(ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অবসান এক এককেন্দ্রিক বিশ্বের জন্ম দিয়েছে। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় তা প্রতিফলিত হয়েছিল, যখন সব বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চারপাশে এক মহাজোটে সামিল হয়েছিল। তবে, এটা সাময়িক বলে প্রমাণিত হয়েছিল। যখন, ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় যুদ্ধের দ্বিতীয় সংস্করণ ঘটাতে চাইল, মহাজোটে ফাটল দেখা দিল। রাশিয়া প্রকাশ্যে সমালোচনা করল, ফ্রান্স তার প্রতিবাদ লিপিবদ্ধ করালো, চীন সাদ্দামকে অভিনন্দন জানাল, জাপান সংযত হওয়ার উপদেশ দিল, এমনকি আরব মিত্ররা পর্যন্ত মুখ ঘুরিয়ে নিল।
ন্যাটোর সম্প্রসারণের প্রশ্নে অভ্যন্তরীণ মতভেদ রীতিমতো প্রকট হল। ১৯৯১-এর পর থেকে, অর্থাৎ ঠাণ্ডা লড়াইয়ের অবসানের সাথে সাথে, ফ্রান্স ও জার্মানি সারা ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার ধারণা তুলে ধরছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই আশঙ্কা আছে যে, জার্মানি একবার নিজে বা ফ্রান্সের সাথে যুক্ত হয়ে, মধ্য ইউরোপে আধিপত্যকারী শক্তি হয়ে উঠলে, তারা ইউরেশিয়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে রাখতে রাশিয়ার সাথে কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারে। এক স্বাধীন রণনৈতিক সত্তা হিসাবে ইউরোপীয়দের গড়ে ওঠাকে বাধা দিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণে নেমে পড়ে এবং কোন কোন দেশকে গ্রহণ করা হবে, এব্যাপারে তার একতরফা সিদ্ধান্তকে চাপিয়ে দেয়। ইউরোপকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বেঁধে রাখতে ও আমেরিকার এককেন্দ্রিক আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ এক গুরুত্বপূর্ণ উপায়। মস্কো ন্যাটোর এই সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক সাহায্য এবং ভেটো অধিকার ছাড়া তার বক্তব্য রাখার সুযোগ থাকবে এমন এক ন্যাটো-রাশিয়া স্থায়ী যুক্ত পরিষদের বিনিময়ে রাশিয়াকে তা স্বীকার করে নিতে হয়েছিল।
যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে “ইতিবাচক সম্পর্কে”র কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে সে নাছোড়বান্দাভাবে চীনকে রোখার নীতি অনুসরণ করে চলে। চীন ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণে ও পশ্চিমদিকে চীনের সীমান্তবর্তী মধ্য এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান রণনৈতিক সক্রিয়তায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ঘেরাও ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার জন্য, তাঁদের পারমাণবিক ও প্রথাগত সামর্থ্যকে আরও শক্তিশালী করা ছাড়াও চীনারা দ্রুত রাশিয়ার সাথে তাঁদের রণনৈতিক সহযোগিতাকে জোরদার করেছে। রাশিয়ান ও চীনা নেতাদের শীর্ষ বৈঠকের পরে প্রচারিত যুক্ত ইস্তাহারে অঙ্গীকার করা হয়েছে যে, তাঁরা একবিংশ শতাব্দীতে রণনৈতিক আন্তঃক্রিয়ার উদ্দেশ্যে এবং এক বহুকেন্দ্রিক দুনিয়া গড়ে তোলার জন্য সমান অংশীদারিত্বের ভাগীদার হবেন। এই ঘটনা হচ্ছে নির্ণায়ক গুরুত্বের, কেননা এই প্রথম দুই বৃহৎ শক্তি আমেরিকান আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন তুললেন ও বহুকেন্দ্রিক বিশ্বের কথা বললেন।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের যে সামরিক চুক্তি হয়েছে, তার আওতা থেকে তাইওয়ানকে বাদ দেওয়ার জন্য চীন জাপানের উপর চাপ দিচ্ছে। চীন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ককে জোরালো করছে এবং পূর্ব এশিয়ার নেতাদের এক সমাবেশে চীনের প্রধানমন্ত্রী “অযৌক্তিক পাশ্চাত্য ব্যবস্থা”র বিরুদ্ধে এবং এক “নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা”র কথা বলেন। চীনারা ব্যাপকভাবে জাতীয়তাবাদকে কাজে লাগাচ্ছে এবং বিশ্ব-রাজনীতিতে আরও সক্রিয় ও মুখর ভূমিকা গ্রহণ করছে। হংকং-এর একীকরণ চীনের অর্থনৈতিক শক্তি ও তার জাতীয়তাবাদী ভিত্তি উভয়কেই আরও জোরদার করেছে।
লেনিন বলেছিলেন যে, এটা খুবই সম্ভব যে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি কিছু অঞ্চলের “শান্তিপূর্ণ” ভাগাভাগির জন্য কোনো জোট গড়ে তুলছে। “কিন্তু প্রশ্ন হল ঐ ধরনের জোটগুলি স্থায়ী হবে কি এবং সেগুলি সংঘর্ষ, সংঘাত ও সংগ্রামগুলিকে সমস্ত সম্ভাব্য রূপে পরিহার করবে কি?
“পুঁজিবাদের অধীনে প্রভাবাধীন এলাকা, ইত্যাদি ভাগাভাগির একমাত্র বোধগম্য ভিত্তি হচ্ছে শক্তির একটা হিসাব আর শক্তি সমান মাত্রায় পরিবর্তিত হয় না, কারণ বিভিন্ন উদ্যোগ, ট্রাস্ট, ইত্যাদির সম বিকাশ অসম্ভব।
“সুতরাং, সাধারণ জোটগুলি হচ্ছে যুদ্ধের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি কালের মতো। শান্তিপূর্ণ জোটগুলি যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে এবং বিপরীতক্রমে তা যুদ্ধ থেকেই উদ্ভূত হয়। একটি অপরটির শর্ত সৃষ্টি করে।”
এভাবে, এককেন্দ্রিক বিশ্ব হচ্ছে সময়ের সাথে সঙ্গতিবিহীন। বস্তুগত প্রক্রিয়া বহুকেন্দ্রিকতার দিকে এগিয়ে চলেছে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া, ইউরোপ এবং চীন-রাশিয়া অক্ষ গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে উদ্ভূত হতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা দুনিয়া জুড়ে তার আধিপত্য খাটাতে বদ্ধপরিকর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ষাটের দশকে শুরু হওয়া কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ, ইরাক ও ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং চীন, রাশিয়া ও জাপানকে ভয় দেখানোর মতো নীতিগুলি অনুসরণ করে যাচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য-যুদ্ধে রত। ভারত সহ আরও অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঔদ্ধত্য সহকারে হস্তক্ষেপ করছে এবং এসবের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আর্থিক ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে কাজে লাগায়, সেই সাথে রাষ্ট্রপুঞ্জকেও কাজে লাগায়, যা সম্প্রতি মার্কিন নীতি অনুসরণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
অতএব, ক্ষুদ্র ও দুর্বল দেশগুলির কাছে এই বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় প্রশ্ন চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রণনীতিতে চীনের বিরুদ্ধে ভারসাম্য-রক্ষাকারী শক্তি হিসাবে ভারত খাপ খেয়ে যায়। এই প্রশ্নে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি রীতিমতো অস্পষ্ট। যদিও সম্প্রতি, চীন-ভারত সম্পর্ক যথেষ্ট উন্নতিলাভ করেছে, তথাপি ভারতে এক শক্তিশালী মার্কিনপন্থী মহল রয়েছে, যারা চীনের সম্প্রসারণবাদী মতলবের ধুয়ো তোলে, তিব্বত প্রশ্নে শোরগোল করে, চীনকে ভারতের প্রধান বাণিজ্য-প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উপস্থিত করে, ইত্যাদি।
আমরা পরমাণু-বিস্তার বিরোধী চুক্তিতে ও সামগ্রিক পরীক্ষা বন্ধ রাখার চুক্তিতে ভারতের স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করাকে স্বাগত জানিয়েছিলাম, কারণ এক সার্বভৌম দেশ হিসাবে ভারতের স্বাধীনতা থাকা উচিত তার গতিপথ নির্ধারণ করার ও মার্কিন হুকুমের কাছে নতিস্বীকার না করার। কিন্তু আমাদের সামনে দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে ওঠার আশঙ্কা ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে। সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি-সম্পন্ন গুজরাল মতবাদ সত্ত্বেও ও পাকিস্তানের সাথে কথাবার্তায় এক সূত্রপাত ঘটানো সত্ত্বেও, নির্দিষ্ট কিছু উদ্ভূত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে না। কাশ্মীর সমস্যা সহ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বকেয়া সমস্যাগুলির সমাধান হতে পারে কেবলমাত্র সহযোগিতার এক প্রশস্ততর কাঠামোর মধ্যে, যেখানে এক শক্তিশালী আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট হিসাবে সার্কভুক্ত বিকাশশীল দেশগুলি থাকবে এবং পাকিস্তানের সাথে এক দ্বিপাক্ষিক পরমাণু প্রসার-বিরোধী চুক্তি সম্পাদন করার মধ্যে আর বহুকেন্দ্রিতকতার প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করার জন্য ভারতের উচিত চীনের সাথে রণনৈতিক সহযোগিতার সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখা। কিন্তু, ভারতের বর্তমান শাসনব্যবস্থা, যার সাথে পশ্চিমের রয়েছে অজস্র প্রকাশ্য ও গোপন বন্ধন, তার পক্ষে এই পথে চলা খুবই অসম্ভব।
বিশ্বায়নের ফল ইউরোপে ইতিমধ্যেই অনুভূত হচ্ছে, সেখানে কর্মহীনতার হার ১১ শতাংশে পৌঁছেছে (স্পষ্ট ভাষায়, দুই কোটি মানুষ সেখানে কর্মহীন), এ সংখ্যাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেকার মহামন্দার সাথেই তুলনীয়। ফ্রান্স সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, সেখানে বেকারী ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। এর সাথে সামাজিক কল্যাণে ব্যাপক ব্যয় হ্রাস ফ্রান্সে প্রতিবাদ ও ধর্মঘটের ঢেউয়ের জন্ম দিয়েছিল।
ফ্রান্সে নির্বাচনে বামপন্থীদের জয় বা অন্য কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে নির্বাচনে শাসক পার্টিগুলির পরাজয় ছিল মূলত উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি। ফ্রান্সে সমাজতন্ত্রীদের কোয়ালিশনের সাম্প্রতিক জয় সম্ভবত সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থনীতিকে থ্যাচারপন্থী ধারায় চালিত করা এবং বর্ণবিদ্বেষী বহিরাগত-বিরোধী দক্ষিণপন্থী আইন প্রণয়নের প্রয়াসকে ব্যর্থ করতে ফ্রান্সের শ্রমিকশ্রেণী যে নির্ধারক জনপ্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, তার পরেই আসে এই জয়। এর বিপরীতে ব্রিটেনে নয়া লেবার দলের জয়ের সঙ্গে সমাজতন্ত্র ও সমাজগণতন্ত্রের কোনো সম্পর্ক নেই। যাকে বলা উচিত নয়া রক্ষণশীল, তাকে ঘুরিয়ে নয়া লেবার বললে তার সম্পর্কে ভুল ধারণারই সৃষ্টি হয়। কাজেই ইউরোপের তথাকথিত বাম ঝোঁক সম্পর্কে উচ্ছ্বাস স্পষ্টতই ভিত্তিহীন।
ইউরোপীয় মুদ্রা ইউনিয়ন ও অভিন্ন মুদ্রা ইউরোর ১৯৯৯-এর ১ জানুয়ারি থেকে প্রচলন শ্রমিকশ্রেণীর কাছে কোনো প্রতিশ্রুতি বহন করে না। পক্ষান্তরে, ঐক্যবদ্ধ ইউরোপে এক একটি দেশ প্রতিযোগিতামূলক দিক থেকে সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে শ্রমিকদের ওপর বাঁধনকে আরও তীব্র করছে। ফলে শ্রমিকশ্রেণী একীকরণের সমগ্র প্রয়াসের বিরোধিতা করছে এবং তার বিরুদ্ধে বড় বড় প্রতিবাদ সংগঠিত করছে।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের প্রজাতন্ত্রগুলির অর্থনীতি এখনও উত্তরশীল পর্যায়ের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে আটকে রয়েছে এবং সেগুলির স্থায়ী পঙ্গুত্বপ্রাপ্তির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তথাকথিত নয়া-উদারনৈতিক সর্বরোগহর দাওয়াই এই সংকট সমাধানে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এই সমস্ত দেশগুলিতে সমাজতন্ত্র-পরবর্তী শাসন ব্যবস্থাগুলির প্রতি জন-অসন্তোষের মধ্যে এই অর্থনৈতিক বাস্তবতার রাজনৈতিক প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। সোভিয়েত পুতুল সরকারগুলির বদলে বসানো পশ্চিমী পুতুল সরকারগুলি এই সমস্ত দেশগুলিতে শীঘ্রই পতনের মুখে পড়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাক্তন কমিউনিস্টরা, যাঁদের মাটিতে শিকড় বেশি ছিল বলে মনে হয়, তাঁরা কমিউনিস্ট তকমা বাদ দিয়ে ফিরে আসেন।
এই বছরে রাশিয়ায় লক্ষ লক্ষ ক্রূদ্ধ শ্রমিক বকেয়া মজুরি, কর্মসংস্থান ও সামাজিক পরিষেবা ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পতনের পরে এই প্রথম শ্রেণীগত সক্রিতায় ১ কোটিরও বেশি শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেছেন।
আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও এশিয়ার দেশে দেশেও নয়া উদারনীতির সংকট সুস্পষ্ট। এর ফলে নয়া-উদারনীতিবাদীদের নিষ্ঠাবান বড় বড় পাণ্ডাদের মধ্যেই মতভেদের জন্ম হয়েছে এবং শোনা যায় জাপান অর্থনীতির উপরিস্তরে স্থায়িত্ব ও কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের নয়া উদারনৈতিক নীতিগুচ্ছের বিজ্ঞতা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাঙ্ক কর্তৃক প্রকাশিত এই বছরের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টের মূল বিষয় ছিল অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের নির্ণায়ক ভূমিকা পুনঃপ্রতিষ্ঠা। বলা হচ্ছে যে, নয়া-উদারনৈতিক তাত্ত্বিক আলোচনায় রাষ্ট্রের এই সাম্প্রতিক পুনরুত্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যকার মতপার্থক্যেরই পরিণাম। এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাম্প্রতিক মুদ্রাসংক্রান্ত আলোড়নের অব্যবহিত পরে এই মদভেদ তীব্রতর হতে শুরু করেছে এবং তা আরও জোরালোভাবে প্রকাশ্যে এসেছে, যখন জাপান মুদ্রা-সংক্রান্ত ফাটকাবাজির উপর বিধিনিষেধ আরোপের আহ্বান জানিয়েছে এবং এশিয়ার জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলারের এক অর্থভাণ্ডারের প্রস্তাব করেছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার হংকং-এর তার সাম্প্রতিক সভায় জাপানের এই সমস্ত প্রস্তাবের প্রবল বিরোধিতা করেছে এই বলে যে, শর্ত আরোপের উৎস একটিই হওয়া উচিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারী ৬ শতাংশ রয়েছে, কিন্তু পরিষেবা ক্ষেত্রে কম বেতনের চাকুরির অনুপাত বেড়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হচ্ছে, কিন্তু অনেকগুলিই অস্থায়ী, নিরাপত্তাহীন ও ভবিষ্যতহীন। যে জাপানকে অতিসম্প্রতি পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রগতির নমুনা হিসাবে দেখনো হত এবং ভারতীয় পুঁজিপতিরা তাঁদের শ্রমিকদের কাছে যে জাপানী শ্রমিকদের সহযোগিতামূলক মনোভাবের প্রচার করার কোনো সুযোগই ছাড়ত না এই বলে যে সে সহযোগিতামূলক মনোভাব নাকি জাপানে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটিয়েছে – সেই জাপানের জৌলুস অনেক কমেছে। আশির দশকের সেই উত্তুঙ্গ দিনগুলি বিগত হয়েছে, যে দিনগুলিতে জাপানী কোম্পানিগুলিকে মনে হতো অপ্রতিরোধ্য। স্টক মার্কেটের তেজীর সাত বছর পরে জাপান এখন গভীর সমস্যায় পড়েছে। মন্দাকে জয় করার সমস্ত প্রচেষ্টারই ফল হয়েছে সামান্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানকে চাপ দিয়ে চলেছে তার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার জন্য এবং তার বাজারকে আমেরিকার পণ্যের জন্য উন্মুক্ত করার জন্য। একদিকে জাপান রাজনৈতিক অস্থায়ীত্বের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, অন্যদিকে ওখানকার কমিউনিস্ট পার্টি বিগত নির্বাচনে ভালো ফল করেছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলির কাছে যাদেরকে সোৎসাহে নমুনা হিসাবে তুলে ধরা হত, সেই এশীয় “বাঘ” অর্থনীতিগুলি এখন সংকটের জালে আটকে পড়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বৃদ্ধির হার কমে আসছে এবং বাণিজ্য ভারসাম্য বিপর্যস্ত। ৩৭ হাজার মার্কিন সৈন্য মোতায়েন করার বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিবাদে দক্ষিণ কোরিয়া ইতিমধ্যে কেঁপে উঠেছে। এখন শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে এসেছে। নতুন শ্রম আইনের বিরুদ্ধে – যার ফলে মালিকের পক্ষে শ্রমিক ছাঁটাই সহজতর হত – হাজার হাজার শ্রমিক সিওল ও অন্যান্য শহরের রাস্তায় মিছিল করেছে। থাইল্যান্ডের বৈদেশিক ঋণ বেড়ে ৯০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, রপ্তানি কমে গেছে, চলতি খাতে ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়ে গেছে। এর ফলে থাই মুদ্রার মূল্য আবার পড়ে যায়, তার কম্পন শীঘ্রই দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইনস, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় পৌঁছায়। ১৬ বিলিয়ন ডলারের এক ঋণ আইএমএফ বন্দোবস্ত করে – যার ১ বিলিয়ন ডলার, মজার কথা, চীন দেবে বলে কথা দিয়েছিল, যাতে থাইল্যান্ডকে সংকট থেকে মুক্ত করা যায়। কিন্তু বর্তমানে ঐ অঞ্চলকে আরেক দফা মুদ্রা-সংক্রান্ত আলোড়ন গ্রাস করেছে। বাঘেরা ক্লান্তির চিহ্ন দেখাতে শুরু করেছে এবং আগামী বছরগুলিতে শ্রমিকশ্রেণীর জঙ্গী কার্যকলাপ তীব্রতর হতে বাধ্য।
বস্তুত, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মুদ্রার উপর আক্রমণ এবং পুঁজির সহসা অন্তর্ধানের ফলে ঐ অর্থনীতিগুলির দুর্বল হয়ে পড়া – মেক্সিকোর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে যা সর্বপ্রথম অত্যন্ত তীব্র আকারে দেখা গিয়েছিল – এক ব্যাপকতর পরিঘটনা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে এবং বিশ্বায়নের যুগে তৃতীয় বিশ্বের অনেক অর্থনীতিকেই প্রতিরোধহীন করে তুলেছে। সামগ্রিকভাবে, বিশ্বায়নের সাত বছরে বিশ্ব অর্থনীতির বৃদ্ধির রেকর্ড অনুজ্জ্বলই রয়েছে – এই সময়ে গড় বৃদ্ধির হার সত্তরের দশকের হারের নীচেই রয়েছে।
পূর্ব এশিয়ার সাম্প্রতিক মুদ্রা সংকটের মধ্যে কেবলমাত্র চীনা মুদ্রা ইউয়ানই মজবুত হয়ে ছিল। এটা চীনের অর্থনীতির বুনিয়াদী দিকগুলির শক্তি দেখিয়ে দেয়, সাথে সাথে চীনের আর্থিক ব্যবস্থাপনার শক্তিও দেখায়, যে ব্যবস্থাপনা ফাটকাবাজির বিশেষ সুযোগ দেয় না। চীনের অর্থনীতি বছরে ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত ১৬ বিলিয়ন ডলার, আর চীনের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার ২০০ বিলিয়ন ডলারের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বৈদেশিক ঋণ খুব কম। চীন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পেরেছে যার ৮০ শতাংশই আসে প্রবাসী চীনাদের কাছ থেকে।
যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলিই এখনো ১৭ কোটি শহুরে কর্মীবাহিনীর ব্যাপক অংশকে নিয়োগ করে, তবে মোট শিল্পীয় উৎপাদনে তাদের অংশ এক-তৃতীয়াংশেরও কমে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭৮ সালে যখন সংস্কার শুরু হয়, তখন তা ছিল তিন-চতুর্থাশেরও বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলি গভীর সংকটে রয়েছে এবং জানা গেছে যে, শত সহস্র শ্রমিকেরা মাসের পর মাস বেতনহীন অবস্থায় রয়েছেন। রুগ্ন রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলি কর্তৃক দেওয়া ঋণের পরিমাণ গত বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২০ বিলিয়ন ডলার। তবে ঋণের অনেকটাই গেছে কেবলমাত্র মজুরি দিতে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদ্য সমাপ্ত কংগ্রেসের সর্বপ্রধান আলোচ্যসূচি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্কার। পুঁজিবাদী ক্ষেত্র বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে চলেছে এবং চীন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টি “সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি” কথাটি চালু করেছে। তা এই যুক্তির উপরে দাঁড়িয়ে আছে যে, এক সামগ্রিক সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর ভিতরে, যথা কমিউনিস্ট পার্টির শাসন, পরিকল্পনা ও লগ্নির উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদির ভিতরে সমাজতন্ত্র নির্মাণের জন্য বাজারকে পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত এবং ব্যবহার করা যেতে পারে। একে তাঁরা বলছেন সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক স্তর এবং মনে করছেন যে আগামী ৫০ বছর ধরে তা চলবে, যতদিন না পর্যন্ত চীন মোটামুটি বিকশিত পুঁজিবাদী দেশগুলির সমান মাথাপিছু আয় অর্জন করছে। সমাজতন্ত্রের সম্বন্ধে চিরায়ত মার্কসবাদী তত্ত্বের এই সংশোধনই চীনা বৈশিষ্ট্য সমন্বিত সমাজতন্ত্র নির্মাণের দেং জিয়াও পিং-এর তত্ত্ব বলে পরিচিত। ১৯৫০ সাল থেকে সিপিসি-র মধ্যকার দুই লাইনের সংগ্রামে ফিরে গিয়ে আমরা এই তত্ত্বের উৎপত্তি সন্ধান করতে পারি।
একটি একক দেশে, তাও আবার পশ্চাদপদ এক এশীয় দেশে, সমাজতন্ত্র নির্মাণের যে বিরাট অসুবিধা আছে, আমরা তা স্বীকার করি।
আমরা সেই পদ্ধতিকেও খণ্ডন করি যা সমাজতন্ত্র গঠনের প্রশ্নকে বিমূর্তভাবে, এক কাল্পনিক মডেল হিসাবে আলোচনা করে, যেন সমাজতন্ত্রকে যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সময়ে নিছক ইচ্ছাশক্তির জোরে উঠিয়ে এনে লাগানো যেতে পারে। পরিবর্তে আমরা সমাজতন্ত্রকে দেখি পুঁজিবাদের দ্বন্দ্বগুলি থেকে বেরিয়ে আসা এক সমাজ হিসাবে, ইতিহাসের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসাবে এবং তাই ভিন্ন ভিন্ন দেশে, ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে, ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহকারী হিসাবে।
তবুও, সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির সমগ্র ধারণাটি অত্যন্ত বিতর্কমূলক বলে মনে হয়। চীনা অর্থনীতির ব্যাপক পরিমাণে পুঁজিবাদী হয়ে ওঠা, আঞ্চলিক বৈষম্য ও ধনী-দরিদ্র ফারাক বেড়ে চলা, নব্য ধনীর এক সমগ্র নতুন শ্রেণী উঠে আসা, দুর্নীতি রীতিমতো অবাধ হয়ে ওঠা – ইত্যাদি ঘটনাগুলি বিবেচনা করে আমরা চীনা সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতররূপে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না।