এনজিও বা “অ-সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো” (কেউ কেউ এদের নতুন নামকরণ করেছেন নাগরিক সমাজের সংগঠন) নাগরিক সমাজকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি হিসাবে প্রতিস্থাপিত করে এবং নিজেদের নাগরিক সমাজের প্রবক্তা তথা অগ্রবাহিনী বলে বর্ণনা করে, যারা নাকি রাষ্ট্রের নিস্পৃহতা ও আমলাতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বাজারের এককাট্টা শক্তিগুলো যখন মানুষের জীবনে তীব্র বিপর্যয় সৃষ্টি করছে এবং ব্যাপক সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছে, তখন তারা “কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রবাদ” এবং “বাজারভিত্তিক নির্মম পুঁজিবাদ”-এর মধ্যে এক “তৃতীয় পন্থা” বলে নিজেদের তুলে ধরছে।
রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসাবে দাঁড় করানোটা এক নৈরাজ্যবাদী মোহ। মার্কস ও এঙ্গেলস জার্মান মতাদর্শ নামক রচনায় যেমন দেখিয়েছেন, নাগরিক সমাজ তার বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজেকে জাতি হিসাবে প্রকাশ করে এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নিজেকে রাষ্ট্র হিসাবে সংগঠিত করে। ১৮৪৬ সালে পি আন্নেনকভকে লেখা এক চিঠিতে মার্কস ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “উৎপাদন, বাণিজ্য ও ভোগের বিকাশের এক বিশেষ পর্যায়ের কথা ধরে নিলেই এসে যাবে তার সামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিক গঠনের একটি রূপ; পরিবার, বর্গ বা শ্রেণী-সংগঠনের একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ রূপ, এক কথায় একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নাগরিক সমাজ। একটি বিশেষ নাগরিক সমাজ ধরে নিলেই এসে যাবে একটি বিশেষ রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা নাগরিক সমাজের সরকারী অভিব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।”
অ-সরকারী সংস্থাগুলো নাগরিক সমাজ সম্পর্কে অবলীলায় যে কথাগুলো বলে যায় তা এই বিষয়টাকেই ঝাপসা করে দিতে চায় যে সমাজ নিপীড়ক ও নিপীড়িত, শোষক ও শোষিতের মধ্যে বিভাজিত এবং এই দুই বৈরী শিবিরের মধ্যে নিরবচ্ছিন্নভাবে এক জীবন-মরণের সংগ্রাম চলছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের সমস্ত সমালোচনা সত্ত্বেও কেউ তাদের বিরুদ্ধে অন্তত এই অভিযোগ আনতে পারবে না যে ঐ নিপীড়ক যন্ত্রটিকে উৎখাতের এমনকি কোনও সুদূর কর্মসূচী তাদের রয়েছে। সুতরাং, অ-সরকারী সংস্থাগুলোর কাজ এই জনবিরোধী, নিপীড়নমূলক বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক পেটিবুর্জোয়া প্রত্যুত্তর ছাড়া অন্য কিছু নয়। রাষ্ট্র যখন শাসকশ্রেণীগুলোর হাতে মূলত এক দমনমূলক যন্ত্র হিসাবেই কাজ করে চলে, অ-সরকারী সংস্থাগুলো তখন মূলগতভাবে এক উপশমকারী যন্ত্র হিসাবে জনগণের ক্ষোভকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়, যাতে তা বিপ্লবী পথে প্রবাহিত না হতে পারে। এককথায়, বুর্জোয়া ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা রক্ষার দিক থেকে উভয়েই পরস্পরের পরিপূরক ভূমিকা পালন করে চলেছে। পাঠক লক্ষ্য করবেন, অ-সরকারী সংস্থাগুলো কমিউনিস্ট ইস্তাহারে বর্ণিত এক পুরনো ধারারই প্রতিনিধিত্ব করছে :
“বুর্জোয়া সমাজের অস্তিতটা বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই বুর্জোয়াশ্রেণীর একাংশ সামাজিক অভাব-অভিযোগের প্রতিকার চায়। এঁদের মধ্য পড়েন অর্থনীতিবিদরা, লোকহিতব্রতীরা, মানবতাবাদীরা, শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থার উন্নয়নকারীরা, দুঃস্থ-ত্রাণ সংগঠকেরা … এঁরা সমাজের বর্তমান অবস্থান বজায় রাখতে চান, কিন্তু তার বিপ্লবী ও ধ্বংসকারী উপাদানসমূহ বাদ দিয়ে।”
অ-সরকারী সংগঠনের শুরুর দিকে তাকালে দেখা যাবে, যুদ্ধোত্তর পর্যায়ে এদের কেউ কেউ নজরদারী সংস্থা হিসাবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এরা বিশ্বের বিভিন্ন অংশে রাষ্ট্রের বাড়াবাড়িগুলোর ওপরে নজর রাখত ও সেগুলোর সমালোচনা করত। মানবাধিকার লঙ্ঘন, পরিবেশের ক্ষতি, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও মানুষের দৈন্যদশার উন্নতিবিধানের মতো ইস্যুগুলোর সঙ্গেই তাদের পরিচিতি জড়িয়ে ছিল। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও 'সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর' সংকট আর অন্যদিকে চলমান সাম্রাজ্যবাদী ভুবনীকরণের তীব্রতা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট মতাদর্শগত-রাজনৈতিক পটভূমিতে গত দু-দশকে অ-সরকারী সংস্থাগুলোর সক্রিয়তা অভাবনীয় রকম বেড়ে গেছে। ভুবনীকরণ বিরোধী আন্দোলনে প্রায়শই কয়েকটি বিরাটাকার অ-সরকারী সংস্থা প্রচারের আলো হাতিয়ে নেয়। তারা আবার বিশ্ব সামাজিক মঞ্চের মধ্যে দিয়ে এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, আই এম এফ, বিশ্বব্যাঙ্ক, জি-৭ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইত্যাদির সভাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারিত বিক্ষোভ সমাবেশগুলোর মধ্যে দিয়ে তাদের ভুবনীকরণের নিজস্ব সংস্করণকেও তুলে ধরতে শুরু করেছে। তবে একটু তলিয়ে দেখলে আমরা প্রায় সর্বত্রই রাষ্ট্র ও অ-সরকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও যৌথক্রিয়ার এক ক্রমবর্ধমান ধারা দেখতে পাব, যেখানে সরকারগুলো সামাজিক ক্ষেত্রটিকে কার্যত অ-সরকারী সংস্থাগুলোর এক নেটওয়ার্কের কাছে ইজারা দিয়ে দিয়েছে।
রাষ্ট্র যখন একের পর এক ক্ষেত্রে তার সামাজিক দায়বদ্ধতাকে পরিত্যাগ করছে তখন সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে অ-সরকারী সংস্থাগুলোকে ঐ অপরিহার্য কাজগুলোর দায়ভার নিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে (এবং তা দিচ্ছে রাষ্ট্র ও কর্পোরেট জগৎ)। এই ব্যবস্থাপনার কিছু বিশেষ সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, এতে অনেক কম পয়সায় অনেক বেশি কাজ করানো যায়, কেননা অ-সরকারী সংস্থাগুলোর নিচু স্তরের কর্মীরা সাধারণত সামান্য বেতনে যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে থাকেন। বেতনভোগী কর্মচারিদের বিশাল বাহিনীকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিপুল আর্থিক ও অন্যান্য 'দুর্বহ ভার' থেকে রাষ্ট্র মুক্ত হয়। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র যখন কোনও দায়ভার নেয় (যেমন গরিব মানুষের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা) সেটা তখন আইনি বাধ্যবাধকতা ও গণআন্দোলের শক্তিশালী ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। অ-সরকারী সংস্থাগুলোর সমাজকল্যাণমূলক কাজের ক্ষেত্রে এটা ঘটে না, বরং এরা সামাজিক উদ্যোগগুলোর বে-রাজনীতিকীকরণে সহায়তা করে।
গোটা বিষয়টাকে সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে দেখা যাবে যে, অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান বেসরকারীকরণ, শ্রমিকদের মধ্যে অস্থায়ী ও নারী শ্রমিকদের অনুপাত বৃদ্ধি এবং পরিবেশের ক্রমাবনতির যুগে সমাজব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদী ও সামগ্রিক স্বার্থ ক্ষমতার অপব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ ও ত্রুটি সংশোধনের এক ব্যবস্থাপনা, এক ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দাবি করে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের তুলনায় বেসরকারী সংস্থাগুলোই এই কাজের সঙ্গে বেশি খাপ খায়, আর এই জন্যই রাজনৈতিক-মতাদর্শগত ধারা নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো ক্রমবর্ধমানভাবেই এদের স্বীকৃতি দিয়ে চলেছে।