(ডিসেম্বর ১৯৯২, পঞ্চম পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত)
১। সিপিআই(এমএল) ১৯১৭ সালের কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে পরিচালিত মহান অক্টোবর বিপ্লবের পতাকাকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরছে। ঐ বিপ্লব শুধুমাত্র পৃথিবীর প্রথম সফল সর্বহারা বিপ্লবই ছিল না, তা এশিয়ায় এক নতুন চেতনার জন্ম দিয়েছিল। ৭৫ বছর পরে ঐ বিপ্লব আজ পরাজিত, কিন্তু তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য চিরদিন অম্লান থাকবে।
২। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র গঠনে এবং ফ্যাসিস্ত আগ্রাসনের কবল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে রক্ষা করতে কমরেড স্তালিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা সিপিআই(এমএল) অবশ্যই স্বীকার করে।
তবে স্তালিনের মধ্যে ভালোমাত্রায় অধিবিদ্যা ছিল এবং এটিই তাঁর দুঃখজনক ভুলগুলির মুখ্য উৎস হিসাবে কাজ করেছে। তাঁর সময়কালে আন্তঃপার্টি গণতন্ত্র এবং সমাজের অভ্যন্তরে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রেরও গুরুতর বিকৃতি ঘটেছিল।
৩। ষাটের দশকের প্রথমদিকে “মহাবিতর্ক” চলাকালীন মাও জে দং ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টি আধুনিক সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন, সিপিআই(এমএল) তার পক্ষে দাঁড়ায়।
সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণী সংগ্রামের অস্তিত্ব ও কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে তার প্রতিফলন, পুঁজিবাদের প্রত্যাবর্তনের বিপদ এবং সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যে এখনও অমীমাংসিত চরিত্রের সংগ্রাম সম্পর্কে কমরেড মাও-এর বক্তব্যগুলি ইতিহাসের নিরীখে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এইভাবে মাও-এর চিন্তাধারা স্তালিনীয় অধিবিদ্যা এবং ক্রুশ্চেভীয় সংশোধনবাদের নেতিকরণের মধ্য দিয়ে বিকাশলাভ করে এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনে।
মাও-এর সংগ্রাম ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করে। আধুনিক সংশোধনবাদের যাবতীয় ভারতীয় সংস্করণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আমাদের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির উদ্ভবে মাও-এর চিন্তাধারার প্রভূত অবদান রয়েছে।
৪। সমাজতন্ত্রের নতুন প্রাণ সঞ্চারের জন্য ব্রেজনেভ-উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে অতি বৃহৎ শক্তির অবস্থানের আমূল পরিবর্তন, অনমনীয় অর্থনৈতিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস এবং সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলির পুনর্নিমাণ একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। তাই গর্বাচভ যখন ‘পেরেস্ত্রৈকা’ ও ‘গ্লাসনস্ত’-এর প্রয়োগে নামেন তখন বিশ্বের কমিউনিস্টরা, প্রগতিশীল শক্তিগুলি ও গণতান্ত্রিক মানুষ তাঁকে ব্যাপক সমর্থন জানান। কিন্তু ক্রমশ বোঝা যায় যে উদারনৈতিক বুর্জোয়া মতাদর্শ ও পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই গর্বাচভ কাজ করছেন। সিপিআই(এমএল) তাই দলত্যাগী হিসাবে গর্বাচভকে ধিক্কার জানাচ্ছে।
৫) সিপিআই(এমএল) যে কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র ও অতিবৃহৎ পার্টির ধারণার তীব্র বিরোধী। আন্তর্জাতিক বিষয়গুলিতে নিজস্ব উপলব্ধির ভিত্তিতে এক স্বাধীন নীতির অনুসরণে সে বিশ্বাসী। ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক ও উন্নত করার জন্য চীনা প্রয়াসকে আমরা যেমন স্বাগত জানাই, তেমনই আবার উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ে চীনা বিদেশনীতি সমালোচনা না করে আমরা পারি না।
৬) ভারতের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে একটি বহুদলীয় ব্যবস্থা সমন্বিত সর্বহারা রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে সিপিআই(এমএল) নাকচ করে দেয় না। একমাত্র অনুশীলনের প্রক্রিয়াতেই ঐ রাষ্ট্রের চরিত্র ও রূপ নির্ধারিত হতে পারে।
৭) বিশ্ব-বুর্জোয়াদের সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে মার্কসবাদের সপক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানো, মার্কসবাদের বিপ্লবী অন্তর্বস্তুকে পুনরুদ্ধার করা ও ভারতীয় বিপ্লব সম্পন্ন করার প্রক্রিয়ায় তাকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলাকে সিপিআই(এমএল) তার অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে মনে করে।