(২৭ আগস্ট ১৯৯৪ পাটনায় অনুষ্ঠিত বিশেষ কর্মী বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণের অংশবিশেষ। লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯৪ থেকে)

কমরেডগণ,

সাত মাস আগে এই একই স্থানে আমরা একটি কনভেনশন করেছিলাম। সেই সময় কেউ কেউ এই অভিমত পোষণ করতেন যে একদিকে এমসিসি অপরদিকে জনতা দলের চাপে আমাদের পার্টি শেষ হয়ে যাচ্ছে। সংবাদপত্রগুলিতেও এই ধরনের ধারণাগুলির প্রচার করা হচ্ছিল। সেই কনভেনশনে আমি বলেছিলাম যে যদি আপনারা দৃঢ়সংকল্প প্রচেষ্টা চালান তাহলে বিহারের পরিস্থিতিকে আপনারা পাল্টে দিতে পারেন। ঐক্যবদ্ধভাবে ও সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে আমরা সাফল্যের সঙ্গে ঐতিহাসিক ১৮ মার্চের সমাবেশ সংগঠিত করেছি। সমাবেশের পর সংবাদপত্রগুলি তাদের মত পাল্টায়। এমসিসি ও জনতা দলের চাপে আমরা শেষ হয়ে গেছি – এইসব বলার পরিবর্তে তারা বলতে শুরু করে যে জনতা দল সম্পর্কে মানুষের মোহ ভাঙ্গতে শুরু করেছে এবং সিপিআই(এমএল) এক শক্তি হিসাবে সামনে উঠে এসেছে।

সুতরাং আমি পুনরায় বলতে চাই যে ঐক্যবদ্ধ হতে ও সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করতে আমাদের কর্মীদের সামর্থ্য আছে। বিহারের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা দৃঢ়ভাবে বিপ্লবী পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। এই সময়কালে আর একটি বিষয় দেখা গেছে যে আমাদের নেতারা এক নতুন কাজের ধারা গড়ে তুলেছেন। এটি এক স্বাস্থ্যকর কাজের ধারা এবং এই লক্ষ্যেই আমরা কিছুদিন আগে শুদ্ধিকরণ আন্দোলন চালিয়েছিলাম। সেই সময় কোনো না কোনোভাবে নেতা ও কর্মীদের মধ্যে এক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। সমাবেশের সময়কালে আমরা যে কাজের ধারা গড়ে তুলেছি তা কঠোরভাবে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

পার্টির বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান সমস্ত মতপার্থক্য সমাধান করতে হবে, তা না হলে বিরুদ্ধ শক্তিগুলি এর সুযোগ নেবে। এই বিষয়টি আমরা অতীতেও ঘটতে দেখেছি। এই কারণে আমি আবার জোর দিয়ে বলতে চাই যে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য থাকতে হবে।

আপনাদের সামনে যে প্রতিবেদন রাখা হয়েছে সে সম্পর্কে আপনারা সকলে মতামত রেখেছেন। অনেক ভালো মতামত ব্যক্ত হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি রাজ্য নেতৃত্ব এই সমস্ত মতামত নিয়ে আলোচনা করবে এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলির বাস্তব ও প্রকৃত মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বহু কমরেড যেসব নির্দিষ্ট বিষয় তুলে ধরেছেন সেসব নিয়েও আলোচনা করবেন। প্রতিবেদনে যদি এটি বলা হয়ে থাকে যে জনতা দল(ব) শেষ হয়ে গেছে বা জাতীয় স্তরে তাদের কোনো গুরুত্বই নেই, তাহলে অবশ্যই তা সঠিক মূল্যায়ন নয়। তারা এখনও শক্তিশালী বিরোধীপক্ষ। তাই এই ধরনের কোনো মূল্যায়ন থাকলে তা সংশোধন করা উচিত। বিএসপি সম্পর্কে যদি এই ধরনের মূল্যায়ন থাকে তাও সংশোধন করা উচিত। বিএসপি বিহারে ঢোকার পথ তৈরি করছে। তারা উত্তরপ্রদেশে শক্তিশালী এবং এই শক্তির ওপর ভিত্তি করে তারা বিহারে অগ্রগতি ঘটানোর চেষ্টা চালাবে। তাই তাদের সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

জনতা দল (জর্জ) ও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সঙ্গে রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলা সম্পর্কে অনেক কমরেড এইসব শক্তিগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা অতীতে কংগ্রেসের সাথে মাখামাখি করেছিল। আর, জনতা দল (জর্জ)-এর বর্তমান অবস্থাও সন্দেহজনক। আমি মনে করি কমরেডদের অনুভূতিগুলি সঠিক। বর্তমানে জনতা দল (জর্জ)-এর সঙ্গে জোট গড়া ও সরকার গঠন করা সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা যদি প্রতিবেদনে থাকে তবে তা বাদ দেওয়া উচিত। জনতা দল (জর্জ)-এর সঙ্গে বড়জোর কিছু আসনে বোঝাপড়া নিয়ে আলোচনা হতে পারে এবং বর্তমানে এটাই হল যথাযথ মূল্যায়ন। আসন সংক্রান্ত বোঝাপড়া কতদূর হতে পারে বা আদপেই হবে কিনা সে সম্পর্কে কিছু কমরেড সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আমি মনে করি এই সন্দেহও সঠিক এবং শেষ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক বোঝাপড়া নাও হতে পারে। এমনকি আসন নিয়ে বোঝাপড়াও সম্ভবপর না হতে পারে। আমাদের একাই লড়তে হতে পারে। এই সম্ভাবনা আমরা নাকচ করতে পারি না। তাই প্রতিবেদনে রাজনৈতিক জোট নিয়ে কম কথা থাকাই সম্ভবত ভালো। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনে আমাদের যে একা লড়তে হতে পারে সেই সম্ভাবনার কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকা উচিত এবং তার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা নিশ্চয়ই মিত্র খোঁজার চেষ্টা করব, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক জোট বা কর্মসূচি সংক্রান্ত বোঝাপড়া সম্ভব নাও হতে পারে।

ঝাড়খণ্ডে দ্বিতীয় শক্তি হল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (মারডি গোষ্ঠী) বা বিনোদ বিহারী মাহাতো গোষ্ঠী। তাদের তুলনামূলকভাবে প্রগতিশীল বা বামদের প্রতি ঝুঁকে থাকা বলে মনে করা হত, কিন্তু তারা ক্রমে ক্রমে বর্তমানে জনতা দলের দিকে চলে যাচ্ছে এবং কার্যত ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দাবি ছেড়ে দিয়েছে। আজসু-র মতো অন্যান্য শক্তি যারা বিরাট প্রতিশ্রুতি নিয়ে সামনে এসেছিল, তারা পরবর্তীতে ভেঙে পড়ে এবং বিভিন্ন ধরনের সুবিধাবাদী বোঝাপড়ায় উপনীত হয়। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার দুটি দিক আছে। এদের নেতাদের সম্পর্কে আপনাদের বক্তব্য সঠিক। তারা মাফিয়া ও গুণ্ডা। কিন্তু সাধারণ আদিবাসীরা তাদের এভাবে দেখে না। সাধারণ আদিবাসীদের চোখে তারা ঝাড়খণ্ডের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তি। আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন হাজির হয়েছে। তারা প্রায়শই কংগ্রেসের দিকে বা কেন্দ্রের সরকারের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং এদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। তাদের শ্রেণী ভিত্তি ও শ্রেণী অবস্থানের জন্য এটি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এর আর একটি দিক থাকতে পারে। আমরা তাদের কাছে সরাসরি প্রশ্ন রেখেছি যে, আপনাদের হয় কংগ্রেস না হয় সিপিআই(এমএল)-কে বেছে নিতে হবে। আমরা সেই ধরনের বন্ধুত্বের কথা বলি না যেখানে একই সঙ্গে কংগ্রেস ও সিপিআই(এমএল)-এর সাথে সম্পর্ক রেখে চলা যাবে। যদি আপনাদের কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাত থাকে তাহলে আপনাদের সিপিআই(এমএল)-এর সাথে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। বন্ধুত্ব বলতে আমরা এটিই বুঝি। সর্বদলীয় কমিটিতে আমরা একথাই তাদের বলেছি। যখন তারা কংগ্রেসের দিকে যেতে শুরু করেছে আমরা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। তাদের সম্মেলনে, তারা তাদের মতো করে একই প্রশ্ন তুলেছে। তারা একদিকে বলেছে যে, তারা সিপিআই(এমএল)-এর সঙ্গে সম্পর্ক চায়। অপরদিকে তারা কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছে। এতে আমরা আশা করতে পারি যে কংগ্রেসের কাছ থেকে ধাক্কা খাওয়ার পর তারা আমাদের দিকে আসবে এবং তাদের সংগঠনের মধ্যকার বিতর্ক তীব্র হয়ে উঠবে। তারা একটি জনগণের সংসদ আয়োজন করেছিল যেখানে একজন বলেন যে তিনি এই সংসদে কংগ্রেসীদেরও আমন্ত্রণ করেছিলেন। তা উপস্থিত অনেকের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। আমি যতদূর জানি সেখানে কংগ্রেস বিরোধী স্লোগানও উঠেছিল। আমার মনে হয় এই প্রশ্নে তাদের মধ্যে বিতর্ক আছে এবং তাদের মধ্যে এই ধরনের কংগ্রেস বিরোধী কিছু শক্তি রয়েছে। আমরা ধারাবাহিকভাবে এই প্রশ্ন তুলে ধরতে চাই এবং তাদের পুরোপুরিভাবে আমাদের দিকে টেনে আনতে না পারলেও অন্ততপক্ষে তাদের মধ্যে বিভাজন ঘটবে। এটি ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ও কংগ্রেসের মধ্যে বন্ধুত্বের প্রশ্ন নয় বরং এটি কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের সরাসরি সংঘাতের প্রশ্ন। আমাদের প্রচেষ্টা হল কংগ্রেসের কাছ থেকে তাদের সরিয়ে এনে বিরোধী শক্তির ঘনিষ্ঠ করে তোলা। দুই দিকের মধ্যে টানাটানির এই তীব্র প্রতিযোগিতায় একপ্রান্তে রয়েছে কংগ্রেস, অপরপ্রান্তে রয়েছি আমরা। তাদের সঙ্গে যৌথ ফ্রন্ট গড়ে তোলা সম্পর্কে এটিই আমাদের কৌশলের অন্তর্বস্তু এবং এই লক্ষ্যে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যেতে চাই।

জনতা দল (জর্জ) সম্পর্কে আমি একটি বিষয় পরিষ্কার করতে চাই। নীতীশের ভাবনা হল যাদব আধিপত্য ও যাদব প্রতিপত্তির বিরোধিতার নামে কুর্মী ও অন্যান্য জাতকে ঐক্যবদ্ধ করা। এই ভাবনার সঙ্গে আমরা একমত নই। আমরা যাদব জাতের বিরোধিতা করার ভিত্তিতে অন্যান্য জাতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার পক্ষে নই। বিহারে যাদবরা সংখ্যায় অনেক এবং তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ হলেন গরিব ও মাঝারি কৃষক। আমাদের নেতা, ক্যাডার ও কর্মীদের এক বড় অংশ যাদব জাত থেকে এসেছেন এবং বিভিন্ন এলাকায় যাদব জনগণের মধ্যে আমাদের রাজনৈতিক কাজ আছে। প্রকৃতপক্ষে যাদবদের ভিতরে একমাত্র আমাদের পার্টিই লালু যাদবকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। এক্ষেত্রে অন্য কোনো পার্টির সেই জায়গা নেই। আমরা যাদব সম্প্রদায়ের মধ্যে মেরুকরণ ঘটাতে চেষ্টা চালাচ্ছি। এই কাজের মধ্য দিয়ে আমরা এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টির আশা করি। কারণ অন্যান্য পার্টি মনে করে যে সমস্ত যাদবেরাই লালু প্রসাদের সঙ্গে আছে, তাই তারা কেবলমাত্র অন্যান্য জাতকে সংগঠিত করার কথা ভাবে। আমাদের পার্টি এভাবে ভাবে না এবং এভাবে ভাবলে আমরা কমিউনিস্ট পার্টি থাকব না। নীতীশের ভাবনার তালে আমরা চলতে পারি না। তাদের সাথে আমাদের মৌলিক মতপার্থক্য আছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করি। তারা যেভাবে কুর্মী সমর্থন সংগ্রহ করছেন সে সম্পর্কে এবং কুর্মী কুলাকদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম রয়েছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে একটা কথা আমি বলতে চাই। গতবার সংরক্ষণ, মণ্ডল ও পশ্চাদপদতার প্রশ্নে লালু এক ঢেউ তুলেছিলেন এবং নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন। এটি সত্য যে তিনি আবার এই ধরনের চেষ্টা চালাবেন। জনপ্রিয় এক প্রবাদ আছে যে, একই নদীতে দুবার স্নান করা যায় না। একথা বলার পিছনে অনেক কারণ আছে। সেই সময় তাদের পার্টির দেশজুড়ে এক অভ্যুত্থান ঘটেছিল। তাদের জাতীয় স্তরে নেতা ছিল। এখন সেই পার্টি শেষ হয়ে গেছে। ভি পি সিং রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। তাদের সামনে এখন এক বিরাট সমস্যা। তাই এবার তারা আর বড় ঢেউ তুলতে পারবেন না। তারা সংরক্ষণের জন্য যত শতাংশের কথাই বলুন না কেন, আমরা সুবিধাভোগী স্তরের প্রশ্নটি তুলে ধরব, কেননা তাঁরা সবসময়ই সুবিধাভোগী স্তরটির অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। আমরা সবসময়ই বলে এসেছি যে লালু হলেন সুবিধাভোগী স্তরটির প্রতিনিধি এবং এটি স্বাভাবিক যে তিনি তা মেনে নেবেন না। সংরক্ষণের শতাংশ যাই হোক না কেন, আমরা এটি তুলে ধরব যে পশ্চাদপদ জাতের মধ্য থেকে সুবিধাভোগী স্তরের উদ্ভব হয়েছে এবং চাকরির সুযোগ সীমিত হওয়ার কারণে সমস্ত সুবিধা ঐ সুবিধাভোগী স্তর কুক্ষিগত করে। যতটুকু সুযোগ আছে তার সমস্ত কিছুই সুবিধাভোগী স্তরটি ভোগ করবে। কুর্মী হোক আর যাদবই হোক, তাদের বড় অংশই এই সুযোগ থেকে কখনই উপকৃত হবে না। আর সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জাতগুলি কিছুই পাবে না।

বিহারে জাতপাতের বিভাজন রয়েছে এবং কোনো পার্টিই এই বিভাজনকে অস্বীকার করে না। তাই আমাদের কাছে সুবিধাভোগী স্তরের প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটি পার্টি জাতপাতের এই বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে নিজেদের কৌশল তৈরি করে। সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর মতো পার্টিগুলির ক্ষেত্রে তফাৎ শুধু এই যে এরা বর্তমান জাতপাতের ধাচাটির উপর ভিত্তি করে বা এখানে বিদ্যমান স্বাভাবিক দ্বন্দ্বগুলির উপর ভিত্তি করে জনতা দলের লেজুড়বৃত্তি করেন। আমরাও জাতপাতের দ্বন্দ্বের কথা বলি, কিন্তু আমরা সর্বদাই শ্রেণী লাইন অনুযায়ী জাতের মধ্যে বিভাজন ঘটানোর লক্ষ্যে চেষ্টা চালাই। অবশ্য সেই সমস্ত জাতের কথা আলাদা যাদের শ্রেণী লাইনে বিভাজন করা যায় না। কিছু জাত আছে যারা সম্পূর্ণতই গরিব কৃষক ও কৃষিশ্রমিক। এটি অন্য এক বিষয়। কিন্তু যেখানেই জাতের মধ্যেই শ্রেণী বিভাজনের সম্ভাবনা বর্তমান আছে, সেখানেই আমাদের তা সামনে আনতে হবে। এখানেই অন্যান্যদের থেকে কমিউনিস্টদের তফাৎ। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুবিধাভোগী স্তরের ধারণাটি সুপ্রীম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে এলেও তা আমাদের কাজে সাহায্য করবে। কেননা বিভিন্ন জাতের মধ্যে শ্রেণীলাইনে বিভাজনের ধারণা আমরা নিয়ে যেতে পারব, তাদের বোঝাতে পারব এবং বিভাজনের জন্য তাদের প্রস্তুত করতে পারব। সেই কারণে অন্যান্য পার্টি যেখানে সুবিধাভোগী স্তরের কথা অস্বীকার করছে আমরা সেখানে সুবিধাভোগী স্তরের কথা সামনে আনব যাতে পশ্চাদপদ জাতের গরিব ও মাঝারি কৃষকদের আমাদের দিকে টেনে আনা যায়। এই কারণে সুবিধাভোগী স্তরকে চিহ্নিত করার জন্য তারা কিছু মানদণ্ডের কথা বলেছে। অনুরূপভাবে আমাদের দিক থেকেও পার্টির নিজস্ব মানদণ্ডের কথা বলতে হবে। আপনাদের এই বিষয়ে ভাবতে হবে। পার্টির রাজ্য কমিটিকে এই কাজে হাত দিতে হবে। এমএলএ, এমপি ও প্রথম শ্রেণীর অফিসারদের পরিবার থেকে এই স্তর শুরু হতে পারে।

আর একটি প্রশ্ন এখানে উঠে এসেছে। একটি মত হল যে যেহেতু আমরা আগে একটি বাম সরকারের জন্য আহ্বান রেখেছি তাই জনতা দল (জর্জ) ও অন্যান্যদের পরিবর্তে বাম দলগুলির সঙ্গে ঐক্যের জন্য আমাদের বেশি চেষ্টা করা উচিত। এই প্রশ্নে আমাদের বুনিয়াদী নীতি থেকে আমরা সরে আসিনি। আমরাও বাম ঐক্য চাই এবং সবসময়ে তা চেয়ে এসেছি। আমাদের এক নম্বর চেষ্টা থেকেছে অন্যান্য বাম শক্তিগুলির কাছাকাছি আসা এবং তাদের সঙ্গে একসাথে এগোনো। এই প্রশ্নে আমরা পিছিয়ে আসিনি। কিন্তু অপরদিক থেকে কোনো ইতিবাচক উত্তর আসেনি। যেখানে ও যে যে বিষয়ে যৌথ কার্যকলাপ সম্ভব, আমরা সবসময়েই তাতে অংশ নেব। কিন্তু বিহারের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা পরস্পর বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি। সিপিআই(এম) সম্পর্কে বলতে গেলে, দ্বারভাঙ্গা, কাটিহার, নওদা বা রাঁচী যেখানেই হোক না কেন, অনেক গ্রামীণ এলাকায় তাদের সঙ্গে আমাদের সংগ্রাম চলেছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা রক্তাক্তও হয়ে উঠেছে। অন্য এলাকায় অন্যরকম হতে পারে, কিন্তু বিহারের এই সমস্ত গ্রামীণ এলাকায় সিপিআই(এম) সামন্তশক্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এই কারণে বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এইসব সংগ্রাম চলছে সিপিআই(এম) ও সিপিআই(এমএল)-এর মধ্যে, কিন্তু গভীরে গেলে দেখা যাবে এই সংগ্রাম হল প্রত্যক্ষ শ্রেণী সংগ্রাম। গরিব কৃষক ও কৃষিশ্রমিকরা রয়েছে আমাদের দিকে, আর তারা রয়েছে সামন্তশক্তির দিকে।

আমরা সিপিআই-এর বিরুদ্ধে কিছু রাজনৈতিক আক্রমণ চালিয়েছি। কিন্তু এর লক্ষ্য সিপিআই-কে পরিত্যাগ করা নয়। আমরা এই কারণেও আক্রমণ চালাইনি যে সিপিআই-এর সঙ্গে আমাদের সব সম্পর্ক চুকে গেছে। বিপরীতে, সিপিআই-এর মধ্যে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে তাকে তীব্র করে তুলতে আমরা এই আক্রমণ চালিয়েছি এবং আমরা কিছু সফলতা অর্জন করেছি। আমরা তাঁদের কিছু নেতার সঙ্গে সাক্ষাত করেছি এবং তাঁরা তাঁদের পার্টির মধ্যকার বিতর্ক সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন। তাঁরা আমাদের জানিয়েছেন যে তাঁদের মধ্যকার একটি অংশ লালু না জর্জ কার সঙ্গে সমঝোতা করা হবে সে সম্পর্কে মাথা না ঘামিয়ে প্রথমে সিপিআই(এমএল)-এর সঙ্গে সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ করে তোলার কথা ভাবেন। তাঁদের মতে উভয় পার্টি একসঙ্গে বসে ঠিক করুক যে কাদের সঙ্গে সমঝোতা করা হবে। আমাদের লক্ষ্য এই বিতর্ককে তীব্র করা। সিপিআই(এম) যেখানে অনেক বেশি কট্টর, সেই তুলনায় সিপিআই তাদের অবস্থানের প্রায়শই পরিবর্তন ঘটায়। তাই কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে আবার অন্য কোনো সময়ে অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে চলা তাদের পক্ষে অসুবিধাজনক নয়। এই সুবিধাবাদ  একদিকে যেমন সিপিআই-এর দুর্বল দিক, তেমন অন্য অর্থে ইতিবাচক দিকও বটে। আশা করা যায় সিপিআই আবার একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে যেতে পারে। যদি আমাদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে এবং যদি সিপিআই-এর কাছে মনে হয় যে লালুর পরিস্থিতি টলমল করছে ও আমাদের সঙ্গে জোট গড়া শক্তিশালী হবে, তাহলে তারা লালুর সঙ্গ ছেড়ে সিপিআই(এমএল)-এর দিকে চলে আসবে। তাই সমস্ত স্তরে সিপিআই-এর সঙ্গে আমাদের আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।

এখানে কিছু কমরেড আর একটি বিষয় তুলেছেন; বন্যা, আন্ত্রিক ইত্যাদি সমস্যায় জনগণ ভুগছেন, কিন্তু আমাদের দিক থেকে এইসব ইস্যুতে সাধারণভাবেই উদ্যোগের অভাব থাকছে। আমি মনে করি কমরেডরা ইতিবাচক সমালোচনাই করেছেন। রাজ্য নেতৃত্বকে এ সম্পর্কে ভাবতে হবে এবং আমাদের সেই রকম এক রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে হবে যারা বিহারের জনগণের সমস্ত সমস্যার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এই ধরনের সমস্যা দেখা দিলে নেতৃত্বকে বিবৃতি দিতে হবে এবং পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে নিজেদের টিম পাঠাতে হবে। তা না হলে আমাদের পরিচিতি একপেশে হয়ে পড়বে।

এখন আমাদের কাছে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হল নির্বাচন। এই নির্বাচনে আমাদের রয়েছে এক সীমিত লক্ষ্য। সীমিত লক্ষ্য বলতে আপাতত আমাদের স্বীকৃত রাজ্য পার্টির মর্যাদা পেতে হবে এবং এই নির্বাচনেই তা নিশ্চিত করতে হবে। এই মর্যাদা পেতে গত নির্বাচনে আমাদের দরকার ছিল ১৪ থেকে ১৫ লক্ষ ভোট এবং এক্ষেত্রে আমাদের ৪-৫ লক্ষ ভোট কম ছিল। এই নির্বাচনে আমাদের লক্ষ্যপূরণ করতে হবে। আমরা কতগুলি আসনে জিতলাম বা হারলাম সেটি অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল গত নির্বাচনে যদি ১০ লাখ ভোট আমাদের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে এবার লক্ষ্য হওয়া উচিত ২০ লাখ ভোট। বিহারে স্বীকৃত পার্টির মর্যাদা অর্জন করতে আমাদের এই লক্ষ্য থাকা দরকার। রাজ্যে স্বীকৃত পার্টির মর্যাদা পেলে তা জাতীয় ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাবে। আমি তাই এটি এক চ্যালেঞ্জ হিসাবে আপনাদের গ্রহণ করতে বলছি।

পরিশেষে, আমি ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলার কথা আবার বলব। আমি ইস্পাতদৃঢ় ঐক্যের কথা বলছি কেননা যুদ্ধ চালাতে এক বিশেষ ধরনের শৃঙ্খলা প্রয়োজন। যুদ্ধ শুরুর আগে যে কেউ তার অভিমত পেশ করতে পারেন, বিতর্কে অংশ নিতে পারেন, কিন্তু যুদ্ধ একবার শুরু হয়ে গেলে বাহিনী যেভাবে এগোবে অবশ্যই সেই অনুযায়ী প্রত্যেককে এগোতে হবে।

(বিহারে পার্টি কমিটিগুলির সম্পাদকদের সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ। লিবারেশন মার্চ, ১৯৯৪ থেকে)

কমরেড,

এখানে বিহারের বিভিন্ন জেলা ও ব্লক থেকে ১০০ জনের মতো পার্টি নেতা এসেছেন। আপনারা সবাই পার্টি নেতা এবং ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চেষ্টার সাহায্যে আপনারা বিহারের পরিস্থিতি আরও একবার পাল্টে দিতে পারেন। আমরা বিহারের পার্টি সংগঠনে এক শুদ্ধিকরণ আন্দোলন চালাচ্ছি এবং আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এই শুদ্ধিকরণ আন্দোলনটি আমরা এমন এক সময়ে চালাচ্ছি যখন আমাদের পার্টি সাম্প্রতিককালের নানা সমস্যা ও ক্ষয়ক্ষতি অতিক্রম করে নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে এবং এগোতে শুরু করেছে। অন্যদিকে বর্তমানে বিহারে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জনতা দল চারিদিক থেকে সমস্যা কবলিত হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত খবরের কাগজগুলি লিখছিল যে লালু যাদবের আক্রমণের মুখে সিপিআই(এমএল)-আইপিএফ ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিন্তু এখন কাগজের ভাষা পাল্টাচ্ছে। এখন খবরের শিরোনাম হচ্ছে “লালুর বিরুদ্ধে লাল আক্রমণ তীব্রতর”। বিশেষ করে সাম্প্রতিক নির্বাচনে দেশে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন হল তারপর থেকে জনতা দলের সংকট আরও গভীর হয়েছে। বিহারেও তাদের পার্টিতে এর প্রভাব বড় আকারেই পড়বে।

এই রকম এক সময়ে, এই রকম এক পরিবেশে আমরা শুদ্ধিকরণ আন্দোলন চালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

এটা স্পষ্ট দেখিয়ে দেয় যে আমাদের লক্ষ্য হল আগামীদিনে এই প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, দৃঢ়ভাবে উদ্যোগ নিজেদের হাতে নেওয়া এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করা। এর জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে এবং তাই ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল পার্টি সংগঠন গড়ে তোলা অবশ্য কর্তব্য। আমার মতে আগামী দিনগুলিতে পার্টিকে রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণে সক্ষম করে তোলাটাই শুদ্ধিকরণ আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য। ইতিমধ্যেই আমরা এটা করতে শুরুও করে দিয়েছি।

অন্য যে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি আমাদের সামনে ছিল তা হল, জনতা দলের মোকাবিলায় দিশার প্রশ্নটির নিষ্পত্তি করা, এই বিষয়ে ইস্যুগুলি ও কার্যধারা নির্ধারণ করা। ক্রমে ক্রমে আমরা এই প্রশ্নগুলিও সমাধান করেছি। ছাত্রদের আন্দোলন, ভূমি সংস্কারের জন্য সংগ্রাম অথবা ঝাড়খণ্ডের স্বায়ত্ততা – এই সমস্ত আন্দোলনগুলিকে আমরা এক সূত্রে গ্রথিত করতে চাই। বিহারী সমাজের গণতান্ত্রিকীকরণের স্লোগানকে তুলে ধরে আমরা ঠিক এই কাজটি করারই চেষ্টা করে গেছি। এখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, জনতা দলের মতো সরকারগুলির মোকাবিলায় এই স্লোগান, এই দিশা খুবই কার্যকরী। ইতিমধ্যে আমাদের প্রচেষ্টাগুলি জনতা দলের নিজস্ব মতাদর্শগত ভিত্তিকে ঘা দিয়েছে, তার সামাজিক ভিত্তি ও তার সমর্থক গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকেও আমরা প্রভাবিত করতে পারছি। এইভাবে দিশার প্রশ্নটিকে একটা স্তর পর্যন্ত আমরা সমাধান করতে পেরেছি এবং জনমতের বিভিন্ন ধারাও আজ মনে করছে যে বিহারে নতুন স্তরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব আমাদের পার্টিই দেবে।

মণ্ডল ইস্যুটি ধীরে ধীরে পিছনে চলে যাওয়ায় আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে আর তেমন কোনো জোরদার ইস্যু নেই। তাই কাল পর্যন্ত লালু যাদব ঘোষণা করতেন যে আইপিএফ শেষ হয়ে গেছে, তিনিই এখন প্রায়ই ফোনে আমাদের কমরেডদের বলছেন যে, আগামী নির্বাচনে জনতা দল, সিপিআই আর আইপিএফের জোট বাঁধা উচিত।

অতএব আমরা যখন শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু করছি, তখন পরিস্থিতিটা এইরকম। এই রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত, নির্দিষ্ট পরিস্থিতি আর এই অভিযানের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যটিকে বোঝা খুবই জরুরি। কিছু কমরেড ইতিমধ্যেই এই প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন এবং আমিও মনে করি যে এছাড়া শুদ্ধিকরণ অভিযানের কোনো তাৎপর্যই থাকবে না।

আমরা পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ও তার শৃঙ্খলাকে মজবুত করতে চাই। এব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের যে ভুল চিন্তাগুলি আমাদের সংগঠনে আছে, এখানে উপস্থাপিত দলিলে সে সম্পর্কে অনেক আলোচনা রয়েছে। আমার মতে দলিলে আলোচিত প্রয়োজনবাদের সমস্যাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ভূমি সংস্কারের কথা, কৃষক আন্দোলনের কথা, কৃষক সংগঠনকে শক্তিশালী করার কথা বলি; কিন্তু যখন আমরা পাটনায় মুখ্যমন্ত্রীকে ঘেরাও করি, সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাই, তখন কিন্তু সেটাকে লালু সরকারকে উৎখাত করার কোনো নির্দিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক সংগ্রাম হিসাবে দেখার এক প্রবণতা মাথা চাড়া দেয়। এটা ঠিক নয়। আমরা যে বিপ্লব অর্থাৎ সামগ্রিক পরিবর্তনের কথা বলি, তার মধ্যে যে কৃষি-বিপ্লব, কৃষক সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সে কথা আমাদের বুঝতে হবে। একের পর এক সরকার আসে, আবার চলেও যায়। লালু সরকারও চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না, অন্য কোনো সরকার তার স্থান গ্রহণ করবে। আমাদের এই সামগ্রিক আন্দোলন, এই কৃষক সংগ্রাম, এটা সাময়িকভাবে কোনো এক সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করার জন্য, তার সামনে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি করা বা তাকে পদত্যাগে বাধ্য করার মতো কোনো সীমিত রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য নয়। এই বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। একথা ঠিকই যে, কোনো সরকারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক লক্ষ্যভিত্তিক স্লোগান কৌশলগত স্তরে জনগণকে সমাবেশিত করতে সহায়ক হয়। কিন্তু কোনো এক নির্দিষ্ট সরকারকে উৎখাত করার সীমিত পরিপ্রেক্ষিতেই যদি আন্দোলনের সামগ্রিক লক্ষ্যকে বোঝা হয়, তবে সেখান থেকে শুরু হয়ে যায় এক মতাদর্শগত বিকৃতি, যাকে আমরা বলি প্রয়োজনবাদ। এই দৃষ্টিভঙ্গিই কৃষক আন্দোলনকে সময়বিশেষের কর্তব্যকর্ম করে তোলে। আমাদের সবসময়েই কৃষক সংগঠনকে শক্তিশালী করে যেতে হবে, কৃষক আন্দোলনের ওপর জোর দিয়ে যেতে হবে। আমরা প্রায়ই দেখি যে আমাদের কৃষক সংগঠন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, তারপর আবার কিছু কর্মসূচির মাধ্যমে তাকে সক্রিয় করে তোলা হয়। এরকম কেন হবে? আমাদের এক কৃষিবিপ্লব সংগঠিত করতে হবে, তাহলে আমাদের কৃষক সংগঠন কেন বারবারই এভাবে আটকে যাবে আর তারপর আবার কিছু স্লোগান, সরকারের কিছু নীতির বিরোধিতা বা তার বিরুদ্ধে ঘেরাও সংগঠিত করার ভিত্তিতে তাকে সক্রিয় করে তুলতে হবে? আমার মনে হয় এই মতাদর্শগত বিকৃতি, এই প্রয়োজনবাদ এই সমস্ত বিষয়ে কোনও না কোনোভাবে আমাদের ওপর তার ছাপ ফেলে, যেমন, কৃষক আন্দোলনকে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের এক কৌশল হিসাবে দেখা। সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর মতো দলগুলি এই পদ্ধতি নিয়ে থাকে। তাদের বন্ধু সরকার এখানে রয়েছে, আর তাই রাজনৈতিক প্রয়োজন থেকে কৃষক ইস্যুগুলি তাদের কাছে কখনও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, আবার কখনও সেগুলির কোনো গুরুত্ব থাকে না। এটা কিন্তু আমাদের নীতি হতে পারে না। বিশেষত বিহারের মতো রাজ্যে কৃষক আন্দোলন, বিপ্লবী কৃষক সংগ্রামের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে, আর এগুলির মধ্য দিয়েই আমাদের সমগ্র সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরণ ঘটাতে হবে। এই সংগ্রাম অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ী হবে, আর আপনারা জানেন আমাদের পার্টি এই সংগ্রামের কোনো নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দেয়নি।

হাজার হাজার কৃষকের অংশগ্রহণের বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে পার্টি এই সামন্তবাদ-বিরোধী সংগ্রামগুলিকে তাদের উচ্চতম স্তরে উন্নীত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তা এই কারণে যে, সমগ্র সমাজের রূপান্তরসাধনের জন্য এই সংগ্রামই হল মূল চাবিকাঠি। এটা অতএব কৃষক সংগ্রামকে কোনো নির্দিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যম করে তোলা বা আগে থেকেই তার সীমা নির্ধারিত করার প্রশ্ন নয়। এই বিষয়টিকে অবশ্যই সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে হবে, অন্যথায় এই নীতিমালা থেকে সামান্যতম বিচ্যুতিও প্রয়োজনবাদের ঢল নিয়ে আসবে।

আমি যে বিষয়টিতে জোর দিতে চাইছি তা হল, যে আন্দোলনগুলি আমরা শুরু করেছি – তা ছাত্র আন্দোলনই হোক অথবা কৃষি সংস্কার বা ঝাড়খণ্ডের স্বায়ত্ততার আন্দোলনই হোক, সেগুলিকে যে আমরা একসূত্রে বাঁধতে চাইছি সেটা বিহারী সমাজের গণতান্ত্রিকীকরণের আন্দোলন ছাড়া অন্য কিছু নয়, জনপ্রিয় ভাষায় যেটাকে আমরা বলে থাকি ৭৪-এর আন্দোলনের পুনরুজ্জীবন ঘটানো। তার ফলে লালু সরকারের কী ঘটল সেটা আমাদের কাছে বড় কথা নয়। যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার এবং সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তরণের জন্য আন্দোলনের বিকাশ ঘটানো।

এই সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতকে মাথায় রাখতে হবে। সরকারের সমালোচনা, তার ত্রুটি-বিচ্যুতির বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং তাৎক্ষণিক ইস্যুর ভিত্তিতে সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম – ব্যবহারিক রাজনীতিতে এসব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপক মানুষের মধ্যে আমাদের বক্তব্যকে নিয়ে যেতে ও তাঁদের ব্যাপকভাবে সমাবেশিত করতে এসমস্ত কিছুই সহায়ক হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু আমাদের মতাদর্শগত-রাজনৈতিক চিন্তাধারা যদি এই তাৎক্ষণিকতার মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে যায় তবে আমার আশঙ্কা, আমাদের পার্টি তার কমিউনিস্ট চরিত্রই হারিয়ে ফেলবে এবং আশু দাবিগুলির ভিত্তিতে সংগ্রামরত এক সাধারণ গণতান্ত্রিক চরিত্রের সংগঠনে পর্যবসিত হবে। এই প্রসঙ্গে দলিলে যে প্রয়োজনবাদের বিপদের কথা বলা হয়েছে তাকে আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি এবং একথাও আমি জোরের সাথে বলতে চাই যে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের পার্টিতে যে মতাদর্শগত অবক্ষয় চলছে প্রয়োজনবাদ হল তারই বহিঃপ্রকাশ।

মতাদর্শগত অবক্ষয়ের আরও বহিঃপ্রকাশ রয়েছে এবং দলিলেও সেগুলি উল্লিখিত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে এই মতাদর্শগত অবক্ষয়ের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় যখন আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এক নতুন অনুশীলনের সূচনা করলাম। আামাদের লক্ষ্য ছিল সংসদীয় সংগ্রাম এবং বিধানসভার অভ্যন্তরে সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক বিপ্লবী মডেল স্থাপন করা। আপনারা জানেন আমাদের প্রয়াস ভালোরকম ধাক্কা খেয়েছে। আমাদের চারজন বিধায়ককে জনতা দল নিজেদের পক্ষে জয় করে নিল, অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে, তাঁরা সংসদবাদের আবর্তে আটকে গেলেন এবং নিজেদের বিকিয়ে দিলেন। আমাদের পার্টির ইতিহাসে অনেক বড় বড় ভুলই হয়েছে, আমরা ধাক্কাও খেয়েছি। কিন্তু কোনো ভুল বা ধাক্কা এই দলত্যাগগুলির মতো পার্টির মর্যাদাকে এত নীচে নামিয়ে দেয়নি। এই ঘটনায় জাতীয় স্তরেও আমাদের মাথা অনেক হেঁট হয়ে গেছে, কেননা মানুষ কখনই ভাবেননি যে আমাদের বিধায়কদের প্রত্যয় এতটা শূন্যগর্ভ। আমাদের পার্টির ইতিহাসে এটা একটা কালো দাগ। এই কালো দাগকে মুছে ফেলতে আমরা চেষ্টা করেছি এবং ক্রমে ক্রমে আমরা জনগণের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে সফল হয়েছি যে আমাদের পার্টি হল সংগ্রামের, আন্দোলনের পার্টি এবং আমাদের ভাবমূর্তিকে আমরা পুনরায় অনেকটাই উজ্জ্বল করে তুলতে পেরেছি। কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যায় : এমনটা ঘটল কী করে? কেউ যদি বলেন যে তারা চরিত্রগতভাবেই ঐরকম ছিল আর তাই তাদের প্রার্থী করাটাই ঠিক হয়নি, তাহলে এই প্রশ্নটা উঠে আসে, তাদের টিকিট দেওয়া হল কেন? যদি বলা হয় যে, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি, তাহলেও এই প্রশ্নটা দেখা দেয়, নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা ব্যর্থ হলাম কেন? কাজেই শুধু এই দলত্যাগীদের দোষ দিলে পার পাওয়া যাবে না; এতবছর ধরে পার্টি সংগঠন কী করেছে, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আমি মনে করি এর মধ্যে একটা গভীর প্রশ্ন নিহিত আছে। এই বিধায়করা যে সংসদীয় বিচ্যুতির মধ্যে জড়িয়ে গেল, সেটা আমাদের সংগঠনকে প্রভাবিত করেছে যে মানসিকতা তারই সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ। আমার মনে হয় সমস্যাটিকে বিচার করার এটাই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি।

দীর্ঘদিন ধরে কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন এমন অনেক কমরেডই আজ বিধায়ক বা সাংসদ হওয়ার জন্য লালায়িত। শুধু নতুন কমরেডরাই নন, অনেক পুরোনো কমরেডের মধ্যেই আজ সংসদবাদের ব্যাধির প্রকোপ। আমরা দেখলাম, সমগ্র সংগঠনের মধ্যে পার্টি বা সংগঠনের নেতৃবৃন্দের চেয়ে সাংসদ বা বিধায়করাই অধিকতর মর্যাদা ভোগ করছেন। এনিয়ে আমরা লাগাতার সংগ্রাম চালাবার চেষ্টা করেছি। আমরা এও দেখলাম অনেক জায়গা থেকেই জনসভার জন্য সাংসদ ও বিধায়কদের ডাক পড়ছে, পার্টি ও গণসংগঠনের নেতাদের যেন কোনো গুরুত্ব নেই। সমাজের মানুষ সাংসদ ও বিধায়কদের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে থাকে, আমাদের সংগঠনেও এই ক্ষতিকারক প্রভাব পড়েছে। ঐ সমস্ত ক্ষেত্রে বিধায়ক ও সাংসদরা আত্মম্ভরী হয়ে উঠলেন এবং পার্টির সমস্ত ক্যাডারদের কাছেও তাঁরা অনুকরণীয় মডেল হয়ে উঠলেন। এইভাবে এই প্রবণতা আমাদের সমগ্র সংগঠনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। এটা ঠিক নয়, এটা ভুল হচ্ছে – এই বলে আমরা এর মোকাবিলার চেষ্টা করলাম। আমরা বললাম, পার্টি ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মর্যাদাই সর্বোচ্চ হওয়া উচিত। কিন্তু এর কোনো ফলই দেখা গেল না। আপনারা দেখবেন, সমস্যা কী গুরুতর আকার নিয়েছিল, এর বিরুদ্ধে লড়াই করা সত্ত্বেও কেউ কর্ণপাত করতে চাইছিল না। একদিক থেকে দেখতে গেলে, এই বিধায়কদের দলত্যাগ পার্টির মধ্যে পরিবেশ পরিবর্তনের সহায়ক হয়ে দেখা দিয়েছে এবং ফলে আমরা আবার সংগ্রামের পথে ফিরে এসেছি। এই সমস্ত ব্যাপারই গভীরতর অনুসন্ধানের দাবি রাখে, কেননা বিধায়ক ও সাংসদরা এখনও আছেন এবং ভবিষ্যতে তাদের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। অবশ্য তাদের প্রয়োজনীয়তাও আছে এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করতে হবে। কিন্তু আন্দোলনে বিধায়ক ও সাংসদদের সঠিক ভূমিকা কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় যাতে সংগঠনের প্রতিপত্তি ও মর্যাদাও অক্ষুণ্ণ থাকে? এটা হল লাখ টাকার প্রশ্ন। মতাদর্শগত অবক্ষয়ের জন্য সংসদীয় সংগ্রামের ক্ষেত্রে এক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠার চেয়ে বিহারে আমাদের শুরুটা বরং অনেক নেতিবাচক হয়ে দেখা দিল।

সমগ্র পার্টিকেই এই প্রশ্নে গভীর বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। সমগ্র পার্টিকেই ভাবতে হবে কখন এবং কীভাবে পার্টিতে এই মতাদর্শগত অবক্ষয় শুরু হল। আলোচনার সময় অনেক কমরেডই এ বিষয়ে বিভিন্ন মতামত রেখেছেন এবং আমাদের এক সামগ্রিক বিশ্লেষণ হাজির করতে হবে।

এই মতাদর্শগত অবক্ষয় পার্টির সাংগঠনিক জীবনে অনৈক্যের সৃষ্টি করে। আর তাই শুদ্ধিকরণ অভিযানের মধ্য দিয়ে পার্টিকে মতাদর্শগত অবক্ষয় ও সাংগঠনিক অনৈক্য এই দুই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করতে হবে। এই মতাদর্শগত অবক্ষয় টিবি রোগের মতো, যা ধীরে ধীরে সমস্ত শরীরটাকেই ক্ষয় করে তোলে। কাঠামোটা পড়ে থাকে, কিন্তু জীবাণু ভেতরে ভেতরে সমস্ত শরীরটাকেই ফাঁপা করে দেয়। মতাদর্শগত অবক্ষয় হলে একটা পার্টির ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটে। বাহ্যিক রূপ, কাঠামো ঠিকই থাকে, কিন্তু ভেতর থেকে পার্টি ক্রমশই মৃত্যুর দিকে, ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। আমার মতে, আমাদের পার্টি কোনো না কোনোভাবে মতাদর্শগত ক্ষয় রোগে আক্রান্ত, যার ফলেই এই সমস্ত বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। শুদ্ধিকরণ আন্দোলন হল এক যুদ্ধ, মতাদর্শগত ব্যাধির এক চিকিৎসা।

আমরা জানি টিবি রোগ সেরে গেলে মানুষ আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনারা শরীরের অভ্যন্তরে জীবাণুর ক্ষতিকর প্রভাবকে, পার্টির অভ্যন্তরে ক্ষয় রোগের প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করবেন এবং পার্টিকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ ও সবল করে গড়ে তুলবেন। ...

আজকের এই প্রসঙ্গে যে কথাগুলো মনে এল, সেগুলো আপনাদের কাছে রাখলাম।

(৭০ দশকের গণহত্যার তদন্তের দাবিতে, ২৭ নভেম্বর ১৯৯৮, কলকাতার নাগরিক কনভেনশনে ভাষণ)

সত্তর দশকের হত্যাকাণ্ডগুলি নিয়ে তদন্তের শ্বেতপত্র প্রকাশের; চারু মজুমদার, সরোজ দত্তের হত্যার তদন্তের দাবি উঠেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে বামফ্রন্ট নেতৃত্ব নকশালপন্থী শহীদদের ব্যবহার করতে কখনই পিছপা হয়নি। নতুন যে বিষয়টি আমরা দেখছি তা হল – এই প্রথম কোনো কংগ্রেসী নেতা, তাও আবার সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, নিজেই বলেছেন যে নকশালপন্থীদের কংগ্রেস হত্যা করেনি, হত্যা করেছে সিপিআই(এম)। তাহলে প্রশ্ন হল হত্যা কে করেছে। সিপিআই(এম) বলছে কংগ্রেস করেছে, কংগ্রেস বলছে সিপিআই(এম) করেছে। ইতিহাস বলছে এই হত্যাকাণ্ড কংগ্রেস করেছে, সিপিআই(এম)ও করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে উভয়ে মিলে করেছে। সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস তাদের মধ্যকার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমাদের শহীদদের দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহার করতে চায়। এটা একটা বড় চক্রান্ত। আমাদের শহীদদের, বিপ্লবী বামপন্থী আন্দোলনের শহীদদের হাতিয়ার করার অধিকার আমরা কংগ্রেস বা সিপিআই(এম)-কে দিতে পারি না। সেই অর্থে সমস্ত বিপ্লবী বামপন্থী কর্মী, তাঁরা যে সংগঠনেই থাকুন না কেন, তাঁদের কর্তব্য সেই সময় বাস্তবিকই কী ঘটেছিল সেই সত্যটাকে সামনে আনার। বিভিন্ন রাজ্যে যে বামপন্থী সরকারগুলি আছে, যাঁরা নিজেদের সবচেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক হিসাবে, নাগরিক অধিকার-রক্ষক হিসাবে দাবি করেন, সে পশ্চিমবাংলায় হোক বা কেরালায় হোক, তাঁরা কোনো তদন্ত করতে রাজি হচ্ছেন না। তাঁরা নিজেরা যে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সেটা উন্মোচিত হওয়ার ভয় থেকে, নাকি আরও কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এর মধ্যে জড়িত আছে, তা আমাদের জানা নেই। যাই হোক, দাবি তাঁরা সহজে মানবেন না। কাজেই আন্দোলন হবে দীর্ঘস্থায়ী। তাঁরা এই যুক্তি আনবেন – বিষয়টি ২৮ বছরের পুরোনো। কিন্তু বিদেশে কোনো মিলিটারী অফিসার যখন ঘোষণা করেন যে, তিনি চে গুয়েভারাকে হত্যা করেছেন, সেটা নিয়ে সিপিআই(এম) খুব হৈ চৈ করে। তখন তাদের কাছে এটা মনে হয় না যে, বিষয়টি ২৮ বা ৩০ বছরের পুরোনো।

১৯৭০ দশকে যে আন্দোলন হয়েছিল, তা আগামীদিনে বিশাল বিদ্রোহের রিহার্শাল মাত্র ছিল। সে আন্দোলন আজও দেশের বিভিন্ন অংশে অব্যাহত আছে। আগামীদিনে আবার ঐ হত্যাকাণ্ডগুলির পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, বা ঘটলেও তার বিরুদ্ধে যাতে একটা প্রতিবাদ সংগঠিত করা যায়, তার জন্য প্রয়োজন আজকের এই তদন্তের। এই দাবি যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে এবং আশা করা যায় যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তার মধ্যে আরও অনেক গণতান্ত্রিক মানুষকে সামিল করা হবে।

(৬ আগস্ট ১৯৯৮, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলনে সমাপ্তি ভাষণ)

আধা-সামন্ততন্ত্রের কথা যখন আমরা বলি তখন এটা ধরেই নেওয়া হয় যে সামন্ততন্ত্রের থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের একটা প্রক্রিয়া অবিরাম চলছে। কৃষিতে পুঁজিবাদ বেড়ে চলেছে এটা সত্য এবং কোনো বুর্জোয়া বিপ্লব ছাড়াও তা ঘটছে। বিপ্লবি পদ্ধতিতে সামন্ততন্ত্রকে সম্পূর্ণ উৎখাত করে পুঁজিবাদী বিকাশ আমাদের কাম্য, কিন্তু তা না করা গেলেও নিজস্ব স্বতস্ফূর্ত ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াতেও তা ঘটবে, এমনকি চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধরনের কোনো রাজত্বেও। তবে এটা হবে দীর্ঘতর কষ্টসাধ্য বহু সামন্ততন্ত্রের অবশেষকে বাঁচিয়ে রেখেও বা কিছুটা বিন্যস্ত করে। ভারতবর্ষে কৃষিতে পুঁজিবাদী বিকাশের এই প্রক্রিয়াই মূলত চলছে এবং আধা-সামন্ততন্ত্র বললে এই বিশিষ্ট প্রক্রিয়াকে বেশি সঠিকভাবে বোঝা বা চিহ্নিত করা সম্ভব। কাজেই আধা-সামন্ততন্ত্রের চরিত্রায়ণ পুঁজিবাদী বিকাশকে নাকচ করে না, বরং এই বিকাশের প্রকৃত চিত্রণ করে। অনেকে আধা-পুঁজিবাদ শব্দটা বেশি পছন্দ করেন ভারতের এই বিশিষ্ট প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করার জন্য। তবে উত্তরণটা যেহেতু সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদের দিকে তাই আধা-সামন্ততন্ত্রটাই বেশি বৈজ্ঞানিক বলে মনে হয়।

পশ্চিমবাংলায় “কৃষিতে সংকট নেই” যখন বলা হয় তার অর্থ এটা নয় যে, সাধারণ আপামর কৃষক জনসাধারণের সংকট নেই। কৃষি সংকট বলতে গ্রামের জোতদার, ধনী কৃষকদের অর্থনীতির সংকটের কথা বলা হয়। সিপিআই(এম)-এর রাজত্বে গ্রামাঞ্চলে অনেক সংস্কার হয়েছে এবং জোতদার ধনী কৃষক অর্থনীতির পুরোনো সংকট থেকে উদ্ধার করে এক নতুন স্থায়িত্ব তারা প্রদান করেছে। সেই প্রক্রিয়ায় শাসক শ্রেণীর স্তর বেড়েছে। নতুন নতুন সামাজিক স্তর শাসক শ্রেণীতে যোগ দিয়েছে। এই শাসক শ্রেণীর সাধারণ কৃষক জনগণের উপর মতাদর্শগত প্রভাবটাও বেশি। এই শাসকশ্রেণী সিপিআই(এম)-এর শক্তির মূল ভিত্তি। তাদের ভেতরে বিভিন্ন শক্তি-গোষ্ঠী আছে। তাদের মধ্যে সংঘাতও আছে। ক্রমেই তা বাড়ছে। সাম্প্রতিককালে মমতার উত্থানের পেছনে নিছক আন্দোলন ইত্যাদি কারণ নয়, এই শ্রেণীর একটা অংশ তাদের অভ্যন্তরীণ ঝগড়ার জন্য মমতার দিকে অবস্থান পরিবর্তন করেছে এবং সেটাই বড় কথা। তবে এখনও এই সংঘাত বিরাট রূপ নেয়নি। নিলে তা বামফ্রন্টের অভ্যন্তরে বা সিপিআই(এম)-এর অভ্যন্তরে ভাঙ্গন হিসাবে দেখা দিতে পারে। এই ঐক্য টিকে থাকার পেছনে কৃষি অর্থনীতির একটা স্থায়িত্ব সত্ত্বেও যেখানে শাসক শ্রেণীর এই পুরো স্তরটাই শোষণ চালিয়ে নিজেদের সম্পদশালী করছে সেখানে কৃষিমজুর এবং গরিব কৃষকদের সংগ্রামের ইস্যুগুলো আসবে, আন্দোলনও হবে, বড় বড় আন্দোলন সংগঠিত হবে এবং সেই আন্দোলন অবশ্যই করা যায়। তবে বাঁধে ফাটল ধরলে যেমন নদীর জল সেই ফাটল ধরে হুড়মুড় করে বন্যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভাসিয়ে দেয় তেমনি শাসক শ্রেণীর মধ্যে ফাটল ধরলে কৃষক আন্দোলনও যে উত্তাল গতিতে ছড়িয়ে পড়ে সেই পরিস্থিতি আছে কিনা তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে।

সিপিআই(এম)-এর সন্ত্রাসের মোকাবিলায় কিছুটা আধা-গোপন কাজের স্টাইল নিতে হবে। সিপিআই(এম) থেকে যারা আসছেন তাদের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ্য করে না দিয়ে ভেতর থেকে প্রভাব বিস্তারের জন্য কিছুদিন কাজ করার কথা ভাবা যেতে পারে। যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে আপেক্ষিকভাবে এক বড় এলাকায় বিদ্রোহ সংগঠিত করতে হবে। প্রতিরোধের যাবতীয় প্রস্তুতিও বাড়াতে হবে এবং দু-একটা জায়গায় অনুকূল অবস্থায় পাল্টা আঘাতও দিতে হবে। পশ্চিমবাংলার পরিস্থিতি ক্রমেই আমাদের অনুকূল হবে, লোক বাড়াবার সুযোগও আসবে, যেমন এই উত্তরবাংলাতে।

নতুন প্রজন্মের যুব কমরেডদের এগোতে হবে, দায়িত্ব নিতে হবে। নেতৃত্বের উচিত সাহস করে তাঁদের দায়িত্ব দেওয়া। পার্টির জন্ম এই পশ্চিমবাংলায়, আন্দোলনের সর্বোচ্চ পর্যায়ও এখানেই পৌঁছেছিল, তবে ক্লান্তি ও বার্ধক্যের লক্ষণও এখানে সবচেয়ে বেশি। নবীন প্রজন্মের হাতে পার্টিটাকে তুলে দিতে হবে। তবেই সক্রিয়তা, ত্যাগ সবকিছুই আসবে।

(৪ আগস্ট ১৯৯৮, পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণ)

এই শহর ও মহকুমার সাথে আমাদের পার্টির, আমাদের আন্দোলনের বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এটা আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতা কমরেড চারু মজুমদারের কর্মভূমি। নকশালবাড়ির মহান আন্দোলনের এখান থেকেই সূত্রপাত, তাতে বহু কমরেড রক্ত ঝরিয়েছেন এই অঞ্চলগুলিতে। তবে আমরা শুধু অতীতের স্মৃতিচারণা করতে এখানে আসিনি। ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণ করার জন্য, আরও একবার সিপিআই(এমএল)-কে, বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনকে, পশ্চিমবাংলার মাটিতে শক্তিশালী করে তোলার জন্য এই শিলিগুড়ি শহরে আপনারা মিলিত হয়েছেন।

সাম্প্রতিককালে দেশের বহু কিছুই পাল্টে গেছে। বিজেপি বহু বছর অপেক্ষার পর কেন্দ্রের ক্ষমতা দখল করেছে। বিজেপির বিরুদ্ধে বামপন্থী প্রতিরোধ কীভাবে শক্তিশালী করা যায়, আমরা সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ৪ আগস্ট পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহারে সিপিআই(এমএল)-এর নেতৃত্বে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে পুরো বিহার জুড়ে বন্ধ ডাকা হয়েছে এবং সমস্ত বামপন্থী পার্টি, বিহারের সিপিআই(এম) থেকে শুরু করে আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক সবাই মিলে এই বন্ধে সমর্থন জানাচ্ছে। বামপন্থী সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তোলার আমাদের এক প্রচেষ্টা চলছে এবং বিশেষ করে ভারতবর্ষের হিন্দি কেন্দ্রস্থলগুলিতে, যেখানে বিজেপি বা সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির স্তম্ভ ও ঘাঁটি এলাকা, সেখানে আমরা উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে একটা শক্তিশালী বাম ঐক্য গড়ে তুলে তাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছি। চিন্তাধারার জগতে হোক, অনুশীলনের জগতে হোক, সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা বামপন্থী শক্তিকে করতে হবে, বামপন্থী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, বামপন্থার ঐক্য গড়ে তুলতে হবে এবং সেই ক্ষেত্রে সিপিআই(এমএল)-কে নেতৃত্বকারী ভূমিকা নিতে হবে। এই কর্তব্য জাতীয় রাজনৈতিক কর্তব্য হিসাবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে।

পশ্চিমবাংলাতেও পরিস্থিতি অবশ্যই জটিল, এখানে এই কর্তব্যকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় এই প্রশ্নটাও আমাদের কাছে বিচার্য বিষয়। পশ্চিমবাংলায় ২১ বছর ধরে একটা বাম সরকার চলছে। আর কোনো বিষয়ে ভারত বিশ্ব রেকর্ড করতে পারেনি, অলিম্পিকে আমরা কোনো গোল্ড মেডেল পাই না, কোনো বিশেষ রেকর্ড করতে পারিনি। কিন্তু বলা হয় যে, সংসদীয় পথে একটা কমিউনিস্ট সরকার, একটা বাম সরকার চালানোর বিশ্বরেকর্ড অবশ্যই ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটা কতটা গর্বের বিষয়, সেটা নিশ্চয়ই ভেবে দেখার আছে। কিন্তু যাই হোক, এটা তো ঘটনাই এ ব্যাপারে সিপিআই(এম) একটা বিশ্বরেকর্ড করেছে। কারণ এর আগে এরকম ঘটতে দেখা যায়নি। চিলি হোক, অন্যান্য দেশে হোক, ইন্দোনেশিয়ায় হোক, আমরা দেখেছি কমিউনিস্টদের এরকম যে কোনো প্রচেষ্টার রক্তাক্ত পরিণতি হয়েছে। কিন্তু এখানে ২১ বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে বেশ দিব্যি একটা বাম পার্টি, একটা বাম সংগঠন ক্ষমতা চালিয়ে যাচ্ছে। হয়তো ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণী অনেক উদার হয়েছে, অনেক নরমপন্থী হয়ে গেছে। কিংবা হয়তো যে কমিউনিস্টরা শাসনে আছেন তারা কোথাও না কোথাও কমিউনিস্ট মৌলিক চরিত্র পরিত্যাগ করেছেন, কোথাও না কোথাও তারা স্যোশাল ডেমোক্রাসি রাজনীতির শিকার হয়েছেন, এই প্রশ্ন অবশ্যই বিচারের আছে। সিপিআই(এম) যখন ক্ষমতায় আসীন হয় তার আগে ওঁদের নিজেদের ভাষায়, পশ্চিমবাংলার বুকে কংগ্রেসের আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস চলেছিল এবং তাতে বহু বামপন্থী কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু এই সরকার ক্ষমতায় এলো, ২১ বছর ক্ষমতায় থাকল, সেই আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের জন্য দায়ী একজন পুলিশ অফিসারেরও শাস্তি হল না, একজনও কংগ্রেসী গুণ্ডা গ্রেপ্তারই হল না। কমরেড চারু মজুমদার, কমরেড সরোজ দত্ত যাঁদের রহস্যজনকভাবে হত্যা করা হল, তা নিয়ে আমাদের পার্টি এবং পশ্চিমবাংলার বিশিষ্ট বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ও জনগণ বারবার দাবি জানানো সত্ত্বেও তারা কিন্তু তদন্ত বসালেন না। এমনকি পুলিশ রেকর্ডে কমরেড সরোজ দত্ত এখনও পর্যন্ত ফেরার, এই পশ্চিমবাংলায় তার হত্যার কথা স্বীকারই করে না। সিপিআই(এম) নেতৃত্ব এ সমস্ত তথ্য জানে এবং নির্বাচনে এগুলিকে কাজে লাগায়। কিন্তু তারা আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কোনো তদন্ত তারা করেনি। কাজেই প্রশ্নটা ওঠে। তাদের মুখে সীমিত ক্ষমতার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু ক্ষমতা যে এতটাই সীমিত এটা আমাদের জানা ছিল না। তাই প্রশ্ন ওঠে, আপনাদের ক্ষমতার এই সীমা সংবিধান ঠিক করে দিয়েছে নাকি সেই সীমা আপনারা নিজেদের জন্য ঠিক করে নিয়েছেন।

পশ্চিমবাংলায় ২১ বছরের শাসনে এক সর্বাত্মক অধঃপতন ঘটেছে। সেটা ওদের নেতারাই মাঝে মাঝে স্বীকার করেন। এবং এই নিয়ে ওদের মধ্যে কিছু বিবাদও আছে। এর আগেও সিপিআই(এম)-এর ভেতরে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন এবং কিছু বিক্ষুব্ধ সিপিআই(এম) গোষ্ঠী আমরা গত ১০ বছরে বারবার গড়ে উঠতে দেখেছি। কিন্তু ঐ বিক্ষুব্ধ গ্রুপগুলির ভবিষ্যৎ আমরা ভালো দেখিনি, তাদের বেশিরভাগই হয় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, নয়তো কংগ্রেসের সাথে হাত মিলিয়েছে। তবে এমনও খবর আছে, পশ্চিমবাংলায় বা গোটা ভারতবর্ষে সিপিআই(এম)-এর মধ্যে একটা অংশ আছে, তাতে কিছু নেতারাও আছেন, যাঁরা পার্টির এই সর্বাত্মক অধঃপতন নিয়ে চিন্তিত এবং পার্টির মধ্যে থেকে তাঁরা এই অধঃপতনের বিরুদ্ধে আন্তঃপার্টি সংগ্রাম চালাচ্ছেন বলে তাঁরা মনে করেন এবং তাঁরা আশা করেন আন্তঃপার্টি লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে সিপিআই(এম)-এর যে সমাজগণতান্ত্রিক অধঃপতন হচ্ছে তার থেকে তাকে বিপ্লবী দিশায় ফিরিয়ে আনতে পারবেন। যদিও আমাদের এই আশা নেই।

পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এমএল)-এর অন্যান্য কিছু গ্রুপ আছে। এখানে অসীম চ্যাটার্জী এখন সিপিআই(এম)-এর চেয়েও বড় সিপিআই(এম)। তিনি বলছেন কংগ্রেসের সাথে হাত মেলাতে হবে, মোর্চা বানাতে হবে। এখানে কানুবাবু আছেন, নকশালবাড়ির সম্মানীয় নেতা, নকশালবাড়ির প্রতীক হিসাবে জাতীয় ক্ষেত্রে তাঁর মর্যাদা আছে। আমাদের পার্টি তাঁকে বলেছিল, আপনি এক বিশিষ্ট ব্যক্তি, আমাদের আন্দোলনের সাথে আপনি একটা প্রতীক হিসাবে আছেন, আপনার পক্ষে কোনো সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতি অথবা স্থানীয় দু-চারটে গ্রাম নিয়ে রাজনীতি করাও শোভা পায় না। তখন ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট ছিল, আমরা আহ্বান করেছিলাম, আপনি আসুন এবং জাতীয় স্তরে একজন জাতীয় নেতা হিসাবে সারা দেশে এই আন্দোলনের বীজ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আপনার ব্যক্তিত্ব, আপনার প্রভাবকে কাজে লাগান। আপনাকে আমরা জাতীয় মঞ্চ তৈরি করে দেব। কিন্তু জানি না কেন তিনি তা স্বীকার করেননি। বরং উল্টে নিজের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে, কমরেড চারু মজুমদারের বিরুদ্ধে, নকশালবাড়ির আন্দোলনের বিরুদ্ধে এবং অতীতের সেই যা কিছু গৌরবময়, যার জন্যই কানু সান্যালকে কানু সান্যাল হিসাবে সারা দেশ জানত, তিনি সেই সব কিছুরই বিরোধিতা করতে শুরু করলেন। এবং আপনারা জানেন তিনি আজ কী অবস্থায় আছেন।

সুতরাং আমরা দেখছি, এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ এসে উপস্থিত হয়েছে বামপন্থী আন্দোলনে, কমিউনিস্ট আন্দোলনে। সমাজগণতান্ত্রিক পার্টিগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকটের শিকার, নৈরাজ্যবাদী শক্তিগুলো দক্ষিণপন্থার সাথে হাত মেলাচ্ছে, এমন এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে আমাদের উপর এক বিশেষ দায়িত্ব হল সিপিআই(এমএল)-এর আন্দোলনকে সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া এবং সেই সাথে পশ্চিমবাংলার বুকে তার পুনর্জাগরণ ঘটানো। তবে সেটার জন্য বহু কঠোর-কঠিন প্রচেষ্টা দরকার। যে সক্রিয়তা দিয়ে আজ আপনারা কাজ করছেন আমি মনে করি তার দশগুণ বেশি সক্রিয়তার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে প্রয়োজন ছাত্র-যুবদের যে শক্তি কিছু ফ্যাসিবাদী শক্তির পেছনে, ‘লাল হঠাও’ শ্লোগানের পেছনে ছুটছে, সেখান থেকে তাদের ফিরিয়ে আনা। কারণ তারাই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। আমার মনে হয়, কৃষক ফ্রন্টে কাজ করার পরে আপনাদের অন্যতম দায়িত্ব ছাত্র-যুবদের মধ্যে নতুন করে বিপ্লবী রাজনীতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। আর এই সফলতা আমরা পাব না যদি নতুন করে আত্মবলিদান ও আত্মত্যাগ করতে না পারি। বীরত্বের যে ঐতিহ্য আমাদের রয়েছে সেই ইতিহাসকে সামনে রেখে আমাদের ভবিষ্যতের রাস্তা ঠিক করতে হবে। আমার এটা দৃঢ় বিশ্বাস, সমাজগণতন্ত্রীদের সংকটের জন্য পশ্চিমবাংলায় আমাদের এগিয়ে যাওয়ার এবং নতুন এক জনজোয়ারের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি এই সম্মেলন থেকে আপনারা সেই দিশা ও আস্থা নিয়ে যাবেন এবং নতুন করে সমস্ত শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করবেন এক নতুন বিপ্লবী জোয়ার সৃষ্টি করার জন্য।

ইনক্লাব জিন্দাবাদ!

(২৭ মার্চ ১৯৯৫, কালনায় কমরেড আবদুল হালিমের স্মরণসভায় ভাষণ)

সর্বপ্রথম আমি আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে শহীদ কমরেড আবদুল হালিমকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছি। আমার বিশ্বাস আমাদের পার্টি অবশ্যই কমরেড হালিমের হত্যার বদলা নেবে, প্রতিশোধ নেবে।

বামপন্থী রাজত্বে তা সে পশ্চিমবাংলাতেই হোক বা ত্রিপুরাতেই হোক, মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার থাকছে না। এটা আমার কথা নয়, সিপিআই(এম)-এর পলিটব্যুরোর সদস্য নৃপেন চক্রবর্তী নিজেই বলেছেন যে বামফ্রন্টের রাজত্বে এত বিকৃতি ঘটেছে, এত পতন ঘটেছে, সে পশ্চিমবাংলাতেই হোক বা ত্রিপুরাতেই হোক, মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার থাকছে না। আমরা কংগ্রেসী জমানায় কংগ্রেসী সন্ত্রাস দেখেছি, এই কালনা কংগ্রেসী সন্ত্রাস দেখেছে। কীভাবে গোটা শাসনব্যবস্থা, গোটা পুলিশবাহিনী সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেসীরা বিরাট আকারে সন্ত্রাস নামিয়েছিল। আজ একই জিনিস সিপিআই(এম)-এর রাজত্বে দেখছি। যদি পরিস্থিতি এরকমই হয়ে ওঠে, সরকার নিজেই যদি সন্ত্রাসের পথ গ্রহণ করে, সরকারের পুলিশবাহিনী যদি শাসক পার্টির ইশারাতেই সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার নামিয়ে আনে, সরকারের গুণ্ডারা যদি আমাদের কমরেডদের ও সাধারণ মানুষের ওপর জঘন্য অত্যাচার নামিয়ে আনে, তাহলে সাধারণ মানুষেরও অধিকার আছে এই অত্যাচারের প্রতিরোধ করার, প্রয়োজন হলে সশস্ত্রভাবে প্রতিরোধ করার। এই অধিকার আপনার নৈতিক অধিকার।

সিপিআই(এম) আজ এমন একটা পার্টি হয়ে উঠেছে যে পার্টি তার ভিতরের কোনো প্রতিবাদ সহ্য করতে পারছে না। এই ধরনের চরিত্র কোনো কমিউনিস্ট পার্টির হতে পারে না। এই ধরনের চরিত্র একটা ফ্যাসিস্ত পার্টিরই শুধু থাকে। এই প্রশ্নটা ভাববার আছে, যে পার্টি একসময় কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে গড়ে উঠেছিল ক্রমেই একটা ফ্যাসিবাদী পার্টি হিসাবে তার পতন ঘটছে। সেই পার্টির মধ্যে আপনি নেতৃত্বের লাইন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না, নেতৃত্বের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারবেন না, নেতাদের জনগণ বিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদ করতে পারবেন না। যদি তা আপনি করতে চান, তাহলে আপনার বিরুদ্ধে সবরকমের কুৎসা রটনা করা হবে, আপনাকে পার্টি থেকে বার করে দেওয়া হবে। তবু যদি আপনি চুপ না করেন তাহলে ঠাণ্ডা মাথায় আপনাকে হত্যা করা হবে। আমাদের করন্দার ক্ষেতমজুর কমরেডদের, কমরেড আবদুল হালিমের, নাদনঘাটের কমরেডদের ‘অপরাধ’ এটাই ছিল যে, তাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন পার্টি নেতৃত্বের দাদাগিরির বিরুদ্ধে, সিপিআই(এম) নেতৃত্বের দুর্নীতির বিরুদ্ধে। আমি বলতে চাই, এই ‘অপরাধ’ আমাদের পার্টি হাজারবার করতে থাকবে এবং তার জন্য এক নয় – হাজার হাজার আবদুল হালিমকেও যদি জীবন দিতে হয়। আমার বিশ্বাস বর্ধমানের সংগ্রামী মানুষের ভিতর থেকে, পশ্চিমবাংলার সংগ্রামী মানুষের ভিতর থেকে আবদুল হালিমদের অভাব হবে না।

আজ পশ্চিমবাংলায় তারা শিল্পায়নের নামে দেশী-বিদেশী ধনিকশ্রেণীর সাথে বড় বড় বুর্জোয়াদের সাথে দহরম মহরম করছে। গ্রামাঞ্চলে তারা ধনী চাষি, জোতদারদের সাথে হাত মেলাচ্ছে। আমাদের পার্টি এই ঘটনাগুলির প্রতিবাদ করছে। যেহেতু এই প্রতিবাদ গোটা পশ্চিমবাংলায় একমাত্র আমাদের পার্টিই জোরালোভাবে জানিয়েছে, সেটাই একমাত্র কারণ যে, সিপিআই(এম) সর্বত্রই চেষ্টা করছে আমাদের পার্টিকে শেষ করে দেওয়ার। কারণ তারা জানে যে আগামীদিনে সিপিআই(এম)-এর যে বিকল্প এই পশ্চিমবাংলায় উঠে আসবে সেই বিকল্প একমাত্র ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)।

একসময় এই পশ্চিমবাংলায়, বামপন্থীদের এই বর্ধমান জেলায় আমাদের যে কোনো প্রচেষ্টা যখন শুরু হত, শুরুতেই ওরা আমাদের মেরে শেষ করে দিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এবার আমরা দেখেছি, করন্দায় তারা আমাদের ওপর গণহত্যা সংগঠিত করল, কিন্তু আজও করন্দার মাটিতে আমাদের পার্টি বেঁচে আছে। আর করন্দার মাটি থেকে আমাদের পার্টি আরও শক্তিশালী হয়েছে। কালনায় তারা আবদুল হালিমকে মেরে ভেবেছিল এখান থেকে তারা আমাদের পার্টিকে উৎখাত করবে। কিন্তু কালনায় আমাদের পার্টি আরও শক্তিশালী হয়েছে। নাদনঘাটে অত্যাচার করে তারা ভেবেছিল আমাদের পার্টিকে সেখান থেকে উৎখাত করবে। কিন্তু আমাদের পার্টি সেখানে ব্যাপক গণভিত্তি নিয়ে এগিয়ে গেছে। যতই তারা হত্যা করে আমাদের শেষ করতে দিতে চাইছে, ততই বেশি বেশি করে সিপিআই(এম)-এর ভিতর থেকেই সমস্ত সৎ বামপন্থী কর্মীরা, যাদের মধ্যে আজও বিবেক আছে, সততা আছে, হিম্মত আছে, বেশি বেশি সংখ্যায় ঐ পার্টি থেকে বেরিয়ে আসছেন এবং সিপিআই(এমএল)-এর পতাকাতলে সমাবেশিত হচ্ছেন।

আজ নতুন যুগে, নতুন পরিস্থিতিতে এই বর্ধমান জেলার বুকে বিপ্লবী বামপন্থী শক্তি যেভাবে এগিয়ে আসছে তাতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সুবিধাবাদী বামপন্থীদের সাথে বিপ্লবী বামপন্থীদের যে সংগ্রাম দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে পশ্চিমবাংলার বুকে চলছে, তার রণভূমি হচ্ছে এই বর্ধমান। এবং এই সংগ্রামে আমাদের পার্টি অবশ্যই এবার বিজয়ী হবে।

সমস্ত বামপন্থী কর্মীরা, তাঁরা যে কোনো বামপন্থী পার্টিতেই থাকুন না কেন, সকলের কাছে আমাদের আহ্বান, আসুন আমরা একসাথে হাত মেলাই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বিপ্লবী বামপন্থার পতাকা এই বর্ধমান জেলা থেকেই উঠতে থাকবে। এখান থেকে বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে যেতে থাকবে। নতুন পর্যায়ে যে নকশালবাড়ি পশ্চিমবাংলায় ঘটবে, তার রণভূমি হবে এই বর্ধমান জেলাই।

(৯ ডিসেম্বর ১৯৯৪, পার্টির নদীয়া জেলা সম্মেলন উপলক্ষে কৃষ্ণনগর টাউন হল ময়দানে জনসভায় ভাষণ)

এই পশ্চিমবাংলায় গত সতের বছর ধরে একটা বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আছে। এত বছর ধরে শাসন করার পর আজ তাঁরা বলছেন, কেন্দ্রের নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগ করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। হঠাৎই আমরা দেখছি এই সরকারের নেতারা, এই পার্টির নেতারা, কেন্দ্রের নয়া আর্থিক নীতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়েছেন। হঠাৎই দেখা যাচ্ছে বোফর্স কেলেঙ্কারির অন্যতম নায়ক হিন্দুজাদের প্রশংসায় তাদের হয়ে সাফাই গাইছেন এখানকার সিপিআই(এম) নেতারা। আজ তাঁরা নয়া আর্থিক নীতি পশ্চিমবাংলায় চালু করতে চাইছেন, কাল কেন্দ্রের কৃষি নীতিও চালু করবেন, শিক্ষা নীতিও চালু করবেন। এবং সব ক্ষেত্রেই তাঁদের একটাই যুক্তি, পশ্চিমবাংলা তো আলাদা নয়, ভারতেরই অঙ্গ; আমাদের ক্ষমতা সীমিত, তাই আমরা বাধ্য, আমাদের সেটা করতে হচ্ছে।

এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, একথা আমাদের পার্টি বহু বছর আগেই বলেছিল। বলেছিল, তুমি যদি এই শাসন ক্ষমতা এভাবেই চালিয়ে যাও বহু বছর ধরে, এই শাসন ক্ষমতা চালাবার দায়িত্ব যদি তুমি নিজের হাতেই নিয়ে নাও, তাহলে এই ব্যবস্থার জন্যই তোমাকে কাজ করতে হবে, অন্যথা কিছু হতে পারে না।

আমাদের পার্টি যে কথাটা বলেছিল আজ তাঁরা নিজেরাই সেসব কথা স্বীকার করছেন এবং সেই নিয়ে তাঁদের নিজেদের পার্টির মধ্যেই ভালোরকম বিতর্ক হচ্ছে, ভালোরকম সংকট এসেছে। অনেকেই একথা বলছেন যে এত বছর ধরে শাসন করে যাওয়া, এটা তো ভালোর জায়গায় খারাপ হল। সতের বছরের মধ্যে আমাদের এই অবস্থা হয়েছে, আরও পাঁচ-সাত বছর ধরে শাসন করলে আমাদের আরও কী পরিণতি হবে। আমি বলছি এই পার্টি যেভাবে রাজনৈতিক নীতি পাল্টাচ্ছে, সেভাবেই তাদের সংগঠনের চরিত্রটাও পাল্টে যাচ্ছে। এখন পার্টির মধ্যে কংগ্রেসের মতনই বিভিন্ন গ্রুপ গড়ে উঠেছে। নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি-মারামারি শুরু হয়েছে।

তাদের রাজনৈতিক নীতিই হোক, সংগঠনের দুর্নীতিই হোক, তাদের সংগঠনের চরিত্রই হোক, এটা ক্রমেই কংগ্রেসের মতন হয়ে যাচ্ছে। এখানে প্রশ্ন উঠছে, যদি একটি বামফ্রন্ট সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া আর্থিক নীতিই এখানে চালু করে, তাহলে শাসক শ্রেণীর জন্য এই পার্টির শাসনটাই তো ভালো। সেই কারণে আমার মনে হয়, বোধহয় পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেস পার্টির প্রাসঙ্গিকতা শেষ হয়ে গেছে। কংগ্রেসকে দিয়ে যা করার কথা ভারতের শাসকশ্রেণী আগে ভাবত, ওরা দেখছে সেই কাজটাই অনেক ভালোভাবে, অনেক সুষ্ঠুভাবে বামফ্রন্ট সরকারকে দিয়ে করা যায়। এই একটি পরিস্থিতির পরিবর্তন এসেছে।

কাজেই আমাদের কাছে, বিপ্লবী বামপন্থীদের কাছেও দায়িত্ব এসে গেছে যে প্রধান বিরোধী পক্ষ হিসেবে আমাদের উঠে আসতে হবে। আপনাদের সেই দায়িত্ব নিতে হবে। কংগ্রেসের যে বিরোধিতা আছে এই বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে, তার আর কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, কারণ বামফ্রন্ট সরকার সেইসব নীতি কার্যকরী করছে যেটা একটি কংগ্রেস সরকার এখানে থাকলে করত। যদি এই বামফ্রন্ট সরকার কেন্দ্রেরই আর্থিক নীতি ও অন্য সমস্ত নীতি প্রয়োগ করে, তাহলে যে সমস্ত চাপ আসবে মেহনতি মানুষের ওপর, শ্রমিকশ্রেণীর ওপর এবং গ্রামাঞ্চলের ক্ষেতমজুর ও গরিব কৃষকদের ওপর, সেই সমস্ত মানুষদের সংগঠিত করার, সেই সমস্ত মানুষের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এখন এসে গেছে আমাদের কাঁধে। কাজেই আগামীদিনে পশ্চিমবাংলায় এই পরিস্থিতিটাই দেখা যাবে যে এখানে বামফ্রন্ট থাকবে সরকারে এবং প্রধান বিরোধী শক্তি হিসাবে দাঁড়াবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। এই দুটির মধ্যে সংগ্রামের ভেতর দিয়েই ফয়সালা হবে ভারতবর্ষের পরিবর্তন, ভারতবর্ষের বিপ্লব কোন পথে এগোবে।

এই নদীয়া জেলায় অন্যান্য নকশালপন্থী গ্রুপও আছে, ঐতিহাসিকভাবেও তাঁরা থেকেছেন। আমি আশা করব বিভিন্ন নকশালপন্থী গ্রুপের সাথে যুক্ত বিভিন্ন কমরেডরা, বন্ধুরা সকলেই একথাটা ভাববেন যে আমাদের মধ্যেকার বিভেদ আমাদের আন্দোলনকে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কাজেই আমি আশা করব নতুন করে গড়ে ওঠা, নতুন করে এগিয়ে চলা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-র পতাকাতলে সকলেই আপনারা ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে পশ্চিমবাংলায় আমাদের ওপর যে বিরাট দায়িত্ব এসেছ সে দায়িত্ব আমরা সকলে মিলে পালন করব।

সিপিআই(এম)-এর মধ্যেও, আমি বিশ্বাস করি, অনেক সৎ মানুষ আছেন এবং তাঁরাও চিন্তিত। যে দিকে, যে দিশায়, এ সরকার চলেছে সকলের কাছেই সেটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সব বামপন্থী কমরেডদের কাছেও আমি অনুরোধ করব আপনারা আপনাদের পার্টির নীতি নিয়ে ভেবে দেখুন এবং আসুন আমরা সকলে মিলে নতুন এক বামফ্রন্ট এখানে গড়ে তুলি, নতুন এক বামমোর্চা এখানে গড়ে তুলি। একটা বিপ্লবী পথে যে বামফ্রন্ট, যে বামমোর্চা এগিয়ে যাবে।

(২২ এপ্রিল ১৯৯৪, পার্টি প্রতিষ্ঠার রজত জয়ন্তী সমাবেশে শহীদ মিনার ময়দানে ভাষণ)

কমরেডস,

আজ থেকে ২৫ বছরে আগে আমাদের পার্টি সিপিআই(এমএল)-এর জন্ম হয়েছিল এবং ১৯৬৯ সালের ১ মে এই শহীদ মিনারেই তা ঘোষণা করা হয়েছিল। আজ পার্টির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমরা সেই ঐতিহাসিক ময়দানে আবার মিলিত হয়েছি।

আমাদের আন্দোলনকে প্রচণ্ড দমন-পীড়ন সহ্য করতে হয়েছে – ভারতবর্ষে কোনো আন্দোলনকেই বোধ হয় এত বেশি অত্যাচার, এত বেশি দমন-পীড়ন সহ্য করতে হয়নি। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে সিপিআই(এমএল)-কে শেষ করা যায়নি, সে বেঁচে আছে এবং এগিয়ে চলেছে।

অনেকে ভাবতেন যে নকশালপন্থীরা দমন দিয়ে শেষ হয়নি বটে কিন্তু এদের বহু গ্রুপ আছে – নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করেই ক্রমে ক্রমে এরা শেষ হয়ে যাবে। ইতিহাস কিন্তু প্রমাণ করেছে যে এই ধারণাটিও ছিল ভুল। ইতিহাসের অনিবার্য নিয়মে ঠিক যেভাবে রুশ বিপ্লবে বহু গ্রুপের ভেতর থেকে কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরাই সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ধারা, সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে উঠে এসেছিলেন – বাকি সমস্ত গ্রুপই ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে ভারতবর্ষে। বহু গ্রুপের ভেতরকার সংঘাতের মধ্যে দিয়ে, রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্য দিয়ে আমরাই ভারতবর্ষের পার্টি হিসাবে বেরিয়ে এসেছি। বহু গ্রুপই ক্রমে ক্রমে বিলীয়মান এবং বাকিরা সেই পথের দিকেই চলেছে।

অনেকে আবার মনে করেছিলেন নতুনভাবে উঠে দাঁড়ালেও আজকের পরিস্থিতিতে আবার আগেকার মতো কাণ্ডকারখানা, পুরোনো ভুলের পুনরাবৃত্তিই এরা করবে এবং এই প্রক্রিয়ায় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে – শেষ হয়ে যাবে। আমরা এই ধারণাকেও ভুল বলে প্রমাণ করেছি। আমাদের পার্টি ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রেখে তার লাইনকে বিকাশ করেছে এবং চরমতম কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায় তা দেখিয়ে দিয়েছে। নকশালপন্থী বলতে যদি সশস্ত্র বিপ্লবের ফাঁকা বুলি আওড়ানো মনে করা হয়, যদি সশস্ত্র দল বানিয়ে কিডন্যাপিং বোঝানো হয়, সশস্ত্র স্কোয়াড বা দলের সাহায্যে পোস্ট অফিস পোড়ানো, রেল লাইন ওপড়ানো মনে করা হয়, তথাকথিত গণআদালতের নামে লোকজনের কান-নাক কাটা বোঝায়, শিশু-মহিলা নির্বিশেষে সাধারণ গরিব মানুষের গণহত্যা বোঝানো হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই আমরা নকশালপন্থী নই। যদি নকশালপন্থী বলতে সেই শক্তিকে বোঝানো হয়ে থাকে, যে শক্তি লক্ষ লক্ষ কৃষক সাধারণের সংগ্রামকে নেতৃত্ব দেবে, তাদের বিপ্লবী গণআন্দোলনকে নেতৃত্ব দেবে, সেই বিপ্লবী গণআন্দোলনের মধ্যে তাদের সশস্ত্র প্রতিরোধকে নেতৃত্ব দেবে – তাহলে সেই অর্থে আমরা অবশ্যই নকশালপন্থী এবং আমরাই ভারতবর্ষের একমাত্র নকশালপন্থী।

কমরেডস, নকশালবাড়ির সংগ্রামের ধারাবাহিকতাকে শুধু আমাদের পার্টিই এগিয়ে নিয়ে চলেছে। পার্টি পুনর্গঠন করতে গিয়ে আমাদের পার্টির ভেতরে যে নৈরাজ্যবাদীরা ছিল তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এবং আজ সংসদীয় সুবিধাবাদী শক্তিগুলি, সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর মতো পার্টিগুলি যারা বামপন্থার নেতৃত্ব নিয়ে বসে আছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের পার্টি সবচেয়ে শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে দাঁড়িয়েছে। আজ প্রশ্ন এসেছে ভারতবর্ষের বাম আন্দোলনের, কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব কাদের হাতে থাকবে। এই সংসদীয় সুবিধাবাদী পার্টিগুলির হাতে থাকবে নাকি একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি – ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-র হাতে থাকবে। করন্দা-কালনার ঘটনা দেখিয়ে দেয় সিপিআই(এম)-এর ভেতর যে বিপ্লবী শক্তি ছিলেন, বিপ্লবী কমরেডরা ছিলেন, তাঁরা সিপিআই(এম) থেকে ভেঙে আমাদের  পার্টিতে যোগ দিচ্ছেন। সিপিআই(এম)-এর দেউলিয়াপনা এখানেই যে আমাদের সাথে রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে এই সমস্ত শক্তিগুলিকে তারা আটকে রাখতে পারেনি, তাই তারা হত্যার রাজনীতি আমদানি করে তাদের ভাঙ্গনকে ঠেকাতে চাইছে। করন্দা-কালনা সত্ত্বেও, সেইসব হত্যাকাণ্ড সত্ত্বেও, আমাদের পার্টি রাজনৈতিক প্রতিবাদই করেছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতায় ২৩ মার্চ আমি একটা কথা বলেছিলাম যে এরকম করন্দা যদি ঘটতে থাকে তাহলে আমরা অবশ্যই নকশালবাড়ি সংগঠিত করব। কারণ পশ্চিমবাংলার ক্ষেতমজুর-গরিব কৃষকরা পড়ে পড়ে মার খেতে পারেন না, তাঁদের অধিকার আছে প্রতিবাদ করার, প্রতিরোধ করার। এই কথাতে তাঁরা আমাদের বিরুদ্ধে রাগ দেখালেন। আশ্চর্য লাগল আমার। একজন নকশালপন্থী হয়ে আমি তো নকশালবাড়ির কথাই বলব। আমি তো আর মামাবাড়ির কথা বলতে পারি না, সাঁইবাড়ির কথা বলতে পারি না। এতে অত আশ্চর্যের কী ছিল। অথচ দেখলাম তাঁরা আমার ঐ বক্তব্যের সূত্র ধরে বললেন যে পশ্চিমবাংলায় তাঁরা আমাদের সাথে আর সংযুক্ত কার্যকলাপ করবেন না। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংযুক্ত কার্যকলাপও তাঁরা আমাদের সাথে করবেন না। যে মহামিছিল আমরা একসাথে করতে যাচ্ছিলাম সেটা ছিল ডাঙ্কেল প্রস্তাবের বিরুদ্ধে – গ্যাট চুক্তির বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁরা অর্জুন সিং-এর সাথে হাত মেলাতে রাজি, তামাম জনতা দলের শক্তির সাথে হাত মেলাতে রাজি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের মতো বিপ্লবী বাম শক্তির সাথে হাত মেলাতে রাজি নন।

কমরেডস, আমরা তাঁদের বারবার বলেছি, পশ্চিমবাংলা একটি রাজ্য – ভারতবর্ষের একটি রাজ্য মাত্র। এখানে আপনারা সরকারে আছেন, আমরা আপনাদের বিরোধী পক্ষে আছি। আমাদের মধ্যে সংঘাত থাকবে এটা স্বাভাবিক। এ সংঘাত আজকের নয়, এ সংঘাতের জন্ম ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ি থেকেই। নকশালবাড়ির সেই সময়ে আপনারা সরকারে ছিলেন এবং আমরা কৃষকের বিদ্রোহ সংগঠিত করেছিলাম। আপনাদের এবং আমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক এখান থেকেই তো শুরু। আমরা বলেছিলাম পশ্চিমবাংলায় না হয় থাক, আমাদের মধ্যে সংগ্রাম-সংঘাত থাকতেই পারে। কিন্তু পশ্চিমবাংলা ভারতবর্ষের একটি রাজ্য মাত্র। গোটা দেশের কথা ভাবুন, জাতীয় স্বার্থের কথা ভাবুন। জাতীয় অর্থে আপনারাও একটা বিরোধীপক্ষ, আসুন সেখানে হাত মেলাই। আসুন সেখানে আমরা সমস্ত বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি মিলে কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকারের বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী বামপন্থী প্রতিরোধ গড়ে তুলি। এটা ছিল আমাদের আহ্বান। আমরা তাঁদের বারবার বলেছি আপনারা যদি নরসিমহা রাওয়ের বিরুদ্ধে সত্যিকারের আন্দোলন করতে চান, কেন্দ্রের কংগ্রেসী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে আপনারা যদি সত্যিই আন্তরিক হন, তাহলে অবশ্যই আমাদের মতো বিপ্লবী বামপন্থী শক্তির সাথে আপনারা হাত মেলাতে চাইবেন। কমরেডস, তাঁরা তাতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন যে পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের মর্যাদাটাই সবচেয়ে বড়। সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার চেয়েও বড়। সব কিছুর থেকে বড়। আমরা বলেছি বামফ্রন্ট সরকারের মর্যাদা আপনারা নিজেরাই স্খলন ঘটাচ্ছেন – রশিদ খানের সঙ্গে যোগসাজশের মধ্যে দিয়ে, করন্দার মধ্যে দিয়ে। আপনাদের বামফ্রন্ট সরকারের মর্যাদার স্খলন যদি ঘটে তার জন্য আমরা দায়ী নই, দায়ী আপনাদের কার্যকলাপ।

কমরেডস, যখন তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে এখানকার যৌথ সংগ্রাম থেকে আমাদের বাদ দেবেন তখন পশ্চিমবাংলার দশটি বামপন্থী পার্টি আমাদের সঙ্গে আসেন। আমি এ ব্যাপারে খুবই খুশি হয়েছিলাম। তাঁরা বলেন যে সিপিআই(এম)-এর এই আচরণ অগণতান্ত্রিক। তাঁরা স্পষ্টভাবে প্রতিবাদ জানান এবং তাঁরা এই সিদ্ধান্তও নেন যে সেই মহামিছিলে সামিল হবেন না। বামপন্থী পার্টিগুলির এই বলিষ্ঠ ও সাহসী সিদ্ধান্তের, বামপন্থী মর্যাদার এই সিদ্ধান্তের জন্য এই মঞ্চ থেকে আমি তাঁদের সকলকে আমার বিপ্লবী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমার খুব আফশোস রয়ে গেল যে বামফ্রন্টের মধ্যেকার কিছু শরিক পার্টি তাঁদের মেরুদণ্ড সোজা করে এই অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারলেন না। আলাদাভাবে তাঁরা বলেন যে আমাদের এটায় ঠিক সায় ছিল না। কিন্তু তাঁরা এই ধরনের অগণতান্ত্রিক বামপন্থা-বিরোধী – বামপন্থী শক্তির ক্ষয় করবে এমন এক সিদ্ধান্তের স্পষ্ট প্রতিবাদ করতে পারলেন না। বামফ্রন্টের ভেতরে থাকতে থাকতে তাঁদের এই করুণ অবস্থা হয়েছে। যাই হোক, আমাদের পার্টি এই সংসদীয় সুবিধাবাদ, সমাজগণতন্ত্রী রাজনীতির বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। পাশাপাশি নৈরাজ্যবাদী ধারার বিরুদ্ধেও সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এর ভিতর দিয়ে আমাদের এই পার্টিই হয়ে উঠবে ভারতবর্ষের বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টি – এই বিশ্বাসে আমরা দৃঢ়।

কমরেডস, আমি আপনাদের বলতে চাই যে পথ হাজার হাজার শহীদ তাঁদের রক্ত দিয়ে সিঞ্চিত করেছেন, যে পথের নির্মাণ করেছেন, আমাদের পার্টি সেই পথেই চলছে। আমাদের পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড চারু মজুমদারের যে আহ্বান ছিল – জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ, আমাদের পার্টি সেই দিশা-নির্দেশ নিয়েই নিজেকে পুনর্গঠিত করে এগিয়ে চলেছে। পার্টি প্রতিষ্ঠার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে আমি আমাদের পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মহান নেতা কমরেড চারু মজুমদারকে সমগ্র পার্টি ও সমগ্র কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে বিপ্লবী অভিনন্দন জানিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

(২৩ মার্চ ১৯৯৪, কলকাতায় বিধানসভা অভিযানে ভাষণ)

কমরেডস,

গত বছরের মাঝামাঝি করন্দায় যখন একটা গণহত্যা হয়, আমি সেখানে গিয়েছিলাম পাঁচ-পাঁচজন ক্ষেতমজুর কমরেডের মৃতদেহে মাল্যার্পণ করার জন্য। সেদিন করন্দায় আমরা যা দেখেছিলাম সেটা নিছক একটা গ্রামের ঘটনা ছিল না। গোটা পশ্চিমবাংলা জুড়ে সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্ব ক্রমেই এমন সব শক্তির হাতে চলে যাচ্ছে গ্রামাঞ্চলে যারা নতুন উঠতি বাবু সম্প্রদায়। আর সর্বত্রই ক্ষেতমজুর গরিব কৃষকদের ওপর শুরু হয়েছে এক ধরনের শাসানি, অত্যাচার। তারই পরিণতি ঘটেছিল করন্দায়। এবং আজও শুনতে পাই যেখানেই ক্ষেতমজুর গরিব কৃষকরা তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে, তাঁদের সম্মান নিয়ে, তাঁদের অধিকার নিয়ে আওয়াজ তোলেন, এই নতুন উঠতি জোতদারেরা তাঁদের হুমকি দেয় ‘করন্দা বানিয়ে দেব’।

কিছুকাল আগে কলকাতায় কাগজের রিপোর্টারদের সাথে কথাবার্তায় বলেছিলাম – এই যে বামফ্রন্ট সরকার এখন ক্ষমতায় আছে ১৯৭৭ সাল থেকে, তা কোনো গণআন্দোলনের ফসল নয়। জাতীয় রাজনৈতক পরিস্থিতিতে যে বিশেষ পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল সেই সুযোগেই তারা ক্ষমতায় এসেছে – কোনো গণআন্দোলনের জোয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে তারা ক্ষমতায় আসেনি। সেই কথা নিয়ে দেখলাম সিপিআই(এম)-এর তাত্ত্বিকেরা আলোচনা এড়িয়ে গেলেন। কারণ সেই আলোচনায় গেলে অনেক কথাই বেরিয়ে আসবে। ওদের একটি ছোটো দলের একজন ছোটো মাপের নেতা বললেন বিনোদ মিশ্রের ইতিহাসের জ্ঞান নেই। জ্যোতি বসু এককালে শ্রমিকদের সাথে চাটাইয়ে বসে কথাবার্তা বলতেন। বিনোদ মিশ্রের কোনো বই পড়ে ইতিহাসের জ্ঞানের দরকার নেই। কারণ সে যুগের যে ইতিহাস, আমি নিজেই সেই ইতিহাসের অংশ, আমি নিজেই সেই ইতিহাসের অংশীদার। আর জ্যোতিবাবু কবে শ্রমিকদের সাথে চাটাইতে বসে কথা বলতেন – সে যুগের কথা আলাদা। কিন্তু আজকে সারা দেশের পুঁজিপতিরা সমবেত স্বরে একটাই স্লোগান দেয়, ‘কমিউনিস্ট হো তো ক্যায়সা হো জ্যোতি বাবু য্যায়সা হো’। এই হচ্ছে বাস্তব অবস্থা। গণআন্দোলন ছাড়া যে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছে, এই দিশাতেই, এই দিকেই সে যাচ্ছে।

এর প্রভাব পড়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে। যেমন দেখুন, আজকের বিহারে এক বিপ্লবী বামফ্রন্ট গড়ে তোলার, এক শক্তিশালী গণআন্দোলনের ওপর দাঁড়িয়ে বামফ্রন্ট গড়ে তোলার কী চমৎকার এক পরিস্থিতি এসেছে। এই কাঁসিরাম যে সারা ভারতবর্ষ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, এমনকি, কলকাতায় এসেও কত হৈ চৈ করে গেল, সে লোকটার আজ পর্যন্ত সাহস হয়নি বিহারে ঢোকার। সেখানে আমরা এক বিশাল সামাজিক পরিবর্তন ৠালি করেছি গত ১৮ মার্চ। বিহারের সবকটা কাগজে এই কথা লিখেছে যে গত বিশ বছরে যত ৠালি হয়েছে পাটনায়, সবকটার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে সিপিআই(এমএল)-এর ৠালি। কাজেই আমি বলতে চাইছিলাম, এক বিপ্লবী বামফ্রন্ট গড়ার একটা দারুণ পরিস্থিতি সেখানে আছে। কিন্তু আমাদের সিপিআই, সিপিআই(এম) বন্ধুরা তাতে রাজি নন, তাঁরা সেখানে লালু যাদবকেই বেছে নিয়েছেন তাঁদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে।

দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে বামপন্থী ঐক্য নিশ্চয়ই আমরা চাই। সারা দেশেই হোক, বিভিন্ন রাজ্যেই হোক, এমনকি পশ্চিমবাংলাতেই হোক আমরা অবশ্যই বামপন্থী শক্তিদের সাথে হাত মিলিয়ে একসাথে চলতে চাই। কিন্তু এই বামফ্রন্ট সরকারের যেভাবে এক সার্বিক অধঃপতন হয়ে চলেছে – করন্দায় তাঁরা ক্ষেতমজুরদের হত্যা করছেন, কোথাও স্কুলের হেডমাস্টারকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মারা হচ্ছে, কোথাও শিশু মহিলা সহ একটা বর্গাদার পরিবারকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, বীরভূমে একজন ডাক্তারের বদলি নিয়ে মানুষের যে বিক্ষোভ সেখানে পুলিশ গুলি চালাচ্ছে, কে একটা সাট্টা ডন আছে কী এক খান, তার সাথে শোনা যাচ্ছে সিপিআই(এম) নেতাদের ভালোই মেলামেশা, মহিলা সমিতির যিনি নেত্রী তিনি মহিলা বিরোধী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত – এই যে একটা সার্বিক অধঃপতন হচ্ছে, এই যে একটা স্খলন হচ্ছে বামফ্রন্ট সরকারের, সেখানে তাদের বিরোধিতা করা ছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই। আমরা তাঁদের বলেছি, শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার বলে আপনারা আপনাদের যাত্রা শুরু করেছিলেন কিন্তু আজ আপনারা গণআন্দোলন দমনের যন্ত্রে পরিণত হয়েছেন। আমরা আপনাদের এই স্খলনের অংশীদার হতে পারব না, আপনাদের এই দমনযন্ত্রের সাথে হাত মেলাতে পারব না – দয়া করে আমাদের ক্ষমা করবেন।

তাঁরা আমাদের হুমকি দেন, “আমরা আপনাদের সারা ভারতবর্ষের বামপন্থী রাজনীতি থেকে, বামপন্থী শক্তিগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেব”। আমরা বললাম সে চেষ্টা আপনারা করে দেখতেই পারেন। আমরা অনেক বছর ধরেই অপেক্ষা করছি। আরও বহু বছর অপেক্ষা করার ধৈর্য্য আমাদের আছে, কিন্তু কোনোমতেই আমরা আপনাদের অধঃপতনের অংশীদার হতে পারব না এবং পশ্চিমবাংলায় সার্বিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করা এক গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য বলেই আমরা মনে করি।

পশ্চিমবঙ্গে দেখা যাচ্ছে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের যে বিক্ষোভ আছে, আক্রোশ আছে সেটাকে পুঁজি করে মমতা ব্যানার্জী অনেক হাঁকডাক করে বেড়ান। এই সুযোগে যুব কংগ্রেসের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে তিনি সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন। তাঁর স্লোগান – পশ্চিমবঙ্গ থেকে লাল হঠাও। আমরা বলতে চাই পশ্চিমবঙ্গ সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পূর্ব-ইউরোপ নয়। এখানে যেমন ক্ষমতালিপ্সু অধঃপতিত বামপন্থীরা আছেন তেমনই বিপ্লবী বামপন্থী শক্তিও আছে। পশ্চিমবাংলার বুকে সিপিআই(এমএল)-ই ছিল তৃতীয় শক্তি যে সমগ্র রাজ্যে এক বিশাল শক্তি হয়ে উঠেছিল। বামফ্রন্ট সম্পর্কে যে নৈরাশ্য আজ মানুষের মনে জাগছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে সেই শক্তিও উঠে দাঁড়াচ্ছে। কাজেই মমতা ব্যানার্জীদের আমি বলে দিতে পারি – তাঁরা যদি মনে করেন যে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে লড়েই লালকে হঠাতে পারবেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে, সেটা কোনোদিনই সম্ভব নয়। তার পেছন থেকে উঠে আসছে আর এক বিপ্লবী লাল শক্তি এবং সেই লাল শক্তির সাথে লড়াইটা চলবে। কাশীপুর-বরানগরের গণহত্যার কথা আমরা ভুলিনি। কংগ্রেসের সাথে আমাদের অনেক হিসেব-নিকেশ বাকি আছে। কাজেই সে সুযোগ আমরা কংগ্রেসীদের কোনোদিন দেব না। পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের ভাঙন ও পতনের ফলে যদি এখানে কোনো এক নতুন শক্তি উঠে দাঁড়ায় সেটা হবে নকশালপন্থার বিপ্লবী বামশক্তি। আর কোনো বিকল্প এখানে গড়ে উঠতে পারে না।

করন্দায় আমরা দেখলাম এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে যার মুখ্য ভূমিকা, সেই রামনারায়ণ গোস্বামীকে তাঁরা প্রমোশন দিয়ে কিষাণসভার বড় নেতা বানিয়ে দিয়েছেন এবং যে লোকটা প্রধান অভিযুক্ত তাকে তাঁরা সেখানে পঞ্চায়েত প্রধান বানিয়ে দিলেন। তাঁরা এই হুমকিটাই দিয়ে যাচ্ছেন যে, করন্দা ঘটিয়ে দেব। আমিও বলে দিতে চাই যে তাঁরা যদি করন্দা ঘটিয়ে দিতে থাকেন, করন্দা যদি ঘটে – তাহলে নকশালবাড়িও ঘটবে এবং নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের লক্ষ্য হবে এই নতুন জোতদারেরা যারা সিপিআই(এম)-এর ঝাণ্ডা নিয়ে পঞ্চায়েতকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। এই কটি কথা বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ।