(লিবারেশন, মে, জুন ও জুলাই ১৯৯৩-এ প্রকাশিত পার্টি ইতিহাসের সহজবোদ্ধ রূপরেখার সংক্ষেপিত অংশ)

ষাটের দশকের গোড়ার দিকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে মহাবিতর্ক চলাকালীন ১৯৬৪ সালে সিপিআই-এ প্রথম ভাঙ্গন ঘটে এবং সিপিআই(এম)-এর জন্ম হয়। সাধারণের কাছে সিপিআই রুশপন্থী আর সিপিআই(এম) চীনপন্থী বলে পরিচিত ছিল। জাতীয় গণতন্ত্রের লাইন সিপিআই-এর বৈশিষ্ট্য বলে ধরা হত। এই লাইন বলতে বোঝাত ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী একচেটিয়া-বিরোধী অংশ অর্থাৎ জাতীয় বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিত্বকারী নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ভারতের গণতান্ত্রিক রূপান্তরকরণের নেতৃত্বকারী ভূমিকা নেবে আর কমিউনিস্ট পার্টির কাজ হবে ভারতীয় বুর্জোয়াদের একচেটিয়া অংশের বিরুদ্ধে তার পিছনে দাঁড়ানো এবং খুব বেশি হলে জাতীয় বুর্জোয়াদের দোদুল্যমানতার বিরুদ্ধে এক প্রেসার গ্রুপের ভূমিকা পালন করা। অন্যদিকে সিপিআই(এম)-কে চরিত্রায়িত করা হত তার জনগণতন্ত্রের লাইনের দ্বারা, ব্যাপক গণআন্দোলন বিশেষত কৃষক সংগ্রাম গড়ে তোলার উপর জোর দিয়ে এই লাইনে নেহরু কংগ্রেসের সঙ্গে কোনোরকম আঁতাতকে নাকচ করে দেওয়া হয়েছিল।

বিপ্লবের পথ সম্পর্কে আলোচনায় আসা যাক। এ প্রশ্নে সিপিআই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করাকেই একমাত্র রাস্তা হিসাবে ওকালতি করত, আর সিপিআই(এম) সংসদীয় গণতন্ত্রের এক সীমাবদ্ধ ভূমিকার কথাই কেবল স্বীকার করত, যেখানে কমিউনিস্টরা খুব বেশি হলে কয়েকটি রাজ্যে সরকারি ক্ষমতা দখল করতে পারে। সিপিআই(এম)-এর মতে এই ধরনের ক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে জনগণকে বু্র্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন করা ও তার মধ্য দিয়ে শ্রেণী সংগ্রামকে ধারালো করে তোলার জন্য। তাই স্লোগান দেওয়া হয়েছিল “বাম সরকার শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার”।

১৯৬৪ সালে যখন ভাঙ্গন ঘটল তখন স্বভাবতই বিপ্লবী কমিউনিস্টরা সকলেই ছিলেন সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকেই সিপিআই(এম) নেতৃত্ব উপরোক্ত প্রত্যেকটি প্রশ্ন দোদুল্যমানতা দেখাতে আরম্ভ করল আর সেই কারণে একেবারে গোড়া থেকেই এক আন্তঃপার্টি সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল। কমরেড চারু মজুমদারের বিখ্যাত আটটি দলিল ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭-র মধ্যেকার এই সংগ্রামের সবচেয়ে ভালো সংক্ষিপ্তসার। পশ্চিমবাংলায় প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন হওয়ার সাথে সাথে সর্বত্র কর্মীবাহিনীর বিপ্লবী আশা আকাঙ্খা বেড়ে গেল এবং পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জায়গায় জমির লড়াই শুরু হয়ে গেল। বিশেষ করে নকশালবাড়ি অঞ্চলে এই লড়াই উন্নততর স্তরে পৌঁছে গেল এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখোমুখি হল। একদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের হুমকির মুখে সিপিআই(এম) প্রাধান্যাধীন সরকার নিজেকে রক্ষা করতে রক্তাক্ত উপায়ে আন্দোলনকে দমন করার পথ বেছে নিল। পার্টি জুড়ে জ্বলে উঠল প্রতিবাদের আগুন। উত্তরপ্রদেশ, দিল্লী, জম্মু ও কাশ্মীরের মতো রাজ্য কমিটিগুলি পার্টি থেকে বেরিয়ে গেল আর অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবাংলার মতো অন্যান্য রাজ্যে সর্বস্তরে বড় ধরনের ভাঙ্গন দেখা দিল।

কমিউনিস্ট বিপ্লবী শক্তিগুলি প্রথমে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সর্বভারতীয় সমন্বয় কেন্দ্রে (এআইসিসিসিআর) নিজেদের সংগঠিত করেন, যার থেকে পরে সিপিআই(এমএল) গড়ে ওঠে। আশির দশকের প্রথম দিকে সিপিএমে আরও একটি ভাঙ্গন ঘটে। তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক পি সুন্দরাইয়ার অনুগামীরা পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এমসিপিআই গড়ে তোলেন। সিপিআই(এম)-এ এখনও ছোটোখাটো ভাঙ্গন ঘটে চলেছে এবং প্রত্যেকবারই প্রশ্ন উঠছে ১৯৬৪-র কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে।

প্রথম পর্যায়ে সিপিআই(এমএল) সমস্ত ধরনের বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান বর্জনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে এবং বিশুদ্ধ চীনা বিপ্লবের ধাঁচে ঘাঁটি এলাকা গড়ে তোলার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার আহ্বান রাখে। রুশ পথ বনাম চীনা পথের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে বহু দিন থেকেই বিতর্ক চলছিল। তেলেঙ্গানার পর এ প্রশ্নে আন্তঃপার্টি সংগ্রাম মাঝপথে থেমে গিয়েছিল। তখন ঠিক করা হল, বিষয়টি এবার চূড়ান্তভাবে ফয়সালা করতেই হবে।

ষাটের দশকের শেষভাগে ও সত্তরের দশকের শুরুতে সিপিআই(এমএল)-এর নেতৃত্বে যে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল তা সশস্ত্র বিপ্লব সংগঠিত করার এযাবৎকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা হিসাবে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভারতীয় বিপ্লবের বেদীমূলে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সহ হাজার হাজার পার্টি নেতা ও কর্মীর প্রাণ উৎসর্গ করার এই বীরত্বগাথা ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য হয়ে রয়েছে। ভাবী প্রচেষ্টার স্বার্থে এই ঐতিহ্যকে অবশ্যই সযত্নে লালন-পালন করতে হবে।

কিন্তু সেই সশস্ত্র সংগ্রাম গুরুতর ধাক্কার সম্মুখীন হল। পার্টিও অসংখ্য গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে গেল। পুরোনো লাইনের ভিত্তিতে  আন্দোলনকে পুনর্জীবিত করা ও পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করার সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। কয়েকটি গোষ্ঠী সুবিধাবাদ ও অধঃপতনের পাঁকে গভীরভাবে নিমজ্জিত হল আর কয়েকটি পরিণত হল পুরোদস্তুর নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীতে। পিপলস ওয়ার হল শেষোক্তদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। আমরাই ছিলাম একমাত্র গোষ্ঠী যারা অন্ত্যন্ত কঠিন সময়ে বিহারের ভোজপুরে নকশালবাড়ির মশালকে জ্বালিয়ে রেখেছিল। যখন অন্যান্য সবকটি গোষ্ঠী কার্যত টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছিল তখন আমাদের গোষ্ঠীই ধাপে ধাপে নিজেকে পুনর্গঠিত করে এবং এক দশকেরও বেশি সময় জুড়ে কষ্টসাধ্য লড়াইয়ের পরে পার্টি ও আন্দোলনকে জাতীয় স্তরে পুনর্জীবিত করে।

মার্কসীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আমাদের পার্টি এটা বুঝতে পেরেছিল যে একটি আন্দোলনকে কখনই পুরোনো শ্লোগানের ভিত্তিতে পুনর্জীবিত করা যায় না। যে নতুন পর্যায়ের মধ্যে আমাদের আন্দোলন প্রবেশ করেছিল পার্টি সে সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন চালায়। বিহারে অর্থাৎ একটি হিন্দিভাষী এলাকায় নিজের পুনরুত্থানের ঘটনাটি সে বিশেষ গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য করে। পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় পার্টি একপ্রস্থ নমনীয় কর্মনীতি ও কৌশল গ্রহণ করে, ধাপে ধাপে ও সতর্কতার সঙ্গে বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে খাপ খাইয়ে কাজ চালাতে থাকে এবং কয়েকটি নতুন ও সাহসী পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। যেসব গুরুতর নৈরাজ্যবাদী প্রবণতা আমাদের মধ্যে থেকে গিয়েছিল, তা ঝেড়ে ফেলার উদ্দেশ্যে পার্টি ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে নিজের শিকড়ের ওপর গুরুত্ব দেয়। সাথে সাথেই সে মূলধারার বাম ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে নতুন রূপে দুই কৌশলগত লাইনের মধ্যেকার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

সুবিধাবাদী কৌশলগত লাইনের বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য বিপ্লবী কাঠামোর মধ্যে মূল ধারার বামদের কয়েকটি জনপ্রিয় স্লোগানকে আত্মস্থ করে নেওয়ার নমনীয়তাও সে দেখিয়েছে। আমাদের পার্টি এটা করেছে সাফল্যের সঙ্গে, অর্থাৎ নিজস্ব নীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, নিজের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে এবং ঐক্য বজায় রেখে। এর ফলে অন্যান্য বাম পার্টির সঙ্গে আরও বেশি করে আন্তঃক্রিয়া চালাতে ও তাদের কর্মীবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক গড়ে তুলতে আমাদের সুবিধা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় নিজের নিজের সুবিধাবাদী নেতৃত্বের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে বাম কর্মীবাহিনী আরও বেশি করে আমাদের পক্ষে চলে আসছেন।

কলকাতা কংগ্রেসের সাথে সাথে আমাদের পার্টি এক নতুন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। মার্কসবাদী তত্ত্বের ক্ষেত্রে, ভারতের বাম ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐক্যের দিক থেকে এবং সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ – দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অভ্যন্তরে বামপন্থী কেন্দ্রকে সংহত করার জন্য তাকে আরও অনেক বড় ধরনের ভূমিকা নিতে হবে।

প্রধান প্রধান প্রশ্নে সিপিআই(এম) ও সিপিআই(এমএল)-এর অবস্থানের পর্যোলোচনা

আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন : সিপিআই(এম) শুরু করেছিল চীনপন্থী পরিচিতি দিয়ে, আর দ্রুতই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন উভয়ের থেকেই সমদূরত্বের তত্ত্ব গড়ে তুলল। রুশ-চীন মৈত্রী ভেঙ্গে যাওয়ার পর সমাজতান্ত্রিক শিবিরের কোনও অস্তিত্ব আর না থাকা সত্ত্বেও সে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের কথা বলে যেতে লাগল। ক্রুশ্চেভীয় সংশোধনবাদের বিরোধিতা সে করেছিল ঠিকই, কিন্তু শান্তিপূর্ণ বিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে পুঁজিবাদের পুনঃপ্রবর্তনের বিপদ সম্পর্কে মাও-এর তত্ত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল। সিপিআই(এম) সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহৎ শক্তিসুলভ অবস্থান এবং চেকোশ্লোভাকিয়া ও আফগানিস্তান আক্রমণের মতো সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদী ধরনের কার্যকলাপকে সমর্থন করে যেতে লাগল। এই “বিপ্লব রপ্তানি”কে সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদ বলে সমর্থন করতে লাগল আর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলল ব্রেজনেভ জমানার সঙ্গে। সেই ব্রেজনেভ জমানা, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত জমানা বলে পরিগণিত।

সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে সমস্ত সমালোচনাকে সিপিআই(এম) সাম্রাজ্যবাদী প্রচার বলে নাকচ করে দিয়েছে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সিআইএ-র চক্রান্ত ও অন্যান্য বহিরাগত বিপদের কথা বারবার বলতে থেকেছে। তত্ত্বগত স্তরে সমাজতান্ত্রিক সমাজের অভ্যন্তর থেকে পুঁজিবাদে শান্তিপূর্ণ বিবর্তন প্রসঙ্গে মাও-এর চমৎকার বিশ্লেষণ নাকচ করে দেওয়ায় তাদের কাছে হয়তো আর কোনও পথ খোলাও ছিল না। কিন্তু তাদের সমস্ত তাত্ত্বিক কসরৎ সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতন রোধ করা গেল না। আর এটা শুধুমাত্র সমাজতন্ত্রেরই পতন ছিল না। পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থানের মুখে সমগ্র সোভিয়েত সাম্রাজ্যটাই তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়ল।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে চমৎকার ভারসাম্যমূলক সমদূরত্বের তত্ত্বও মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং সিপিআই(এম) এখন চীনের আরও কাছাকাছি চলে এসেছে। আর চীনের ক্ষেত্রেও সেই একই ‘সর্বহারা সংহতি’ সে অনুসরণ করে চলেছে, যার অর্থ হল তিয়েন-আন-মেন ট্রাজেডির মতো ঘটনাকেও বাহ্যিক কারণ তথা সিআইএ-র চক্রান্তের ফল হিসাবে দেখা।

সিপিআই(এম) নেতারা আজকাল সোভিয়েত পতনের পেছনে কিছু কিছু অভ্যন্তরীণ কারণের কথা কখনও সখনও বলছেন বটে, কিন্তু তাঁরা পুঁজিবাদের পুনঃপ্রবর্তনের গতিসূত্রকে ধরতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। সোভিয়েত বৃহৎশক্তির আধিপত্যমূলক কার্যকলাপ ও শেষপর্যন্ত অনেকগুলি জাতীয় ও জাতিগোষ্ঠীগত সত্তায় তার খণ্ড বিখণ্ড হয়ে পড়া – ব্যবহারিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এ দুয়ের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কটিকেও তাঁরা ধরতে পারেননি।

মহাবিতর্কে আমাদের পার্টি ক্রুশ্চেভীয় সংশোদনবাদের বিরুদ্ধে মাও-এর অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানিয়ে এসেছে, প্রকৃত আন্তর্জাতিকতাবাদী মনোভাব নিয়ে সমাজতান্ত্রিক চীনকে সমর্থন জানিয়েছে। চীনের প্রতি আমাদের সমর্থন অত্যুৎসাহের দোষে দুষ্ট হয়ে থাকতে পারে কিন্তু তার সঙ্গে বিপ্লব আমদানি বা রপ্তানির কোনো সম্পর্ক ছিল না। কারণ মাও সবসময়ই সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠিক এই প্রশ্নেই তীব্রভাবে সমালোচনা করতেন। অনুরূপভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপের প্রতি আমাদের সমালোচনার ক্ষেত্রে সমগ্র ব্যবস্থাটিকে সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদী আখ্যা দেওয়া এবং দুটি বৃহৎ শক্তির মধ্যে সোভিয়েতকে বেশি বিপজ্জনক বলে মনে করার মধ্যে হয়তো বাড়াবাড়ি থাকতে পারে। কিন্তু পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আমাদের সমালোচনা তথা তার আধিপত্যবাদী কার্যকলাপের ব্যাপারে আমাদের বিরোধিতাই ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।

মার্কসবাদ সংক্রান্ত বুনিয়াদী বিষয়সমূহ নিয়ে চীন আজ আর কোনো বিতর্ক চালাচ্ছে না। সে কোনো সাম্রাজ্যবাদী ঘেরাও-এর সম্মুখীনও নয়। ভারতীয় শাসকশ্রেণীও আর চীনের প্রতি আগের মতো শত্রুভাবাপন্ন নেই। সে সমাজতন্ত্র গঠনের যে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে তা মনোযোগের সঙ্গে ও বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে অধ্যয়ন করা দরকার। তাছাড়া, সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পরে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রশ্নটি আরও অনেক বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছে। আজকের দিনে একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ওপরে টেক্কা দিতে হবে। এইসব কারণে আমরা বিশ্বাস করি যে, চীনকে আমাদের স্বাধীনভাবে বিচার করতে হবে সে দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকা একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসাবে। চীনা সমাজতন্ত্রকে সাধারণভাবে সমর্থন করার পাশাপাশি আমরা তার কিছু নির্দিষ্ট কর্মনীতিকে (বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রশ্নে) সমালোচনা করার অধিকার সংরক্ষিত রেখেছি। এই অর্থে আমরা নিশ্চিতভাবে এবং সঠিকভাবেই চীনের কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে এসেছি। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি যে এতে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন ধরন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে – যা হবে আরও স্পষ্ট আরও খোলামেলা।

সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ ও উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি সাধারণ সমর্থন জানানো, সাধারণভাবে সাম্রাজ্যবাদের ও বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মুক্তি আন্দোলনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা – নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাধারণ লাইন কেবল এটাই হতে পারে। ঘটনা প্রবাহ দুনিয়ার কমিউনিস্টদের মোটামুটিভাবে এই সাধারণ লাইনকে গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে।

ভারতবর্ষে জনগণতন্ত্রের দুই কৌশল

ষাটের দশকের প্রথমদিকে ভারতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক মহাবিতর্কের ঝড় ওঠে। জনপ্রিয়ভাবে এই বিতর্ক জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যেকার সংগ্রাম নামেই পরিচিত। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লাইন বাহ্যিক দিক থেকে অ-পুঁজিবাদী পথে বিকাশ সংক্রান্ত ক্রুশ্চেভীয় তত্ত্বের দ্বারা এবং অভ্যন্তরীণ দিক থেকে নেহরু অনুসৃত মিশ্র অর্থনীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর (অর্থাৎ নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের) সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, একচেটিয়া ঘরানা বিরোধী ও সামন্ততন্ত্র বিরোধী ভূমিকার ওপর নির্ভর করেছিল এই লাইন। এতে আশা পোষণ করা হয়েছিল যে ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে বিপুল সোভিয়েত সাহায্যের ফলে কালক্রমে ভারতবর্ষে সমাজতন্ত্র এসে যাবে। সিপিআই এই লাইন সরকারিভাবে গ্রহণ করে এবং এর ফলে কংগ্রেসের লেজুড়-পার্টিতে পরিণত হয়। এর বিপরীতে জনগণতন্ত্রের লাইন কংগ্রসকেই মূল শত্রু হিসাবে গণ্য করার ওপর জোর দেয়, নেহরুর মিশ্র অর্থনীতিকে পুঁজিবাদেরই নামান্তর বলে মনে করে এবং শক্তিশালী সামন্ত অবশেষই যে ভারতের বিকাশের পথে প্রধান বাধা হয়ে আছে একথা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করে। সিপিআই(এম) নেতৃত্ব জনগণতন্ত্রের পথ বেছে নেয়। কিন্তু প্রথম থেকেই তার অবস্থান ছিল অস্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, সে বলে যে স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি স্তর সমাধা হয়ে গেছে। এর একমাত্র অর্থ হতে পারে যে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিকটির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, কিন্তু সামন্ততন্ত্র বিরোধী দিকটি এখনও রয়ে গেছে। ভারতের বৈদেশিক নীতিকে প্রগতিশীল আর অভ্যন্তরীণ নীতিকে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দেওয়ার পিছনে এই সূত্রায়নই কাজ করেছে। কাজেকাজেই তারা দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের বৈদেশিক নীতিকে সমর্থন করে এসেছে এবং সেটি বিশেষ করে আরও এই কারণে যে ঐ নীতিগুলি সোভিয়েত বিদেশনীতির ধারণার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিনী পরাক্রমের মোকাবিলা করবে – দীর্ঘদিন ধরে লালিত পার্টির এই কল্পকথা যখন তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়ল কেবলমাত্র তখনই ভারতের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিদেশনীতি সম্পর্কে তার মোহগ্রস্ততাও নির্মম ধাক্কা খেল। বিদেশনীতির ক্ষেত্রে ১৯৮০-র দশক থেকেই ভারত খোলাখুলিভাবে সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। সিপিআই(এম) এই রূপান্তরের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছে। সেই দিক থেকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা যে এখনও ভারতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কর্তব্যকর্ম হয়ে রয়েছে সিপিআই(এমএল)-এর এই অবস্থান ভারতের বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে এইসব প্রকাশ্য পরিবর্তনের দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

১৯৬২ সালে চীনের বিরুদ্ধে যে জাতীয়তাবাদী জিগির উঠেছিল সিপিআই-এর মধ্যকার বিপ্লবী অংশ সেই জোয়ারে গা ভাসাতে অস্বীকার করে এবং ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময়ও বামপন্থী কমিউনিস্টরা উভয় দেশের শাসকশ্রেণীর নিন্দা করে। কিন্তু ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় থেকে সিপিআই(এম) প্রতিবেশী দেশগুলির, বিশেষত পাকিস্তানের প্রতি ভারতীয় শাসকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গির কট্টর সমর্থকে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের বৃহত্তম দেশ হওয়ার দরুণ ভারত যে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী উচ্চাকাঙ্খা পোষণ করে একথা মানতে সে অস্বীকার করে। নিজ দেশের শাসকশ্রেণীর উগ্র জাতীয়তাবাদকে সমর্থন জানানো সর্বদা ও সর্বত্র সংশোধনবাদের সবচেয়ে বড় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে রয়েছে। কাজেই ভারতীয় শাসকশ্রেণীর আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের দৃঢ় ও ধারাবাহিক বিরোধিতা অবশ্যই ভারতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হবে এবং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে পার্টি উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতি অনুসরণ করে সে কখনই গণতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারে না।

সিপিআই(এমএল) প্রথম থেকেই ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশগুলির ওপর ভারতীয় আধিপত্য কায়েম করার সমস্ত অভিব্যক্তির বিরোধিতা করে এসেছে। এটিকে আমরা সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদ যাচাই করার কষ্টিপাথর বলে মনে করি এবং এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কিউবা, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা প্যালেস্তাইনকে সমর্থন জানানোর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী সম্পর্কে সিপিআই(এম)-এর সূত্রায়ন ছিল, ঐ শ্রেণী সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে ক্রমশই আপোশপন্থী লাইন গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে যে ধারণা অন্তর্নিহিত ছিল তা হল, ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে দোদুল্যমানতা ও আপোশের কিছু দিক থাকলেও, তারা মূলত স্বাধীন বুর্জোয়া শ্রেণী। সিপিআই-এর মতো সিপিআই(এম)-ও এই মোহ পোষণ করতে শুরু করে যে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বৃহৎ বুর্জোয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে এক ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তির ভূমিকা পালন করছে। ব্যাঙ্ক জাতীয়কণের মতো ইন্দিরা গান্ধীর জাতীয়করণের পদক্ষেপগুলিকে বৃহৎ বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ধরে নিয়ে সে সেগুলিকে সমর্থন করতে শুরু করে।

এইসব অবস্থানের ফলে বিভিন্ন জটিল সন্ধিক্ষণও কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক সহযোগিতা গড়ে ওঠে, যেমন সিণ্ডিকেটের বিরুদ্ধে ইন্দিরা কংগ্রেসের পক্ষ নেওয়া, গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করা এবং সম্প্রতি কংগ্রেস(ই)-কে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্ট গড়ার ওকালতি করা। বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফের নির্দেশেই ভারত সরকারের নতুন অর্থনৈতিক নীতি অনুসৃত হওয়ায় ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর মৌলিক চরিত্রায়ন সম্পর্কে সিপিআই(এম)-এর মধ্যে আবার প্রশ্ন ওঠে, ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীকে মুৎসুদ্দি হিসাবে অভিহিত করার একটি প্রস্তাবও বিগত কংগ্রেসে ওঠে, কিন্তু নেতৃত্ব ঐ প্রস্তাব নাকচ করে দেন।

যে সূত্রায়নকে কেন্দ্র করে এই পার্টির সমগ্র সুবিধাবাদ ঘুরপাক খাচ্ছে তা হল, “শক্তিসমূহের সামাজিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য শাসকশ্রেণীগুলির মধ্যকার ও পারস্পরিক দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে নেওয়া”। এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগানোর সুযোগকে এত বেশি অতিরঞ্জিত করে দেখা হয়েছে যে পার্টি এর ওপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। এর ফলে পার্টি বুর্জোয়া রাজনীতির পঙ্কিল আবর্ত ও রাজনৈতিক ধড়িবাজির গভীরে নিমজ্জিত হয়েছে। তার গুরুত্বপূর্ণ পার্টি নেতারা বুর্জোয়া রাজনীতিকদের ওপরতলার লোকজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাতে ও তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করতেই ব্যস্ত থাকেন।

কৌশলের ক্ষেত্রে, ডিএমকে, তেলেগু দেশম, জনতা দল, আকালি দল প্রভৃতি আঞ্চলিক ও মধ্যপন্থী দলের মতো বিরোধী দলগুলির সঙ্গে আঁতাত গড়ে তোলার ওপরই সিপিআই(এম) সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। এই ধরনের আঁতাতের বিনিময়ে ঐ সমস্ত দলের মূল সামাজিক ভিত্তি কুলাক শ্রেণীর বিরুদ্ধে কৃষি-শ্রমিক ও দরিদ্র কৃষকদের সংগ্রামকে সে জলাঞ্জলি দিয়েছে। কাজেই, সামন্তবিরোধী সংগ্রাম অথবা গ্রামাঞ্চলে বিকাশমান নতুন শ্রেণীসংগ্রামগুলির সম্মুখ সারিতে তাদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এইভাবে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল ভিত্তিকেই খাটো করে দেখা হয়েছে। পার্টির গণতান্ত্রিক কর্মসূচির সমগ্র অভিঘাত পর্যবসিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রীবাদ, রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা, পঞ্চায়েতের হাতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি সাধারণ গণতান্ত্রিক শব্দগুচ্ছে।

অন্যদিকে সিপিআই(এমএল) নয়াগণতন্ত্র সম্পর্কে মাওয়ের দিকনির্দেশের ওপর ভিত্তি করে জনগণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। সে ভারতবর্ষকে আধা-উপনিবেশ হিসাবে অভিহিত করেছে, যার অর্থ হল, ভারতীয় রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও, ভারতীয় রাষ্ট্রের নীতিসমূহকে প্রভাবিত ও পরিচালিত করার মতো যথেষ্ট প্রতিপত্তি তার এখনও আছে। আর এটি সে করে থাকে ভারতীয় বুর্জোয়াদের মাধ্যমেই, যে বুর্জোয়ারা চরিত্রগত দিক থেকে মূলত নির্ভরশীল। তাদের সমস্ত আপেক্ষিক স্বাধীনতা অর্থাৎ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে দরকষাকষি করার ক্ষমতা নির্ভরশীলতার এই সামগ্রিক কাঠামোরই অধীন। এই কারণে সিপিআই(এমএল) একেবারে শুরু থেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর পক্ষে বড় ধরনের কোনো গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটানো আর সম্ভব নয় এবং সর্বহারাকেই নেতৃত্ব হাতে তুলে নেওয়া উচিত। বৈদেশিক সম্পর্ক তথা অভ্যন্তরীণ নীতি – এই উভয় ক্ষেত্রেই ভারতীয় শাসকদের কপটতার মুখোশ খুলে ধরার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা আমরা চালিয়েছি। এর ফলে আমাদের পার্টি ভারতীয় শাসকশ্রেণীগুলির সঙ্গে পার্থক্যের সীমারেখা সুস্পষ্টভাবে বজায় রাখতে ও অবিচল গণতন্ত্রের প্রধান প্রবক্তা হিসাবে সামনে ওঠে আসতে সমর্থ হয়েছে।

সিপিআই(এমএল) সবসময়েই গ্রামাঞ্চলে সামন্ত-বিরোধী সংগ্রাম তথা সবুজ বিপ্লব পরবর্তী পর্যায়ে কুলাকদের বিরুদ্ধে কৃষিমজুর ও দরিদ্র কৃষকদের শ্রেণীসংগ্রামের ওপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে এসেছে।

নাগরিক স্বাধীনতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রবাদ পর্যন্ত গণতন্ত্রের সমস্ত ইস্যুগুলিকেই সিপিআই(এমএল) ধরেছে এবং সম্ভাব্য ব্যাপকতম গণতান্ত্রিক জোট গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়েছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে সে সর্বদা তার শ্রেণী-স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক উদ্যোগ বজায় রাখার ওপরই জোর দিয়েছে।

সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে বর্তমান বিতর্কে আমরা লেজুড়বৃত্তির বিরুদ্ধে যে তীব্র সমালোচনা রেখেছি এবং যে ধারাবাহিক জোর দিয়েছি তা কিছু বিমূর্ত নীতিমালা বা নিছক কিছু কৌশলগত পদক্ষেপের প্রশ্ন নয়। এগুলি জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রস্তুতির জন্য মৌলিক উপাদান। এই বিষয়টি বুঝতে না পারলে ভারতবর্ষে জনগণতন্ত্রের দুই কৌশলের মধ্যেকার সংগ্রামকে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

সংসদ-সর্বস্বতা বনাম সংসদীয় সংগ্রাম

বুর্জোয়া সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে মার্কসবাদী ও সংশোধনবাদীদের মধ্যে বিতর্ক অনেক দিনের। বহুকাল আগে লেনিন যখন বার্নস্টাইন ও মেনশেভিকদের যুক্তি কার্যকরীভাবে ধুলিসাৎ করেন, তখন মনে হয়েছিল এই বিতর্কের মীমাংসা হয়ে গেছে। বাস্তবেও দেখা গেল, পশ্চিম ইউরোপে সংশোধনবাদীরা সমাজগণতন্ত্রীতে অধঃপতিত হলেন, পরিণত হলেন বুর্জোয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার লেজুড়ে। বিপরীতে, রাশিয়া ও চীনে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বিপ্লব সাফল্য লাভ করল। ষাটের দশকের গোড়ায় ক্রুশ্চেভ ঐ বিতর্ক আবার চাগিয়ে তুললেন এই অজুহাতে যে একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবিরের উদ্ভবের ফলে শক্তির ভারসাম্যে যে আমূল পরিবর্তন এসেছে তা এক ‘নতুন পরিস্থিতির’ জন্ম দিয়েছে। এই যুক্তি দেখানো হয়েছিল, শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতায় সাম্রাজ্যবাদকে পরাস্ত করতে আজ সমাজতন্ত্র যথেষ্ট সমর্থ এবং তাই সংসদীয় উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতায় উত্তরণের নতুন সুযোগ আজ কমিউনিস্টদের সামনে উপস্থিত। আণবিক যুদ্ধের বিপদকেও ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা’ ও ‘শান্তিপূর্ণ উত্তরণের’ সপক্ষে যুক্তি হিসাবে খাড়া করা হয়।

ভারতবর্ষে সিপিআই সোৎসাহে এই চিন্তাধারায় সামিল হয়ে যায় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে এমন এক লাইন গ্রহণ করে যাতে সমস্ত জোর থাকে আরও বেশি বেশি সংসদীয় আসন জয় করা এবং এইভাবে গরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতালাভের ওপর। এই লাইন সংসদীয় পথ নামে পরিচিত। সংসদীয় গরিষ্ঠতা সিপিআই-এর কাছে আজও মরীচিকা। ইতিমধ্যে ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা’র দূর্গটাই ধুলিসাৎ হয়ে গেছে আর সিপিআই কার্যত একটি সমাজগণতান্ত্রিক পার্টিতে পর্যবসিত হয়েছে।

বিশ্বের মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা ক্রুশ্চেভের হাজির করা সংসদীয় পথকে প্রত্যাখ্যান করেন। ভারতবর্ষে সিপিআই ভেঙ্গে সিপিআই(এম)-এর জন্মের পিছনেও এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে থেকেছে। সিপিআই(এম) সংসদীয় ও সংসদ-বহির্ভূত সংগ্রামের সমন্বয়ের পক্ষে রায় দেয়। সংসদীয় গরিষ্ঠতার বলে ক্ষমতা অর্জনের সম্ভাবনাকে সে নাকচ করে। নির্বাচনের মাধ্যমে কয়েকটি রাজ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের বিষয়টিকে একটি সম্ভাব্য পন্থা হিসাবে গণ্য করা হয়। শর্ত রাখা হয় যে পার্টি সেই সমস্ত রাজ্যেই সরকারে অংশগ্রহণ করবে যেখানে তারা নেতৃত্বকারী শক্তি, নিদেনপক্ষে সরকারের কাজের ধারাকে প্রভাবিত করার সামর্থ রাখে। এখানে সরকারি ক্ষমতাকে রাষ্ট্রক্ষমতার থেকে পৃথক করে দেখা হয়েছিল এবং বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে সরকারি ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করাকেই পার্টির সুনির্দিষ্ট কাজ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে এভাবে জনগণের রাজনৈতিক চেতনার মান উন্নত করা যাবে, তাঁদের প্রস্তুত করা যাবে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ হানতে। একমাত্র এই নির্দিষ্ট অর্থেই বামফ্রন্ট সরকারকে শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে দেখা হয়েছিল।

১৯৫৭ সালে কেরালায় কমিউনিস্ট সরকারের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিয়েছে যে কেন্দ্র ঐ ধরনের কোনো সরকারকে কাজ করতে দেবে না এবং তা সংসদীয় ব্যবস্থার কপটতাকে উন্মোচিত করার আরও একটি সুযোগ এনে দেবে ও এইভাবে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করবে।

পার্টি কর্মীরা এইভাবেই সংসদীয় সংগ্রামের প্রশ্নে সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর মধ্যেকার পার্থক্য বুঝেছিলেন।

এক শক্তিশালী গণআন্দোলনের ওপর ভর করে ও বিপ্লবী কথাবার্তা বলে ১৯৬৭ সালে সিপিআই(এম) পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় আসে। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট স্থায়ী হয়নি। ১৯৬৯-এর সাফল্যও ছিল স্বল্পমেয়াদী এবং ১৯৭৭ পর্যন্ত রাজ্যে এক শ্বেত সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। ১৯৭৭ সালে বর্তমান বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে জাতীয় রাজনীতিতে এক অভিনব ঘটনাপরম্পরার ফলশ্রুতিতে। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে রাজ্যে তখন গণআন্দোলন স্তিমিত আর সিপিআই(এম)-এর পার্টি সংগঠনও স্থানু হয়ে গেছে। তারপর থেকে গত ষোল বছরে কেন্দ্রে শাসক কংগ্রেস(ই) সংসদীয় খেলার নিয়ম মেনেই চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকার বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিশেষ চেষ্টা করেনি। ‘বামফ্রন্ট সরকার সংগ্রামের হাতিয়ার’ ইত্যাদি স্লোগান বা কেন্দ্রের বিরোধিতার যাবতীয় বুলি পার্টির শব্দভাণ্ডার থেকে নিঃশব্দে অন্তর্হিত হয়েছে। বুর্জোয়া সংসদের কপটতাকে উন্মোচিত করার পরিবর্তে এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ‘জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের’ মহিমাকীর্তন ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে এতদিন ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকার অনুপম দৃষ্টান্তকে তুলে ধরার ওপর। বিধানসভা ও সংসদে আসনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য এই পার্টি বিভিন্ন বুর্জোয়া দলবলের সঙ্গে যেভাবে ঢলাঢলি করছে, এমনকি জাতীয় মোর্চা-বামমোর্চা সমন্বয়ের মাধ্যমে কেন্দ্রে ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার কথা বিবেচনা করছে, তাতে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে এই পার্টির শিকড় আজ সংসদীয় পথের গভীরে গেঁড়ে বসেছে।

সিপিআই(এম)-এর মধ্যে সংসদ-সর্বস্বতার প্রথম লক্ষণগুলি ফুটে ওঠার সাথে সাথে নকশালবাড়িতে বিপ্লবী কমিউনিস্টরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। কিছুদিনের মধ্যে সিপিআই(এমএল)-এর গঠন হয় এবং তা সংসদীয় পথ বর্জন করে। সংসদীয় সংগ্রামকে সর্বাংশে বর্জন করার প্রশ্নে বিতর্ক অবশ্য সিপিআই(এমএল)-এর মধ্যে কোনো দিন থেমে থাকেনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মহলেও এটি একটি বিতর্কিত বিষয় হিসাবেই থেকেছে। সিপিআই(এমএল) সংসদীয় পথ, অর্থাৎ বুর্জোয়া সংসদে গরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের লাইনকে সবসময়েই প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। কিন্তু সংসদীয় সংগ্রামকে কাজে লাগানোর প্রশ্নে সে ক্রমে ক্রমে এক সর্বাঙ্গীণ ও নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটিয়েছে। সংসদ-বহির্ভূত সংগ্রামের সাথে সংসদীয় সংগ্রামকে সমন্বয়ের – যার মধ্যে সংসদ-বহির্ভূত সংগ্রামেরই থাকবে মুখ্য ভূমিকা – মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পরিপ্রেক্ষিতের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে সিপিআই(এমএল)-এর এই দৃষ্টিভঙ্গি। একইসাথে, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কৌশল হিসাবে পার্টি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পরিস্থিতিতে নির্বাচন বয়কটের বিষয়টি বাতিলও করে না, আবার পিছু হটার সময়ে নির্বাচনের বিশেষ ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার সম্ভাবনাও অস্বীকার করে না। আরও বিশেষ করে, ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে যখন কিছু কিছু রাজ্যে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে সরকার গঠনের বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে, তখন এই সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা তথা প্রকৃত অর্থেই শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করবে বাম সরকারের এমন এক বিকল্প মডেল হাজির করা পার্টির কাছে অত্যন্ত জরুরি।

চীনের পথ বনাম রাশিয়ার পথের বিতর্কে আমাদের পার্টি চীনের পথ বেছে নিয়েছিল, যার অর্থ শক্তিশালী লাল ফৌজ তৈরি করে গ্রামাঞ্চলে লাল রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা, এইভাবে শহরগুলিকে ঘিরে ফেলে সেগুলিকে মুক্ত করা। এই পথে যাত্রা শুরু করার সময়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে বিপ্লবের সমগ্র পর্যায় জুড়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো প্রশ্নই নেই এবং এইভাবে নির্বাচন বয়কটকে একটি রণনীতিগত তাৎপর্যে মণ্ডিত করা হয়।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চীনের পথ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পর পার্টি তার অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ভারতের পরিস্থিতিতে চীনের ঐতিহাসিক মডেলকে অন্ধভাবে অনুকরণ করা ভুল। মুল বিষয় হল, ভারতের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও-এর চিন্তাধারাকে একাত্ম করা। চীনে যেহেতু সংসদই ছিল না, সংসদীয় সংগ্রামের প্রশ্নই সেখানে ওঠেনি। ভারতের পরিস্থিতি অন্যরকম। কাজেই গোড়ার দিকে অগ্রগতির পর্যায়ে, বিশেষ করে নতুন এক বিপ্লবী দিশায় যাত্রারম্ভের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে, নির্বাচন বয়কট সঠিক থাকলেও, ভারতীয় কমিউনিস্টরা সংসদীয় সংগ্রামকে চিরদিনের জন্য বর্জন করতে পারেন না এবং তা করা উচিতও নয়। এইভাবে নির্বাচন বয়কটকে কৌশলগত প্রশ্নে পরিণত করা হল। পার্টি আজও গ্রামাঞ্চলের ওপর ও কৃষক জনতার জঙ্গী প্রতিরোধ সংগ্রামের বিকাশের ওপর জোর দেয়। কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জনগণের সশস্ত্র শক্তির সাহায্যে ঐ বিস্তীর্ণ অঞ্চল সমান্তরাল শক্তির কেন্দ্র হিসাবে বিকাশলাভ করে জাতীয় স্তরে শক্তির ভারসাম্যে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

পার্টি দৃঢ়ভাবে সংসদীয় পথকে প্রত্যাখ্যান করে চলেছে আর সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পঞ্চম কংগ্রেসে পার্টি পুনরায় ঘোষণা করেছে যে চূড়ান্ত বিচারে একমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামই ভারতীয় বিপ্লবের ফলাফল নির্ধারণ করবে। এই বুনিয়াদী পরিপ্রেক্ষিতের ওপর ভিত্তি করেই পার্টি বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায়ে সংসদীয় ও সংসদ-বহির্ভূত সংগ্রামের সমন্বয়ের বিভিন্ন রূপ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিবে যাবে। আর এইভাবেই নির্ধারিত হবে বিপ্লবের ভারতীয় পথ।

(ডিসেম্বর ১৯৮২, তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে তীব্র বিতর্ক চলেছে তা হল কমরেড চারু মজুমদার কর্তৃক সূত্রায়িত ‘খতম’-এর প্রশ্ন। অনেকে তর্ক তোলেন যে এর মধ্যে নাকি কোনো মার্কসবাদই নেই, এটা স্রেফ স্থূল ব্যক্তিগত সন্ত্রাসবাদ, এতে কেবল ক্ষতিই হয়েছে, ইত্যাদি। সশস্ত্র সংগ্রাম ও গণসংগ্রামকে অবশ্যই মেলাতে হবে, আর তাই ‘খতম লাইন’কে নিন্দা না করলে চলে না – এমন কথাও শোনা যায়।

সশস্ত্র সংগ্রাম ও গণসংগ্রামকে মেলানোর প্রশ্নটি প্রথমে ধরা যাক। সাধারণভাবে এই কথাটি এক সর্বরোগহর দাওয়াই হিসেবে বারবার আউড়ে গেলে মার্কসবাদী বাস্তব কর্মীর জন্য তা কোনোই তাৎপর্য বহন করে না। ইতিহাসের তথ্য এ কথাই বলে যে অগ্রগতির পথে সমস্ত গণআন্দোলন নতুন নতুন রূপ গ্রহণ করে; লাগাতার চলতে থাকে পুরাতনকে বর্জন করে নতুনের সৃষ্টি আর ঘটতে থাকে নতুন ও পুরোনো রূপের রূপান্তর বা নতুন নতুন বিন্যাস। কমিউনিস্ট হিসাবে আমাদের কর্তব্য হল উপযুক্ত সংগ্রামের রূপ গড়ে তোলার এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া। লেনিন বলেছেন, বলপ্রয়োগ ও সন্ত্রাসের প্রয়োজনকে নীতিগতভাবে বিন্দুমাত্র অস্বীকার না করেও আমাদের এমন সব সংগ্রামের রূপের বিকাশ ঘটাতে হবে যাতে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ঘটতে পারে এবং এই অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা হয়েছে।

বীরত্বপূর্ণ নকশালবাড়ি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নয়া-সংশোধনবাদের শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পর এবং প্রায় দুবছর ধরে গণআন্দোলন গড়ে তোলার বিপ্লবী অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করার পর ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা এমনই এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন। সংগ্রামের এক নতুন রূপের জন্য তাঁরা ব্যগ্র হয়ে উঠলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই শ্রীকাকুলাম সংগ্রামের উত্তাপের মধ্যে সূত্রায়িত হল গণসমর্থনের উপর ভিত্তিশীল ‘খতম’ – যার উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা আর জনগণকে ধাপে ধাপে সংগ্রামে সামিল করা – এই দুটি দিককে মেলানো। চারু মজুমদারের লাইনের এই মূল দিশা – গণসংগ্রামের সঙ্গে সশস্ত্র কার্যকলাপকে মেলানো (এক এক সময় এক একটি দিক প্রধান হতে পারে) – এটাই নকশালবাড়ির আগে থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক লাইনে বিধৃত আছে। তাঁর প্রচেষ্টার সাফল্য ও ব্যর্থতাগুলির মূল্যায়ন করা এক জিনিস, প্রকৃত অগ্রগতির পক্ষে একান্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে; কিন্তু তাকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেওয়া হবে চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা ও হীনতার পরিচয়। গণসমর্থনের সামগ্রিক পটভূমিকায় এবং গণআন্দোলনগুলির সঙ্গে মেলানোর দিশায় সংগ্রামের এই বিশেষ রূপের লক্ষ্য ছিল এলাকাভিত্তিক ক্ষমতা দখল। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলি কৃষক স্কোয়াড ও গণঅভ্যুত্থান গড়ে উঠেছিল। বিপ্লবী কমিটির মাধ্যমে ও কৃষি সংস্কারের কয়েকটি কর্মসূচি নিয়ে এই গণঅভ্যুত্থানকে সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চলে এবং পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনী  তথা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা এ্যাকশন চালিয়ে গণমুক্তি ফৌজের ইউনিট হিসাবে এই স্কোয়াডগুলিকে সংগঠিত করার চেষ্টা হয়, যাতে লাল ক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। সংক্ষেপে, এই হল ‘খতম লাইন’-এর গোটা প্রক্রিয়া ও ফলাফল। এর সাফল্যের পাল্লায় বহু কিছুই আছে – আর আজ পর্যন্ত ভোজপুরের টিকে থাকা এ সাক্ষ্যই দেয়। তবে এর নেতিবাচক দিকও ছিল, আর ক্রমে ক্রমে সেটাই প্রধান দিক হয়ে দাঁড়ায়। বহু এলাকায় ক্ষতমকে এক অভিযান হিসাবে চালিয়ে বহু নির্বিচার ও অপ্রয়োজনীয় হত্যা করা হল। কৃষকদের শ্রেণীসংগ্রাম থেকে খতম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। পুলিশী দমনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলা গেল না এবং আমাদের সংগ্রামী এলাকাগুলি ধ্বংস হয়ে গেল। যে সব জায়গায় পার্টি তার নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলল, গণআন্দোলন ও প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলা যায়নি সেখানেই এটা ঘটল। খতমের অত্যুৎসাহী সমর্থকরা – অসীম থেকে শুরু করে দীপক এবং শেষে মহাদেব পর্যন্ত – এই ভুলগুলিকে চরমে নিয়ে গেল। ধাপে ধাপে তারা এক বাম সুবিধাবাদী লাইন গড়ে তুলল, যা জনগণ ও বিপ্লবের বিপুল ক্ষতি ডেকে আনল।

দুনিয়া জুড়ে এক আশু ও সর্বব্যাপী বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজ করছে – এইভাবেই তখনকার সময়কে চিহ্নিত করে এক সার্বিক বিপ্লবী আক্রমণের পরিকল্পনা করা হল। বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে এই অতিরিক্ত মূল্যায়ন তাড়াহুড়োর জন্ম দিল, বিষয়ীগত শক্তির অবস্থাও বিবেচনা করা হল না, আর এইভাবে ভুলগুলি আরও বেড়ে গেল। এটা ঠিকই যে তখন শাসকশ্রেণীগুলি গভীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে ভুগছিল, বিপ্লবী পরিস্থিতিও ছিল আমাদেরই অনুকূলে। তাই যেখানেই সম্ভব সেখানেই কৃষকদের সশস্ত্র সংগ্রামে জাগিয়ে তোলা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালানো সর্বহারার অবশ্য কর্তব্য ছিল। তবে ভারতীয় বিপ্লবের অসম বিকাশের বিষয়কে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়নি। ফলে, সাধারণ কর্মসূচি ও মূল রণকৌশলগত লাইন সঠিক হওয়া সত্ত্বেও, বিপ্লবী পরিস্থিতিকে বাড়িয়ে দেখা এবং ভারতীয় বিপ্লবের অসম বিকাশকে হিসাবে না নেওয়ার দরুণ যা ঘটল তা হচ্ছে – সংগ্রামের যে রূপ ও অগ্রগতির যে পথ কোনো কোনো এলাকার পক্ষে উপযুক্ত তাকে দেশের সর্বত্রই (শুধু তাই নয়, অভিযান হিসাবে) প্রযোজ্য বলে ধরে নেওয়া হল। নিঃসন্দেহে এগুলি ছিল গুরুতর বাম বিচ্যুতি। আর বিকাশের বস্তুগত নিয়ম আমাদের উচিত শিক্ষাও দিল – গণঅভ্যুত্থানের অঞ্চলগুলি মাত্র কয়েকটি জায়গায় সীমাবদ্ধ হয়ে গেল ও একটি মাত্র এলাকায় অব্যাহত রইল।

এই পটভূমিকায় বলা যায়, আমাদের প্রথম পার্টি কংগ্রেসের ঘোষণা – ‘শ্রেণীসংগ্রাম, অর্থাৎ খতমই আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করবে’ – অবশ্যই ভুল ছিল। তবে কোনো কোনো এলাকায় গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত খতম, সেই অভ্যুত্থানকে বিপ্লবী কমিটির মাধ্যমে ও কৃষি সংস্কারের স্লোগান দিয়ে সংগঠিত করার প্রাথমিক প্রচেষ্টাগুলি এবং গেরিলা স্কোয়াডগুলি থেকে লালফৌজ গড়ে তোলার বিভিন্ন প্রচেষ্টা বিপ্লবী অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে গৌরবময় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আর এই ভিত্তিতেই অনতিসচেতন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের শুরু করা ও পরবর্তীকালে পার্টি নেতৃত্ব কর্তৃক সংগঠিত ভোজপুরের কৃষক সংগ্রাম গড়ে উঠেছে, কঠিনতম পরিস্থিতিতে ব্যাপকতম আত্মত্যাগের বিনিময়ে টিকে থেকেছে এবং বর্তমানে বৃহত্তর এলাকায় বিতিত্রতম রূপে ছড়িয়ে পড়ছে। আর এই মহান ঐতিহ্যের জন্যই চারু মজুমদার লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত ভারতবাসীর মনে অমর হয়ে আছেন – তাঁর লাইনই ভারতবর্ষের একমাত্র বিপ্লবী লাইনের প্রতীক হয়ে আছে। এর বিপরীতে, অনেক কেতাবী মার্কসবাদী ও সুবিধাবাদী নেতা ‘সশস্ত্র সংগ্রাম ও গণসংগ্রামকে মেলানো’র বুলি আউড়েছেন, কিন্তু কোনোদিনই ব্যাপক জনগণের কাছে পৌঁছতে পারেননি বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেননি – সশস্ত্র সংগ্রাম বা তথাকথিত ‘মেলানো’ তো দূরের কথা। দুনিয়ায় সবকিছুই করা আর সবকিছুই মেলানোর যে পণ্ডিতি মনোভাব কোনো কোনো স্বঘোষিত মার্কসবাদী দেখিয়ে থাকেন তাতে কোনো সমাধন নয়, কেবল সমাধানের প্রহসনই মেলে। এটা হল বাস্তব অভিজ্ঞতাবর্জিত বিশুদ্ধ পুঁথিসর্বস্ব মনোভাব। বিপ্লবী লাইনের পূর্ণাঙ্গ রূপ গ্রহণ একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কেবল সম্ভব ছিল; সংগ্রামের পুরোনো রূপগুলিকে বর্জনের মধ্য দিয়ে শুরু করে একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই পার্টির পক্ষে নতুন ও পুরোনো রূপগুলির এক নতুন সমন্বয়ে পৌঁছানো সম্ভব ছিল।

শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের প্রশ্নে চারু মজুমদার সঠিকভাবেই সংগ্রামের পুরোনো রূপগুলি বর্জন না করেও নতুন নতুন রূপের বিকাশ ঘটানোর এবং ট্রেড ইউনিয়ন লড়াই নাকচ না করে রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

ছাত্র-যুব আন্দোলনের ক্ষেত্রে, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে তিনিই সর্বপ্রথম শ্রমিক-কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রশ্ন নিয়ে আসেন। আর এজন্য দরকার ছিল ছাত্র-যুবদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগত সংগ্রামের গণ্ডি থেকে বের করে আনা। ছাত্র-যুবকেরা তাঁর আবেদনে প্রচণ্ড উৎসাহের সাথে সাড়া দিয়েছিলেন, আর তিনিও পুরোনো মূল্যবোধ, পুরোনো শিক্ষা-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। সমসাময়িক চীনা যুবকদের লালরক্ষী আন্দোলন ও ফ্রান্সের ‘নয়া বাম’ আন্দোলনের সঙ্গে এ দেশের যুব-ছাত্রদের আন্দোলনের ফারাক কোথায় এবং শেষোক্ত আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাগুলি কী কী তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন ও এই আন্দোলনের ভিত্তি কৃষক সংগ্রামের সঙ্গে তাদের একাত্ম হতে বলেছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি ভারতবর্ষের ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস আরও গভীরভাবে অধ্যয়ন করার জন্য বুদ্ধিজীবীদের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন – যে কাজ বহু সংখ্যক প্রগতিশীল ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী কাঁধে তুলে নিয়েছেন ও এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

আমাদের ভুলগুলির জন্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সেই সময়কার মূল্যায়নকে দায়ী করা অথবা কোনো ভুলই হবে না – এই আশায় তথাকথিত ‘মেলানো’র পণ্ডিতি মনোভাব গ্রহণ করা এক অসুস্থ চিন্তারই প্রকাশ। যে কোনো বিপ্লবী অভ্যুত্থানই দক্ষিণ ও বাম বিচ্যুতিগুলির জন্ম দিতে বাধ্য; “অতীতের গণ্ডি ভাঙতে না পারার দরুণ দক্ষিণ বিচ্যুতি” ও “বর্তমানের সঠিক মূল্যায়নের অভাবে বাম বিচ্যুতি”। আমাদের সমস্ত ভুলের জন্য কেবল আমরাই দায়ী, আর যে কোনো বিপ্লবী অভ্যুত্থানে ভুলত্রুটি অনিবার্য। এসব ভুলের মধ্যে দিয়েই কমিউনিস্টরা শিখতে পারেন, নেতা এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণও হয় এভাবেই – এছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই।

খতম-যুদ্ধের সামরিক রূপ বা সামরিক লাইনের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক লাইনের সেবা করা আর সমগ্র বিপ্লবী প্রক্রিয়ার লক্ষ্যই ছিল বিপ্লবী গণলাইনের বিকাশ ঘটানো।  ‘নিজেদের গ্রামগুলি মুক্ত করার জন্য কৃষকদের সামিল করাতে হবে, তাঁদের বলতে হবে – জমিদাররা নয়, আপনারাই হবেন গ্রামের সমস্ত ব্যাপার ঠিক করার একমাত্র কর্তৃত্ব, সমস্ত জমি, সব পুকুর হবে আপনাদের, জমিদাররা খতম হওয়ার পর পুলিশ জানতে পারবে না যে কার জমি কে চাষ করছে ইত্যাদি’ – কৃষকের কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতার এই প্রচার যা তাঁদের মানসিক গঠন অনুসারে ও এমন সহজবোধ্য ভাষায় নিয়ে যাওয়া হত যে তাঁরা বিপ্লবী উদ্দীপনায় জেগে উঠতেন – এটা ছিল কমরেড চারু মজুমদারের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এই প্রচার ছিল সংশোধনবাদী প্রচারের সম্পূর্ণ বিপরীত। কাপুরুষ হিসাবে জনগণের ভূমিকাকে নাকচ করে দিয়ে কয়েকজন অগ্রণীকে ‘ব্যক্তিবীর’ হিসাবে গ্রহণ করার ভিত্তিতে নয়, বরং জনগণের মধ্যে যে প্রচণ্ড সৃজনীশক্তি লুকিয়ে আছে তার ওপর গভীর আস্থার ভিত্তিতেই চারু মজুমদার খতমকে সূত্রবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর রচনাগুলি আগাগোড়া  এই ভাবমানসেই উদ্দীপ্ত হয়ে আছে আর তাই গোটা পার্টি জনগণের পরিপূর্ণ আস্থার ওপরেই দাঁড়িয়েছিল। এই আস্থার কণামাত্রও তাঁর বিরোধীদের মধ্যে দেখা যায় না, যারা জনগণ সম্পর্কে অবিশ্বাস থেকে কোনো না কোনো বুর্জোয়া পার্টির সঙ্গে ফ্রন্ট গড়ার ওকালতি করেন।

দেশের রাজনৈতিক জীবনে ভূমিহীন ও গরিব কৃষকদের সামনে নিয়ে আসা – সমস্ত বুর্জোয়া তাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদ এই ব্যাপারটি মেনে নেন, যখন তারা বলেন যে দরিদ্র গ্রামবাসীদের অসন্তোষ থেকেই নকশালবাদের জন্ম – এবং কংগ্রেস সরকারের ভূমি সংস্কার পদক্ষেপগুলিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে কৃষি বিপ্লবকে আশু কর্তব্য হিসাবে তুলে ধরা, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের ও ভারতীয় সর্বহারার চিন্তার স্তরকে সংশোধনবাদী রাজনীতির টুকিটাকি থেকে মাতৃভূমির মুক্তির স্বপ্নে নিয়ে যাওয়া এবং আন্তর্জাতিক সর্বহারা ও নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে হাজারে হাজারে তরুণ শক্তি নিয়ে আসা এবং যে নকশালবাদ নকশালবাড়ির মাটিতে জন্ম নিলেও যা কেবল পরবর্তীকালেই নির্দিষ্ট ও বিকশিত রূপ নিয়েছিল (কানু সান্যাল ঠিক এই ব্যাপারটিকে বোঝেন না আর সেই কারণেই নিজের ব্যর্থতার মূল কারণও ধরতে পারেন না) এবং যা ভস্মস্তূপ থেকেও এবং তাঁকে ছাড়াই বারবার উঠে দাঁড়ায় তাকে এক দেশব্যাপী রাজনৈতিক ধারা হিসাবে গড়ে তোলা আর সর্বোপরি, ভারতীয় সর্বহারার বিপ্লবী পার্টি সিপিআই(এমএল)-কে গড়ে তোলা – এগুলিই ছিল তাঁর প্রধান প্রধান অবদান তথা তাঁর বিপ্লবী লাইনের মূল বিষয়বস্তু।

যাই হোক, বিপ্লবী পরিস্থিতিকে বাড়িয়ে দেখা, ভারতবর্ষের বস্তুগত পরিস্থিতি সম্পর্কে অসম্পূর্ণ উপলব্ধি ও খতমের সংগ্রামের সাধারণীকরণ এবং সেই সঙ্গে পার্টিতে ভাঙ্গনগুলি ও অসংগঠিত অবস্থা, বাংলাদেশের ঘটনা ও রুশ-ভারত সামরিক চুক্তির মধ্য দিয়ে শাসকশ্রেণীগুলির সাময়িক স্থিতিশীলতা অর্জন – প্রভৃতি কারণে শত্রুর প্রচণ্ড দমনের মুখে আমরা গুরুতর ধাক্কার কবলে পড়লাম।

খতম নিয়ে যে বাড়াবাড়ি চলেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে তাকে গণসংগ্রামের সঙ্গে মেলানো যায়নি – চারু মজুমদার একথা উপলদ্ধি করেন এবং ধাক্কা ও পার্টির অসংগঠিত অবস্থা যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল তার মূল্যায়ন করেন। তিনি তাই রাজনীতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ পার্টি ও শ্রমজীবী মানুষের, বিশেষত বাম পার্টিগুলির সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবীদের নিয়ে কংগ্রেস রাজত্বের বিরুদ্ধে যুক্তমোর্চা গড়ে তোলার আহ্বান রাখেন। তিনি নির্দিষ্টভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম নয়, সাধারণভাবে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ভিত্তিতেই যুক্তমোর্চা গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন ও নির্বাচিত এলাকাগুলিতে ভূমিসংস্কারের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। স্পষ্টতই এটা ছিল নতুন পরিস্থিতিতে পিছিয়ে আসারই কর্মনীতি, কিন্তু পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল পশ্চাদপসরণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কারণ, প্রথমত, তখনও এই পশ্চাদপসরণকে খুবই সাময়িক ব্যাপার হিসাবে নেওয়া হয়েছিল এবং অল্পদিনের মধ্যেই আবার ব্যাপক বিস্তৃত গণঅভ্যুত্থানের আশার ওপর এই রণকৌশল নির্ভরশীল ছিল। দ্বিতীয়ত, সংগ্রাম ও সংগঠনের বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে পিছিয়ে আসার কর্মনীতি ও পদ্ধতিগুলিকে পরিষ্কারভাবে সূত্রবদ্ধ করা হয়নি।

সংগ্রামে ধাক্কা, পার্টিতে ভাঙ্গন ও পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠনের সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে কমরেড চারু মজুমদারের প্রতি অনুগত ব্যাপক সাধারণ কর্মীরা কেন্দ্রীয় কমিটির পুনর্গঠনের সাময়িক পর্যায়ের জন্য তাঁর হাতেই সমস্ত কর্তৃত্ব তুলে দেন। তাঁর চারিদিকে যেসব উচ্চাকাঙ্খী ব্যক্তিরা ছিল তাদের অনেকে এই ব্যাপারটিকে এক সাধারণ চরিত্র দিয়ে বসে, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ‘ব্যক্তিগত কর্তৃত্বে’র ধারণা প্রচার করতে থাকে এবং কেন্দ্রীয় কমিটিকে পুনর্গঠিত করার পথে বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। শেষপর্যন্ত তারা পার্টি ও কমরেড চারু মজুমদারের প্রতিই বিশ্বাসঘাতকতা করে।

সারসংক্ষেপ করে বলা যায় যে পার্টি যে ভুলগুলি করেছিল তা হল – সংগ্রামের রূপ হিসাবে খতমকে সারা ভারতের প্রতিটি বিন্দুতে প্রযোজ্য বলে সাধারণীকরণ করে ফেলা, একে এক অভিযান হিসাবে নেওয়া, যদিও এর এক সামগ্রিক দিশা ছিল এবং কোনো কোনো এলাকায় সাফল্যও এসেছিল, তবুও এই সংগ্রামকে গণসংগ্রামগুলির সঙ্গে মেলানোর জন্য এক পরিপূর্ণ ও সুসঙ্গত কর্মনীতি স্থির করতে না পারা এবং ধাক্কার গুরুতর লক্ষণগুলি দেখা দেওয়ার সাথে সাথে সামরিক আক্রমণ থেকে রাজনৈতিক আক্রমণের দিকে পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল পশ্চাদপসরণ করতে ব্যর্থ হওয়া। মোটামুটিভাবে স্থায়ী অভ্যুত্থানের অবস্থা বিরাজ করছে – ভারতবর্ষের বিপ্লবী পরিস্থিতিকে এইভাবে বাড়িয়ে দেখা, ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে অসম্পূর্ণ উপলদ্ধি, মনোগত আকাঙ্খা থেকে যে কোনো বিশেষকে সাধারণীকরণ করে ফেলার ভুল পদ্ধতি, পার্টির শৈশবাবস্থা ও সংশোধনবাদী বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিক্রিয়া হিসাবে পার্টি নেতৃত্বের অধৈর্যপনা – এগুলিই ছিল উপরোক্ত ভুলগুলির উৎস।

কমরেড চারু মজুমদার শহীদ হওয়ার ফলে পরিস্থিতি এক জটিল মোড় নিল। গুরুত্বের সাথে ভুলগুলিকে শুধরে নেওয়ার কাজ শুরু হতে পারল দীর্ঘ পাঁচ বছর পরেই, অর্থাৎ ১৯৭৭ সালে।

কমরেড চারু মজুমদার শহীদ হওয়ার পর শর্মা ও মহাদেব ১৯৭২ সালের ৫-৬ ডিসেম্বর একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন। লিন পিয়াও ঘটনার সাথে সাথে ১৯৭৩-এর শুরুতে তাঁরা আলাদা হয়ে যান এবং প্রত্যকেই নিজস্ব উপদলীয় স্বার্থে নিজের নিজের কেন্দ্রীয় কমিটির নামে চারু মজুমদারের নীতিহীন নিন্দা অথবা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে থাকেন। বিশেষত মহাদেব মুখার্জী উদ্ভট উদ্ভট কাণ্ডকারখানায় মেতে ওঠেন। তিনি  ‘চারু মজুমদারের প্রতিটি কথার বিশুদ্ধতা রক্ষা’র নামে পার্টিকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে দাঁড় করান এবং কৃষকদের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্নভাবে এ্যাকশন বাড়িয়ে তোলেন। এইভাবে তিনি বিপ্লবী শক্তিগুলির গুরুতর ক্ষতি ডেকে আনেন, বিশেষত পশ্চিমবাংলায় এবং শেষপর্যন্ত নিজেকেই ধ্বংসের পথে নিয়ে যান।

এই সংকট মুহূর্তে বিহার রাজ্য কমিটির কমরেডরা ও নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নেতৃত্বকারী টিমের কমরেডরা মহাদেব ও শর্মার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অভিজ্ঞতাগুলি এবং বিহারের নতুন অভ্যুত্থান ও ধাক্কার পরে পশ্চিমবঙ্গে পুনর্গঠনের অভিজ্ঞতাগুলি বিনিময় করেন। ইতিমধ্যে দিল্লীর কমরেডরাও এই ধারার সাথে যোগ দেন। কমরেড জহরের নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালের ২৮ জুলাই কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠিত হয়। সেই সময় বিহারে, বিশেষত ভোজপুর ও পাটনা অঞ্চলে কৃষক সংগ্রাম চলছিল, পশ্চিমবঙ্গেও নতুন করে কৃষক সংগ্রাম সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চলছিল। এই সমস্ত সংগ্রামকে পথ দেখানো ও নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটি কেন্দ্রের একান্ত প্রয়োজন তখন বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছিল। মহাদেব ও শর্মা কোম্পানির হাতে চারু মজুমদারের লাইনের বিকৃতি ঘটার পর তার লাইনের বিপ্লবী মর্মবস্তুকে রক্ষা করাই হয়ে উঠল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। এই কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষিত লক্ষ্যগুলি ছিল : (ক) কমরেড চারু মজুমদারের বিপ্লবী লাইনের মর্মবস্তুকে রক্ষা করা; (খ) এই ভিত্তিতে পার্টিকে রাজনীতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ করা; (গ) ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করা।

সেই সময় পর্যন্ত এই কেন্দ্রীয় কমিটির কাজের ক্ষেত্র কেবল বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লী ও উত্তরপ্রদেশের একটি ছোটো অঞ্চলেরই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে আসামের অনেক কমরেডও এর সাথে যোগ দেন। সেই সময়ে অন্ধ্র, তামিলনাড়ু ও কেরালার কমরেডরাও কৃষকদের মধ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁরা কিছু কিছু জঙ্গী সংগ্রাম গড়ে তুলছিলেন এবং শর্মা ও মহাদেব চক্রের প্রবণতাগুলির মতো বিভিন্ন প্রবণতার বিরুদ্ধেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বিভিন্ন স্তরের পার্টি কমিটিগুলিতে তাঁরা সংগঠিত ছিলেন। বিশেষত তামিলনাড়ুর কমরেডরা রাজ্য কমিটির অধীনে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু পুনর্গঠিত পার্টি কেন্দ্র তাঁদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি, আর এই কারণে বিপ্লবী দিশায় পুনর্গঠিনের প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। দেশের সর্বত্রই বিপ্লবী আন্দোলনগুলি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল এবং অনেক কমরেডই হয় শহীদ আর না হয় গ্রেপ্তার হয়ে গিয়েছিলেন। কিছু সময় পরে শর্মা ও মহাদেবের কেন্দ্রীয় কমিটিগুলিও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ধ্বংস হয়ে গেল। এমন পরিস্থিতিতে বিপ্লবী দিশায় পার্টি-শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করা ও কৃষক সংগ্রাম সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালনার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনো পথ ছিল না।

কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করার সাথে সাথে বিহারের কৃষক সংগ্রামে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার হল। উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর ও বালিয়া জেলায় এবং পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়িতেও সশস্ত্র এ্যাকশন ও কৃষক সংগ্রাম গড়ে তোলা হল। কমরেড জহর সর্বদাই পার্টির স্বার্থ ও কেন্দ্রীয় কমিটির যৌথ নেতৃত্বকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন ও ব্যক্তিগতভাবে ভোজপুরের কৃষক সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন। তিনি তীব্রতম শ্রেণীসংগ্রামের মধ্য দিয়ে সামনে আসা শক্তিকে সংগঠিত করা ও সামরিক কার্যকলাপে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বিশিষ্ট সংগঠক ও কমাণ্ডার গড়ে তোলার কর্তব্যকর্ম সামনে এনেছিলেন ও শত্রুর ঘেরাও-দমন ভাঙ্গার জন্য ও জনগণের মনোবল বাড়িয়ে তোলার জন্য চলমান শত্রুবাহিনীর ওপর আক্রমণের ওপর জোর দিয়েছিলেন। সংগ্রামের এই এলাকাগুলিকে তিনি কংগ্রেস-বিরোধী যুক্তমোর্চার ভিত্তি হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন।

যাই হোক, সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় কমিটি ও বিশেষভাবে কমরেড জহরের মধ্যে ভালোমাত্রায় অধিবিদ্যা ছিল। সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনা না করা এবং আনুষ্ঠানিক ও বিষয়ীগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে কোনো বিশেষ ব্যাপারকে সাধারণ চরিত্র দিয়ে ফেলার ভুল পদ্ধতি – উভয়ই অনুসরণ করেছিলেন। কমরেড জহর তাই তাঁর দার্শনিক রচনা ‘এক ভেঙ্গে দুই – দুই মিলে এক নয়’-তে ‘সঠিক লাইন’কে এভাবে সূত্রায়িত করেন যে সঠিক লাইনের মাত্র বুনিয়াদী দিক ও বিকাশমান দিক থাকে। সঠিক লাইন সম্পর্কে এটা ছিল এক যান্ত্রিক সূত্রায়ন। এতে আমাদের ভুলগুলিকে তত্ত্বের স্তরে শুধরে নেওয়ার পথে আরও বাধা সৃষ্টি হল। তার ওপর, চলমান শত্রুবাহিনীর ওপর আক্রমণকে চলমান যুদ্ধের সূচনা হিসাবে সূত্রায়িত করা ও সমস্ত জায়গার জন্যই এর সাধারণীকরণ – যা ছিল যান্ত্রিকভাবে খতমকে উন্নত স্তরে নিয়ে যাওয়া – ভুল সামরিক লাইনের দিকে নিয়ে যায়। যদিও বহু জায়গাতেই বিপ্লবী কমিটিগুলির নেতৃত্বে জনগণকে পুলিশ ও জমিদারদের আক্রমণের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ সংগ্রামে সংগঠিত করা হয়েছিল, কিন্তু গণআন্দোলন গড়ে তোলা ও কৃষি সংগ্রাম গভীরতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো পূর্ণাঙ্গ ও সুসঙ্গত কর্মনীতি গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি ও ব্যাপকতর পরিধিতে জনগণের উদ্যোগ কমে আসার মধ্য দিয়ে ঐ সব ভুল চিন্তার নেতিবাচক ফলগুলি আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে কমরেড জহর ভোজপুরের যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হন। কিছু কিছু বিবেকবোধহীন (unscrupulous) ব্যক্তি আমাদের পার্টিকে ধ্বংস করার বাসনায় কমরেড জহরকে ভোজপুরের নেতা হিসাবে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করার মধ্য দিয়ে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অর্থাৎ পার্টির পুনর্গঠন এবং পার্টিতে যৌথ নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা ফিরিয়ে আনা – যা ছাড়া ভোজপুরের সংগ্রাম টিকত না – এই ভূমিকাকেই অস্বীকার করেন। এভাবে তাঁরা নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে এই মহান বিপ্লবী নেতার অসম্মান করেন।

১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে বিপ্লবী শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার ব্যাপারে এই কংগ্রেস এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সেই সময়কার রাজনৈতিক লাইনকেই সঠিক বলে ঘোষণা করল। পুরো ১৯৭৬ সাল জুড়ে আমরা কঠিনতম পরিস্থিতিতে সংগ্রামকে ও পার্টিকে টিকিয়ে রাখলাম। কৃষকদের বিভিন্ন অংশকে সমাবেশিত ও সংগঠিত করার জন্য রাজনৈতিক অভিযান হিসাবে চলমান এ্যাকশন অভিযানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া, মাঝে মাঝে এ্যাকশন করা, কৃষিশ্রমিকদের ধর্মঘটের আকারে গণসংগ্রাম এবং জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রাম – এসব অব্যাহত রইল। পাটনা ও উত্তর বিহারের অন্য কিছু অঞ্চলে, উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর ও বালিয়ায় এবং পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি ও বাঁকুড়ায় আবার সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা চলছিল। বিপ্লবী কমিটিগুলির মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত করার জন্য এবং প্রধানত ভোজপুর ও নকশালবাড়িতে সশস্ত্র ইউনিটগুলিকে আবার গড়ে তোলার জন্যও প্রচেষ্টা চলছিল। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সালের এই সমগ্র পর্ব জুড়ে আমাদের সর্বপ্রধান ঘাটতি ছিল এই যে প্রথমত, আমরা বিহারে ছাত্র, যুবক ও জনগণের সমস্ত অংশের কংগ্রেস বিরোধী অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারিনি, যে অভ্যুত্থান পরবর্তীকালে জয়প্রকাশের নেতৃত্বে চলে যাওয়ায় শক্তিহীন হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয়ত, জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার সময়ে যখন নেতাদের গ্রেপ্তারি ও জনগণের ওপর অত্যাচারের দরুণ আন্দোলন ভেঙে পড়ল তখন আমরা বাকি শক্তির সামনে কোনো পথনির্দেশ রাখতে বা তাঁদের সংগঠিত করতে পারিনি। কংগ্রেস বিরোধী যুক্তমোর্চা গড়ে তোলার লাইন আমরা ধরে রেখেছিলাম এবং আমাদের এলাকাগুলিকে এর মডেল হিসেবে তুলে ধরেছিলাম বটে, কিন্তু কংগ্রেস বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে একে মেলাতে পারিনি। এর কারণ ছিল এই যে কমরেড চারু মজুমদারের ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে যুক্তমোর্চার বিকাশ সম্পর্কে আমরা এক যান্ত্রিক ধারণা গড়ে তুলেছিলাম এবং সেই যাত্রিক কাঠামোর বাইরে ঠিক যেভাবে সবকিছুর বিকাশ ঘটছিল তা বিশ্লেষণ করে দেখতে অস্বীকার করেছিলাম। এই শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যৎ পথের ওপর এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখে গেছে।

১৯৭৭ সালে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতিতে ও আমাদের আন্দোলনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা গেল। তামিলনাড়ু, অন্ধ্র ও কেরালার কমরেডদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠল এবং এর ফলে আমাদের পার্টি এক সর্বভারতীয় চেহারা পেল। জরুরি অবস্থার সময়ে সংগ্রামের সমস্ত ফ্রন্টই যখন মোটামুটি নীরব ছিল, তখন কেবল আমরাই কঠিনতম পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিলাম ও ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলাম; তাই সংবাদপত্রের সেন্সার ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পর ভোজপুর শিরোনামে স্থান পেতে লাগল। ১৯৭৬ সালের মধ্যে প্রয়োগের দ্বান্দ্বিকতা আর তত্ত্বের ক্ষেত্রে অধিবিদ্যা – এই দুইয়ের মধ্যে দারুণ সংঘাত লাগল এবং প্রয়োজনীয় শর্তগুলি হাজির হলেই পার্টি এক বড় আকারের পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেছিল। এর সূত্রপাত হল ‘পার্টির মধ্যেকার ভুল চিন্তাধারার সংশোধন’ (কেবলমাত্র ফৌজি ইউনিটগুলির ক্ষেত্রে) দিয়ে, আর বড় বড় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবর্তন এবং কৃষক সংগ্রামের এক নতুন জোয়ারের সঙ্গে মিলে এটা হয়ে দাঁড়াল পার্টি-জোড়া এক পূর্ণাঙ্গ শুদ্ধিকরণ আন্দোলন।

সংক্ষেপে, অতীতকে দেখা সম্পর্কে এই হল আমাদের মূল্যায়ন – আমাদের মূল সফলতাগুলি ও প্রধান ত্রুটিগুলি সম্পর্কে  আমাদের মূল্যায়ন। এছাড়া আরও অনেক ছোটোখাটো দিক আছে যা নিয়ে হয় ১৯৭৯ সালের পার্টি সম্মেলনে আলোচনা হয়েছিল অথবা যেগুলি বর্তমানে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। আমাদের বিশ্লেষণ দেখিয়ে দিচ্ছে যে কীভাবে অতীত সম্পর্কে মূল্যায়ন আমাদের আন্দোলনের মধ্যে বিভিন্ন বিলোপবাদী ও নৈরাজ্যবাদী ধারার জন্ম দিয়েছে আর কীভাবেই বা আমরা অতীতের শিক্ষাগুলিকে বর্তমানের প্রয়োজনের সঙ্গে মিলিয়ে বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে চলেছি।

(লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯৮ থেকে)

গত দুই দশকেরও বেশি সময়ের বিহারের ইতিহাস গণহত্যার ঘটনায় পরিপূর্ণ। দলিত জাতিগুলির গ্রামীণ দরিদ্রদের এই গণহত্যাগুলি সংঘটিত করেছে জমিদারদের বিভিন্ন সেনাবাহিনীগুলি। গ্রামীণ দরিদ্রদের ক্রমবর্ধমান অভ্যুত্থানগুলিকে দমন করতে এবং জাতপাতগত ও শ্রেণীগতভাবে প্রাপ্ত বিশেষ সুবিধাগুলিকে অক্ষত রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে জমিদার ও কুলাকদের নতুন শ্রেণীগুলি। তাই তারা সমগ্র জনগণকেই সন্ত্রস্ত করে তুলতে বারবারই এই সন্ত্রাস সৃষ্টির কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। তবুও ১ ডিসেম্বর রাতে জাহানাবাদের লক্ষ্মণপুর বাথের গণহত্যার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে এবং তা যথার্থভাবেই ভারতীয় স্বাধীনতার অর্ধ-শতবর্ষে জাতির বিবেককে আলোড়িত করেছে। মোট ৬১ জনকে – যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই হল শিশু, নারী ও বৃদ্ধ – গভীর রাতে ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই গণহত্যার যাঁরা শিকার হয়েছেন তাঁরা সকলেই ছিলেন কৃষিমজুর শ্রেণীর এবং সামাজিক স্তর বিন্যাসের দিক থেকে দলিত। সামাজিক-অর্থনৈতিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সংগ্রামে তাঁরা সিপিআই(এমএল)-এর বিপ্লবী পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলেন।

ঘাতকরা ছিল রণবীর সেনার লোকজন – এরা উচ্চবর্ণের জমিদারদের সেনাবাহিনী এবং এদের পিছনে বিজেপির রাজনৈতিক মদত ও আরজেডির একটি অংশের সমর্থনও রয়েছে।

তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসাবে এবার তারা জাহানাবাদের এমন একটি গ্রামকে বেছে নেয় যা ভোজপুর, পাটনা ও ঔরঙ্গাবাদ জেলার লাগোয়া। মূল উদ্দেশ্য ছিল সারা মধ্য বিহারে তাদের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। যে সময়কে তারা বেছে নেয় সেটিও ছিল যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তখন কেন্দ্রে রাজনৈতিক সংকট চরমে পৌঁছেছিল এবং ক্ষমতায় ছিল এক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই অবস্থায় ভূমিহার ও রাজপুত – উচ্চবর্ণের এই উভয় জাতির একত্রে সমাবেশিত হওয়ার বিষয়টি ছিল চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির রাজনৈতিক দিক থেকে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠারই পরিচায়ক। প্রাপ্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, নির্বাচনের আগে পরিকল্পিত তিনটি গণহত্যার মধ্যে এটি ছিল প্রথম ঘটনা। অন্য দুটি গণহত্যার পরিকল্পনা রয়েছে রোহতাস ও বক্সার জেলায়।

গণহত্যার সমগ্র পরিকল্পনা ছকা হয়েছিল অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে। জাহানাবাদ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী সমস্ত জেলা থেকেই পেশাদার খুনীদের জড়ো করা হয়েছিল। এক নজির সৃষ্টি করা এবং আন্তর্জাতিক স্তরে সংবাদের শিরোনামে উঠে আসার জন্য কত সংখ্যক মানুষকে খুন করা হবে তা আগে থেকেই ঠিক করা হয়েছিল, যার মধ্যে আবার বিশেষ লক্ষ্যবস্তু করা হয় নারী ও শিশুদের। পরিকল্পনাটি যাতে অবলীলায় কার্যকর করা যায় তার জন্য নিশানা হিসাবে এমন একটি গ্রামকে বেছে নেওয়া হয়েছিল যেখানে মানুষের আশঙ্কার কোনো কারণ ছিল না, তাঁরা একেবারেই অপ্রস্তুত ছিলেন, আর তাই প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।

নজির অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছিল, শুধু সংখ্যাগত দিক থেকেই নয়, নৃশংশতা ও কাপুরুষতার বিচারেও। পাশাপাশি প্রচারমাধ্যমও, বিশেষত বিহারের প্রচারমাধ্যম চূড়ান্ত কপটতা জাহির করে অন্য এক নজির সৃষ্টি করেছিল। একেবারে প্রথম দিন থেকেই সংঘ পরিবারের প্রচারযন্ত্র আসরে নেমে পড়ে আর সংবাদ মাধ্যমও তার তালে তাল ঠুকতে থাকে। পাটনার এক নামজাদা সাংবাদিক এক জাতীয় দৈনিকে লেখেন, এটি হল রণবীর সেনা আর নকশালপন্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষের সেই চিরাচরিত কাহিনী, এবারে একমাত্র ফারাক হল নকশালপন্থীরা নিরস্ত্র ছিল। সেই সঙ্গে ঠাণ্ডা মাথায় নারী ও শিশুদের গণহত্যাকে চতুরভাবে নিয়মিত সংঘর্ষ বলে যুক্তির অবতারণা করা হল। ঐ একই সাংবাদিক তাঁর পরবর্তী লেখাগুলিতে যথেচ্ছ নকশালপন্থীদের হিংসার বিরুদ্ধে চাষিদের ক্ষোভের অভিব্যক্তি হিসাবে রণবীর সেনার যৌক্তিকতাকে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। দু-একজন ব্যতিক্রমের কথা বাদ দিলে সমগ্র উচ্চ বর্ণের সাংবাদিককূলের মধ্যে এই মনোভাবই চোখে পড়েছে। সংপাদপত্রগুলিতে নকশালপন্থী প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তু গ্রামগুলির দীর্ঘ তালিকা মোটা হরফে ছাপা হয়। জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর স্কোয়াডের জাহানাবাদের গ্রামে ঢুকে পড়ার মতো আষাঢ়ে গপ্পোও ফলাও করে ছাপা হয়। লক্ষ্মণপুর বাথের ঘটনা নিয়ে যে বিশ্লেষণ শুরু হয় তা অবধারিতভাবে শেষ হয়েছে সাধারণভাবে আইন শৃঙ্খলার অবনতির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং সমান্তরাল সরকার চালানো ও এমনকি পুলিশকে আক্রমণের স্পর্ধা দেখায় যে সমস্ত নকশালপন্থী উগ্রপন্থী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করা হয়েছে। প্রতিরোধের খবরগুলিকে গুরুত্বহীন করে তোলা হয় আর বিজেপি নেতাদের অনশন ও বাজপেয়ীর গ্রাম পরিদর্শনকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। রণবীর সেনা এবং বিজেপির সঙ্গে তার অবিচ্ছেদ্য সংযোগের দিক থেকে জনসাধারণের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দিতে এবং ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারটিও আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই ঘুরিয়ে দিতে প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করতে এ সমস্তই ছিল একেবারে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ।

এই ঘটনা মানুষদের বিরুদ্ধে কলমকে ব্যবহারের চিরাচরিত কাহিনীকেই তুলে ধরে, কিন্তু এবারে ব্যতিক্রম ছিল এই যে, কলম সরাসরি বেয়নেটের সঙ্গেই যুক্ত ছিল! একথা উল্লেখ না করলেও চলে যে রাষ্ট্রযন্ত্রও এই ‘কলম ঘাতকদের’ বাধিত করার জন্য মুখিয়ে ছিল। রণবীর সেনার বিরুদ্ধে নামেমাত্র কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের পর – তাও আবার বাস্তবের চেয়ে বেশ কাগুজে – প্রতিশোধের ঘটনাকে প্রতিহত করার অজুহাতে সমগ্র অভিঘাত ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে জনগণের শক্তিগুলির বিরুদ্ধে।

কিন্তু সমস্ত ধরনের ভাড়াটে বাহিনীর ষড়যন্ত্রই গ্রামীণ দরিদ্রদের মুক্তি সংগ্রামে শেষ কথা নয়। প্রতিবাদ দ্রুত বেড়ে চলেছে এবং ব্যাপকতর মাত্রা অর্জন করছে।

৫ ডিসেম্বর ১৭ দলের বাম ও গণতান্ত্রিক জোট বিহার বনধের ডাক দেয়। প্রসঙ্গত সমস্ত ধরনের বনধকে সর্বাত্মকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সুপ্রীম কোর্টের কুখ্যাত রায় বেরোনোর পর এটিই ছিল প্রথম বন্ধ । অন্যান্য অনেক গণতান্ত্রিক শক্তিই ঐ বনধকে সমর্থন করে এবং বন্ধ সর্বাত্মকভাবে সফল হয়। সারা দেশের এমনকি বিদেশেরও প্রগতিশীল জনমত ঐ গণহত্যার ঘটনাকে ধিক্কার জানায়। বহু প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবী ঐ প্রতিবাদে সামিল হন।

এই গণহত্যা গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে ব্যাপক শ্রেণী ঘৃণার জন্ম দিয়েছে, নিজেদের সংহতিকে আরও দৃঢ় করে তুলতে তাদের সংকল্পকে শক্তিশালী করেছে এবং তারা ক্রমশই আরও বেশি বেশি করে উপলব্ধি করছে যে আক্রমণই আত্মরক্ষার সবচেয়ে কার্যকরী পথ।

আরওয়ালে পার্টির সমাবেশ সর্বাঙ্গীনভাবে সফল হয়েছে। রণবীর সেনার বিরুদ্ধে রণধ্বনি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তোলে। হাজার হাজার যুবক ক্রোধে ফেটে পড়ছিলেন এবং শত্রুকে তার নিজের ভূমিতেই মোকাবিলা করার শপথ নিয়ে তাঁরা ফিরে যান।

রণবীর সেনার আবির্ভাবের ফলে শ্রেণীযুদ্ধ আর মধ্য বিহারের এই বা সেই অঞ্চলে আবদ্ধ নেই। সারা মধ্য বিহারেই তা ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে এক ব্যাপকতর শ্রেণী ঐক্য গড়ে ওঠার শর্তও সৃষ্টি হয়েছে, যে ঐক্য রক্তের বন্ধনে দৃঢ় হচ্ছে। এই শ্রেণীযুদ্ধ আবার সামাজিক ন্যায়ের মেকি দেবতা লালু যাদবকেও অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে, যিনি তাঁর পূর্ববর্তী অবতার রূপে আমাদের পার্টিকে নিশ্চিহ্ন করার মেকিয়াভেলীয় পরিকল্পনা হিসাবে রণবীর সেনাকে বেড়ে উঠতেই মদত যুগিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ সেনা এখন তাঁর কাছে এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হিসাবে হাজির হয়েছে এবং বিজেপির আক্রমণাত্মক রাজনৈতিক উদ্যোগ বেড়ে চলার পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ঐ সেনা এখন তাঁর নিজস্ব সামাজিক ভিত্তিকে হুমকি দিচ্ছে। এর ফলে আমাদের পার্টির উদ্যোগে সামাজিক স্তরে এক নতুন বিন্যাস ঘটানোর পক্ষে পরিস্থিতি অনুকূল হয়ে উঠেছে। পার্টি বিভিন্ন রূপেই তার আক্রমণাত্মক উদ্যোগুলিকে বাড়িয়ে তুলছে এবং বিশেষত ভোজপুরে পার্টি কংগ্রেসের আগে ও পরে গৃহীত কিছু পদক্ষেপ তৃণমূল স্তরে উদ্যোগের দ্বার খুলে দিতে সাহায্য করেছে।

যারা ‘জাতির লজ্জা’ সংঘটিত করেছে সেই রণবীর সেনার চ্যালেঞ্জকে অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে। বিহারের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের স্বার্থ আর গৈরিক বাহিনীর আক্রমণকে রুখে দেওয়ার জাতীয় কর্তব্য একাকার হয়ে একটি কর্তব্য হিসাবেই সামনে এসেছে – তা হল রণবীর সেনাকে নিশ্চিহ্ন করা।

নিজেদের আর্থ-সামাজিক মুক্তি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য গ্রামীণ সর্বহারারা রক্ত ঝরিয়েই চলেছেন। আমাদের কর্তব্য হল তাদের শ্রেণী ভাইদের হত্যার বদলা নেওয়ার জন্য তাদের সংগঠিত করা, আর তার জন্য আমাদের ব্যাপকতম পরিধিতে তাদের উন্মোচিত করার জন্য প্রচার অভিযান চালাতে হবে, বিশেষত সংবাদ মাধ্যম শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে; যে কোনো প্রকারের সংকীর্ণতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে সমস্ত ধরনের ইতিবাচক সামাজিক অংশ ও রাজনৈতিক শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং এই নৃশংস ঘাতক, কাপুরুষ বাহিনীর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য নিজেদের প্রস্তুতিকেও অনেক উচ্চস্তরে তুলতে হবে।

এই লড়াইয়ে অবশ্যই জয়ী হওয়া সম্ভব এবং জিততে আমাদের হবেই। এটিই হল মানব প্রগতি, গণতন্ত্র ও প্রকৃত জাতীয়তাবাদের আহ্বান। সমকালও এই আহ্বানই জানাচ্ছে।

(লিবারেশ, জুলাই ১৯৯৭ থেকে সংক্ষেপিত)

রাজ্যপাল সিবিআই-কে তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশীট পেশের অনুমতি প্রদানের পর লালু যাদব বিহার শাসনের নৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। ঐ অনুমতি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগের দাবি আরও জোরালো ও ব্যাপক-ভিত্তিক হয়েছে – বামেদের সমগ্র অংশ এবং জনতা দলেরও একটি অংশ একই দাবি করে আসছে। সমস্ত দিক থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে তাঁর পতনের সূচনা হয়ে গেছে। এই নতুন পরিস্থিতিতে বামেদের অবস্থানগুলি পর্যালোচনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

এই সেদিন বিহারের এক বিশিষ্ট বাম তাত্ত্বিক টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় তাঁর এক লেখায় লালু সম্পর্কে বামেদের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করতে গিয়ে হ্যামলেটের দ্বন্দ্বের বিখ্যাত অভিব্যক্তি ‘টু বি অর নট টু বি’ (এটাও হতে পারে, ওটাও হতে পারে) স্মরণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, লালু যাদবকে বিশ্বাস করে বামেরা যদি এর আগে ভুল করে থাকেন, তবে লালু-বিরোধী জেহাদকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেলে তারা সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাবেন। তার কারণ লালুর প্রতি জনগণের এক ভালো অংশের সমর্থন এখনও অটুট এবং ঘোলা জলে মাছ ধরতে বিজেপি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। বামেদের এই নতুন উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও তাঁর লেখা শেষ হয়েছে এই সংশয় প্রকাশের মধ্যে যে লালুর পতনে কে লাভবান হবে এবং এই ধাঁধার কোনো সমাধান তিনি দিতে পারেননি।

বাম বলতে তিনি তাঁর নিজস্ব ক্ষুদ্ধ গোষ্ঠী সহ সরকারি বামপন্থীদের বুঝিয়েছেন, যারা সেই প্রবাদের ‘রাজার প্রতি সবচেয়ে বেশি অনুগত’ ভঙ্গিতে এতদিন লালুর লেজুড়বৃত্তি করে এসেছেন।

সিপিআই(এমএল)-এর কোনো উল্লেখই যে তিনি করেননি, তার কারণ সহজবোধ্য। এটা স্বীকার করা তাঁর পক্ষে খুবই অস্বস্তিকর হত যে, লালুর সাত বছরের রাজত্বের একেবারে শুরু থেকেই সিপিআই(এমএল) কোনো বুর্জোয়া নেতার প্রতি আস্থা স্থাপনের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে এসেছে, এই তথাকথিত মণ্ডলপন্থী ত্রাণকর্তার স্বরূপ উন্মোচনের অভিযান পরিচালনা করেছে এবং নিজের স্বাধীন কর্মধারা নির্ধারণ করে লালুর অপশাসনের বিরুদ্ধে এক জনপ্রিয় আন্দোলন পরিচালনা করেছে। তা করতে গিয়ে সিপিআই(এমএল), যে সরকারি বামপন্থীরা লালুর ভাবমূর্তিতে বিমোহিত হয়ে পড়েছিলেন, তাদের রোষের শিকার হয়েছে। সিপিআই(এমএল)-কে প্রগতির গতিধারার প্রতিহতকারী হিসাবে মণ্ডল-বিরোধী ছাপ মারা হয়েছে, এমনকি এই অভিযোগেও অভিযুক্ত করা হয়েছে যে এক সামাজিক ন্যায়ের রাজত্বের পতন ঘটাতে চেয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে সমঝোতা করছে। খবু কম লোকই এটা জানে যে সমগ্র বাম বিন্যাসের মধ্যে অতিবাম ধারাও সিপিআই(এমএল)-কে মোটামুটি একইভাবে সমালোচনা করেছিল। সরকারি কমিউনিস্ট এবং সরকারি নৈরাজ্যবাদী – উভয়েই পরিণতি হিসাবে লালু যাদবের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং লালু যাদবও সিপিআই(এমএল)-কে কুৎসা করতে এবং এমনকি তার ক্যাডারদের নিঃশেষ করতে তাদের পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে।

কিন্তু ইতিহাসের আস্তিনে লুকানো ছিল অন্য এক ছক। আজ চক্রের আবর্তন সম্পূর্ণ হওয়ার পর ‘দরিদ্র জনসাধারণের ঐ ত্রাণকর্তা’ যিনি তাঁর গ্রাম্য ভঙ্গিতে দেশের মানুষের মনোরঞ্জন করেছিলেন এবং যিনি নিজেকে রাজা ঠিক করার নায়ক হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি নিজেই আজ কেলেঙ্কারির নায়কদের মধ্যমণি হিসাবে প্রতিপন্ন হয়েছেন। তাঁর একমাত্র কাজ ছিল সরকারি তহবিল লুণ্ঠন করে নিজের আখের গোছানো এবং তাঁর শাগরেদদের সন্তুষ্ট রাখা। যে সমস্ত বাম মুখপাত্র এবং সাংবাদিক লালুর ভাবমূর্তিতে ঔজ্জ্বল্যের প্রলেপ দিয়েছিলেন, তারা আজ সে ব্যাপারে নিজেদের হাত ধুয়ে ফেলতে এবং লালুর দ্বারা তাঁরা যে প্রতারিত হয়েছিলেন সেকথা গোপন করতে দেখাতে চাইছেন যে লালুর অধঃপতন হয়েছে অনেক দেরীতে, যখন তিনি প্রতিপত্তিশালী এবং উদ্ধত হয়ে ওঠেন। এটি একেবারে নির্জলা মিথ্যাচার। তথ্য থেকে প্রকাশ পেয়েছে, বিরোধী দলনেতা থাকার সময়ই তিনি পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই পুরোমাত্রায় ঐ কাজে নেমে পড়েন। তাঁর জনমোহিনী প্রদর্শনী ছিল অপরাধমূলক কাজকর্মকে চাপা দেওয়ার আবরণ মাত্র।

তাঁর সামন্ত-বিরোধী পরিচিতিও ছিল মেকি। এটি প্রকাশ পায় পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত ৫৬ জনকে নিয়ে গঠিত তাঁর চক্রের গঠন বিন্যাসের মধ্যে। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চবর্ণের সামন্তস্বার্থের প্রতিভূ কুখ্যাত মাতব্বরদেরও নাম। তাঁর ঘোষিত কর্মসূচি ছিল বিহারের রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর উচ্চবর্ণের সামন্ততান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করা ও বিজেপিকে রোখা। কিন্তু তাঁর গোপন কর্মসূচি ছিল পশ্চাদপদ ও উচ্চবর্ণের জাতিগুলির অভিজাতদের মধ্যে ক্ষমতার এক ভারসাম্য সৃষ্টি করা এবং বিহারের ক্রমবর্ধমান বিপ্লবী বাম আন্দোলনকে রোখা। ভারতীয় শাসকশ্রেণীর বুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিনিধিরা এই গোপন কর্মসূচি সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন আর তাই বিহারের বিস্ফোরক বিপ্লবী পরিস্থিতিতে এক বিরুদ্ধ শক্তি হিসাবে তাঁরা তাঁকে সমর্থন করেছিলেন।

অবশ্য, পশ্চাদপদ জাতিগুলিকে তাঁর কব্জায় ধরে রাখতে লালু যাদব ব্যর্থ হন এবং সমতা পার্টির রূপে যে ভাঙ্গন ঘটে তা বিজেপিকে উচ্চবর্ণ ও পশ্চাদপদ জাতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের এক বিকল্প ভিত্তি হাজির করার সুযোগ এনে দেয়। অপরদিকে সিপিআই(এমএল) লালুর হুমকি ও উৎকোচের নীতির কাছে নতিস্বীকার করতে অস্বীকার করে এবং গ্রামীণ দরিদ্র ও দলিতদের সামাজিক স্তরকে সমাবেশিত করার কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাদের ওপর লালুর প্রভাব যথেষ্ট ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। বিহারে সিপিআই(এমএল)-এর ইতিহাসে এই পর্বটি ছিল সর্বাপেক্ষা রক্তক্ষয়ী পর্ব, যখন পার্টিকে ভোজপুরে উচ্চবর্ণের সামন্ততান্ত্রিক রোষের বিরুদ্ধে, সিওয়ানে উচ্চবর্ণ ও পশ্চাদপদদের শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলির সম্মিলিত হত্যালীলার বিরুদ্ধে এবং মধ্য ও দক্ষিণ বিহারের কিছু অংশে এমসিসি-পার্টি ইউনিটির তীব্র আক্রমণের মোকাবিলা করতে হয়। এ সবগুলিতেই অব্যাহত মদত জোগায় লালু প্রশাসন। তবুও পার্টি তার অবস্থানে অবিচল থাকে এবং লালু রাজত্বের বিরুদ্ধে গ্রামীণ দরিদ্রদের জনপ্রিয় সমাবেশ ঘটানোর কোনো সুযোগকেই হাতছাড়া করেনি। আমাদের পার্টিই কেলেঙ্গারি-কলঙ্কিত রাজের বিরুদ্ধে বৃহত্তর জনসমাবেশ ঘটিয়েছে এবং বিরোধী পক্ষের কোনো দলই তার সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি।

সাত বছর রাজত্বের পর লালুর নিজের সামাজিক ভিত্তি এবং রাজনৈতিক কূটচালের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি তাঁর বাম মিত্রদেরও প্রান্তিক করে তুলেছেন ও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার ধ্বংসাধন করেছেন, যে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা বিজেপির বৃদ্ধিকে আটকানোর ব্যাপারে অন্ততপক্ষে এক বাড়তি শক্তির ভূমিকা পালন করত। অন্যদিকে বিজেপি তার প্রতিপত্তি বাড়িয়েছে এবং সিপিআই(এমএল)ও মূলধারার বাম হিসাবে সামনে এসেছে। তাঁর নিজের গোপন কর্মসূচিকে যুক্তিযুক্ত পরিণতি দিতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হওয়াই শাসকশ্রেণীর মতলবের কাছে লালুর অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার একমাত্র কারণ। এবং লালু যা দাবি করেন ও উপরোক্ত বাম তাত্ত্বিকও যার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে তাঁর তথাকথিত জেহাদ – তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার কারণ – এটি কোনোক্রমেই ঠিক নয়।

লালু খুব উঁচুদরের বাক্যবাগীশ। বামেদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে বলা যায়, তাঁর এক বিখ্যাত মন্তব্যে তিনি বামেদের বিপথগামী বলে বর্ণনা করেন এবং তাঁর বাম মিত্রদের ও লাল পতাকাকে প্রকাশ্যে অপমানিত করার কোনো সুযোগই তিনি ছাড়েননি। তবুও ‘বামরা’ যদি এখনও তাঁর প্রতি সমস্ত ধরনের মোহ পোষণ করেন এবং তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখেন তাবে তা মূলত ঘটছে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য ঐ ধরনের শক্তির ওপর নির্ভর করার ভুল কৌশলগত উপলব্ধি থেকে।

পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে সিবিআই লালু যাদবের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেওয়ার ফলে উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতি এক নতুন রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের জন্ম দিয়েছে এবং এই লক্ষ্যেই আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছিলাম। আমাদের উদ্যোগে এবং লালুর পদত্যাগের দাবিতে ১৫টি বাম ও গণতান্ত্রিক দলের ঢিলেঢালা এক জোট সামনে এসেছে। যদিও সিপিআই এবং অন্যান্যদের কেউ কেউ এই জোটে যোগ দিতে বাধ্য হয়, কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য লালুর পদত্যাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং তাঁরা উদ্ভূত নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতার সুবাদে দরকষাকষিতে বেশি সুবিধা আদায় করে পুরোনো পরিবারেই ফিরে যাবার আশা পোষণ করে। আর তাই তাঁরা এই জোটে দায়সারাভাবে অংশগ্রহণ করছেন এবং জোটের সংহতকরণকে ঠেকাতে কিছু শরিককে সঙ্গে নিয়ে গোপন ও সন্দেহজনক সমান্তরাল উদ্যোগ সহ সমস্ত ধরনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এই জোট অতএব খুবই ভঙ্গুর এবং অস্থায়ী প্রকৃতির।

তবুও এই জোটের উদ্ভব যাঁরা লালু রাজত্বের এক বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্পের সন্ধান করছিলেন, সেই জনগণের মধ্যে উচ্চ প্রত্যাশা জাগিয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার বনধের আহ্বানে তাদের স্বতস্ফূর্ত ও ব্যাপক সমর্থনের মধ্যে এটি পরিলক্ষিত হয়েছে। দ্বিতীয় দিনের বন্ধ থেকে সিপিআই সরকারিভাবে নিজেকে সরিয়ে নেয় এবং প্রকৃতপক্ষে বনধ সফল করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব বর্তায় সিপিআই(এমএল)-এর কাঁধে। এ সত্ত্বেও বন্ধ চূড়ান্তভাবে সফল হয়। বাস্তব পরিস্থিতিকে স্বীকার করে নেওয়ার সাহস যদি সিপিআই দেখাত এবং কার্যত সিপিআই(এমএল)-ই যে বিহারে সবথেকে বড় বাম দল হিসাবে উঠে এসেছে তা স্বীকার করে নিত – তাহলে জোটের বেশিরভাগ শরিকই যে ধারণা পোষণ করে থাকে – ঐ জোট বিহার রাজনীতিতে বিজেপির শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারত। পরিস্থিতির চাপে আমাদের সঙ্গে হাত মেলাতে বাধ্য হলেও তারা বাস্তবকে মেনে নিতে পারেনি। সংবাদপত্রের বিশ্লেষকরা যখন লিখলেন যে সাত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে সিপিআই(এমএল)-ই সবথেকে এগিয়ে গেছে, তখন সিপিআই তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।

সে যাই হোক না কেন, আন্দোলনের সমগ্র প্রক্রিয়া সিপিআই(এমএল)-এর নৈতিক কর্তৃত্ব ও মতাদর্শগত উৎকর্ষকেই সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেই সঙ্গে স্বাধীনভাবে ব্যাপকমাত্রায় জনসমাবেশ সংগঠিত করা, বিভিন্ন ধরনের শক্তির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণের ব্যাপারে সিপিআই(এমএল)-এর সামর্থ্য বিভিন্ন মহল থেকে প্রশংসা অর্জন করেছে।

লালু যাদবের সমর্থনে প্রকাশ্যে এগিয়ে আসায় এমসিসি-র মহাবিপ্লবীরা উন্মোচিত হয়ে গেছেন। জীবন্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে পার্টি ইউনিটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির জটিল সন্ধিক্ষণই এই ধরনের গোষ্ঠীগুলির মূলগতভাবে অরাজনৈতিক, নৈরাজ্যবাদী চরিত্র প্রমাণ করে দেয়।

বিহারের পরিস্থিতি অবশ্যই আমাদের অনুকূলে ঘুরেছে। লালুর জমানা শেষ হয়ে আসছে এবং সিপিআই(এমএল)-এর রাজনৈতিক প্রভাব সারা বিহার জুড়েই বিস্তারলাভ করেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীগুলিও আশায় আমাদের দিকে তাকাতে শুরু করেছে। কিন্তু রাস্তা এখনও যথেষ্টই আঁকাবাঁকা।

লালু বিরোধী আন্দোলনে নিজেদের হাতে উদ্যোগ রেখে কে অপরকে ছাপিয়ে যাবে, এই ব্যাপারে বিজেপি ও সিপিআই(এমএল)-এর মধ্যে এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। এক প্রধান জাতীয় পার্টি এবং শাসকশ্রেণীর প্রিয়পাত্র হওয়ায় বিজেপি অবশ্যই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তাঁদের ছোটোখাটো উদ্যোগও সংবাদপত্র ও টিভি-তে সারা দেশে ঢালাও প্রচার পেয়ে থাকে। অপরদিকে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগগুলিও প্রচারের আলো দেখে না। সমতা দলের মধ্যে তাঁরা এক দৃঢ় মিত্রকে পেয়েছেন আর আমাদের মিত্র সিপিআই আমাদের পিছন থেকে ছুরি মারতেই বেশি আগ্রহী। এ সত্ত্বেও আমরা প্রতিটি পদেই বিজেপির সাথে পাঞ্জা কষে চলার চেষ্টা করেছি এবং ৪৮ ঘণ্টা বন্ধ তাদের পিছনে ফেলে দিয়েছে। আদবানির রথ বিহারে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি উদ্যোগ ফিরে পাওয়ার পরিকল্পনা করছে এবং আমরা জনগণের কাছে ঐ যাত্রা বয়কট করার আহ্বান রেখেছি। লালুর পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিজেপির সঙ্গে নতুন পর্যায়ের এক সংঘাত অবশ্যম্ভাবী এবং এই সাম্প্রদায়িক বিপদের মোকাবিলায় পার্টিকে তার ভূমিকা বাড়িয়ে তুলতে হবে।

লালুকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য আন্দোলন বিহারে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ১৫ দলের জোটকে সংহত করার জন্য এবং ঐ জোটে এক কর্মসূচিগত দিশা প্রদানের জন্য পার্টি যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। ক্ষমতায় আসন্ন নতুন শক্তির সাপেক্ষে এক বিরোধী জোট হিসাবে আমরা এই জোট রেখে দিতে চাই। কিন্তু তা সরকারি বামেদের ‘থাকব, না বিদায় নেব’ এই দ্বিধাগ্রস্ততার বিরুদ্ধে লাগাতার সংগ্রাম চালানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বাধীন উদ্যোগকে শক্তিশালী করে তোলারও দাবি করে। নতুন পরিস্থিতিতে বামেদের যদি উদ্যোগ ধরে রাখতে হয় তবে তাদের মেকি সামাজিক ন্যায় এবং মেকি জাতীয়দতাবাদ – উভয়েরই মোকাবিলা করতে হবে।

(২৯ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৯৭, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধীন বিহার ইকনমিক অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ। লিবারেশন, এপ্রিল ১৯৯৭ থেকে)

ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাবৃন্দ,

আমার আগে দক্ষিণপন্থীদের প্রতিনিধি হিসাবে বিজেপির পক্ষ থেকে মিঃ সিং আলোচ্য বিষয়বস্তুর ওপর বলেছেন। আমি বোধ হয় এখানে বামপন্থীদের পক্ষ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি। যাই হোক, দক্ষিণ দক্ষিণই, আর বাম বামই, কিন্তু এখনও পর্যন্ত বামপন্থীরাই অর্থনীতির বিষয়ে বারবার সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছেন।

আমাকে বিহারের অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর বক্তব্য রাখতে বলা হয়েছে।

বিহার যে অনুন্নত, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু ভারতের অন্যান্য অনেক রাজ্য ও অঞ্চলও একইভাবে অনুন্নত রয়ে গেছে। তাহলে বিহারের অনুন্নতি নিয়ে আলোচনার কী এমন বিশেষ ও নির্দিষ্ট প্রয়োজন আছে?

স্বাধীনতার সময়কালে, সমস্ত রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম মাথাপিছু আয় ছিল বিহারেই এবং সেই ব্যবধানও ছিল বিরাট, যদিও ভারতের মোট উৎপাদিত খাদ্যশস্যের ৮ শতাংশ উৎপন্ন হত এই রাজ্য থেকে, সমস্ত রাজ্যগুলির মধ্যে এই রাজ্য শিল্পীয় উৎপাদনের নিরিখে ছিল চতুর্থ স্থানে এবং কয়লা ও ইস্পাতে ছিল বৃহত্তম উৎপাদক।

এখন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বাদে এসেও দেখা যাচ্ছে, বিহারে এখনও মাথাপিছু আয় নিম্নতম, দৈনিক ভিত্তিতে মাত্র ১০ টাকার মতো, যা কিনা মূলত কৃষি অর্থনীতিভিত্তিক অন্য এক রাজ্য পাঞ্জাবের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশেরও কম। আর এই সম্মেলনে গত দুদিন আগে ডঃ ভাল্লা যা বলেছেন তা যদি বিশ্বাস করতে হয় তবে ভারতের মধ্যে বিহারই একমাত্র রাজ্য যেখানে মাথাপিছু আয় বছরের পর বছর আসলে নীচে নেমে আসছে।

এই চিরস্থায়ী পশ্চাদপদতা, বিহারের অনুন্নতির বা অনুন্নয়নের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা এক সর্বাঙ্গীন ও গভীর অধ্যয়নের দাবি জানায়।

বিহার একটা ফাঁদে পড়ে গেছে, এক দারিদ্রের ফাঁদে, একটা আবর্তের মধ্যে এবং এখান থেকে তার বের হয়ে আসা মোটেই সহজ কাজ নয়।

বারবার আশা জেগেছিল, যেমন ধরুন ৫০-এর দশকে, যখন অর্থনীতি এক সন্তোষজনক হারে সম্প্রসারিত হয়েছিল, তেমনি ৭০-এর দশকের শেষভাগ থেকে ৮০-র দশকের মধ্যভাগে, যখন খাদ্যশস্যের সামগ্রিক উৎপাদন বেড়ে গিয়েছিল এবং কৃষি থেকে আয়ের পরিমাণ প্রায় ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

৯০-এর দশকেও, পরিসংখ্যান দেখিয়ে দেয় খাদ্যশস্য উৎপাদনে উচ্চবৃদ্ধির হার এবং উচ্চফলনশীল চাষের এলাকায় প্রকৃত অর্থেই বৃদ্ধির চিত্র। একর প্রতি রাসায়নিক সার বিনিয়োগের পরিমাণও ১৯৮৯-৯০-এর ৫৪.১৪ কেজির তুলনায় ১৯৯৪-৯৫ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪.৫১ কেজিতে। পরিবারভিত্তিক সঞ্চয়ের বৃদ্ধি ঘটেছে উল্লেখযোগ্যভাবে, জেভিজি-র মতো নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল সংস্থাগুলির বিস্ময়কর বৃদ্ধিই এর সাক্ষ্য দেয়। ৯০-এর দশকে, আশা বিশেষভাবে জেগেছিল সামাজিক ন্যায়ের শাসকদের ক্ষমতায় অভিষেক হওয়ার সাথে সাথে, যে শাসককূল শক্তিশালী সমর্থন পেয়েছিল জাত-শ্রেণীর বিচারে মধ্যবর্তী জাতগুলির, যারা ছিল প্রধানত মধ্য কৃষক।

এখন ক্ষমতায় থাকার প্রায় ৭ বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে, এই সরকার দেশের বৃহত্তম দুর্নীতিতে টলমল করছে, বিহার রাজনৈতিক অস্থিরতার আর এক পর্বে প্রবেশ করেছে এবং বিহার পূর্বাবস্থাতেই ফিরে এসেছে।

এটা সত্য যে, জনসংখ্যাগত ও প্রযুক্তিগত কারণগুলিও বিহারের অনুন্নতির জন্য দায়ী। ভারতে কেরালার পর উত্তর বিহারেই জনগণের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘনত্ব রয়েছে, কিন্তু এই সমগ্র এলাকায় কোনো খনিজ সম্পদ নেই। আরও বলতে গেলে, এটা একটা বন্যাকবলিত এলাকা। এরপর বর্তমানে কয়লার বদলে বেশি ব্যবহার হচ্ছে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অভ্রের বদলে ফাইবার অপটিকস। এর ফলে ছোটনাগপুরের বিশেষ স্ট্র্যাটেজিক সুযোগ-সুবিধা গুরুতরভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে।

তবুও বিহারের অনুন্নতির জন্য এগুলিই কেবলমাত্র কারণ নয়।

এই চিরস্থায়ী পশ্চাদপদতার অন্যতম বড় দিক হল বাহ্যিক অর্থাৎ জাতীয় অর্থনীতির বিপরীতে বিহারের অর্থনীতির অবস্থান। আন্তর্জাতিক স্তরে উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন টানা হয় এইভাবে যে দক্ষিণের অনুন্নত থেকে যাওয়ার সাথে উত্তরের সমৃদ্ধির এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একে অপরের শর্তস্বরূপ। একইরকমভাবে কিছু লোক তুলনা টানেন যে বিহারের ব্যাপার অল্প কয়েক রাজ্যের অর্থনীতির সমৃদ্ধির সাথে সম্পর্কযুক্ত। বহু অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী বিহারকে এক অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিহার কৃষি ও শিল্পে এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলিতে সস্তা শ্রম ও কাঁচামাল সরবহারকারীতে পরিণত হয়েছে। কয়লা ও ইস্পাতের ক্ষেত্রে অভিন্ন মূল্যনীতির ফলে স্থানীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়া থেকে ছোটনাগপুর শিল্পাঞ্চল বঞ্চিত হয়।

তারপরে আবার গ্যাডগিল সূত্র আসার আগে পর্যন্ত, পরিকল্পনা বণ্টনপ্রণালী বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মতো জনঅধ্যুষিত রাজ্যগুলির বিরুদ্ধেই গেছে। এমনকি তারপরেও, ৭ম যোজনায় পরিকল্পনা বণ্টনের ক্ষেত্রে বিহারের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল মাথাপিছু ৬২২ টাকা, যা জাতীয় গড় মাথাপিছু ৯২০ টাকার চেয়ে অনেক কম। সরকারি ও বেসরকারি – সব ক্ষেত্রেই মাথাপিছু বিনিয়োগ অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বিহারে ৮০-র দশক সহ গত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নীচেই থেকেছে। সঞ্চয়ের ভালো অংশই রাজ্যের বাইরে চলে যায়। আইডিবিআই গ্রুপ ও ইউটিআই, এলআইসি ও জিআইসি ইত্যাদি সংস্থাগুলির দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ বিহারে সবচেয়ে কম। এমনকি বিশ্বায়ন ও উদারনীতিকরণের পর্যায়ে এখানে বিনিয়োগের চিত্র বড়ই বিবর্ণ। ১৯৯১-এর আগস্ট থেকে ১৯৯৫-এর মে মাস পর্যন্ত বিহারে সবচেয়ে কম, ঠিক ০.১৪ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগ পেয়েছে। কেন্দ্রীয় যোজনা ব্যয়ে গুরুত্ব এখন স্থানান্তরিত করা হয়েছে দারিদ্র্য নির্মূলীকরণ ও কল্যাণ প্রকল্পে যেখানে পুঁজি গঠনের উপাদান খুবই কম।

কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার, বিহারে যারা শাসন করছে সেই একই পার্টির নেতৃত্বেই পরিচালিত হলেও বিহারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে কোনো ভরসা যোগায় না। এই সরকার, বিপরীতে, এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলির শক্তিশালী লবিগুলির চাপের প্রভাবেই রয়েছে।

গোদের উপর বিষফোঁড়া এই যে বিহারে অপদার্থ প্রশাসন থাকার জন্য পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ অর্থের অর্ধেকটুকু ব্যয় করা হয় না।

চিরস্থায়ী পশ্চাদপদতা অথবা অভ্যন্তরীণ উপনিবেশের অবস্থা তাহলে স্রেফ কেন্দ্রীয় বরাদ্দ আরও বাড়িয়ে বা আরও বেশি বিদেশী পুঁজি আগমনের প্রতীক্ষায় থেকে ভেঙ্গে ফেলা যাবে না। আঞ্চলিকতাবাদের অনুশীলন প্রান্তিক হয়ে যাওয়া রাজনীতিবিদদের জন্য ভালো রাজনীতি হতে পারে কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তা অবশ্য খুবই খারাপ।

অচলায়তনটি ভেঙ্গে ফেলার ভরবেগকে অবশ্যই আসতে হবে ভিতর থেকে, অভ্যন্তরীণ ব্যাপক সম্পদ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। আর এখানেই আমরা অনুন্নত অবস্থার পিছনে থাকা অন্য প্রধান দিকটির দিকে অভিনিবেশ করব, আর এটিই হল বিহারের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ গতিসূত্র।

প্রথমত, ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্র। উদ্যোগী ক্ষুদ্র চাষিদের হাতে জমি দিতে জমির আমূল পুনর্বণ্টন করা খুবই জরুরি প্রয়োজন। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের আওতায় থাকা ক্ষুদ্র জোতগুলি যাতে অর্থনৈতিকভাবে কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য-সহযোগিতা করা উচিত।

আমূল ভূমিসংস্কার কার্যকরী করতে, সমগ্র কার্যক্রম নিখুঁতভাবে করে উঠতে, রাজনৈতিক দলকে সমস্ত জমির জাতীয়করণ পর্যন্ত এগোতে প্রস্তুত হতে হবে এবং লিজের ভিত্তিতে উদ্যোগী ক্ষুদ্র চাষিদের হাতে ঐ সমস্ত জমির পুনর্বণ্টন করতে হবে। বড় ও ছোটো চাষি উভয়েই যাতে কৃষি মজুরদের ন্যূনতম মজুরি দেয় তা নিশ্চিত করাও সমানভাবে প্রয়োজনীয়।

দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ এবং আধা-শহরাঞ্চলের সঞ্চয়ের বেশি অংশ অবশ্যই রাজ্য সরকারি সংস্থাগুলির মাধ্যমে পুনরায় চাষাবাদে বিনিয়োগ করার সাথে সাথে পরিকাঠামো গড়ে তোলা ও সামাজিক পরিষেবা উন্নত করার কাজে লাগাতে হবে।

তৃতীয়ত, বিহারে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি যাতে ঋণ-আমানত অনুপাতকে উন্নত করে এবং আইডিবিআই গ্রুপ, এলআইসি, জিআইসি এবং ইউটিআই ইত্যাদি নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক ঋণদানকারী সংস্থাগুলি যাতে তাদের বিনিয়োগ বাড়ায় তার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

চতুর্থত, তার পশ্চাদপদতার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থাকার দরুণ বিহারের প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত।

কেবলমাত্র অভ্যন্তরীণ স্পন্দনের প্রেক্ষিতেই শিল্পীয় বিকাশের জন্য বিদেশী পুঁজি সহ, পুঁজি আকর্ষণ করার ব্যবস্থাগুলি অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে।

বিহারের সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশার ব্যাপারে ভারতের শাসক প্রতিষ্ঠান আদৌ কোনো চিন্তা করে না। ভোগবাদকে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তারা এখনও পর্যন্ত বিহারে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মারুতি গাড়ি বিক্রি করতে পারে। লুই ফিলিপি এবং মন্টে কার্লোর মতো প্রচণ্ড দামী পোশাক পরিচ্ছদ পাটনাতেই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। বিহারের বেশিরভাগ সঞ্চয় থেকেই দ্রুত গড়ে তোলা হচ্ছে জে ভি জি সাম্রাজ্য। বিহারী সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক সমবসময়ই জেএনইউ এবং দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে চালান হয়ে যেতে পারে।

বিহারের সাধারণ জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের, যারা বিহারের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক অংশের ভুখা পেটে থেকে যাওয়ার ঘটনায় অত্যন্ত বিচলিত হয়ে উঠছেন, তাঁদেরকেই এই অচলায়তন ভাঙ্গতে উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু আপনি তা এমন একটি রাজনৈতিক দলের কাছে প্রত্যাশা করতে পারেন না যে দুর্নীতিতে আপাদমস্তক ডুবে রয়েছে, এটি আমলাতন্ত্রের মাধ্যমেও অর্জন করা সম্ভব হতে পারে না যারা সামস্ত শক্তিগুলির সঙ্গে গভীর আঁতাতবদ্ধ রয়েছে।

এক দুর্নীতিমুক্ত নেতৃত্ব, যাদের বিহারের বিকাশসাধনের প্রশ্নে বিরাট দূরদৃষ্টি আছে, যারা সুবিধাভোগীদের জাতপাতগত গোষ্ঠীসংঘাতের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন, যাদের তৃণমূলস্তরের শক্তিশালী গণউদ্যোগের সাথে মেলবন্ধন রয়েছে, তারাই বিহারের দারিদ্র্য-ফাঁদের শৃঙ্খলকে ভাঙ্গতে পারেন।

হয় আপনাকে আমূল সমাধানের রাস্তা নিতে হবে, নয়তো চিরাচরিত পশ্চাদপদতা অনুসরণ করে যেতে হবে, এই দুইয়ের মাঝে কোনো মধ্যবর্তী রাস্তা খোলা নেই। আর বিহারের উগ্রপন্থার উত্থান ঘটছে বলে নাকিকান্না কেঁদেও কোনো লাভ নেই। ইতিহাসে, চরম পরিস্থিতিগুলি চরম সমাধানই দাবি করে।

সংকট যব বিক্রল হো যাতা হ্যায়, মহাভারত তব অনিবার্ষ হোতা হ্যায়! (সংকট যখন বিশাল আকার ধারণ করে তখন মহাভারতও অনিবার্য হয়ে ওঠে!)

(মূল নিবন্ধটি মেইনস্ট্রীম পত্রিকার ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সংখ্যার জন্য লেখা হয়, যার সংক্ষেপিত এই অংশটি ১৯৯৬-এর অক্টোবরে লিবারেশনে প্রকাশিত হয়।)

(...) ঘটনার পর দিনই দেশের সংবাদপত্রগুলির শিরোনামে এই হত্যাকাণ্ড স্থান পায় এবং প্রধান প্রধান দৈনিকগুলিতে পরপরই সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ও বিশ্লেষণাত্মক লেখাগুলি প্রকাশিত হয়। দূরদর্শন ঘটনাটিকে কদর্যভাবে প্রদর্শন করে এবং বিশেষ যত্নের সঙ্গে একথা বলতে ভুল করে না যে এ পর্যন্ত রণবীর সেনা ও সিপিআই(এমএল)-এর মধ্যে রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষে ২৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। যে সব সংবাদপত্র সংঘ পরিবারের কাছ থেকে মতাদর্শগত প্রেরণা পেয়ে থাকে তাদের সম্পাদকীয় কলমে বিহারের সাধারণভাবে আইন শৃঙ্খলাহীন অবস্থার কথা বলে খুবই হৈ চৈ বাধানো হয়। সাথে সাথেই তারা বিহারের ২৩টি জেলায় বাম উগ্রপন্থীদের তথাকথিত সমান্তরাল সরকার পরিচালনার মুখরোচক কাহিনী পরিবেশন করতে থাকে এবং আধা-সামরিক বাহিনী দিয়ে বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাদের দমন করার জন্য খুবই চেঁচামেচি করতে থাকে। সিবিআই-এর এক প্রাক্তন অধিকর্তাও এশিয়ান এজ পত্রিকায় ঠিক একই ধাঁচে কলম ধরেন। আরও বিভিন্ন খবরের কাগজে হিংসা আর পাল্টা হিংসার চক্রাবর্তের শিহরণ জাগানো সব কাহিনী সাজানো হয়। এইসব লেখায় দারুণভাবে অস্ত্র সজ্জিত সামন্তশক্তির দিক থেকে গণসন্ত্রাস সৃষ্টির হাতিয়ার হিসাবে নারী ও শিশুদের উপর সংগঠিত হত্যালীলার সাথে আত্মরক্ষা ও ন্যায্য অধিকারের দাবিতে গ্রামীণ দরিদ্রদের প্রতিরোধ সংগ্রামের মধ্যকার বুনিয়াদী পার্থক্যকেই গুলিয়ে দেওয়া হয়। অদ্ভূত যুক্তির কসরতের সাহায্যে আক্রান্তদেরই নিন্দামন্দ করা হয়।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন যে নৈরাজ্যবাদী গ্রুপগুলির থেকে আলাদা একথা সুবিদিত। এও সুবিদিত যে এটি একটি গণরাজনৈতিক দল যার বিহার বিধানসভায় ছ’জন সদস্য রয়েছে। যার মধ্যে দুজন হলেন সেই এলাকার যেখানে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে। ১৯৮৯-তে পার্টি আরা সংসদীয় আসন জয় করে এবং ১৯৯৬-এর লোকসভা নির্বাচনে পার্টি সেখানে পায় ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ভোট। পার্টি দরিদ্র কৃষকদের এক শক্তিশালী আন্দোলন পরিচালনা করছে এবং পাটনা ও দিল্লীর মতো রাজধানী শহরগুলিতে কয়েকটি বৃহত্তম বাম রাজনৈতিক সমাবেশ সংগঠিত করেছে। পার্টি নির্বিচার হিংসায় বিশ্বাস করে না এবং একান্ত অপরিহার্য না হলে প্রতিশোধমূলক বদলারও আশ্রয় নেয় না। সিপিআই(এমএল) নিরপরাধ নারী ও শিশুদের হত্যা করেছে – এমন অভিযোগ কেউই করতে পারে না। যথেষ্ট প্ররোচনা সত্ত্বেও যে কোনো জাতপাতগত প্রত্যাঘাতকেও পার্টি সবসময় প্রশমিত করে থাকে এবং সেক্ষেত্রে বাথানিটোলাও কোনো ব্যতিক্রম নয়।

দলিতদের দুই স্বঘোষিত মুখপাত্র কাঁসিরাম ও রামবিলাস পাশোয়ান ঘটনার নিন্দাটুকু পর্যন্ত করতে প্রয়োজন বোধ করেননি। দলিতদের ক্ষমতায় নিয়ে আসার সর্বাগ্রগণ্য ভি পি সিং – যিনি মুম্বাইতে রাজেশ কিনির পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যথেষ্ট সময় ও উৎসাহ বোধ করেছেন – তিনি সমগ্র ঘটনাপর্ব জুড়ে রহস্যপূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করেছেন। রণবীর সেনা বিজেপিরই এক শাখা সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও এবং ঘটনার যারা শিকার তাঁদের অনেকেই মুসলিম সম্প্রদায়ের হওয়া সত্ত্বেও বা করবস্থান ও কারবালার জমি উদ্ধার করা (সেনাদের) আশু লক্ষ্য জেনেও অথবা হত্যাকাণ্ডের পিছনে জোরালো সাম্প্রদায়িক তাগিদ ছিল জেনেও মুসলিম সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য কোনো নেতা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার গরজ অনুভব করেননি।

কেন্দ্রের কমিউনিস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত ঘটনাস্থলে উড়ে গিয়েছিলেন এবং ভূমিসংস্কার না হওয়াই সমস্যার মূল কারণ – এ ধরনের ধার করা বুলি আউড়ে গেছেন এবং এভাবেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে কোনো কিছু করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যখন কারো নির্দিষ্ট কোনো কিছু করার ইচ্ছা থাকে না তখন এ ধরনের যা খুশি তাই তাত্ত্বিক সূত্রায়নে অসুবিধে হয় না। আর তাই দিল্লী ফিরে যাওয়ার আগে কমিউনিস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথামাফিক বিহারের পুলিশবাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস দিতে পেরেছেন এবং মুখ্যমন্ত্রী ও পুলিশের বড় কর্তাদের দাবি অনুযায়ী আধা-সামরিক বাহিনীর নতুন নতুন ইউনিট মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দিতে পেরেছেন। ভাবতে অবাক লাগে যে পুলিশী নিষ্ক্রিয়তার পিছনে নাকি অস্ত্রশস্ত্রের অভাবই ছিল আসল কারণ! লোকসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিহারে উগ্রপন্থার মাথা চাড়া দেওয়ার কারণ অনুসন্ধানের জন্য অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মচারিদের নিয়ে এক টাস্কফোর্স গঠনের কথা ঘোষণা করেন। জেলা প্রশাসনের কর্তব্যে অবহেলার অপরাধ সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণ করা হয়নি বা কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি এবং এমনকি সাধারণীকরণের আড়ালে এই ধরনের মারাত্মক ঘটনার তদন্ত করতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের যে বরাবরের প্রথা তাকেও অস্বীকার করা হয়।

ভূমিসংস্কার না হওয়াই যে মূল কারণ গুপ্তের এই উক্তি সমস্যার অন্তর্বস্তুকে স্পর্শ করতে পেরেছে বলে উদারনৈতিক সংবাদ মাধ্যমগুলির কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ও বিশেষ সময় পর্বের নিরিখে এটা ছিল অতীব হাস্যকর এক মন্তব্য। নকশালপন্থার বৃদ্ধির পিছনে ভূমিসংস্কার না হওয়াকেই মূল কারণ হিসেবে দেখিয়ে প্রায়শই সম্পাদকীয় ও নানা সামাজিক বিশ্লেষণ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। গুপ্তও একই ধরনের উদ্বেগে আকূল এবং তাই তিনি বাঁধাধরা দাওয়াই-ই বাতলেছেন। তাঁর পণ্ডিতসুলভ ভ্রান্ত দুঃসাহসের আতিশয্যে তিনি বাথানিটোলার মর্মবস্তুকে আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন – যা ছিল ক্রমবর্ধমান সামন্ত প্রত্যাঘাতেরই এক পরিঘটনা।

সাধারণভাবে ভোজপুরে এবং নির্দিষ্টভাবে বাথানিটোলার কাছে বরকি খারাওঁ নামে মূল গ্রামটিতে নিজেদের সংগঠিত শক্তি ও বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে জনগণ মজুরি ও ভূমি সংস্কারের ফলাফল ইতিমধ্যেই ছিনিয়ে নিয়েছেন। গত সংসদীয় নির্বাচনে বিহারে বিজেপির উত্থানের ঘটনায় বলীয়ান হয়ে সামন্তশক্তির প্রত্যাবর্তনকামীরা এই ফলগুলি কেড়ে নিতে এবং সাবর্ণ আধিপত্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়। ঘটনাচক্রে রণবীর ছিল অতীতদিনের এক ভূমিহার বীর যে রাজপুত আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল আর তাই রাজপুতরা সাধারণভাবে রণবীর সেনায় যোগ দিতে অনিচ্ছুক। কবরস্থান ও কারবালার যে জমি জোর করে সাবর্ণ জাতের জমিদাররা দখলে রেখেছে এবং যাকে ঘিরে বর্তমান সংঘাত তা থেকে উদ্ভূত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিজেপির লোকজনেরা বরকি খারাওঁ-এ দুই জাতের মধ্যে ঐক্যস্থাপন করে। ১৯৭৮ সালে যখন মুখিয়া পদের জন্য পঞ্চায়েত নির্বাচনে ইউনুস মিঞা কেশো সিং-কে পরাজিত করে এবং অব্যবহিত কাল পরে ইমামবাড়াকে যে ধুলিসাৎ করে দেওয়া হয় এই সংঘর্ষের সূত্রপাত সেই তখন থেকে।

প্রকাশ্য শ্রেণীযুদ্ধের এক বৈশিষ্ট্যমূলক ঘটনা হল বাথানিটোলা। যদিও তার তীব্রতা দেখা গেছে তৃণমূলে, কিন্তু তাকে উপরতলার রাজনৈতিক সংগ্রামের মাপকাঠিতেই বুঝতে হবে। সমসাময়িক ভারতীয় সমাজের দুই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মানদণ্ড – জাতপাত আর সাম্প্রদায়িক বৈরিতা – তাকে শ্রেণী সংগ্রামের কাঠামোর মধ্যে মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়ার এ এক বৈশিষ্ট্যমূলক ঘটনা। বিপ্লবী বাম শক্তি আর অতি দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি যে এই শ্রেণীযুদ্ধে মুখোমুখি সংঘর্ষে অবতীর্ণ তা কোনো আকস্মিক বিষয় নয় – যে শ্রেণীযুদ্ধ গ্রাস করেছে সমগ্র ভোজুপর জেলাকে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে বিহারের অন্যান্য অংশেও। আর এও কোনো বিস্ময়জনক ঘটনা নয় যে প্রকাশ্য শ্রেণী সংগ্রাম ফেটে পড়তেই মধ্যপন্থী ও সমাজগণতন্ত্রী শক্তিগুলি নির্বীর্যে পর্যবসিত হয়েছে, প্রায়শই গ্রহণ করছে এমন এক নিরপেক্ষ অবস্থান যা কেবল লুন্ঠনকারীদেরই উপকারে লেগে যায়।

এই শ্রেণীসংগ্রাম – যা জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদকে নিজের মধ্যে অন্তর্লীন করে নেয় তা একইসাথে অগ্রাধিকারের বিষয়গুলিকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য উত্তর-আধুনিকতাবাদীদের যে আলোচ্যসূচি তাকেও নস্যাৎ করে দেয়।

সংবাদমাধ্যমের সাথে সাথে দলিত ও সংখ্যালঘুদের ক্ষমতাসীন করার সমস্ত প্রবক্তাদেরই নীরব থেকে যাওয়াকে এই প্রেক্ষাপট থেকেই দেখতে হবে। তবুও প্রতিবাদ আন্দোলন থেমে নেই। সিপিআই(এমএল) ধারার প্রথম যে সদস্য ভারতীয় সংসদে প্রবেশ করেছেন এবং বর্তমানে যিনি ভোজপুরের এক বিধায়ক – সেই রামেশ্বর প্রসাদের জেলা প্রশাসনের শাস্তি ও ভোজপুরের সামন্তপ্রভুদের নিরস্ত্র করার দাবিতে আমরণ অনশনকে কেন্দ্র করে বেশি বেশি সংখ্যায় প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীরা বাথানিটোলায় নামিয়ে আনা মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে ও রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন।

ভোজপুরের পঁচিশ বছরের ইতিহাস যদি কোনো পথনির্দেশ করে থাকে তাহল সংগ্রাম এখানে কখনো মাঝপথে থেমে থাকেনি। পঁচিশ বছর আগের তুলনায় গ্রামের গরিবরা এখানে আর্থ-সামাজিক ফসলগুলি ছিনিয়ে নিয়েছেন এবং রাজনীতিগতভাবেও যথেষ্ট পরিমাণে অগ্রসর হয়েছেন। কোনো বাথানিটোলাই তাদের অর্জিত সাফল্যগুলি থেকে বিন্দুমাত্র আত্মসমর্পণ করাতে পারবে না। যুদ্ধ তাই চলমান এবং সামন্ততন্ত্রের শেষ কণাটুকু চূড়ান্তভাবে মাটিতে মিশিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত লড়াই জারি থাকবে।

(বাথানিটোলা হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে সিপিআই(এমএল)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রচারপত্রের আকারে এই লেখাটি প্রকাশিত হয়)

আপনারা ভালোভাবেই অবগত যে, গত ১১ জুলাই রণবীর সেনার রক্তপিপাসু ঘাতকেরা বাথানিটোলার নিরপরাধ জনগণের উপর পাশবিক হত্যালীলা চালিয়েছে। সেই অভিশপ্ত দিনে ১২ জন মহিলা ও ৮ জন শিশুকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। এক গর্ভবতী রমণীর পেট চিরে দেওয়া হয়। ছোট্ট একটি শিশুর মাথা তরবারি দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার আগে শিশুটির জিভ কেটে নেওয়া হয়। অপর একটি শিশুর হাত থেকে আঙ্গুলগুলি কেটে নেওয়া হয়। আর একটি নবজাত শিশুকে তার মায়ের বুক থেকে টেনে নিয়ে তরোয়াল দিয়ে দু-টুকরো করে দেওয়া হয় আর তাদের কুঁড়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সদ্য কৈশোর পার হওয়া একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হয় এবং তাকে হত্যা করার আগে তার স্তন দুটি কেটে নেওয়া হয়। আহতদের মধ্যে দুটি শিশু বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। কেউই একথা অস্বীকার করবেন না যে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এ ধরনের পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা এক কথায় নজিরবিহীন। এই মর্মান্তিক গণহত্যার আড়ালে যে ঐতিহাসিক পশ্চাদপট তা কি আমাদের প্রত্যেকেরই জানা আবশ্যক নয়? এই বর্বর অপরাধের মধ্যে নিহিত আসল সত্যটিই বা কী?

সরকারি প্রচার – একগুচ্ছ নির্জলা মিথ্যা

আপনাদের জানা দরকার যে দেড় বছর হল রণবীর সেনাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার নামে টোলার (বাথানিটোলা – অনু) আশপাশের এলাকায় ৩টি পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে। জেলা প্রশাসনকে এক বড় ধরনের হত্যাকাণ্ডের আশঙ্কার কথা বার বার জানানো হয়েছে। তবুও কোনো সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আর রক্তপায়ীদের বীভৎস তাণ্ডবের সামনে পুলিশ থেকেছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়। মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং কর্তব্যে অবহেলার জন্য স্থানীয় পুলিশদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছেন কিন্তু জেলা শাসক বা পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে তিনি অস্বীকার করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী একদিকে লম্বা-চওড়া ভাষণ দিচ্ছেন অন্যদিকে তিনিই সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া কথাবার্তার সময় এহেন উক্তি করছেন যে “এমএল-দের লোকজনেরা যদি অর্থনৈতিক অবরোধ চালাতে থাকে তাহলে তাদের (রণবীর সেনা) কাছ থেকে আর কিই বা আশা করা যায়?”

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টোলা পরিভ্রমণ করেছেন কিন্তু এলাকার জনগণের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে প্রকৃত তথ্য খুঁজে বের করার প্রশ্নে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই বলেই মনে হয়েছে। তিনি আমাদের পাটনার প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সাক্ষাত করেননি। উল্টে, মুখ্যমন্ত্রী ও আমলাদের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বিহার পুলিশকে আধুনিকীকরণ ও মজবুত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং দিল্লী ফিরে গেছেন। ভাবখানা যেন এইরকম যে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাবেই পুলিশ এইরকম নিষ্ক্রিয় থেকেছে। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাবার্তার সময় তিনি যা বলেছেন বলে জানা গেছে তা হল এই যে ভূমিসংস্কার কর্মসূচি রূপায়নে ব্যর্থতার ফলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে (এবং আরও ঘটতেই থাকবে)। মনে হয় এসব কথা বলার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভুলে গেছেন যে বিহার সরকার জনতা দল ছাড়া আর কেউ চালাচ্ছে না আর তাকে সমর্থন করছে সিপিআই। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিহার প্রশাসনের নিন্দা করেছেন এবং কোনো এক সংবাদপত্রের খবর অনুয়ায়ী তিনি নাকি প্রশাসনের মদতেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন। যাই হোক, লালু যাদবের চাপে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের কথা প্রত্যাহার করে নেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রকাশ্য অভিযোগের পরেও এবং ডিএম ও এসপি-কে শাস্তি দেওয়ার জন্য সর্বদলীয় কমিটির সুপারিশ সত্ত্বেও বিহার সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে।

বিপরীতে, এই অপরাধী প্রশাসকেরাই লাঠি, জলকামান ও অন্যান্য সন্ত্রাসমূলক কৌশলের সাহায্যে জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাঁদের দাবিগুলিকে তুলে ধরার জন্য যে সব জনপ্রতিনিধি অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশনে বসেছিলেন তাঁদের জেলে বন্দী করা হচ্ছে। আমরা দেখছি আরোয়াল হত্যাকাণ্ড পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে আর ‘আরোয়াল’ খ্যাত অপরাধী এস পি কাসোয়ান নির্লজ্জভাবে তাঁর চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে রয়েছেন। রণবীর সেনার বিরুদ্ধে কোনো পুলিশী ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। শাসকশ্রেণীর সব দলগুলিই রণবীর সেনাকে বাঁচাতে সচেষ্ট এবং যত রকমরের অবাস্তব যুক্তি আর মিথ্যা প্রচার চালিয়ে তারা আমাদের উপরই দোষারোপ করে চলেছে।

আমাদের তথাকথিত কিছু বাম বন্ধু দায়হীন অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তাঁরা দরিদ্র ভূমিহীন কৃষক আর সামন্ত-কুলাকদের মধ্যে পার্থক্য করতে অসমর্থ, তাঁরা দলিত ও সংখ্যালঘু আর সাবর্ণ জাতি-আধিপত্যের শক্তিগুলির মধ্যেকার প্রভেদকেও দেখতে চান না। এই পাশবিক ও ঘৃণ্য ধ্বংসলীলা – যার পিছনে নিহিত রয়েছে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা – তাকে তারা খোলা চোখে সনাক্ত করতে চান না। নবজাত শিশু ও নিরপরাধ মহিলাদের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড দেখেও তাঁরা পথে নামার কোনো গরজ অনুভব করেন না। বরং তাঁরা প্রশাসনের সাথে একই সুরে গলা মিলিয়ে চলেছেন এবং মিথ্যা প্রচার চালিয়ে প্রগতিশীল জনমতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে চলেছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে, কঠিন সত্যগুলি সম্পর্কে আপনাদের অবহিত করা আমাদের কাছে জরুরি, যে সত্যের কথা খবরের কাগজগুলিতে প্রায় অপ্রকাশিতই থেকেছে।

হত্যাকারী রণবীর সেনা ও অশুভ রাজনৈতিক আঁতাত

প্রায় দুবছর আগে রণবীর সেনা তৈরি হয় যার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ভোজপুরের গরিব কৃষকদের বিপ্লবী আন্দোলনের রোষের সামনে কম্পমান সামন্ততন্ত্রের প্রাসাদকে রক্ষা করা। তারা সর্বশক্তি দিয়ে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, “আমরা ভোজপুরকে রাশিয়া কিম্বা চীনে পরিণত হতে দেব না; আমাদের বন্দুক দিয়ে আমরা শুধু ভোজপুর থেকে নয়, গোটা দেশ থেকেই লালঝাণ্ডার সমস্ত চিহ্ন মুছে দেব। আমাদের পূর্বপুরুষদের সামাজিক বিধি-ব্যবস্থাকে আমরা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করব ও পুরোনো রীতি ও নিয়মবিধিকে পুনরুদ্ধার করব।” এই সেনা জন্মের পর থেকে, ভোজপুর জেলার কেবলমাত্র সাহার ও সন্দেশ ব্লকেই, প্রায় একশ নিরপরাধ মানুষকে খুন করেছে যার মধ্যে অধিকাংশই হল অত্যন্ত অনগ্রসর দলিত ও মুসলিম সম্প্রদায়ের নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী মানুষেরা। আরা শহরে রণবীর সেনার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে আমাদের পার্টি সদস্যদের ধর্ণা-অবস্থানের ওপর গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছে। ১১ মার্চ দিল্লী সমাবেশে যোগদানের উদ্দেশ্যে আমাদের যে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মিছিলকারীরা চলেছিলেন তাঁদের উপরেও একইভাবে গ্রেনেড নিয়ে হামলা চালানো হয়। গ্রেনেডটি ফাটলে শত শত মানুষ মারা যেত। শুরুতে সেনার নেতৃত্ব ছিল কংগ্রেসের সাথে, পরে তারা বিজেপির দিকে ঘুরে যায়, আর এরই সাথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ই হয়ে ওঠে তাদের আক্রমণের নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু। বিজেপি নেতারা তাদের ঘাঁটিগুলিতে তড়িঘড়ি যাতায়াত শুরু করে দেয় এবং ঘন ঘন সভা করতে থাকে। এর পরই রণবীর সেনা লিখিত ‘ফতোয়া’ জারি করে বিজেপির প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে দেয়। বিধানসভায় জনতা দল সরকার কর্তৃক এই ফতোয়ার কপিও প্রদর্শন করা হয়। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-সমতা জোটের জোরদার উপস্থিতি জাহির হওয়ার পর সমগ্র বিহার জুড়েই উঁচুজাতের আধিপত্যবাদী শক্তিগুলি ও সামন্ত-কুলাক শক্তি নতুন করে বলীয়ান হয়ে ওঠে ও প্রচণ্ড হিংস্র হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্ত শক্তিকে সরাসরি লড়াইয়ে মোকাবিলা করার পরিবর্তে জনতা দলের নপুংসক নেতৃত্ব এদের তোয়াজ করে চলতে থাকে। বিশেষত ভোজপুর জেলায় যেখানে দলিত ও অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষদের অধিকাংশই রয়েছে সিপিআই(এমএল)-এর সাথে এবং যেখানে সিপিআই(এমএল)-এর বৃদ্ধিকে রোধ করার জন্য জনতা দল খোলাখুলিভাবেই সামন্ত জমিদারদের পক্ষ অবলম্বন করে, সেখানে লালু যাদবকে প্রকাশ্যেই অপরাধী জমিদারদের সঙ্গে এক মঞ্চে ভাষণ দিতে দেখা যায়। চন্দ্রদেও ভার্মার মতো জনতা দলের সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে রণবীর সেনার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানাতে দেখা যায়। আর দেখা যায় ওই দলের বহু নেতা প্রকাশ্যেই রণবীর সেনার দাগী নেতাদের সঙ্গে পানভোজন করছে। রণবীর সেনার মনোবল বৃদ্ধি এবং তার সাথে প্রশাসনের যোগসাজশের পিছনে এটিই হল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে

১৯৭৮-এর গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে মহম্মদ ইউনুস তদানীন্তন মুখিয়া কেশো সিং-কে পরাজিত করে তার আসন দখল নেন। এই ঘটনার পরবর্তী ঘটনাবলীর দিকে আমরা যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে ইউনুসের বিজয় স্থায়ী সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উচ্চবর্ণের সামন্ত মানসিকতা এই পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি। তারা মুসলিমদের উপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করে। তারা প্রথমে ইমামবাড়ার সামনে রাস্তা দখল করে নেয় তারপরে সরাসরি ইমামবাড়ারই দখল নিয়ে নেয়। ১৯৯১-এর ১৩ আগস্ট আঞ্চলিক প্রশাসকের কাছে এ বিষয়ে এক মামলাও রুজু হয় এবং তিনি তাঁর অধস্তন একজনের কাছে তদন্তেরও ভার দেন। যদিও রিপোর্টে এই অন্যায় দখল প্রমাণিত হয় প্রশাসন কিন্তু কোনো নির্ধারক পদক্ষেপ নেয় না। ১৯৯২-৯৩ সাল নাগাদ, জমিদাররা ইমামবাড়াটি ধ্বংস করে দেয় এবং সমস্ত ধ্বজাগুলি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে জ্বালিয়ে দেয়। স্থানীয় থানায় একটি এফআইআর নথিভুক্ত করা হয় ও একটি মামলা দায়ের করা হয। বাথানিটোলা হত্যাকাণ্ডের ১৩ দিন পর, ২৩ জুলাই ১৯৯৬ আদালতে এই মামলার নিষ্পত্তি হয়। রায়ে বলা হয়, সেখানে ইমামবাড়ার অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ নেই।

একই কায়দায় কবরস্থানের জমিও কব্জা করে নেওয়া হয়। ১৯৯৩-এর ১৪ এপ্রিল মহম্মদ নঈমুদ্দিন একটি মামলা দায়ের করেন এবং করবস্থানের চৌহদ্দি ঘিরে দেওয়ার দাবি জানান। শেষ পর্যন্ত অর্থাভাবে মামলাটি লড়া যায়নি এবং খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু অন্যায় দখলদারী আগের মতোই বহাল থাকল।

রণবীর সেনার লোকেরা কানফারি (সাহার) ও নওয়াডিতেও (তরারি) কবরস্থান ও কারবালার জমি দখল করে নিয়েছিল। এই জমি দখলদারির প্রতিবাদে ১০ জানুয়ারি ১৯৯৬ কারবালা মুক্তি জন জাগরণ মঞ্চ গঠন করা হয়। কানফারিতে যে সব মানুষ সভা থেকে ফিরে আসছিলেন তাদের উপর রণবীর সেনার লোকেরা হামলা চালায়। কিন্তু তাদের আক্রমণকে প্রতিরোধ করা হয়। উত্তেজনা বাড়তেই থাকে, কিন্তু দখলীকৃত জমি উদ্ধারের জন্য সরকার কোনো উদ্যোগ নেয় না। যদিও লালু যাদব ঘোষণা করেন সমস্ত গোরস্থানকে রক্ষা করা হবে, কিন্তু কোনো কিছুই করা হয়নি। রমজান মাসে, ২৫ এপ্রিল মহম্মদ সুলতানকে খুন করা হয় কিন্তু তার দেহ রণবীর সেনার দলবল খারাওঁনের কবরখানায় সমাধি দিতে বাধা দেয়। এখানেও তারা বহু লোককে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু মৃতদেহ নিকটবর্তী ছাতারপুরা গ্রামে সমাধিস্থ করতে নিয়ে গিয়ে এই হত্যাকাণ্ড এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। তাতেও তারা সন্তুষ্ট হয় না এবং তারা খারাওঁ গ্রামের মুসলিম পাড়া আক্রমণ করে এবং মা-লে সমর্থকদের বাড়িতে হামলা চালায় ও জিনিসপত্র লুটপাট করে। ৫০টি পরিবার গৃহহীন হয়, যার মধ্যে ১৮টি ছিল মুসলিম পরিবার। মহম্মদ নঈমুদ্দিনের পরিবার সহ অনেকেরই পরিবার বাথানিটোলায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু যেহেতু মসজিদটি ছিল রণবীর সেনা অধ্যুষিত এলাকায় তাই তারা ভয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যেতে পারেনি। পুলিশের বন্দোবস্ত করা গেলে তবেই তারা নামাজ পড়তে সক্ষম হয়।

তবুও উত্তেজনা প্রশমন হয় না। বাথানিটোলা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায় এবং মে মাসের শুরু থেকে ১১ জুলাই-এর মধ্যে সেনার গুণ্ডারা সাত বার এই টোলায় আক্রমণ চালায়। প্রতিবারই পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয় কিন্তু গ্রামবাসীরা নিজেদের শক্তিতেই গুণ্ডাদের তাড়া করে। ১১ জুলাই সেনার গুণ্ডারা সফল হয় এবং মহম্মদ নঈমুদ্দিনের পরিবারের ৫ জন সদস্যকে তারা হত্যা করে ও পরবর্তীতে হাসপাতালে একটি শিশুর মৃত্যু হয়। মহম্মদ নঈমুদ্দিন ও তার স্ত্রী ঘটনার সময় গ্রামে না থাকায় রক্ষা পায়। কেউ কেউ বলেন এই নিদারুণ হত্যাকাণ্ডের পিছনে ছিল মজুরি ও জমি সংক্রান্ত বিরোধ। কিন্তু সত্য যা তা হল এই দ্বন্দ্ব এক বছর আগেই মিটে গিয়েছিল এবং সেখানে আর কোনো অর্থনৈতিক অবরোধও ছিল না। শংকর শরণ তথ্যানুসন্ধানী টিমের রিপোর্টেও এই তথ্য প্রমাণিত হয়েছে এবং সত্য যা তা হল লড়াইয়ের শুরু তার পরেই। সুতরাং এই বিরোধের ফলেই যে গণহত্যা – এই প্রচারের কোনো সত্যতা নেই। দ্বিতীয়ত, যেভাবে এই গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে তা সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা, ঘৃণা ও প্রতিহিংসার মনোভাবকেই দেখিয়ে দেয় এবং তথ্যের ও যুক্তির বিচারে সমস্ত মানদণ্ডেই এই গণহত্যার সাম্প্রদায়িক চরিত্র ও তার পশ্চাদপট পরিস্ফুট হয়।

শান্তির জন্য আমাদের প্রচেষ্টা এবং রণবীর সেনা ও প্রশাসনের মনোভাব

আমরা সব সময়েই শান্তি প্রতিষ্ঠার সপক্ষে থেকেছি। এই কারণেই যে শান্তিকামী জনগণের আকাঙ্খার কথা মনে রেখে আমরা শান্তির জন্য উদ্যোগ নিতে শুরু করি। বিহটার (পাটনা) কিষাণ মহাসভার দ্বারা সংগঠিত স্বামী সহজানন্দ সরস্বতীর বার্ষিকী অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আমরা শান্তির জন্য আলাপ-আলোচনা শুরু করি। ভূমিহার জাতের আরও কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি সহ শ্রীমতী তারকেশ্বরী সিনহা এবং শ্রী ললিতেশ্বর শাহী আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। আমাদের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক কমরেড পবন শর্মা উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা যথেষ্ট ইতিবাচক হয়েছিল। এই সব আলোচনার ঠিক দুদিন পর পার্টির সাধারণ সম্পাদক আরায় সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে শান্তির জন্য এক আবেদন প্রকাশ করেন। এই আবেদন সংবাদপত্রগুলিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়। সমস্ত শান্তিপ্রিয় মানুষ একে স্বাগত জানান। আমরা রণবীর সেনার কাছ থেকেও সদুত্তর প্রত্যাশা করেছিলাম। পরবর্তীতে, দুপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করছিলেন এমন এক বন্ধুর মারফত আমরা এক বার্তা পাঠাই যে রণবীর সেনাও কোনো বিবৃতি প্রকাশ করুক যাতে আমরা পরবর্তী ধাপে পৌঁছাতে পারি। আমাদের বন্ধু বার্তা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু উত্তর মিলেছে হতাশাজনক। আমাদের শান্তি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

এলাকায় যাতে আমরা উন্নয়নমূলক কাজে হাত দিতে পারি তার জন্য শান্তি খুবই জরুরি ছিল, তাই আমরা শান্তি প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করিনি। এবার আমরা ভিন্ন এক পদ্ধতিতে শুরু করি। আমরা ভেবেছিলাম, জনমত সংগঠিত করেই জনগণের দিক থেকে চাপ সৃষ্টি করা দরকার। আমরা আশা করেছিলাম, প্রশাসনও আমাদের সাহায্য করবে। ১৯৯৬-এর জুনে, প্রধান প্রধান বাজার ও গ্রামের চকগুলিতে ডজন খানেক জনসভা সংগঠিত করার মাধ্যমে আমরা শান্তি অভিযান শুরু করি এবং মানুষকে এই শান্তি প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাই। ইতিমধ্যেই, রণবীর সেনার কিষাণদের ও আমাদের জনগণের মধ্যে পাঁচটি গ্রামে দ্বন্দ্বের নিরসন করা হয়। এই প্রচারাভিযানের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের প্রশ্নে আমাদের উদ্যোগ ভালো সাড়া ফেলে এবং তরারি ব্লকে আমরা ‘ঘেরা ডালো ডেরা ডালো’ আন্দোলন শুরু করি। আন্দোলন চমৎকার সাফল্যলাভ করে।

আরায় শান্তির প্রশ্নে আমরা এক সেমিনারের আয়োজন করি যেখানে সাধারণ জনগণের সঙ্গে অনেক শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী ও শান্তিপ্রিয় মানুষ অংশগ্রহণ করেন।

এটা দুর্ভাগ্যজনক যে রণবীর সেনা শান্তিকামী জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে কোনো মর্যাদাই দেয়নি এবং শান্তির জন্য প্রচার অভিযানের সমগ্র পর্যায় জুড়েই তারা ধারাবাহিকভাবে হিংসাত্মক প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করেছে। এভাবে আমাদের দ্বিতীয় প্রচেষ্টাও সফল হয়নি। একটি লিফলেটের মাধ্যমে রণবীর সেনা এই শান্তি প্রচেষ্টাকে অগ্রাহ্য করার জন্য জনগণের কাছে আহ্বান জানায় এবং চলমান যুদ্ধে সামিল হওয়ার ডাক দেয়। এটাই হয়তো সেই কারণ যে জন্য ‘বাথানিটোলা’ ঘটিয়ে শান্তি প্রচেষ্টাকে পুরস্কৃত করা হল।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম

গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্র বিহার কীভাবে গণতন্ত্রের সমাধিক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে বাথানিটোলা গণহত্যা ও সরকারি জবাব তারই জীবন্ত উদাহরণ। এই খেলায় সমস্ত পশ্চাদগামী ও অন্ধকারের শক্তিগুলি জোটবদ্ধ হয়েছে – যে জোট হল মাফিয়া ও সামন্ততান্ত্রিক কায়েমী স্বার্থের জোট।

আমরা সমস্ত প্রগতিশীল, বিপ্লবী, গণতান্ত্রিক, সমাজবাদী ও বামপন্থী সংগঠন ও জনগণের কাছে গণতন্ত্রের জন্য এই সংগ্রামে সামিল হওয়ার ও এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।

আমরা বাথানিটোলা গণহত্যার জন্য দায়ী প্রশাসনিক পদাধিকারীদের শান্তির দাবি জানিয়েছি। এই যুদ্ধে জয় ছিনিয়ে নিতে আমরা যদি ব্যর্থ হই তাহলে কাসোয়ানের মতো অপরাধীদের বেড়ে ওঠা আমরা রোধ করতে পারব না, পারব না পুলিশ আর প্রাইভেট আর্মির দ্বারা আরও আরও বাথানিটোলার মতো নরমেধ যজ্ঞ ঘটানোকে রুখে দিতে।

আমরা আপনাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে বুদ্ধিজীবীদের সভা সমিতিতে প্রস্তাব গ্রহণ করে, মিছিল সংগঠিত করে, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে অথবা জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেটের শাস্তির দাবি জানিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করে ন্যায়বিচারের জন্য এই আন্দোলনে সামিল হোন।

(লিবারেশন, আগস্ট ১৯৯৫ থেকে, সংশোধিত)

প্রায় তিন মাস পর বিহার নির্বাচন সম্পর্কে কিছু লিখতে যাওয়া অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু দেরীতে পর্যালোচনার বাড়তি সুবিধা এই যে, অন্যান্য বিশ্লেষকদের যুক্তি ও সিদ্ধান্তগুলিকে খুঁটিয়ে দেখা যায়। তাছাড়া কর্মীবাহিনীর বিভ্রান্তিকে কাজে লাগিয়ে যে বিকল্প অবস্থান পার্টির অভ্যন্তরে জন্ম নিয়েছে, তা দানা বাঁধতে শুরু করেছে অতি সম্প্রতি। এ সমস্ত কিছুই আমাদের নির্বাচনী অনুশীলন ও ফলাফল আরেকবার খতিয়ে দেখা একান্ত প্রয়োজনীয় করে তুলেছে।

আমাদের অবস্থান সম্পর্কে কয়েকজন বিশ্লেষকের পর্যালোচনা দিয়ে শুরু করা যাক। সিপিআই তাত্ত্বিক চতুরানন মিশ্র এক হিন্দী দৈনিকে মন্তব্য করেছেন যে, যেখানে সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর সিংহভাগ ভোট এসেছে জনতা দলের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাতের মাধ্যমে, সেখানে সমতা পার্টির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা থেকে সিপিআই(এমএল) যৎসামান্য ভোটই পেয়েছে। সিপিআই(এম)-এর সমান সংখ্যক আসন সিপিআই(এমএল) লাভ করায় তিনি বিস্মিত হয়েছেন। এ কে রায় তাঁর বহুল আলোচিত প্রবন্ধে জনতা দলের ওপর বামেদের ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি জনতা দলের সঙ্গে আঁতাতে যেতে অস্বীকার করায় সিপিআই(এমএল)-কে ‘একরোখা’ আখ্যা দিয়েছেন এবং সমতা পার্টি ও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সঙ্গে অনীতিনিষ্ঠ আঁতাতে আবদ্ধ হওয়ার অভিযোগে সিপিআই(এমএল)-কে অভিযুক্ত করেছেন। কেননা, তাঁর মতে, ঐ আঁতাতের পেছনে শুধুমাত্র আসন ও ক্ষমতার প্রলোভনই কাজ করেছে।

এককালে পার্টি ইউনিটি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত প্রাক্তন নকশালপন্থী সাংবাদিক শ্রী তিলক ডি গুপ্ত ইকনমিক এন্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় লিখেছেন, “নিজেদের নির্বাচনী ফলাফলে সন্তোষলাভের যথেষ্ট কারণ সিপিআই(এমএল) গোষ্ঠীর রয়েছে, যদিও তাদের মাত্রাধিক প্রত্যাশার তুলনায় তাদের ফলাফল যথেষ্টই খারাপ হয়েছে। সমস্ত দলগুলির মধ্যে সিপিআই(এমএল)-কেই প্রশাসনের সর্বাধিক শত্রুতার মুখোমুখি হতে হয়, যে প্রশাসন বৃহৎ জমিদারদের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত। এছাড়াও ঐ দলকে এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, যেখানে যে সমস্ত গ্রামীণ মেহনতি মানুষকে ঐ দল কৃষিসংগ্রামে সামিল করেছিল, তাঁদের এক বড় অংশ নির্বাচনে জনতা দলকে ভোট দেয়। তাছাড়া সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর তুলনায় সিপিআই(এমএল)-কে তার নিজস্ব শক্তির ওপর নির্ভর করেই লড়তে হয়। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচার করলে বলা যেতে পারে যে, এক যথেষ্ট কঠিন পরিস্থিতিতেও ঐ দল যথেষ্ট ভালো ফল করেছে।”

এই প্রশংসার পর শ্রীযুক্ত গুপ্ত যোগ করেছেন, “একথা বলার পর এটাও উল্লেখের প্রয়োজন যে, অ-যাদব ভূমি স্বার্থের প্রতিনিধিদের আপাত সমাজতান্ত্রিক, কিন্তু স্পষ্টতই দক্ষিণপন্থী সংগঠনের সঙ্গে অনীতিনিষ্ঠ জোট গঠনের প্রয়াস এক ধরনের রাজনৈতিক সুবিধাবাদকেই চিহ্নিত করে, যা অতীতে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে বারংবার পরিলক্ষিত হয়েছে। অধিকন্তু, জনতা দলকে কালিমালিপ্ত ও ক্ষমতাচ্যুত করার আগ্রহাতিশয্যে অন্যান্য বিরোধী দলগুলির সঙ্গে সিপিআই(এমএল) গোষ্ঠীও বিহারে মুখ্য নির্বাচনী কমিশনারের স্বেচ্ছাচারী ও পক্ষপাতদুষ্ট কার্যকলাপের এক সক্রিয় সহযোগী না হলেও অন্তত কিছুটা সমর্থন যুগিয়েছে।”

দুই জোট : দুই কৌশল

এখন দেখা যাক এই সমস্ত বক্তব্য কী তাৎপর্য বহন করে। চতুরানন মিশ্রের বিশ্লেষণে জনতা দলের সঙ্গে সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর জোট এবং সমতা পার্টির সঙ্গে সিপিআই(এমএল)-এর জোটকে একই গোত্রের হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, তার মধ্যে পার্থক্য শুধুমাত্র পরিমাণগত। অর্থাৎ নিজ নিজ জোট থেকে কে কতটা ভোট আদায় করতে পেরেছে, তফাৎ শুধু সেখানেই। জোটগুলির মধ্যকার অন্তর্নিহিত গুণগত পার্থক্যটিকে তিনি এড়িয়ে গেছেন। প্রথম জোটটি গড়া হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে, দ্বিতীয়টি এক বিরোধী দলের সঙ্গে। তাছাড়া চূড়ান্ত নির্ভরশীলতাই যেখানে প্রথম জোটটির বৈশিষ্ট্য, সেখানে দ্বিতীয় জোটটির ভিত্তি হল চরম স্বাধীনতা। নিজস্ব শক্তির ওপর ভিত্তি করে সিপিআই(এমএল)-এর বিজয়ের বিপরীতে সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর প্রাপ্ত সিংহভাগ ভোটই হল জনতা দলের সমর্থন প্রসূত – এই ঘটনা থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। সমতা পার্টির সঙ্গে আঁতাত নিছক প্রতীকী চরিত্রের হওয়ার এবং দু-তিনটি আসন বাদে অন্য সর্বত্র সমতা প্রার্থীরা আমাদের বিরোধিতা করার পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলা হাস্যকর যে, আমাদের প্রাপ্ত ভোটের সামান্য অংশও সমতা পার্টির সমর্থনপুষ্ট। তা আরও হাস্যকর এই কারণে যে সমতা পার্টি নিজেই চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আর একই সংখ্যক আসন প্রাপ্তির ভিত্তিতে সিপিআই(এম) ও সিপিআই(এমএল)-কে সমান করে দেখাটা বাস্তবতার পরিহাস মাত্র। জনতা দলের সমর্থন থেকে সিংহভাগ ভোট লাভ করেও সিপিআই(এম)-এর প্রাপ্ত ভোট আমাদের ভোটের অর্ধেকও নয়।

দুই জোট, দুই ধারার নির্বাচনী প্রচার ও প্রাপ্ত ভোটের দুটি ধরন – এগুলি প্রত্যেকটিই গুণগতভাবে পৃথক আর এটি উপলব্ধি করতে না পারলে সমস্ত নির্বাচনী বিশ্লেষণই ভাসাভাসা হতে বাধ্য, খুব বেশি হলে তা নিজের সুবিধাবাদকে গোপন করার সুচতুর কৌশল মাত্র।

প্রথম জোটটির ক্ষেত্রে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মূল কথাটিই হল বুর্জোয়া মিত্রের ওপর নির্ভরশীলতা, এবং চরম নির্ভরশীলতা। আর দ্বিতীয় জোটটির মূলকথা বুর্জোয়া মিত্রের সাপেক্ষে সর্বহারা পার্টির চূড়ান্ত স্বাধীনতা। জেনেশুনেই হোক আর না বুঝেই হোক, যে কেউই এটা গুলিয়ে দিতে চান, তিনি সমাজগণতন্ত্রী ও বিপ্লবী কমিউনিস্টদের নির্বাচনী কৌশলের মধ্যকার বুনিয়াদী পার্থক্যকে মুছে দেওয়ার অপরাধে অপরাধী।

জনতা দলের সঙ্গে আঁতাতবদ্ধ হওয়ার বামেদের নির্বাচনী কৌশল জনতা দলের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতার দিকেই তাদের নিয়ে গেছে বলে স্বীকার করেও শ্রী এ কে রায় কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তরটি এড়িয়ে গেছেন যে, আসন ও ক্ষমতার প্রলোভন ছাড়া অন্য কী উদ্দেশ্যে বামেরা জনতা দলের সঙ্গে আঁতাতে আবদ্ধ হয়েছে। স্বকীয় পরিচিতির বিলোপ বা জনতা দলের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা – গত পাঁচ বছরে জনতা দলের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের বিকাশের প্রক্রিয়া এটাকেই অবধারিত করে তুলেছে এবং এটা কোনো আকস্মিক বিকাশ নয়। সমস্ত ধরনের প্রতিকূলতার মুখে সিপিআই(এমএল) যদি সমগ্র পর্যায় ধরেই একরোখা হওয়াকেই বেছে নেয় এবং আসন ও ক্ষমতার লালসায় প্রলোভিত হতে অস্বীকার করে, তবে নীতিষ্ঠতাই কি তার ভিত্তি ছিল না? তাঁর নিজস্ব সংগঠন মার্কসবাদী কো-অর্ডিনেশন কমিটি জনতা দলের সঙ্গে যে অনীতিনিষ্ঠ আঁতাত গড়ে তুলেছে সে বিষয়ে এই স্বঘোষিত নীতিবাগীশের নির্লিপ্ত নীরবতা খুব কম করে বললেও রহস্যময়।

জেএমএম ও সমতা পার্টির সঙ্গে আঁতাতের প্রয়াসের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সব সময়েই বলে এসেছি যে আমরা কখনই সমতা-জেএমএম সরকারের শরিক হব না, এবং খুব বেশি হলে শর্ত সাপেক্ষে সমর্থন জানাব। ঐ ধরনের কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হলে – যদিও প্রথম থেকেই সেই সম্ভাবনা সুদূরপরাহতই ছিল – এটা খুব স্বাভাবিক যে আমূল পরিবর্তনের লড়াইয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ আমাদের পার্টি দ্রুতই তার বিপ্লবী বিরোধীপক্ষের ভূমিকাতেই ফিরে যেত। সমতা-জেএমএম সরকারের পক্ষে আমাদের শর্ত মেনে নেওয়া ও তা পালন করা সম্ভব ছিল না। ক্ষমতার লালসার পিছু ধাওয়া করাকে প্রথম থেকেই নাকচ করা হয়। তা, জেএমএম ও আমাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের তথ্যগুলি কী?

প্রমত, জেএমএম-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নির্বাচনের প্রাক্কালে হঠাৎ করে এবং আসন ও ক্ষমতার সুবিধাবাদী ভাগের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। ডিগবাজি খেয়ে লালু যাদব যখন ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেন, তখন থেকেই এই সম্পর্কের সূত্রপাত। ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের এক নতুন জোয়ারের মধ্যে আমরা জেএমএম-এর সঙ্গে একই মঞ্চের শরিক হই। দ্বিতীয়ত, জেএমএম এখনও ঝাড়খণ্ড আন্দোলনের অগ্রগণ্য প্রতিনিধি হওয়ায় ব্যবহারিক রাজনীতির ক্ষেত্রে তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখাটা অসম্ভব। আমরা অবশ্য যে কোনো যৌথ কার্যকলাপে কংগ্রেসকে বিচ্ছিন্ন রাখার দাবি তুলে পারস্পরিক সম্পর্কটিকে শর্তসাপেক্ষ করে তুলি। আর জেএমএম কংগ্রেসের সঙ্গে মাখামাখি শুরু করলে ঐ যৌথ মঞ্চ থেকেই আমরা বেরিয়ে আসি। তৃতীয়ত, উভয় তরফেই জোট বাঁধার ইচ্ছা প্রকাশ করে কিছু রাজনৈতিক বিবৃতি ছাড়া জোট বা আসন ভাগাভাগি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কথাবার্তাই হয়নি। আর ঘটনাক্রমে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী পর্যায়ে তারা জনতা দলের সঙ্গে পুনরায় মাখামাখি শুরু করলে আমরা তাদের সঙ্গে এমনকি প্রতীকী আঁতাতকেও প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্ত নিই। পরবর্তীতে তারা যখন পুনরায় ফিরে আসে, সমতা পার্টিই তাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়। আমরা কখনই তার শরিক হইনি।

নীতি এখানে কোথায় বিসর্জিত হয়েছে, শ্রীযুক্ত রায় কী দয়া করে একটু বলবেন? এর বিপরীতে যিনি স্বতন্ত্র ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা ছিলেন, যিনি ছিলেন বহিরাগত বিহারীদের সাপেক্ষে স্থানীয় মানুষের স্বার্থকে তুলে ধরার প্রেক্ষিত থেকে জেএমএম গঠনের মূল চালিকাশক্তি এবং যিনি ঝাড়খণ্ডকে ‘বিহারের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ’ পর্যন্ত বলতে দ্বিধা করেননি, সেই শ্রীযুক্ত রায় লালু যাদব ঝাড়খণ্ড সম্পর্কে আদ্যোপান্ত ‘বিহারী উপনিবেশবাদী’ অবস্থান গ্রহণ করার পরও তারই পিছু পিছু চলেছেন। নিজেই নীতিকে জলাঞ্জলি দেওয়ার পর শ্রীযুক্ত রায় যদি বামেদের স্বকীয় পরিচিতি বিলোপের জন্য বিলাপ করেন, তবে তার জন্য তিনি দায়ী করছেন কাকে?

আর এখন জেএমএম সানন্দে পুনরায় জাতীয় মোর্চায় ফিরে এসেছে, আর জাতীয় মোর্চা বামফ্রন্ট জোটের মাধ্যমে বামেরা – যার মধ্যে শ্রীযুক্ত রায়ও আছেন – জেএমএম-এর সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে, তবে এটা কতটা নীতিনিষ্ঠ হবে তার উত্তর দেওয়ার কোনো তাগিদ অবশ্য তাঁদের থাকবে না।

কৃষি সংগ্রামের রাজনৈতিক তাৎপর্য

শ্রীযুক্ত তিলক ডি গুপ্ত আমাদের প্রশংসা করেছেন এই বলে যে, “যে সমস্ত গ্রামীণ মেহনতি মানুষকে ঐ দল কৃষি সংগ্রামে সামিল করেছিল, তাদের এক বড় অংশ নির্বাচনে জনতা দলকে ভোট” দেওয়া সত্ত্বেও আমরা আমাদের আসন সংখ্যাকে বজায় রাখতে পেরেছি।

প্রথমত আমি বলতে চাই, প্রাপ্ত ভোটের সিংহভাগই – যা পাঁচ বছর আগে প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে তুলনীয় – এসেছে গ্রামীণ মেহনতি জনগণের কাছ থেকে যাদের কৃষি সংগ্রামে সামিল করা হয়েছে। এই অংশ থেকে আমাদের ভোট জনতা দলের অনুকূলে চলে যাওয়ার ঘটনাটি জাহানাবাদ জেলা এবং পাটনা জেলার দু-একটি আসনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমাদের গতবারের জেতা আসন বিক্রমগঞ্জ ও বারাচট্টিতে আমাদের ভোট প্রচণ্ডভাবে কমে গেছে ঠিকই, কিন্তু যে ভোট আমাদের দিক থেকে চলে গেছে তা হল মূলত মধ্যশ্রেণীর ভোট, যাঁরা গতবারে আমাদের ভোট দিয়েছিলেন। এবার যে ভোট আমরা পেয়েছি তা শুধুমাত্র ভূমিহীন, দরিদ্র শ্রেণীর কাছ থেকেই এসেছে।

সাহাবাদ অঞ্চলে আমাদের অবস্থানকে আমরা মূলত বজায় রাখতে পেরেছি, দক্ষিণ বিহারে অল্প উন্নতি ঘটিয়েছি এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটাতে পেরেছি। জাহানাবাদের বিপর্যয় সেখানকার গুরুতর সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। এর পেছনে আবার কারণ হিসাবে থেকেছে রাজনৈতিক দিশা পরিবর্তন, অর্থাৎ কৃষি সংগ্রামে মেহনতি মানুষকে সমাবেশিত করার দিশা থেকে সরে যাওয়া। এই দিকভ্রান্তির পেছনে আবার রয়েছে এমন এক পরিস্থিতি যেখানে পার্টিকে এমসিসি-পার্টি ইউনিটির আক্রমণের মোকাবিলায় নামতে হয়। আমাদের বিরুদ্ধে এই সমস্ত শক্তিগুলিকে প্ররোচিত করা ছিল লালু যাদবের এক সুপরিকল্পিত কৌশলেরই অঙ্গ, এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাগুলিকে মিটিয়ে নেওয়ার প্রয়াসে আমরা এমসিসি-পার্টি ইউনিটির দিক থেকে কোনো সাড়া পাইনি। এছাড়াও জাহানাবাদে প্রশাসনিক বৈরিতাও ছিল তুঙ্গে।

একমাত্র নির্বাচনের পরেই আমরা কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে জাহানাবাদে পাঠাতে পারি, কর্মীবাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করি ও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে কিছু কঠোর সাংগঠনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করি এবং মেহনতি জনতাকে কৃষি সংগ্রামে সামিল করার পথে ফিরে যেতে সক্ষম হই।

জাহানাবাদে একটি বিশেষ ব্যতিক্রম এবং নৈরাজ্যবাদীরা আখেরে কীভাবে শাসক শ্রেণীরই সেবা করে তার একটি বৈশিষ্ট্যমূলক উদাহরণ। জাহানাবাদে এমসিসি-পার্টি ইউনিটি অবশ্যই আমাদের পার্টির যথেষ্ট ক্ষতি করেছে যা জনতা দলের স্বার্থেই গেছে। কিন্তু নির্বাচন বয়কটের ওপর ভিত্তি করে তারা কি কোনো বিকল্প রাজনৈতিক মডেলের বিকাশ ঘটাতে পেরেছে? তাদের নির্বাচন বয়কটের আহ্বান দুঃসাহসিকতাবাদের দিকে মোড় নেয় এবং শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। স্থানীয় সংবাদ থেকে জানা যায়, এবং বেশ কিছু সাংবাদিকও লক্ষ্য করেছেন যে তাদের কর্মী ও সমর্থক বাহিনীর ব্যাপক অংশ জনতা দলের পক্ষে ভোট দিয়েছে। রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে, তীব্র রাজনৈতিক আলোড়নের সময়ে এই সমস্ত গোষ্ঠীগুলি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছিল।

বিপরীতে আমাদের নির্বাচনী সমর্থনের মধ্যে আমাদের পার্টি পরিচালিত কৃষি সংগ্রামেরই রাজনৈতিক প্রতিফলন ঘটেছে। শ্রীযুক্ত গুপ্ত এই বিষয়টিকেই স্বীকার করেন যখন তিনি বলেন, “এটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা যে, এই প্রথমবার সিপিআই(এমএল) গোষ্ঠী লালু হাওয়ার মধ্যেও উত্তর বিহারের সমতলে দুটি আসন লাভ করেছে। এটা দেখিয়ে দেয় যে কৃষি সংগ্রাম নকশালপন্থীদের প্রথাগতভাবে শক্তিশালী অঞ্চল দক্ষিণ ও মধ্য বিহার ছাড়িয়ে অন্যত্রও বিস্তার লাভ করেছে।”

এর অর্থ এই নয় যে জাহানাবাদে আমাদের দুর্বলতাকে আমি খাটো করে দেখছি। চরম প্ররোচনা সত্ত্বেও কৃষি সংগ্রামের দিশাকে আঁকড়ে থাকাই পার্টির উচিত ছিল, জাহানাবাদে তা করতে আমরা একেবারেই ব্যর্থ হয়েছি। আমি যা বলতে চাই তা হল, “যে সমস্ত গ্রামীণ মেহনতি মানুষকে ঐ দল কৃষি সংগ্রামে সামিল করে, তাদের এক বড় অংশ জনতা দলকে ভোট দেয়” – এই সূত্রায়ন মূলগতভাবে ভুল। বিপরীতে বলা যায়, যে সমস্ত অঞ্চলে কোনো না কোনো কারণে পার্টি কৃষি সংগ্রামে গ্রামীণ জনতাকে সামিল করার বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়, কেববমাত্র সেই সমস্ত অঞ্চলেই এটি ঘটেছে।

শ্রীযুক্ত গুপ্ত আমাদের “মাত্রাধিক প্রত্যাশার” কথাও উল্লেখ করেছেন। একথা সত্যি যে প্রত্যাশার তুলনায় আমাদের ফলাফল যথেষ্টই খারাপ হয়েছে। আমরা ১২-১৩ লাখ ভোট এবং ১০-১২টি আসনের প্রত্যাশা করেছিলাম, যা আমাদের রাজ্য পার্টির স্বীকৃতি এনে দিত। এই লক্ষ্যমাত্রা পার্টির আয়ত্তের একেবারে বাইরে ছিল এমন নয়। প্রশাসনিক বৈরিতা, পার্টির এক প্রবীণ নেতার হত্যা, সমগ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়াটি অস্বাভাবিক বিলম্বিত হওয়ার ফলে বৃহৎ পার্টিগুলির কৌশলগত সুবিধালাভ, মহারাষ্ট্র-গুজরাত নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার ফলে জনতা দল ও বিজেপির মধ্যে ভোটের তীব্র মেরুকরণ ঘটে যাওয়া, রিগিং, ইত্যাদি – এ সমস্ত কিছুই আমাদের নির্বাচনী সম্ভাবনাকে বেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করার পিছনে কম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি। একেবারে শুরুতেই আমরা বলেছিলাম যে ২৫টি আসনে আমরা শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী। এর মধ্যে ৬টি আসনে আমরা বিজয়ী হই, দ্বিতীয় স্থান লাভ করি ৮টি আসনে এবং অন্য দশটি আসনে ১৪০০০ থেকে ২৫০০০ ভোট লাভ করি। ২৫তম আসনটি হল হিলসা, এখানে নির্বাচন স্থগিত হওয়ার ফলে আমাদের সম্ভাবনা প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রথম পর্যায়ে যে সমতা পার্টি প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধারেকাছেও ছিল না, দ্বিতীয় পর্যায়ে সেই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উঠে আসে। আমাদের ২৫টি আসনের প্রাথমিক তালিকায় অবশ্য ভোরের স্থানে ছিল বারাচট্টি, আর সেটাই একমাত্র ব্যতিক্রম। আমি বিশদভাবেই দেখিয়েছি যে, এই ধরনের বাস্তব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রত্যাশাকে কখনই “মাত্রাধিক” বলা যায় না।

একথা বলার পরও আমি বলতে বাধ্য যে কিছু জায়গায় মাত্রাধিক প্রত্যাশা অবশ্যই ছিল, যে প্রত্যাশা গড়ে উঠেছিল কিছু ভাসাভাসা বিষয়ীগত উপাদানকে ভিত্তি করে। যেমন উচ্চবর্ণের নেতিবাচক ভোট অর্জনের প্রত্যাশা, যেখানে সমতা পার্টি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেই সেখানে কুর্মী জাতির মধ্যে সমতা পার্টির ভিত্তির কথা বিবেচনা, বিশেষ বিশেষ প্রার্থীর জাতের সমর্থন লাভের আকাঙ্খা, ইত্যাদি। এই সমস্ত আকাশকুসুম চিন্তা আসনের প্রত্যাশাকে ২৫-৩০ বা তারও বেশিতে নিয়ে যায়। আমি আবার বলছি এটা কখনই পার্টির ঘোষিত অবস্থান ছিল না, এটা ছিল পেটিবুর্জোয়া আত্মগত ধারণা এবং সংসদসর্বস্বতার অভিব্যক্তি যা নেতৃত্বের একটি অংশকে এবং ব্যাপক কর্মীবাহিনীকে আচ্ছন্ন করে। প্রত্যেকবারই যখন নির্বাচন এগিয়ে আসে এবং যখন নির্বাচনী উত্তাপ চরমে ওঠে, তখন অনেকেই অনেক অলীক স্বপ্ন দেখতে থাকেন, কোনো মার্জিত মূল্যায়নে কান দিতেই চান না। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিচ্যুতি, যা ভগ্নোদ্যম ও হতাশায় পরিণতি লাভ করে। এই প্রবণতার বিরুদ্ধে পার্টিকে ধারাবাহিক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

শ্রী গুপ্ত বিশেষ সমালোচনার জন্য আলাদাভাবে বেছে নিয়েছেন সমতা পার্টির সঙ্গে – যারা তাঁর মতে জনতা দলের চেয়েও অধিকতর দক্ষিণপন্থী – জোট বাঁধার আমাদের তথাকথিত অনীতিনিষ্ঠ প্রয়াসকে, আর এটাকে তিনি সিপিআই-সিপিআই(এম) ধারার রাজনৈতিক সুবিধাবাদের সমগোত্রীয় বলে মনে করেন। শ্রী গুপ্ত নিজেই স্বীকার করেছেন, সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর তুলনায় আমরা নিজস্ব শক্তির ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচনী লড়াই পরিচালনা করেছি। তিনি আরও স্বীকার করেছেন যে উত্তর বিহারে আমাদের বিজয় কৃষি সংগ্রামের ক্রমবর্ধমান বিস্তারকেই চিহ্নিত করে। এই জোটটি সম্পর্কে বলতে গিয়েও তিনি চতুরানন মিশ্র এবং এ কে রায়ের থেকে ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছেন, এবং শুধুমাত্র “অনীতিনিষ্ঠ প্রয়াসের” কথাই বলেছেন। কেননা তিনি ভালোভাবেই জানেন যে প্রতীকী চরিত্র ছাড়া কার্যত জোটের আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। জনতা দলের সঙ্গে সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর “সম্পূর্ণ সমঝোতার” পরিবর্তে ঐ জোটের প্রতীক-সর্বস্বতায় পর্যবসিত হওয়াটাই দেখিয়ে দেয় যে আমাদের পার্টি তার চূড়ান্ত স্বাধীনতাকে তুলে ধরার বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে, যে সমস্ত কেন্দ্রে পার্টি ঐতিহাসিকভাবে কুর্মী কুলাকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত সেই সমস্ত অঞ্চল সহ কৃষি সংগ্রামের সমস্ত কেন্দ্রগুলিতে প্রার্থী দেওয়ার বিষয়ে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সমতা পার্টির ছোটো শরিক হয়ে কাজ করতে, যৌথ ইস্তাহার, কর্মসূচি ও নির্বাচনী অভিযানের শরিক হতে সে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে।

সমতা পার্টির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক

সমতা পার্টি সম্পর্কে ১৯৯৪ আগস্ট পাটনায় রাজ্য ক্যাডার সম্মেলনে আমি যা বলেছিলাম, তা মনে করা যাক – “জনতা দল (জর্জ) সম্পর্কে আমি একটি বিষয় পরিষ্কার করে বলতে চাই। যাদবদের অত্যাচার ও আধিপত্যের বিরোধিতার নামে নীতীশ যাদবদের বিরুদ্ধে অন্যান্য জাত বিশেষত কুর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করছে। এরকম কোনো ধারণার সঙ্গে আমরা একমত হতে পারি না। ... বিহারে যাদবদের একটি বড় অংশই দরিদ্র ও মধ্য কৃষক। ... আমরা যাদব গোষ্ঠীর মধ্যে এক মেরুকরণ ঘটানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। ... আমরা নীতীশের চিন্তাধারায় পরিচালিত হতে পারি না। তাদের সঙ্গে আমাদের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। বাস্তবে বিষয়টি বরং উল্টো। যে পথে সে কুর্মী জাতের সমর্থন আদায় করছে, সে পথে কুর্মী কুলাকদের সঙ্গে আমাদের সংগ্রাম রয়েছে।” (লোকযুদ্ধ, ১৫-৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪)

পরে ১৯৯৫-এর ফেব্রুয়ারিতে আসন রফা সম্পর্কিত আলোচনা ভেঙ্গে যাওয়ার পর আমি লিখি, “আমরা সমতা পার্টির সঙ্গে নির্বাচনী বোঝাপড়া গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলাম। আমরা প্রকৃতপক্ষে যা চেয়েছিলাম তা হল, লালু বনাম নীতীশের রাজনীতি বা যাদব-কুর্মী বিভাজনকে দূরে সরিয়ে রেখে সমাজ পরিবর্তনের একটি কর্মসূচির ভিত্তিতে সমতা পার্টিকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসা। অবশ্য আমাদের এই প্রচেষ্টা এখনও সাফল্য লাভ করেনি, কেননা সমতা পার্টির নেতৃত্ব জাতপাতের চালবাজির মাধ্যমেই ক্ষমতায় আসীন হতে চান। তাঁরা বরং আমাদের পার্টিকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

“আমাদের অর্থাৎ কমিউনিস্টদের কাছে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতার অর্থ আমাদের স্বাধীনতাকে বিসর্জন দেওয়া নয়, আর আমাদের বিকাশ ও বিস্তৃতির মূল্যে ঐ ধরনের কোনো দলকে ক্ষমতায় আসীন হতে আমরা সাহায্য করতে পারিও না।” (লোকযুদ্ধ, ১-১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫)

এখানেও আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে, জনতা দলে ভাঙ্গন ঘটার কয়েক মাস আগে থেকেই যখন আমরা স্বায়ত্ততা রক্ষার জন্য যৌথ সংগ্রামে সামিল হই, তখন থেকেই জর্জ ফার্ণান্ডেজের এইচএমকেপি-র সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের সূচনা। এ সত্ত্বেও বিহারে সমতা পার্টির নেতৃত্ববৃন্দ আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যৌথ কার্যকলাপ ও আঁতাতের ব্যাপারে বিরূপ ছিলেন। তাঁরা প্রথমে সিপিআই ও সিপিআই(এম) এবং পরে আনন্দমোহনের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা চালান। আমরা তাদের পরিষ্কারভাবেই জানিয়ে দিই যে বিপিপি-র সঙ্গে সমস্ত ধরনের সম্পর্ক ছেদ না করলে তাদের সঙ্গে আমাদের আঁতাত সম্ভবপর নয়। একমাত্র প্রকাশ্যে বিপিপি-কে বর্জন করার পরই তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনার সূত্রপাত ঘটে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এক সেমিনারের মধ্য দিয়ে, আর ঐ সেমিনারে দলিত প্রশ্নে আমার ও নীতীশের বক্তব্যের মধ্যকার পার্থক্য কোনো আগ্রহী শ্রোতার মনোযোগই এড়িয়ে যায়নি। সমতা পার্টির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে কোনো গোপনীয়তা ছিল না। স্পষ্টতই তারা যখন জনতা দল ও সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর মধ্যকার সম্পর্কের মতো আমাদেরও তাদের ছোটো শরিকে পরিণত করতে চাইল এবং বিজয়ের সম্ভাবনাকেই আসন বণ্টনের মাপকাঠি করে তুলল তখনই আমরা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের সিদ্ধান্ত নিই। আমরা তাদের স্পষ্টভাবেই বলি যে আন্দোলনের প্রয়োজনের দিক থেকে যে সমস্ত আসন আমাদের কাছে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেই সমস্ত আসনেই আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। বিজয় লাভ বা প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ এসবই আমাদের কাছে অবান্তর। আলোচনা ভেঙ্গে যায় এবং আমরা স্বীয় শক্তির ওপর ভর করেই লড়াইয়ের ময়দানে নামি। কেবলমাত্র একেবারে শেষ মুহূর্তে আঁতাতের জন্য তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মরিয়া তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রতীকী আঁতাতে সম্মত হই। সমতা পার্টির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা গড়ে তোলা থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত ঐ আঁতাতের নিছক প্রতীকে পর্যবসিত হওয়া অবধি সমগ্র প্রক্রিয়ায় তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ যে কোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের কাছেই প্রমাণ করবে যে, “অতীতে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে বারংবার পরিলক্ষিত রাজনৈতিক সুবিধাবাদের” নেতিকরণের ওপরই আমাদের কৌশল প্রতিষ্ঠিত ছিল।

কাজেই সমঝোতা গড়ে ওঠার সমগ্র প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো অনীতিনিষ্ঠতা ছিল না। অবশ্য, সমতা পার্টির শ্রেণী চরিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে কেউ তার সঙ্গে সমঝোতা গড়ে তোলার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে পারেন। এখানে ব্যবহারিক রাজনীতির রূঢ় বাস্তবতাকে বিস্মৃত হলে চলবে না। গত পাঁচ বছরে জনতা দল রাজের বিরুদ্ধে আমরাই ছিলাম একমাত্র বাম বিরোধীপক্ষ। সিপিআই ও সিপিআই(এম) লালু যাদবের পাশে ছিল, আর এমসিসি ও পিইউ আমাদের নিঃশেষ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। লালু যাদব আমাদের বিধায়ক গোষ্ঠীর মধ্যে ভাঙ্গন ঘটায় এবং সাতজন বিধায়কের মধ্যে চারজনকে আমরা হারাই। মণ্ডলকে হাতিয়ার করে সে পশ্চাদপদদের মধ্যে আমাদের ভিত্তির ক্ষয় ঘটাতে থাকে। পার্টি কর্মীদের একটি অংশ আমাদের ত্যাগ করে জনতা দলের পক্ষে যোগ দেয়। সাধারণভাবে যে ধারণাটি গড়ে ওঠে তা হল যে জনতা দল ও এমসিসি আমাদের সামাজিক ভিত্তিতে ধ্বস নামিয়েছে এবং লালু যাদব ঔদ্ধত্যের সঙ্গে ঘোষণা করলেন যে আমাদের পার্টি চিরদিনের মতো শেষ হয়ে গেছে। এমসিসি ও পিইউ সোল্লাসে একই কথা প্রচার করতে থাকে। সত্যিসত্যিই চারদিক থেকেই আমরা ঘেরাও-এর মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম।

আঁতাত সম্পর্কে লেনিনীয় কৌশল

এই পরিস্থিতিতে এই সংকটকে প্রতিহত করতে এবং পার্টিকে চাঙ্গা করে তুলতে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করি। প্রথম কাজটি অবশ্যই ছিল কৃষি সংগ্রামকে তীব্রতর করে তোলা এবং নতুন নতুন অঞ্চলে তাকে ছড়িয়ে দিয়ে একেবারে লালু যাদবের ঘাঁটি উত্তর বিহার পর্যন্ত তাকে বিস্তৃত করা। দ্বিতীয়ত, আমরা সামাজিক ন্যায়ের শ্লোগানের বিপরীতে সামাজিক পরিবর্তনের স্লোগানকে তুলে ধরি এবং পাটনায় এক বিশাল জনসমাবেশ সংগঠিত করি। তৃতীয়ত, লড়াইকে জনতা দলের অভ্যন্তর পর্যন্ত বিস্তৃত করার লক্ষ্যে আমরা ১৯৭৪-এর আন্দোলনের মেজাজকে তুলে ধরি, আমাদের ছাত্র সংগঠনকে সক্রিয় করে তুলে জঙ্গী আন্দোলনে সামিল করি এবং দুর্নীতি ও ১৯৭৪-এর আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য জনতা দলের মধ্যকার সমস্ত গণতান্ত্রিক ব্যক্তির কাছে আবেদন রাখি। আমরা জর্জ ফার্ণান্ডেজের প্রস্তাবে সাড়া দিই, কেননা তার মধ্যে জনতা দলের এক আসন্ন ভাঙ্গনের ইঙ্গিত ছিল। কয়েক মাস পরে ভাঙ্গন সত্যি সত্যিই ঘটল এবং যাঁরা বেরিয়ে এলেন তাঁরা ১৯৭৪-এর আন্দোলনের ইস্যুটিকে ধরেই বেরিয়ে এলেন। বিহারে জনতা দলই আমাদের মূল প্রতিপক্ষ হওয়ায় তার মধ্যে যে কোনো ভাঙ্গনকেই কাজে লাগিয়ে নেওয়ার কৌশল সম্পূর্ণভাবেই ন্যায়সঙ্গত, তা আরও এই কারণে যে ঐ ভাঙ্গন তীব্রতর হয়ে ওঠার মূলে আমরাই অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিলাম।

এটা মনে রাখা দরকার যে পুরো পাঁচ বছর ধরে জনতা দলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কংগ্রেস ও বিজেপির মতো দক্ষিণপন্থী বিরোধী পার্টিগুলির সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্রব ছিল না। আমাদের দিক থেকে আমরা সর্বদা বামেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিকাশের ওপরই অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছি। ঐ ধরনের যে কোনো সুযোগকেই আমরা আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবারে জনতা দল নিজ শক্তির বলেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবং ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার সিপিআই-এর আকাঙ্খা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায়, সিপিআই বিরোধী আসনে বসতে বাধ্য হয়েছে। আর রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে বাম ঐক্যের প্রক্রিয়া আবার গতিশীল হতে শুরু করেছে।

স্বেচ্ছা-বিচ্ছিন্নতাকে স্বাধীনতার সমার্থক করে তুললে তা খুবই বিপ্লবী শোনাতে পারে, কিন্তু আদতে তা শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা ছাড়া অন্য কিছু নয় যা একমাত্র আন্দোলনের ধ্বংস সাধনই করতে পারে। স্বল্পস্থায়ী ও অনির্ভরযোগ্য হলেও গণচরিত্রসম্পন্ন মিত্রশক্তির সন্ধানে থাকা এবং শত্রু শিবিরের যে কোনো ভাঙ্গনকেই কাজে লাগিয়ে নেওয়াটা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কৌশলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সমতা পার্টি ও জেএমএম-এর সঙ্গে আঁতাতবদ্ধ হওয়ার আমাদের প্রচেষ্টা ঐ কৌশলের বাস্তব প্রয়োগ ছাড়া অন্য কিছু নয়। আর লালু যাদবের পাঁচ বছরের জমানায় কেবলমাত্র ঐ সংক্ষিপ্ত পর্যায়েই আমরা তাকে বেকায়দায় ফেলতে সক্ষম হই এবং তাঁকে বহু বিনিদ্রি রজনী যাপনে বাধ্য করি। জোটের মধ্যেও সর্বহারা পার্টির চূড়ান্ত স্বাধীনতা বজায় রাখাটা ছিল পার্টির অনুশীলনের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় এবং সিপিআই(এমএল) তা থেকে অক্ষত ও বিজয়ী হয়েই বেরিয়ে এসেছে। এমনকি আমাদের চরম শত্রুকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে সিপিআই(এমএল)-এর ভোটের ভিত্তি তার নিজস্ব শক্তি ও গ্রামীণ দরিদ্রদের কৃষি সংগ্রামের শক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

শেষন উপাখ্যান

বিহারে “অবাধ ও সুষ্ঠু” নির্বাচন চালু করার জন্য শেষনের পদক্ষেপগুলিকে আমরা যে সমর্থন করেছিলাম সে কথা আমরা অস্বীকার করি না, কারণ বিহার এমনই একটি রাজ্য যেখানে সমগ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়াটিই তামাশায় পরিণত হয়। কিন্তু ঐ পদক্ষেপগুলির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও আমাদের জানা ছিল। এক আদর্শ বুর্জোয়া ধারণায় “অবাধ ও সুষ্ঠু” নির্বাচনের অর্থ হল শুধুমাত্র বুথ দখলের মতো প্রকাশ্য জোরজুলুমগুলি থেকে মুক্ত হওয়া। অন্য কথায়, তা হল পুঁজির অবাধ ভূমিকার দ্বারাই ফলাফল নির্ধারিত হওয়া। কাজেই কোনো বুর্জোয়া সমাজে “অবাধ ও সুষ্ঠু” নির্বাচন মূলগত প্রকৃতিতে বুর্জোয়াই থেকে যায়।

তবে স্বেচ্ছাচারীভাবে নির্বাচনকে বিভিন্ন দিনে ভেঙ্গে দেওয়া বা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে পিছিয়ে দেওয়ার মতো পদক্ষেপগুলিকে আমরা কিন্তু কখনই সমর্থন করিনি, এবং একটি বিবৃতিতে আমরা বলি যে ঐ সমস্ত কার্যকলাপ কংগ্রেস(ই)-কে সহায়তা করার লক্ষ্যেই পরিচালিত। সমতা পার্টির নেতৃবৃন্দের প্রস্তাবমতো নির্বাচনী দুর্নীত সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের কাছে কংগ্রেস(ই) ও বিজেপির সঙ্গে কোনোরকম যৌথ প্রতিনিধিত্বের অংশীদার হতেও আমরা অস্বীকার করি। কাজেই এই বিষয়ে আমরা অন্যান্য বিরোধী দলগুলিকে নীরব সমর্থন জানিয়েছি আমাদের বিরুদ্ধে শ্রীগুপ্তর এই অভিযোগ সঠিক নয়।

লালুর জনমোহিনী ক্ষমতার স্বরূপ

শ্রীগুপ্ত লালুর বিজয়ের পিছনে যে সমস্ত কারণ খুঁজে পেয়েছেন সেগুলি হল লালুর ব্যক্তিগত জনমোহিনী ক্ষমতা, সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর একাত্মবোধ, দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়িত সংখ্যাগরিষ্ঠ নীরব মানুষকে ভাষা দেওয়া, ইত্যাদি। তা বেশ, কিন্তু লালুর বিজয়কে আমরা কীভাবে দেখব? এ কথা ঠিক যে, সিপিআই(এমএল)-এর ঘাঁটিগুলি ছাড়া অন্য সমস্ত জায়গায় জনতা দল গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে, এবং গ্রামীণ দরিদ্র জনসাধারণ তাঁর বাকচাতুরিতে ভেসে গেছেন, ঠিক যেমনভাবে তাঁরা একসময়ে ইন্দিরা গান্ধীকে সমর্থন জানাতেন বা বর্তমানে রামারাও ও জয়ললিতাকে সমর্থন করে থাকেন। আমাদের পার্টি নির্বাচনে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের আত্মঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে, যা মর্যাদাপূর্ণ ও উন্নত জীবনের জন্য তাঁদের আকাঙ্খাকেই প্রতিফলিত করে। কিন্তু শুধুমাত্র এইটুকুই জনতা দলের বিজয়ের তাৎপর্যকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে না। জনতা দলের প্রতি প্রশাসনের সক্রিয় মদতের অভিযোগটি যদি উপেক্ষাও করা যায়, তবুও বলতে হবে লালু যাদব সহ অন্য কেউই প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনতা দলের বিপক্ষে কাজ করার অভিযোগ আনেননি। বিহার প্রশাসন বৃহৎ জমিদারদের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত – শ্রীগুপ্ত নিজেও সেকথা উল্লেখ করেছেন – এই পরিপ্রেক্ষিতে দরিদ্রদের এই পরিত্রাতার সাপেক্ষে প্রশাসনের এই আচরণের তিনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

একথা বিস্মৃত হলে চলবে না যে জনতা বিধায়কদের অনেকেই দাগী আসামী। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনই হল উচ্চবর্ণের, বিশেষত রাজপুত জাতির, এবং কুখ্যাত সামন্ততান্ত্রিক পশ্চাদপটসম্পন্ন। নকশালপন্থীদের হিংসা থেকে উচ্চবর্ণের মানুষদের কেবলমাত্র তিনিই রক্ষা করতে পারেন, এই কথা বলে লালু যখন উচ্চবর্ণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন, তখন তাঁর অন্য রূপটিও প্রকাশ হয়ে পড়ে।

তাঁর পাঁচ বছরের রাজত্বে দুহাতে দাক্ষিণ্য ও আনুকূল্য বিতরণ করে তিনি কয়েকজন শক্তিশালী সামন্ত প্রভুকে তাঁর দিকে টেনে নেন, যারা আগে কংগ্রেস(ই) ও বিজেপির সঙ্গে ছিল। মুসলিমদের সমর্থন লাভের জন্য ধর্মীয় মৌলবাদের প্রতি আবেদনকেও তিনি চরমে নিয়ে যান এবং দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া মুসলিম সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ও দৃঢ়ভাবেই তাঁকে সমর্থন জানায়।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, লালুর ব্যক্তিগত জনমোহিনী ক্ষমতার অন্তরালে লুকিয়ে আছে বিভিন্ন শক্তিগোষ্ঠী এবং উচ্চবর্ণের এক ব্যাপক অংশ সহ আধিপত্যকারী জাতগুলির ভূস্বামীদের এক জোট। এই সামাজিক গতিসূত্রটিকে উপলব্ধি করতে না পারলে কেউ লালুর বিজয়ের একপেশে, উদারনীতিবাদী ও সমাজগণতান্ত্রিক ব্যাখ্যার ফাঁদে আটকে পড়তে পারেন।

লালু যাদব বিহারে ক্রমবর্ধমান বিপ্লবী সংগ্রামের প্রতি শাসক শ্রেণীর প্রত্যুত্তর ছাড়া অন্য কিছু নন। লালুর পিছনে প্রশাসন এবং প্রধান প্রধান শক্তিগোষ্ঠীগুলির ব্যাপক অংশের সমর্থনের রহস্যও রয়েছে এইখানেই। তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে লালু যাদব যথেষ্ট সচেতন এবং আমরা দেখতে পাই যে তিনি একই সঙ্গে উচ্চবর্ণের ভূমিস্বার্থের প্রতিভূদের কাছে নিজেকে হিংসাপরায়ন নকশালপন্থীদের বিকল্প হিসাবে তুলে ধরছেন। যখন তিনি দাবি করেন যে নকশালপন্থীরা যেখানে দরিদ্রদের হাতে বন্দুক তুলে দিয়েছে, সেখানে তিনি তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন বইপত্র, তখন তিনি চরম হিংসাসঙ্কুল ও সশস্ত্র বিহারী সমাজে জনগণকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নিরস্ত্র করে তোলার তাঁর উদ্দেশ্যকেই উন্মোচিত করে ফেলেন।

এক কমরেড বিদ্রুপ করে লোকযুদ্ধে লিখেছেন যে আমাদের নির্বাচনী অনুশীলন হল এলাকাভিত্তিক ক্ষমতা দখলের রাজনীতি থেকে এলাকাভিত্তিক আসন দখলে উত্তরণ। কিন্তু গভীর বিশ্লেষণ দেখিয়ে দেয় যে আমাদের নির্বাচনী সাফল্য এবং আমাদের সামন্ত-বিরোধী সংগ্রাম অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে আবদ্ধ। যে সমস্ত অঞ্চলে আমরা বিজয়ী হয়েছি সেই সমস্ত অঞ্চলেই সংগ্রাম ছিল সর্বাপেক্ষা তীব্র, আর গত তিন মাস যদি কোনো ইঙ্গিত বহন করে থাকে, তবে আমাদের বিজয় সংগ্রামকে তীব্রতর করে তুলেছে মাত্র। বাস্তবে এই এলাকাগুলিই সংসদীয় ও সংসদ-বহির্ভূত সংগ্রামের সমন্বয়ের অনুপম দৃষ্টান্ত। বিধানসভায় ক্ষুদ্র শক্তি হয়েও গত পাঁচ বছরে আমরা বিহার রাজনীতির মূল ধারার মধ্যেই থেকেছি। আগামী পাঁচ বছরও এর ব্যতিক্রম হবে না।

(পাটনায় অনুষ্ঠিত বিহারের বিকাশ সম্পর্কে কনভেনশনে প্রদত্ত ভাষণের অংশবিশেষ। লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯৪ থেকে)

বিহারের বিকাশ সম্পর্কে যদি বলা যায় যে তার গতি অত্যন্ত মন্থর, তবে প্রকৃত অবস্থা বোঝানোর পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। প্রকৃত অবস্থা হল বিহার পিছনের দিকে হাঁটছে। এটাই বিহারের বিশেষত্ব। পুরোনো অর্থনৈতিক নীতির অধীনে স্থাপিত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বড় বড় কারখানাগুলি দ্রুতই রুগ্ন হয়ে পড়ছে। অপরদিকে নয়া আর্থিক নীতির ভিত্তিতে অন্যান্য রাজ্যগুলিতে যেমন নতুন করে পুঁজির বিনিয়োগ হচ্ছে, বিহারে তা দেখা যাচ্ছে না। পুরোনো বা নতুন কোনো অর্থনীতিই বিহারের পক্ষে লাভজনক হতে দেখা যায়নি। রাজ্য সরকারের সংস্থাগুলিতে ব্যাপক লোকসান হচ্ছে। ভারতবর্ষের মধ্যে বিহারেই মাথাপিছু আয় সব থেকে কম। দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের শতকরা হিসাবের দিক থেকেও বিহারই রয়েছে সর্বাগ্রে এবং ঐ শতকরা হার দিন দিন বেড়েই চলেছে।

অন্য আর একটি বিষয়ও এখানে লক্ষ্যণীয়। তা হল কয়লা থেকে প্রাপ্ত রয়ালটি হোক, কেন্দ্রের অনুদান বা বিশ্বব্যাঙ্কের সাহায্য হোক, সরকারি কর্মচারি ও শিক্ষকদের বেতনের টাকাই হোক বা প্রভিডেন্ট ফাণ্ডে সঞ্চিত তাদের জমা টাকাই হোক – এ সমস্ত কিছুকে সম্বল করেই সরকার চলে। অন্যভাবে বলতে গেলে, রাজ্যের অভ্যন্তরে তেমন রাজস্ব সৃষ্টি হচ্ছে না।

এই রাজ্যের তৃতীয় বিশেষত্ব হল তার রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্র। এই রাজ্যে বর্তমান যাঁরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন, বিহারের উন্নয়ন সম্পর্কে তাঁদের কোনো অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ নেই। রাজনীতি হল অর্থনীতিরই প্রতিফলন, আর তাই আমরা যাকে বলি রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বাস্তবে তা হল অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়নেরই প্রতিফলন। জগন্নাথ মিশ্র থেকে লালু যাদব, এই যে পরিবর্তন ঘটেছে তা হল উচ্চ বর্ণের মধ্যকার দুর্বৃত্তদের আধিপত্য থেকে অনগ্রসরদের মধ্যকার দুর্বৃত্তদের আধিপত্যের রূপান্তরণ। এমনকি ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের উপজাতি নেতৃত্বের মধ্যেও মাফিয়া বৈশিষ্ট্য যথেষ্ট প্রকট। এই ধারা সমস্ত দিককেই গ্রাস করেছে। এমনকি রাজনীতিবিদরাও এক বিশেষ ধরনের ‘শ্রেণী’ হয়ে উঠেছেন। বিহারের জনগণ এমনিতেই জমিদার, কুলাক ও বিভিন্ন ধরনের দুর্বৃত্তের ভারে ভারাক্রান্ত, তার ওপর এই রাজনীতিবিদদের শ্রেণী তাদের ভারকে আরও দুর্বিসহ করে তুলেছে। সরকারি কাজকর্মকে দখল করাই বিহারের সমগ্র রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিহারের চতুর্থ বিশেষত্ব হল : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চরম অধঃপতন, নির্বাচন এখানে চূড়ান্ত হিংসাপ্রবণ এবং পঞ্চায়েত ও পুরসভার কোনো নির্বাচনই এখানে অনুষ্ঠিত হয় না। এগুলির শেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭৮ সালে এবং তাতে ২০০০ মানুষ মারা গিয়েছিলেন।

বিহারে পঞ্চম অভিশাপ হল হিংসার সবচেয়ে দানবীয় রূপ। আজকাল এখানে দু-চারজন মানুষের মৃত্যু তেমন কোনো খবরই নয়। কেবলমাত্র ব্যাপক আকারের গণহত্যাই এখানে খবর হতে পারে। এটি দেখিয়ে দেয় বিহারের মানুষের জীবন কত সস্তা।

সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের দ্রুত অবক্ষয় হল এ রাজ্যের ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্য : শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য, রাষ্ট্রকে প্রতারিত করা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে রাজা-মহারাজা ও অবতার হিসাবে তুলে ধরা হয়।

বিহারে কৃষি উৎপাদনের গতিরুদ্ধতাই রাজ্যের অন্যান্য সমস্ত বিষয়ের অধঃপতনের মূল কারণ। জাতীয় গড় হারের তুলনায় বিহারে প্রতি একর জমিতে ৭০ শতাংশের বেশি কৃষক, ১২০ শতাংশের বেশি কৃষিমজুর এবং ৬৫ শতাংশের বেশি গবাদি পশু নিয়োজিত হয়, তবু উৎপাদনের দিক থেকে জাতীয় গড়ের তুলনায় এই রাজ্য অনেক পিছিয়ে রয়েছে। গভীর বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে এখানে চাষবাস হল মূলত জীবনধারণ ভিত্তিক, অর্থাৎ উৎপাদন মূলত নিজেদের ভোগের জন্য, বাজারের জন্য নয়।

কেন পরিস্থিতি এরকম হয়েছে? প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতাগুলির অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই যে মূল সমস্যা হল ভূমিসংস্কার, আজ পর্যন্ত বিহারে যা অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। লালু যাদব যখন ক্ষমতায় আসেন, তিনি বলেন – বস্তুত হুমকি দেন – যে ৬৫টি পরিবারের ৫০০ একরেরও বেশি জমি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি আইনি ব্যবস্থা নেবেন এবং প্রয়োজন হলে তিনি জমির জাতীয়করণও করবেন। সমস্ত জমিদারদের জমি নথিভুক্তি করার ব্যাপারে রাজ্য সরকার একটি সার্কুলারও জারি করে। তারপর যত দিন গেছে লালু এই সমস্ত কথা বলা বন্ধ করেন এবং এমনকি সার্কুলার প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু লালু যখন ঐ সমস্ত কথাবার্তা বলতেন, জগন্নাথ মিশ্র তার বিরোধিতা করতেন। তাঁর প্রথম আপত্তির বিষয় ছিল যে, নথিভুক্তকরণের প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হবে, খুব সম্ভবত খরচ দাঁড়াবে ৪০০০ কোটি টাকা। আর দ্বিতীয়ত, এটি করতে গেলে তা ব্যাপক সামাজিক উত্তেজনার সৃষ্টি করবে। আমরা দেখলাম, লালুজীও ক্রমে ক্রমে ঐ সমস্ত কথাবার্তা বলা বন্ধ করলেন এবং সার্কুলার তুলে নিলেন। এইভাবে, লালু ও জগন্নাথ মিশ্রের মধ্যে, জনতা দল ও কংগ্রেসের মধ্যে এক ঐতিহাসিক চুক্তি হল। অথবা আপনি বলতে পারেন, অগ্রসর ও অনগ্রসর জাতিগুলির কুলাকরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় উপনীত হল যে, জমির বুনিয়াদী প্রশ্নে আমরা লড়ালড়ি করব না; আমাদের যদি একান্তই লড়াই করতে হয় তবে কেবলমাত্র সরকারি চাকরির সংরক্ষণ নিয়েই লড়াই করব। জমির বুনিয়াদী প্রশ্নে লড়াই করা ঠিক নয়, কেননা তা সামাজিক উত্তেজনার সৃষ্টি করবে যার থেকে সুবিধা আদায় করে নেবে বিপ্লবী শক্তিগুলি।

বিহারের কিছু বুদ্ধিজীবী এমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন যে, এই রাজ্যে ভূমিসংস্কারের আর কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা যেটুকু ভূমিসংস্কারের দরকার ছিল ইতিমধ্যেই তা হয়ে গেছে। অগ্রসর ও অনগ্রসরদের মধ্যকার ভাগচাষিরা জমির দখল পেয়ে গেছে এবং জমিদারী প্রথারও বিলোপ সাধন করা হয়েছে। আর এই সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা বলছেন যে, ‘কিষাণ রাজ’ (লালু সরকারের পরিপ্রেক্ষিতে) এসে গেছে। কাজেই এখন ভূমিসংস্কারের কথা বলা সঙ্গত নয়। আবার আর একটি অভিমতও উঠে এসেছে, তা হল, ভূমিসংস্কার কর্মসূচিকে বকেয়া কাজ হিসাবে সম্পূর্ণ করার, এখানে সেখানে কিছু কিছু করার মতো কাজ হিসাবে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু তার পরিধিকে বিস্তৃত করার প্রয়োজন নেই। যা দরকার তা হল জনগণকে শিক্ষিত করা যাতে তাদের মধ্যে এক ব্যবসায়িক উদ্যোগের বোধ জাগিয়ে তোলা যায়। ‘বাবু’ বনে যাওয়ার পরিবর্তে বিহারী যুবককে পুঁজি বিনিয়োগ করে শিল্প গড়তে হবে। তাঁরা বললেন, এটি জাতপাত নির্ভরশীল ব্যাপার নয়, বরং মানবিক গুণাবলীর উপরই ভিত্তিশীল এবং এই মানবিক গুণাবলীকে লালনপালন করতে হবে। প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার মধ্য দিয়েই তা সম্পন্ন করা যাবে। শুধু চাল আর গম উৎপাদন করলেই চলবে না, আলু উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করতে হবে, মাছ চাষে উৎসাহ দিতে হবে, ইত্যাদি। এটিই হবে বিহারের প্রগতির পথ। আমি মনে করি এই সমস্ত ধারণাই ভ্রান্ত, তা যে কোনো বাম রূপেই আসুক না কেন। আপনারা দেখবেন, এখানে স্থিতাবস্থাপন্থী যে সমস্ত শক্তিগুলি আছে, তা কংগ্রেসই হোক বা জনতা দলই হোক, সবাই ঘুরিয়ে বলে যে এখানে ভূমিসংস্কারের কোনো প্রয়োজন নেই। বিহারে যদি উন্নত প্রথায় চাষবাস করা যায় এবং আমলাতন্ত্রকে যদি কিছুটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত করে তোলা যায়, তবে বিহারের সমস্ত সমস্যাই দূর করা যেতে পারে। এইভাবে আমরা বুঝতে পারি যে এই সমস্ত যুক্তিগুলিই কোনো না কোনোভাবে স্থিতাবস্থাপন্থী ও সরকারি শক্তিগুলির পক্ষেই কাজ করে।

ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাব, বিহারে ১৯৭৩ সালে ভূমিসংস্কার সম্পর্কে এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং অনেক সুপরিচিত বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্যরা তাতে অংশগ্রহণ করেন। অনেক বিষয়ই সেখানে আলোচিত হয় এবং কী করণীয় – বিশেষত বিহার সরকারের কী করার আছে সে সম্পর্কে অনেক প্রস্তাবই উঠে আসে। প্রথম যে প্রস্তাব আসে তা হল, জমির নথিভুক্তিকরণ যথাযথ অবস্থায় নেই, সেগুলি সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা আছে, বিশেষত ভাগচাষিদের নথিভুক্তিকরণ বিশেষ প্রয়োজন। দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল, ভাগ চাষ সম্পর্কেও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আছে যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে ভাগচাষিদের তাঁদের নিজস্ব জমির মালিক করে তোলা। প্রয়োজন হলে ভাগচাষিদের জন্য যথাযথ অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তাঁরা ক্ষতিপূরণ দিতে পারেন। আর সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণের এই অর্থ ঋণ হিসাবে ভাগচাষিদের দেওয়া উচিত, যা আবার পর্যায়ক্রমে কিস্তিতে তাঁদের কাছ থেকে আদায় করে নিতে হবে। এর ফলে ভাগচাষিরা আরও ভালোভাবে চাষবাস করতে পারবেন এবং জমিদারদের কাছে তাঁদের যে ঋণ থাকবে তা ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির কাছ থেকে কম হারের সুদে প্রাপ্ত ঋণের মাধ্যমে শোধ করা যাবে। তৃতীয় যে প্রস্তাব উঠে আসে তা হল ঊর্ধ্বসীমা সম্পর্কিত আইনের সংশোধন ও তার যথাযথ রূপায়ন। চতুর্থ প্রস্তাব ছিল, জমি সংক্রান্ত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে এবং মামলাগুলিকে আদালত থেকে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত করে সেগুলির দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।

সম্প্রতি ১৯৯১ সালে ভূমিসংস্কার সম্পর্কিত এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় সেই পাটনাতেই, আর সেখানে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এমন কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন যাঁরা ১৯৭৩ সালের আলোচনাক্রেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই কর্মশালা বিগত কুড়ি বছরে ১৯৭৩ সালের প্রস্তাবগুলির কী পরিণতি হয়েছে সে সম্পর্কে আলোচনা করে। তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বিগত কুড়ি বছরে বিহারে ভূমিসংস্কারে প্রক্রিয়া একটুও এগোয়নি। ঊর্ধ্বসীমাকে নামিয়ে আনার ব্যাপারে আইন প্রণয়ন এবং দখলীকৃত জমি বিতরণের কাজে বিন্দুমাত্র অগ্রগতি ঘটেনি। বস্তুত অপ্রাসঙ্গিক হিসাবে অভিহিত করে ভূমিসংস্কারের কর্মসূচিকে সব সময়েই পিছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ঐ কর্মশালা রাজ্য সরকারের কাছে পুনরায় কিছু প্রস্তাব পাঠায় এবং আশা করে যে সেগুলির রূপায়ন হবে। ঐ কর্মশালার বিশেষ প্রস্তাব ছিল, জমির ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করতে হবে এবং এক নতুন পদ্ধতিতে, বর্তমানে জমির ভাগবিন্যাসের যে দুটি ধরন রয়েছে, এখন থেকে তা হবে তিন ধরনের। প্রথমত চাষযোগ্য জমির ঊর্ধ্বসীমা হবে ১৫ একর; অ-চাষযোগ্য জমির ঊর্ধ্বসীমা হবে ২২ একর এবং বন্ধ্যা ও পতিত জমির ঊর্ধ্বসীমা হবে ৩০ একর। দ্বিতীয়ত বেসরকারি ট্রাস্টের অধীনে এবং চিনি কলের নামে জমির জন্য যে সমস্ত ব্যক্তিকে ঊর্ধ্বসীমা সংক্রান্ত ছাড় দেওয়া আছে তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। তৃতীয় প্রস্তাব ছিল, হাইকোর্ট আটকে দেওয়ায় সরকার আগে যে জমি সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারেনি, তা আবার গঠন করতে হবে। আর সেই জন্যই প্রস্তাব ছিল, ট্রাইব্যুনাল যাতে গঠন করা যায় তার জন্য সুপ্রীম কোর্টের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। চতুর্থ প্রস্তাব ছিল, পশ্চিমবঙ্গের ‘অপারেশন বর্গা’র মতো বিহারেও ‘অপারেশন বাটাই’ চালু করতে হবে। বিহারের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা এই সমস্ত প্রস্তাব পাঠালেও বিহার সরকার সেগুলি রূপায়নের পথে যায়নি।

কাজেই আমরা যা বলছি, সেটি শুধু আমাদের কথা নয়। দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা, সমস্ত প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীরা যাঁরাই বিহারের উন্নতি চান, সকলেই এব্যাপারে একমত যে বিহারে ভূমিসংস্কার অসম্পূর্ণ এবং একে সম্পূর্ণ করার মধ্যেই রয়েছে বিহারের উন্নতির চাবিকাঠি। শুধুমাত্র জগন্নাথ মিশ্র ও লালু যাদবরা বা দালাল-বুদ্ধিজীবীরাই কেবল বলে থাকেন বিহারে ভূমিসংস্কারের কোনো প্রয়োজন নেই, আর কৃষিতে নতুন প্রযুক্তিই হল বিহারের সর্বরোগহর দাওয়াই।

সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কৃষিমজুরদের প্রশ্ন এবং তাদের ন্যূনতম মজুরি দেওয়া উচিত। এর জন্য চাষের মরশুম শুরু হওয়ার আগেই স্থানীয় চাষি, কৃষক, কৃষিমজুর, কিষাণ সভার মতো জনগণের সংগঠনগুলি এবং প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের একসঙ্গে বসে সেই মরশুমের জন্য মজুরি নির্ধারিত করা উচিত। একে নিয়মিত ব্যবস্থাপনায় পরিণত করতে হবে, কেননা প্রতি বছরই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় এবং তার ভিত্তিতে মজুরির নতুন হারও ঠিক করতে হবে। দেখতে হবে মজুরির এই হার যেন রূপায়িত হয়, কেননা মজুররা সারা বছর কাজ পায় না। কাজেই তাদের কাজের ব্যাপারে নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে হবে এবং ঘর তৈরি করার জন্য তাদের জমি দিতে হবে। এটিই হবে এক নম্বর কর্মসূচি। দ্বিতীয়ত, জমি নথিভুক্তিকরণের জন্য নতুন করে জরিপ করতে হবে, তারপর জমি শুধু বিতরণ করলেই চলবে না, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষবাসের জন্য যৌথব্যবস্থা ভিত্তিক চাষবাসেরও প্রয়োজন। এছাড়াও, ভাগচাষিদের অধিকারকে সুরক্ষিত করতে হবে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে তাদের কম সুদের হারে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা ভালোভাবে চাষবাস করতে পারে এবং কালক্রমে নিজেরাই নিজেদের জমির মালিক হয়ে ওঠে। এটি হবে আমাদের দ্বিতীয় কর্মসূচি।

তৃতীয় কর্মসূচি হবে, সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে, পুরোনো খালগুলির সংস্কারসাধন করে এবং আরও ভালো উৎপাদনের জন্য জমির গুণগত মানের বৃদ্ধি ঘটিয়ে কৃষির পরিকাঠামোকে শক্তিশালী করে তোলা। চতুর্থ কর্মসূচি হবে কৃষি-উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনা। হাঁস-মুরগি পালন ব্যবস্থাকে চালু করতে হবে। পঞ্চম বিষয় হল; চটকল, চিনিকল অথবা উত্তর বিহারের খাদি বস্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলির মতো বিহারের ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। ষষ্ঠ বিষয় হল, পঞ্চায়েতের মতো সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকেই আমাদের অবশ্যই পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে হবে। আর সপ্তম যে বিষয়টি আমি বলতে চাই তা হল, কিষাণ সভার মতো গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলিকে এই সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করাতে হবে।

আমার মতে, বিহারের উন্নতির জন্য এই কর্মসূচি অপরিহার্য। কিন্তু এর রূপায়ন খুব সহজ ব্যাপার নয়। এর জন্য আমাদের সংগ্রামের এক দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। সর্বপ্রথম সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে জমিদার অথবা ধনী কুলাকদের বিরুদ্ধে এবং তাদেরও বিরুদ্ধে যারা বিভিন্ন ব্যবসার সাথে যুক্ত এবং যারা কূটকৌশলের মাধ্যমে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ও পিছন থেকে আঞ্চলিক রাজনীতিকে পরিচালিত করে। ভোজপুরের কুখ্যাত জমিদার জোয়ালা সিং-এর মধ্যে এই তিনটি গুণই বিদ্যমান ছিল। সে একদিকে বিপুল জমির মালিক, অন্যদিকে অন্ধকার জগতের কাজকর্ম থেকে কামিয়ে নেওয়া কালো টাকা দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা চালাতো এবং ঐ অঞ্চলের গোটা রাজনীতি পরিচালিত করতো। এই ধরনের শক্তিগুলি বিহারের প্রতিটি কোণেই বিদ্যমান এবং আমাদের প্রথম কাজ হল তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করা। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতিপরায়ণ আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধেও তীব্র সংগ্রাম পরিচালনা করা উচিত। তৃতীয়ত এর আগে আমি যে রাজনীতিবিদদের শ্রেণীর কথা বলেছি, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হবে।

সবশেষে আমি বলতে চাই যে, বিহারে শিক্ষাক্ষেত্রে চূড়ান্ত নৈরাজ্যের অবসান ঘটানো প্রয়োজন। চারওহা বিদ্যালয়গুলির (রাখালদের জন্য) মধ্যে সময় নষ্ট না করে কৃষি-প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলি খুলতে হবে। বিহারে প্রযুক্তিগত চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রামলখন সিং যাদব ও তপেশ্বর সিং-এর অপ্রয়োজনীয় বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়গুলির মতো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে এবং সেগুলিকে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। এই প্রসঙ্গে আমি আরও বলতে চাই যে, শিক্ষাকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ আর তাই এই জাতপাতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সংরক্ষণ থাকবে দলিতদের জন্য যার মধ্যে সুবিধাবাদী স্তরটি বাদ যাবে। সংরক্ষণের হারকে ৬০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে, তবে এর মধ্যে মহিলাদের জন্য ন্যূনতম পক্ষে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ রাখতে হবে। কেননা, বিহারে পশ্চাদপদতার ভাঙ্গনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে গেলে নারীদেরই সামাজিক বিকাশের পুরোভাগে আনতে হবে।