আমরা এখানে লেনিনের রাষ্ট্র (সংগৃহীত রচনাবলী, খণ্ড – ২৯) থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি এবং তার সঙ্গে মার্কস ও এঙ্গেলসের আরও কিছু বক্তব্য তুলে ধরছি।
রাষ্ট্র বলে কিছু চিরদিন ছিল না। এমন একটা সময় ছিল যখন কোনও রাষ্ট্র ছিল না। যখন ও যেখানেই সমাজে শ্রেণীবিভাজন দেখা দেয়, যখন শোষক ও শোষিত দেখা দেয়, তখনই রাষ্ট্রও দেখা দেয়।
মানুষ মানুষকে শোষণ করতে শুরু করার আগে, সমাজে প্রথম শ্রেণীবিভাজন – দাস ও দাসমালিক – দেখা দেওয়ার আগে ছিল গোষ্ঠীতান্ত্রিক বা ক্ল্যান পরিবার (ক্ল্যান – গোষ্ঠী, যখন মানুষ বংশপরম্পরা অনুসারে একসঙ্গে বসবাস করত)। তখন রাষ্ট্র বলে কিছু ছিল না এবং রীতিনীতি ও প্রথার বলে, গোষ্ঠীর প্রধানরা বা মেয়েরা – যারা তখন প্রায়শই শুধু পুরুষের সমান মর্যাদা ভোগ করত না, অনেক সময়েই মর্যাদায় পুরুষকে ছাড়িয়ে যেত – যে কর্তৃত্ব বা সম্মান ভোগ করত তার বলে পরস্পরের মধ্যে সাধারণ বন্ধন, সমাজ, শৃঙ্খলা রক্ষিত হত এবং কাজের বিন্যাস সাধিত হত। তখন শাসন-বিশেষজ্ঞ হিসাবে কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল না। ইতিহাসে দেখা যায় যে, যখনই এবং যেখানেই সমাজে শ্রেণীবিভাজন দেখা দিল অর্থাৎ সমাজ এমন কয়েকটি দলে বিভক্ত হল যাদের মধ্যে কেউ কেউ স্থায়ীভাবে অন্যদের শ্রমের ফল হস্তগত করার মতো ক্ষমতা অর্জন করল, যেখানে কিছু লোক অন্যদের শোষণ করতে লাগল – তখনই মানুষের প্রতি বলপ্রয়োগের বিশেষ যন্ত্র হিসাবে রাষ্ট্র দেখা দিল।
প্রথম গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীবিভাজন হল – দাস মালিক ও দাস এই দুইয়ের মধ্যে। দাস মালিকরা শুধু উৎপাদনের সমস্ত উপকরণের (জমি ও চাষের সরঞ্জাম, সে সময়ে যতই নিকৃষ্ট ও আদিম হোক না কেন) মালিকই ছিল না, তারা কিছু মানুষেরও মালিক ছিল। এই দলকে বলা হত দাস মালিক, আর যারা অন্যদের জন্য খাটত ও অন্যদের শ্রম সরবরাহ করত তাদের বলা হত দাস।
এই স্তরের পর ইতিহাসে দেখা যায় আরেকটি স্তর – সামন্ততন্ত্র। বেশিরভাগ দেশেই ক্রমবিকাশের ধারায় ক্রীতদাসত্ব ভূমিদাসত্বে পরিণত হল। এখন সমাজে মূল বিভাজনটা হল সামন্ততান্ত্রিক জমিদার ও কৃষক-ভূমিদাসদের মধ্যে। মানুষে মানুষে সম্পর্কের ধরন বদলে গেল। দাস মালিকরা মনে করত যে ক্রীতদাসরা তাদের সম্পত্তি, আইনও এই মতকে সমর্থন করত এবং আইনের চোখে ক্রীতদাসরা ছিল পুরোপুরিভাবে দাস মালিকদের অস্থাবর সম্পত্তি। কৃষক-ভূমিদাসদের বেলাতেও শ্রেণী-উৎপীড়ন ও নির্ভরতা রয়ে গেল, কিন্তু তারা যে সামন্ততান্ত্রিক জমিদারদের অস্থাবর সম্পত্তি একথা আর মনে করা হত না, জমিদার হল কৃষক-ভূমিদাসের শ্রমের মালিক এবং জমিদার তাকে কয়েকটি বিশেষ ধরনের কাজ করতে বাধ্য করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, আপনারা তো জানেনই, ভূমিদাসত্ব ও ক্রীতদাসত্বের মধ্যে কোনও পার্থক্য ছিল না – বিশেষ করে রাশিয়াতে যেখানে ভূমিদাসত্ব সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং সবচেয়ে কুৎসিত রূপে আত্মপ্রকাশ করে।
আরও পরে, বাণিজ্য ও মুদ্রা-প্রচলনের বিকাশ এবং পৃথিবীব্যাপী বাজার গড়ে ওঠার সাথেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজের মধ্যে থেকে এক নতুন শ্রেণী উদ্ভূত হল – পুঁজিপতি শ্রেণী। পণ্যদ্রব্য, পণ্যদ্রব্যের বিনিময় ও টাকার জোরের থেকে এল পুঁজির জোর। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে – বলা উচিত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে – সারা পৃথিবী জুড়ে বিপ্লব দেখা দিল। পশ্চিম ইউরোপের সব দেশে সামন্ততন্ত্র বিলুপ্ত হল। সবচেয়ে দেরিতে তা ঘটল রাশিয়াতে। ১৮৬১ সালে রাশিয়াতেও একটা মৌলিক পরিবর্তন দেখা দিল, যার ফলে এক ধরনের সমাজব্যবস্থার জায়গায় এল আর এক ধরনের সমাজব্যবস্থা – সামন্ততন্ত্রকে হঠিয়ে এল পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদেও শ্রেণীবিভাজন রইল, ভূমিদাসত্বের নানা রেশ ও অবশেষ রয়ে গেল, কিন্তু শ্রেণী-বিভাজনের রূপ মৌলিকভাবে বদলে গেল।
সব পুঁজিবাদী দেশেই পুঁজির মালিক, জমির মালিক, কল-কারখানার মালিকরা চিরকালই জনসংখ্যার একটি নগণ্য অংশ। সমগ্র জনসাধারণের শ্রমের ওপর অখণ্ড নিয়ন্ত্রণ তাদের, কাজেকাজেই তারা সমস্ত শ্রমজীবীর ওপর প্রভুত্ব করে, তাদের উৎপীড়ন ও শোষণ করে। এই শ্রমজীবীদের অধিকাংশই সর্বহারা অর্থাৎ মজুরি-শ্রমিক, যারা উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় নিজেদের শ্রমশক্তি বেচে তবেই জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করতে পারে। সামন্ততন্ত্রের যুগে যে কৃষকরা বিচ্ছিন্ন ও পদানত হয়েছিল, পুঁজিবাদ দেখা দেওয়ার ফলে তাদের এক অংশ (বেশিরভাগ) সর্বহারা হয়ে পড়ল এবং আরেক অংশ (সংখ্যালঘু অংশ) সম্পন্ন ধনী কৃষক হয়ে দাঁড়াল – এরা হল গ্রাম্য বুর্জোয়া, এরা নিজেরাই মজুর খাটাত।
সমাজে শ্রেণীবিভাজন দেখা দেওয়ার আগে রাষ্ট্র বলে কিছু ছিল না। কিন্তু শ্রেণীবিভাজিত সমাজ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রও দেখা দিল এবং কায়েম হল। বরাবরই রাষ্ট্র হল এমন একটি যন্ত্র যা সমাজের বাইরে থাকে এবং এমন সমস্ত মানুষদের দ্বারা চালিত যারা পুরোপুরিভাবে বা প্রায় পুরোপুরিভাবে বা প্রধানত শাসন কার্যে নিযুক্ত। মানুষকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয় – শাসিত ও শাসন-বিশেষজ্ঞ; শাসন-বিশেষজ্ঞদের বলা হয় শাসক, রাষ্ট্রের প্রতিনিধি, এরা সমাজের ঊর্ধ্বে।
বলপ্রয়োগের একটি স্থায়ী যন্ত্র অর্থাৎ রাষ্ট্র ছাড়া সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে অন্য অংশটির জন্য সুব্যবস্থিতভাবে খাটতে বাধ্য করা যায় না। অন্যভাবে বললে রাষ্ট্র হল একটি শ্রেণীর দ্বারা অন্য শ্রেণীকে উৎপীড়নের যন্ত্র, একটি শ্রেণীর দ্বারা অন্য শ্রেণীকে পদানত করে রাখার যন্ত্র। এই যন্ত্রের নানান রূপ। দাস মালিক রাষ্ট্রে রাজতন্ত্র, অভিজাততান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, এমনকি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রও ছিল। যেখানে শুধু দাস মালিকরাই ছিল নির্বাচকমণ্ডলী। আসলে শাসনের রূপে অনেক পার্থক্য দেখা গেছে, কিন্তু তার সারবস্তু একই থেকেছে – দাসদের কোনও অধিকার ছিল না এবং তারা ছিল উৎপীড়িত শ্রেণী; তাদের মানুষ বলে গণ্য করা হত না। সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রেও একই জিনিস দেখি।
শোষণের রূপের পরিবর্তন ঘটায় দাস মালিক রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়াল সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ ঘটনার গুরুত্ব অসীম। দাস-মালিকানা যুগের সমাজে দাসদের কোনও অধিকারই ছিল না, আর তাদের মানুষ বলে গণ্যই করা হত না; সামন্ততান্ত্রিক সমাজে কৃষক জমির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ল। ভূমিদাসত্বের মূল বৈশিষ্ট্যই হল এই যে, সেখানে কৃষকদের (আর সে যুগে কৃষকই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, শহরের লোক ছিল খুবই কম) জমির সঙ্গে বাঁধা বলে মনে করা হত – ভূমিদাসত্ব ধারণাটাই এসেছে এর থেকে। জমিদার কৃষককে যে জমি দিত সেখানে নির্দিষ্ট কয়েকটা দিন সে নিজের কাজ করতে পারত; বাকি দিনগুলোতে কৃষক-ভূমিদাসকে খাটতে হত তার মালিকের জন্য। শ্রেণীসমাজের সারবস্তুটি রয়ে গেল – সমাজের ভিত্তি হল শ্রেণীশোষণ। একমাত্র জমিদারদেরই পূর্ণ অধিকার ছিল; কৃষকদের কোনও অধিকারই ছিল না। আসলে দাস মালিক রাষ্ট্রে দাসদের অবস্থার সঙ্গে তাদের অবস্থায় অল্পই পার্থক্য ছিল। তবুও কৃষকদের মুক্তির পথ প্রশস্ততর হল, কারণ কৃষক ভূমিদাসকে সরাসরিভাবে জমিদারদের সম্পত্তি বলে মনে করা হত না। কিছুটা সময় সে নিজের জমিতে কাজ করতে পারত, বলা যায় যে, তার নিজের কিছুটা সত্তা ছিল।
দাসত্বের যুগে এবং সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও সমাজের একটি নগণ্য সংখ্যালঘু অংশ কখনও বলপ্রয়োগ ছাড়া বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ওপর প্রভুত্ব করতে পারত না। ইতিহাসে বার বার দেখা গেছে উৎপীড়নের জোয়াল ভাঙার জন্য উৎপীড়িতরা চেষ্টা চালিয়েছে। দাসযুগের ইতিহাসে দেখা যায় যে দাসত্বের বিরুদ্ধে অনেক মু্ক্তিসংগ্রাম চলেছে দশক-দশক ধরে। প্রসঙ্গত, জার্মান কমিউনিস্টরা স্পার্টাকাসের অনুসরণেই নিজেদের “স্পার্টাকাসপন্থী” বলে, যিনি দু-হাজার বছর আগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক দাসবিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন। সম্পূর্ণভাবে দাসপ্রথার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত রোমান সাম্রাজ্যকে আপাতদৃষ্টিতে সর্বশক্তিমান বলে মনে হত। স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে সশস্ত্র ঐক্যবদ্ধ দাসবাহিনীর বিরাট অভ্যুত্থান সেই রোমান সাম্রাজ্যের ওপর বহু বছর ধরে আঘাত হেনেছিল, তাকে নাড়া দিয়েছিল বারবার। শেষে দাস মালিকরা তাদের পরাজিত ও গ্রেপ্তার করে তাদের ওপর অত্যাচার চালায়। শ্রেণীসমাজের গোটা ইতিহাস জুড়েই এই ধরনের গৃহযুদ্ধ ঘটেছে। সামন্ততান্ত্রিক যুগ জুড়েও ক্রমাগত কৃষকদের এই ধরনের অভ্যুত্থানগুলো দেখা গেছে।
বাণিজ্য বাড়ার ফলে, পণ্যদ্রব্য আদান-প্রদানের ফলে গড়ে উঠল নতুন এক শ্রেণী – পুঁজিপতি শ্রেণী। পুঁজি দেখা দিল মধ্যযুগের শেষে যখন আমেরিকা আবিষ্কারের পর বিশ্ববাণিজ্য প্রচুর বেড়ে গেল, যখন মূল্যবান ধাতুর পরিমাণ বেড়ে গেল, যখন সোনা ও রূপা আদান-প্রদানের মাধ্যম হয়ে দাঁড়াল, যখন মুদ্রা সঞ্চালনের ফলে কিছু ব্যক্তি অনেক সম্পদের অধিকারী হতে পারল। সারা দুনিয়াতেই সোনা ও রূপাকে সম্পদ মানা হত। জমিদার শ্রেণীর অর্থনৈতিক ক্ষমতা কমে গেল আর নতুন শ্রেণীর – পুঁজির প্রতিনিধিদের – ক্ষমতা বাড়তে থাকল। সমাজ এমনভাবে পুনর্গঠিত হল, যেন সব নাগরিকের মধ্যে সমতা এল, দাস মালিক ও দাসদের মধ্যে পুরনো শ্রেণীবিভাজন দূর হল, পুঁজির পরিমাণ নির্বিশেষে আইনের চোখে সবাই সমান বলে বিবেচিত হল, ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে জমিই থাকুক বা নিজের খাটার ক্ষমতাটুকু বাদে নিঃস্ব ভিখারিই হোক – আইনের চোখে সবাই সমান হল। আইন প্রত্যেককে 'সমানভাবে' রক্ষা করে; যাদের কোনও সম্পত্তি নেই, খাটার ক্ষমতা ছাড়া আর কিছু না থাকায় অবস্থার ক্রমাগত অবনতির ফলে যারা সর্বহারা হয়ে পড়ে তাদের আক্রমণের হাত থেকে সম্পত্তিবানদের সম্পত্তি রক্ষা করে আইন। এমনি হল পুঁজিবাদী সমাজ।
পুঁজিবাদী শাসনে গরিব চাষি ও শ্রমিকদের দমন করার জন্য রাষ্ট্র পুঁজিবাদীদের হাতের যন্ত্র হয়েই রইল, কিন্তু বাইরের খোলস দেখে মনে হত এ রাষ্ট্রে স্বাধীনতা আছে। এই রাষ্ট্র সর্বজনীন ভোটাধিকার ঘোষণা করল, তার সমর্থক, প্রচারক, পণ্ডিত ও দার্শনিকদের মুখ দিয়ে সে ঘোষণা করল যে, এ রাষ্ট্র শ্রেণীরাষ্ট্র নয়। বুর্জোয়া রাষ্ট্রে সবাই সমান – এই মিথ্যা দাবিটাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পুঁজিপতিরা আজ পর্যন্ত সর্বোতভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বহারার পার্টিকেই জনগণকে বোঝাতে হবে যে যতদিন শোষণ থাকবে ততদিন প্রকৃত সমতা আসতে পারে না। বুর্জোয়ারা শ্রমিকের সমান হতে পারে না। বুভুক্ষু মানুষও বিত্তবানের সমান হতে পারে না।
একথা অবশ্য অস্বীকার করা যাবে না যে, সামন্ততন্ত্রের তুলনায় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ও সর্বজনীন ভোটাধিকার যথেষ্ট প্রগতিশীল অগ্রগতির সূচক। সর্বহারাদের বর্তমান ঐক্য ও সংহতি, তাদের যে দৃঢ়বদ্ধ সুশৃঙ্খল বাহিনী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রাম চালাচ্ছে – তা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে এরই ফলে। কৃষক-ভূমিদাসদের মধ্যেও এর কাছাকাছি কিছু ছিল না আর দাসদের কথা তো ওঠেই না। আমরা জানি দাসরা বিদ্রোহ করেছে, দাঙ্গা করেছে, গৃহযুদ্ধ শুরু করেছে – কিন্তু তারা কখনোই সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য পার্টি গড়তে ও সমাজের অধিকাংশকে শ্রেণীসচেতন করে তুলতে পারেনি, পারেনি নিজেদের উদ্দেশ্য পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করতে, এমনকি, ইতিহাসের সবচেয়ে বৈপ্লবিক মুহূর্তেও তারা চিরকাল শাসকশ্রেণীর হাতের ক্রীড়নক হয়েই থেকেছে। বিশ্বজোড়া সামাজিক ক্রমবিকাশের দিক থেকে দেখলে বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্র, সংসদ, সর্বজনীন ভোটাধিকার – সবই বিরাট অগ্রগতির পরিচায়ক। মানুষ পুঁজিবাদের দিকে এগিয়ে এল। একমাত্র পুঁজিবাদের ফলেই, নাগরিক সংস্কৃতির দরুণ, উৎপীড়িত সর্বহারাশ্রেণী আত্মসচেতন হতে পারল এবং দুনিয়াজোড়া শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারল, সারা পৃথিবী জুড়ে লাখ লাখ শ্রমিককে বিভিন্ন পার্টিতে সঙ্ঘবদ্ধ করতে পারল – এ পার্টিগুলো হল সোস্যালিস্ট পার্টি, যেগুলো জনতার সংগ্রামে সচেতন নেতৃত্ব দিচ্ছে। সংসদীয় ব্যবস্থা ছাড়া, নির্বাচনী ব্যবস্থা ছাড়া শ্রমিকশ্রেণীর এ অগ্রগতি সম্ভব হত না। সেই জন্য সাধারণ মানুষের চোখে এ সব জিনিসের গুরুত্ব এত বেশি হয়ে উঠেছে। সেই জন্য বৈপ্লবিক পরিবর্তন এত কঠিন হয়ে দেখা দেয়। সমাজগণতন্ত্রীরা সর্বত্র সংসদীয় গণতন্ত্রের সীমানার মধ্যে অতি সরল এই ধারণার ওপরই তাদের সীমিত সংস্কারের তত্ত্ব ও অনুশীলনকে ভিত্তি করে থাকে। এর বিপরীতে মার্কস ও এঙ্গেলসের সময় থেকেই বিপ্লবী কমিউনিস্টরা উন্নততর সামাজিক ব্যবস্থা গড়ার পূর্বশর্ত হিসাবে পুঁজিবাদী সমাজের আমূল বৈপ্লবিক রূপান্তরণের এবং বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ধ্বংসের ওপর জোর দিয়ে এসেছে।
এই হল লেনিনের রচনার সারসংক্ষেপ। এখন প্রশ্ন হল, বুর্জােয়া রাষ্ট্রকে চূর্ণ করা হলে তার স্থান কে গ্রহণ করবে? তার স্থানে আসবে বিজয়ী সর্বহারা রাষ্ট্র, যার কাজ হবে (ক) ক্ষমতাচ্যুত শত্রু অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণীকে দমিত রাখা এবং (খ) সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের জন্য যথার্থ সমতা ও গণতন্ত্রকে সুনিশ্চিত করা। অন্য কথায়, সর্বহারা তখন রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নিজেই শাসকশ্রেণী হয়ে ওঠে। বিপ্লবোত্তর সমাজের প্রথম পর্যায়ে, অর্থাৎ সাম্যবাদের প্রথম পর্যায়ে বা সমাজতন্ত্রে সর্বহারাকে ক্ষমতাচ্যুত কিন্তু সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস না হওয়া বুর্জোয়াশ্রেণীর ওপর শ্রেণী একনায়কত্ব কায়েম করতে হয়, প্রতিবিপ্লব গড়ে তোলার বুর্জোয়া প্রচেষ্টাকে ক্ষমতার বলে চূর্ণ করতে হয়।
এই স্তর প্রসঙ্গে মার্কস বলেছিলেন : “পুঁজিবাদী সমাজ আর সাম্যবাদী সমাজ, এই দুই-এর মধ্যে রয়েছে একটি থেকে অপরটিতে বিপ্লবী রূপান্তরের এক পর্ব। তারই সঙ্গে সহগামী থাকে একটি রাজনৈতিক উত্তরণ পর্ব যখন রাষ্ট্র সর্বহারার বিপ্লবী একনায়কত্ব ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।” (গোথা কর্মসূচীর সমালোচনী থেকে)।
এই একনায়কত্ব কিন্তু এক-পার্টি শাসন নাও হতে পারে। এই রূপটির প্রয়োগ হয়েছিল রাশিয়াতে, যেখানে সংসদীয় ধারার কোনও ঐতিহ্য ছিল না। কিন্তু একনায়কত্বের অন্য অনেক রূপই থাকতে পারে – ঠিক যেমন রাষ্ট্রের বিভিন্ন রূপের মধ্যে দিয়ে বুর্জোয়া একনায়কত্ব চলছে। লেনিন যেমন ব্যাখ্যা করেছিলেন, সর্বহারার শক্তির অর্থ “প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান এবং নির্বাচনী নীতির অবসান নয়, বরং বক্তৃতাবাজির জায়গা থেকে 'কাজের' সংস্থায় প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর রূপান্তরণ।” উদাহরণস্বরূপ, আমাদের দেশে বিপ্লবের পর বহুদলীয় ব্যবস্থা চলতেও পারে নাও পারে, তবে রূপ যাই হোক না কেন একেবারে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত সমস্ত স্তরেই নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। রাজ্যপালের মতো অ-নির্বাচিত পদগুলোর অবসান ঘটাতে হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার সহ একগুচ্ছ গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রবর্তন করতে হবে। কেননা, প্রতিবিপ্লবীদের ওপর একনায়কত্ব কায়েমের সাথে সাথে নতুন রাষ্ট্রকে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের জন্য প্রকৃত গণতন্ত্রকে সুনিশ্চিত করতে হবে যাতে তাঁরা নতুন সমাজ গঠনে ও তার পরিচালনায় নিজেদের সুবিপুল সৃজনী ক্ষমতার পরিপূর্ণ স্ফূরণ ঘটাতে পারেন।
এই উত্তরণশীল পর্যায় হবে দীর্ঘস্থায়ী, নানা বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে ও আঁকাবাঁকা পথেই তা এগিয়ে যাবে। নতুন সমাজ যখন বস্তুগত ও আত্মিক দিক থেকে বিকাশলাভ করবে, রাষ্ট্রের রূপে সংগঠিত সর্বহারা চালিত শ্রেণীসংগ্রামের প্রক্রিয়ায় অবশেষে যখন ক্ষমতাচ্যুত শাসকশ্রেণীগুলোর অবশিষ্টাংশ, অভ্যাস ও সংস্কৃতিকে নির্মূল করা যাবে, সমাজতন্ত্র যখন উৎপাদকের স্বাধীন ও সমান অংশগ্রহণের ভিত্তিতে উৎপাদনকে পুনর্গঠিত করবে, তখন সমাজতন্ত্রের প্রথম পর্যায় দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ পরিণত সাম্যবাদে উন্নীত হবে।
গোটা প্রেক্ষাপটটাই তখন পাল্টে যাবে এবং রাষ্ট্রটাই তখন অপ্রয়োজনীয় হবে পড়বে :
“দমন করে রাখার মতো কোনও সামাজিক শ্রেণী যখন থাকবে না, যখন শ্রেণী শাসন এবং তার সঙ্গে উৎপাদনের বর্তমান নৈরাজ্যের ওপর গড়ে ওঠা ব্যক্তির জীবনধারণের সংগ্রাম এবং এইগুলো থেকে উদ্ভূত সংঘাত ও অত্যাচার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, তখন আর দমন করার মতো কোনওকিছুই থাকবে না এবং দমনের বিশেষ শক্তি অর্থাৎ রাষ্ট্রটারই প্রয়োজন থাকবে না। এটাই হল প্রথম কাজ যার দ্বারা রাষ্ট্র নিজেকে যথার্থভাবেই সমগ্র সমাজের প্রতিনিধি করে তুলবে – একইসঙ্গে এটাই হবে আবার রাষ্ট্র হিসাবে তার শেষ স্বাধীন কাজ। একের পর এক ক্ষেত্রে সামাজিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে এবং এইভাবে একটা সময়ে সে নিজের থেকেই শেষ হয়ে যাবে … রাষ্ট্রকে 'উচ্ছেদ' করতে হবে না, সে নিজেই একটু একটু করে বিলীন হয়ে যাবে।” (এ্যান্টি ড্যুরিং থেকে)
পার্থ্যকটা অতএব সুস্পষ্ট। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হল সংখ্যাগুরু মেহনতি মানুষদের দমন করার জন্য সংখ্যালঘু শোষণকারীদের হাতে এক যন্ত্র, আর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হল ঠিক এর বিপরীত। গণতন্ত্রের আবরণের আড়ালে তাদের শ্রেণী একনায়কত্বকে চিরন্তন করার জন্য বুর্জোয়াশ্রেণী রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে নিপুণ করে তোলে। জনগণের জন্য গণতন্ত্রকে সম্প্রসারিত করা এবং সমস্ত শ্রেণী, রাষ্ট্রের সকল রূপ, সমস্ত একনায়কত্বের চূড়ান্ত অবসানের লক্ষ্যেই সর্বহারা কায়েমি স্বার্থের ওপর তার একনায়কত্বের কথা ঘোষণা করে ও তা কার্যকরী করে।