কমিউনিস্ট পার্টি হল সর্বহারার বিপ্লবী পার্টি। এই পার্টি শ্রমিকশ্রেণীকে এবং সমাজের সমস্ত শোষিত অংশকে তাদের আশু স্বার্থের জন্য এবং সমস্ত ধরনের শোষণ ও অন্যায়ের অবসানের জন্য সংগ্রামে সমাবেশিত ও ঐক্যবদ্ধ করে।
কমিউনিস্ট ইস্তাহার-এর সংজ্ঞা অনুসারে, “সর্বহারা অর্থাৎ আধুনিক শ্রমিকশ্রেণী হল শ্রমজীবীদের এমন এক শ্রেণী, যাঁরা কাজ পেলে তবেই বাঁচতে পারেন এবং যাঁরা কাজ পান শুধু তখনই যখন তাঁদের শ্রম পুঁজির বৃদ্ধি ঘটায়। এই শ্রমিকরা নিজেদের একটু একটু করে বেচে দিতে বাধ্য হন, তাই তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যান্য পণ্যের মতো নিজেরাই একটি পণ্য। ফলে প্রতিযোগিতার সমস্ত ঝুঁকি আর বাজারের সবরকম ওঠা-পড়া তাঁদের সহ্য করতে হয়।” সর্বহারা হল সবচাইতে বিপ্লবী শ্রেণী। কারণ ধনতান্ত্রিক সমাজের যে পিরামিডসদৃশ শ্রেণী-কাঠামো রয়েছে তার সবচাইতে তলায় এঁদের অবস্থান; সুতরাং, এঁরা যখন নিজেদের মুক্ত করার জন্য উঠে দাঁড়ান তখন সমগ্র শ্রেণীগত পিরামিডটাই – “সরকারী সমাজের বিপুল ধাঁচাটাই” হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সর্বহারার বিপুল বিপ্লবী শক্তি, বিপ্লবে তার নেতৃত্বকারী ভূমিকা নিহিত রয়েছে বর্তমান সমাজের শ্রেণীবিন্যাসে তার বস্তুগত অবস্থানটির মধ্যে – এই বাস্তবতার মধ্যে যে, নিজেকে মুক্ত করতে গেলে অন্যান্য শ্রমজীবী শ্রেণীর মুক্তি তাকে ঘটাতেই হবে। এছাড়া তাঁদের যৌথ, সংগঠিত, সুশৃঙ্খল জীবনধারা ও আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাঁদের জীবন্ত যোগাযোগের কারণে এবং “শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর মতো কিছুই তাঁদের না থাকার” কারণে সর্বহারাই হয়ে ওঠে বিপ্লবের সবচাইতে যোগ্য, সুদৃঢ়, সংগঠিত অগ্রবাহিনী।
পুরনো শোষণমূলক সমাজ-কাঠামো ধ্বংস করার ক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্ব প্রদানই তাকে নতুন সমাজ গঠনের ক্ষেত্রেও নেতার ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করে। ইউরোপে বুর্জোয়ারা নিজেদের শ্রেণীস্বার্থেই সামন্ততন্ত্র ধ্বংস করার কাজে এবং সেই সুবাদেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গঠনেও নেতৃত্ব দিয়েছিল। সুতরাং “স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব”-র মহান শ্লোগান তুলে ধরেও তারা শ্রেণীবিভাজন ও শ্রেণীশোষণের ব্যবস্থাকে অব্যাহত রেখে তাকে আরও নিপুণ করে তুলেছিল। কিন্তু শোষণ করার মতো কোনও অধস্তন শ্রেণী সর্বহারার নীচে নেই। বরং তার স্বার্থ ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তিই দাবি করে। সুতরাং এই আদলেই সে গড়ে তোলে নতুন সমাজ। বিপ্লবের পরে সে নিজেকে পুনরাবিষ্কার করে এক নতুন ভূমিকায় – নতুন সমাজের স্থপতির ভূমিকায়।
কিন্তু শ্রমিকশ্রেণী নিছক অর্থনৈতিক বা ট্রেড ইউনিয়ন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তার এই ঐতিহাসিক ব্রতকে উপলব্ধি করতে পারে না। তাকে এই ভূমিকা পালনের জন্য সচেতন ও সংগঠিত করে কমিউনিস্ট পার্টি। অন্যভাবে বলতে গেলে, সর্বহারার বস্তুগত ঐতিহাসিক ভূমিকা সচেতন ও কেন্দ্রীভূত অভিব্যক্তি লাভ করে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মধ্যে।