(পাটনায় অনুষ্ঠিত বিহারের বিকাশ সম্পর্কে কনভেনশনে প্রদত্ত ভাষণের অংশবিশেষ। লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯৪ থেকে)

বিহারের বিকাশ সম্পর্কে যদি বলা যায় যে তার গতি অত্যন্ত মন্থর, তবে প্রকৃত অবস্থা বোঝানোর পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। প্রকৃত অবস্থা হল বিহার পিছনের দিকে হাঁটছে। এটাই বিহারের বিশেষত্ব। পুরোনো অর্থনৈতিক নীতির অধীনে স্থাপিত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বড় বড় কারখানাগুলি দ্রুতই রুগ্ন হয়ে পড়ছে। অপরদিকে নয়া আর্থিক নীতির ভিত্তিতে অন্যান্য রাজ্যগুলিতে যেমন নতুন করে পুঁজির বিনিয়োগ হচ্ছে, বিহারে তা দেখা যাচ্ছে না। পুরোনো বা নতুন কোনো অর্থনীতিই বিহারের পক্ষে লাভজনক হতে দেখা যায়নি। রাজ্য সরকারের সংস্থাগুলিতে ব্যাপক লোকসান হচ্ছে। ভারতবর্ষের মধ্যে বিহারেই মাথাপিছু আয় সব থেকে কম। দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের শতকরা হিসাবের দিক থেকেও বিহারই রয়েছে সর্বাগ্রে এবং ঐ শতকরা হার দিন দিন বেড়েই চলেছে।

অন্য আর একটি বিষয়ও এখানে লক্ষ্যণীয়। তা হল কয়লা থেকে প্রাপ্ত রয়ালটি হোক, কেন্দ্রের অনুদান বা বিশ্বব্যাঙ্কের সাহায্য হোক, সরকারি কর্মচারি ও শিক্ষকদের বেতনের টাকাই হোক বা প্রভিডেন্ট ফাণ্ডে সঞ্চিত তাদের জমা টাকাই হোক – এ সমস্ত কিছুকে সম্বল করেই সরকার চলে। অন্যভাবে বলতে গেলে, রাজ্যের অভ্যন্তরে তেমন রাজস্ব সৃষ্টি হচ্ছে না।

এই রাজ্যের তৃতীয় বিশেষত্ব হল তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্র। এই রাজ্যে বর্তমান যাঁরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন, বিহারের উন্নয়ন সম্পর্কে তাঁদের কোনো অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ নেই। রাজনীতি হল অর্থনীতিরই প্রতিফলন, আর তাই আমরা যাকে বলি রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বাস্তবে তা হল অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়নেরই প্রতিফলন। জগন্নাথ মিশ্র থেকে লালু যাদব, এই যে পরিবর্তন ঘটেছে তা হল উচ্চ বর্ণের মধ্যকার দুর্বৃত্তদের আধিপত্য থেকে অনগ্রসরদের মধ্যকার দুর্বৃত্তদের আধিপত্যের রূপান্তরণ। এমনকি ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের উপজাতি নেতৃত্বের মধ্যেও মাফিয়া বৈশিষ্ট্য যথেষ্ট প্রকট। এই ধারা সমস্ত দিককেই গ্রাস করেছে। এমনকি রাজনীতিবিদরাও এক বিশেষ ধরনের ‘শ্রেণী’ হয়ে উঠেছেন। বিহারের জনগণ এমনিতেই জমিদার, কুলাক ও বিভিন্ন ধরনের দুর্বৃত্তের ভারে ভারাক্রান্ত, তার ওপর এই রাজনীতিবিদদের শ্রেণী তাদের ভারকে আরও দুর্বিসহ করে তুলেছে। সরকারি কাজকর্মকে দখল করাই বিহারের সমগ্র রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিহারের চতুর্থ বিশেষত্ব হল : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চরম অধঃপতন, নির্বাচন এখানে চূড়ান্ত হিংসাপ্রবণ এবং পঞ্চায়েত ও পুরসভার কোনো নির্বাচনই এখানে অনুষ্ঠিত হয় না। এগুলির শেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭৮ সালে এবং তাতে ২০০০ মানুষ মারা গিয়েছিলেন।

বিহারে পঞ্চম অভিশাপ হল হিংসার সবচেয়ে দানবীয় রূপ। আজকাল এখানে দু-চারজন মানুষের মৃত্যু তেমন কোনো খবরই নয়। কেবলমাত্র ব্যাপক আকারের গণহত্যাই এখানে খবর হতে পারে। এটি দেখিয়ে দেয় বিহারের মানুষের জীবন কত সস্তা।

সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের দ্রুত অবক্ষয় হল এ রাজ্যের ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য : শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য, রাষ্ট্রকে প্রতারিত করা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে রাজা-মহারাজা ও অবতার হিসাবে তুলে ধরা হয়।

বিহারে কৃষি উৎপাদনের গতিরুদ্ধতাই রাজ্যের অন্যান্য সমস্ত বিষয়ের অধঃপতনের মূল কারণ। জাতীয় গড় হারের তুলনায় বিহারে প্রতি একর জমিতে ৭০ শতাংশের বেশি কৃষক, ১২০ শতাংশের বেশি কৃষিমজুর এবং ৬৫ শতাংশের বেশি গবাদি পশু নিয়োজিত হয়, তবু উৎপাদনের দিক থেকে জাতীয় গড়ের তুলনায় এই রাজ্য অনেক পিছিয়ে রয়েছে। গভীর বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে এখানে চাষবাস হল মূলত জীবনধারণ ভিত্তিক, অর্থাৎ উৎপাদন মূলত নিজেদের ভোগের জন্য, বাজারের জন্য নয়।

কেন পরিস্থিতি এরকম হয়েছে? প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতাগুলির অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে মূল সমস্যা হল ভূমিসংস্কার, আজ পর্যন্ত বিহারে যা অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। লালু যাদব যখন ক্ষমতায় আসেন, তিনি বলেন – বস্তুত হুমকি দেন – যে ৬৫টি পরিবারের ৫০০ একরেরও বেশি জমি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি আইনি ব্যবস্থা নেবেন এবং প্রয়োজন হলে তিনি জমির জাতীয়করণও করবেন। সমস্ত জমিদারদের জমি নথিভুক্তি করার ব্যাপারে রাজ্য সরকার একটি সার্কুলারও জারি করে। তারপর যত দিন গেছে লালু এই সমস্ত কথা বলা বন্ধ করেন এবং এমনকি সার্কুলার প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু লালু যখন ঐ সমস্ত কথাবার্তা বলতেন, জগন্নাথ মিশ্র তার বিরোধিতা করতেন। তাঁর প্রথম আপত্তির বিষয় ছিল যে, নথিভুক্তকরণের প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হবে, খুব সম্ভবত খরচ দাঁড়াবে ৪০০০ কোটি টাকা। আর দ্বিতীয়ত, এটি করতে গেলে তা ব্যাপক সামাজিক উত্তেজনার সৃষ্টি করবে। আমরা দেখলাম, লালুজীও ক্রমে ক্রমে ঐ সমস্ত কথাবার্তা বলা বন্ধ করলেন এবং সার্কুলার তুলে নিলেন। এইভাবে, লালু ও জগন্নাথ মিশ্রের মধ্যে, জনতা দল ও কংগ্রেসের মধ্যে এক ঐতিহাসিক চুক্তি হল। অথবা আপনি বলতে পারেন, অগ্রসর ও অনগ্রসর জাতিগুলির কুলাকরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় উপনীত হল যে, জমির বুনিয়াদী প্রশ্নে আমরা লড়ালড়ি করব না; আমাদের যদি একান্তই লড়াই করতে হয় তবে কেবলমাত্র সরকারি চাকরির সংরক্ষণ নিয়েই লড়াই করব। জমির বুনিয়াদী প্রশ্নে লড়াই করা ঠিক নয়, কেননা তা সামাজিক উত্তেজনার সৃষ্টি করবে যার থেকে সুবিধা আদায় করে নেবে বিপ্লবী শক্তিগুলি।

বিহারের কিছু বুদ্ধিজীবী এমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন যে, এই রাজ্যে ভূমিসংস্কারের আর কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা যেটুকু ভূমিসংস্কারের দরকার ছিল ইতিমধ্যেই তা হয়ে গেছে। অগ্রসর ও অনগ্রসরদের মধ্যকার ভাগচাষিরা জমির দখল পেয়ে গেছে এবং জমিদারী প্রথারও বিলোপ সাধন করা হয়েছে। আর এই সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা বলছেন যে, ‘কিষাণ রাজ’ (লালু সরকারের পরিপ্রেক্ষিতে) এসে গেছে। কাজেই এখন ভূমিসংস্কারের কথা বলা সঙ্গত নয়। আবার আর একটি অভিমতও উঠে এসেছে, তা হল, ভূমিসংস্কার কর্মসূচিকে বকেয়া কাজ হিসাবে সম্পূর্ণ করার, এখানে সেখানে কিছু কিছু করার মতো কাজ হিসাবে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু তার পরিধিকে বিস্তৃত করার প্রয়োজন নেই। যা দরকার তা হল জনগণকে শিক্ষিত করা যাতে তাদের মধ্যে এক ব্যবসায়িক উদ্যোগের বোধ জাগিয়ে তোলা যায়। ‘বাবু’ বনে যাওয়ার পরিবর্তে বিহারী যুবককে পুঁজি বিনিয়োগ করে শিল্প গড়তে হবে। তাঁরা বললেন, এটি জাতপাত নির্ভরশীল ব্যাপার নয়, বরং মানবিক গুণাবলীর উপরই ভিত্তিশীল এবং এই মানবিক গুণাবলীকে লালনপালন করতে হবে। প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার মধ্য দিয়েই তা সম্পন্ন করা যাবে। শুধু চাল আর গম উৎপাদন করলেই চলবে না, আলু উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করতে হবে, মাছ চাষে উৎসাহ দিতে হবে, ইত্যাদি। এটিই হবে বিহারের প্রগতির পথ। আমি মনে করি এই সমস্ত ধারণাই ভ্রান্ত, তা যে কোনো বাম রূপেই আসুক না কেন। আপনারা দেখবেন, এখানে স্থিতাবস্থাপন্থী যে সমস্ত শক্তিগুলি আছে, তা কংগ্রেসই হোক বা জনতা দলই হোক, সবাই ঘুরিয়ে বলে যে এখানে ভূমিসংস্কারের কোনো প্রয়োজন নেই। বিহারে যদি উন্নত প্রথায় চাষবাস করা যায় এবং আমলাতন্ত্রকে যদি কিছুটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত করে তোলা যায়, তবে বিহারের সমস্ত সমস্যাই দূর করা যেতে পারে। এইভাবে আমরা বুঝতে পারি যে এই সমস্ত যুক্তিগুলিই কোনো না কোনোভাবে স্থিতাবস্থাপন্থী ও সরকারি শক্তিগুলির পক্ষেই কাজ করে।

ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাব, বিহারে ১৯৭৩ সালে ভূমিসংস্কার সম্পর্কে এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং অনেক সুপরিচিত বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্যরা তাতে অংশগ্রহণ করেন। অনেক বিষয়ই সেখানে আলোচিত হয় এবং কী করণীয় – বিশেষত বিহার সরকারের কী করার আছে সে সম্পর্কে অনেক প্রস্তাবই উঠে আসে। প্রথম যে প্রস্তাব আসে তা হল, জমির নথিভুক্তিকরণ যথাযথ অবস্থায় নেই, সেগুলি সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা আছে, বিশেষত ভাগচাষিদের নথিভুক্তিকরণ বিশেষ প্রয়োজন। দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল, ভাগ চাষ সম্পর্কেও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আছে যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে ভাগচাষিদের তাঁদের নিজস্ব জমির মালিক করে তোলা। প্রয়োজন হলে ভাগচাষিদের জন্য যথাযথ অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তাঁরা ক্ষতিপূরণ দিতে পারেন। আর সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণের এই অর্থ ঋণ হিসাবে ভাগচাষিদের দেওয়া উচিত, যা আবার পর্যায়ক্রমে কিস্তিতে তাঁদের কাছ থেকে আদায় করে নিতে হবে। এর ফলে ভাগচাষিরা আরও ভালোভাবে চাষবাস করতে পারবেন এবং জমিদারদের কাছে তাঁদের যে ঋণ থাকবে তা ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির কাছ থেকে কম হারের সুদে প্রাপ্ত ঋণের মাধ্যমে শোধ করা যাবে। তৃতীয় যে প্রস্তাব উঠে আসে তা হল ঊর্ধ্বসীমা সম্পর্কিত আইনের সংশোধন ও তার যথাযথ রূপায়ন। চতুর্থ প্রস্তাব ছিল, জমি সংক্রান্ত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে এবং মামলাগুলিকে আদালত থেকে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত করে সেগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।

সম্প্রতি ১৯৯১ সালে ভূমিসংস্কার সম্পর্কিত এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় সেই পাটনাতেই, আর সেখানে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এমন কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন যাঁরা ১৯৭৩ সালের আলোচনাক্রেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই কর্মশালা বিগত কুড়ি বছরে ১৯৭৩ সালের প্রস্তাবগুলির কী পরিণতি হয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা করে। তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বিগত কুড়ি বছরে বিহারে ভূমিসংস্কারে প্রক্রিয়া একটুও এগোয়নি। ঊর্ধ্বসীমাকে নামিয়ে আনার ব্যাপারে আইন প্রণয়ন এবং দখলীকৃত জমি বিতরণের কাজে বিন্দুমাত্র অগ্রগতি ঘটেনি। বস্তুত অপ্রাসঙ্গিক হিসাবে অভিহিত করে ভূমিসংস্কারের কর্মসূচিকে সব সময়েই পিছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ঐ কর্মশালা রাজ্য সরকারের কাছে পুনরায় কিছু প্রস্তাব পাঠায় এবং আশা করে যে সেগুলির রূপায়ন হবে। ঐ কর্মশালার বিশেষ প্রস্তাব ছিল, জমির ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করতে হবে এবং এক নতুন পদ্ধতিতে, বর্তমানে জমির ভাগবিন্যাসের যে দুটি ধরন রয়েছে, এখন থেকে তা হবে তিন ধরনের। প্রথমত চাষযোগ্য জমির ঊর্ধ্বসীমা হবে ১৫ একর; অ-চাষযোগ্য জমির ঊর্ধ্বসীমা হবে ২২ একর এবং বন্ধ্যা ও পতিত জমির ঊর্ধ্বসীমা হবে ৩০ একর। দ্বিতীয়ত বেসরকারি ট্রাস্টের অধীনে এবং চিনি কলের নামে জমির জন্য যে সমস্ত ব্যক্তিকে ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত ছাড় দেওয়া আছে তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। তৃতীয় প্রস্তাব ছিল, হাইকোর্ট আটকে দেওয়ায় সরকার আগে যে জমি সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারেনি, তা আবার গঠন করতে হবে। আর সেই জন্যই প্রস্তাব ছিল, ট্রাইব্যুনাল যাতে গঠন করা যায় তার জন্য সুপ্রীম কোর্টের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। চতুর্থ প্রস্তাব ছিল, পশ্চিমবঙ্গের ‘অপারেশন বর্গা’র মতো বিহারেও ‘অপারেশন বাটাই’ চালু করতে হবে। বিহারের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা এই সমস্ত প্রস্তাব পাঠালেও বিহার সরকার সেগুলি রূপায়নের পথে যায়নি।

কাজেই আমরা যা বলছি, সেটি শুধু আমাদের কথা নয়। দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা, সমস্ত প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীরা যাঁরাই বিহারের উন্নতি চান, সকলেই এব্যাপারে একমত যে বিহারে ভূমিসংস্কার অসম্পূর্ণ এবং একে সম্পূর্ণ করার মধ্যেই রয়েছে বিহারের উন্নতির চাবিকাঠি। শুধুমাত্র জগন্নাথ মিশ্র ও লালু যাদবরা বা দালাল-বুদ্ধিজীবীরাই কেবল বলে থাকেন বিহারে ভূমিসংস্কারের কোনো প্রয়োজন নেই, আর কৃষিতে নতুন প্রযুক্তিই হল বিহারের সর্বরোগহর দাওয়াই।

সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কৃষিমজুরদের প্রশ্ন এবং তাদের ন্যূনতম মজুরি দেওয়া উচিত। এর জন্য চাষের মরশুম শুরু হওয়ার আগেই স্থানীয় চাষি, কৃষক, কৃষিমজুর, কিষাণ সভার মতো জনগণের সংগঠনগুলি এবং প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের একসঙ্গে বসে সেই মরশুমের জন্য মজুরি নির্ধারিত করা উচিত। একে নিয়মিত ব্যবস্থাপনায় পরিণত করতে হবে, কেননা প্রতি বছরই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় এবং তার ভিত্তিতে মজুরির নতুন হারও ঠিক করতে হবে। দেখতে হবে মজুরির এই হার যেন রূপায়িত হয়, কেননা মজুররা সারা বছর কাজ পায় না। কাজেই তাদের কাজের ব্যাপারে নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে হবে এবং ঘর তৈরি করার জন্য তাদের জমি দিতে হবে। এটিই হবে এক নম্বর কর্মসূচি। দ্বিতীয়ত, জমি নথিভুক্তিকরণের জন্য নতুন করে জরিপ করতে হবে, তারপর জমি শুধু বিতরণ করলেই চলবে না, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষবাসের জন্য যৌথব্যবস্থা ভিত্তিক চাষবাসেরও প্রয়োজন। এছাড়াও, ভাগচাষিদের অধিকারকে সুরক্ষিত করতে হবে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে তাদের কম সুদের হারে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা ভালোভাবে চাষবাস করতে পারে এবং কালক্রমে নিজেরাই নিজেদের জমির মালিক হয়ে ওঠে। এটি হবে আমাদের দ্বিতীয় কর্মসূচি।

তৃতীয় কর্মসূচি হবে, সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে, পুরোনো খালগুলির সংস্কারসাধন করে এবং আরও ভালো উৎপাদনের জন্য জমির গুণগত মানের বৃদ্ধি ঘটিয়ে কৃষির পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করে তোলা। চতুর্থ কর্মসূচি হবে কৃষি-উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনা। হাঁস-মুরগি পালন ব্যবস্থাকে চালু করতে হবে। পঞ্চম বিষয় হল; চটকল, চিনিকল অথবা উত্তর বিহারের খাদি বস্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলির মতো বিহারের ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। ষষ্ঠ বিষয় হল, পঞ্চায়েতের মতো সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকেই আমাদের অবশ্যই পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে হবে। আর সপ্তম যে বিষয়টি আমি বলতে চাই তা হল, কিষাণ সভার মতো গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলিকে এই সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করাতে হবে।

আমার মতে, বিহারের উন্নতির জন্য এই কর্মসূচি অপরিহার্য। কিন্তু এর রূপায়ন খুব সহজ ব্যাপার নয়। এর জন্য আমাদের সংগ্রামের এক দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। সর্বপ্রথম সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে জমিদার অথবা ধনী কুলাকদের বিরুদ্ধে এবং তাদেরও বিরুদ্ধে যারা বিভিন্ন ব্যবসার সাথে যুক্ত এবং যারা কূটকৌশলের মাধ্যমে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ও পিছন থেকে আঞ্চলিক রাজনীতিকে পরিচালিত করে। ভোজপুরের কুখ্যাত জমিদার জোয়ালা সিং-এর মধ্যে এই তিনটি গুণই বিদ্যমান ছিল। সে একদিকে বিপুল জমির মালিক, অন্যদিকে অন্ধকার জগতের কাজকর্ম থেকে কামিয়ে নেওয়া কালো টাকা দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা চালাতো এবং ঐ অঞ্চলের গোটা রাজনীতি পরিচালিত করতো। এই ধরনের শক্তিগুলি বিহারের প্রতিটি কোণেই বিদ্যমান এবং আমাদের প্রথম কাজ হল তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করা। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতিপরায়ণ আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধেও তীব্র সংগ্রাম পরিচালনা করা উচিত। তৃতীয়ত এর আগে আমি যে রাজনীতিবিদদের শ্রেণীর কথা বলেছি, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হবে।

সবশেষে আমি বলতে চাই যে, বিহারে শিক্ষাক্ষেত্রে চূড়ান্ত নৈরাজ্যের অবসান ঘটানো প্রয়োজন। চারওহা বিদ্যালয়গুলির (রাখালদের জন্য) মধ্যে সময় নষ্ট না করে কৃষি-প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলি খুলতে হবে। বিহারে প্রযুক্তিগত চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রামলখন সিং যাদব ও তপেশ্বর সিং-এর অপ্রয়োজনীয় বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়গুলির মতো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে এবং সেগুলিকে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। এই প্রসঙ্গে আমি আরও বলতে চাই যে, শিক্ষাকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ আর তাই এই জাতপাতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সংরক্ষণ থাকবে দলিতদের জন্য যার মধ্যে সুবিধাবাদী স্তরটি বাদ যাবে। সংরক্ষণের হারকে ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে, তবে এর মধ্যে মহিলাদের জন্য ন্যূনতম পক্ষে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ রাখতে হবে। কেননা, বিহারে পশ্চাদপদতার ভাঙ্গনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে গেলে নারীদেরই সামাজিক বিকাশের পুরোভাগে আনতে হবে।