(বিহারে পার্টি কমিটিগুলির সম্পাদকদের সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ। লিবারেশন মার্চ, ১৯৯৪ থেকে)

কমরেড,

এখানে বিহারের বিভিন্ন জেলা ও ব্লক থেকে ১০০ জনের মতো পার্টি নেতা এসেছেন। আপনারা সবাই পার্টি নেতা এবং ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চেষ্টার সাহায্যে আপনারা বিহারের পরিস্থিতি আরও একবার পাল্টে দিতে পারেন। আমরা বিহারের পার্টি সংগঠনে এক শুদ্ধিকরণ আন্দোলন চালাচ্ছি এবং আমি আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এই শুদ্ধিকরণ আন্দোলনটি আমরা এমন এক সময়ে চালাচ্ছি যখন আমাদের পার্টি সাম্প্রতিককালের নানা সমস্যা ও ক্ষয়ক্ষতি অতিক্রম করে নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে এবং এগোতে শুরু করেছে। অন্যদিকে বর্তমানে বিহারে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জনতা দল চারিদিক থেকে সমস্যা কবলিত হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত খবরের কাগজগুলি লিখছিল যে লালু যাদবের আক্রমণের মুখে সিপিআই(এমএল)-আইপিএফ ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিন্তু এখন কাগজের ভাষা পাল্টাচ্ছে। এখন খবরের শিরোনাম হচ্ছে “লালুর বিরুদ্ধে লাল আক্রমণ তীব্রতর”। বিশেষ করে সাম্প্রতিক নির্বাচনে দেশে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন হল তারপর থেকে জনতা দলের সংকট আরও গভীর হয়েছে। বিহারেও তাদের পার্টিতে এর প্রভাব বড় আকারেই পড়বে।

এই রকম এক সময়ে, এই রকম এক পরিবেশে আমরা শুদ্ধিকরণ আন্দোলন চালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

এটা স্পষ্ট দেখিয়ে দেয় যে আমাদের লক্ষ্য হল আগামীদিনে এই প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, দৃঢ়ভাবে উদ্যোগ নিজেদের হাতে নেওয়া এবং শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করা। এর জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে এবং তাই ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল পার্টি সংগঠন গড়ে তোলা অবশ্য কর্তব্য। আমার মতে আগামী দিনগুলিতে পার্টিকে রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণে সক্ষম করে তোলাটাই শুদ্ধিকরণ আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য। ইতিমধ্যেই আমরা এটা করতে শুরুও করে দিয়েছি।

অন্য যে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি আমাদের সামনে ছিল তা হল, জনতা দলের মোকাবিলায় দিশার প্রশ্নটির নিষ্পত্তি করা, এই বিষয়ে ইস্যুগুলি ও কার্যধারা নির্ধারণ করা। ক্রমে ক্রমে আমরা এই প্রশ্নগুলিও সমাধান করেছি। ছাত্রদের আন্দোলন, ভূমি সংস্কারের জন্য সংগ্রাম অথবা ঝাড়খণ্ডের স্বায়ত্ততা – এই সমস্ত আন্দোলনগুলিকে আমরা এক সূত্রে গ্রথিত করতে চাই। বিহারী সমাজের গণতান্ত্রিকীকরণের স্লোগানকে তুলে ধরে আমরা ঠিক এই কাজটি করারই চেষ্টা করে গেছি। এখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, জনতা দলের মতো সরকারগুলির মোকাবিলায় এই স্লোগান, এই দিশা খুবই কার্যকরী। ইতিমধ্যে আমাদের প্রচেষ্টাগুলি জনতা দলের নিজস্ব মতাদর্শগত ভিত্তিকে ঘা দিয়েছে, তার সামাজিক ভিত্তি ও তার সমর্থক গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকেও আমরা প্রভাবিত করতে পারছি। এইভাবে দিশার প্রশ্নটিকে একটা স্তর পর্যন্ত আমরা সমাধান করতে পেরেছি এবং জনমতের বিভিন্ন ধারাও আজ মনে করছে যে বিহারে নতুন স্তরের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব আমাদের পার্টিই দেবে।

মণ্ডল ইস্যুটি ধীরে ধীরে পিছনে চলে যাওয়ায় আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে আর তেমন কোনো জোরদার ইস্যু নেই। তাই কাল পর্যন্ত লালু যাদব ঘোষণা করতেন যে আইপিএফ শেষ হয়ে গেছে, তিনিই এখন প্রায়ই ফোনে আমাদের কমরেডদের বলছেন যে, আগামী নির্বাচনে জনতা দল, সিপিআই আর আইপিএফের জোট বাঁধা উচিত।

অতএব আমরা যখন শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু করছি, তখন পরিস্থিতিটা এইরকম। এই রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত, নির্দিষ্ট পরিস্থিতি আর এই অভিযানের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যটিকে বোঝা খুবই জরুরি। কিছু কমরেড ইতিমধ্যেই এই প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন এবং আমিও মনে করি যে এছাড়া শুদ্ধিকরণ অভিযানের কোনো তাৎপর্যই থাকবে না।

আমরা পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করতে ও তার শৃঙ্খলাকে মজবুত করতে চাই। এব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের যে ভুল চিন্তাগুলি আমাদের সংগঠনে আছে, এখানে উপস্থাপিত দলিলে সে সম্পর্কে অনেক আলোচনা রয়েছে। আমার মতে দলিলে আলোচিত প্রয়োজনবাদের সমস্যাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ভূমি সংস্কারের কথা, কৃষক আন্দোলনের কথা, কৃষক সংগঠনকে শক্তিশালী করার কথা বলি; কিন্তু যখন আমরা পাটনায় মুখ্যমন্ত্রীকে ঘেরাও করি, সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাই, তখন কিন্তু সেটাকে লালু সরকারকে উৎখাত করার কোনো নির্দিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক সংগ্রাম হিসাবে দেখার এক প্রবণতা মাথা চাড়া দেয়। এটা ঠিক নয়। আমরা যে বিপ্লব অর্থাৎ সামগ্রিক পরিবর্তনের কথা বলি, তার মধ্যে যে কৃষি-বিপ্লব, কৃষক সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সে কথা আমাদের বুঝতে হবে। একের পর এক সরকার আসে, আবার চলেও যায়। লালু সরকারও চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না, অন্য কোনো সরকার তার স্থান গ্রহণ করবে। আমাদের এই সামগ্রিক আন্দোলন, এই কৃষক সংগ্রাম, এটা সাময়িকভাবে কোনো এক সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করার জন্য, তার সামনে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি করা বা তাকে পদত্যাগে বাধ্য করার মতো কোনো সীমিত রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য নয়। এই বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। একথা ঠিকই যে, কোনো সরকারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক লক্ষ্যভিত্তিক স্লোগান কৌশলগত স্তরে জনগণকে সমাবেশিত করতে সহায়ক হয়। কিন্তু কোনো এক নির্দিষ্ট সরকারকে উৎখাত করার সীমিত পরিপ্রেক্ষিতেই যদি আন্দোলনের সামগ্রিক লক্ষ্যকে বোঝা হয়, তবে সেখান থেকে শুরু হয়ে যায় এক মতাদর্শগত বিকৃতি, যাকে আমরা বলি প্রয়োজনবাদ। এই দৃষ্টিভঙ্গিই কৃষক আন্দোলনকে সময়বিশেষের কর্তব্যকর্ম করে তোলে। আমাদের সবসময়েই কৃষক সংগঠনকে শক্তিশালী করে যেতে হবে, কৃষক আন্দোলনের ওপর জোর দিয়ে যেতে হবে। আমরা প্রায়ই দেখি যে আমাদের কৃষক সংগঠন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, তারপর আবার কিছু কর্মসূচির মাধ্যমে তাকে সক্রিয় করে তোলা হয়। এরকম কেন হবে? আমাদের এক কৃষিবিপ্লব সংগঠিত করতে হবে, তাহলে আমাদের কৃষক সংগঠন কেন বারবারই এভাবে আটকে যাবে আর তারপর আবার কিছু স্লোগান, সরকারের কিছু নীতির বিরোধিতা বা তার বিরুদ্ধে ঘেরাও সংগঠিত করার ভিত্তিতে তাকে সক্রিয় করে তুলতে হবে? আমার মনে হয় এই মতাদর্শগত বিকৃতি, এই প্রয়োজনবাদ এই সমস্ত বিষয়ে কোনও না কোনোভাবে আমাদের ওপর তার ছাপ ফেলে, যেমন, কৃষক আন্দোলনকে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের এক কৌশল হিসাবে দেখা। সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর মতো দলগুলি এই পদ্ধতি নিয়ে থাকে। তাদের বন্ধু সরকার এখানে রয়েছে, আর তাই রাজনৈতিক প্রয়োজন থেকে কৃষক ইস্যুগুলি তাদের কাছে কখনও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, আবার কখনও সেগুলির কোনো গুরুত্ব থাকে না। এটা কিন্তু আমাদের নীতি হতে পারে না। বিশেষত বিহারের মতো রাজ্যে কৃষক আন্দোলন, বিপ্লবী কৃষক সংগ্রামের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে, আর এগুলির মধ্য দিয়েই আমাদের সমগ্র সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরণ ঘটাতে হবে। এই সংগ্রাম অবশ্যই দীর্ঘস্থায়ী হবে, আর আপনারা জানেন আমাদের পার্টি এই সংগ্রামের কোনো নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দেয়নি।

হাজার হাজার কৃষকের অংশগ্রহণের বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে পার্টি এই সামন্তবাদ-বিরোধী সংগ্রামগুলিকে তাদের উচ্চতম স্তরে উন্নীত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তা এই কারণে যে, সমগ্র সমাজের রূপান্তরসাধনের জন্য এই সংগ্রামই হল মূল চাবিকাঠি। এটা অতএব কৃষক সংগ্রামকে কোনো নির্দিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যম করে তোলা বা আগে থেকেই তার সীমা নির্ধারিত করার প্রশ্ন নয়। এই বিষয়টিকে অবশ্যই সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে হবে, অন্যথায় এই নীতিমালা থেকে সামান্যতম বিচ্যুতিও প্রয়োজনবাদের ঢল নিয়ে আসবে।

আমি যে বিষয়টিতে জোর দিতে চাইছি তা হল, যে আন্দোলনগুলি আমরা শুরু করেছি – তা ছাত্র আন্দোলনই হোক অথবা কৃষি সংস্কার বা ঝাড়খণ্ডের স্বায়ত্ততার আন্দোলনই হোক, সেগুলিকে যে আমরা একসূত্রে বাঁধতে চাইছি সেটা বিহারী সমাজের গণতান্ত্রিকীকরণের আন্দোলন ছাড়া অন্য কিছু নয়, জনপ্রিয় ভাষায় যেটাকে আমরা বলে থাকি ৭৪-এর আন্দোলনের পুনরুজ্জীবন ঘটানো। তার ফলে লালু সরকারের কী ঘটল সেটা আমাদের কাছে বড় কথা নয়। যা গুরুত্বপূর্ণ তা হল জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার এবং সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তরণের জন্য আন্দোলনের বিকাশ ঘটানো।

এই সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতকে মাথায় রাখতে হবে। সরকারের সমালোচনা, তার ত্রুটি-বিচ্যুতির বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং তাৎক্ষণিক ইস্যুর ভিত্তিতে সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম – ব্যবহারিক রাজনীতিতে এসব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপক মানুষের মধ্যে আমাদের বক্তব্যকে নিয়ে যেতে ও তাঁদের ব্যাপকভাবে সমাবেশিত করতে এসমস্ত কিছুই সহায়ক হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু আমাদের মতাদর্শগত-রাজনৈতিক চিন্তাধারা যদি এই তাৎক্ষণিকতার মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে যায় তবে আমার আশঙ্কা, আমাদের পার্টি তার কমিউনিস্ট চরিত্রই হারিয়ে ফেলবে এবং আশু দাবিগুলির ভিত্তিতে সংগ্রামরত এক সাধারণ গণতান্ত্রিক চরিত্রের সংগঠনে পর্যবসিত হবে। এই প্রসঙ্গে দলিলে যে প্রয়োজনবাদের বিপদের কথা বলা হয়েছে তাকে আমি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি এবং একথাও আমি জোরের সাথে বলতে চাই যে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের পার্টিতে যে মতাদর্শগত অবক্ষয় চলছে প্রয়োজনবাদ হল তারই বহিঃপ্রকাশ।

মতাদর্শগত অবক্ষয়ের আরও বহিঃপ্রকাশ রয়েছে এবং দলিলেও সেগুলি উল্লিখিত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে এই মতাদর্শগত অবক্ষয়ের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় যখন আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এক নতুন অনুশীলনের সূচনা করলাম। আামাদের লক্ষ্য ছিল সংসদীয় সংগ্রাম এবং বিধানসভার অভ্যন্তরে সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক বিপ্লবী মডেল স্থাপন করা। আপনারা জানেন আমাদের প্রয়াস ভালোরকম ধাক্কা খেয়েছে। আমাদের চারজন বিধায়ককে জনতা দল নিজেদের পক্ষে জয় করে নিল, অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে, তাঁরা সংসদবাদের আবর্তে আটকে গেলেন এবং নিজেদের বিকিয়ে দিলেন। আমাদের পার্টির ইতিহাসে অনেক বড় বড় ভুলই হয়েছে, আমরা ধাক্কাও খেয়েছি। কিন্তু কোনো ভুল বা ধাক্কা এই দলত্যাগগুলির মতো পার্টির মর্যাদাকে এত নীচে নামিয়ে দেয়নি। এই ঘটনায় জাতীয় স্তরেও আমাদের মাথা অনেক হেঁট হয়ে গেছে, কেননা মানুষ কখনই ভাবেননি যে আমাদের বিধায়কদের প্রত্যয় এতটা শূন্যগর্ভ। আমাদের পার্টির ইতিহাসে এটা একটা কালো দাগ। এই কালো দাগকে মুছে ফেলতে আমরা চেষ্টা করেছি এবং ক্রমে ক্রমে আমরা জনগণের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে সফল হয়েছি যে আমাদের পার্টি হল সংগ্রামের, আন্দোলনের পার্টি এবং আমাদের ভাবমূর্তিকে আমরা পুনরায় অনেকটাই উজ্জ্বল করে তুলতে পেরেছি। কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকেই যায় : এমনটা ঘটল কী করে? কেউ যদি বলেন যে তারা চরিত্রগতভাবেই ঐরকম ছিল আর তাই তাদের প্রার্থী করাটাই ঠিক হয়নি, তাহলে এই প্রশ্নটা উঠে আসে, তাদের টিকিট দেওয়া হল কেন? যদি বলা হয় যে, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি, তাহলেও এই প্রশ্নটা দেখা দেয়, নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা ব্যর্থ হলাম কেন? কাজেই শুধু এই দলত্যাগীদের দোষ দিলে পার পাওয়া যাবে না; এতবছর ধরে পার্টি সংগঠন কী করেছে, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আমি মনে করি এর মধ্যে একটা গভীর প্রশ্ন নিহিত আছে। এই বিধায়করা যে সংসদীয় বিচ্যুতির মধ্যে জড়িয়ে গেল, সেটা আমাদের সংগঠনকে প্রভাবিত করেছে যে মানসিকতা তারই সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ। আমার মনে হয় সমস্যাটিকে বিচার করার এটাই সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি।

দীর্ঘদিন ধরে কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন এমন অনেক কমরেডই আজ বিধায়ক বা সাংসদ হওয়ার জন্য লালায়িত। শুধু নতুন কমরেডরাই নন, অনেক পুরোনো কমরেডের মধ্যেই আজ সংসদবাদের ব্যাধির প্রকোপ। আমরা দেখলাম, সমগ্র সংগঠনের মধ্যে পার্টি বা সংগঠনের নেতৃবৃন্দের চেয়ে সাংসদ বা বিধায়করাই অধিকতর মর্যাদা ভোগ করছেন। এনিয়ে আমরা লাগাতার সংগ্রাম চালাবার চেষ্টা করেছি। আমরা এও দেখলাম অনেক জায়গা থেকেই জনসভার জন্য সাংসদ ও বিধায়কদের ডাক পড়ছে, পার্টি ও গণসংগঠনের নেতাদের যেন কোনো গুরুত্ব নেই। সমাজের মানুষ সাংসদ ও বিধায়কদের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে থাকে, আমাদের সংগঠনেও এই ক্ষতিকারক প্রভাব পড়েছে। ঐ সমস্ত ক্ষেত্রে বিধায়ক ও সাংসদরা আত্মম্ভরী হয়ে উঠলেন এবং পার্টির সমস্ত ক্যাডারদের কাছেও তাঁরা অনুকরণীয় মডেল হয়ে উঠলেন। এইভাবে এই প্রবণতা আমাদের সমগ্র সংগঠনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। এটা ঠিক নয়, এটা ভুল হচ্ছে – এই বলে আমরা এর মোকাবিলার চেষ্টা করলাম। আমরা বললাম, পার্টি ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মর্যাদাই সর্বোচ্চ হওয়া উচিত। কিন্তু এর কোনো ফলই দেখা গেল না। আপনারা দেখবেন, সমস্যা কী গুরুতর আকার নিয়েছিল, এর বিরুদ্ধে লড়াই করা সত্ত্বেও কেউ কর্ণপাত করতে চাইছিল না। একদিক থেকে দেখতে গেলে, এই বিধায়কদের দলত্যাগ পার্টির মধ্যে পরিবেশ পরিবর্তনের সহায়ক হয়ে দেখা দিয়েছে এবং ফলে আমরা আবার সংগ্রামের পথে ফিরে এসেছি। এই সমস্ত ব্যাপারই গভীরতর অনুসন্ধানের দাবি রাখে, কেননা বিধায়ক ও সাংসদরা এখনও আছেন এবং ভবিষ্যতে তাদের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। অবশ্য তাদের প্রয়োজনীয়তাও আছে এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করতে হবে। কিন্তু আন্দোলনে বিধায়ক ও সাংসদদের সঠিক ভূমিকা কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় যাতে সংগঠনের প্রতিপত্তি ও মর্যাদাও অক্ষুণ্ণ থাকে? এটা হল লাখ টাকার প্রশ্ন। মতাদর্শগত অবক্ষয়ের জন্য সংসদীয় সংগ্রামের ক্ষেত্রে এক ইতিবাচক দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠার চেয়ে বিহারে আমাদের শুরুটা বরং অনেক নেতিবাচক হয়ে দেখা দিল।

সমগ্র পার্টিকেই এই প্রশ্নে গভীর বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে। সমগ্র পার্টিকেই ভাবতে হবে কখন এবং কীভাবে পার্টিতে এই মতাদর্শগত অবক্ষয় শুরু হল। আলোচনার সময় অনেক কমরেডই এ বিষয়ে বিভিন্ন মতামত রেখেছেন এবং আমাদের এক সামগ্রিক বিশ্লেষণ হাজির করতে হবে।

এই মতাদর্শগত অবক্ষয় পার্টির সাংগঠনিক জীবনে অনৈক্যের সৃষ্টি করে। আর তাই শুদ্ধিকরণ অভিযানের মধ্য দিয়ে পার্টিকে মতাদর্শগত অবক্ষয় ও সাংগঠনিক অনৈক্য এই দুই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করতে হবে। এই মতাদর্শগত অবক্ষয় টিবি রোগের মতো, যা ধীরে ধীরে সমস্ত শরীরটাকেই ক্ষয় করে তোলে। কাঠামোটা পড়ে থাকে, কিন্তু জীবাণু ভেতরে ভেতরে সমস্ত শরীরটাকেই ফাঁপা করে দেয়। মতাদর্শগত অবক্ষয় হলে একটা পার্টির ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটে। বাহ্যিক রূপ, কাঠামো ঠিকই থাকে, কিন্তু ভেতর থেকে পার্টি ক্রমশই মৃত্যুর দিকে, ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। আমার মতে, আমাদের পার্টি কোনো না কোনোভাবে মতাদর্শগত ক্ষয় রোগে আক্রান্ত, যার ফলেই এই সমস্ত বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। শুদ্ধিকরণ আন্দোলন হল এক যুদ্ধ, মতাদর্শগত ব্যাধির এক চিকিৎসা।

আমরা জানি টিবি রোগ সেরে গেলে মানুষ আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনারা শরীরের অভ্যন্তরে জীবাণুর ক্ষতিকর প্রভাবকে, পার্টির অভ্যন্তরে ক্ষয় রোগের প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করবেন এবং পার্টিকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ ও সবল করে গড়ে তুলবেন। ...

আজকের এই প্রসঙ্গে যে কথাগুলো মনে এল, সেগুলো আপনাদের কাছে রাখলাম।