(লিবারেশন, এপ্রিল ১৯৯১ থেকে)
‘যুদ্ধ আর কিছুই নয়, তা হল অন্য উপায়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা’
– কার্ল ফন ক্লজবীৎস
ঠাণ্ডা যুদ্ধের পর, ফুকুয়ামা যখন ‘ইতিহাসের পরিসমাপ্তি’ ঘোষণা করছিলেন, তখন তিনি বোধহয় স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে, ইতিহাস এত তাড়াতাড়ি আবার যাত্রা শুরু করবে।
প্রায় এক মাস হল উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। জর্জ বুশ মনে করছেন যে এটিই হল শেষ যুদ্ধ যার পরিসমাপ্তির পর নতুন এক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। সাদ্দাম হুসেনের কাছে এটিই হল সব যুদ্ধের জননী, যার পরিণতিতে আরব দুনিয়া পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে এবং মুক্ত হবে প্যালেস্তাইন। ঠিক কী হবে তা এখনও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, তবে এই যুদ্ধের অভিপ্রায় যে নিছক কুয়েতের মুক্তি নয় তা হলফ করেই বলা যায়। এই যুদ্ধ হচ্ছে বর্তমান দুনিয়ায় জোটগুলির দ্বন্দ্বের প্রতিফলন এবং আবার একই সঙ্গে সম্পর্কগুলির পুনর্বিন্যাসেরও মাধ্যম। যুদ্ধ হচ্ছে মৃত্যু ও ধ্বংসের উন্মত্ত লীলা। কিন্তু কখনও সখনও ইতিহাসে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে এবং ইতিহাসকেই গতি প্রদান করে। উপসাগরীয় যুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই ইতিহাসের ক্ষেত্রে অবশ্যই এক নতুন সূচনা সৃষ্টি করেছে।
১৯৯০ সালটি ছিল সমাজতন্ত্রের পরাজয় এবং সাম্রাজ্যবাদের বিজয়ের বছর। সর্বগ্রাসী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ব ইউরোপে ‘উদারনৈতিক বুর্জোয়া মূল্যবোধ’ বিজয়ী আত্মপ্রকাশ ঘটায়। সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র তখন মৃত্যুপথযাত্রী। আর, তিয়েন-আন-মেনের ঝাঁকানির পর, পশ্চিমী দুনিয়ার আক্রমণাত্মক অবস্থানের মুখে চীন পড়ে যায় রক্ষণাত্মক অবস্থায়। নির্জোট আন্দোলন তার সমস্ত প্রাসঙ্গিকতা খুইয়ে ফেলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্ব পুঁজিবাদ তার বিজয় কেতন ওড়ায় এবং বহু দশক পর বিশ্বকে আবার এককেন্দ্রিক হয়ে উঠতে দেখা যায়।
জর্জ বুশের তুলে ধরা নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার সহজ অর্থই হল তৃতীয় বিশ্ব এবং তার সম্পদসমূহের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তার করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৯১ সালের প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা বাজেট বিতর্কিত ‘নক্ষত্র যুদ্ধ’ খাতে ব্যয় বরাদ্দ বিগত বছরের ২.৯ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৪.৮ বিলিয়ন ডলার। বাজেট ঘোষণায় সোভিয়েত রাশিয়া থেকে পারমাণবিক বিপদের সম্ভাবনা কমে যাওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি থেকে সম্ভাব্য ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের অজুহাত খাড়া করে এই বরাদ্দ বৃদ্ধিকে যুক্তিসঙ্গত হিসাবে দেখানো হয়।
নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার এই মার্কিনী পরিপ্রেক্ষিত থেকে, এটি খুবই স্বাভাবিক যে ইরাকের দিক থেকে কুয়েত আগ্রাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিছুতেই বরদাস্ত করবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের মতো দেশগুলি পশ্চিম এশিয়ার তেলের খনির উপর তাদের অধিকারকে জন্মগত অধিকার হিসাবেই মনে করে। মার্কিনী এজেন্ট কুয়েতের শেখ-এর পতন এবং তারই পাশাপাশি আবার শক্তিশালী এক দেশ হিসাবে ইরাকের উত্থান এবং ২০ শতাংশ তেল সম্পদের ওপর তার কর্তৃত্ব নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার প্রতি বাস্তবিকই এক সরাসরি আঘাত হিসাবেই ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবলমাত্র এক যুদ্ধের জন্যই উন্মুখ হয়ে ছিল। আর এককেন্দ্রিক বিশ্বের এক চমৎকার নিদর্শন স্বরূপ রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোলাম হিসাবেই কাজ করল। ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জোটভুক্ত দেশগুলি বহুজাতিক সেনাবাহিনীতে যোগ দিল এবং তার সঙ্গে সিরিয়া, মরোক্কো এবং মিশরের মতো আরব দেশগুলিও অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ল। পাকিস্তান পাঠাল পদাতিক বাহিনী আর ভারত যোগান দিল মার্কিন সামরিক যুদ্ধ বিমানের জন্য জ্বালানি। জার্মানি ও জাপান দিল আর্থিক সহায়তা। সোভিয়েত রাশিয়া নৈতিক সমর্থন নিয়ে এগিয়ে এলো এবং চীন অবলম্বন করল রহস্যজনক নীরবতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পুরো রাজনৈতিক উদ্যোগ চলে আসে, আর ইরাক হয়ে পড়ল একা, সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। ইয়েমেন ও কিউবার মতো কয়েকটি ছোটো দেশ বাদে আমেরিকার বিরুদ্ধে আর কাউকেই প্রতিবাদী কণ্ঠে সোচ্চার হতে দেখা গেল না। এত কিছুর পরও ইরাক লড়াই চালিয়ে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়। কুয়েতের ইস্যুটির সঙ্গে প্যালেস্তাইনের প্রশ্ন যুক্ত করে এবং ইরানের সঙ্গে পুরোনো বৈরিতা মিটিয়ে নিয়ে ইরাক তার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করেই রেখেছিল।
সমস্ত নৃশংসতা নিয়েই যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। ইরাক এখন ইতিহাসের জঘন্যতম বোমাবর্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে। আর এটিই পাশ্চাত্য সভ্যতার কুৎসিত মুখকে উন্মোচিত করেছে। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদের মাঝখানে শতাব্দী পুরাতন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সমস্ত অবশেষ, বাগদাদ ও বাসরার মতো ঐতিহাসিক শহরগুলি এবং কয়েক শতাব্দী ব্যাপী ইসলাম সভ্যতার ধর্মীয় স্থানগুলি ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। খুন করা হচ্ছে শয়ে শয়ে শিশু, মহিলা ও সাধারণ নাগরিকদের। উন্নত প্রযুক্তির প্রতি পাশ্চাত্য দুনিয়ায় আকর্ষণ এই বীভৎসতাকে দুরদর্শনের পর্দায় এক রোমাঞ্চকর খেলায় রূপান্তরিত করেছে। মার্কিনী নেতাদের অশালীন কথাবার্তা এবং পাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যমগুলির ভাষা স্পষ্টতই তাদের জাতিবিদ্বেষের মনোভাবকে প্রতিফলিত করে; এই মনোভাব আর কিছুই নয়, তা তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলির আকাঙ্খা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি প্রবল ঘৃণারই অভিব্যক্তি।
মূল কথা হল, এই হচ্ছে আমেরিকার এককেন্দ্রিক বিশ্বের ছবি, যার স্বপ্ন সে এতদিন দেখে আসছে।
যদিও, স্বপ্ন অনেকক্ষেত্রে কেবলমাত্র স্বপ্নই রয়ে যায়। মার্কিনের যে সমস্ত সেনাপতিরা পূর্বে ঘোষণা করেছিলেন যে মাত্র ছদিনের মধ্যে যুদ্ধ জয় করবেন, তাঁরা আজ পর্যন্ত স্থলপথে আক্রমণ শানানোর মুরোদ দেখাতে পারেননি। সংবাদে প্রকাশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ও সাদ্দামের সপক্ষে বিশ্বের বহু দেশে গণবিক্ষোভের জোয়ার শুরু হয়েছে। একের পর এক দেশ বাধ্য হচ্ছে তাদের অবস্থান পাল্টাতে। আর, বহুজাতিক জোটের অভ্যন্তরে ফাটল বাড়ছে ক্রমশই।
সাদ্দাম হুসেনকে হয়তো সহজেই যুদ্ধে পরাস্ত করা যাবে, কিন্তু প্যালেস্তাইন ইস্যুকে তিনি কুয়েতের সঙ্গে যুক্ত করতে অনেকাংশেই সফল হয়েছেন। এখন যে কোনো শান্তি প্রস্তাবকেই প্যালেস্তাইন সমস্যার বিষয়টি বিচার-বিবেচনা করতে হবে। এমনকি সাদ্দাম পরাজিত হলেও, তাঁর জাগিয়ে তোলা আরব জাতীয়তাবাদ এমনকি আগামী দিনগুলিতে আমেরিকাকে লাগাতার তাড়িয়ে বেড়াবে। এর ভিত্তিতে, ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলি স্বাধীন রাজনৈতিক উদ্যোগের পথে পা বাড়াবে যা মার্কিন স্বার্থের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ হতে বাধ্য। মার্কিন-সোভিয়েতের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের বর্তমান পর্যায়টি এক উত্তপ্ত উত্তেজনাময় শান্তিতে পরিণত হতে পারে। আর, মার্কিন বিরোধী ঢেউ-এর যে প্লাবন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে লক্ষ্যণীয় তা নিশ্চিতভাবেই এক নতুন রাজনৈতিক মেজাজ নিয়ে আসবে।
এই যুদ্ধের পরিণতি যাই হোক না কেন, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে মার্কিনের এককেন্দ্রিক বিশ্বের স্বপ্নের সলিল সমাধি হবে খোদ পারস্য উপসাগরেই।