(বাথানিটোলা হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে সিপিআই(এমএল)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রচারপত্রের আকারে এই লেখাটি প্রকাশিত হয়)
আপনারা ভালোভাবেই অবগত যে, গত ১১ জুলাই রণবীর সেনার রক্তপিপাসু ঘাতকেরা বাথানিটোলার নিরপরাধ জনগণের উপর পাশবিক হত্যালীলা চালিয়েছে। সেই অভিশপ্ত দিনে ১২ জন মহিলা ও ৮ জন শিশুকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। এক গর্ভবতী রমণীর পেট চিরে দেওয়া হয়। ছোট্ট একটি শিশুর মাথা তরবারি দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার আগে শিশুটির জিভ কেটে নেওয়া হয়। অপর একটি শিশুর হাত থেকে আঙ্গুলগুলি কেটে নেওয়া হয়। আর একটি নবজাত শিশুকে তার মায়ের বুক থেকে টেনে নিয়ে তরোয়াল দিয়ে দু-টুকরো করে দেওয়া হয় আর তাদের কুঁড়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সদ্য কৈশোর পার হওয়া একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হয় এবং তাকে হত্যা করার আগে তার স্তন দুটি কেটে নেওয়া হয়। আহতদের মধ্যে দুটি শিশু বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। কেউই একথা অস্বীকার করবেন না যে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এ ধরনের পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা এক কথায় নজিরবিহীন। এই মর্মান্তিক গণহত্যার আড়ালে যে ঐতিহাসিক পশ্চাদপট তা কি আমাদের প্রত্যেকেরই জানা আবশ্যক নয়? এই বর্বর অপরাধের মধ্যে নিহিত আসল সত্যটিই বা কী?
আপনাদের জানা দরকার যে দেড় বছর হল রণবীর সেনাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার নামে টোলার (বাথানিটোলা – অনু) আশপাশের এলাকায় ৩টি পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে। জেলা প্রশাসনকে এক বড় ধরনের হত্যাকাণ্ডের আশঙ্কার কথা বার বার জানানো হয়েছে। তবুও কোনো সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আর রক্তপায়ীদের বীভৎস তাণ্ডবের সামনে পুলিশ থেকেছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়। মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং কর্তব্যে অবহেলার জন্য স্থানীয় পুলিশদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছেন কিন্তু জেলা শাসক বা পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে তিনি অস্বীকার করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী একদিকে লম্বা-চওড়া ভাষণ দিচ্ছেন অন্যদিকে তিনিই সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া কথাবার্তার সময় এহেন উক্তি করছেন যে “এমএল-দের লোকজনেরা যদি অর্থনৈতিক অবরোধ চালাতে থাকে তাহলে তাদের (রণবীর সেনা) কাছ থেকে আর কিই বা আশা করা যায়?”
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টোলা পরিভ্রমণ করেছেন কিন্তু এলাকার জনগণের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে প্রকৃত তথ্য খুঁজে বের করার প্রশ্নে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই বলেই মনে হয়েছে। তিনি আমাদের পাটনার প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সাক্ষাত করেননি। উল্টে, মুখ্যমন্ত্রী ও আমলাদের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বিহার পুলিশকে আধুনিকীকরণ ও মজবুত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং দিল্লী ফিরে গেছেন। ভাবখানা যেন এইরকম যে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাবেই পুলিশ এইরকম নিষ্ক্রিয় থেকেছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাবার্তার সময় তিনি যা বলেছেন বলে জানা গেছে তা হল এই যে ভূমিসংস্কার কর্মসূচি রূপায়নে ব্যর্থতার ফলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে (এবং আরও ঘটতেই থাকবে)। মনে হয় এসব কথা বলার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভুলে গেছেন যে বিহার সরকার জনতা দল ছাড়া আর কেউ চালাচ্ছে না আর তাকে সমর্থন করছে সিপিআই। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিহার প্রশাসনের নিন্দা করেছেন এবং কোনো এক সংবাদপত্রের খবর অনুয়ায়ী তিনি নাকি প্রশাসনের মদতেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন। যাই হোক, লালু যাদবের চাপে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের কথা প্রত্যাহার করে নেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রকাশ্য অভিযোগের পরেও এবং ডিএম ও এসপি-কে শাস্তি দেওয়ার জন্য সর্বদলীয় কমিটির সুপারিশ সত্ত্বেও বিহার সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে।
বিপরীতে, এই অপরাধী প্রশাসকেরাই লাঠি, জলকামান ও অন্যান্য সন্ত্রাসমূলক কৌশলের সাহায্যে জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাঁদের দাবিগুলিকে তুলে ধরার জন্য যে সব জনপ্রতিনিধি অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশনে বসেছিলেন তাঁদের জেলে বন্দী করা হচ্ছে। আমরা দেখছি আরোয়াল হত্যাকাণ্ড পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে আর ‘আরোয়াল’ খ্যাত অপরাধী এস পি কাসোয়ান নির্লজ্জভাবে তাঁর চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে রয়েছেন। রণবীর সেনার বিরুদ্ধে কোনো পুলিশী ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। শাসকশ্রেণীর সব দলগুলিই রণবীর সেনাকে বাঁচাতে সচেষ্ট এবং যত রকমরের অবাস্তব যুক্তি আর মিথ্যা প্রচার চালিয়ে তারা আমাদের উপরই দোষারোপ করে চলেছে।
আমাদের তথাকথিত কিছু বাম বন্ধু দায়হীন অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তাঁরা দরিদ্র ভূমিহীন কৃষক আর সামন্ত-কুলাকদের মধ্যে পার্থক্য করতে অসমর্থ, তাঁরা দলিত ও সংখ্যালঘু আর সাবর্ণ জাতি-আধিপত্যের শক্তিগুলির মধ্যেকার প্রভেদকেও দেখতে চান না। এই পাশবিক ও ঘৃণ্য ধ্বংসলীলা – যার পিছনে নিহিত রয়েছে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা – তাকে তারা খোলা চোখে সনাক্ত করতে চান না। নবজাত শিশু ও নিরপরাধ মহিলাদের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড দেখেও তাঁরা পথে নামার কোনো গরজ অনুভব করেন না। বরং তাঁরা প্রশাসনের সাথে একই সুরে গলা মিলিয়ে চলেছেন এবং মিথ্যা প্রচার চালিয়ে প্রগতিশীল জনমতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে চলেছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে, কঠিন সত্যগুলি সম্পর্কে আপনাদের অবহিত করা আমাদের কাছে জরুরি, যে সত্যের কথা খবরের কাগজগুলিতে প্রায় অপ্রকাশিতই থেকেছে।
প্রায় দুবছর আগে রণবীর সেনা তৈরি হয় যার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ভোজপুরের গরিব কৃষকদের বিপ্লবী আন্দোলনের রোষের সামনে কম্পমান সামন্ততন্ত্রের প্রাসাদকে রক্ষা করা। তারা সর্বশক্তি দিয়ে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, “আমরা ভোজপুরকে রাশিয়া কিম্বা চীনে পরিণত হতে দেব না; আমাদের বন্দুক দিয়ে আমরা শুধু ভোজপুর থেকে নয়, গোটা দেশ থেকেই লালঝাণ্ডার সমস্ত চিহ্ন মুছে দেব। আমাদের পূর্বপুরুষদের সামাজিক বিধি-ব্যবস্থাকে আমরা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করব ও পুরোনো রীতি ও নিয়মবিধিকে পুনরুদ্ধার করব।” এই সেনা জন্মের পর থেকে, ভোজপুর জেলার কেবলমাত্র সাহার ও সন্দেশ ব্লকেই, প্রায় একশ নিরপরাধ মানুষকে খুন করেছে যার মধ্যে অধিকাংশই হল অত্যন্ত অনগ্রসর দলিত ও মুসলিম সম্প্রদায়ের নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী মানুষেরা। আরা শহরে রণবীর সেনার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে আমাদের পার্টি সদস্যদের ধর্ণা-অবস্থানের ওপর গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছে। ১১ মার্চ দিল্লী সমাবেশে যোগদানের উদ্দেশ্যে আমাদের যে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মিছিলকারীরা চলেছিলেন তাঁদের উপরেও একইভাবে গ্রেনেড নিয়ে হামলা চালানো হয়। গ্রেনেডটি ফাটলে শত শত মানুষ মারা যেত। শুরুতে সেনার নেতৃত্ব ছিল কংগ্রেসের সাথে, পরে তারা বিজেপির দিকে ঘুরে যায়, আর এরই সাথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ই হয়ে ওঠে তাদের আক্রমণের নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু। বিজেপি নেতারা তাদের ঘাঁটিগুলিতে তড়িঘড়ি যাতায়াত শুরু করে দেয় এবং ঘন ঘন সভা করতে থাকে। এর পরই রণবীর সেনা লিখিত ‘ফতোয়া’ জারি করে বিজেপির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে দেয়। বিধানসভায় জনতা দল সরকার কর্তৃক এই ফতোয়ার কপিও প্রদর্শন করা হয়। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-সমতা জোটের জোরদার উপস্থিতি জাহির হওয়ার পর সমগ্র বিহার জুড়েই উঁচুজাতের আধিপত্যবাদী শক্তিগুলি ও সামন্ত-কুলাক শক্তি নতুন করে বলীয়ান হয়ে ওঠে ও প্রচণ্ড হিংস্র হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্ত শক্তিকে সরাসরি লড়াইয়ে মোকাবিলা করার পরিবর্তে জনতা দলের নপুংসক নেতৃত্ব এদের তোয়াজ করে চলতে থাকে। বিশেষত ভোজপুর জেলায় যেখানে দলিত ও অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষদের অধিকাংশই রয়েছে সিপিআই(এমএল)-এর সাথে এবং যেখানে সিপিআই(এমএল)-এর বৃদ্ধিকে রোধ করার জন্য জনতা দল খোলাখুলিভাবেই সামন্ত জমিদারদের পক্ষ অবলম্বন করে, সেখানে লালু যাদবকে প্রকাশ্যেই অপরাধী জমিদারদের সঙ্গে এক মঞ্চে ভাষণ দিতে দেখা যায়। চন্দ্রদেও ভার্মার মতো জনতা দলের সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে রণবীর সেনার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানাতে দেখা যায়। আর দেখা যায় ওই দলের বহু নেতা প্রকাশ্যেই রণবীর সেনার দাগী নেতাদের সঙ্গে পানভোজন করছে। রণবীর সেনার মনোবল বৃদ্ধি এবং তার সাথে প্রশাসনের যোগসাজশের পিছনে এটিই হল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে
১৯৭৮-এর গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে মহম্মদ ইউনুস তদানীন্তন মুখিয়া কেশো সিং-কে পরাজিত করে তার আসন দখল নেন। এই ঘটনার পরবর্তী ঘটনাবলীর দিকে আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে ইউনুসের বিজয় স্থায়ী সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উচ্চবর্ণের সামন্ত মানসিকতা এই পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি। তারা মুসলিমদের উপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করে। তারা প্রথমে ইমামবাড়ার সামনে রাস্তা দখল করে নেয় তারপরে সরাসরি ইমামবাড়ারই দখল নিয়ে নেয়। ১৯৯১-এর ১৩ আগস্ট আঞ্চলিক প্রশাসকের কাছে এ বিষয়ে এক মামলাও রুজু হয় এবং তিনি তাঁর অধস্তন একজনের কাছে তদন্তেরও ভার দেন। যদিও রিপোর্টে এই অন্যায় দখল প্রমাণিত হয় প্রশাসন কিন্তু কোনো নির্ধারক পদক্ষেপ নেয় না। ১৯৯২-৯৩ সাল নাগাদ, জমিদাররা ইমামবাড়াটি ধ্বংস করে দেয় এবং সমস্ত ধ্বজাগুলি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে জ্বালিয়ে দেয়। স্থানীয় থানায় একটি এফআইআর নথিভুক্ত করা হয় ও একটি মামলা দায়ের করা হয। বাথানিটোলা হত্যাকাণ্ডের ১৩ দিন পর, ২৩ জুলাই ১৯৯৬ আদালতে এই মামলার নিষ্পত্তি হয়। রায়ে বলা হয়, সেখানে ইমামবাড়ার অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই।
একই কায়দায় কবরস্থানের জমিও কব্জা করে নেওয়া হয়। ১৯৯৩-এর ১৪ এপ্রিল মহম্মদ নঈমুদ্দিন একটি মামলা দায়ের করেন এবং করবস্থানের চৌহদ্দি ঘিরে দেওয়ার দাবি জানান। শেষ পর্যন্ত অর্থাভাবে মামলাটি লড়া যায়নি এবং খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু অন্যায় দখলদারী আগের মতোই বহাল থাকল।
রণবীর সেনার লোকেরা কানফারি (সাহার) ও নওয়াডিতেও (তরারি) কবরস্থান ও কারবালার জমি দখল করে নিয়েছিল। এই জমি দখলদারির প্রতিবাদে ১০ জানুয়ারি ১৯৯৬ কারবালা মুক্তি জন জাগরণ মঞ্চ গঠন করা হয়। কানফারিতে যে সব মানুষ সভা থেকে ফিরে আসছিলেন তাদের উপর রণবীর সেনার লোকেরা হামলা চালায়। কিন্তু তাদের আক্রমণকে প্রতিরোধ করা হয়। উত্তেজনা বাড়তেই থাকে, কিন্তু দখলীকৃত জমি উদ্ধারের জন্য সরকার কোনো উদ্যোগ নেয় না। যদিও লালু যাদব ঘোষণা করেন সমস্ত গোরস্থানকে রক্ষা করা হবে, কিন্তু কোনো কিছুই করা হয়নি। রমজান মাসে, ২৫ এপ্রিল মহম্মদ সুলতানকে খুন করা হয় কিন্তু তার দেহ রণবীর সেনার দলবল খারাওঁনের কবরখানায় সমাধি দিতে বাধা দেয়। এখানেও তারা বহু লোককে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু মৃতদেহ নিকটবর্তী ছাতারপুরা গ্রামে সমাধিস্থ করতে নিয়ে গিয়ে এই হত্যাকাণ্ড এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। তাতেও তারা সন্তুষ্ট হয় না এবং তারা খারাওঁ গ্রামের মুসলিম পাড়া আক্রমণ করে এবং মা-লে সমর্থকদের বাড়িতে হামলা চালায় ও জিনিসপত্র লুটপাট করে। ৫০টি পরিবার গৃহহীন হয়, যার মধ্যে ১৮টি ছিল মুসলিম পরিবার। মহম্মদ নঈমুদ্দিনের পরিবার সহ অনেকেরই পরিবার বাথানিটোলায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু যেহেতু মসজিদটি ছিল রণবীর সেনা অধ্যুষিত এলাকায় তাই তারা ভয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যেতে পারেনি। পুলিশের বন্দোবস্ত করা গেলে তবেই তারা নামাজ পড়তে সক্ষম হয়।
তবুও উত্তেজনা প্রশমন হয় না। বাথানিটোলা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায় এবং মে মাসের শুরু থেকে ১১ জুলাই-এর মধ্যে সেনার গুণ্ডারা সাত বার এই টোলায় আক্রমণ চালায়। প্রতিবারই পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয় কিন্তু গ্রামবাসীরা নিজেদের শক্তিতেই গুণ্ডাদের তাড়া করে। ১১ জুলাই সেনার গুণ্ডারা সফল হয় এবং মহম্মদ নঈমুদ্দিনের পরিবারের ৫ জন সদস্যকে তারা হত্যা করে ও পরবর্তীতে হাসপাতালে একটি শিশুর মৃত্যু হয়। মহম্মদ নঈমুদ্দিন ও তার স্ত্রী ঘটনার সময় গ্রামে না থাকায় রক্ষা পায়। কেউ কেউ বলেন এই নিদারুণ হত্যাকাণ্ডের পিছনে ছিল মজুরি ও জমি সংক্রান্ত বিরোধ। কিন্তু সত্য যা তা হল এই দ্বন্দ্ব এক বছর আগেই মিটে গিয়েছিল এবং সেখানে আর কোনো অর্থনৈতিক অবরোধও ছিল না। শংকর শরণ তথ্যানুসন্ধানী টিমের রিপোর্টেও এই তথ্য প্রমাণিত হয়েছে এবং সত্য যা তা হল লড়াইয়ের শুরু তার পরেই। সুতরাং এই বিরোধের ফলেই যে গণহত্যা – এই প্রচারের কোনো সত্যতা নেই। দ্বিতীয়ত, যেভাবে এই গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে তা সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা, ঘৃণা ও প্রতিহিংসার মনোভাবকেই দেখিয়ে দেয় এবং তথ্যের ও যুক্তির বিচারে সমস্ত মানদণ্ডেই এই গণহত্যার সাম্প্রদায়িক চরিত্র ও তার পশ্চাদপট পরিস্ফুট হয়।
আমরা সব সময়েই শান্তি প্রতিষ্ঠার সপক্ষে থেকেছি। এই কারণেই যে শান্তিকামী জনগণের আকাঙ্খার কথা মনে রেখে আমরা শান্তির জন্য উদ্যোগ নিতে শুরু করি। বিহটার (পাটনা) কিষাণ মহাসভার দ্বারা সংগঠিত স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর বার্ষিকী অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আমরা শান্তির জন্য আলাপ-আলোচনা শুরু করি। ভূমিহার জাতের আরও কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি সহ শ্রীমতী তারকেশ্বরী সিনহা এবং শ্রী ললিতেশ্বর শাহী আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। আমাদের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক কমরেড পবন শর্মা উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা যথেষ্ট ইতিবাচক হয়েছিল। এই সব আলোচনার ঠিক দুদিন পর পার্টির সাধারণ সম্পাদক আরায় সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে শান্তির জন্য এক আবেদন প্রকাশ করেন। এই আবেদন সংবাদপত্রগুলিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়। সমস্ত শান্তিপ্রিয় মানুষ একে স্বাগত জানান। আমরা রণবীর সেনার কাছ থেকেও সদুত্তর প্রত্যাশা করেছিলাম। পরবর্তীতে, দুপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করছিলেন এমন এক বন্ধুর মারফত আমরা এক বার্তা পাঠাই যে রণবীর সেনাও কোনো বিবৃতি প্রকাশ করুক যাতে আমরা পরবর্তী ধাপে পৌঁছাতে পারি। আমাদের বন্ধু বার্তা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু উত্তর মিলেছে হতাশাজনক। আমাদের শান্তি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এলাকায় যাতে আমরা উন্নয়নমূলক কাজে হাত দিতে পারি তার জন্য শান্তি খুবই জরুরি ছিল, তাই আমরা শান্তি প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করিনি। এবার আমরা ভিন্ন এক পদ্ধতিতে শুরু করি। আমরা ভেবেছিলাম, জনমত সংগঠিত করেই জনগণের দিক থেকে চাপ সৃষ্টি করা দরকার। আমরা আশা করেছিলাম, প্রশাসনও আমাদের সাহায্য করবে। ১৯৯৬-এর জুনে, প্রধান প্রধান বাজার ও গ্রামের চকগুলিতে ডজন খানেক জনসভা সংগঠিত করার মাধ্যমে আমরা শান্তি অভিযান শুরু করি এবং মানুষকে এই শান্তি প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাই। ইতিমধ্যেই, রণবীর সেনার কিষাণদের ও আমাদের জনগণের মধ্যে পাঁচটি গ্রামে দ্বন্দ্বের নিরসন করা হয়। এই প্রচারাভিযানের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের প্রশ্নে আমাদের উদ্যোগ ভালো সাড়া ফেলে এবং তরারি ব্লকে আমরা ‘ঘেরা ডালো ডেরা ডালো’ আন্দোলন শুরু করি। আন্দোলন চমৎকার সাফল্যলাভ করে।
আরায় শান্তির প্রশ্নে আমরা এক সেমিনারের আয়োজন করি যেখানে সাধারণ জনগণের সঙ্গে অনেক শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী ও শান্তিপ্রিয় মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
এটা দুর্ভাগ্যজনক যে রণবীর সেনা শান্তিকামী জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে কোনো মর্যাদাই দেয়নি এবং শান্তির জন্য প্রচার অভিযানের সমগ্র পর্যায় জুড়েই তারা ধারাবাহিকভাবে হিংসাত্মক প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করেছে। এভাবে আমাদের দ্বিতীয় প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। একটি লিফলেটের মাধ্যমে রণবীর সেনা এই শান্তি প্রচেষ্টাকে অগ্রাহ্য করার জন্য জনগণের কাছে আহ্বান জানায় এবং চলমান যুদ্ধে সামিল হওয়ার ডাক দেয়। এটাই হয়তো সেই কারণ যে জন্য ‘বাথানিটোলা’ ঘটিয়ে শান্তি প্রচেষ্টাকে পুরস্কৃত করা হল।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্র বিহার কীভাবে গণতন্ত্রের সমাধিক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে বাথানিটোলা গণহত্যা ও সরকারি জবাব তারই জীবন্ত উদাহরণ। এই খেলায় সমস্ত পশ্চাদগামী ও অন্ধকারের শক্তিগুলি জোটবদ্ধ হয়েছে – যে জোট হল মাফিয়া ও সামন্ততান্ত্রিক কায়েমী স্বার্থের জোট।
আমরা সমস্ত প্রগতিশীল, বিপ্লবী, গণতান্ত্রিক, সমাজবাদী ও বামপন্থী সংগঠন ও জনগণের কাছে গণতন্ত্রের জন্য এই সংগ্রামে সামিল হওয়ার ও এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।
আমরা বাথানিটোলা গণহত্যার জন্য দায়ী প্রশাসনিক পদাধিকারীদের শান্তির দাবি জানিয়েছি। এই যুদ্ধে জয় ছিনিয়ে নিতে আমরা যদি ব্যর্থ হই তাহলে কাসোয়ানের মতো অপরাধীদের বেড়ে ওঠা আমরা রোধ করতে পারব না, পারব না পুলিশ আর প্রাইভেট আর্মির দ্বারা আরও আরও বাথানিটোলার মতো নরমেধ যজ্ঞ ঘটানোকে রুখে দিতে।
আমরা আপনাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে বুদ্ধিজীবীদের সভা সমিতিতে প্রস্তাব গ্রহণ করে, মিছিল সংগঠিত করে, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে অথবা জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেটের শাস্তির দাবি জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে ন্যায়বিচারের জন্য এই আন্দোলনে সামিল হোন।