কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ইতিহাসকে অধ্যয়ন করেছিলেন দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে আর মানুষের সামাজিক জীবনকে বিশ্লেষণ করেছিলেন বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে, এইভাবেই আবির্ভাব ঘটেছিল ঐতিহাসিক বস্তুবাদের। আমরা এখন ঐতিহাসিক বস্তুবাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করব।
(১) ভাববাদের মত, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ কোনো “সার্বজনীন সত্তা” বা “অতিপ্রাকৃত শক্তি”র মধ্যে সামাজিক অগ্রগতির কারণ অনুসন্ধান করে না, বরং মানুষের বাস্তব জীবনেই তার অনুসন্ধান চালায়। বাঁচার জন্য মানুষের প্রয়োজন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শক্তি ইত্যাদি অনেক কিছু। আর এইসব কিছু পাওয়ার জন্য মানুষকে এগুলি উৎপাদন করতে হয়। উৎপাদনই হল প্রথম ঐতিহাসিক কাজ যা মানবসমাজকে বাকি প্রাণীজগত থেকে আলাদা করে। উৎপাদনের জন্য মানুষের চাই উৎপাদনের উপকরণ (লাঙল, যন্ত্র ইত্যাদি)। উৎপাদনের উপকরণ, মানুষের শ্রম, শ্রমের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা (যার সাহায্যে মানুষ উৎপাদন করে) -- এই সব কিছু মিলিয়ে হল উৎপাদিকা শক্তি। কিন্তু এটা উৎপাদনের একটি দিক মাত্র। উৎপাদনের জন্য, প্রকৃতি থেকে বেঁচে থাকার উপাদান আহরণের জন্য, কেবলমাত্র উৎপাদিকা শক্তিই যথেষ্ট নয়। একমাত্র নিজেদের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেই মানুষ প্রকৃতি থেকে জীবনধারণের উপকরণ সংগ্রহ করতে পারে, এই সম্পর্ক যেমন পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক হতে পারে, তেমনি জনসমষ্টির এক অংশ দ্বারা অন্য অংশকে দাবিয়ে রাখার সম্পর্কও হতে পারে। উৎপাদনের প্রক্রিয়ায়, মানুষের নিজেদের মধ্যে যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে তাকে বলা হয় উৎপাদন সম্পর্ক। উৎপাদনের সাহায্য করার জন্য উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদিকা শক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। উৎপাদিকা শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্ক দুইয়ে মিলে গঠিত হয় উৎপাদন ব্যবস্থা বা উৎপাদনের ধরন (mode of production)। উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের ফলে সমাজের পরিবর্তন ঘটে।
(২) অধিবিদ্যার মতো ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এই উৎপাদন ব্যবস্থাকে এক স্থির, জড় এবং স্থায়ী ব্যাপার হিসেবে দেখে না, বরং সদাপরিবর্তনশীল ও রূপান্তরময় হিসেবে মনে করে। যে কোনো উৎপাদন ব্যবস্থাতেই প্রথমে ঘটে উৎপাদিকা শক্তির পরিবর্তন এবং উৎপাদিকা শক্তির মধ্যে আবার উৎপাদনের উপকরণে পরিবর্তন আসে সবার আগে। এই কারণে, যে কোনো উৎপাদন ব্যবস্থাতেই উৎপাদনের উপকরণ হল সবচেয়ে সচল উপাদান। উৎপাদনের উপকরণের দ্বারা শ্রমের সংগঠন নির্ধারিত হয়। নতুন উৎপাদিকা শক্তি উৎপাদন সম্পর্কে পরিবর্তন দাবি করে -- চলতি পুরনো উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে তার সংঘাত ঘটে। পরিশেষে পুরনো উৎপাদন সম্পর্ক ধ্বংস হয়, আসে নতুন উৎপাদন সম্পর্ক বা নতুন উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধিতে সহযোগিতা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা আজ পর্যন্ত পাঁচ ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থা এবং তার ফলে পাঁচ রকমের সমাজব্যবস্থা দেখেছি -- আদিম সাম্যবাদ, দাসব্যবস্থা, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্র।
(৩) অধিবিদ্যার বিপরীতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ মনে করে যে, উৎপাদিকা শক্তিও – পরিমাণ থেকে গুণ, নিম্নতর থেকে উচ্চতর, সরল থেকে জটিল – এইভাবেই বিকাশলাভ করে। আদিম যুগে, মানুষের ছিল শুধু পাথরের হাতিয়ার, তাই একমাত্র একটি সমষ্টিবদ্ধ ইউনিট (পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত) হিসেবেই তাদের পক্ষেও প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাগুলির মোকাবিলা করা এবং কোনো রকমে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল। কিন্তু উন্নত ধরনের পাথরের সন্ধানের (তাদের পাথরের যন্ত্রকে আরও মসৃণ ও ছূঁচালো করার উদ্যেশ্যে) প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা আবিষ্কার করল তামা এবং অন্যান্য ধাতু। ধাতুর আবির্ভাব আদিম মানুষের উৎপাদনের উপকরণে এবং ধীরে ধীরে তাদের সমগ্র সামাজিক জীবনে আনল বৈপ্লবিক পরিবর্তন। পাথরের হাতিয়ারে পরিমাণগত পরিবর্তন ধীরে ধীরে এক গুণগত উল্লম্ফনের দিকে মোড় নিল। তাদের উৎপাদনের উপকরণে পরিমাণগত পরিবর্তন তাদের চলতি উৎপাদন সম্পর্ককে বড় একটা প্রভাবিত করেনি। কিন্তু উৎপাদন উপকরণে এই গুণগত উল্লম্ফন উৎপাদনের নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখার স্বার্থে দাবি জানালো নতুন উৎপাদন সম্পর্কের। এই নতুন উৎপাদন উপকরণ জীবনধারণের নতুন নতুন রাস্তা খুলে দিল – কেউ চাষাবাদকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করল, কেউ বেছে নিল ধাতুর কাজ ও হস্তশিল্প, কেউ বা শিকার নিয়েই পড়ে রইল। এলো শ্রমের বিভাজন, শুরু হল বিনিময়ের প্রত্যক্ষ রূপ, এবং ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি হল। এইভাবে গোষ্ঠী মানবের (tribals) জীবনে ধাতুর প্রবেশ তাদের আদিম সামাজিক জীবনকে সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিল। উৎপাদন বৃদ্ধি পেল, কিছু উদ্বৃত্ত উৎপাদন সম্ভব হল এবং কিছু কিছু উৎপাদনের উপকরণ অতিরিক্ত হয়ে পড়ল। এই অতিরিক্ত উৎপাদন উপকরণকে যথাসম্ভব কাজে লাগাবার জন্য নতুন উৎপাদন সম্পর্কের প্রয়োজন হয়ে পড়ল এবং প্রতিষ্ঠিত হলও। গোষ্ঠীযুদ্ধে পরাজিত বন্দীদের মেরে না ফেলে এখন থেকে তাদের দাস হিসেবে উৎপাদিকা শ্রমে নিয়োগ করা হল। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পুরনো উৎপাদন সম্পর্ক ভেঙে গিয়ে এইভাবে প্রতিষ্ঠিত হল দাস ব্যবস্থার ভিত্তিতে নতুন সম্পর্ক।
(৪) উৎপাদন উপকরণের বিকাশের প্রক্রিয়ায় নতুন উপকরণ যে সামাজিক পরিবর্তনকে ডেকে আনতে পারে সেকথা মাথায় রেখে মানুষ সচেতনভাবে নতুন উৎপাদন উপকরণ আবিষ্কার করে না। তার আশু প্রয়োজন মেটাতেই মানুষ নতুন উপকরণ আবিষ্কার করে। তাই উৎপাদনের উপকরণের বিকাশকে একটা পর্যায় পর্যন্ত স্বতস্ফূর্ত ও অসচেতন বলা যেতে পারে, কিন্তু এটা একটা পর্যায় পর্যন্তই। পুরনো উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যেই নতুন উৎপাদিকা শক্তি যখন পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়, তখনই তাদের প্রতিনিধিত্বকারী নতুন শ্রেণীসমূহের আবিষ্কার ঘটে, এবং এই নতুন শ্রেণীসমূহের সাথে আসে নতুন চিন্তা, নতুন রাজনীতি, নতুন আইন ইত্যাদি। অর্থাৎ এক কথায় নতুন উৎপাদিকা শক্তি প্রতিনিধিত্বকারী নতুন তত্ত্ব আবির্ভূত হয়। তারপর এই নতুন তত্ত্ব নতুন শ্রেণীগুলোকে সমাবেশিত করে এবং সচেতন প্রয়াসের মধ্য দিয়ে তারা পুরনো উৎপাদন সম্পর্কের প্রতিনিধিত্বকারী পুরনো শ্রেণীসমূহকে ক্ষমতাচ্যূত করে। এইখানেই তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং এই কারণেই লেনিন বলেছেন, “বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন হতে পারে না।” মার্কসের ভাষায়, “এই উৎপাদন সম্পর্কগুলি একত্রিত হয়ে সমাজের অর্থনৈতিক বনিয়াদ সৃষ্টি করে, এই বনিয়াদের সঙ্গে নির্দিষ্ট ধরনের সমাজচেতনার সামঞ্জস্য আছে, এবং এই বাস্তব ভিত্তির উপরই আইনগত ও রাজনৈতিক ইমারত গড়ে ওঠে। সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও বৌদ্ধিক জীবনধারাকে সাধারণভাবে বাস্তব জীবনের উৎপাদন পদ্ধতিই নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের চেতনা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে না বরং বিপরীত দিক থেকে মানুষের সামাজিক সত্তাই তার চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিকাশের একটি বিশিষ্ট স্তরে সমাজের বাস্তব উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে উৎপাদন-ব্যবস্থার পারস্পরিক সম্পর্কগুলির বিরোধ ঘটে, কিংবা ঐ একই ব্যাপারকে আইনের ভাষায় বলতে গেলে, যে সম্পত্তি-সম্পর্কের গণ্ডিতে উৎপাদিকা শক্তি বিকাশলাভ করেছিল তার সঙ্গেই বিরোধ বাধে। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের বিভিন্ন রূপ থেকে এখন এই সম্পর্কগুলিই সে-শক্তির শৃঙ্খলে পরিণত হয়। তখন আরম্ভ হয় সামাজিক বিপ্লবের যুগ। অর্থনৈতিক বনিয়াদের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বিরাট ইমারত অল্পাধিক দ্রুত বেগে বদলে যেতে থাকে।” সহজেই দেখা যায় যে উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক বনিয়াদ পরিবর্তিত হওয়ার পরেও কিছু সময় পর্যন্ত পুরনো উপরিকাঠামো (পুরনো ধ্যান-ধারণা, সংস্কৃতি অভ্যাস) থেকে যায় এবং নতুন উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশে বাধা দেয়। সুতরাং উৎপাদন ব্যবস্থা উপরিকাঠামোকে নির্ধারণ করে এবং এই উপরিকাঠামোও আবার উৎপাদন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে।
আজকের দুনিয়াতে বৃহৎ বুর্জোয়ারা অনেক কারখানা ও উৎপাদন উপকরণের মালিক এবং মুনাফার উদ্দেশ্যে তারা উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ করে। যখন তাদের মুনাফা কমতে থাকে তারা কারখানা বন্ধ করে দেয়, হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে, বিপুল পরিমাণে উৎপাদিকা শক্তির ধ্বংস হয়। উৎপাদিকা শক্তি আজ পুরনো উৎপাদন সম্পর্কের অর্থাৎ পুঁজি আর মজুরিশ্রমের সম্পর্কের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত। এর ফলে বর্তমান যুগ সমাজ বিপ্লবের যুগ। নতুন উৎপাদিকা শক্তির প্রতিনিধি আন্তর্জাতিক সর্বহারা বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছে। একমাত্র নতুন উৎপাদন সম্পর্ক অর্থাৎ উৎপাদন উপকরণের ওপরে সাধারণ মালিকানার সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কই পারে আজ নতুন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশকে বাধামুক্ত করতে।
কৃষকরা চায় উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ – নিজের আওতায় এনে আরও বেশি বেশি জমি (জমিদাররা যা অনুৎপাদনকারী বা স্বল্প উৎপাদনকারী করে রেখেছে) চাষ করতে ও কৃষিকে উন্নত করে তুলতে। কিন্তু চলতি উৎপাদন সম্পর্কের সাথে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটানোর এই প্রচেষ্টার বিরোধ বাধে। একমাত্র জমিদার ও তাদের স্বার্থরক্ষাকারী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করেই তাদের (কৃষকদের) পক্ষে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটানো সম্ভব।
অতএব নতুন উৎপাদন উপকরণ নিজেই উৎপাদন সম্পর্ককে পরিবর্তিত করে না। সুনিশ্চিতভাবেই এই নতুন উৎপাদন উপকরণসমূহ পুরনো উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তির ক্ষয় ডেকে আনে, কিন্তু তবুও সমাজ বিপ্লব ছাড়া গুণগত পরিবর্তন আসে না। ধরা যাক পুরনো উৎপাদন সম্পর্কই বজায় আছে এবং ওপর থেকে কিছু মাত্রায় নতুন উৎপাদন উপকরণ ঢুকিয়ে দেওয়া হল – তাহলে কী হবে? নিশ্চিতভাবেই এতে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ বাধামুক্ত হবে না। পরিবর্তে বরং এতে কিছু নতুন সামাজিক গঠনের জন্ম হবে, পুরনো শ্রেণীগুলিকে নতুন ধাঁচে দেখা যাবে। ভারতবর্ষে 'সবুজ বিপ্লব' এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
অধিবিদ্যা কোনো উৎপাদন ব্যবস্থাকে অন্যান্য উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হিসেবে দেখতে অস্বীকার করে, এর ফলে ঐ উৎপাদন ব্যবস্থার কিছু কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে তা অক্ষম [যেমন, কেন লাগাতার কৃষি উন্নতি ঘটাবার মতো মূলকাঠামোগত সুযোগসুবিধা (Infrastructural Facilities) ভারতের কম ছিল, কেন সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামীণ উন্নতি বা 'সবুজ বিপ্লব' প্রকল্পে টাকা ঢেলেছে, কেন অতিরিক্ত উৎপাদন সত্ত্বেও ভারত আজ গম আমদানি করে ইত্যাদি]। যে গতি সূত্রগুলো কোনো উৎপাদন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলো সম্পর্কে এবং কিভাবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক অবস্থায় উৎপাদন উপকরণ বিভিন্নভাবে উৎপাদন সম্পর্কের উপর ক্রিয়া করে এবং এর ফলে কিভাবে শ্রেণীসমূহে ও সামাজিক কাঠামোসমূহে পর্বর্তিন সংঘটিত হয় সে সম্পর্কে অধিবিদ্যা পুরোপুরি অজ্ঞ। অধিবিদ্যাবাগীশরা শ্রেণীসমূহকে বা সামাজিক গঠনসমূহকে এক রকম ছকেবাঁধা প্রস্তুরীভূত জিনিসের মতো করে দেখে। ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে আধিবিদ্যক পণ্ডিতেরা গ্রামভারতের জায়গায় জায়গায় গুটিকয়েক ট্রাক্টর দেখেই চেঁচিয়ে ওঠেন : “গ্রাম-ভারতে পুঁজিবাদ বিকাশলাভ করছে।”
বিভিন্ন ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে, বিকাশের রূপ কিভাবে বিভিন্ন রকমের হয় তা আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য আসুন আমরা পুঁজির বিকাশের উদাহরণটি দেখি :
ভারতবর্ষ ও আমেরিকা আবিষ্কৃত হয়, বিশ্ববাজার জন্মলাভ করে, পণ্যদ্রব্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সে পণ্য উৎপাদন দ্রুত বিকাশলাভ করে, ধীর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ছোট কারিগর ( journeymen) ও গিল্ড মালিকরা (guild-masters) পুঁজিপতিতে পরিণত হয়। মার্কসের ভাষায়, এটাই ছিল পুঁজিবাদের বিকাশের প্রকৃত বিপ্লবী পথ।
ব্রিটেন ও ফ্রান্সে পুঁজিবাদ বিকশিত হয়, অনেক দেশ এদের উপনিবেশে পরিণত হয়, পুঁজিবাদী সংকটের (অত্যুৎপাদন) চক্র ইতিমধ্যেই এইসব দেশে শুরু হয়ে যায় এবং ব্যাপকহারে সর্বহারা আন্দোলনেরও সূচনা হয়। এই অবস্থায় জার্মানি ও রাশিয়াতে যে পুঁজির বিকাশ হয় তা স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ছিল এবং সর্বহারা আন্দোলনকে ভীষণ ভয় করত, ফলে তা খুব ধীরে এবং সতর্কভাবে সামন্ততন্ত্রের ক্ষতিসাধন করতে থাকে এবং নানাভাবে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে একজন প্রত্যক্ষ উৎপাদকের পক্ষে পুঁজিপতিতে পরিণত হওয়াটা ছিল বড়ই কঠিন। বাণিজ্যিক শ্রেণী (ব্যবসায়ী সম্প্রদায়) উৎপাদনের ওপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে এবং পুঁজিপতিতে পরিণত হয়। এই পুঁজির চরিত্র হল রক্ষণশীল এবং দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের রক্ষণাধীনে তা বিকশিত হয়।
সাম্রাজ্যবাদের প্রাক্কাল পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদের যুগ – সমগ্র পৃথিবী মুষ্টিমেয় একচেটিয়া বুর্জোয়াদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গেছে। এই একচেটিয়া বুর্জোয়াদের দল প্রচুর পুঁজি জড়ো করল, প্রায় সমস্ত উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যা ও পরিচালন দক্ষতার ওপরে কায়েম করল তাদের একচেটিয়া মালিকানা। তাদের পৃথিবীব্যাপী বিক্রয়সংস্থা ছিল এবং কাঁচামালের উৎসগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণও ছিল এবং পণ্য-রপ্তানির তুলনায় পুঁজি-রপ্তানি তাদের কাছে ইতিমধ্যেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এই রকম পরিস্থিতিতে উপনিবেশসমূহে পুঁজি জয়লাভ করল। পুঁজি, প্রযুক্তিবিদ্যা, পরিচালনা, বাজার এবং কাঁচামাল – যাবতীয় ব্যাপারেই এই পুঁজিপতিরা সাম্রাজ্যবাদীদের উপর নির্ভরশীল ছিল। বিদেশী পুঁজির বৃদ্ধি ছিল তার নিজস্ব বিকাশের প্রাথমিক শর্ত। উপনিবেশসমূহের অতিরিক্ত সম্পদ গ্রাস করে নেওয়ার জন্য বিদেশী পুঁজির কাছে আরও একটি মাধ্যম এভাবে তৈরি হল। আজও এই অবস্থা অব্যাহত রয়েছে। এইভাবে উপনিবেশসমূহে যে পুঁজির আবির্ভাব ঘটল, তার চরিত্র হল মর্মবস্তুতে মুৎসুদ্দি (Comprador)।
অধিবিদ্যা বাস্তব ঐতিহাসিক পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্নভাবেই পুঁজির বিকাশকে দেখে। তাই যাঁরা অধিবিদ্যায় ভুগছেন তাঁরা অনেক সময় উপনিবেশের পুঁজিকে ব্রিটিশ ও ফরাসি পুঁজির মতো বিপ্লবী চরিত্র-বিশিষ্ট মনে করেন। তাঁদের মধ্যে অন্য কেউ কেউ আবার রাশিয়া ও জার্মানির পুঁজির সঙ্গে এর তুলনা করেন।
এখানে আমরা তিনটি ঐতিহাসিক পরিবেশে পুঁজির প্রভাবশালী (প্রধান) দিকটি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। দ্বন্দ্ববাদ অনুসারে, পুঁজির বিকাশের ক্ষেত্রে এই প্রভাবশালী, প্রধান অংশের পাশাপাশি একটি গৌণ অংশও থাকে।
ইংল্যান্ডে টোরী আর হুইগ, ফ্রান্সে জিরান্দোপন্থী ও জ্যাকোবিনপন্থী, জার্মানি ও রাশিয়াতে রক্ষণশীল ও উদারনৈতিক বুর্জোয়া উপনিবেশসমূহে মুৎসুদ্দি ও জাতীয় বুর্জোয়া -- এরাই হল যথাক্রমে প্রধান ও অপ্রধান অংশের প্রতিনিধি। উভয় ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় অংশটি হল ছোট ও মাঝারি বুর্জোয়া। অধিবিদ্যা পুঁজির বৃদ্ধি ও বিকাশের মাত্র একটি দিককেই দেখে, ফলে লাইন, কর্মনীতি, স্লোগান সবকিছুু নির্ধারণেই গুরুতর ভুল করে।
(৫) শ্রেণীবিভক্ত সমাজে, প্রতিটি উৎপাদন ব্যবস্থা ও একটি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকে। যেমন, প্রাচীন পৃথিবীতে দাস-মালিকদের রোমান সাম্রাজ্য, গ্রীসের সামন্ত সাম্রাজ্য এবং বর্তমান দুনিয়ায় পুঁজির বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদ। প্রত্যেক ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে, যা উপনিবেশ স্থাপনকারী দেশসমূহের উৎপাদন ব্যবস্থা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। ঔপনিবেশক ব্যবস্থার উৎস হল শোষণভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা -- যার নিজস্ব একটা প্রবণতাই হল নিজের সমাজের এবং সাথে সাথে এই প্রক্রিয়ায় অন্য দেশেরও বেশি বেশি অতিরিক্ত উদ্বৃত্ত গ্রাস করা। বিভিন্ন জাতির অসম বিকাশের ফলে এটা সম্ভবও হয়। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার সর্বোচ্চ রূপ যুক্ত থাকে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ রূপ সাম্রাজ্যবাদের সাথে। আজকের দিনের নয়া-উপনিবেশবাদ হল উপনিবেশবাদের সবচেয়ে উন্নত (sophisticated) রূপ। মুষ্টিমেয় কিছু আন্তর্জাতিক একচেটিয়া গোষ্ঠী, কেবলমাত্র পুঁজি, প্রযুক্তিবিদ্যা, পরিচালন দক্ষতা, বাজারের সুবিধা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের ছাড়াই, অভূতপূর্বভাবে পৃথিবীব্যাপী সমস্ত অনুন্নত ও দুর্বল দেশসমূহ থেকে প্রায় সমস্ত উদ্বৃত্ত কেড়ে নিচ্ছে। সারা পৃথিবীর বিশাল উৎপাদিকা শক্তি কেবলমাত্র মুষ্টিমেয় একচেটিয়া কারবারির বিপুল মুনাফা সৃষ্টির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এই কারবারিরা -- যখনই তাদের বিপুল পুঁজি সংকটের মুখে পড়ে তখনই গোটা পৃথিবীকে ঠেলে দেয় শ্রমশক্তি ও সম্পদেল বিরাট ধ্বংসের মধ্যে। এমনকি বিশ্বযুদ্ধের অগ্নিকুণ্ডের মধ্যেও। এইভাবে বিশ্বজোড়া উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাম্রাজ্যবাদ। সারা বিশ্বের সমস্ত দেশের অতিরিক্ত (surplus) সম্পদ গ্রাস করার জন্য, সাম্রাজ্যবাদ সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া ও অনুন্নত আধা-সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কগুলিকে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু একই সাথে সে তার বিপরীতকেও নিয়ে এসেছে -- তাহল আন্তর্জাতিক সর্বহারা, নিপীড়িত জনগণ ও জাতিসমূহের ঐক্য।
(৬) সমাজের গতিসূত্রগুলিকে তুলে ধরে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সেই সূত্রের ওপর ভিত্তি করে সমাজগঠনে আমাদের অনুপ্রাণিত করে। যদি নতুন উৎপাদিকা শক্তি এবং পুরনো উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব, পরস্পরের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত শ্রেণীসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং নতুন ও পুরনোর দ্বন্দ্বের ফলেই সমাজ বিকশিত হয়, তবে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে কোন উৎপাদন সম্পর্ক আজ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা দেখতে হবে। সমাজের মধ্যে প্রধান দ্বন্দ্ব খুঁজে বের করবার এটাই হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদী পদ্ধতি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী উৎপাদন সম্পর্কই নতুন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে বিশ্ব-জনগণের দ্বন্দ্বই প্রধান দ্বন্দ্ব। কিন্তু দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি অনুযায়ী যে কোনো ঐতিহাসিক পর্যায়েই আমাদের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে একটি একক সত্তা হিসেবে দেখলে চলবে না। তাই নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে বিশ্ব-জনগণের দ্বন্দ্বই আজ প্রধান দ্বন্দ্ব হয়ে উঠেছে।
এই একই পদ্ধতিতে জাতীয় ক্ষেত্রেও প্রধান দ্বন্দ্ব খুঁজে বের করতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে জনগণের দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব বলে একথা ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই যে, প্রত্যেক দেশের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। এই ধরনের সূত্রায়ণ অধিবিদ্যার পরিচয় দেয়। যখন আমরা বলি যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে জনগণের দ্বন্দ্বই প্রধান দ্বন্দ্ব, তখন সেটা বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন দ্বন্দ্বের সাধারণ রূপ মাত্র। তাই বিভিন্ন দেশে প্রত্যক্ষ সামরিক অনুপ্রবেশ রয়েছে, সেখানে অনুপ্রবেশকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে সবচেয়ে বড় বাধা। তাই সেখানে সেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে ব্যাপক জনগণের দ্বন্দ্বই প্রধান দ্বন্দ্ব হয়ে ওঠে। কিন্তু যে সমস্ত দেশে প্রত্যক্ষ সামরিক অনুপ্রবেশ নেই, সেখানে দেশের মধ্যকার কোনো উৎপাদন সম্পর্কই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে প্রত্যক্ষ বাধা হিসাবে কাজ করে। সুতরাং সেই উৎপাদন সম্পর্কের সঙ্গে ব্যাপক জনগণের দ্বন্দ্বই প্রধান দ্বন্দ্ব হিসাবে থাকে। তাই যদি একাধিক পুরনো উৎপাদন সম্পর্ক প্রত্যক্ষ বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি প্রয়োগ করেই আমাদের প্রধান বাধা খুঁজে বার করতে হবে। একমাত্র এই প্রধান দ্বন্দ্বের সমাধান করেই সামাজিক বিকাশে উল্লম্ফন ঘটানো যায়।
(৭) আজ পর্যন্ত ইতিহাসে যে কোনো উৎপাদন ব্যবস্থাতেই কোনোরকমে বেঁচে থাকার জন্য পরিশ্রমেই সমাজের অধিকাংশ সদস্যের সমস্ত বা প্রায় সমস্ত সময় ব্যয়িত হয়েছে। সেইজন্য সমগ্র মানবসমাজ প্রকৃতির নিয়মসমূহ অনুধাবন করে তাকে পরিবর্তিত করা এবং তার উপর প্রভুত্ব অর্জন করবার মতো অবস্থায় কখনোই উপনীত হয়নি। কিন্তু অভূতপূর্ব উৎপাদন ক্ষমতার অধিকারী আধুনিক শিল্প আজ আমাদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। যদি আধুনিক শিল্পকে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে তার প্রচণ্ড উৎপাদন ক্ষমতাকে কাজে লাগানো যায় তাহলে মানবসমাজ স্বল্প সময়েই তার জীবনধারণের উপকরণ সংগ্রহ করতে পারবে এবং দৈনন্দিন জীবনের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়ে প্রকৃতির প্রভুত্ব অর্জনের পথে দ্রুত এগোতে পারবে। আধুনিক শিল্প এই কাজকে সম্পূর্ণ করার বাস্তব শর্ত তৈরি করেছে। আমাদের সঙ্গে রয়েছে বিকাশের পূর্ণাঙ্গ প্রক্রিয়ার ইতিহাস (আদিম সাম্যবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে ভবিষ্যতের উচ্চতর সাম্যবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বাস্তব ভিত্তি সৃষ্টি পর্যন্ত)। শুধু তাই নয়, যে শ্রেণী আধুনিক ইতিহাসকে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের জোয়াল থেকে মুক্ত করতে সক্ষম, সেই সর্বহারাও একটি স্বাধীন শক্তি হিসেবে গত শতাব্দীর মধ্যভাগে মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে। এবং সেই সময় থেকে অক্টোবর বিপ্লব এবং মহান চীন বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সর্বহারা তার লক্ষ্য পূরণের দিকে অনেক দূর এগিয়েও গেছে। যদিও তার অগ্রগতির পথ আঁকাবাঁকা, এই পথে কিছু ধাক্কাও আসতে পারে, তবু প্রয়োজনীয়তার জগত থেকে স্বাধীনতার জগতে তার উত্তরণ অব্যাহত থাকবে।
“প্রয়োজনকে যতটা বোঝা না যায় ততটাই সে অন্ধ। প্রাকৃতিক নিয়মাবলী থেকে কোনো কাল্পনিক মুক্তির মধ্যে স্বাধীনতা নেই, স্বাধীনতা রয়েছে এই নিয়মগুলো বোঝা এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সুনির্দিষ্টভাবে এই নিয়মগুলোকে প্রয়োগ করবার যে সম্ভাবনা এ থেকে জন্ম নেয় তার মধ্যে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন সম্পর্কিত জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে এইভাবে আমাদের নিজেদের ওপরে এবং বাহ্যিক প্রকৃতির ওপরে যে নিয়ন্ত্রণ জন্মায় তাতেই রয়েছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা তাই অবশ্যই ঐতিহাসিক বিকাশের ফসল।” দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পথ নির্দেশক দর্শনে বলীয়ান সর্বহারা অবশ্যই সাম্যবাদী সমাজ গড়ে তোলার মহান ব্রত সফল করে তুলবে, যে সময়ের কথা ভেবে এঙ্গেলস বলেছিলেন, “একমাত্র এই সময়েই মানুষ শেষপর্যন্ত বাকি প্রাণীজগত থেকে নিজেকে এক অর্থে আলাদ করে নেয় এবং অস্তিত্বের জান্তব অবস্থা থেকে যথার্থ মানবিক অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়। ... ... যে সমস্ত বাহ্যিক বস্তুগত শক্তি এতদিন পর্যন্ত ইতিহাসের ওপর প্রভুত্ব করেছে তারা এবার মানুষের নিজের নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে। একমাত্র এই সময় থেকেই মানুষ সম্পূর্ণ সচেতনভাবে নিজের ইতিহাস রচনা করবে ... ... এটাই হবে প্রয়োজনীয়তার জগত থেকে স্বাধীনতার জগতে মানবসমাজের উল্লম্ফন।”
এখানে আমরা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছি। এ থেকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা আমরা পাই তাহল অর্থনীতির ভিত্তির ওপরেই সমগ্র সামাজিক সৌধ নির্মিত হয়। তাই আমাদের পরবর্তী পুস্তিকায় আমরা অর্থনীতি প্রসঙ্গে আলোচনা করব।