মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের দুটি বিশেষ দিক রয়েছে। একটি হল এর শ্রেণীচরিত্র – এই দর্শন প্রকাশ্যেই ঘোষণা করে যে তা সর্বহারার সেবায় নিয়োজিত। দ্বিতীয়টি হল এর বাস্তবমুখিতা। এই দর্শন এ বিষয়ে জোর দেয় যে তত্ত্ব অনুশীলনের ওপর নির্ভরশীল, অনুশীলনকে ভিত্তি করেই তা গড়ে ওঠে, আবার অনুশীলনেরই সেবা করে।
সর্বহারা এমন একটি শ্রেণী যার কোনো বক্তিগত সম্পত্তি নেই। শৃঙ্খল ছাড়া তার হারাবার কিছুই নেই, অন্যদিকে জয় করবার জন্য তার সামনে আছে গোটা পৃথিবী। তাই ক্ষুদে উৎপাদকদের সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত মানসিকতা থেকে তা মুক্ত এবং কোনো বস্তুকে দেখার ক্ষেত্রে একমাত্র তারই এক নিরপেক্ষ, সংস্কারমুক্ত ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মনোভাব থাকা সম্ভব। যেহেতু সর্বহারা একটি পুরোপুরি বিপ্লবী শ্রেণী যার লক্ষ্য সমগ্র মানবজাতির মুক্তি, সেহেতু সর্বহারাই পারে মানবিক চিন্তার সর্বাঙ্গীণ বিপ্লবী পদ্ধতি -- দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে কাজে লাগাতে। নিজেদের গোষ্ঠীগত উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার জন্য অন্য কোনো শ্রেণীই এই বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী ব্যবহার করতে পারে না। আজ পর্যন্ত মানবজাতির যা কিছু ভালো জিনিস বা বিকাশমান চমৎকার ঐতিহ্য – সর্বহারা এই দর্শনের অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করবে এবং আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। সমস্ত বস্তু, শক্তি, সংগঠন ও ব্যক্তিকেই – তাদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক ও দ্বন্দ্বের সমাবেশে এবং বিকাশের প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেখে। সর্বহারার মনের প্রসারতা ও ক্ষুদে উৎপাদকের গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতার মধ্যে পার্থক্যের এটাই হল দার্শনিক ভিত্তি।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ কোনো স্বপ্নবিলাসকে প্রশ্রয় দেয় না বরং বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ দাবি করে। কোনো পরিবর্তন আনতে গিয়ে হতাশাগ্রস্ত বা হঠকারী কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করা থেকে সর্বহারাকে এই দর্শন রক্ষা করে। আত্মমুখীনতার নির্মম শত্রু হল এই দর্শন এবং তা সর্বহারা ও জনগণকে যেমন ভবিষ্যতে আস্থা রাখতে শেখায় তেমনি তাদেরকে বিকাশের যে কোনো নির্দিষ্ট পর্যায়ে বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে সঠিক রণনীতি, কর্মনীতি ও কৌশল সূত্রবদ্ধ করতে ও ধাপে ধাপে বিজয়ের দিকে এগিয়ে যেতে শিক্ষা দেয়। মার্কস বলেছিলেন, “আজ পর্যন্ত দার্শনিকেরা পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেছেন কিন্তু আসল ব্যাপার হল তাকে পরিবর্তন করা।” মার্কসীয় দর্শন, দর্শনকে 'দার্শনিকদের' মৃত বইয়ের মধ্যে বন্দিদশা থেকে বের করে এনে, তার রহস্যের আবরণটাকে ভেঙ্গে দিয়ে ব্যাপক জনগণের হাতে পরিবর্তনের এই অস্ত্রই তুলে দিয়েছে।
এই অস্ত্র হাতে নিয়ে আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারি যে পৃথিবীতে আজকের গোলযোগ পুরনো ব্যবস্থার ভাঙ্গন ও নতুনের সৃষ্টি -- এই প্রক্রিয়ারই ফল, বুঝতে পারি এই ভাঙ্গনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে শান্তি প্রগতি ও স্থায়িত্বের নতুন যুগ আনার কাজে বিপ্লবী অগ্রবাহিনীর কী ভূমিকা।