(লিবারেশন, অক্টোবর ১৯৯১ থেকে)

ইউরোপে কমিউনিজমের শেষ দুর্গটিরও পতন ঘটেছে। ক্যু বা ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একে রক্ষা করার শেষ মরিয়া প্রয়াস করাল ভবিষ্যতকে ত্বরান্বিত করেছে মাত্র।

একদা কমিউনিজমের ভূত ইউরোপকে তাড়া করে বেড়াত, আর আজ ইউরোপের ভূত সর্বত্র কমিউনিজমকে তাড়া করছে। ইউরোপে কমিউনিজমের মৃত্যু কি এশিয়ায় কমিউনিজমের ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করবে? চীন কতদিন পুঁজিবাদের আগ্রাসনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে এর কেমন প্রভাব পড়বে? এই ধরনের নানা প্রশ্ন আমাদের দেশের কমিউনিস্টদের ও মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীদের মন তোলপাড় করছে এবং জনগণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের বিষয় হয়ে দেখা দিচ্ছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘটনাবলী থেকে শুরু করা যাক। সফল সর্বহারা বিপ্লবের প্রথম দেশ, মহান লেনিনের দেশে সমাজতন্ত্র যে ধাক্কা খেয়েছে তা সমস্ত কমিউনিস্টদের কাছেই অত্যন্ত হৃদয়-বিদারক ঘটনা। দুর্বল চিত্তের কমিউনিস্টদের ক্ষেত্রে তা হতাশা, এমনকি পার্টি ছেড়ে দেওয়ার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। কিন্তু মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের কাছে তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রেণী সংগ্রাম অর্থাৎ সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যে সংগ্রামের অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী চরিত্রকেই প্রকট করেছে মাত্র।

মার্কিনী চক্রান্ত বা গর্বাচভ ও ইয়েলেৎসিনের মতো কয়েকজন ব্যক্তির ওপর দোষারোপ করে লাভ নেই। মূল বিষয় হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজিবাদ যেখানে তার ধাক্কা সামলিয়ে নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে পেরেছে, সমাজন্ত্র সেখানে অগ্রগতির একটা পর্যায়ের পর দুনিয়াকে আর কিছুই দিতে পারেনি। ক্রমে ক্রমে সে পরিণত হয় এক অচলায়তনে। শ্রমিকশ্রেণী সহ সমস্ত স্তরের জনগণই তা প্রত্যাখ্যান করতে শুরু করেন। সমাজতান্ত্রিক শৃঙ্খল প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়ে এবং যেখানে তার বিকৃতি সর্বাধিক অর্থাৎ প্রথমে পূর্ব ইউরোপে ও পরে সোভিয়েত রাশিয়ায় তা ভেঙ্গে পড়ে।

সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে রক্ষা করার জন্য ব্যাপক পারমাণবিক অস্ত্র-ভাণ্ডার গড়ে তোলা হয়েছিল। সামরিক দিক থেকে মার্কিনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া এমনকি তাকে টপকে যাওয়াই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে পড়ে। আর এই প্রক্রিয়াতেই ঘটে এক বিচিত্র ঘটনা – সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক বুনিয়াদের ওপর আধিপত্যবাদী অতিবৃহৎ শক্তির আবির্ভাব। ইতিহাসের কী পরিহাস, আঘাত যখন এল, একটি গুলিও ছুটল না, আর সোভিয়েত ইউনিয়নে পালাবদলের পালা ‘শান্তিপূর্ণ পথে বিবর্তনের’ এক চিরায়ত দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্র এই দুই ব্যবস্থার মধ্যেকার বুনিয়াদী দ্বন্দ্বকে যান্ত্রিকভাবে দুই শিবিরের মধ্যে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসাবে চালিয়ে দেওয়ার ফলে গড়ে ওঠে সর্বোচ্চ নেতা, বৃহত্তম পার্টি ও অতিবৃহৎ শক্তির ব্যাপারটি। নিঃসন্দেহে এসবের সূচনা হয়েছিল স্তালিনের আমলেই। এই সমস্ত অদ্ভুত অবাস্তব ধারণার স্বাভাবিক অনুসঙ্গ হিসাবে সমাজতান্ত্রিক শিবিরে বিভাজন দেখা দেয়, কেননা মাও ঐ তত্ত্বকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং চীন সোভিয়েত আধিপত্যের কাছে নতিস্বীকার করতে রাজি হয় না। সোভিয়েত অর্থনীতির সামরিকীকরণ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ফাঁক সৃষ্টি করে আর জনগণকে পরিবেশন করা হতে থাকে কেবল ভূয়ো পরিসংখ্যান। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে বিসর্জন দেওয়া হয়, শুরু হয় সবরকম মতান্তর বা বিক্ষোভকে দাবিয়ে রাখার যুগ। সেই সঙ্গে চলতে থাকে ‘কমিউনিজনের প্রথম ধাপ’, ‘বিকশিত সমাজতন্ত্র’-এর মায়াজালে জনগণকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখার চেষ্টা। এক অতি বৃহৎ শক্তিসুলভ মনোভাব মাথা চাড়া দেয়, যা পুরোনো যুগের রুশ জাতীয়তাবাদের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। এসবের আড়ালে ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, দুর্নীতিপরায়ন ও অধঃপতিত একটি কমিউনিস্ট পার্টি তথা শাসনযন্ত্র।

সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক বুনিয়াদে দীর্ঘদিন ধরে এই অতিবৃহৎ শক্তিসুলভ কাঠামো টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না, আর তাই আশির দশকের মধ্যভাগে সোভিয়েত দেশের পরিস্থিতি এক আগ্নেয়গিরির মতো হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য গর্বাচভ শুরু করেন তাঁর সংস্কারের কার্যক্রম। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। তাঁর পেরেস্ত্রৈকা ও গ্লাসনস্ত পূর্ব ইউরোপে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন নিয়ে আসে, সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে জাতিগুলির নিজস্ব আশা-আকাঙ্খা বাড়িয়ে তোলে, বিকাশ ঘটায় বেশ কিছু নতুন সামাজিক শক্তির এবং পুঁজিবাদের পুরোপুরি পুনঃপ্রবর্তনের দাবি নিয়ে ইয়েলেৎসিনের নেতৃত্বে এক নতুন মেরু গড়ে ওঠে। সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর বেশ ভালো সুযোগ পশ্চিমী শক্তিগুলি পেয়ে যায়। তাঁর নিজেরই উস্কে দেওয়া শক্তিগুলিকে বাগে আনার জন্য গর্বাচভের সমস্ত প্রচেষ্টাই বিফল হয় এবং সমন্বয়মূলক ভারসাম্য নিয়ে আসার দুরাশায় তিনি একের পর এক অবস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। সমাজের অর্থনৈতিক পুনর্জীবন সুদূরপরাহত থেকে যায়। সাহায্যের জন্য পশ্চিমী শক্তিগুলির কাছে তাঁকে কার্যত ভিক্ষা চাইতে হয় এবং বিনিময়ে তিনি তাদের একের পর এক রাজনৈতিক ছাড় দিতে থাকেন। ফলস্বরূপ তাঁর নিজের অবস্থান দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয় এবং ইয়েলেৎসিনের অবস্থান সুদৃঢ় হতে থাকে। নানান রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক পরিবর্তন কমিউনিস্ট পার্টিকে গুরুত্বহীন করে তোলে। পুরোনো কাঠামোর কমিউনিস্ট পার্টি বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে বেমানান হয়ে পড়ে। গর্বাচভ একটি সমাজগণতান্ত্রিক পার্টির ধারণা হাজির করেন এবং একটি নতুন ইউনিয়ন চুক্তির প্রস্তাবও রাখেন।

এই সন্ধিক্ষণে ঘটল সেই বহু-নিন্দিত ক্যু। আমাদের হাতে এমন সমস্ত তথ্য নেই যা দিয়ে আমরা বিচার করতে পারি প্রকৃত কোন ঘটনা অভ্যুত্থানের নেতৃবৃন্দকে ঐ পন্থা অবলম্বনে প্ররোচিত করেছিল এবং পর্দার আড়ালেই বা কী কী ঘটে চলেছিল।

কিন্তু তাঁদের কট্টরপন্থী বা রক্ষণশীল হিসাবে অভিহিত করা ঠিক নয়। তাঁরা সকলেই গর্বাচভের নিজস্ব পছন্দের লোক – গর্বাচভের সংস্কারের ফসল তথা প্রধান অবলম্বন। গোটা মন্ত্রীসভাই যখন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে প্রতিভাত হচ্ছে, তখন এর অধিকতর যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা এটাই হতে পারে যে আসলে গর্বাচভই তাঁর ওপর ন্যস্ত বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেননি। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে তিনি থেমে যাবেন এবং আরও অধঃপতন রোখার জন্য স্ব-অর্জিত জরুরি ক্ষমতা ব্যবহার করবেন বলেই মন্ত্রীসভার প্রত্যাশা ছিল। তাঁরা মনে করলেন সেই সময় এসে গেছে। কিন্তু নিজের জালে আটকে গর্বাচভ তাঁদের মতে সায় দিতে অস্বীকার করে বসলেন। সম্পর্কের আকস্মিক এই ছেদ ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা কব্জা করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প খোলা রাখল না। ব্যর্থ হওয়াই ছিল এই ক্যু-এর নিয়তি, কেননা পেরেস্ত্রৈকা-পন্থী শক্তিগুলির নেতা তখনও গর্বাচভই। আর অভ্যুত্থানের নেতৃবৃন্দ প্রথম থেকেই এক দোদুল্যমান ও ঢিলেঢালা গ্রুপ হিসাবে থেকেছেন। ইয়েলেৎসিন এই ফাটলটি বুঝতে পেরে সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ক্যু ব্যর্থ হয় এবং জনতা নতুন নায়ক ইয়েলেৎসিনের দিকে চলে যান। ভগ্ন-হৃদয় গর্বাচভ ফিরে এসে দেখলেন তাঁর সামাজিক ভিত্তি দ্রুত সরে যাচ্ছে। ইয়েলেৎসিনকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছেড়ে দিতে তিনি বাধ্য হলেন। কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ায় ভাঙ্গন ত্বরান্বিত হল এবং তিনটি বাল্টিক প্রজাতন্ত্র প্রকৃত অর্থেই সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ইয়েলেৎসিন কমিউনিস্ট পার্টি বিরোধী জিগির চাগিয়ে তুললেন। কয়েকদিন মূলত ইয়েলেৎসিনের হুকুমে চলার পর গর্বাচভ ইয়েলেৎসিনের সাপেক্ষে তাঁর অবস্থান দৃঢ় করার পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টিকে ভেঙ্গে দেওয়ার পদক্ষেপ আসলে তাঁর মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি সমাজগণতন্ত্রী পার্টি গড়ার (এখন অবশ্য কিছুটা ঘুর পথে) প্রস্তুতি ছাড়া আর কিছু নয়। এটা নিশ্চিত যে, কমিউনিস্ট পার্টির এক বড় অংশ গর্বাচভের পরিকল্পনায় নিজেদের রূপান্তরিত করে নেবেন। আগামী দিনগুলিতে সোভিয়েত সমাজের প্রতিনিধিত্বমূলক দুই ব্যক্তিত্বের মধ্যে সহযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা কীভাবে এগোয়, তা সত্যিই এক দেখার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

আমরা জানি না সোভিয়েত রাশিয়ার মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা কেমনভাবে নিজেদের সংগঠিত করবেন। আমরা এও জানি না যে, ‘কট্টরপন্থী’ ও ‘রক্ষণশীলদের’ প্রতিক্রিয়াই বা কী হবে এবং কোন কোন নাটকীয় ঘটনাবলী এখনও অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু এটা বলাই যায় যে, নভেম্বর বিপ্লবের দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য আমাদের দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হবে।

এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ‘কমিউনিস্ট’ আন্দোলনের কেন্দ্র ফ্রান্স-জার্মানি-রাশিয়া হয়ে এখন সরে এসেছে চীনে। আর অন্য যে দেশটির দিকে এখন সবাই সাগ্রহে তাকিয়ে থাকবে তা অবশ্যই ভারতবর্ষ।

এবার বিতর্কের কথায় আসা যাক। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২৮তম কংগ্রেসের যে ইতিবাচক মূল্যায়ন আমরা করেছি, তার উল্লেখ করে সিপিআই(এম)-এর তাত্ত্বিক নেতা প্রকাশ কারাত[] আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে যে, আমরা আমাদের আগেকার পুরোদস্তুর সোভিয়েত বিরোধী অবস্থান থেকে আপাদমস্তক গর্বাচভ-পন্থী হয়ে পড়েছি। একেবারে প্রথম থেকেই গর্বাচভকে সমালোচনা করার কৃতিত্ব তাঁরা দাবি করেন। বাস্তব ঘটনা কী বলে দেখা যাক। আন্তর্জাতিক মহাবিতর্কে আমরা দৃঢ়ভাবেই চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থানকে সমর্থন করি এবং ক্রুশ্চেভের তত্ত্বের সমালোচনা করি। ‘সম-দূরত্বের তত্ত্বে’ আমাদের কোনোদিনই আস্থা ছিল না; মাও ও চীনের পক্ষেই আমরা দৃঢ়ভাবে দাঁড়াই। মাও চিন্তাধারাকেই আমরা নিজেদের পথনির্দেশিকা বলে গ্রহণ করেছিলাম – যে চিন্তাধারা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতৃত্বকারী পার্টির তত্ত্বের বিরোধিতা করেছিল, তৃতীয় বিশ্ব ও সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্বকে আজকের দুনিয়ার প্রধান দ্বন্দ্ব বলে অভিহিত করেছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের অতিবৃহৎ শক্তিসুলভ আধিপত্যকারী অবস্থানের বিরোধিতা করেছিল। স্তালিনের অধিবিদ্যার পরিবর্তে মাও-এর দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই আমরা দার্শনিক পথপ্রদর্শক হিসাবে গ্রহণ করি এবং এটাই আমাদের সমাজতান্ত্রিক সমাজের অভ্যন্তরে শ্রেণী সংগ্রামের অস্তিত্ব ও পুঁজিবাদের পুনরুত্থানের বিপদকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। ভুল আমাদের অবশ্যই হয়েছে, কখনও কখনও আমরা চরম সীমাতেও চলে গিয়েছি। কিন্তু আমাদের মূল প্রেক্ষিত কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। অন্যদিকে সিপিআই(এম) মাও-এর দার্শনিক চিন্তাকে বিদ্রুপ করেছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের অতিবৃহৎ শক্তিসুলভ অবস্থানকে অভিনন্দিত করেছে এবং চেকোশ্লোভাকিয়া, আফগানিস্তান ও কাম্পুচিয়ায় আগ্রাসনকে সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়েছে। কয়েকটি ভুলের সঠিক সমালোচনা সত্ত্বেও সিপিআই(এম)-এর মূল প্রেক্ষিত মনগড়া বলেই প্রমাণিত হয়েছে।

১৯৮৭-র ডিসেম্বরে আমাদের চতুর্থ কংগ্রেসের দলিলে আমরাই প্রথম গর্বাচভের ২ নভেম্বর ভাষণের কড়া সমালোচনা করি। অনেক পরে মক্সো থেকে ফিরে তবেই সিপিআই(এম) মুখ খোলে। সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে গর্বাচভের ধারণাকে আমরা সর্বদাই তীব্র সমালোচনা করেছি। শ্রেণী সংগ্রাম ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে গর্বাচভের ধারণা লক্ষ্য করে আমরা তাঁকে ক্রুশ্চেভের আধুনিক সংস্করণ বলেই অভিহিত করেছি। আমরা স্বাগত জানিয়েছিলাম কেবল সোভিয়েত রাশিয়ার অতিবৃহৎ শক্তিসুলভ অবস্থান ভেঙ্গে ফেলা এবং চরম স্বৈরতান্ত্রিক একটি ব্যবস্থার মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কারের সূচনা করার মতো পদক্ষেপগুলিকে। ব্রেজনেভীয় সমাজতান্ত্রিক মডেলের প্রতি সিপিআই(এম)-এর এখনও যদি কোনো মোহ থেকে থাকে, তবে তাদের ভোলা উচিত নয় যে ঐ মডেল তার শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল, ফলে তার পতনও ছিল অনিবার্য। গর্বাচভ ইতিহাসের অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছেন মাত্র। ঐ ব্রেজনেভীয় জমানাই যে ভারতে জরুরি অবস্থা ও ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকে সমর্থন জানিয়েছিল – একথাও কারোর বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়। ২৮তম কংগ্রেসে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে শক্তিগুলির ভারসাম্য বাস্তবে যেমন অবস্থায় ছিল সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ইয়েলেৎসিনের বিরুদ্ধে গর্বাচভকে সমর্থন জানিয়েছিলাম মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। আমরা জানতাম যে আজকের রাশিয়ায় আমাদের কল্পনার ঘাঁটি বিপ্লবী কমিউনিস্টদের অন্বেষণে স্রেফ মনোগতবাদ ছাড়া কিছুই নয়। ঐ অন্বেষণে সিপিআই(এম)-কে লিগাচেভ ও তার দলবলের ওপর আস্থা স্থাপনের দিকে নিয়ে যায়। আর লিগাচেভদের আসল ওজন যে কত তা ২৮তম কংগ্রেসেই উদ্ঘাটিত হয়ে গেছে।

আমরা যে ক্যু সমর্থন করিনি তার কারণ হল – আমাদের মনে এটা হয়তো বেশি খুশির ব্যাপার হতে পারে, কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এর প্রতি বিন্দুমাত্র জনসমর্থনও জোটেনি। সোভিয়েত রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকার হস্তক্ষেপ নিয়ে যদি আমরা হৈ চৈ না করি, সেখানকার কমিউনিস্ট পার্টির মৃত্যুতে আমাদের যদি কান্না না আসে তবে তার কারণ হল সে দেশের ভিতর থেকে এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে না। সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন আমরা দেখি, কিন্তু সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে কোনো দেশের জনগণের উপর এটা চাপিয়ে দেওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ৭৪ বছরের অভিজ্ঞতার পর সোভিয়েত জনগণ আজ যদি তা প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তবে সৈন্যবাহিনী, কেজিবি ও সামরিক আইনের মাধ্যমে তা চাপিয়ে দেওয়ার ওকালতি আমরা করি কী করে? ধ্বস রুখবার যথেষ্ট সময় যখন ছিল তখন কিছু করা হয়নি, আর যে কোনো সমালোচনাকেই সোভিয়েত নেতৃত্ব ও ভারতে তাদের অনুগামীরা সিআইএ-এর দালাল বলে ছাপ মেরে দিয়েছে। আজকের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মন্দের ভালোকেই আমাদের বেছে নিতে হবে এবং ঘটনাধারার যে অনুকূল মোড়ে কমিউনিস্টরা আবার উদ্যোগ ছিনিয়ে নিতে সমর্থ হবেন, সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। একমাত্র এটাই হতে পারে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। বাকি আর সবই হল প্রলাপ, নৈরাশ্যজনিত অরণ্যে রোদন।

অনেক দিক দিয়েই চীন সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে স্বতন্ত্র, আর এর মূল বিশেষভাবে রয়েছে মাও-এর শক্তিশালী উত্তরাধিকার। সমাজতন্ত্র (অবশ্যই প্রাথমিক স্তরে) সেখানে টিকে আছে এবং তিয়েন-আন-মেনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ও কিছু কিছু বিকৃতি সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রের পিছনে জনসমর্থনও রয়েছে। চীনের স্বর্ণোজ্জ্বল চিত্র তুলে ধরে সমাজতন্ত্রের ওপর জনগণের আস্থা অটুট রাখার চেষ্টা করা ঠিক নয় যদিও সিপিআই(এম) ঠিক তাই-ই করতে চলেছে বলে মনে হয়। এটা যে শুধু তথ্যগত দিক থেকেই ভুল তা নয়, শেষ পর্যন্ত এর ফলে হিতে বিপরীতই হতে পারে। জনগণের কাছে আমাদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে হবে এবং সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যে তীক্ষ্ণ আঁকাবাঁকা পথের সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁদের শিক্ষিত করতে হবে।

সিপিআই(এমএল) যখন তার যাত্রা শুরু করে, তার উপলব্ধিতে কেবল চীন ও ক্ষুদ্র আলবেনিয়াই ছিল সমাজতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু এজন্য আমরা ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করতে বিন্দুমাত্র হতোদ্যম হইনি। আমাদের দেশে পুরোনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামই যেহেতু মূল বিষয়, তাই কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভবিষ্যৎ এখানে উজ্জ্বল – অবশ্যই উজ্জ্বল। উদ্বেগ যেটুকু আছে তা হল পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকারকে নিয়ে, যার অপকর্মের সুযোগ নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলরা কমিউনিস্ট বিরোধী জিগির চাগিয়ে তোলার চেষ্টা করবে। আমরা আশা করি, সিপিআই(এম) নেতৃত্ব সমালোচনা সম্পর্কে আরও সহনশীল হবেন, নিজেদের ভুলগুলি শুধরে নেবেন এবং মার্কসবাদকে রক্ষা করতে ও গণসংগ্রামের ময়দানে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সঙ্গে হাত মেলাবেন।

টীকা

(১) ‘দি মার্কসিস্ট’ পত্রিকার অক্টোবর-ডিসেম্বর, ১৯৯০ সংখ্যায় প্রকাশ কারাতের “সিপিআই(এমএল)/আইপিএফ – বাম ভূমিকার অন্বেষণে”