আমরা এখন এক তরঙ্গসঙ্কুল পৃথিবীতে বাস করছি। এক অদ্ভূতপূর্ব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক বিশৃঙ্খলা আমাদের ঘিরে ধরেছে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারী, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লব এবং জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামগুলির সাথে সাথে পারস্পরিক বিরোধিতায় লিপ্ত বিভিন্ন মার্কা 'সমাজতন্ত্র', রাষ্ট্রকর্তৃক ক্রমবর্ধমান নৃশংসতা, ব্যাপক রক্তক্ষয়, ভয়াবহ লোডশেডিং যার কোনো সুরাহা নেই, নৈতিক মূল্যের অবক্ষয়, পারিবারিক বন্ধনগুলি ভেঙ্গে পড়া, পুনঃপুন প্রাকৃতিক ও মানুষের সৃষ্ট বিপর্যয়, শক্তি সংকট, ব্যাপক দুর্নীতি, বিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য আবিষ্কার এবং পারমাণবিক ও রাসায়নিক যুদ্ধের বিপদ, আন্তর্জাতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি ইত্যাদি ইত্যাদি সমস্ত বিষয়গুলিই আমাদের হতবুদ্ধি করে দিচ্ছে। কেন এই দুনিয়া জোড়া টালমাটাল অবস্থা? মহাসমুদ্রের আবর্তে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করি, পরক্ষণেই আবার অদৃষ্টবাদ ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার দৃষ্টিভঙ্গীর আশ্রয় নিই। মনে হয় যেন কিছু রহস্যময় শক্তি আমাদের প্রতিষ্ঠিত অবস্থাকে ভেঙ্গে চূরমার করে দিচ্ছে, আবার কোনো কোনো সময়ে সেই শক্তিগুলিই আমাদের মনে উন্নত জীবনের জন্য নতুন আশার সঞ্চার করছে।
দর্শনশাস্ত্রকে সাধারণভাবে এক রহস্যময় কিছু হিসাবে, আমাদের বাস্তব জীবনের বাইরের কিন্তু একই সাথে সর্বজনীনভাবে প্রযোজ্য কিছু বিষয় হিসাবে ভাবা হয়। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে মানুষ দর্শনের বিষয়বস্তুর মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। যদি কেউ আকস্মিকভাবে মারা যান, তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে শোকাভিভূত হয়ে বলতে শোনা যায় ... “কে পারে ভাগ্যের চাকাকে রোধ করতে? জীবন-মৃত্যু, লাভ-লোকসান, যশ-অপযশ এইগুলি সবই সর্বশক্তিমান ভাগ্যের হাতে।” কিন্তু এমন একটা সময় আসে যখন অদৃষ্টবাদ আর কাজ করে না, জীবনের জটিল বিষয়গুলির মানুষকে দর্শনের আশ্চর্য জগতে উঁকিঝুঁকি দিতে বাধ্য করে। শুধু উঁকিঝুঁকি নয়, মানুষ এই সমস্ত জটিল বিষয়গুলির সাথে জড়িয়ে পড়ে ও সেগুলি সমাধান করে এবং সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে। এইভাবে জীবনের বাস্তব সমস্যাবলী সমাধানের প্রক্রিয়ায় জ্ঞানের সমস্ত শাখাগুলির মতো দর্শনশাস্ত্রও গড়ে ওঠে। তাহলে দর্শনশাস্ত্র জিনিসটা কী? এটির প্রয়োজনীয়তা কী? সমাজ ও প্রকৃতিকে পরিবর্তিত করতে এটি কিভাবে ব্যবহার করা যায়? এ সবগুলিই হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জানার বিষয়।
তাই অতীতের দিকে ফিরে তাকানো যাক যখন মানুষ তার বন্যতার শেষ যুগে বা বর্বরতার সূচনার যুগে ছিল। তখন শিকারই ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের বেঁচে থাকার মুখ্য উপায়। কৃষিকার্য বা পশুপালন তখনও চালু হয়নি। তখন প্রকৃতির প্রতি তাদের মনোভাব কী ছিল? প্রকৃতি ঠিক যে রকম ছিল সেইভাবে তারা দেখত। প্রকৃতির রহস্যগুলির গভীরে যাওয়া তখন তাদের সাধ্যের বাইরে ছিল। প্রকৃতি ঠিক যে রকম ঠিক সেইভাবেই তাকে দেখাটা হল আদিম বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী। প্রাচীন গ্রীক দর্শনে এবং বৈদিক মন্ত্রে আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গীর ছোঁয়াচ পাই। এখনও পর্যন্ত আমরা পৃথিবীর কোনো কোনো অংশে কিছু গোষ্ঠীর পরিচয় পাই যাদের জীবনযাত্রা আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনযাত্রার সাথে মিলে যায়। তখন তাদের কোনো “বিমূর্ত ধারণার” প্রয়োজন হয়নি এবং এটা সম্ভবও ছিল না। তারা অবশ্যই প্রকৃতির কিছু রহস্যকে অনুভব করত কিন্তু এই অনুভব ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, তখনও পর্যন্ত তাদের প্রকৃতি ও মনের আন্তঃসম্পর্কের প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হয়নি। আগেই হোক আর পরেই হোক এই প্রশ্নটির উদ্ভব ছিল অনিবার্য এবং তা কিছুটা অদ্ভুতভাবেই হাজির হয়েছিল। আদিম বস্তুবাদের পক্ষে এই ধাঁধার সমাধান ছিল অসম্ভব।
তখনও পর্যন্ত মানুষ তার দৈহিক গঠন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। মস্তিষ্কের কাজ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। স্বপ্ন প্রায়শই তাদের চিন্তুত করে তুলত। উপনিষদে একটি গল্প আছে যাতে বোধা যায় যে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে স্বপ্ন ছিল একটা বিরাট উদ্বেগের বিষয়। এক রাজা সেই সময়কার এক বড় সাধুকে তিনটি প্রশ্ন করেছিলেন, তার মধ্যে প্রথম প্রশ্নটি হল “আমাদের মধ্যে কে আছেন যিনি কথা বলেন এবং আমরা ঘুমিয়ে থাকলে যিনি সক্রিয় থাকেন?” যাজ্ঞবল্ক্যের সূত্রে এই স্বপ্ন সম্পর্কে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা আছে। তাই স্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্রমেই মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মালো যে চিন্তা ও অনুভূতি তাদের কোনো শারীরিক ক্রিয়া নয় বরং এটা হল এক পৃথক আত্মার কাজ, যে আত্মা দেহের মধ্যেই থাকে এবং মৃত্যুর সাথে সাথে দেহ পরিত্যাগ করে। তখন থেকেই মানুষ এই আত্মা ও বহির্জগতের সম্পর্ককে তাদের চিন্তা-ভাবনায় প্রতিফলিত করতে থাকে। যদি মৃত্যুর সাথে সাথে আত্মা দেহত্যাগ করে ও অবিনশ্বর থাকে তাহলে এই আত্মার শেষ পরিণতি আবিষ্কারের কোনো প্রয়োজনই থাকে না। এইভাবেই অমরতার ধারণার উদ্ভব ঘটল।
একবার যখন স্বীকার করা হল যে দেহের বিনাশের পর আত্মার বিনাশ হয় না তখন এই আত্মাকে নিয়ে কী যে করা যায় সে সম্পর্কে সার্বিক ও সাধারণ অজ্ঞতা থেকেই জন্ম নিল ব্যক্তিগত অমরত্বের ধারণা। ঠিক একইভাবে প্রথমে, দেবতাদেরও আবির্ভাব ঘটেছে প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে ব্যক্তি রূপ দেওয়ার মধ্যে দিয়ে।’ তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য প্রার্থনা, ভোজবাজি, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, জাদুবিদ্যা, বলিদান, ইত্যাদি দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমশ বিভিন্ন ধর্মের উদ্ভব ঘটে এবং ধর্ম এই আচার অনুষ্ঠানকে, স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশের সাথে সাথে অবশেষে বহু দেবতার পরিবর্তে আসে এক এবং একমাত্র দেবতা, এইভাবে ভাববাদ। প্রাচীন বস্তুবাদকে নাকচ (negate) করে দেয়।
যদিও এই ধারণাগুলি বস্তুগত বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তথাপি মানুষ এই রকম এক সিদ্ধান্তে এসেছিল কেবলমাত্র জীবনের সমস্যাগুলি ব্যাখ্যা করা ও সমাধান করার জন্য। সুতরাং এইসব অবৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকলাপ সত্ত্বেও প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ও নতুন রূপে দেখার চেষ্টা তারা চালিয়ে যেতে লাগল। একদিকে তারা রোগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ভূত-প্রেতের পূজা আরম্ভ করল, আবার অপরদিকে ঔষধপত্র আবিষ্কারের কাজও করতে লাগল। একদিকে তারা যেমন বৃষ্টির জন্য যজ্ঞ ও পূজা করত তেমনি অপরদিকে খরার মোকাবিলায় খাল এবং পুকুর তৈরির কাজও চালিয়ে গেল।
এইভাবে, চেতনার সাথে অস্তিত্বের সম্পর্কের, আত্মার সাথে প্রকৃতির সম্পর্কের প্রশ্নটি হল সমগ্র দর্শন শাস্ত্রের প্রধান বিষয়বস্তু। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দার্শনিকেরা দুটি বড় শিবিরে ভাগ হয়ে গেছেন। যাঁরা প্রকৃতির চেয়ে আত্মাকে প্রাধান্য দেন এবং তাই মনে করেন পৃথিবী হল কোনো না কোনো ভাবে ঈশ্বর বা কোনো “পরম ভাবে” সৃষ্টি, তাঁদের নিয়েই ভাববাদী শিবির গড়ে ওঠে। অন্য দার্শনিকেরা যাঁরা মনে করেন প্রকৃতিই হল আদি, তাঁরা বস্তুবাদের বিভিন্ন ধারার জন্ম দেন। ভাববাদের সাথে বস্তুবাদের দ্বন্দ্বই হল দর্শন শাস্ত্রের মূল দ্বন্দ্ব এবং এই দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়েই শাস্ত্রের বিকাশ ঘটেছে।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দার্শনিক ধারাগুলি মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কোনো দর্শনকেই (বস্তুবাদী বা ভাববাদী, দ্বান্দ্বিক বা অধিবিদ্যক যাই হোক না কেন) বিমূর্তভাবে “প্রগতিশীল” হিসাবে প্রশংসা করা বা “প্রতিক্রিয়াশীল” হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না। অবশ্যই এটা ঠিক যে, যেহেতু দর্শন হল মতাদর্শগত উপরিসৌধের প্রকাশ, তাই যে কোনো শ্রেণীবিভক্ত সমাজে পরস্পর বিরোধী দুই দার্শনিক চিন্তাধারার মধ্যে সংগ্রাম প্রকৃতপক্ষে সমাজের শ্রেণী সংগ্রামেরই প্রতিফলন। এই বিষয়গুলিকে মাথায় রেখে দর্শনশাস্ত্রের প্রণালীবদ্ধ ও বিস্তৃত অধ্যয়নে আসা যাক।