(ডিসেম্বর ২৬, ১৯৯৩, পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির আয়োজিত মাও জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে সেমিনারে প্রদত্ত ভাষণ। লিবারেশন, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪ থেকে)
মাও সে তুঙের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সারা দেশ জুড়ে অনেক আলোচনা শুরু হয়েছে, অনেক লেখা হচ্ছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান হচ্ছে। মাও সে তুঙের প্রতি নতুন করে এই জানা-বোঝার আগ্রহ অনেক আশা জাগায়। এমনকি যাঁরা কাল পর্যন্তও মনে করতেন যে পুঁজিবাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া সমাজতন্ত্র আর পুঁজিবাদে ফিরে যেতে পারে না, তা শুধু বিকশিত সমাজতন্ত্র ও তারপরে সাম্যবাদের দিকেই এগোবে এবং যাঁরা মাও-এর দ্বন্দ্ব সম্পর্কে রচনা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতেন আজ তাঁদেরও দেখছি মাও-এর দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে চিন্তাভাবনার প্রশংসা করছেন। এই বিতর্ক, এই আলাপ-আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এটা ঠিকই কেউ কেউ তাঁদের সমাজগণতান্ত্রিক কাঠামোতে মাও-কে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাবেন, কেউ চেষ্টা চালাবেন তাঁদের ভাববাদী-নৈরাজ্যবাদী ধারণাগুলির সঙ্গে মাও এবং তাঁর চিন্তাকে খাপ খাইয়ে নিতে। যাই হোক, মাও নিয়ে এই বিতর্ক, এই আলাপ-আলোচনা মাও এবং তাঁর চিন্তাধারা সম্পর্কে এক সর্বাঙ্গীন ও সঠিক উপলব্ধিতে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। এটা এই কারণে আরও বেশি প্রয়োজনীয় কারণ ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনে মাও ও তাঁর চিন্তাধারার প্রশ্ন চিরদিনই এক বিতর্কিত প্রশ্ন এবং এই প্রশ্নে এক সঠিক ও ঐক্যবদ্ধ ধারণা ছাড়া, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন তার পরবর্তী ধাপে এগিয়ে যেতে পারে না। এই সমস্ত কারণে যে বিতর্ক, যে আলোচনা মাও-কে নিয়ে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে শুরু হয়েছে তাকে আমি স্বাগত জানাই।
সত্তরের দশকের শুরুতে অদ্ভুত একটা স্লোগান কলকাতার দেওয়ালে ভরে গিয়েছিল – “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান”। হাজারে হাজারে যুবকেরা, তরুণেরা একটা বিপ্লবী আহ্বানের প্রতীক হিসাবে এই শ্লোগানে সোচ্চার হয়েছিল। অনেকেই স্লোগানটির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন, কেউ কেউ বলেছেন এটা আমাদের জাতীয় ভাবনার, দেশপ্রেমের পরিপন্থী। শোনা যায় এমনকি মাও নিজেও নাকি এই শ্লোগানের বিরোধিতা করেছিলেন। পরবর্তীকালে আমাদের পার্টিও এই স্লোগান তুলে নেয়। কিন্তু কঠিন প্রশ্ন একটা থেকেই যায় – হঠাৎ ভারতবর্ষের এই হাজার হাজার যুবক কেন তাদের বিপ্লবী উদ্দীপনার ভাবপ্রকাশ এই শ্লোগানের মধ্যে করতে চেয়েছিল? তারা কারোর চেয়ে কম দেশপ্রেমিক ছিল না, তাদের জাতীয় ভাবনা কারোর চেয়ে কম ছিল না। মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি – এই স্বপ্ন নিয়েই তাঁরা হাজারে হাজারে মূল্যবান জীবন বলিদান করেছেন। তবু এই স্লোগান তাঁরা কেন দিয়েছিলেন? অন্যকথায় চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুঙ কীভাবে আন্তর্জাতিক বিপ্লবের নেতা হয়ে উঠেছিলেন, কেমন করেই বা দেশে দেশে যুবকদের কাছে, বিপ্লবী জনসাধারণের কাছে তাঁদের আপনজন, তাঁদের আশার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন? এর উত্তর পেতে হলে সেসময়কার ঐতিহাসিক পরিস্থিতির কথা জানা দরকার।
ষাটের দশকের সোভিয়েত নেতৃত্ব হঠাৎ করে বলতে শুরু করলেন, আণবিক বোমার আবির্ভাবের পর থেকে সমস্ত কিছু পাল্টে গেছে। এখন সব কিছু নতুন করে ভাবতে হবে। সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে আণবিক বোমা আছে এবং নিমেষেই অসংখ্য মানুষকে মেরে ফেলতে পারে ও তা গোটা পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কাজেই আর শ্রেণীযুদ্ধ নয়। আর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ নয়। এমন কিছু চলবে না যা সাম্রাজ্যবাদীদের প্ররোচিত করতে পারে। তাঁরা বললেন আজকের নতুন যুগে, আণবিক যুগে মার্কসবাদের নতুন পরিভাষা সংজ্ঞা বার করতে হবে। এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আধুনিক সংশোধনবাদের জন্ম হল। বিপ্লবী কমিউনিস্টদের পক্ষে এর বিরুদ্ধে মাও সেদিন দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, যে কোনো অস্ত্রই হোক না কেন, তা সে যতই উন্নত হোক বা তার ধ্বংসের ক্ষমতা যতই বেশি হোক না কেন তা মানব সমাজের মৌলিক বিষয়গুলিকে পাল্টে দিতে পারে না। বিশ্ব ইতিহাসের চালিকাশক্তি জনগণ, শুধুমাত্র জনগণ – কোনও আধুনিক পারমাণবিক বোমা নয়। সাম্রাজ্যবাদীরা যখন আণবিক বোমার জুজুর ভয় দেখিয়ে বিশ্বজুড়ে বিপ্লবী সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছিল তখন মাও সেই বিখ্যাত ঘোষণা করেছিলেন – আণবিক বোমা একটি কাগুজে বাঘ ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই সন্ধিক্ষণে মাও-এর এই দৃঢ় আত্মঘোষণাই শোষিত নিপীড়িত মানুষকে সর্বত্রই সাহস যুগিয়েছিল, তাঁদের সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় প্রেরণা দিয়েছিল।
মাও আরও বলেছিলেন যে একটি ছোটো শক্তি ক্রমে ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করে একটি বড় শক্তিকে পরাজিত করতে পারে। এভাবে ষাটের দশকে যখন সংশোধনবাদের প্রভাবে মার্কসবাদের অস্তিত্ব বিপদের সম্মুখীন হতে বসেছিল, সেই সময় মাও-এর এই আওয়াজ পৃথিবীর মানুষকে ভরসা জুগিয়েছিল এবং তিনি চীনের সীমান্ত ছাড়িয়ে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাতিন আমেরিকার তথা সমগ্র পৃথিবীর সমস্ত বিপ্লবী মানুষের কাছে তাঁদের একান্ত আপনজন হয়ে উঠেছিলেন।
মাও সে তুঙ চিন্তাধারার উদ্ভবের পিছনে একটা ইতিহাস আছে। মার্কস-এঙ্গেলস সর্বহারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন এবং তাঁরা মনে করতেন এই বিপ্লব উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি থেকে শুরু হবে এবং সেই সব দেশের বিজয়ী সর্বহারা পরবর্তীকালে উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশের নিপীড়িত মানুষকে মুক্ত করবে। কিন্তু বাস্তব জীবনে বিপ্লব এই সোজা পথ নেয়নি। সর্বাহারা বিপ্লব প্রথমে রাশিয়ায় ঘটল। লেনিনের প্রত্যাশা ছিল যে রুশ বিপ্লব পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে বিপ্লবের আগুন জ্বালাবে। তাও ঘটেনি। লেনিন তাই রুশ বিপ্লবের সাথে উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের এক জীবন্ত সম্পর্কের ওপর জোর দিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে বিশ্ব বিপ্লবের কেন্দ্র স্থানান্তরিত হচ্ছে এশিয়ার দিকে। তিনি প্রাচ্যের কমিউনিস্টদের বললেন তাদের দেশের বিপ্লবের পথের বিষয়ে মার্কসবাদের বইগুলি থেকে বিশেষ কিছুই তাঁরা পাবেন না। কমিউনিজমের সাধারণ নীতিগুলি এবং অবশ্যই অক্টোবর বিপ্লবের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে তাঁদের পথ নিজেদেরই বার করতে হবে।
মাও চিন্তাধারার আবির্ভাব কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। বিপ্লবের কেন্দ্র যেহেতু স্থানান্তরিত হয়েছিল প্রাচ্যে, এশিয়ায়, তাই সেখান থেকে নতুন এক বিপ্লবী তত্ত্বের আবির্ভাব হওয়া ঐতিহাসিকভাবে অবশ্যম্ভাবী ছিল – যা ভারত থেকে হতে পারত। বাস্তবে সেটা চীন থেকেই হল এবং মাও হলেন সেই ঐতিহাসিক অনিবার্যতারই ফসল।
এক আধা-উপনিবেশিক দেশ চীনের কৃষক জনসাধারণের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে মাও পরীক্ষা চালিয়ে দেখলেন ও তাকে কাজে লাগিয়ে এমনকি বিপ্লব সম্পূর্ণ করতে এক সশস্ত্র লাল সৈন্যবাহিনীও গড়ে তুললেন। সর্বহারার ইতিহাসে কৃষক জনসাধারণের এই ভূমিকা মার্কসবাদের ভাণ্ডারে এক বিশিষ্ট অবদান। জাতীয় চেতনাকে সামনে রেখে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুক্তমোর্চা গঠন করা হল মার্কবাদের ভাণ্ডারে তাঁর আর একটি বিশেষ অবদান।
নিজের চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মাও-কে নিজের পার্টির ভিতরে এবং কমিন্টার্ণের বিরুদ্ধেও তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর লাইন, মতাদর্শ ও তাঁর চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠা করেন।
স্তালিন সম্পর্কে মাও-এর বিরাট শ্রদ্ধা ছিল, তিনি স্তালিনকে এক মহান বিপ্লবী নেতা হিসাবে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি, একমাত্র তিনিই স্তালিনের ভুলত্রুটির মতাদর্শগত উৎসকে চিহ্নিত করেছেন। যখন স্তালিনের বিরুদ্ধে চারদিকে ব্যক্তিগত কুৎসা চলছিল, তাঁকে অপরাধী বানানো হচ্ছিল মাও তখন সমাজতন্ত্র গঠনে তাঁর অবদানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। স্তালিনে ভুলগুলির মতাদর্শগত উৎসকে চিহ্নিত করতে গিয়ে নির্দ্বিধায় মাও বলেছেন যে স্তালিনের মধ্যে ভালো পরিমাণে অধিবিদ্যা ছিল, একপেশেপনা ছিল।
চীনে সমাজতন্ত্র গঠন করতে গিয়ে মাও অন্ধভাবে সোভিয়েত মডেলের নকল করার বিরোধিতা করেছিলেন। সোভিয়েত পার্টিকে সর্বোচ্চ পার্টি হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতাও তিনি করেছিলেন এবং সর্বোপরি সোভিয়েত ইউনিয়নের অতিবৃহৎ শক্তি হয়ে ওঠার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বারংবার গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ যতই শক্তিশালী হয়ে উঠুক না কেন তার কখনই বৃহৎশক্তি হওয়া উচিত নয়, কখনই অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা এবং সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে অন্যান্য দেশ দখল করা উচিত নয়। সোভিয়েত সেনারা যখন সমাজতন্ত্রকে রক্ষার নামে পূর্ব ইউরোপ থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত চষে বেড়াচ্ছিল, তখন মাও দৃঢ়ভাবে এই অতিবৃহৎ শক্তিসুলভ আচরণের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ যদি বৃহৎশক্তির মতো আচরণ করে তবে তার সমাজতন্ত্র আর প্রকৃত সমাজতন্ত্র থাকে না।
মাও শুধু ক্রুশ্চেভীয় সংশোধনবাদেরই বিরোধতা করেননি, স্তালিনীয় অধিবিদ্যারও বিরোধিতা করেছিলেন। আমাদের পার্টির মতে, মাও চিন্তাধারাকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে হলে তার এই উভয় দিক সম্বন্ধে অবশ্যই জানাবোঝার প্রয়োজন আছে।
মাও বারবার বলতেন পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের এখনও মীমাংসা হয়নি। তিনি বললেন এই সংগ্রাম বহু বছর ধরে, এমনকি কয়েকশো বছর ধরে চলতে পারে এবং সেই লড়াইয়ে কে জিতবে আর কে হারবে সে প্রশ্নের মীমাংসা এখনও হয়ে যায়নি। সোভিয়েত নেতৃত্বের দাবি ছিল সমাজতন্ত্র কেবলমাত্র বিকশিত সমাজতন্ত্র ও তারপর সাম্যবাদের পথেই এগোতে পারে। মাও বললেন, তা ঠিক নয়, ভুল। এটি ছিল মার্কসবাদী দর্শন ও তত্ত্বের ক্ষেত্রে মাও-এর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
তিনি এও বলেছিলেন ঠিক কীভাবে একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ রূপান্তরিত হয়ে পুঁজিবাদে ফিরে যেতে পারে। তাঁর মতে সমাজতান্ত্রিক দেশেও শ্রেণীসংগ্রাম থাকে এবং একটি বুর্জোয়া শ্রেণীর অস্তিত্ব থাকে। এই বুর্জোয়াশ্রেণী কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে নিজেকে সংগঠিত করে ও পুঁজিবাদের পথিকরা কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তর থেকেই জন্ম নেয়। পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘটনাবলীতে এই বিশ্লেষণের যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। সমাজতন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে ফিরে যাওয়ার, পুঁজিবাদের পথিকদের পার্টির ভিতর থেকেই সদর দপ্তর দখল করার কথা তিনি ঠিক যেভাবে বলেছিলেন বাস্তবে রাশিয়ায় সেভাবেই ফলে গেছে। বিশেষত সোভিয়েতের পতনের পর মাও-এর চিন্তাধারার প্রতি মানুষ যে আরও বেশি বেশি করে আকৃষ্ট হচ্ছেন তার মূল কারণ নিহিত রয়েছে এখানেই।
বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে কীভাবে এই বিরাট গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করা যায় মাও সেই চেষ্টা করেছিলেন। এব্যাপারে মাও চীনের ক্ষেত্রে যা প্রয়োগ করেছিলেন তা পরিচিত সাংস্কৃতিক বিপ্লব বলে। সাংস্কৃতিক বিপ্লব শেষে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। শেষে দেখা গেল এমন কিছু লোক যারা কমিউনিস্টই ছিল না তারা পার্টিতে ক্ষমতা দখল করল। শেষ পর্যন্ত মাও-কে ১৯৭৬ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সমাপ্তি ঘোষণা করতে হল এবং দেং শিয়াও পিং-কে আবার ফিরিয়ে আনতে হল। প্রাথমিক বিশ্লেষণে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে মাও সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করেছিলেন শেষ পর্যন্ত তা পূরণ হয়নি বরং অনেকক্ষেত্রেই বিপরীত ফল দিয়েছে।
যাই হোক, অমীমাংসিত প্রশ্নগুলি মাও-এর চিন্তাধারা আরও বিকাশ সাধনের জন্য শর্তগুলি সৃষ্টি করে। বিপ্লবের ইতিহাসে প্রতিটি পর্বে কিছু প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে যায় এবং এগুলি আবার মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভবিষ্যত বিকাশের জন্য শর্ত হাজির করে। বারবার ব্যর্থতার পরই সফলতা আসে। সাংস্কৃতিক বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু সেটা কোনো বড় কথা নয়। বড় কথা হল মাও প্রকৃত প্রশ্নগুলিকে চিহ্নিত করেছিলেন এবং সেগুলি সমাধানের এক চেষ্টা করেছিলেন। বিপদ যে বাস্তব তা প্রমাণিত হয়েছে এবং ভবিষ্যতের মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা এইসব প্রশ্নের সমাধানের যে প্রচেষ্টা চালাবেন তা মাও-এর প্রচেষ্টার অন্তর্বস্তুর ওপর বিরাটভাবে ভিত্তি করেই চলবে।
অনেকেই আজ মাও সে তুঙ-এর মূল্যায়ন করছেন। অবশ্যই সেটা প্রয়োজন। কিন্তু মাও-এর সামগ্রিক মূল্যায়ন সম্পর্কে শেষ কথা বলার মতো পরিস্থিতি এসে গেছে বলে আমি মনে করি না। স্তালিন সম্পর্কে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি মূল্যায়ন করেছিল। কিন্তু দুনিয়ার কমিউনিস্টরা তা নাকচ করে দিয়েছিলেন। কাজেই মাও সম্পর্কে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়নকেই আমি শেষ কথা বলে মনে করি না। অবশ্যই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়ন মাও-এর সামগ্রিক মূল্যায়নের একটি অংশ। কিন্তু মাও সে তুঙ শুধু চীনের নন। তাঁর মূল্যায়ন করবেন সারা পৃথিবীর মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা এবং সেই মূল্যায়নের জন্য ইতিহাসকে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
আজকের প্রয়োজন বরং মাও চিন্তাধারার আলোকে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূল্যায়ন করা – কেন ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি তা বিবেচনা করা। আমাদের পার্টির চিন্তাধারা সঠিক, এই অবস্থান থেকে মাও-কে বিচার না করে বরং মাও-এর চিন্তাধারার আলোকে আমাদের পার্টির লাইনকে বিচার করতে হবে।
মাও ভুল করেননি এমন নয়। যাঁরাই বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেন ও বিপ্লবী সংগ্রামের জন্য প্রয়াস চালান তাঁরাই ভুল করেন। যারা সংগ্রামে নামে না তারাই কেবল দাবি করে যে তারা কোনো ভুল করেনি। মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনও ভুল করেছিলেন। তবে তাঁদের ভুলগুলি ছিল মহান বিপ্লবীদের ভুল। এমনকি তাঁরা তাঁদের সেই ভুলগুলির মধ্য দিয়েও মানুষের বিপ্লবী সচেতনতাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। মাও-এর ভুলগুলিকেও এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বিচার করতে হবে। যাঁরা সব ঠিক করেছেন বলে দাবি করেছেন ইতিহাস তাঁদের মনে রাখেনি। ইতিহাস মনে রেখেছে মার্কসকেই – লাসাল বা বার্ণস্টাইনকে নয়, ইতিহাস মনে রেখেছে লেনিনকেই – প্লেখানভকে নয়, ইতিহাস মনে রেখেছে মাও-কে – লিউ শাও চি-কে নয়।
১৯৬৮ সালে কলেজে যখন বিপ্লবী রাজনীতি শুরু করি তখন কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয়তে চেয়ারম্যান মাও কথাটি ব্যবহার করা হয়েছিল। সে সময় আমরা ছিলাম মাত্র চার-পাঁচ জন। প্রতিক্রিয়াশীলরা দলবল জুটিয়ে আমাদের সেই ‘ভ্যানগার্ড’ ম্যাগাজিন পুড়িয়ে দিয়েছিল। আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম – ‘বিশ্ববিপ্লবের মহান নেতা মাও সে তুঙ’ স্লোগান দিয়ে। পরবর্তীকালে যখন ধরা পড়লাম তখন সঙ্গে মাও-এর বই থাকার জন্য পুলিশ অফিসারের হাতে নির্মমভাবে মার খেতে হল। পরবর্তীকালে মাও-এর নির্বাচিত রচনাবলী কোনোমতে আমি জেলে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। জেলে সেটা পড়তাম ও অনুবাদ করে অন্যান্য কমরেডদের পড়ে শোনাতাম। সেই দিনগুলিতে এটি ছিল আমার প্রিয় কাজ।
১৯৭৯ সালে অনেক পাহাড় পর্বত পেরিয়ে যখন চীনে গিয়েছিলাম, তখন সেখানে মাও-কে বাতিল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। মোটামুটিভাবে চীন বিপ্লবের সমস্ত স্মরণীয় জায়গাতেই আমরা গিয়েছিলাম এবং সেখানকার প্রবীণ কৃষকদের সাথে তথা বহু মানুষের সাথে আমরা কথা বলেছিলাম। তখন আমারা উপলব্ধি করেছি যে মাও-এর প্রতি চীনের সমস্ত মানুষের, নীচুতলার সমস্ত কর্মীবাহিনীর অগাধ আস্থা ও শ্রদ্ধা আছে এবং চীন থেকে মাও-কে কোনো দিন মুছে দেওয়া যাবে না।
মাও-এর মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে সেদিনও মনে হয়েছিল যে, মাও সে তুঙ তুমি আমাদের চেয়ারম্যান চিরকাল থেকেই যাবে – অবশ্য চীনের চেয়ারম্যান বলে নয়, ভারতীয় বিপ্লবের পথের দিশারী হিসাবে।