(কেন্দ্রীয় পার্টি স্কুলে কমরেড বিনোদ মিশ্রের উদ্বোধনী ভাষণ, জুন ১৯৯৪)
প্রিয় কমরেডস,
আমি আপনাদের সকলকে কেন্দ্রীয় পার্টি স্কুলে স্বাগত জানাই। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন বহুদিন ধরে আমাদের পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের এক সর্বাঙ্গীণ ও সৃজনশীল অধ্যয়নের অভ্যাস গড়ে তুলেছে এবং গোটা ১৯৮০-র দশক জুড়ে গোপন অবস্থায় কাজ করা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় স্তর থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত সমস্ত স্তরে পার্টি স্কুল সংগঠিত করেছে। এই সমস্ত স্কুলে চিরায়ত মার্কসবাদী সাহিত্য এবং ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি – উভয়ের অধ্যয়নই বিষয়বস্তু হিসাবে থেকেছে। ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সার্বজনীন সত্যের সমন্বয়সাধন করা, এইভাবে পার্টি লাইনকে সমৃদ্ধ করা এবং সমগ্র পার্টিকে ঐ লাইনের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে এই অধ্যয়ন পার্টির কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আমাদের পার্টি যে এরকম জোরদার মতাদর্শগত-তাত্ত্বিক কাজ ধারাবাহিকভাবে করে এসেছে সেকথা পার্টির বাইরে বিশেষ কেউই জানেন না। আর তাই আমরা যে বিনা জটিলতায় একটা পর্যায় থেকে পরবর্তী পর্যায়ে উত্তরণ ঘটিয়ে চলেছি তা বাইরের পর্যবেক্ষকদের কাছে বিস্ময়কর বলেই মনে হয়। আইপিএফ-এর মধ্যে কাজ করার সময়ও ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত পার্টি কাঠামো যে অটুট রেখে দেওয়া হয়েছিল তা নিছক কাজের ভাগাভাগির স্বার্থেই নয়, মূলত সমগ্র আন্দোলনের মতাদর্শগত-তাত্ত্বিক পথপ্রদর্শনের জন্যই, একথাও অনেকেই জানেন না। যাঁরা মনে করেছিলেন আইপিএফ-এর বেদীমূলে পার্টিকে বলি দেওয়া হচ্ছে, আজ যখন সমগ্র রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পার্টি বিনা সমস্যায় নিজের হাতে তুলে নিয়েছে সেটা তাঁরা আর ব্যাখ্যা করতে পারছেন না।
মাসখানেক আগে কোনো এক এম-এল গোষ্ঠীর জনৈক কমরেডের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমাদের পার্টি সম্পর্কে তাঁর অনেক সমালোচনা ছিল। কিন্তু একটা বিষয়ে তিনি আমাদের প্রশংসাই করলেন। তাঁর ভাষায় সেটি হল পার্টি গঠনে আমাদের পারদর্শিতা। বস্তুত, সাংগঠনিক দক্ষতা বা কোনো ব্যক্তি নেতার আকর্ষণ নয়, মতাদর্শগত-তাত্ত্বিক কাজকে পার্টি গঠনের মূল যোগসূত্র হিসাবে নেওয়ার ফলেই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আন্দোলনে ব্যাপক রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ও সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলার মধ্যেও আমরা পার্টি গঠনের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। এটা আমাদের পার্টির একটা বৈশিষ্ট্য, এক মহান ঐতিহ্য, যা আমাদের রক্ষা করা, টিকিয়ে রাখা উচিত।
আপনারা জানানে, সিপিআই মার্কসবাদের অধ্যয়ন বহুকাল ছেড়ে দিয়েছে। সোভিয়েত প্রচারপুস্তিকাই তাদের একমাত্র অধ্যয়নের বিষয় হয়ে উঠেছিল। আর সোভিয়েতের পতনের পর সিপিআই-এর গোটা প্রচারব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। সিপিআই(এম)-এর অধ্যয়ন চিরকালই অত্যন্ত ছকে বাঁধা এবং তার মধ্যে অধিবিদ্যা রয়েছে প্রচুর। মার্কসবাদের কোনো স্বাধীন ও সৃজনশীল অধ্যয়নের বা পার্টির ভিতরে কোনো মতাদর্শগত-তাত্ত্বিক বিতর্ক চালানোর কোনো সুযোগ সেখানে নেই। অতি-বাম গ্রুপগুলির মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই। মাও চিন্তাধারাকেও তারা প্রথমে তার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ভিত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং তারপর তার সামগ্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে মাওয়ের কিছু উদ্ধৃতি তুলে নিয়ে নিজেদের ভাববাদী-নৈরাজ্যবাদী চিন্তাভাবনার সঙ্গে মিলিয়ে সেগুলির ব্যাখ্যা দেয়।
এসবের বিপরীতে আমাদের অবস্থা নিঃসন্দেহে বেশ ভালো। কিন্তু আমি মনে করি না আমাদের পার্টিতেও সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। বিশেষ করে গত দুবছরে মতাদর্শগত স্তরে কিছু অবনতি দেখা গেছে, সাধারণভাবে পার্টির তাত্ত্বিক মানও নেমে গেছে। আমার মনে হয় এই স্কুলে উপস্থিত কমরেডদের মধ্যে যদি সমীক্ষা চালানো হয় তবে দেখা যাবে ভালো সংখ্যক কমরেডই সাম্প্রতিক চিরায়ত সাহিত্যের ধারেকাছে যাননি তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই দৈনন্দিন কাজের চাপকে এই অবস্থার জন্য দায়ী করবেন।
যতদূর মনে পড়ে, পার্টিকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসার পিছনে আমাদের একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মার্কসবাদের বিরুদ্ধে বুর্জোয়াদের নতুনতর আক্রমণের মোকাবিলা করা। আমরা সকলেই সম্ভবত স্বীকার করতে বাধ্য যে এ ব্যাপারে আমরা যেটুকু করে উঠতে পেরেছি তা আজকের চ্যালেঞ্জের তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। আর এখন, যখন আমাদের পার্টি এক দ্রুত বিস্তারের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, যখন আমরা সমস্ত কমিউনিস্টদের সিপিআই(এমএল)-এ যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছি, তখন পার্টির মতাদর্শগত-তাত্ত্বিক সংহতকরণ এক নতুন আশু গুরুত্ব নিয়ে সামনে আসছে। আর তাছাড়া, পার্টি-অনুশীলনের বিভিন্ন শাখা যখন তাদের কাজের পরিমাণের বৃদ্ধির দরুণ ও পৃথক পূর্ণাঙ্গ কাঠামোর মাধ্যমে ক্রমশই স্বাধীন মর্যাদা অর্জন করতে শুরু করেছে, তখন মতাদর্শগত-তাত্ত্বিক কাজের কোনোরকম অবহেলা একপেশে ও আধিবিদ্যক দৃষ্টিভঙ্গীর জন্ম দিতে বাধ্য। মতাদর্শগত-তত্ত্বগত কাজ পার্টির প্রাণস্বরূপ, যা বাদ দিলে পার্টি এক জড় বস্তুতে পরিণত হবে। পার্টিকে একটি জাহাজ হিসাবে ধরলে এই কাজ হল তার ইঞ্জিন যেটি ছাড়া জাহাজ মহাশয় দিশাহীনভাবে ঘুরে বেড়াবে এবং তীরে পৌঁছানোর কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। কেন্দ্রীয় স্কুলের উদ্দেশ্য এই লক্ষ্যে এক নতুন সূচনা করা এবং পরবর্তী কয়েক মাসে স্কুল ব্যবস্থাকে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে হবে।
আমাদের পার্টি তার জীবনের ২৫ বছর অতিক্রম করে এসেছে। ১৯৯৩ সালে পার্টি প্রকাশ্যে কাজ করতে শুরু করার পর থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমরা পার্টির অগ্রগতির এক নতুন, বলা যায় নির্ণায়ক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি। আমি একে এক নির্ণায়ক পর্যায় বলছি এই জন্য যে ঠিক এখনই একদিকে সিপিআই(এম) পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকারের মধ্যে মূর্ত দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী কৌশল এবং অন্যদিকে জনযুদ্ধ গোষ্ঠী পরিচালিত আশু ক্ষমতা দখলের বাম সুবিধাবাদী কৌশল উভয়েই এক অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছে। উভয়ের মধ্যেই অবক্ষয় ও অধঃপতনের চিহ্ন সুস্পষ্ট।
একনাগাড়ে ১৭ বছর টিকে থাকা সত্ত্বেও বামফ্রন্ট সরকার দেশের শ্রমিক-কৃষক জনসাধারণের মধ্যে কোনোরকম প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের অপর ঘোষিত উদ্দেশ্য – কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস – অর্জনেও তারা ব্যর্থ। তারা কোনো বিকল্প অর্থনৈতিক কার্যক্রমও হাজির করতে পারেনি। বাম ও গণতান্ত্রিক বা ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্পের বহু বড় বড় বুলি সত্ত্বেও কেন্দ্রে কংগ্রেস(ই)-র শাসনের সংহত হয়ে ওঠাকেও তারা ঠেকাতে পারেনি। আর নেতিবাচক দিকের কথা বলতে গেলে, বামফ্রন্টের শাসন পশ্চিমবাংলায় বুর্জোয়া জমিদারদের শাসনকেই সংহত করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে এবং জাতীয় স্তরে তা এই দলের নানা ধরনের সুবিধাবাদী সামাজিক-রাজনৈতিক আঁতাতে জড়িয়ে পড়ার পথকেই প্রশস্ত করেছে। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় টিকে থাকার অন্ধ আকুলতা সম্প্রতি সিপিআই(এম)-কে কংগ্রেস(ই)-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে নির্বাচনী সংস্কার বিলের সক্রিয় সমর্থনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
বিপ্লবী বাম শিবিরের পক্ষ থেকে একমাত্র আমাদের পার্টিই বামফ্রন্ট সরকারের তত্ত্ব ও অনুশীলনের এক পূর্ণাঙ্গ সমালোচনা হাজির করতে পেরেছে। সমস্ত ফ্রন্টে এই সরকারের জনবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপগুলির সমালোচনা ও বিরোধিতা করার পাশাপাশি আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি গ্রামাঞ্চলে এই সরকারের সামাজিক ভিত্তিতে সুস্পষ্ট শ্রেণীনির্ভর বিভাজন সৃষ্টির ওপর। করন্দা[১] প্রমাণ করে যে এটাই এই সরকারের দুর্বলতম জায়গা। উপরন্তু, সরকার গঠনের সমাজগণতন্ত্রী অনুশীলনের দ্বান্দ্বিক বৈপরীত্যে প্রকৃতই শ্রেণীসংগ্রামের হাতিয়ার হিসাবে একটি বাম সরকার গড়ে তোলার প্রশ্ন আমরা সামনে নিয়ে এসেছি। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, প্রকৃতি ও সমাজের সমস্ত বিভাজনের মতো মার্কসবাদী ও সংস্কারবাদী কৌশলের মধ্যে বিভাজনরেখাও পরিবর্তনশীল এবং বাস্তব পরিস্থিতিই তা নির্ধারণ করে। আজকের পরিস্থিতিতে সরকার গঠন সম্পর্কে আমাদের কৌশলকে নতুন স্তরে উন্নীত করাই হল সমাজগণতন্ত্রীদের এক মারাত্মক আঘাত হানার, তাদের গণভিত্তি ও সাধারণ কর্মীবাহিনীকে আমাদের পক্ষে জয় করে নিয়ে আসার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। এছাড়া আর সবকিছুই নিছক বুলিসর্বস্বতা, যা সমাজগণতন্ত্রের প্রভাবকে কণামাত্র খাটো করতে পারে না। পশ্চিমবাংলায় সীমিত শক্তি নিয়েও মার্কসবাদী-লেনিনবাদী শক্তিগুলির মধ্যে একমাত্র আমাদের পার্টিই যে রাজ্য-রাজনীতির মূলস্রোতে নিজস্ব জায়গা করে নিতে পেরেছে তা আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়। সমস্ত ধরনের চাপের মুখেও আমরা পশ্চিমবঙ্গে সরকারের বামপন্থী বিরোধিতার নীতিনিষ্ঠ অবস্থানে অবিচল থেকেছি এবং প্রায় সমস্ত ফ্রন্টে সিপিআই(এম)-এর সুবিধাবাদী তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের বিরোধিতা করে গেছি।
ভারতবর্ষের বাম আন্দোলনের অভ্যন্তরে আমাদের সিপিআই(এম)-এর বিপরীত মেরু হিসাবে গণ্য করা হয়। ঐক্যের স্বার্থকে বিন্দুমাত্র বিসর্জন না দিয়েই আমরা এই স্বীকৃতি লাভ করেছি। সিপিআই(এম)-এর মোকাবিলায় আমাদের কৌশল সমাজগণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক সংগ্রামেরই ধারাবাহিকতা, অবশ্যই উচ্চতর স্তরে। ক্রমশই বেশি বেশি সংখ্যায় বিপ্লবী কমিউনিস্টরা আমাদের কৌশলকেই নতুন পরিস্থিতিতে সমাজগণতন্ত্রের বিরুদ্ধে একমাত্র বাস্তবধর্মী, কার্যকরী ও গণভিত্তিসম্পন্ন চ্যালেঞ্জ হিসাবে উপলব্ধি করতে পারছেন। বর্তমানে সমাজগণতন্ত্রী পরীক্ষা-নিরীক্ষা যখন এক অচলাবস্থার সম্মুখীন, তখন আমাদের পার্টি নতুন ও দৃঢ় উদ্যোগ নেওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছে। যে যে বিষয়গুলির কথা মাথায় রেখে আমি বলেছিলাম যে আমরা পার্টির অগ্রগতির এক নতুন, নির্ণায়ক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি, এটি তার অন্যতম।
১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে আমাদের ঐক্য প্রচেষ্টা, বিশেষ করে সীতারামাইয়ার নেতৃত্বাধীন অন্ধ্র গোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের ঐক্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে পার্টির পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া দুটি ভিন্ন পথে এগোতে থাকে। অন্ধ্র গোষ্ঠীটি চারু মজুমদার ও খতনের লাইনের বিরোধিতা করে এবং আইনি ও গণকার্যকলাপের ওপর জোর দেয়। তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্রে সক্রিয় কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গে একযোগে এরা একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রের কেন্দ্রীয় সংগঠন গড়ে তোলে, যা সিপিআই(এমএল) জনযুদ্ধ গোষ্ঠী হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের ও ছাত্রদের কিছু শক্তিশালী গণসংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে এঁদের সূচনা ছিল সম্ভাবনাময়। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই এ সবকিছুই আবার পুরোদস্তুর “দলম্”-কেন্দ্রিক কার্যকলাপে অধঃপতিত হয়। এঁদের তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক অবস্থান কখনই খুব স্পষ্ট ছিল না। সাধারণভাবে জনগণের, বিশেষত উপজাতীয় জনগণের অভাব-অভিযোগের সমাধানে জঙ্গী সশস্ত্র অ্যাকশনকেই প্রধান কাজ হিসাবে দেখা হত। কিন্তু রাজনৈতিক বা কৌশলগত স্তরে এগুলিকে লাল রাজনৈতিক ক্ষমতার ঘাঁটি এলাকা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা হিসাবেই একমাত্র ব্যাখ্যা করা যায়। এই সংগঠনের শেষপর্যন্ত একটি নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীতে রূপান্তরের সমগ্র কাহিনি এখানে পুনরাবৃত্তি না করলেও চলবে। এটুকু বলাই যথেষ্ট যে বর্তমানে এই গোষ্ঠী এক গুরুতর মতাদর্শগত বিক্ষোভ ও সাংগঠনিক ভাঙনের মধ্যে দিয়ে চলেছে, এবং এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এঁদের নেতৃত্ব কৌশলগত লাইনে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটাতে চলেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
বিপরীতে, ১৯৭০ দশকের শেষদিকেই আমাদের পার্টি উপলব্ধি করে যে প্রত্যক্ষ বিপ্লবী আক্রমণের প্রথম পর্যায় শেষ হয়ে গেছে। সশস্ত্র সংগ্রামকে নতুন স্তরে উন্নীত করে লাল ফৌজ ও ঘাঁটি এলাকা গড়ে তোলার কোনো আহ্বান এখন বাম হঠকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রয়োজনমতো সশস্ত্র প্রতিরোধ সহ গণ কৃষক সংগ্রাম গড়ে তোলার ওপর প্রাথমিক গুরুত্ব দিয়ে চলার পাশাপাশি ব্যাপক জনসাধারণের মধ্যে আমাদের প্রভাব বাড়িয়ে তোলার স্বার্থে আমরা সংসদসহ সমস্ত আইনি সুযোগকেই কাজে লাগানোর, ভারতীয় জনগণের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে থেকে নতুন সহযোগী খুঁজে বের করতে যুক্তমোর্চার কার্যকলাপ শুরু করার এবং শত্রু শিবিরের সমস্ত দ্বন্দ্বকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিই।
ভারতের নির্দিষ্ট পরিস্থিতি তথা বিপ্লবী আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ সামগ্রিক একগুচ্ছ কৌশল গড়ে তুলতে গিয়ে আমাদের পার্টির ভিতরে বিলোপবাদী প্রবণতার সম্মুখীন হতে হয়। এই প্রবণতা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শ ও কমিউনিস্ট পার্টিকে নাকচ করে তার পরিবর্তে নিয়ে আসতে চায় এক অসংবদ্ধ বাম মতাদর্শ ও এমন এক বাম সংগঠন যা কৃষক সংগ্রামে বুনিয়াদী শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিকেই অস্বীকার করে এবং আমাদের পার্টিকে বামফ্রন্ট বা জনতা দল ধরনের কোনো সরকারের লেজুড়ে পরিণত হওয়ার পক্ষে দাঁড়ায়। সংসদসর্বস্বতার বিভিন্ন ধরনের বহিঃপ্রকাশের বিরুদ্ধেও পার্টিকে লাগাতার লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। নানা ধরনের পেটি বুর্জোয়া বিপ্লবীরা আমাদের নীতিগুলির তীব্র বিরোধিতা করে, আমাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনে এবং আমাদের কখনও দেং জিয়াও পিং-এর দালাল, কখনও বা সরকারি নকশাল ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করে। আমাদের পার্টি দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধভাবে এই অতি-বাম বিরোধিতার মোকাবিলা করে এবং এই বাম সুবিধাবাদীদের আসল চেহারা উন্মোচিত করে। পরবর্তীতে এঁরাই পুরোপুরি নৈরাজ্যবাদে অধঃপতিত হন, জঘন্য ধরনের রাজনৈতিক সুবিধাবাদ অনুশীলন করেন এবং এঁদের কেউ কেউ এমনকি সাধারণ জনগণ ও কমিউনিস্ট কর্মীদের হত্যাকাণ্ডেও লিপ্ত হয়।
ইতিহাসের অভিজ্ঞতা স্মরণ করার জন্য ফ্রান্সে শ্রেণীসংগ্রাম-এর ভূমিকা থেকে এঙ্গেলসের বক্তব্য শোনা যাক। “(১৮৪৯-এর পরাজয়ের পর) অমার্জিত গণতন্ত্র আশা করেছিল অদূর ভবিষ্যতেই নতুন করে আক্রমণ শুরু করা যাবে। আমরা কিন্তু ১৮৫০-এর শরৎকালেই ঘোষণা করেছিলাম যে বিপ্লবী যুগের অন্তত প্রথম অধ্যায় শেষ হয়ে গেছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে আবার নতুন সংকট ঘনিয়ে না আসা পর্যন্ত অন্য কিছু আশা করা যায় না। এই কারণে আমাদের বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতক বলে অপাংক্তেয় করে দেওয়া হয়। যাঁরা আমাদের সেদিন তাড়িয়ে দিয়েছিলেন ব্যতিক্রমহীনভাবে তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই কিন্তু পরবর্তীকালে বিসমার্কের সঙ্গে মিটমাট করে নেন, অবশ্য বিসমার্ক তাঁদের যতটা পাত্তা দিতে প্রস্তুত ছিলেন ততদূর পর্যন্তই।”
এই নতুন পর্যায়ে সংগ্রামের নতুন রূপ সম্পর্কে এঙ্গেলস বলেন, “সার্বজনীন ভোটাধিকার থেকে আমরা যদি একমাত্র এই সুবিধাটুকুই পেয়ে থাকি যে এর ফলে প্রতি তিন বছর অন্তর আমরা আমাদের সংখ্যা গোনার একটা সুযোগ পাই; প্রতিবার প্রমাণিতভাবে আমাদের ভোটের অভাবনীয় দ্রুত বৃদ্ধি একই অনুপাতে শ্রমিকদের বিজয়ের নিশ্চয়তা ও তাদের শত্রুদের অস্বস্তি বাড়ায় এবং এইভাবে আমাদের সবচেয়ে ভালো প্রচারের উপায় হয়ে দাঁড়ায়; এর মাধ্যমে আমরা আমাদের পদক্ষেপগুলির সাফল্যের মাত্রার এক অতুলনীয় পরিমাণ পাই যা আমাদের অকারণ ভীরুতা ও বেপরোয়া দুঃসাহস দুইয়ের থেকেই রক্ষা করে – সার্বজনীন ভোটাধিকার থেকে যদি আমরা মাত্র এইটুকু সুবিধাই পেতাম তাহলেও সেটা হত অনেক। কিন্তু বাস্তবে তা আমাদের আরও বহু কিছুই দিয়েছে। আমাদের থেকে এখনও যাঁরা দূরে আছেন নির্বাচনের ময়দানে তাঁদের কাছে যাওয়ার, ব্যাপক জনগণের সামনে সমস্ত দলকে আমাদের আক্রমণের জবাবে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যকলাপের পক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য করার এক অতুলনীয় সুযোগ এর দরুণ আমরা পেয়েছি। এছাড়াও রাইখাস্টাগে আমাদের প্রতিনিধিরা সংসদে আমাদের বিরোধীদের ও সংসদের বাইরে ব্যাপক জনগণের কাছে নিজেদের বক্তব্য পৌঁছে দেওয়ার এমন একটা মঞ্চ পেয়েছেন যার কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতা সংবাদ মাধ্যমে বা জনসভায় রাখা বক্তব্যের থেকে আলাদা। ...
“এইভাবে সার্বজনীন ভোটাধিকারকে সফলভাবে কাজে লাগানোর ফলে কিন্তু সর্বহারা সংগ্রামের একেবারেই নতুন একটি উপায় উদ্ভাবিত হল এবং শীঘ্রই তা আরও বিকাশলাভ করল। বোঝা গেল যে বুর্জোয়াদের শাসন যে সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগঠিত হয় সেগুলিই আবার শ্রমিকশ্রেণীকে সেগুলির বিরুদ্ধেই লড়াইয়ের সুযোগও করে দেয়।”
রাশিয়াতেও ১৯০৫-এর বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পর লেনিন আইনি ও প্রকাশ্য কাজকর্মের জন্য ও ডুমায় অংশগ্রহণের জন্য পার্টিকে ঢেলে সাজান। রুশ পার্টিতেও এই সময় কিছু বাম সুবিধাবাদী প্রবণতা আত্মপ্রকাশ করে যারা লেনিনের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনে এবং বলশেভিকবাদকে বয়কটবাদের সঙ্গে এক করে দেখায়। লেনিন এই সমস্ত প্রবণতাকে শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা হিসাবে চিহ্নিত করেন, দৃঢ়ভাবে এদের নাকচ করেন ও সতর্কতার সাথে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
চীনের ক্ষেত্রেও বাম সুবিধাবাদী ভুলের দরুণ প্রায় সমস্ত ঘাঁটি এলাকা এবং লাল ফৌজের এক বড় অংশকে হারাতে হয়েছিল। ফলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি লং মার্চের পথে যেতে বাধ্য হয়। মাও যখন জাপানী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চিয়াং কাই শেকের সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের লাইন নিয়ে আসেন বাম সুবিধাবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধেও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনেছিল।
এই সমস্ত ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরার কারণ এই যে এর থেকে প্রমাণ হয়, প্রতিটি দেশেই বিপ্লবী সংগ্রাম পর্যায়ক্রমে অগ্রগতি ও পশ্চাদপসরণের মধ্যে দিয়ে যায় এবং সেই অনুযায়ী পার্টির নীতি ও কৌশলগুলিকে পাল্টে নিতে হয়। কৌশলের তথা নেতৃত্বের দক্ষতার প্রশ্নে মার্কসবাদী ধারণার এটাই হল সারকথা। একটি পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য কৌশল ভিন্নতর পরিস্থিতিতেও প্রয়োগ করা বা পরিস্থিতি যখন পার্টির পুনর্গঠন ও শক্তিসঞ্চয়ের জন্য অপেক্ষা করার দাবি করে তখনও প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কথা বলা মানে সোজা শত্রুর ফাঁদে পা দেওয়া।
চীনের মডেল নিয়ে শুরু করা আমাদের ক্ষেত্রে সঠিকই ছিল, কারণ এক আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক দেশে বিপ্লবের এক মডেলই আমাদের সামনে ছিল। কিন্তু গত ২৫ বছরে আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে তথা ভারতীয় সমাজের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলি আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করার পর চীনা মডেলে প্রয়োজনীয় রদবদল করে ক্রমশ ভারতীয় বিপ্লবের এক ভারতীয় মডেল গড়ে তোলাই তো স্বাভাবিক। চীনা পথকেই গোঁড়াভাবে আঁকড়ে থাকা মাও চিন্তাধারার অন্তর্বস্তুকেই নাকচ করে। বহু ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও চীনে যাঁরা রাশিয়ার মডেল অন্ধভাবে অনুসরণ করে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে মাও-কে দৃঢ় সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। এই সংগ্রামের প্রক্রিয়াতেই উঠে এসেছে মার্কসবাদ-লেনিবাদের সার্বজনীন সত্যকে চীনের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে একাত্ম করার মাও-এর বিখ্যাত সূত্রায়ন।
অনেকেই জানেন না যে এই সমস্ত বাম সুবিধাবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে দৃঢ় সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই আমাদের পার্টি লাইন গড়ে উঠেছে। আর তাঁদের কাজকর্ম যেখানে ক্রমশই নিছক স্কোয়াড অ্যাকশনে অধঃপতিত হয়েছে, আমরা সেখানে কৃষক জনতার গণ বিপ্লবী আন্দোলনের পরিধি ও বিস্তার বহুগুণ বাড়াতে সক্ষম হয়েছি এবং আমাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনীর ক্রিয়াকলাপ এর এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে জনযুদ্ধ গোষ্ঠী কর্তৃক অনুসৃত নৈরাজ্যবাদী কৌশল যখন গতিরুদ্ধ, আমাদের পার্টি তখন বিপ্লবী কমিউনিস্টদের সঠিক লাইনের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করার মতো দৃঢ় অবস্থায় রয়েছে। পার্টির অগ্রগতির যে নির্ণায়ক পর্যায়ের কথা আমি বলছিলাম এটি তার অপর উল্লেখযোগ্য দিক।
আমার মতে সাধারণভাবে বাম আন্দোলনের মধ্যে আমাদের প্রধান মতাদর্শগত প্রতিদ্বন্দ্বি হল সমাজগণতন্ত্র, যার প্রতিভূ হল সিপিআই(এম)। আর নির্দিষ্টভাবে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বা নকশালপন্থী আন্দোলনের মধ্যে আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হল নৈরাজ্যবাদ, যার প্রতিভূ হল জনযুদ্ধ গোষ্ঠী। ভারতে একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে গেলে এই উভয় প্রবণতার বিরুদ্ধেই মতাদর্শগত-রাজনৈতিক সংগ্রামের এক যথাযথ সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি।
নির্বাচনী সংগ্রামে আমাদের কৌশল সম্পর্কে কয়েকটি কথা এখানে বলা উচিত। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে এর দরুণ আমাদের নিজেদের সংগঠনেও বেশ কিছু গুরুতর অস্বাস্থ্যকর বুর্জোয়া প্রবণতা ঢুকে পড়েছে। টিকিটের জন্য খেয়োখেয়ি, জেতার জন্য যেকোনো রকম সুবিধাবাদী আঁতাতে যোগ দেওয়া, নির্বাচিত বহু প্রতিনিধি অর্থ, যশ, বা বুর্জোয়া সুখসুবিধের জন্য লালায়িত, তাঁদের কারো কারো নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য শেষ পর্যন্ত পার্টি ছেড়ে শাসক দলে যোগদান – এসব দেখে আমরা হতবাক। কমিউনিস্ট আচরণবিধি, পার্টির নীতিসমূহ, পার্টির শৃঙ্খলা সবকিছুকে নির্লজ্জভাবে বিসর্জন দেওয়া হল। এই ঘটনাগুলি পার্টির মর্যাদাকে বিরাটভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। এ থেকে বোঝা যায় যে নির্বাচনী কৌশলের গুরুত্ব পার্টি সংগঠনের গভীরে প্রবেশ করতে পারেনি, পার্টি সংগঠন তার সংসদীয় শাখার ওপর পার্টি শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রশ্নে যথেষ্ট দুর্বল। ভারতের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নির্বাচন ও সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে পার্টিকে এখনও বহুদূর যেতে হবে। কিন্তু, বর্তমান অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে এব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার ফলাফল মারাত্মক হতে পারে। নির্বাচনী মঞ্চকে কাজে লাগানোর প্রশ্নে আমি এর আগে এঙ্গেলসের উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম। এবার কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে মার্কসের বক্তব্য শোনা যাক।
“... বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক প্রার্থীদের পাশাপাশি সর্বত্র শ্রমিকদের প্রার্থীদের দাঁড় করাতে হবে। যতদূর সম্ভব লীগের সদস্যদের মধ্যে থেকে প্রার্থীদের বাছাই করতে হবে। সমস্ত উপায়ে তাঁদের নির্বাচিত করার চেষ্টা চালাতে হবে। যেসব ক্ষেত্রে জয়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, সেখানেও নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখার, শক্তি যাচাই করার এবং জনগণের সামনে বিপ্লবী মানসিকতা ও পার্টির বক্তব্যকে তুলে ধরার জন্য শ্রমিকদের নিজেদের প্রার্থীদের দাঁড় করাতে হবে। এই প্রসঙ্গে, এর ফলে গণতান্ত্রিক দলের ভোট ভাগাভাগি হয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের জয়ের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে – গণতন্ত্রীদের এই ধরনের কথায় শ্রমিকদের ভুললে চলবে না। এইসব কথাবার্তার আসল উদ্দেশ্য শ্রমিকদের বোকা বানানো। এই স্বাধীন উদ্যোগের মাধ্যমে সর্বহারার পার্টি যে অগ্রগতি অর্জন করতে পারবে তা প্রতিনিধিসভায় কয়েকজন প্রতিক্রিয়াশীল সদস্যের উপস্থিতির দরুণ সম্ভাব্য অসুবিধের চেয়ে বহুগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” কমরেড লেনিনও নির্বাচনে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক দলগুলির পরিপ্রেক্ষিতে এই কমিউনিস্ট কৌশলকে বারবার তুলে ধরেছেন এবং সংসদীয় ময়দানে কমিউনিস্টদের ভূমিকাকে বিপ্লবী বিরোধীপক্ষের ভূমিকা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। নিঃসন্দেহে এটাই হওয়া উচিত আমাদের সূচনাবিন্দু।
আমাদের পরিস্থিতিতে নির্বাচনী সংগ্রাম চালাতে গেলে আসন সমঝোতা, নির্বাচনী আঁতাত থেকে শুরু করে রাজ্যস্তরে সরকারে অংশগ্রহণ পর্যন্ত নানা প্রশ্ন উঠে আসবে। পার্টির নিঃশর্ত স্বাধীনতা বজায় রাখা ও বিপ্লবী গণআন্দোলনের সুযোগ ও পরিধি বিস্তৃত করার ওপর ভিত্তি করেই সবসময়ে এই ধরনের সমস্ত প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে হবে। বিপ্লব-পূর্ব চীনের মতো ভারতও একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক দেশ হলেও ভারতীয় শাসকশ্রেণীগুলির ক্ষমতার কাঠামো চীনের থেকে বিরাটভাবে আলাদা, আর এই পার্থক্য ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়। জাত, ধর্ম বা অঞ্চল-কেন্দ্রিক সমাবেশের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা তথা বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতায় বহুবিচিত্র রাজনৈতিক শক্তির ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ শাসকশ্রেণীগুলির বিভিন্ন অংশ ও স্তরের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্নে সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্রের তথা এই ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েনেরই পরিচায়ক। এই পরিস্থিতি বিপ্লবী গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির সামনে এই ব্যবস্থার মধ্যে বিভিন্ন মাত্রায় ভাঙ্গন ধরানোর সুযোগও এনে দেয়। বিপ্লবী গণতন্ত্রের পক্ষে এক গণজাগরণের জন্ম দিতে এই পরিস্থিতিকে পুরোপুরি কাজে লাগানো দরকার। আমাদের আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়ে এই কৌশলের কোনো বিকল্প নেই।
একথা বোঝা দরকার যে পার্টির নির্বাচনী কৌশল হল বিপ্লবী গণআন্দোলন গড়ে তোলার প্রশ্নে পার্টির সামগ্রিক কৌশলেরই এক অবিচ্ছদ্য অঙ্গ, ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার নয়। সুতরাং এই কৌশল সফলভাবে প্রয়োগের জন্য পার্টি একমাত্র পরীক্ষিত কমরেডদের ওপরই নির্ভর করতে পারে এবং সেটাই করা উচিত।
এক ব্যাপকতম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তোলা আমাদের পার্টির সামনে এক রণনৈতিক কর্তব্য। বুর্জোয় ও পেটিবুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের একাংশের সঙ্গে সাম্প্রতিককালে আমাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমরা বোধ হয় এক সংশ্লেষণের যুগের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগে সহযোগিতার ইতিহাসের আলোকে ও সোভিয়েতের পতন ও সাম্রাজ্যবাদের নতুনতর আক্রমণের পরিস্থিতিতে নতুন করে সহযোগিতার প্রয়োজনীতার ওপর জোর দিয়ে আমরা বিপ্লবী কমিউনিস্ট ও ৠাডিকাল সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে ঐক্যের এক তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি। পরিস্থিতির পরিহাসে আমাদের বাম কনফেডারেশনের আহ্বান বাম আন্দোলনে সিপিআই(এম)-এর আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। আমাদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ কার্যকলাপের ক্ষেত্রে সিপিআই(এম)-এর পার্টি কংগ্রেসের দলিলে সূত্রবদ্ধ অবস্থানের পিছনে ছিল একটি আকাঙ্খা – আমাদের তরফে ‘ভুল সংশোধন’, অর্থাৎ সিপিআই(এম)-এর অবস্থান ও তার আধিপত্যের গণ্ডির কাছাকাছি আসা। পরবর্তী ঘটনাবলী তাদের এই আশাকে বাস্তবে পরিণত না করায় তারা আবার যেনতেন প্রকারেণ আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে চেষ্টা করার পুরোনো লাইনে ফিরে গেছে। আমি মনে করি মানুষ যতই তাদের মোহ ত্যাগ করে বাস্তবকে মেনে নিতে শিখবে ততই মঙ্গল। সিপিআই(এম)-এর তীব্র বিরোধিতা নিয়ে আমাদের বিশেষ বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের অগ্রগতিতে এরও একটা ইতিবাচক ভূমিকা আছে। আমাদের উড়িয়ে দেওয়ার ও বিচ্ছিন্ন করার সিপিআই(এম)-এর অতীত প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। নতুন করে সে চেষ্টা করলে তা আবারও ব্যর্থ হতে বাধ্য। ভবিষ্যতে ঘটনাপ্রবাহের নতুন মোড়ে আমাদের সম্পর্কও নতুন করে গড়ে উঠবে সমানাধিকার ও মতপার্থক্যের স্বীকৃতির ভিত্তিতে। একমাত্র সেটাই হবে এক সুস্থ ও নীতিনিষ্ঠ ঐক্য। এই ধরনের পরিবর্তন আনার জন্য আমাদের ধৈর্যসহকারে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে কিছু কথা। সোভিয়েত ব্লকের পতন ও চীনে সুদূরপ্রসারী কিছু পরিবর্তন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমগ্র প্রেক্ষাপটই বিরাটভাবে বদলে দিয়েছে। ষাটের দশকের মহাবিতর্কের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা সোভিয়েতপন্থী ও চীনপন্থী পার্টিগুলির পুরোনো বিভাজন আজ অচল হয়ে পড়েছে। সোভিয়েতের পতন অবশ্য রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট মঞ্চগুলির মধ্যে কিছু পুনর্বিন্যাসের জন্ম দিয়েছে। এই পার্টিগুলি নিজেদের অতীতের, বিশেষত সংশোধনবাদের ক্ষতিকর প্রভাবের পুনর্মূল্যায়ন করছে। অন্যদিকে, ১৯৬৮-৭০-এর ঝোড়ো দিনগুলিতে সারা দুনিয়া জুড়ে আত্মপ্রকাশ করা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টিগুলির মধ্যে যারা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পেরেছে, তারাও এককালে যেসব অতিবাম বিচ্যুতির শিকার হয়েছিল সেগুলি বিশ্লেষণ করছে। এর ফলে উভয় ধারার পার্টিগুলির কাছাকাছি আসার অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। ওয়ার্কার্স পার্টি অফ বেলজিয়ামের উদ্যোগে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারের মধ্যে এই নির্দিষ্ট প্রবণতারই প্রতিফলন দেখা যায়। এই সেমিনারে অতীতের এই দুই ধারা তথা ‘স্বাধীন’ ধারার প্রায় ৫০টি পার্টি ও গোষ্ঠী অংশ নেয়। আমাদের পার্টিও সেখানে অংশগ্রহণ করে এবং কাছাকাছি আসার এই প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমরা মনে করি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ঐক্যের প্রশ্নকে নিছক মাও চিন্তাধারার অনুগামী মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টিগুলির ঐক্যের ধারণায় পরিণত করা অত্যন্ত সংকীর্ণ চিন্তার পরিচায়ক এবং আজকের পরিস্থিতিতে নিতান্তই অচল।
আমার মনে হয় চীন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরেকবার স্পষ্ট করে নেওয়া দরকার, কারণ এটি বহু বিভ্রান্তি ও বিতর্কের জন্ম দিয়ে চলেছে। আমাদের মতে, সমাজতন্ত্র গঠনের প্রশ্নটি সংশ্লিষ্ট দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতি ও নির্দিষ্ট যুগের থেকে বিচ্ছিন্ন ও বিমূর্তভাবে দেখা উচিত নয়। ছোটোখাটো কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ ছাড়া আর কোথাও সমাজতন্ত্র যখন টিকে নেই, দীর্ঘকালের মধ্যে কোনো উন্নত পুঁজিবাদী দেশে সর্বহারা বিপ্লবের সম্ভাবনা যখন সুদূরপরাহত এমন এক পরিস্থিতিতে চীনের মতো একটি পশ্চাদপদ দেশে সমাজতন্ত্র গঠন একটি বিশেষ সমস্যা। সুতরাং সাধারণভাবে সমাজতন্ত্র গঠনের প্রশ্নটি আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত নয়। বরং আজকের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে চীনে সমাজতন্ত্র গঠনের প্রশ্নটিই কোনো অর্থবহ আলোচনার সূচনা করতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই চীনা সংস্কারগুলির সাধারণ দিশাকে আমাদের গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বা চীন সরকারের সমস্ত পদক্ষেপকে সমর্থন করার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। সাধারণ দিশাকে সমর্থন করার মধ্যেই সংশ্লিষ্ট ঝুঁকিগুলির সম্পর্কে দুশ্চিন্তা ও যে সমস্ত নীতিগুলিকে আমরা সমাজতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাধারণ স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করি নিঃসন্দেহে সেগুলির সমালোচনাও নিহিত রয়েছে।
আমরা কোনো চীন-কেন্দ্রিক বা সিপিসি-কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ব্লক গঠনের পক্ষপাতী নই। আবার চীনের নিন্দা করাই যাদের প্রধান উদ্দেশ্য এমন কোনো আন্তর্জাতিক গঠনেও আমরা যোগ দিতে আগ্রহী নই। আমার মনে হয় এটাই চীন তথা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সারকথা।
আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যখন মার্কসবাদের প্রায় সমস্ত বুনিয়াদী ধারণা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এবং ইতিহাসের অবসান দাবি করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে দর্শনের দারিদ্র্য গ্রন্থে মার্কসের একটি কথা। “তাঁরা যখন বলেন যে বর্তমান সম্পর্কই – বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্কগুচ্ছ – স্বাভাবিক, অর্থনীতিবিদরা বোঝাতে চান যে এর অধীনে সম্পদ সৃষ্টি হয় এবং উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটে প্রাকৃতিক নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে। অর্থাৎ এই সম্পর্কগুচ্ছ যুগনিরপেক্ষ প্রাকৃতিক নিয়ম। এগুলিই সমাজের চিরন্তন নিয়ম। এইভাবে এককালে ইতিহাস ছিল, আজ আর নেই।”
অর্থাৎ বুর্জোয়া দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদেরা বহুদিন আগেই ইতিহাসের অবসান ঘোষণা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ইতিহাস এগিয়েছে এবং এই অগ্রগতিতে মার্কসবাদ পথনির্দেশক ভূমিকা নিয়েছে। মার্কস বুর্জোয়া সম্পর্কগুচ্ছের চিন্তন চরিত্রকেই চ্যালেঞ্জ করেন এবং এক বৈজ্ঞানিকের বিরল অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে তিনি দেখান যে অতীতের সম্পর্কগুলির মতোই এগুলিও উত্তরণশীল চরিত্রের। পরিবর্তনই শাশ্বত, এটাই হল মার্কসীয় দর্শনের মর্মবস্তু। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে দুনিয়াকে পাল্টানোর যে কোনো ভবিষ্যত প্রচেষ্টা মার্কসবাদের কাছ থেকে প্রাণশক্তি আহরণ করবে। মার্কস তাঁর মহান সৃষ্টি পুঁজি-তে বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্কের শোষণধর্মী চরিত্র উন্মোচন করেন। মজুরি, শ্রম ও পুঁজি-তে তিনি বলেন, “শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল পরিস্থিতিতে, পুঁজির সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধির সময়েও, শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান যতই উন্নত হোক না কেন, তাঁদের ও বুর্জোয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থের মধ্যেকার বৈরিত্য দূর হয় না। মুনাফা ও মজুরি আগের মতোই বিপরীত অনুপাতেই থেকে যায়।
“পুঁজির যদি দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে তাহলে মজুরিও বাড়তে পারে, কিন্তু পুঁজির মুনাফা বহুগুণ দ্রুতহারে বৃদ্ধি পায়। শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়, কিন্তু তা হয় তাঁদের সামাজিক মর্যাদার অবনতির মূল্যে। তাঁদের ও পুঁজিপতিদের মধ্যে সামাজিক ব্যবধান বেড়েই যায়।”
উৎপাদনের কাঠামো ও গঠনে বহু পরিবর্তন সত্ত্বেও বুর্জোয়া উৎপাদন সম্পর্কে শোষণের ভিত্তি, অর্থাৎ, উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণ, অটুট থেকে গেছে। বরং আন্তর্জাতিক স্তরে সাম্রাজ্যবাদ ও নির্ভরশীল দেশগুলির মধ্যে ও উন্নত পুঁজিবাদী দুনিয়ায় সর্বহারা ও বুর্জোয়াদের মধ্যে সামাজিক ব্যবধান আরও বেড়েই গেছে। সুতরাং বেড়েছে এই দুইয়ের বৈরিতা, আর এটাই হল সেই চালিকাশক্তি যা ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে চলে।
তবু সর্বহারা সংগ্রাম ধাক্কার মুখে পড়েছে। পৃথিবীর এক বিরাট অংশে সমাজতন্ত্র পিছু হটেছে। সুতরাং নিছক মার্কসবাদের ওপর, সর্বহারার বিজয়ের ওপর আস্থা পুনর্ঘোষণা করাই যথেষ্ট নয়। মার্কসবাদকে আজ তুলে ধরা সম্ভব কেবল তাকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যমেই।
মার্কসের পুঁজি-র ভিত্তি ছিল ব্রিটিশ পুঁজিবাদের, সবচেয়ে আদর্শ পুঁজিবাদী বিকাশের অধ্যয়ন। কিন্তু সেই অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ শেষ হতে না হতেই অবাধ প্রতিযোগিতার জায়গায় একচেটিয়া কারবারগুলি আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। লগ্নি পুঁজি তথা একচেটিয়া পুঁজিবাদের পর্যায়ে দেশের ভিতরে প্রতিযোগিতার স্থান নেয় বিশ্ব বাজারের জন্য পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এইভাবে আত্মপ্রকাশ করে বিশ্বযুদ্ধগুলো, ঘটে সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল তার দুর্বলতম স্থানে ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনা। এবং পরবর্তীকালে, আমেরিকার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের একটি একক অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশ তথা দীর্ঘ ঠাণ্ডা লড়াইয়ে সমাজতন্ত্রের পরাজয় ও পতন।
একদিকে যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদী উৎপাদনের কাঠামোয় পরিবর্তন ঘটে চলেছে অন্যদিকে তখনই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রায় অচলাবস্থা বিশ্বজুড়ে মার্কসবাদী তাত্ত্বিকদের সামনে অধ্যয়ন ও গবেষণার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। কমিউনিস্টদের হাতে রয়েছে পঁচাত্তর বছরেরও বেশিদিন ধরে সমাজতন্ত্র গঠনের অভিজ্ঞতা। মানুষ তার ভুল থেকেই শিক্ষা নেয়। সুতরাং আমি যে অধ্যয়নের কথা বলেছি সেটিকে বস্তুত হতে হবে সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক অর্থনীতির এমন এক গভীর অধ্যয়ন যা মাত্রায় একমাত্র মার্কসবাদের পুঁজি-র সঙ্গেই তুলনীয়।
টীকা
(১) ৩১ মে, ১৯৯৩ পশ্চিমবাংলায় বর্ধমান জেলার এই গ্রামে সিপিআই(এম) থেকে আমাদের দিকে আসা ৬ জন পার্টি কমরেডকে – যারা সকলেই কৃষিশ্রমিক – সিপিআই(এম) গুণ্ডারা নৃশংসভাবে খুন করে। অন্ততপক্ষে ৩০ জন গুরুতরভাবে জখম হয় এবং সমগ্র গরিব পাড়াটিকে ভস্মীভূত করে দেওয়া হয়।