ইতিহাসে গণতান্ত্রিক বিপ্লব দেখা দেয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় পৌঁছে যাওয়ার সেতুরূপে। এর চিরায়ত উদাহরণ হল ইংল্যান্ডে ও ফ্রান্সে বুর্জোয়া বিপ্লব (যথাক্রমে সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিক) যা ভূমিদাস প্রথা ও রাজতন্ত্রকে খতম করে সংসদীয় প্রজাতন্ত্রের সূচনা ঘটিয়েছিল। গণতান্ত্রিক বিপ্লব যেহেতু সামন্ততন্ত্র বিরোধী, তার মূল শক্তি হল ব্যাপক কৃষক জনগণ। ইংল্যান্ডে ও ফ্রান্সে এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিল উদীয়মান পুঁজিপতি শ্রেণী।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব (যেমন নভেম্বর ১৯১৭-র রুশ বিপ্লব) ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রে অগ্রগতি সূচিত করে। এই বিপ্লব পুঁজিবাদী ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান ঘটায়, সমগ্র জনগণের হাতে তুলে দেয় উৎপাদনের মূল মূল উপকরণগুলো, যার পরিচালনভার হাতে নেয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। (“রাষ্ট্র” অধ্যায় দেখুন)। অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে শ্রমিকশ্রেণী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়।
তবে আমাদের বিপ্লব রচনায় লেনিন যেমন বলেছেন, “বিশ্ব ইতিহাসের বিকাশ কিছু সাধারণ সূত্র অনুসরণ করে চললেও … কোনও কোনও যুগপর্বে এই বিকাশধারায় রূপ বা ঘটনা পরম্পরায় কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দেখা যায়”। বাস্তবে যেটা ঘটে তা হল, শ্রমিক আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান শক্তি দেখে, বিশেষত প্যারি কমিউনের (১৮৭১) পর বুর্জোয়ারা ভয় পেয়ে যায় এবং শ্রমজীবী জনতার বিরুদ্ধে সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলোর সাথে এক ঐতিহাসিক সমঝোতায় উপনীত হয়। তারা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজটি পরিত্যাগ করে যার দায়িত্ব অতএব এসে পড়ে নতুন বিপ্লবী শ্রেণী অর্থাৎ আধুনিক সর্বহারার ওপর। এর ফলে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের চরিত্রে এক সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা যোগ হয়। কারণ বুর্জোয়াদের মতো গণতান্ত্রিক বিপ্লবেই থেমে না গিয়ে শ্রমিকশ্রেণী তাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে নিয়ে যায় সমাজতান্ত্রিক স্তর পর্যন্ত। এই ব্যাপারটি লেনিন অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সমাজগণতন্ত্রের দুই কৌশল গ্রন্থে :
“সর্বহারা অবশ্যই গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সম্পূর্ণ করে তুলবে ব্যাপক কৃষক জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, যাতে স্বৈরতন্ত্রের প্রতিরোধ সবলে চূর্ণ করা যায় এবং বুর্জোয়াদের দোদুল্যমানতাকে অকার্যকরী করে দেওয়া যায়। সর্বহারা অবশ্যই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করবে জনগণের মধ্যে আধা-সর্বহারা উপাদানগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, যাতে বুর্জোয়াদের প্রতিরোধ সবলে চূর্ণ করা যায় এবং কৃষক ও পেটিবুর্জোয়াদের দোদুল্যমানতাকে অতিক্রম করা যায়।” (জোর মূল রচনাতেই)
উপরোক্ত সূত্রায়ন বিশেষভাবে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের রাশিয়া সম্পর্কেই প্রযোজ্য ছিল এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লব (যার প্রথম প্রচেষ্টা হয়েছিল ১৯০৫ সালে এবং যা সফল হয়েছিল ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে) থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে (নভেম্বর, ১৯১৭) ধারাবাহিক অগ্রগতি সম্পর্কে বলশেভিক অবস্থানকেই ফুটিয়ে তুলেছিল। কিন্তু এর তাৎপর্য এখানেই সীমিত ছিল না, খুলে গিয়েছিল বিপ্লবী তত্ত্ব ও অনুশীলনে এক বিরাট অগ্রগতির দরজা। এর ভিত্তিতেই মাও-জে-দঙ নয়া (বা জনগণের) গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব গড়ে তোলেন, যা সাম্রাজ্যবাদের যুগে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার পশ্চাদপদ দেশগুলোতে বিপ্লবের মূল পথনির্দেশ হাজির করেছিল। আজকের ভারতীয় বিপ্লব জনগণের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে পড়ে, যার মূল অক্ষ হল কৃষিবিপ্লব এবং প্রধান লক্ষ্যবস্তু হল সামন্ত অবশেষ, সাম্রাজ্যবাদ এবং বৃহৎ পুঁজি। সি পি আই (এম এল)-এর সাধারণ কর্মসূচী ঘোষণা করেছে :
“এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাথমিক লক্ষ্য হবে সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক অবশেষের বিলোপসাধন, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের অবসান, কার্যকরী কর ব্যবস্থা, জাতীয়করণ এবং অন্যান্য উপায়ে বৃহৎ পুঁজির রাশ টেনে ধরা এবং তার ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম এবং সমগ্র শাসনযন্ত্র ও ব্যবস্থাপনার গণতান্ত্রিকীকরণ ঘটানো। বিজয়ী গণতান্ত্রিক বিপ্লব এইভাবে সমাজতন্ত্রের দিকে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হয়ে উঠবে এবং নিরবচ্ছিন্ন ধারায় সমাজতন্ত্রে উত্তরণের বস্তুগত ভিত্তিকে শক্তিশালী করবে।”