(লিবারেশন, মে, জুন ও জুলাই ১৯৯৩-এ প্রকাশিত পার্টি ইতিহাসের সহজবোদ্ধ রূপরেখার সংক্ষেপিত অংশ)
ষাটের দশকের গোড়ার দিকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে মহাবিতর্ক চলাকালীন ১৯৬৪ সালে সিপিআই-এ প্রথম ভাঙ্গন ঘটে এবং সিপিআই(এম)-এর জন্ম হয়। সাধারণের কাছে সিপিআই রুশপন্থী আর সিপিআই(এম) চীনপন্থী বলে পরিচিত ছিল। জাতীয় গণতন্ত্রের লাইন সিপিআই-এর বৈশিষ্ট্য বলে ধরা হত। এই লাইন বলতে বোঝাত ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী একচেটিয়া-বিরোধী অংশ অর্থাৎ জাতীয় বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিত্বকারী নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ভারতের গণতান্ত্রিক রূপান্তরকরণের নেতৃত্বকারী ভূমিকা নেবে আর কমিউনিস্ট পার্টির কাজ হবে ভারতীয় বুর্জোয়াদের একচেটিয়া অংশের বিরুদ্ধে তার পিছনে দাঁড়ানো এবং খুব বেশি হলে জাতীয় বুর্জোয়াদের দোদুল্যমানতার বিরুদ্ধে এক প্রেসার গ্রুপের ভূমিকা পালন করা। অন্যদিকে সিপিআই(এম)-কে চরিত্রায়িত করা হত তার জনগণতন্ত্রের লাইনের দ্বারা, ব্যাপক গণআন্দোলন বিশেষত কৃষক সংগ্রাম গড়ে তোলার উপর জোর দিয়ে এই লাইনে নেহরু কংগ্রেসের সঙ্গে কোনোরকম আঁতাতকে নাকচ করে দেওয়া হয়েছিল।
বিপ্লবের পথ সম্পর্কে আলোচনায় আসা যাক। এ প্রশ্নে সিপিআই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করাকেই একমাত্র রাস্তা হিসাবে ওকালতি করত, আর সিপিআই(এম) সংসদীয় গণতন্ত্রের এক সীমাবদ্ধ ভূমিকার কথাই কেবল স্বীকার করত, যেখানে কমিউনিস্টরা খুব বেশি হলে কয়েকটি রাজ্যে সরকারি ক্ষমতা দখল করতে পারে। সিপিআই(এম)-এর মতে এই ধরনের ক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে জনগণকে বু্র্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন করা ও তার মধ্য দিয়ে শ্রেণী সংগ্রামকে ধারালো করে তোলার জন্য। তাই স্লোগান দেওয়া হয়েছিল “বাম সরকার শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার”।
১৯৬৪ সালে যখন ভাঙ্গন ঘটল তখন স্বভাবতই বিপ্লবী কমিউনিস্টরা সকলেই ছিলেন সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকেই সিপিআই(এম) নেতৃত্ব উপরোক্ত প্রত্যেকটি প্রশ্ন দোদুল্যমানতা দেখাতে আরম্ভ করল আর সেই কারণে একেবারে গোড়া থেকেই এক আন্তঃপার্টি সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল। কমরেড চারু মজুমদারের বিখ্যাত আটটি দলিল ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭-র মধ্যেকার এই সংগ্রামের সবচেয়ে ভালো সংক্ষিপ্তসার। পশ্চিমবাংলায় প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন হওয়ার সাথে সাথে সর্বত্র কর্মীবাহিনীর বিপ্লবী আশা আকাঙ্খা বেড়ে গেল এবং পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জায়গায় জমির লড়াই শুরু হয়ে গেল। বিশেষ করে নকশালবাড়ি অঞ্চলে এই লড়াই উন্নততর স্তরে পৌঁছে গেল এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখোমুখি হল। একদিকে কেন্দ্রীয় সরকারের হুমকির মুখে সিপিআই(এম) প্রাধান্যাধীন সরকার নিজেকে রক্ষা করতে রক্তাক্ত উপায়ে আন্দোলনকে দমন করার পথ বেছে নিল। পার্টি জুড়ে জ্বলে উঠল প্রতিবাদের আগুন। উত্তরপ্রদেশ, দিল্লী, জম্মু ও কাশ্মীরের মতো রাজ্য কমিটিগুলি পার্টি থেকে বেরিয়ে গেল আর অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবাংলার মতো অন্যান্য রাজ্যে সর্বস্তরে বড় ধরনের ভাঙ্গন দেখা দিল।
কমিউনিস্ট বিপ্লবী শক্তিগুলি প্রথমে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সর্বভারতীয় সমন্বয় কেন্দ্রে (এআইসিসিসিআর) নিজেদের সংগঠিত করেন, যার থেকে পরে সিপিআই(এমএল) গড়ে ওঠে। আশির দশকের প্রথম দিকে সিপিএমে আরও একটি ভাঙ্গন ঘটে। তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক পি সুন্দরাইয়ার অনুগামীরা পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এমসিপিআই গড়ে তোলেন। সিপিআই(এম)-এ এখনও ছোটোখাটো ভাঙ্গন ঘটে চলেছে এবং প্রত্যেকবারই প্রশ্ন উঠছে ১৯৬৪-র কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে।
প্রথম পর্যায়ে সিপিআই(এমএল) সমস্ত ধরনের বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান বর্জনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে এবং বিশুদ্ধ চীনা বিপ্লবের ধাঁচে ঘাঁটি এলাকা গড়ে তোলার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার আহ্বান রাখে। রুশ পথ বনাম চীনা পথের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে বহু দিন থেকেই বিতর্ক চলছিল। তেলেঙ্গানার পর এ প্রশ্নে আন্তঃপার্টি সংগ্রাম মাঝপথে থেমে গিয়েছিল। তখন ঠিক করা হল, বিষয়টি এবার চূড়ান্তভাবে ফয়সালা করতেই হবে।
ষাটের দশকের শেষভাগে ও সত্তরের দশকের শুরুতে সিপিআই(এমএল)-এর নেতৃত্বে যে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল তা সশস্ত্র বিপ্লব সংগঠিত করার এযাবৎকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা হিসাবে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভারতীয় বিপ্লবের বেদীমূলে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সহ হাজার হাজার পার্টি নেতা ও কর্মীর প্রাণ উৎসর্গ করার এই বীরত্বগাথা ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য হয়ে রয়েছে। ভাবী প্রচেষ্টার স্বার্থে এই ঐতিহ্যকে অবশ্যই সযত্নে লালন-পালন করতে হবে।
কিন্তু সেই সশস্ত্র সংগ্রাম গুরুতর ধাক্কার সম্মুখীন হল। পার্টিও অসংখ্য গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে গেল। পুরোনো লাইনের ভিত্তিতে আন্দোলনকে পুনর্জীবিত করা ও পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করার সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। কয়েকটি গোষ্ঠী সুবিধাবাদ ও অধঃপতনের পাঁকে গভীরভাবে নিমজ্জিত হল আর কয়েকটি পরিণত হল পুরোদস্তুর নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীতে। পিপলস ওয়ার হল শেষোক্তদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। আমরাই ছিলাম একমাত্র গোষ্ঠী যারা অন্ত্যন্ত কঠিন সময়ে বিহারের ভোজপুরে নকশালবাড়ির মশালকে জ্বালিয়ে রেখেছিল। যখন অন্যান্য সবকটি গোষ্ঠী কার্যত টুকরো টুকরো হয়ে পড়েছিল তখন আমাদের গোষ্ঠীই ধাপে ধাপে নিজেকে পুনর্গঠিত করে এবং এক দশকেরও বেশি সময় জুড়ে কষ্টসাধ্য লড়াইয়ের পরে পার্টি ও আন্দোলনকে জাতীয় স্তরে পুনর্জীবিত করে।
মার্কসীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আমাদের পার্টি এটা বুঝতে পেরেছিল যে একটি আন্দোলনকে কখনই পুরোনো শ্লোগানের ভিত্তিতে পুনর্জীবিত করা যায় না। যে নতুন পর্যায়ের মধ্যে আমাদের আন্দোলন প্রবেশ করেছিল পার্টি সে সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন চালায়। বিহারে অর্থাৎ একটি হিন্দিভাষী এলাকায় নিজের পুনরুত্থানের ঘটনাটি সে বিশেষ গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য করে। পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় পার্টি একপ্রস্থ নমনীয় কর্মনীতি ও কৌশল গ্রহণ করে, ধাপে ধাপে ও সতর্কতার সঙ্গে বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে খাপ খাইয়ে কাজ চালাতে থাকে এবং কয়েকটি নতুন ও সাহসী পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে। যেসব গুরুতর নৈরাজ্যবাদী প্রবণতা আমাদের মধ্যে থেকে গিয়েছিল, তা ঝেড়ে ফেলার উদ্দেশ্যে পার্টি ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে নিজের শিকড়ের ওপর গুরুত্ব দেয়। সাথে সাথেই সে মূলধারার বাম ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে নতুন রূপে দুই কৌশলগত লাইনের মধ্যেকার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
সুবিধাবাদী কৌশলগত লাইনের বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য বিপ্লবী কাঠামোর মধ্যে মূল ধারার বামদের কয়েকটি জনপ্রিয় স্লোগানকে আত্মস্থ করে নেওয়ার নমনীয়তাও সে দেখিয়েছে। আমাদের পার্টি এটা করেছে সাফল্যের সঙ্গে, অর্থাৎ নিজস্ব নীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, নিজের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে এবং ঐক্য বজায় রেখে। এর ফলে অন্যান্য বাম পার্টির সঙ্গে আরও বেশি করে আন্তঃক্রিয়া চালাতে ও তাদের কর্মীবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক গড়ে তুলতে আমাদের সুবিধা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় নিজের নিজের সুবিধাবাদী নেতৃত্বের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে বাম কর্মীবাহিনী আরও বেশি করে আমাদের পক্ষে চলে আসছেন।
কলকাতা কংগ্রেসের সাথে সাথে আমাদের পার্টি এক নতুন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। মার্কসবাদী তত্ত্বের ক্ষেত্রে, ভারতের বাম ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐক্যের দিক থেকে এবং সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ – দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অভ্যন্তরে বামপন্থী কেন্দ্রকে সংহত করার জন্য তাকে আরও অনেক বড় ধরনের ভূমিকা নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন : সিপিআই(এম) শুরু করেছিল চীনপন্থী পরিচিতি দিয়ে, আর দ্রুতই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন উভয়ের থেকেই সমদূরত্বের তত্ত্ব গড়ে তুলল। রুশ-চীন মৈত্রী ভেঙ্গে যাওয়ার পর সমাজতান্ত্রিক শিবিরের কোনও অস্তিত্ব আর না থাকা সত্ত্বেও সে সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের কথা বলে যেতে লাগল। ক্রুশ্চেভীয় সংশোধনবাদের বিরোধিতা সে করেছিল ঠিকই, কিন্তু শান্তিপূর্ণ বিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে পুঁজিবাদের পুনঃপ্রবর্তনের বিপদ সম্পর্কে মাও-এর তত্ত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল। সিপিআই(এম) সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহৎ শক্তিসুলভ অবস্থান এবং চেকোশ্লোভাকিয়া ও আফগানিস্তান আক্রমণের মতো সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদী ধরনের কার্যকলাপকে সমর্থন করে যেতে লাগল। এই “বিপ্লব রপ্তানি”কে সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদ বলে সমর্থন করতে লাগল আর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলল ব্রেজনেভ জমানার সঙ্গে। সেই ব্রেজনেভ জমানা, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত জমানা বলে পরিগণিত।
সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে সমস্ত সমালোচনাকে সিপিআই(এম) সাম্রাজ্যবাদী প্রচার বলে নাকচ করে দিয়েছে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সিআইএ-র চক্রান্ত ও অন্যান্য বহিরাগত বিপদের কথা বারবার বলতে থেকেছে। তত্ত্বগত স্তরে সমাজতান্ত্রিক সমাজের অভ্যন্তর থেকে পুঁজিবাদে শান্তিপূর্ণ বিবর্তন প্রসঙ্গে মাও-এর চমৎকার বিশ্লেষণ নাকচ করে দেওয়ায় তাদের কাছে হয়তো আর কোনও পথ খোলাও ছিল না। কিন্তু তাদের সমস্ত তাত্ত্বিক কসরৎ সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের পতন রোধ করা গেল না। আর এটা শুধুমাত্র সমাজতন্ত্রেরই পতন ছিল না। পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থানের মুখে সমগ্র সোভিয়েত সাম্রাজ্যটাই তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়ল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে সাথে চমৎকার ভারসাম্যমূলক সমদূরত্বের তত্ত্বও মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং সিপিআই(এম) এখন চীনের আরও কাছাকাছি চলে এসেছে। আর চীনের ক্ষেত্রেও সেই একই ‘সর্বহারা সংহতি’ সে অনুসরণ করে চলেছে, যার অর্থ হল তিয়েন-আন-মেন ট্রাজেডির মতো ঘটনাকেও বাহ্যিক কারণ তথা সিআইএ-র চক্রান্তের ফল হিসাবে দেখা।
সিপিআই(এম) নেতারা আজকাল সোভিয়েত পতনের পেছনে কিছু কিছু অভ্যন্তরীণ কারণের কথা কখনও সখনও বলছেন বটে, কিন্তু তাঁরা পুঁজিবাদের পুনঃপ্রবর্তনের গতিসূত্রকে ধরতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। সোভিয়েত বৃহৎশক্তির আধিপত্যমূলক কার্যকলাপ ও শেষপর্যন্ত অনেকগুলি জাতীয় ও জাতিগোষ্ঠীগত সত্তায় তার খণ্ড বিখণ্ড হয়ে পড়া – ব্যবহারিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এ দুয়ের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কটিকেও তাঁরা ধরতে পারেননি।
মহাবিতর্কে আমাদের পার্টি ক্রুশ্চেভীয় সংশোদনবাদের বিরুদ্ধে মাও-এর অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানিয়ে এসেছে, প্রকৃত আন্তর্জাতিকতাবাদী মনোভাব নিয়ে সমাজতান্ত্রিক চীনকে সমর্থন জানিয়েছে। চীনের প্রতি আমাদের সমর্থন অত্যুৎসাহের দোষে দুষ্ট হয়ে থাকতে পারে কিন্তু তার সঙ্গে বিপ্লব আমদানি বা রপ্তানির কোনো সম্পর্ক ছিল না। কারণ মাও সবসময়ই সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠিক এই প্রশ্নেই তীব্রভাবে সমালোচনা করতেন। অনুরূপভাবে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপের প্রতি আমাদের সমালোচনার ক্ষেত্রে সমগ্র ব্যবস্থাটিকে সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদী আখ্যা দেওয়া এবং দুটি বৃহৎ শক্তির মধ্যে সোভিয়েতকে বেশি বিপজ্জনক বলে মনে করার মধ্যে হয়তো বাড়াবাড়ি থাকতে পারে। কিন্তু পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আমাদের সমালোচনা তথা তার আধিপত্যবাদী কার্যকলাপের ব্যাপারে আমাদের বিরোধিতাই ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।
মার্কসবাদ সংক্রান্ত বুনিয়াদী বিষয়সমূহ নিয়ে চীন আজ আর কোনো বিতর্ক চালাচ্ছে না। সে কোনো সাম্রাজ্যবাদী ঘেরাও-এর সম্মুখীনও নয়। ভারতীয় শাসকশ্রেণীও আর চীনের প্রতি আগের মতো শত্রুভাবাপন্ন নেই। সে সমাজতন্ত্র গঠনের যে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে তা মনোযোগের সঙ্গে ও বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে অধ্যয়ন করা দরকার। তাছাড়া, সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পরে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রশ্নটি আরও অনেক বেশি গুরুত্ব অর্জন করেছে। আজকের দিনে একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ওপরে টেক্কা দিতে হবে। এইসব কারণে আমরা বিশ্বাস করি যে, চীনকে আমাদের স্বাধীনভাবে বিচার করতে হবে সে দেশের পরিস্থিতি অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকা একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসাবে। চীনা সমাজতন্ত্রকে সাধারণভাবে সমর্থন করার পাশাপাশি আমরা তার কিছু নির্দিষ্ট কর্মনীতিকে (বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রশ্নে) সমালোচনা করার অধিকার সংরক্ষিত রেখেছি। এই অর্থে আমরা নিশ্চিতভাবে এবং সঠিকভাবেই চীনের কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে এসেছি। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি যে এতে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন ধরন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে – যা হবে আরও স্পষ্ট আরও খোলামেলা।
সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ ও উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি সাধারণ সমর্থন জানানো, সাধারণভাবে সাম্রাজ্যবাদের ও বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মুক্তি আন্দোলনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা – নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাধারণ লাইন কেবল এটাই হতে পারে। ঘটনা প্রবাহ দুনিয়ার কমিউনিস্টদের মোটামুটিভাবে এই সাধারণ লাইনকে গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে।
ষাটের দশকের প্রথমদিকে ভারতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক মহাবিতর্কের ঝড় ওঠে। জনপ্রিয়ভাবে এই বিতর্ক জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যেকার সংগ্রাম নামেই পরিচিত। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লাইন বাহ্যিক দিক থেকে অ-পুঁজিবাদী পথে বিকাশ সংক্রান্ত ক্রুশ্চেভীয় তত্ত্বের দ্বারা এবং অভ্যন্তরীণ দিক থেকে নেহরু অনুসৃত মিশ্র অর্থনীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর (অর্থাৎ নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের) সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, একচেটিয়া ঘরানা বিরোধী ও সামন্ততন্ত্র বিরোধী ভূমিকার ওপর নির্ভর করেছিল এই লাইন। এতে আশা পোষণ করা হয়েছিল যে ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে বিপুল সোভিয়েত সাহায্যের ফলে কালক্রমে ভারতবর্ষে সমাজতন্ত্র এসে যাবে। সিপিআই এই লাইন সরকারিভাবে গ্রহণ করে এবং এর ফলে কংগ্রেসের লেজুড়-পার্টিতে পরিণত হয়। এর বিপরীতে জনগণতন্ত্রের লাইন কংগ্রসকেই মূল শত্রু হিসাবে গণ্য করার ওপর জোর দেয়, নেহরুর মিশ্র অর্থনীতিকে পুঁজিবাদেরই নামান্তর বলে মনে করে এবং শক্তিশালী সামন্ত অবশেষই যে ভারতের বিকাশের পথে প্রধান বাধা হয়ে আছে একথা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করে। সিপিআই(এম) নেতৃত্ব জনগণতন্ত্রের পথ বেছে নেয়। কিন্তু প্রথম থেকেই তার অবস্থান ছিল অস্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, সে বলে যে স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি স্তর সমাধা হয়ে গেছে। এর একমাত্র অর্থ হতে পারে যে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিকটির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, কিন্তু সামন্ততন্ত্র বিরোধী দিকটি এখনও রয়ে গেছে। ভারতের বৈদেশিক নীতিকে প্রগতিশীল আর অভ্যন্তরীণ নীতিকে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দেওয়ার পিছনে এই সূত্রায়নই কাজ করেছে। কাজেকাজেই তারা দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের বৈদেশিক নীতিকে সমর্থন করে এসেছে এবং সেটি বিশেষ করে আরও এই কারণে যে ঐ নীতিগুলি সোভিয়েত বিদেশনীতির ধারণার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিনী পরাক্রমের মোকাবিলা করবে – দীর্ঘদিন ধরে লালিত পার্টির এই কল্পকথা যখন তাসের ঘরের মতো ধ্বসে পড়ল কেবলমাত্র তখনই ভারতের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিদেশনীতি সম্পর্কে তার মোহগ্রস্ততাও নির্মম ধাক্কা খেল। বিদেশনীতির ক্ষেত্রে ১৯৮০-র দশক থেকেই ভারত খোলাখুলিভাবে সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা অবস্থান গ্রহণ করে আসছে। সিপিআই(এম) এই রূপান্তরের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছে। সেই দিক থেকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা যে এখনও ভারতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অন্যতম প্রধান কর্তব্যকর্ম হয়ে রয়েছে সিপিআই(এমএল)-এর এই অবস্থান ভারতের বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে এইসব প্রকাশ্য পরিবর্তনের দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৬২ সালে চীনের বিরুদ্ধে যে জাতীয়তাবাদী জিগির উঠেছিল সিপিআই-এর মধ্যকার বিপ্লবী অংশ সেই জোয়ারে গা ভাসাতে অস্বীকার করে এবং ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময়ও বামপন্থী কমিউনিস্টরা উভয় দেশের শাসকশ্রেণীর নিন্দা করে। কিন্তু ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় থেকে সিপিআই(এম) প্রতিবেশী দেশগুলির, বিশেষত পাকিস্তানের প্রতি ভারতীয় শাসকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গির কট্টর সমর্থকে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের বৃহত্তম দেশ হওয়ার দরুণ ভারত যে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী উচ্চাকাঙ্খা পোষণ করে একথা মানতে সে অস্বীকার করে। নিজ দেশের শাসকশ্রেণীর উগ্র জাতীয়তাবাদকে সমর্থন জানানো সর্বদা ও সর্বত্র সংশোধনবাদের সবচেয়ে বড় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে রয়েছে। কাজেই ভারতীয় শাসকশ্রেণীর আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের দৃঢ় ও ধারাবাহিক বিরোধিতা অবশ্যই ভারতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হবে এবং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে পার্টি উগ্র জাতীয়তাবাদী নীতি অনুসরণ করে সে কখনই গণতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারে না।
সিপিআই(এমএল) প্রথম থেকেই ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশগুলির ওপর ভারতীয় আধিপত্য কায়েম করার সমস্ত অভিব্যক্তির বিরোধিতা করে এসেছে। এটিকে আমরা সর্বহারা আন্তর্জাতিকতাবাদ যাচাই করার কষ্টিপাথর বলে মনে করি এবং এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কিউবা, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা প্যালেস্তাইনকে সমর্থন জানানোর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী সম্পর্কে সিপিআই(এম)-এর সূত্রায়ন ছিল, ঐ শ্রেণী সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে ক্রমশই আপোশপন্থী লাইন গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে যে ধারণা অন্তর্নিহিত ছিল তা হল, ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যে দোদুল্যমানতা ও আপোশের কিছু দিক থাকলেও, তারা মূলত স্বাধীন বুর্জোয়া শ্রেণী। সিপিআই-এর মতো সিপিআই(এম)-ও এই মোহ পোষণ করতে শুরু করে যে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বৃহৎ বুর্জোয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে এক ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তির ভূমিকা পালন করছে। ব্যাঙ্ক জাতীয়কণের মতো ইন্দিরা গান্ধীর জাতীয়করণের পদক্ষেপগুলিকে বৃহৎ বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ধরে নিয়ে সে সেগুলিকে সমর্থন করতে শুরু করে।
এইসব অবস্থানের ফলে বিভিন্ন জটিল সন্ধিক্ষণও কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক সহযোগিতা গড়ে ওঠে, যেমন সিণ্ডিকেটের বিরুদ্ধে ইন্দিরা কংগ্রেসের পক্ষ নেওয়া, গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করা এবং সম্প্রতি কংগ্রেস(ই)-কে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্ট গড়ার ওকালতি করা। বিশ্বব্যাঙ্ক ও আইএমএফের নির্দেশেই ভারত সরকারের নতুন অর্থনৈতিক নীতি অনুসৃত হওয়ায় ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর মৌলিক চরিত্রায়ন সম্পর্কে সিপিআই(এম)-এর মধ্যে আবার প্রশ্ন ওঠে, ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীকে মুৎসুদ্দি হিসাবে অভিহিত করার একটি প্রস্তাবও বিগত কংগ্রেসে ওঠে, কিন্তু নেতৃত্ব ঐ প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
যে সূত্রায়নকে কেন্দ্র করে এই পার্টির সমগ্র সুবিধাবাদ ঘুরপাক খাচ্ছে তা হল, “শক্তিসমূহের সামাজিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটানোর জন্য শাসকশ্রেণীগুলির মধ্যকার ও পারস্পরিক দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে নেওয়া”। এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগানোর সুযোগকে এত বেশি অতিরঞ্জিত করে দেখা হয়েছে যে পার্টি এর ওপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। এর ফলে পার্টি বুর্জোয়া রাজনীতির পঙ্কিল আবর্ত ও রাজনৈতিক ধড়িবাজির গভীরে নিমজ্জিত হয়েছে। তার গুরুত্বপূর্ণ পার্টি নেতারা বুর্জোয়া রাজনীতিকদের ওপরতলার লোকজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাতে ও তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করতেই ব্যস্ত থাকেন।
কৌশলের ক্ষেত্রে, ডিএমকে, তেলেগু দেশম, জনতা দল, আকালি দল প্রভৃতি আঞ্চলিক ও মধ্যপন্থী দলের মতো বিরোধী দলগুলির সঙ্গে আঁতাত গড়ে তোলার ওপরই সিপিআই(এম) সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। এই ধরনের আঁতাতের বিনিময়ে ঐ সমস্ত দলের মূল সামাজিক ভিত্তি কুলাক শ্রেণীর বিরুদ্ধে কৃষি-শ্রমিক ও দরিদ্র কৃষকদের সংগ্রামকে সে জলাঞ্জলি দিয়েছে। কাজেই, সামন্তবিরোধী সংগ্রাম অথবা গ্রামাঞ্চলে বিকাশমান নতুন শ্রেণীসংগ্রামগুলির সম্মুখ সারিতে তাদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এইভাবে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল ভিত্তিকেই খাটো করে দেখা হয়েছে। পার্টির গণতান্ত্রিক কর্মসূচির সমগ্র অভিঘাত পর্যবসিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রীবাদ, রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা, পঞ্চায়েতের হাতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি সাধারণ গণতান্ত্রিক শব্দগুচ্ছে।
অন্যদিকে সিপিআই(এমএল) নয়াগণতন্ত্র সম্পর্কে মাওয়ের দিকনির্দেশের ওপর ভিত্তি করে জনগণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। সে ভারতবর্ষকে আধা-উপনিবেশ হিসাবে অভিহিত করেছে, যার অর্থ হল, ভারতীয় রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও, ভারতীয় রাষ্ট্রের নীতিসমূহকে প্রভাবিত ও পরিচালিত করার মতো যথেষ্ট প্রতিপত্তি তার এখনও আছে। আর এটি সে করে থাকে ভারতীয় বুর্জোয়াদের মাধ্যমেই, যে বুর্জোয়ারা চরিত্রগত দিক থেকে মূলত নির্ভরশীল। তাদের সমস্ত আপেক্ষিক স্বাধীনতা অর্থাৎ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মধ্যে দরকষাকষি করার ক্ষমতা নির্ভরশীলতার এই সামগ্রিক কাঠামোরই অধীন। এই কারণে সিপিআই(এমএল) একেবারে শুরু থেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর পক্ষে বড় ধরনের কোনো গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটানো আর সম্ভব নয় এবং সর্বহারাকেই নেতৃত্ব হাতে তুলে নেওয়া উচিত। বৈদেশিক সম্পর্ক তথা অভ্যন্তরীণ নীতি – এই উভয় ক্ষেত্রেই ভারতীয় শাসকদের কপটতার মুখোশ খুলে ধরার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা আমরা চালিয়েছি। এর ফলে আমাদের পার্টি ভারতীয় শাসকশ্রেণীগুলির সঙ্গে পার্থক্যের সীমারেখা সুস্পষ্টভাবে বজায় রাখতে ও অবিচল গণতন্ত্রের প্রধান প্রবক্তা হিসাবে সামনে ওঠে আসতে সমর্থ হয়েছে।
সিপিআই(এমএল) সবসময়েই গ্রামাঞ্চলে সামন্ত-বিরোধী সংগ্রাম তথা সবুজ বিপ্লব পরবর্তী পর্যায়ে কুলাকদের বিরুদ্ধে কৃষিমজুর ও দরিদ্র কৃষকদের শ্রেণীসংগ্রামের ওপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে এসেছে।
নাগরিক স্বাধীনতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রবাদ পর্যন্ত গণতন্ত্রের সমস্ত ইস্যুগুলিকেই সিপিআই(এমএল) ধরেছে এবং সম্ভাব্য ব্যাপকতম গণতান্ত্রিক জোট গড়ে তুলতে আগ্রহী হয়েছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে সে সর্বদা তার শ্রেণী-স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক উদ্যোগ বজায় রাখার ওপরই জোর দিয়েছে।
সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে বর্তমান বিতর্কে আমরা লেজুড়বৃত্তির বিরুদ্ধে যে তীব্র সমালোচনা রেখেছি এবং যে ধারাবাহিক জোর দিয়েছি তা কিছু বিমূর্ত নীতিমালা বা নিছক কিছু কৌশলগত পদক্ষেপের প্রশ্ন নয়। এগুলি জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রস্তুতির জন্য মৌলিক উপাদান। এই বিষয়টি বুঝতে না পারলে ভারতবর্ষে জনগণতন্ত্রের দুই কৌশলের মধ্যেকার সংগ্রামকে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
বুর্জোয়া সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে মার্কসবাদী ও সংশোধনবাদীদের মধ্যে বিতর্ক অনেক দিনের। বহুকাল আগে লেনিন যখন বার্নস্টাইন ও মেনশেভিকদের যুক্তি কার্যকরীভাবে ধুলিসাৎ করেন, তখন মনে হয়েছিল এই বিতর্কের মীমাংসা হয়ে গেছে। বাস্তবেও দেখা গেল, পশ্চিম ইউরোপে সংশোধনবাদীরা সমাজগণতন্ত্রীতে অধঃপতিত হলেন, পরিণত হলেন বুর্জোয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার লেজুড়ে। বিপরীতে, রাশিয়া ও চীনে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বিপ্লব সাফল্য লাভ করল। ষাটের দশকের গোড়ায় ক্রুশ্চেভ ঐ বিতর্ক আবার চাগিয়ে তুললেন এই অজুহাতে যে একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবিরের উদ্ভবের ফলে শক্তির ভারসাম্যে যে আমূল পরিবর্তন এসেছে তা এক ‘নতুন পরিস্থিতির’ জন্ম দিয়েছে। এই যুক্তি দেখানো হয়েছিল, শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতায় সাম্রাজ্যবাদকে পরাস্ত করতে আজ সমাজতন্ত্র যথেষ্ট সমর্থ এবং তাই সংসদীয় উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতায় উত্তরণের নতুন সুযোগ আজ কমিউনিস্টদের সামনে উপস্থিত। আণবিক যুদ্ধের বিপদকেও ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা’ ও ‘শান্তিপূর্ণ উত্তরণের’ সপক্ষে যুক্তি হিসাবে খাড়া করা হয়।
ভারতবর্ষে সিপিআই সোৎসাহে এই চিন্তাধারায় সামিল হয়ে যায় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে এমন এক লাইন গ্রহণ করে যাতে সমস্ত জোর থাকে আরও বেশি বেশি সংসদীয় আসন জয় করা এবং এইভাবে গরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতালাভের ওপর। এই লাইন সংসদীয় পথ নামে পরিচিত। সংসদীয় গরিষ্ঠতা সিপিআই-এর কাছে আজও মরীচিকা। ইতিমধ্যে ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা’র দূর্গটাই ধুলিসাৎ হয়ে গেছে আর সিপিআই কার্যত একটি সমাজগণতান্ত্রিক পার্টিতে পর্যবসিত হয়েছে।
বিশ্বের মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা ক্রুশ্চেভের হাজির করা সংসদীয় পথকে প্রত্যাখ্যান করেন। ভারতবর্ষে সিপিআই ভেঙ্গে সিপিআই(এম)-এর জন্মের পিছনেও এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে থেকেছে। সিপিআই(এম) সংসদীয় ও সংসদ-বহির্ভূত সংগ্রামের সমন্বয়ের পক্ষে রায় দেয়। সংসদীয় গরিষ্ঠতার বলে ক্ষমতা অর্জনের সম্ভাবনাকে সে নাকচ করে। নির্বাচনের মাধ্যমে কয়েকটি রাজ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের বিষয়টিকে একটি সম্ভাব্য পন্থা হিসাবে গণ্য করা হয়। শর্ত রাখা হয় যে পার্টি সেই সমস্ত রাজ্যেই সরকারে অংশগ্রহণ করবে যেখানে তারা নেতৃত্বকারী শক্তি, নিদেনপক্ষে সরকারের কাজের ধারাকে প্রভাবিত করার সামর্থ রাখে। এখানে সরকারি ক্ষমতাকে রাষ্ট্রক্ষমতার থেকে পৃথক করে দেখা হয়েছিল এবং বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে সরকারি ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করাকেই পার্টির সুনির্দিষ্ট কাজ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে এভাবে জনগণের রাজনৈতিক চেতনার মান উন্নত করা যাবে, তাঁদের প্রস্তুত করা যাবে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণ হানতে। একমাত্র এই নির্দিষ্ট অর্থেই বামফ্রন্ট সরকারকে শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে দেখা হয়েছিল।
১৯৫৭ সালে কেরালায় কমিউনিস্ট সরকারের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দিয়েছে যে কেন্দ্র ঐ ধরনের কোনো সরকারকে কাজ করতে দেবে না এবং তা সংসদীয় ব্যবস্থার কপটতাকে উন্মোচিত করার আরও একটি সুযোগ এনে দেবে ও এইভাবে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করবে।
পার্টি কর্মীরা এইভাবেই সংসদীয় সংগ্রামের প্রশ্নে সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর মধ্যেকার পার্থক্য বুঝেছিলেন।
এক শক্তিশালী গণআন্দোলনের ওপর ভর করে ও বিপ্লবী কথাবার্তা বলে ১৯৬৭ সালে সিপিআই(এম) পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় আসে। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট স্থায়ী হয়নি। ১৯৬৯-এর সাফল্যও ছিল স্বল্পমেয়াদী এবং ১৯৭৭ পর্যন্ত রাজ্যে এক শ্বেত সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। ১৯৭৭ সালে বর্তমান বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে জাতীয় রাজনীতিতে এক অভিনব ঘটনাপরম্পরার ফলশ্রুতিতে। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে রাজ্যে তখন গণআন্দোলন স্তিমিত আর সিপিআই(এম)-এর পার্টি সংগঠনও স্থানু হয়ে গেছে। তারপর থেকে গত ষোল বছরে কেন্দ্রে শাসক কংগ্রেস(ই) সংসদীয় খেলার নিয়ম মেনেই চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকার বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিশেষ চেষ্টা করেনি। ‘বামফ্রন্ট সরকার সংগ্রামের হাতিয়ার’ ইত্যাদি স্লোগান বা কেন্দ্রের বিরোধিতার যাবতীয় বুলি পার্টির শব্দভাণ্ডার থেকে নিঃশব্দে অন্তর্হিত হয়েছে। বুর্জোয়া সংসদের কপটতাকে উন্মোচিত করার পরিবর্তে এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ‘জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের’ মহিমাকীর্তন ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে এতদিন ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকার অনুপম দৃষ্টান্তকে তুলে ধরার ওপর। বিধানসভা ও সংসদে আসনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য এই পার্টি বিভিন্ন বুর্জোয়া দলবলের সঙ্গে যেভাবে ঢলাঢলি করছে, এমনকি জাতীয় মোর্চা-বামমোর্চা সমন্বয়ের মাধ্যমে কেন্দ্রে ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার কথা বিবেচনা করছে, তাতে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে এই পার্টির শিকড় আজ সংসদীয় পথের গভীরে গেঁড়ে বসেছে।
সিপিআই(এম)-এর মধ্যে সংসদ-সর্বস্বতার প্রথম লক্ষণগুলি ফুটে ওঠার সাথে সাথে নকশালবাড়িতে বিপ্লবী কমিউনিস্টরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। কিছুদিনের মধ্যে সিপিআই(এমএল)-এর গঠন হয় এবং তা সংসদীয় পথ বর্জন করে। সংসদীয় সংগ্রামকে সর্বাংশে বর্জন করার প্রশ্নে বিতর্ক অবশ্য সিপিআই(এমএল)-এর মধ্যে কোনো দিন থেমে থাকেনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মহলেও এটি একটি বিতর্কিত বিষয় হিসাবেই থেকেছে। সিপিআই(এমএল) সংসদীয় পথ, অর্থাৎ বুর্জোয়া সংসদে গরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের লাইনকে সবসময়েই প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। কিন্তু সংসদীয় সংগ্রামকে কাজে লাগানোর প্রশ্নে সে ক্রমে ক্রমে এক সর্বাঙ্গীণ ও নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটিয়েছে। সংসদ-বহির্ভূত সংগ্রামের সাথে সংসদীয় সংগ্রামকে সমন্বয়ের – যার মধ্যে সংসদ-বহির্ভূত সংগ্রামেরই থাকবে মুখ্য ভূমিকা – মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পরিপ্রেক্ষিতের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে সিপিআই(এমএল)-এর এই দৃষ্টিভঙ্গি। একইসাথে, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কৌশল হিসাবে পার্টি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পরিস্থিতিতে নির্বাচন বয়কটের বিষয়টি বাতিলও করে না, আবার পিছু হটার সময়ে নির্বাচনের বিশেষ ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার সম্ভাবনাও অস্বীকার করে না। আরও বিশেষ করে, ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে যখন কিছু কিছু রাজ্যে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে সরকার গঠনের বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে, তখন এই সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা তথা প্রকৃত অর্থেই শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করবে বাম সরকারের এমন এক বিকল্প মডেল হাজির করা পার্টির কাছে অত্যন্ত জরুরি।
চীনের পথ বনাম রাশিয়ার পথের বিতর্কে আমাদের পার্টি চীনের পথ বেছে নিয়েছিল, যার অর্থ শক্তিশালী লাল ফৌজ তৈরি করে গ্রামাঞ্চলে লাল রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা, এইভাবে শহরগুলিকে ঘিরে ফেলে সেগুলিকে মুক্ত করা। এই পথে যাত্রা শুরু করার সময়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে বিপ্লবের সমগ্র পর্যায় জুড়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো প্রশ্নই নেই এবং এইভাবে নির্বাচন বয়কটকে একটি রণনীতিগত তাৎপর্যে মণ্ডিত করা হয়।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চীনের পথ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পর পার্টি তার অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ভারতের পরিস্থিতিতে চীনের ঐতিহাসিক মডেলকে অন্ধভাবে অনুকরণ করা ভুল। মুল বিষয় হল, ভারতের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও-এর চিন্তাধারাকে একাত্ম করা। চীনে যেহেতু সংসদই ছিল না, সংসদীয় সংগ্রামের প্রশ্নই সেখানে ওঠেনি। ভারতের পরিস্থিতি অন্যরকম। কাজেই গোড়ার দিকে অগ্রগতির পর্যায়ে, বিশেষ করে নতুন এক বিপ্লবী দিশায় যাত্রারম্ভের নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে, নির্বাচন বয়কট সঠিক থাকলেও, ভারতীয় কমিউনিস্টরা সংসদীয় সংগ্রামকে চিরদিনের জন্য বর্জন করতে পারেন না এবং তা করা উচিতও নয়। এইভাবে নির্বাচন বয়কটকে কৌশলগত প্রশ্নে পরিণত করা হল। পার্টি আজও গ্রামাঞ্চলের ওপর ও কৃষক জনতার জঙ্গী প্রতিরোধ সংগ্রামের বিকাশের ওপর জোর দেয়। কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জনগণের সশস্ত্র শক্তির সাহায্যে ঐ বিস্তীর্ণ অঞ্চল সমান্তরাল শক্তির কেন্দ্র হিসাবে বিকাশলাভ করে জাতীয় স্তরে শক্তির ভারসাম্যে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
পার্টি দৃঢ়ভাবে সংসদীয় পথকে প্রত্যাখ্যান করে চলেছে আর সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পঞ্চম কংগ্রেসে পার্টি পুনরায় ঘোষণা করেছে যে চূড়ান্ত বিচারে একমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামই ভারতীয় বিপ্লবের ফলাফল নির্ধারণ করবে। এই বুনিয়াদী পরিপ্রেক্ষিতের ওপর ভিত্তি করেই পার্টি বিপ্লবের বিভিন্ন পর্যায়ে সংসদীয় ও সংসদ-বহির্ভূত সংগ্রামের সমন্বয়ের বিভিন্ন রূপ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিবে যাবে। আর এইভাবেই নির্ধারিত হবে বিপ্লবের ভারতীয় পথ।