মজুরি শ্রমিকের পুঁজিবাদী শোষণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে যে ধনতান্ত্রিক সমাজ, তার ধ্বংসস্তূপের ওপর মাথা তোলে সাম্যবাদী সমাজ অর্থাৎ শ্রেণীহীন সমাজ। পুঁজি ও মজুরি-শ্রম – বৈরিতার এই দুই মেরুর মধ্যেকার শ্রেণীসংগ্রামকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলে উভয়ের বিলুপ্তি পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই এটা সম্ভব হয়। কমিউনিস্টরা যখন সংসদ বা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে তখন সেটা করে এই উদ্দেশ্যেই, বৈরী শ্রেণীগুলোর স্বার্থকে মেলানোর জন্য নয় বা শ্রেণীসমন্বয়ের জন্য নয়।
বিপরীতপক্ষে, সমাজগণতন্ত্রীরা এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে গ্রহণ করে “পুঁজি ও মজুরি-শ্রম – এই দুই চরম বিপরীতের বিলুপ্তিসাধনের জন্য নয়, বরং এদের দ্বন্দ্বকে কমিয়ে আনার জন্য, সমন্বিত করার জন্য। এই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য যতই ভিন্ন ভিন্ন উপায়ের কথা বলা হোক না কেন, তাতে কম বা বেশি যতটুকু বিপ্লবী রঙ লাগানো হোক না কেন, অন্তর্বস্তুটা একই থেকে যায়। সে অন্তর্বস্তু হল সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তর, কিন্তু তা অবশ্যই পেটিবুর্জোয়া পরিসীমার মধ্যে।” (কার্ল মার্কস রচিত লুই বোনাপার্টের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার গ্রন্থ থেকে)
এক কথায়, সাম্যবাদ হল মুলগতভাবেই বিপ্লবী : এর অনুগামীরা সংস্কারকে মূল্য দেয় বিপ্লবের সোপান হিসাবে। সমাজগণতন্ত্রীরা মূলগতভাবেই শ্রেণী সমঝোতাবাদী ও সংস্কারপন্থী, বিপ্লবকে রোখার জন্যই তারা সংস্কারের কথা বলে এবং সংস্কারের কাজ করে।
এইভাবে তারা পুঁজিবাদী সমাজকে কিছুটা গণতান্ত্রিক, কিছুটা সুসভ্য চেহারায় টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করে চলে। এই জায়গাতেই তাদের পেটিবুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গী বৃহৎ বুর্জোয়াদের অধিকতর বুদ্ধিমান অংশের সঙ্গে মিলে যায়।
এই দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে এবং বিপ্লবী কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে তাদের নাছোড়বান্দা লড়াইয়ের কারণে সমাজগণতন্ত্রীরা ক্ষমতাসীন বুর্জোয়াদের আস্থা অর্জন করে নেয়। সংকটে পড়লে ঐ বৃহৎ বুর্জোয়ারা অনেক সময় নিজেদের মুশকিল আসান হিসাবে বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যেই সমাজগণতন্ত্রীদের সরকার গড়তে দেয়, এমনকি তাতে সাহায্য করে। সেই সরকার তখন কল্যাণকর রাষ্ট্রবাদের (অর্থাৎ গরিবদের কিছু রিলিফ দেওয়া) আশ্রয় নেয় এবং শিল্পে শান্তি ও উন্নয়ন, জাতীয় স্বার্থ ইত্যাদি বুলির আড়ালে শোষক ও শোষিতদের মধ্যে একপ্রস্থ সমঝোতা গড়ে দেয়। এইভাবে তারা শ্রেণীসংঘাতকে স্তিমিত রাখার ও বিপ্লবী দাবানল এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় তারা বুর্জোয়া সংসদবাদের মধ্যে ডুবে গিয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। দুর্নীতি ও জনবিরোধী আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার মতো জঘন্য ব্যাধিগুলো তখন তাদের গ্রাস করে। বহু দেশে, রাজ্যস্তরে আমাদের দেশেও, এ জিনিস অনেক দেখা গেছে।
বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য আর একটি কথা। বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতির কারণে রুশ কমিউনিস্টরা নিজেদের পরিচয় দিতেন রুশ সমাজগণতন্ত্রী শ্রমিক পার্টি বলে। বিপ্লবের পরেই তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে কমিউনিস্ট পার্টি নাম গ্রহণ করেন। লেনিনের অধিকাংশ রচনায় তাই সমাজগণতন্ত্র কথাটি ইতিবাচক অর্থে, কমিউনিস্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
মূল লেখায় যেসব রচনা বা গ্রন্থের নাম দেওয়া হয়েছে (এর মধ্যে পুঁজি গ্রন্থটি অবশ্য প্রথম শিক্ষার্থীর জন্য একটু বেশি কঠিন) তা ছাড়া নিম্নোক্ত বই বা লেখাগুলোকে পরবর্তী পাঠ্যক্রম হিসাবে নেওয়া যেতে পারে :
ফ্রান্সে শ্রেণীসংগ্রাম
ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ
পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উদ্ভব
কি করতে হবে?
“বামপন্থী” সাম্যবাদ – এক শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা
মার্কসবাদ ও সংশোধনবাদ
রাষ্ট্র ও বিপ্লব
চীনা সমাজে শ্রেণীসমূহের বিশ্লেষণ
চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও চীন বিপ্লব
নয়া গণতন্ত্র প্রসঙ্গে