(লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯৮ থেকে)
গত দুই দশকেরও বেশি সময়ের বিহারের ইতিহাস গণহত্যার ঘটনায় পরিপূর্ণ। দলিত জাতিগুলির গ্রামীণ দরিদ্রদের এই গণহত্যাগুলি সংঘটিত করেছে জমিদারদের বিভিন্ন সেনাবাহিনীগুলি। গ্রামীণ দরিদ্রদের ক্রমবর্ধমান অভ্যুত্থানগুলিকে দমন করতে এবং জাতপাতগত ও শ্রেণীগতভাবে প্রাপ্ত বিশেষ সুবিধাগুলিকে অক্ষত রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে জমিদার ও কুলাকদের নতুন শ্রেণীগুলি। তাই তারা সমগ্র জনগণকেই সন্ত্রস্ত করে তুলতে বারবারই এই সন্ত্রাস সৃষ্টির কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। তবুও ১ ডিসেম্বর রাতে জাহানাবাদের লক্ষ্মণপুর বাথের গণহত্যার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে এবং তা যথার্থভাবেই ভারতীয় স্বাধীনতার অর্ধ-শতবর্ষে জাতির বিবেককে আলোড়িত করেছে। মোট ৬১ জনকে – যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই হল শিশু, নারী ও বৃদ্ধ – গভীর রাতে ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই গণহত্যার যাঁরা শিকার হয়েছেন তাঁরা সকলেই ছিলেন কৃষিমজুর শ্রেণীর এবং সামাজিক স্তর বিন্যাসের দিক থেকে দলিত। সামাজিক-অর্থনৈতিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সংগ্রামে তাঁরা সিপিআই(এমএল)-এর বিপ্লবী পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
ঘাতকরা ছিল রণবীর সেনার লোকজন – এরা উচ্চবর্ণের জমিদারদের সেনাবাহিনী এবং এদের পিছনে বিজেপির রাজনৈতিক মদত ও আরজেডির একটি অংশের সমর্থনও রয়েছে।
তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসাবে এবার তারা জাহানাবাদের এমন একটি গ্রামকে বেছে নেয় যা ভোজপুর, পাটনা ও ঔরঙ্গাবাদ জেলার লাগোয়া। মূল উদ্দেশ্য ছিল সারা মধ্য বিহারে তাদের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। যে সময়কে তারা বেছে নেয় সেটিও ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তখন কেন্দ্রে রাজনৈতিক সংকট চরমে পৌঁছেছিল এবং ক্ষমতায় ছিল এক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই অবস্থায় ভূমিহার ও রাজপুত – উচ্চবর্ণের এই উভয় জাতির একত্রে সমাবেশিত হওয়ার বিষয়টি ছিল চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির রাজনৈতিক দিক থেকে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠারই পরিচায়ক। প্রাপ্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, নির্বাচনের আগে পরিকল্পিত তিনটি গণহত্যার মধ্যে এটি ছিল প্রথম ঘটনা। অন্য দুটি গণহত্যার পরিকল্পনা রয়েছে রোহতাস ও বক্সার জেলায়।
গণহত্যার সমগ্র পরিকল্পনা ছকা হয়েছিল অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে। জাহানাবাদ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী সমস্ত জেলা থেকেই পেশাদার খুনীদের জড়ো করা হয়েছিল। এক নজির সৃষ্টি করা এবং আন্তর্জাতিক স্তরে সংবাদের শিরোনামে উঠে আসার জন্য কত সংখ্যক মানুষকে খুন করা হবে তা আগে থেকেই ঠিক করা হয়েছিল, যার মধ্যে আবার বিশেষ লক্ষ্যবস্তু করা হয় নারী ও শিশুদের। পরিকল্পনাটি যাতে অবলীলায় কার্যকর করা যায় তার জন্য নিশানা হিসাবে এমন একটি গ্রামকে বেছে নেওয়া হয়েছিল যেখানে মানুষের আশঙ্কার কোনো কারণ ছিল না, তাঁরা একেবারেই অপ্রস্তুত ছিলেন, আর তাই প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।
নজির অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছিল, শুধু সংখ্যাগত দিক থেকেই নয়, নৃশংশতা ও কাপুরুষতার বিচারেও। পাশাপাশি প্রচারমাধ্যমও, বিশেষত বিহারের প্রচারমাধ্যম চূড়ান্ত কপটতা জাহির করে অন্য এক নজির সৃষ্টি করেছিল। একেবারে প্রথম দিন থেকেই সংঘ পরিবারের প্রচারযন্ত্র আসরে নেমে পড়ে আর সংবাদ মাধ্যমও তার তালে তাল ঠুকতে থাকে। পাটনার এক নামজাদা সাংবাদিক এক জাতীয় দৈনিকে লেখেন, এটি হল রণবীর সেনা আর নকশালপন্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষের সেই চিরাচরিত কাহিনী, এবারে একমাত্র ফারাক হল নকশালপন্থীরা নিরস্ত্র ছিল। সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা মাথায় নারী ও শিশুদের গণহত্যাকে চতুরভাবে নিয়মিত সংঘর্ষ বলে যুক্তির অবতারণা করা হল। ঐ একই সাংবাদিক তাঁর পরবর্তী লেখাগুলিতে যথেচ্ছ নকশালপন্থীদের হিংসার বিরুদ্ধে চাষিদের ক্ষোভের অভিব্যক্তি হিসাবে রণবীর সেনার যৌক্তিকতাকে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। দু-একজন ব্যতিক্রমের কথা বাদ দিলে সমগ্র উচ্চ বর্ণের সাংবাদিককূলের মধ্যে এই মনোভাবই চোখে পড়েছে। সংপাদপত্রগুলিতে নকশালপন্থী প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তু গ্রামগুলির দীর্ঘ তালিকা মোটা হরফে ছাপা হয়। জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর স্কোয়াডের জাহানাবাদের গ্রামে ঢুকে পড়ার মতো আষাঢ়ে গপ্পোও ফলাও করে ছাপা হয়। লক্ষ্মণপুর বাথের ঘটনা নিয়ে যে বিশ্লেষণ শুরু হয় তা অবধারিতভাবে শেষ হয়েছে সাধারণভাবে আইন শৃঙ্খলার অবনতির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং সমান্তরাল সরকার চালানো ও এমনকি পুলিশকে আক্রমণের স্পর্ধা দেখায় যে সমস্ত নকশালপন্থী উগ্রপন্থী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করা হয়েছে। প্রতিরোধের খবরগুলিকে গুরুত্বহীন করে তোলা হয় আর বিজেপি নেতাদের অনশন ও বাজপেয়ীর গ্রাম পরিদর্শনকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। রণবীর সেনা এবং বিজেপির সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্য সংযোগের দিক থেকে জনসাধারণের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিতে এবং ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারটিও আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই ঘুরিয়ে দিতে প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করতে এ সমস্তই ছিল একেবারে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ।
এই ঘটনা মানুষদের বিরুদ্ধে কলমকে ব্যবহারের চিরাচরিত কাহিনীকেই তুলে ধরে, কিন্তু এবারে ব্যতিক্রম ছিল এই যে, কলম সরাসরি বেয়নেটের সঙ্গেই যুক্ত ছিল! একথা উল্লেখ না করলেও চলে যে রাষ্ট্রযন্ত্রও এই ‘কলম ঘাতকদের’ বাধিত করার জন্য মুখিয়ে ছিল। রণবীর সেনার বিরুদ্ধে নামেমাত্র কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের পর – তাও আবার বাস্তবের চেয়ে বেশ কাগুজে – প্রতিশোধের ঘটনাকে প্রতিহত করার অজুহাতে সমগ্র অভিঘাত ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে জনগণের শক্তিগুলির বিরুদ্ধে।
কিন্তু সমস্ত ধরনের ভাড়াটে বাহিনীর ষড়যন্ত্রই গ্রামীণ দরিদ্রদের মুক্তি সংগ্রামে শেষ কথা নয়। প্রতিবাদ দ্রুত বেড়ে চলেছে এবং ব্যাপকতর মাত্রা অর্জন করছে।
৫ ডিসেম্বর ১৭ দলের বাম ও গণতান্ত্রিক জোট বিহার বনধের ডাক দেয়। প্রসঙ্গত সমস্ত ধরনের বনধকে সর্বাত্মকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সুপ্রীম কোর্টের কুখ্যাত রায় বেরোনোর পর এটিই ছিল প্রথম বন্ধ । অন্যান্য অনেক গণতান্ত্রিক শক্তিই ঐ বনধকে সমর্থন করে এবং বন্ধ সর্বাত্মকভাবে সফল হয়। সারা দেশের এমনকি বিদেশেরও প্রগতিশীল জনমত ঐ গণহত্যার ঘটনাকে ধিক্কার জানায়। বহু প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবী ঐ প্রতিবাদে সামিল হন।
এই গণহত্যা গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে ব্যাপক শ্রেণী ঘৃণার জন্ম দিয়েছে, নিজেদের সংহতিকে আরও দৃঢ় করে তুলতে তাদের সংকল্পকে শক্তিশালী করেছে এবং তারা ক্রমশই আরও বেশি বেশি করে উপলব্ধি করছে যে আক্রমণই আত্মরক্ষার সবচেয়ে কার্যকরী পথ।
আরওয়ালে পার্টির সমাবেশ সর্বাঙ্গীনভাবে সফল হয়েছে। রণবীর সেনার বিরুদ্ধে রণধ্বনি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তোলে। হাজার হাজার যুবক ক্রোধে ফেটে পড়ছিলেন এবং শত্রুকে তার নিজের ভূমিতেই মোকাবিলা করার শপথ নিয়ে তাঁরা ফিরে যান।
রণবীর সেনার আবির্ভাবের ফলে শ্রেণীযুদ্ধ আর মধ্য বিহারের এই বা সেই অঞ্চলে আবদ্ধ নেই। সারা মধ্য বিহারেই তা ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে এক ব্যাপকতর শ্রেণী ঐক্য গড়ে ওঠার শর্তও সৃষ্টি হয়েছে, যে ঐক্য রক্তের বন্ধনে দৃঢ় হচ্ছে। এই শ্রেণীযুদ্ধ আবার সামাজিক ন্যায়ের মেকি দেবতা লালু যাদবকেও অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে, যিনি তাঁর পূর্ববর্তী অবতার রূপে আমাদের পার্টিকে নিশ্চিহ্ন করার মেকিয়াভেলীয় পরিকল্পনা হিসাবে রণবীর সেনাকে বেড়ে উঠতেই মদত যুগিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ সেনা এখন তাঁর কাছে এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হিসাবে হাজির হয়েছে এবং বিজেপির আক্রমণাত্মক রাজনৈতিক উদ্যোগ বেড়ে চলার পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ঐ সেনা এখন তাঁর নিজস্ব সামাজিক ভিত্তিকে হুমকি দিচ্ছে। এর ফলে আমাদের পার্টির উদ্যোগে সামাজিক স্তরে এক নতুন বিন্যাস ঘটানোর পক্ষে পরিস্থিতি অনুকূল হয়ে উঠেছে। পার্টি বিভিন্ন রূপেই তার আক্রমণাত্মক উদ্যোগুলিকে বাড়িয়ে তুলছে এবং বিশেষত ভোজপুরে পার্টি কংগ্রেসের আগে ও পরে গৃহীত কিছু পদক্ষেপ তৃণমূল স্তরে উদ্যোগের দ্বার খুলে দিতে সাহায্য করেছে।
যারা ‘জাতির লজ্জা’ সংঘটিত করেছে সেই রণবীর সেনার চ্যালেঞ্জকে অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে। বিহারের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের স্বার্থ আর গৈরিক বাহিনীর আক্রমণকে রুখে দেওয়ার জাতীয় কর্তব্য একাকার হয়ে একটি কর্তব্য হিসাবেই সামনে এসেছে – তা হল রণবীর সেনাকে নিশ্চিহ্ন করা।
নিজেদের আর্থ-সামাজিক মুক্তি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য গ্রামীণ সর্বহারারা রক্ত ঝরিয়েই চলেছেন। আমাদের কর্তব্য হল তাদের শ্রেণী ভাইদের হত্যার বদলা নেওয়ার জন্য তাদের সংগঠিত করা, আর তার জন্য আমাদের ব্যাপকতম পরিধিতে তাদের উন্মোচিত করার জন্য প্রচার অভিযান চালাতে হবে, বিশেষত সংবাদ মাধ্যম শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে; যে কোনো প্রকারের সংকীর্ণতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে সমস্ত ধরনের ইতিবাচক সামাজিক অংশ ও রাজনৈতিক শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং এই নৃশংস ঘাতক, কাপুরুষ বাহিনীর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য নিজেদের প্রস্তুতিকেও অনেক উচ্চস্তরে তুলতে হবে।
এই লড়াইয়ে অবশ্যই জয়ী হওয়া সম্ভব এবং জিততে আমাদের হবেই। এটিই হল মানব প্রগতি, গণতন্ত্র ও প্রকৃত জাতীয়তাবাদের আহ্বান। সমকালও এই আহ্বানই জানাচ্ছে।