মার্কসের সমসাময়িক এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম নৈরাজ্যবাদী পিয়েরে যোশেফ প্রুধোঁ এই মত পোষণ করতেন যে, পুঁজির ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতা সমার্থক, আর তাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মধ্যে দিয়ে মুক্তি অর্জন করা সর্বহারার পক্ষে সম্ভব নয়। মাইকেল বুকানিন এবং পিটার ক্রোপোটকিনও এই চরম নাস্তিসর্বস্বতার প্রতি সহমত পোষণ করতেন, যদিও বিশদ রণনীতি ও কর্মনীতির ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল।
নৈরাজ্যবাদী সিন্ডিক্যালবাদ নামে পরবর্তীকালের এক ধারা মনে করত, ট্রেড ইউনিয়নগুলোই সর্বহারার বিপ্লবী অস্ত্র হয়ে উঠবে এবং সেগুলোই রাষ্ট্রকে হঠিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বুনিয়াদ হবে। রাষ্ট্রের প্রশ্নে মার্কসবাদী ও নৈরাজ্যবাদীদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্যকে লেনিন সংক্ষেপে বিবৃত করেছেন এইভাবে :
“মার্কসবাদী ও নৈরাজ্যবাদীদের মধ্যে পার্থক্যটা হল : মার্কসবাদীরা রাষ্ট্রের পূর্ণ বিলুপ্তিকে তাঁদের লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করলেও তাঁরা স্বীকার করেন যে, সে লক্ষ্য সাধিত হতে পারে কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কর্তৃক সমস্ত শ্রেণীর বিলোপসাধনের পরে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফল হিসাবে, যার পরিণতিতে রাষ্ট্র নিজেই নিঃশেষিত হয়ে পড়ার দিকে এগিয়ে যায়। কোন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের বিলোপ সম্ভব সে কথা না বুঝে নৈরাজ্যবাদীরা রাতারাতি রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ বিলোপ চান।
মার্কসবাদীরা স্বীকার করেন যে রাজনৈতিক ক্ষমতা জয় করার পর সর্বহারার অবশ্য কর্তব্য হল সাবেকী রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেঙে দিয়ে তার জায়গায় সশস্ত্র শ্রমিকদের দ্বারা গঠিত প্যারি কমিউন ধরনের এক নতুন রাষ্ট্র গড়া। নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্রযন্ত্রের ধ্বংস সাধনের কথা বললেও, সর্বহারা তার স্থানে কী বসাবে এবং কীভাবে তারা তাদের বিপ্লবী ক্ষমতা ব্যবহার করবে সে সম্পর্কে তাঁদের ধারণা একেবারেই অস্পষ্ট। নৈরাজ্যবাদীরা এমনকি সর্বহারা কর্তৃক রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাটাকেই অস্বীকার করেন, তাঁরা সর্বহারার বিপ্লবী একনায়কত্বকেই বাতিল করেন।
মার্কসবাদীরা বর্তমান রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে বিপ্লবের জন্য সর্বহারাকে প্রশিক্ষিত করার দাবি জানান। নৈরাজ্যবাদীরা এটাকে নাকচ করে দেন।” (রাষ্ট্র ও বিপ্লব থেকে)
আমাদের নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিত, অর্থাৎ প্রাক-বিপ্লবী পরিপ্রেক্ষিতে তৃতীয় পার্থক্যটা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করেন আইনিবাদ ও সংসদীয় সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবী সর্বহারা সাধারণ পরিস্থিতিতে সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য উপযুক্ত মঞ্চগুলোকে কাজে লাগিয়ে তার মতামত প্রচার করতে পারে, বিপ্লবের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করতে পারে এবং সেটা উচিতও বটে। নৈরাজ্যবাদীরা (এবং আমাদের দেশে মাওবাদীদের মতো নৈরাজ্যবাদী-সমরবাদীরা) জনগণকে যুক্ত করে ঐ ধরনের রাজনৈতিক সংগ্রামকে নাকচ করেন এবং তাঁরা এর পরিবর্তে সাধারণত বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র কার্যকলাপ ও সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী কৌশলের ওপরই জোর দেন।
প্রথম পার্থক্যটি প্রসঙ্গে বলা যায়, “সমস্ত শ্রেণীর বিলোপসাধনের পরে ... সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফল হিসাবে” এই বাক্যাংশটি পরিণত, পূর্ণ-বিকশিত সমাজতন্ত্রকে নির্দেশিত করে, যা হল তার দ্বিতীয় ধাপ বা সাম্যবাদ।