথিবীর যুবসমাজকে আলোড়িত করেছিলেন। অবনত মস্তকে নিমগ্ন চিত্তে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। চীনা কমরেডরা এগিয়ে যেতে বলায় হুঁশ ফিলে এল। আমাদের পিছনে যে এক দীর্ঘ সাগ্রহী মানুষের সারি।

চীন ভ্রমণে গিয়ে আমি লং মার্চের গোটা পথই পরিক্রমা করেছিলাম – একেবারে চাংশা পর্বতমালা থেকে ইয়েনানের গুহা পর্যন্ত।

তরুণ চীনা গাইডদের কাছে যেমন চীন বিপ্লবের পুরো বর্ণনা শুনেছি, তেমনি কিছু কৃষক সহ প্রবীণ মানুষদের কাছে জীবন্ত মাও-এর সঙ্গে তাঁদের সান্নিধ্যের আবেগপূর্ণ স্মৃতিমন্থনও শুনেছি। বেজিং-এ গুরুত্বপূর্ণ পার্টি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার সময় মাও বিসর্জনের যেটুকু আভাস পেয়েছিলাম, দেখেছিলাম তৃণমূলে তার কোনো ছাপই পড়েনি। মাও সেই দেবতাই রয়ে গিয়েছিলেন। দেং-এর উত্থান এবং তার সঙ্গে সঙ্গে মহান কাণ্ডারী মাও-কে ঘিরে যা নাকি ছিল অতিকথা তার অবসান ঘটানোর মতো পরিস্থিতি চীনে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমি অবশ্য মাও, তাঁর বিপ্লব ও চিন্তাধারা সম্পর্কে পুনর্নবীকৃত প্রত্যয় নিয়ে দেশে ফিরে এলাম।

আমরা মাও চিন্তাধারাকে বরণ করেছিলাম ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকের সেই ঝোড়ো দিনগুলিতে যখন মতাদর্শগত মহাবিতর্ক চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব এবং ভারতে নকশালবাড়ির জন্ম দিয়েছিল। আমরা জেলারেল গিয়াপ, চে গুয়েভারা, রেজি দ্যব্রে এবং অন্যান্যদের লেখা পড়েছিলাম এবং আজকের আসামের আলফার তরুণ কমরেডদের মতোই সমস্ত ধরনের সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতিই দুর্বার আকর্ষণ বোধ করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছিলাম মাও চিন্তাধারা ও তাঁর কৃষি বিপ্লবকে।

১৯৭১-৭২ সালে বহরমপুর জেলে থাকার সময় আমি লুকিয়ে একটি মাও-এর নির্বাচিত রচনাসংগ্রহ জোগাড় করেছিলাম এবং যে কোনো কারণেই হোক প্রতিদিন তল্লাশি সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ ঐ বইটি নিয়ে যেতে পারেনি। মাসের পর মাস ২৪ ঘণ্টা ঐ কনডেমড সেলে আটক থাকার সময় বারবার ঐ বইটি পড়া ছাড়া আমার আর কোনো কাজ ছিল না, বইটি  প্রায় মুখস্থ করেই ফেলেছিলাম। পার্শ্ববর্তী সেলের কমরেডদের সুবিধার জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় ঐ বইটি থেকে অনুবাদ করে জোর গলায় পড়তাম। এইভাবেই আমি মাও-কে বিভিন্ন দিক থেকে উপলব্ধি করতে পারি – দার্শনিক, প্রথম সারির রণনীতিবিদ এবং শ্রেষ্ঠ সমর নায়ক হিসাবে।

তৃতীয় বিশ্বে নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে কোনো বিপ্লবী সংগ্রামেই মাও-এর চিন্তাধারাকেই একমাত্র হাতিয়ার হিসাবে গণ্য করা হয় – তা সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধেই হোক অথবা কৃষক জনতার উপর সামন্ততান্ত্রিক আধিপত্যের বিরুদ্ধেই হোক বা দেশের অভ্যন্তরে নিপীড়নের বিরুদ্ধে কোনো জাতিসত্তার সংগ্রামই হোক। সামন্ততন্ত্রের জোয়াল থেকে কৃষক জনতার মুক্তি এবং সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সংগ্রামে আমরা যেমন মাও চিন্তাধারার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তেমনি অসমীয়া জাতিসত্তার স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন আলফা ভারতীয় উগ্রজাতীয়তাবাদী স্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যে মাও চিন্তাধারাকেই তার মতাদর্শগত হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছে তা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

মাও চিন্তাধারার প্রতি তাদের বিশ্বাস তাদের নিয়ে গেছে ভারতবর্ষ থেকে আসামকে বিচ্ছিন্ন করার সংগ্রামে, আর মাও চিন্তাধারার প্রতি আমাদের বিশ্বাস থেকে আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি এক ঐক্যবদ্ধ, গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতবর্ষ গঠনে যেখানে জাতিসত্তার উপর সমস্ত ধরনের নিপীড়নকেই মুছে ফেলা হবে। মাও চিন্তাধারার প্রতি তাদের বিশ্বাস পূর্বতন অসমীয়া আন্দোলনে এক নতুন মোড় প্রদানের পথে তাদের নিয়ে গেছে, যা অবশ্যই এক বাম মোড় এবং যা ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকের কমিউনিস্ট-বিরোধী, বাম-বিরোধী, সাম্প্রদায়িক ঝোঁককে দূর করেছে। মাও চিন্তাধারার প্রতি আমাদের বিশ্বাস একেবারে শুরু থেকেই আমাদেরকে অসমীয়া জনগণের সেই আকাঙ্খা ও শঙ্কার শরিক করে তুলেছে, যা হল নিজেদের সম্পদ নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করার আকাঙ্খা এবং জনসংখ্যার পরিসংখ্যানগত বড় আকারের পরিবর্তনের মুখে নিজেদের পরিচিতি হারানোর আশঙ্কা।

মাও চিন্তাধারার বশবর্তী হয়ে তাঁরা রাষ্ট্রের মোকাবিলার জন্য এক সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছেন। আর আমাদের বিশ্বাসের বলে আমরা এগিয়ে গেছি শ্রমজীবী কৃষক জনতার ব্যাপকতর প্রতিরোধ গড়ে তুলে সেই একই রাষ্ট্রশক্তির মোকাবিলার পথে। তাঁদের বিশ্বাস তাঁদের নিয়ে গেছে বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় খণ্ডিত এবং প্রায়শই পরস্পরের সঙ্গে উগ্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত অসমীয়া জনগণের বৃহত্তম ঐক্য পুনর্গঠিত করার দিকে। আমরাও অসমীয়া জনগণের এক বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করি – এমন এক ঐক্য যেখানে মূলধারার অসমীয়া জাতিসত্তার জাতিদম্ভ যেমন থাকবে না, তেমনি উপজাতিদের বিচ্ছিন্নতাকেও প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। কার্বি আন্দোলনের উপর আমাদের পার্টির প্রভাব ঐ আন্দোলনের গণতান্ত্রিকীকরণেই সাহায্য করেছে এবং অন্য সমস্ত সম্প্রদায়ের শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে তার ঐক্যকে শক্তিশালী করেছে।

আলফার তরুণ বিপ্লবীরা যে পেটিবুর্জোয়া বিপ্লবী সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, আর সম্ভবত বর্তমানে তাদের পক্ষে ঐরকম হওয়াই স্বাভাবিক। তারা অবশ্য আসাম আন্দোলনকে এক প্রগতিশীল দিকে ঘোরাতে সক্ষম হয়েছে এবং অসমীয়া যুবসম্প্রদায়ের অসীম গতিময়তা, সাহস ও চমকপ্রদ সাংগঠনিক দক্ষতার তারা প্রতিনিধি। মাও চিন্তাধারার সঙ্গে বাস্তব জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষার সমন্বয়সাধন কি যুক্তিসঙ্গত পরিণতি হিসাবে তাদেরকে কমিউনিস্টে রূপান্তরিত করবে?

আলফার কমরেডরা দেশের এই অংশে মাও ও তাঁর চিন্তাধারার উত্তরাধিকারকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। আমি তাঁদের লাল সেলাম জানাই।