আমরা এর আগেই দেখেছি যে দর্শনশাস্ত্রের উদ্ভব এবং বিকাশ অগ্রগতি এবং অচল অবস্থা এই সবকিছুই নির্ভর করে সমাজের উৎপাদিকা শক্তির ক্রমবিকাশের উপর; উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণীসংগ্রাম এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্রমবিকাশের উপর। ভারতীয় সমাজ আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা ও দাসব্যবস্থার যুগ পেরিয়ে এসেছে এবং সামন্ত সমাজে উপনীত হওয়ার পর অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়। ঐ একই সামাজিক কাঠামো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি আসার আগে পর্যন্ত অটুট থেকে গিয়েছিল। এইভাবে আমাদের প্রাচীন সমাজ দুটি উত্তরণ পর্বের মধ্যে দিয়ে গেছে -- প্রথমটি হল আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা থেকে দাসব্যবস্থার যুগে এবং দ্বিতীয়টি হল দাসব্যবস্থা থেকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার যুগে। এই দুটি উত্তরণ পর্বে নতুন নতুন উৎপাদিকা শক্তি ও বিজ্ঞানের উন্নতি কয়েকটি দার্শনিক চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছিল। এগুলির মধ্যে আমরা এমন কিছু মৌলিক প্রশ্নের ওপর বিতর্ক দেখতে পাই যেগুলি গ্রীক দর্শনেও দেখা গিয়েছিল। তবুও ভারতীয় সমাজব্যবস্থার রূপান্তরের নির্দিষ্ট ধারা তাতে কিছু বৈশিষ্ট্যও যোগ করেছিল।
নতুন উৎপাদিকা শক্তিগুলি অচলাবস্থায় উপনীত হওয়ার পরেও দর্শনের বিভিন্ন ধারাগুলির মধ্যে সংগ্রাম চলতেই থাকল। কিন্তু যে বস্তুগত ভিত্তি পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারত তার অভাবে এই সংগ্রাম বাস্তব জগত থেকে ক্রমশই দূরে সরে গেল। আর শেষপর্যন্ত “ব্রহ্ম সত্য জগত মিথ্যা” -- বলে দুনিয়াটাকেই অস্বীকার করে বসল। এর পরে অনেক আঁকা-বাঁকা পথ, এক কৌতুহলোদ্দীপক পথ পেরিয়ে এসে দর্শন তার আপন গতিকেই রুদ্ধ করে দিল। ১০০০ খ্রিঃ পূঃ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতীয় দর্শনের গতি এই প্রশ্নগুলি থেকেই এসেছে : “তখন সদ বা অসদ কিংবা আকাশ বা তার থেকে দূরবর্তী মহাকাশ (ব্যোম)-- কিছুই ছিল না। তাহলে কে তাদের ঘিরে রেখেছিল? এবং কোথায়? কে তাদের রক্ষাকর্তা ছিল? তা কি ছিল অগাধ জলরাশি?” (ঋকবেদ, নাসদিয়া সুক্ত ১০/১২৯) – এই থেকে শুরু করে শঙ্করাচার্যের “ব্রহ্ম সত্য জগত মিথ্যা” এই উক্তি পর্যন্ত (শঙ্করাচার্য, ৭৮৫-৮২০ খ্রিস্টাব্দ) বস্তু ও চেতনার মধ্যে কোনটি আদি এবং এদের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক কী -- এই প্রশ্নে সেই সময়ে ভারতীয় দার্শনিকদের বিতর্কের মধ্যেই সমস্ত অাধুনিক দার্শনিক ধারার বীজগুলি স্পষ্ট দেখা যায়।
পরে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের যুগে এই দার্শনিক প্রশ্নগুলি অাবার মাথাচাড়া দিয়েছিল, কিন্তু নতুন উৎপাদিকা শক্তিগুলি যে বস্তুগত ভিত্তি সৃষ্টি করে তার অভাবের দরুণ দর্শনের আধুনিক যুগে প্রবেশের দরজা ছিল বন্ধ। আরবীয়দের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য (বিশেষ করে আরবীয় জ্ঞান, বিজ্ঞান ও ইসলাম), কৃষক বিদ্রোহগুলি এবং কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রশক্তির অভাব ভারতবাসীর মনকে প্রভূত পরিমাণে প্রভাবিত করেছিল, এর ফলে বিভিন্ন নতুন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ও চর্চার উদ্ভব ঘটে। ব্রিটিশ শাসনের সময় পশ্চিমী দর্শনের প্রভাব, সারা দেশে জাতীয় চেতনার জাগরণ, আধুনিক শিল্পের পত্তন ও সর্বহারা শ্রেণীর উদ্ভব, দেশব্যাপী প্রচণ্ড বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান এবং মহান অক্টোবর বিপ্লবের ফলে ভারতের বুকে মার্কসবাদ লেনিনবাদের প্রবেশ ভারতীয় দর্শনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করল।
*** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** ***
সমগ্র ভারতীয় দর্শনকে মোটামুটি দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। (১) বৈদিক, (২) অবৈদিক। আবার বৈদিক দর্শনের (যে শাখাগুলি বেদকে ভিত্তি করে আছে) মধ্যে ছয়টি ধারা আছে, (ক) মীমাংসা (আদি), (খ) বেদান্ত (উপনিষদ বা উত্তর মীমাংসা), (গ) ন্যায়, (ঘ) বৈশেষিক, (ঙ) যোগ এবং (চ) সাংখ্য। অবৈদিক দর্শনকেও মোটামুটি তিনভাগে ভাগ করা যায়, (ক) লোকায়ত বা চার্বাকীয় বস্তুবাদের ধারা, (খ) জৈনীয় নিরীশ্বরবাদ (বহুত্ববাদ) এবং (গ) বৌদ্ধ দর্শন ভৌত – অনাত্মাবাদী অনিত্যবাদী অভৌতিকবাদ। বৈদিক দর্শনের এই ছয় এবং অবৈদিক দর্শনের এই তিন ধারার মধ্যে আমরা দ্বন্দ্বতত্ত্ব বস্তুবাদের বীজ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখতে পাই।
ভারতীয় দর্শন অধ্যয়নে একটি বিরাট বাধা হল লিখিত ইতিহাসের অভাব ও লিখিত উপাদানের অভাব। বৈদিক, লোকায়ত বা বৌদ্ধ যাই হেকা না কেন, সমস্ত দর্শনেই সামগ্রিক বিষয়বস্তুগুলি মুখস্ত করা হত ও এইভাবে বংশ পরম্পরায় বহন করা হত এবং এগুলি লিখিত হতে শুরু করে বহু পরে। উপরন্তু বিভিন্ন সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে এগুলি লেখার ফলে বহু বিভ্রান্তির সুযোগও থেকে গেছে। স্পষ্টতই আদি ভাষ্যগুলি আলাদা করা এবং ঐতিহাসিক পর্ব ধরে সেগুলি সাজানো একটি জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য আধুনিককালে দর্শনের পণ্ডিতেরা এই বিষয়ের উপর কিছু মূল্যবান কাজ করেছেন। তথাপি ভারতীয় দর্শনের বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন আজও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
১। মীমাংসা : মীমাংসা হল বেদভিত্তিক (ঋকবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ)। ম্যাক্সমুলারের মতে ১২০০ খ্রিঃ পূঃ থেকে ৬০০ খ্রিঃ পূঃ পর্যন্ত এগুলি ক্রমে ক্রমে ছন্দোবদ্ধ করা হয়েছিল। আর রাধাকৃষ্ণাণের মতে এগুলির রচনাকাল হল খ্রিঃ পূঃ ১৫০০ থেকে খ্রিঃ পূঃ ৬০০ পর্যন্ত। কিন্তু মীমাংসার সূত্রকার (প্রায় ৩০০০ সূত্র) জৈমিনীর সময়কাল ধরা হয় খ্রিঃ পূঃ ২০০ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়। প্রাথমিক বৈদিক মন্ত্রগুলি রচনা করা হয় যখন আর্য গোষ্ঠীগুলি পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার (paternal system) মধ্যে ছিল এবং শ্রেণী বিভক্ত সমাজে এর উত্তরণ ঘটতে শুরু করেছিল। কিন্তু তখনও পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে দাস ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সুতরাং তাদের অবলুপ্ত প্রায় যৌথ-জীবন এবং পূর্বপুরুষদের বন্দনা এই রচনাগুলির বিষয়বস্তু ছিল। স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাদের সামনে আত্মার অস্তিত্বের প্রশ্নটি দেখা দিল। উৎপাদন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তারা ইতিমধ্যেই জল, আগুন, বাতাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তিগুলির অসীম গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। তাই তারা পূর্বপুরুষদের আত্মাকে তৃপ্ত করার জন্য এবং প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে বশে আনার জন্য মন্ত্র ও বন্দনাগানগুলি রচনা করল। তাদের ধারণাগুলি তখনও পর্যন্ত বাস্তব জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। বরং তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির (যজ্ঞ, পূজা, বন্দনা-গান, ডাকিনী-বিদ্যা) মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের জীবনধারণের অবস্থাকে উন্নত করা। কিন্তু সামাজিক অবস্থার ক্রমবিকাশ এই আদিম বস্তুবাদী ধারণাগুলিকে হটিয়ে দিল। তাই তাদের সমগ্র রচনাগুলির মধ্যে ভাববাদী প্রাথমিক ধারণাগুলির সাথে সাথে ছড়ানো ছিটানো ভাবে আদিম বস্তুবাদী ধারণাগুলির চিহ্নও দেখা যায়। সেইজন্য শ্রেণীবিভক্ত সমাজের পরবর্তী বিকাশের পর বেদের মধ্যকার পরস্পর বিরোধী দিকগুলি দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একদিকে এই রচনাগুলি উপনিষদ নির্ভর বেদান্তের অতীন্দ্রিয়বাদের ভিত্তি গড়ে তোলে, যা হল বৈদিক ভাববাদের চরম বিকাশ; অপরদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বস্তুবাদের দিকগুলি বিকশিত হয়ে অবশেষে সাংখ্যের বস্তুবাদী রচনাগুলির মধ্যে স্থান নেয়। এই সাংখ্যের রচয়িতা কপিল (৪০০ খ্রিঃ পূঃ)।
জৈমিনী যখন মীমাংসা সূত্রগুলি ছন্দোবদ্ধ করেন, তখন ইতিমধ্যেই আর্য সমাজ চারটি বর্ণে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, নতুন উৎপাদিকা শক্তিগুলির বিকাশ ঘটেছে এবং শ্রেণী শোষণ নির্মম রূপ নিয়েছে। জৈমিনীর কাছে বেদের বাণীগুলি ছিল শ্বাশত ও স্বয়ম্ভু। তিনি বৈদিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। তিনি ছিলেন নাস্তিক এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় এমন কোনো অতি প্রাকৃত বা অতীন্দ্রিয় শক্তির উপর তাঁর কোনো বিশ্বাস ছিল না; এবং এই ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বস্তুবাদী। কিন্তু বৈদিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির প্রতি তাঁর ভক্তি এগুলিকে ও বৈদিক বাণীগুলিকে অত্যন্ত বাড়িয়ে দেখায়; আর এগুলিকে তাঁর শিষ্যরাও অদৃশ্য শক্তির সৃষ্টিকর্তা হিসাবেই দেখত। এইভাবে তিনি নিজেই তাঁর বস্তুবাদকে নাকচ করেছিলেন। যে পরিবেশে জৈমিনী তাঁর সূত্রগুলি রচনা করেছিলেন, সেই ঐতিহাসিক পরিবেশের প্রভাব থেকে তিনি নিজে মুক্ত হতে পারেননি। তাই তিনি বৈদিক ধর্মানুষ্ঠানে অংশগ্রহণের অধিকার থেকে শূদ্রদের বঞ্চিত করেন। আবার যখন নতুন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে অগ্রগতির নতুন দিগন্ত খুলে গেল, তখন পুরনো রূপে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পুনরাবৃত্তি হয়ে দাঁড়াল উৎপাদিকা শক্তি এবং সামাজিক সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয় (যেমন যজ্ঞে বিপুল পরিমাণ আহুতি দেওয়া)। তাই বৈদিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বেদের অতীন্দ্রিয়বাদকে উপনিষদীয় ভাববাদে বিকাশ ঘটানোর প্রচেষ্টাকে বিরোধিতা করে জৈমিনী ও তাঁর অনুগামীরা তাঁদের মধ্যে সমস্ত বস্তুবাদী দিক থাকা সত্ত্বেও বেদান্ত ভাববাদীদের চেয়েও সমাজে বেশি প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা নিয়েছিলেন।
মীমাংসা সূত্রের প্রধান ভাষ্যকারেরা হলেন সবর স্বামী (৪০০ খ্রিস্টাব্দ), কুমারিল ভট্ট (৫৫০ খ্রিস্টাব্দ) এবং প্রভাকর (কুমারিলের শিষ্য)।
২। বেদান্ত : (৭০০ খ্রিঃ পূঃ -- ১০০ খ্রিঃ পূঃ) যদিও বেদান্তের বেদগুলির শেষাংশ বা উপনিষদ প্রথম দিকের রচয়িতারা বাস্তব জীবন থেকে ও বৈদিক ধর্মীয় অভ্যাসগুলি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলেন না, তথাপি বেদান্তের মূল দর্শন হল ভাববাদ। দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে শুধুমাত্র দুটি প্রধান উপনিষদ ছন্দোগ্য (৭০০ খ্রিঃ পূঃ) ও বৃহদারণ্যক (৬০০ খ্রিঃ পূঃ) হল বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং এগুলি বুদ্ধের আগেই ছন্দোবদ্ধ করা হয়েছিল। উপনিষদের প্রধান দার্শনিকরা হলেন প্রবাহণ জৈবালী (৭০০ খ্রিঃ পূর্ব – ৬৫০ খ্রিঃ পূর্ব), গৌতম বা উদ্দালক আরুণী (৬৫০ খ্রিঃ পূর্ব), যাজ্ঞবল্ক্য (৬৫০ খ্রিঃ পূর্ব), সত্যকাম জাবাল (৬৫০ খ্রিঃ পূর্ব) প্রভৃতি। এই ভাববাদের বাস্তব ভিত্তি ছিল দাস ব্যবস্থা এবং প্রকৃত শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন একটি শ্রেণী, যারা “বিশুদ্ধ চিন্তায়” ভালোরকম এগিয়ে গিয়েছিল। অতএব এই ভাববাদের শ্রেণীভিত্তি ছিল দাস মালিকেরা। এই কারণেই উপনিষদে ক্ষত্রিয়ের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা আমরা দেখতে পাই।
যাই হোক না কেন এই ভাববাদের মধ্যে অনেকগুলি ধারা ছিল যেগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায় – (১) অদ্বৈত্যবাদী -- যারা সর্বশক্তিমান ব্রহ্ম ছাড়া আর অন্য কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করত না; (২) দ্বৈতবাদী -- যারা ব্রহ্মই আদি, একথা স্বীকার করা সত্ত্বেও, বাস্তব জগতের অস্তিত্বও স্বীকার করত। দ্বিতীয় ধারার অন্যতম প্রধান প্রবক্তা ছিলেন রামানুজ।
ততক্ষণে ইতিমধ্যেই সমাজে শ্রেণী বিভাজন তীব্র হয়েছে। সেই জন্য তারা পুনর্জন্মের তত্ত্ব আবিষ্কার করল এবং শূদ্রদের শেয়াল কুকুরের পর্যায়ে নামিয়ে দিল। এইভাবে উপনিষদের ভাববাদ শ্রেণী-শোষণের সবচেয়ে জঘন্য মতাদর্শগত হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছিল।
উপনিষদের ভাববাদ তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছাল শংকরাচার্যের সময় যখন সমগ্র বাস্তব জগতকে মায়া বলে ঘোষণা করা হল।
৩। ন্যায় : গৌতমকে ন্যায় সূত্রের রচয়িতা হিসাবে মনে করা হয়। দর্শন শাস্ত্রের উদ্ভব ও এর বিভিন্ন ধারার মধ্যকার সংগ্রাম এবং এর থেকে উদ্ভূত দার্শনিক বিতর্কগুলি তর্কশাস্ত্র নামে জ্ঞানের এক নতুন শাখার জন্ম দেয় – যার বিষয়বস্তু হল আলোচনার পদ্ধতি। ভারতবর্ষে জ্ঞানের একটি স্বাধীন শাখা হিসাবে তর্কশাস্ত্রের সূচনা হয়েছে গৌতমের রচনা 'ন্যায় সূত্রের' সাথে সাথে। গৌতম মনোজগত থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন এক বাস্তব জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন এবং এই ক্ষেত্রে তিনি বৈশেষিকদের কাছাকাছি। কিন্তু গৌতমের রচনার কেন্দ্রীয় বিষয় হল জ্ঞানতত্ত্ব যাতে বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতির ছাপ আছে। তাঁর মতে কোনো বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হলে পাঁচটি বিষয় একান্ত প্রয়োজন। (ক) বস্তু, (খ) বাহ্যিক যন্ত্র, (গ) ইন্দ্রিয়, (ঘ) মন এবং (ঙ) জ্ঞান আহরণে ইচ্ছুক ব্যক্তি।
৪। বৈশেষিক : এই দার্শনিক ধারার প্রতিষ্ঠাতা হলেন কনাদ। চেতনা থেকে স্বাধীন এক বাস্তব জগতের অস্তিত্বকে তিনি স্বীকার করেন এবং অণুকে বিশ্বজগতের প্রাথমিক কণা হিসাবে মনে করেন। তাঁর মতে বিশ্বে নয়টি মৌলিক উপাদান আছে মাটি, বাতাস, আগুন, জল, মহাকাশ, সময়, আয়তন, আত্মা ও মন। অণু হল শাশ্বত ও অবিনশ্বর। প্রত্যেকটি বস্তু কিছু সাধারণ উপাদান এবং একই সাথে কিছু বিশেষ উপাদান নিয়ে গঠিত যা এক বস্তু থেকে অপর বস্তুকে পৃথক করে। বস্তুর এই বিশেষীকরণের ধারণার জন্য তাঁর দর্শনকে বলা হয় বৈশেষিক (particularist)। যে কোনো প্রতিক্রিয়াকে তিনি বস্তুর মধ্যে অবস্থিত অন্তর্নিহিত কারণগুলির ফল হিসাবে মনে করেন, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে অদৃশ্য কারণের অস্তিত্বও তিনি স্বীকার করেন।
স্পষ্টত বৈশেষিক হল তৎকালীন বাস্তব অবস্থার দ্বারা সীমাবদ্ধ এক বস্তুবাদী দর্শন। এই সীমাবদ্ধতার জন্যই মৌলিক উপাদানগুলির মধ্যে কিছু অ-পদার্থকে (যেমন আত্মা) তিনি যুক্ত করেন। একইভাবে কিছু ক্ষেত্রে কিছু অদৃশ্য কারণের অস্তিত্বকে তিনি স্বীকার করেন। এই দুর্বলতার জন্য তিনি তাঁর বস্তুবাদী পদ্ধতির ভাববাদী বিকৃতি ঘটানোর পথ করে দেন।
৫। যোগ : শারীরিক ও মানসিক নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে কামনাকে দমন করার মারফৎ আত্মার উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে বহির্জগত থেকে আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করার মারফৎ সর্বোচ্চ স্বর্গসুখের অবস্থান অর্জন করার লক্ষ্যেই মূলত পাতঞ্জলির যোগসূত্র রচনা হয়েছে। এটা মনে রাখা দরকার যে এই সময় পর্যন্ত উৎপাদিকা শক্তির এতদূর বিকাশ ঘটেনি যেখানে দার্শনিকরা সমগ্র সমাজের পটভূমিতে চিন্তা করতে পারতেন; সেইজন্য তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে সর্বোচ্চ সুখ অর্জনের পথ অনুসন্ধান করতেন। যোগ হচ্ছে এই অনুসন্ধানেরই একটা অংশ। নাস্তিকদের কাছে যোগ নিজেই ছিল লক্ষ্য। ভাববাদীদের কাছে যোগ হচ্ছে একটা মাধ্যম যার সাহায্যে ব্রহ্মের সাথে একত্ব অনুভব করা যায় এবং এক হওয়ার এই অবস্থাই হল সর্বোচ্চ সুখের অবস্থা। এইভাবে এর প্রথম ধারাটি বস্তুবাদের এক চরম নিষ্ক্রিয় রূপকে দেখিয়ে দেয়। এটা হল পলায়নবাদী বস্তুবাদ। আর দ্বিতীয় ধারাটিও হল ভাববাদের এক চূড়ান্ত পলায়নবাদী রূপ। স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে যোগের কিছু ইতিবাচক দিক থাকতে পারে, কিন্তু দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা নিছক পলায়নবাদ।
৬। সাংখ্য : বৈদিক ধারার অন্তর্গত উপনিষদের ভাববাদের সম্পূর্ণ বিপরীত এক বস্তুবাদী ধারণা -- সাংখ্যের রচয়িতা হলেন কপিল। সাংখ্যের মধ্যে ঈশ্বর বা ব্রহ্মর কোনো স্থান নেই, বস্তু নিজেই হল মৌলিক উপাদান, তবুও বস্তু ও চেতনার মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে কপিল ধরতে পারেননি। তাই তিনি একটি গৌণ ও নিষ্ক্রিয় উপাদান হিসাবেই চেতনার স্বাধীন অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
অন্যান্য বস্তুবাদী দার্শনিকদের মধ্যে উপনিষদে সযুগ্যা রৈক্য (Sayugba Raikya) নামে এক দার্শনিকের উল্লেখ আছে যিনি বাতাসকে মৌলিক উপাদান হিসাবে মনে করতেন। প্রাক বৌদ্ধ যুগের দার্শনিকদের মধ্যে অজিত কেশ কম্বলের নাম উল্লেখযোগ্য যিনি মাটি, জল, আগুন ও বাতাসকে মৌলিক উপাদান বলে মনে করতেন।
বৈদিক দর্শনের ধারাগুলিতে আর্যদের সামাজিক জীবন অর্থাৎ শ্রেণীবিভক্ত সমাজ প্রতিফলিত হয়েছে।
৭। লোকায়ত : অবৈদিক দার্শনিক ধারাগুলির মধ্যে চার্বাকের বস্তুবাদী ধারা হল সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রাচীন। এই ধারাকে “লোকায়ত”ও বলা হয়। লোকায়ত নামটার মধ্যেই এর জনপ্রিয় রূপটি চোখে পড়ে। এই দর্শনের সমস্ত লিখিত উপাদানগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই কেবলমাত্র বিরোধীপক্ষের লেখার মধ্যেই আমরা দর্শনের এই ধারা সম্পর্কে জানতে পারি।
লোকায়তের মতে,
(১) মাটি (পৃথিবী), জল, আগুন ও বাতাস এই চারটি মৌলিক উপাদান আছে।
(২) বিভিন্ন পরিমাণে এই চারটি উপাদানের মিশ্রণের মধ্য দিয়ে জগতের যাবতীয় বস্তুর এমনকি চেতনারও সৃষ্টি হয়েছে। যখন পান, সুপারি ও চুন মেশানো হয় আমরা লাল রং পাই, যদিও তিনটির মধ্যে কারোরই রং লাল নয়। একইভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে মাটি, আগুন, জল এবং বাতাসের মিশ্রণ চেতনার সৃষ্টি করেছে। যদিও এগুলির কারোরই চেতনা নেই।
(৩) ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি বুদ্ধিহীন এবং দুর্বল লোকেদের প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
(৪) স্বর্গ, নরক, পুনর্জন্ম প্রভৃতি সমস্তই হল মিথ্যা।
(৫) লোকায়ত শুধুমাত্র সেই বস্তুগুলিরই অস্তিত্বকে স্বীকার করত যেগুলি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। জ্ঞানের একমাত্র উৎসই হল ইন্দ্রিয় অনুভূতি। জ্ঞান অর্জনের জন্য অনুমান এবং সাক্ষ্য প্রমাণের (testimony) উপরই নির্ভর করা যায় না।
মনে হয়, প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীগুলি এই দর্শনের বদনাম করার জন্য এর বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করেছিল এবং “যাবৎ জীবেৎ সুখম জীবেৎ, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ”-- এই ধরনের নিছক সুখসর্বস্ব দর্শন হিসাবে চিত্রিত করেছিল। যাই হোক “ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হওয়াটাই অস্তিত্বের একমাত্র প্রমাণ” এটা ঘোষণা করে লোকায়ত দর্শনও জ্ঞানের পরিধিকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে।
ভারতীয় ইতিহাসে খ্রিঃ পূর্ব ষষ্ঠ দশক হল একটি নতুন মোড় নেওয়ার কাল। উত্তর-পশ্চিম ভারতে বসবাসকারী আর্যদের মধ্যে দাস এবং বর্ণ ব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি চালু হয়েছিল, কিন্তু পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে অনার্য জাতিরা তখনও পর্যন্ত গোষ্ঠী হিসাবে এবং 'গণ' (গোষ্ঠী-প্রজাতন্ত্র) ব্যবস্থায় বাস করত। এমনকি পূর্বভারতে নতুন প্রতিষ্ঠিত আর্য উপনিবেশগুলিতেও তখনও পর্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক গোষ্ঠী-ব্যবস্থা চালু ছিল অথবা দাস ব্যবস্থা সবেমাত্র শুরু হয়েছে। বর্ণ ব্যবস্থার কড়াকড়ি তখনও পর্যন্ত আসেনি। ইতিমধ্যে লোহার ব্যাপক ব্যবহার, রাজগীরের আশেপাশে পাহাড়গুলিতে ব্যাপক পরিমাণে খনিজ লোহার সন্ধান পাওয়া, গঙ্গা দিয়ে নৌ-চালন, বাণিজ্যের বিকাশ প্রভৃতি উৎপাদিকা শক্তিগুলির বিকাশের পথ খুলে দেয় এবং সামন্ত ব্যবস্থার ভিত্তি প্রস্তুত করে। পূর্ব ভারতে এই গাঙ্গেয় উপত্যকা নতুন উৎপাদিকা শক্তিগুলির বিকাশের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। সেইজন্য এটি নতুন দার্শনিক ধারার উৎপত্তি স্থলও হয়ে ওঠে। যেখানে বেদ ও উপনিষদের উৎপত্তি হয়েছিল সেই কুরুপাঞ্চাল আর দর্শনশাস্ত্রের কেন্দ্র হিসাবে থাকল না। এই বিকাশের রাজনৈতিক রূপ দেখা যায় মগধের মতো নতুন রাজ্যগুলিতে। এই রাজ্যগুলির শাসকরা চিরাচরিত ক্ষত্রিয় থেকে নয়, বরং শিশুনাগ, নন্দ রাজবংশের মতো নীচু বর্ণ থেকে এমনকি শূদ্র থেকে এসেছে। এই বাস্তব পরিস্থিতিতে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব ঘটে এই ধর্ম অখ্যাত নাস্তিক দার্শনিকদের অনেক ধারণাকে গ্রহণ করে।
৮। মহাবীর বর্ধমান : মহাবীর বর্ধমান (৫৯৬ খ্রিঃ পূর্ব – ৪৮৫ খ্রিঃ পূর্ব) ছিলেন জৈনদের চতুর্বিংশ এবং শেষ তীর্থঙ্কর (সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রধান)। তিনি ছিলেন নাস্তিক এবং বেদ ও বৈদিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির বিরোধী। তবে তিনি আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করতেন। তাঁর মতে, দুটি মাত্র মৌলিক উপাদান আছে চেতন পদার্থ, অচেতন পদার্থ। এই দুটিকে সৃষ্টি করা যায় না -- এগুলি হল শাশ্বত।
স্বাধীন অস্তিত্ব থাকলেও এই দুটি পারস্পরিক সম্পর্ক যুক্ত। জৈন ধর্মের মতে এই দুটির মধ্যে চেতন (জীবন্ত) প্রধানস্থান দখল করে আছে। মহাবীরের মতে জ্ঞান হচ্ছে আপেক্ষিক এবং জ্ঞানতত্ত্বের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছাড়াও তিনি ধারণা ও সাক্ষাৎ প্রমাণকে অনুমোদন করেছিলেন। “আমাদের জ্ঞান একটি দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হতে পারে, আবার অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে ভুল হতে পারে। একটা বস্তু আছে আবার নেইও।” মহাবীর এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে লোকায়তদের হাত থেকে জ্ঞানতত্ত্বকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু “আমরা বস্তু সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান অর্জন করতে পারি না”-- এই কথা বলার মধ্য দিয়ে ও জ্ঞানের আপেক্ষিকতার নামে তিনি অজ্ঞেয়বাদের (agnosticism) শিকার হয়ে পড়েন। অপরদিকে তীর্থঙ্করদের “সর্বজ্ঞ” হিসাবে ঘোষণা করে তিনি নিজেই অজ্ঞেয়বাদকে নাকচ করেন এবং এইভাবে অপর প্রান্তে পৌঁছে গিয়ে জ্ঞানতত্ত্বকেই অস্বীকার করে বসেন।
জৈনরাও ব্যক্তিগত মোক্ষলাভের উপর জোর দিতেন। কিন্তু তাঁরা মনে করতেন এই মোক্ষলাভ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সম্ভব নয়, বরং সঠিক বিশ্বাস, সঠিক জ্ঞান ও সঠিক আচরণের মধ্য দিয়েই সম্ভব। সঠিক আচরণের জন্য তাঁরা পাঁচটি মহান অনুশাসনের কথা প্রচার করলেন – অহিংসা, সত্য বলা, কেউ দেয়নি এমন কোনো জিনিস গ্রহণ না করা, ব্রহ্মচর্য এবং অপরিগ্রহ। এগুলির মধ্যে অহিংসা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
৯। গৌতম বুদ্ধ : গৌতম বুদ্ধ (৫৬৩ খ্রিঃ পূর্ব – ৪৮৩ খ্রিঃ পূর্ব) প্রাচীন ভারতে দ্বন্দ্বতত্ত্বের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। উপনিষদ, বৈশেষিক, লোকায়ত এবং জৈনদের প্রবন্ধগুলিতে বিক্ষিপ্তভাবে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির ব্যবহার দেখা গেলেও বৌদ্ধরাই এটির সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। বুদ্ধ নাস্তিক ছিলেন এবং কোনো রূপ চিরন্তন আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতেন। কিন্তু তিনি বস্তুবাদীও ছিলেন না। তিনি আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন বটে কিন্তু মনে করতেন যে এটিরও পরিবর্তন হয় এবং এটি কোনো চিরন্তন বস্তু নয়। তিনি বেদ ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করতেন। তাঁর মতে কেবলমাত্র চারটি মহান সত্য আছে -- (ক) সবকিছুই দুঃখ কষ্টে ভরা, (খ) এই দুঃখ কষ্টের কারণ আছে, (গ) এই দুঃখ কষ্ট নিবারণ করা যায় এবং (ঘ) এই নিবারণ করার একটি পথ আছে। তাঁর মতে, এই দুঃখ কষ্টের মূল উৎস হল মানুষের তৃষ্ণা। এবং এই দুঃখ কষ্টকে দূর করা যায় যদি তৃষ্ণাকে নিবারণ করা যায়। দুঃখ কষ্টকে দূর করার জন্য তিনি আটটি বিষয় সম্বলিত পথের কথা প্রচার করেন – (ক) সঠিক বিশ্বাস, (খ) সঠিক সংকল্প, (গ) সঠিক কথা, (ঘ) সঠিক কাজ, (ঙ) সঠিক জীবনযাপন, (চ) সঠিক প্রচেষ্টা, (ছ) সঠিক চিন্তা এবং (জ) সঠিক একাগ্রতা বা সমাধি। সঠিক বিশ্বাসের অর্থ হল হিংসাকে পরিত্যাগ করা, চুরি না করা, লাম্পট্য না করা এবং মিথ্যা কথা না বলা। সঠিক সংকল্পের অর্থ অহিংস সংকল্প এবং সঠিক জীবনযাপনের অর্থ হল অস্ত্র, প্রাণী, মাংস, মদ, এবং বিষ নিয়ে ব্যবসা না করা।
বুদ্ধের দ্বন্দ্বতত্ত্বকে 'প্রতীত্য সমুৎপাদ' (বস্তুর নির্ভরশীল উদ্ভবের ধারণা) বলা হয়। সমগ্র বিশ্ব একটি নিরবচ্ছিন্ন গতির মধ্যে আছে। কোনো বস্তুর ধ্বংস এবং তার স্থলে আর একটি বস্তুর উৎপত্তির প্রক্রিয়া অনবরত চলছে। কিন্তু বুদ্ধের মতে এই ধ্বংস ও উৎপত্তির নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া হল একটি নিরপেক্ষ প্রক্রিয়া এবং বাস্তবে এই গতি হল চক্রাকার গতি। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন আত্মার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু এটা উপনিষদে বর্ণিত অবিনশ্বর আত্মা নয়, বরং এক বিচ্ছিন্ন গতি (অর্থাৎ প্রতিটি ধ্বংসের পরেই আসে উৎপত্তি) হিসাবে এর অস্তিত্ব আছে এবং দেহের মৃত্যুর পরও এই গতি অব্যাহত থাকে। তাই বুদ্ধ পুনর্জন্মকেও স্বীকার করেছেন। তাঁর মতে নির্বাণের অর্থ হল তৃষ্ণার বিলোপ সাধন এবং এর পরেই পুনর্জন্ম গ্রহণের বাধ্যতা থেকে আত্মা মুক্তি পায় এবং এইভাবেই আত্মা নির্বাণ লাভ করে। এছাড়া বুদ্ধ বাস্তব জগতকে নাকচ করেননি, বরং বাস্তব জগত ও আত্মা উভয়ের উপর তিনি তাঁর 'প্রতীত্য সমুৎপাদ'কে প্রয়োগ করেছিলেন।
পরবর্তীকালে বৌদ্ধরাও দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েন : (ক) হীনযান এবং (খ) মহাযান, এবং এঁদের মধ্যে প্রত্যেকটি আবার দুটি করে ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা হলেন যথাক্রমে সর্বস্তিবাদী ও সৌতান্ত্রিক এবং মাধ্যমিক ও যোগাচারী। হীনযানের অনুগামীরা অনেক বেশি বাস্তববাদী হলেও মহাযানের অনুগামীরা মূলত ভাববাদী ছিলেন।
মাধ্যমিকদের প্রধান নেতা নাগার্জুন ঘোষণা করেছিলেন “এই বিশ্বজগতের কিছুই চিরন্তন নয় এবং সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী” এবং এর ভিত্তিতে তিনি বাস্তব জগতকেই অস্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “শূন্য ছাড়া আর কিছুই নেই।” এই জন্যই তাঁর মতকে শূন্যতাবাদও (voidism) বলা হয়। তাঁর বিপরীতে যোগাচারীরা (অসঙ্গ, বসুবন্ধু, দিঙনাগ, ধর্মকীর্তি ও শান্ত রক্ষিত প্রমুখ) চিন্তার প্রাধান্য স্বীকার করা সত্ত্বেও বাস্তব জগতের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছিলেন। জ্ঞানতত্ত্ব সম্বন্ধে তাদের ধারণা ছিল বস্তুবাদী।
তাঁর সমস্ত দুর্বলতা সত্ত্বেও বৌদ্ধ দর্শন পুরনো পচাগলা দাস ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রাধান্য লাভ করেছিল, কারণ এটি গোড়া থেকেই বর্ণ ব্যবস্থার বিরোধী ছিল। তাই পরবর্তীকালে বৈদিক ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে তত্ত্বগত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতীয় দর্শন বিকাশলাভ করেছিল। মৌর্যবংশের পতনের পর সামন্ত প্রভু ও রাজারা তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হাতিয়ার হিসাবে বৈদিক ধর্মকে বেছে নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও বৌদ্ধধর্ম তার প্রাধান্য বজায় রাখতে পেরেছিল। কিন্তু গুপ্তযুগ পর্যন্ত বৈদিক ধারা প্রয়োজনীয় তাত্ত্বিক প্রস্তুতি চালিয়ে যায়, আর সেই সময় বৌদ্ধধর্ম নাগার্জুনের ভাববাদের দ্বারা বেশি পরিমাণে প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং ক্রমশ সাধারণ জনগণের সমর্থন হারিয়ে ফেলে। তাই গুপ্তযুগের পর যখন ভারতবর্ষ আবার অসংখ্য ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত হয় পড়ল তখন বৈদিক ধর্ম প্রাধান্য লাভ করবার সুবর্ণ সুযোগ পেল। অবশেষে শঙ্করাচার্য বৌদ্ধ ধর্মকে ধ্বংস করার জন্য উপনিষদের ব্রহ্মবাদের সঙ্গে নাগার্জুনের শূন্যতাবাদের (Voidism) মিশ্রণ ঘটিয়ে তাঁর নিজের অস্ত্র মায়াবাদের জন্ম দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে সুপ্রতিষ্ঠিত, প্রতিক্রিয়াশীল এবং অচল সামন্ততন্ত্রের প্রধান দর্শন হয়ে ওঠে। সেই জন্য শঙ্করাচার্য এবং সমস্ত অদ্বৈতবাদীকে প্রায়ই ছদ্মবেশী বৌদ্ধ বলা হয়।