অধিবিদ্যা ও যান্ত্রিক বস্তুবাদের বিপরীতে হেগেলীয় দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি (১৭৭০ – ১৮৩১) দ্বন্দ্বতত্ত্বকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যায়। হেগেলই সর্বপ্রথম প্রকৃতি, ইতিহাস এবং বুদ্ধিবৃত্তিকে একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া হিসাবে উপস্থাপন করেন এবং এটাই তাঁর শ্রেষ্ঠ অবদান। হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্ব অনুসারে সমগ্র বিশ্ব অন্তহীন প্রবাহ এবং বিরামহীন গতি আর পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছ; সব রকমের গতি ও সামগ্রিক বিকাশ যে আভ্যন্তরীণ সম্পর্কগুলির জন্য ঘটে থাকে, ঐ দ্বন্দ্বতত্ত্ব সেগুলিকে আবিষ্কার করার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু হেগেল অন্য সমস্যার সমাধান করতে পারেননি, কারণ (১) ব্যক্তি হিসাবে তাঁর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিলই, (২) তাঁর সময়ে প্রকৃতি বিজ্ঞানে ও সমাজে পূর্বোল্লিখিত (তিনটি আবিষ্কার) অগ্রগতি ঘটেনি, (৩) তিনি নিজে একজন ভাববাদী ছিলেন। ভাববাদী হিসাবে তাঁর মতে “চিন্তা” মানুষের মনে বস্তুজগতের প্রতিফলন নয়, বিপরীতে এমন কি পরিবর্তনশীল বস্তু নিজেই কোনো এক “পরম চিন্তার” প্রতিফলন। এই ভাববাদী ধারণার জন্যই হেগেল সব কিছু উল্টোভাবে দেখেছিলেন।
হেগেল দ্বান্দ্বিক নিয়মগুলিকে শুধুমাত্র “চিন্তার সূত্র” হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন। এইভাবে নিয়মগুলিকে প্রকৃতি ও ইতিহাসের মধ্য থেকে আবিষ্কার এবং বিকাশের পরিবর্তে সেগুলিকে প্রকৃতি ও ইতিহাসের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং বস্তুজগতকে চিন্তার এই পদ্ধতির (যা নিজেই মানুষের চিন্তাধারার বিকাশের ফলে) সাথে অবশ্যই খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
কিন্তু হেগেলের দর্শনের প্রকৃত তাৎপর্য ও বিপ্লবী চরিত্র রয়েছে এখানেই যে এই দর্শন “মানুষের চিন্তা ও ক্রিয়াকলাপ হতে সৃষ্ট সব কিছুই চিরন্তন” এই মতবাদকে চিরতরে খণ্ডন করে। হেগেলের কাছে সত্য নিহিত রয়েছে জ্ঞানের প্রক্রিয়ার মধ্যে, বিভাজনের দীর্ঘ ঐতিহাসিক অগ্রগতির মধ্যে; যা ধাপে ধাপে জ্ঞানের নিরন্তর হতে উচ্চস্তরে উপনীত হয়। কিন্তু কখনই তথাকথিত চরম সত্যে -- যা এমন একটা বিন্দু যার পর অগ্রগতি থাকে না, যার পর আর কিছুই করার থাকে না -- সেই চরম সত্যে কখনোই উপনীত হওয়া যায় না। এটা ইতিহাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যেমন একটা “বিশুদ্ধ” সমাজ বা একটা “বিশুদ্ধ” রাষ্ট্র কেবল কল্পনার মধ্যেই থাকতে পারে। বিপরীতে, প্রত্যেকটি পর্যায়ক্রমিক ঐতিহাসিক ব্যবস্থাই হচ্ছে নিম্নতর স্তর থেকে উচ্চতর স্তরে মানব সমাজের অন্তহীন বিকাশের প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি অন্তর্বর্তী স্তর মাত্র। দ্বান্দ্বিক দর্শনে শেষ, চরম বা পবিত্র বলে কিছুই নেই।
উপরোক্ত দৃষ্টিভঙ্গীগুলি হেগেল এতো স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেননি, তবে তাঁর পদ্ধতি থেকে এই সিদ্ধান্তগুলিই অপরিহার্য ভাবে বেরিয়ে আসে। এসত্ত্বেও তিনি অতীত ধারাবাহিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রাখার জন্য দর্শনে এমন একটা পদ্ধতি প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন যা অবশ্যই কোনো না কোনো চরম সত্যের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। হেগেলের দর্শনের গোঁড়ামিপূর্ণ বিষয়বস্তুকে চরম সত্য হিসাবে ঘোষণা করা হয় – যদিও তা ছিল তাঁর নিজের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিরোধী। এইভাবে রক্ষণশীলতার দিকটি ভারী হওয়ায় বিপ্লবী দিকটি চাপা পড়ে গেল এবং দেখা গেল যে তাঁর “পরম চিন্তা” মূর্ত রূপ নেয় সম্পদশালী শ্রেণীর সীমাবদ্ধ, সংযত ও পরোক্ষ শাসনের মধ্যে যা সেই সময়ে পেটিবুর্জোয়া জার্মানির অবস্থাতে উপযোগী ছিল।
যে সময়ে নব্য হেগেলপন্থীরা ভাববাদ-বস্তুবাদ সমস্যার সমাধানে ব্যস্ত ছিলেন সেই সময়ে উপস্থিত হল ফয়েরবাখের “খ্রিস্টীয় ধর্মের মর্মবস্তু” এক আঘাতেই ফয়েরবাঘ এই দ্বন্দ্বকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে পুনরায় বস্তুবাদকে জয়ীর আসনে বসান। তিনি বললেন যে, সমস্ত দর্শনের থেকে নিরপেক্ষভাবেই প্রকৃতির অস্তিত্ব আছে। প্রকৃতি থেকেই আমাদের সৃষ্টি, প্রকৃতিকে ভিত্তি করেই আমরা মানুষরা বড় হয়েছি। ধর্মীয় কল্পনায় সৃষ্ট উচ্চতর সত্তা হচ্ছে আমাদের অস্তিত্বেরই এক অবাস্তব প্রতিফলন। তখন হেগেলের যাদু কেটে গেল নব্য হেলেগপন্থীরা ফয়েরবাখপন্থী হয়ে উঠলেন।
ফয়েরবাখের ক্রমবিকাশের প্রক্রিয়াটি হল হেগেলীয়দের বস্তুবাদী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া; এই ক্রমবিকাশ একটা নির্দিষ্ট স্তরে তাঁদের পূর্বপুরুষদের ভাববাদী ধারণাগুলির সাথে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদের প্রয়োজনকে সামনে এনেছিল। ফয়েরবাখ বিশুদ্ধ বস্তুবাদী ছিলেন। তাঁর মতে, বস্তু মনের সৃষ্টি নয় বরং মন নিজেই বস্তুর সর্বোচ্চ উৎপাদন (product)। যদিও হেগেল ছিলেন ভাববাদী এবং ফয়েরবাখ ছিলেন বস্তুবাদী, তথাপি তাঁরা উভয়েই একটি বিষয়ে একমত ছিলেন। উভয়েই অষ্টাদশ শতাব্দীর বস্তুবাদকে যান্ত্রিক বস্তুবাদ বলে মনে করতেন। তাই তাঁরা সমালোচনা করেছিলেন এবং এই পদ্ধতির সাথে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।
যদিও প্রকৃতি-বিজ্ঞানের এই তিনটি মহান আবিষ্কার ফয়েরবাখের জীবদ্দশাতেই ঘটেছিল, তথাপি এগুলি সম্পর্কে তিনি অজ্ঞ ছিলেন। সমাজ অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বস্তুবাদ প্রয়োগের গুরুত্বকে তিনি কখনোই বুঝতে পারেননি; এই ক্ষেত্রে তিনি ভাববাদের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিলেন। সুতরাং, প্রকৃতি-বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কারগুলি ও সমাজের নতুন অগ্রগতির সাথে সঙ্গতি রেখে বস্তুবাদের বিকাশ ঘটানোর দায়িত্ব ফয়েরবাখ নিতে পারেনি।
কিন্তু হেগেলীয় ধারার বিলুপ্তির মধ্য থেকে আর একটি ধারাও গড়ে ওঠে এবং একমাত্র এই ধারাটিই প্রকৃত ফলপ্রসূ হয়েছিল। মার্কসবাদী দর্শন এই ধারারই প্রতিনিধিত্ব করে। হেগেলীয় দর্শন থেকে বিচ্ছেদ হল বস্তুবাদী অবস্থানে প্রত্যাবর্তনের ফল। কিন্তু এই প্রথম, বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীকে প্রকৃতই গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা হয় এবং অন্তত মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলির দিক থেকে এক অবিচলভাবে জ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। হেগেলকে নিছক হঠিয়ে দেওয়াই হয়নি, বরং তাঁর দর্শনের বিপ্লবী দিকটি অর্থাৎ উপরোক্ত দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি থেকেই শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর দর্শনে এই পদ্ধতিকে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। তাই হেগেলীয় মতাদর্শগত বিকৃতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই মার্কসীয় পদ্ধতি অনুসারে “চরম ধারণা”র প্রতিফলন হিসাবে বস্তুকে দেখার বিপরীতে, ধারণাকে বস্তুজগতের প্রতিফলন হিসাবে মনে করা হয়। সুতরাং 'ধারণা' সম্পর্কিত দ্বন্দ্বতত্ত্ব নিজেই বাস্তব জগতের দ্বান্দ্বিক গতির সচেতন প্রতিবিম্ব মাত্র। এইভাবে হেগেলীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বকে সোজাভাবে দাঁড় করানো হল।
মার্কস-এঙ্গেলসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের এইভাবেই উৎপত্তি ঘটে। এখন আমরা এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলিকে তিনটি অংশে আলোচনা করব – দ্বন্দ্বতত্ত্ব, বস্তুবাদ এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।