আজকাল আমরা প্রায়ই শুনি ভুবনীকরণের এই যুগে জাতি-রাষ্ট্রের চিরাচরিত ভূমিকা ও তাৎপর্য নাকি অনেকটাই হারিয়ে গেছে। মূলত তিনটি পর্যবেক্ষণের ওপর এই অভিমত দাঁড়িয়ে আছে : (ক) বহুজাতিক সংস্থাগুলোর বিপুল বৃদ্ধি, যাদের কার্যকলাপ নিজ রাষ্ট্রের বাইরেও প্রসারিত, (খ) বিস্ময়কর পরিমাণে ও গতিতে লগ্নি পুঁজির এক দেশ থেকে অন্য দেশে সঞ্চালন, (গ) আই এম এফ, বিশ্বব্যাঙ্ক ও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃত্বের ক্রমান্বয়ী বৃদ্ধি। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে , এই যুক্তিগুলোর কোনও ভিত্তি নেই।
বহুজাতিক সংস্থাগুলোর শিকড় এখনও তাদের নিজেদের দেশের মাটিতেই দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। শক্তিশালী কোম্পানিগুলো এবং তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্র পরস্পরকে নানাভাবে সহায়তা করে থাকে এবং রাষ্ট্রগুলো আবার অন্যান্য দেশে অবস্থিত বহুজাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়। আমরা দেখেছি কীভাবে ওয়াশিংটন পরমাণু চুক্তিতে স্বাক্ষরের জন্য নয়া দিল্লীকে চাপ দিয়েছে এবং কিছুদিন আগে জেনারেল ইলেক্ট্রিকের মতো মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর স্বার্থে দায়বদ্ধতার ধারাটিকে বাদ দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে। কয়েকটি সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে, পৃথিবীর বৃহত্তম কোম্পানিগুলোর ব্যাপক সংখ্যাধিকই তাদের সম্পদ-ভিত্তির অর্ধেকেরও বেশি তাদের নিজ নিজ দেশে বজায় রাখে এবং বিশেষভাবে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পরিচালকমণ্ডলীতে বিদেশীদের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। সংক্ষেপে, শক্তিশালী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর উত্থান জাতি রাষ্ট্রের ক্ষয়কে দেখিয়ে দিচ্ছে না। এর বিপরীতে, একদিকে, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর দিক থেকে (এবং সম্প্রতি কিছুটা কম মাত্রায় চীন, ব্রাজিল ও ভারতের মতো দেশগুলোকেও) দুর্বল দেশগুলোর ওপর আরও বড় আকারে অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চাপিয়ে দেওয়ার নতুন কৌশল আমরা দেখতে পাচ্ছি, এবং অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজিকে নতুন মাত্রায় সংহত হয়ে উঠতেও দেখা যাচ্ছে।
এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থের যে প্রবাহ আমরা দেখি, সেটা কি শুধুই তথ্য-প্রযুক্তির বিস্ময় যার ওপর সংশ্লিষ্ট দেশের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই? ভুবনীকরণের প্রবক্তারা এমনই একটি ধারণা সৃষ্টিতে সচেষ্ট রয়েছেন, যাতে কোনও দেশ জাতীয় স্বার্থে অর্থের ঐ প্রবাহকে রোধ করতে চাইলে আগেভাগেই সে প্রচেষ্টাকে রুখে দেওয়া যায়। বাস্তবে কিন্তু প্রযুক্তির সাহায্যে ঐ ধরনের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা যায়, ঠিক যেমন অন-লাইনে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাণিজ্যের সমগ্র পরিসরের ক্ষেত্রে সমস্ত ধরনের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু শাসকশ্রেণীগুলো নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে রাজি নয়। এটা অতএব রাষ্ট্রীয় নীতির প্রশ্ন – কোনওভাবেই তা রাষ্ট্রের পিছু হঠার সাক্ষ্য বহন করে না।
আই এম এফ এবং বিশ্বব্যাঙ্কের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কোনও নতুন সংস্থা নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এগুলো যে অত্যন্ত কর্তৃত্বমূলক হয়ে উঠেছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর মতো কিছু সদস্য রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী প্রবণতাকেই প্রকাশ করে। অন্যভাবে বললে, রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে সাবেকী অর্থনৈতিক (তার সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামরিক) বৈষম্য ছিল ভুবনীকরণ তাকেই তীব্রতর করেছে। আজ গুটিকয়েক রাষ্ট্র বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামনে রেখে পৃথিবীর গতি-প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব করতে চাইছে।
বস্তুত পুঁজিবাদ ও তার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অসম বিকাশের অন্যান্য দৃষ্টান্তের মতো এখানেও আমরা দেখতে পাই, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং পূর্ব ইউরোপে রাষ্ট্রগুলোর পিছু হঠার সাপেক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো কোনও কোনও রাষ্ট্র আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে চলেছে। এছাড়া একই রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে অনেক সময় আমরা দেখি যে কোনও কোনও বিষয়ে (যেমন বাজারের উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ ও ভুবনীকরণের অর্থনৈতিক নীতিগুলোকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া) চূড়ান্ত সক্রিয়তার পাশাপাশি কোনও কোনও ব্যাপারে সে পিছু হঠছে (যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্র)। নৈরাজ্যবাদী এবং দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদীরা এটাই বুঝে উঠতে পারে না। আর তাই ভুবনীকরণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে তারা খাটো করে দেখে ভুবনীকরণের প্রকৃত, সক্রিয় প্রতিভুদের বিরুদ্ধে – দেশীয় শাসকশ্রেণীগুলো ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে – অতীব গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রামকে।